• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬১ | ডিসেম্বর ২০১৫ | গল্প
    Share
  • ফেলাইন পার্টি : সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়


    ইচ আরের শমিতা আঁটোসাঁটো চামড়ার পোষাকে ক্যাট ওয়াক করতে করতে পার্টিতে এন্ট্রি নিল। আমরা যে যার নিজ নিজ ক্যাট মাস্কের কুতকুতে চোখের মধ্যে দিয়ে তার বিড়াল গতি দেখতে দেখতে হাততালি দিয়ে তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানালাম। (রসাল মরাল গতির মত বিড়াল গতিও মনুষ্য গতির একটি বিশেষ প্রকার। যারা জানে না তাদের অসীম দুর্গতি।) হাততালির তুমুল শব্দে দুটি একটি উটকো দীর্ঘশ্বাস, অস্ফূট স্বগতোক্তি বেমালুম চাপা পড়ে গেল। আরব সমুদ্রের ধারে ছাবারিয়া সাহেবের প্রাসাদোপম বাংলো। সামনে পাঁচিল ঘেরা প্রশস্ত সবুজ ঘাসের লন। বাইরের সিকিউরিটি গেট থেকে বাংলোর সিঁড়ি পর্যন্ত একফালি লাল কার্পেট বিছানো। আমাদের সমবেত দৃষ্টি শমিতার কোমরের সিঁড়ি দিয়ে পিছলে নেমে উন্মুক্ত নাভির ঘূর্ণিতে তলিয়ে যাচ্ছিল। শমিতার অবশ্য ভ্রূক্ষেপ ছিল না। সে সর্বদাই আমাদের তুচ্ছাতিতুচ্ছ পোকামাকড় জ্ঞান করে। মাঝখান থেকে শমিতার গতিপথের সঙ্গে ভারসাম্য রাখতে গিয়ে পাশে বসা দুলালের সঙ্গে আমার মাথা ঠুকে গেল। দুলালটা চিরকালই তালকাটা। ডান বাঁ জ্ঞান কম। কাছেই মিসেস ছাবারিয়া মিস্টার ছাবারিয়ার বুকের কাছে ছেনাল বিড়ালের মত গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি মিস্টার ছাবারিয়ার দৃষ্টিপথের দিকে কড়া নজর রাখছিলেন। মিয়াঁর কাঁকালে কনুইয়ের গুঁতো মেরে ছদ্ম শাসন করে বললেন, “মিয়াঁ-ও!”

    কোম্পানিটা আক্ষরিক অর্থেই আমাদের বড়কত্তা ছাবারিয়া সাহেবের বাপের সম্পত্তি, মানে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত। বুড়োবাবার মৃত্যুর পর তিনিই আমাদের হর্তা-কর্তা-বিধাতা। শুক্কুর বার দিন বিকেল বিকেল ছাবারিয়া সাহেবের বুড়ি সেক্রেটারি মিস মরিয়মের একখানা ইমেল আমাদের ইন বক্সে জমা পড়েছিল—সাহেব বৌয়ের জন্মদিনে ফেলাইন থিম-পার্টি রেখেছেন। শনিবার দিন সন্ধ্যেবেলা তাঁর বাসায় আমাদের সবাইকে বিড়াল সেজে যেতে হবে। শোনা যায় মিস মরিয়ম মিসেস ছাবারিয়ার ব্যক্তিগত সুপারিশে নিযুক্ত হয়েছিলেন। মিস্টার ছাবারিয়ার পূর্বতন রংরঙ্গিলা ছলছবিলা প্রাইভেট সেক্রেটারি মিস পিঙ্কিকে দেখার সৌভাগ্য আমদের হয় নি। আমরা শুধু তার বরখাস্ত হবার গল্প শুনেছি। যাক গে কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। অন্যথায় হাতে মাথা কাটা। উপরন্তু বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেল সাহেবের ব্যক্তিগত চামচা – এইচ আর ডাইরেক্টর চালিয়াৎ চাড্ডা পার্টিতে অ্যাটেন্ডেন্স রেজিস্টারও নিয়ে যাবে। অগত্যা শনির সন্ধ্যে হতে না হতেই আমরা গোঁফ চুমরিয়ে হাজির। যাদের গোঁফ নেই তারা নিজের বা অন্যের বৌয়ের কাজল পেন্সিল ধার করে ঠোঁটের ওপর গোঁফের রেখা এঁকে এসেছে। মাঝে মাঝে তাতেই তা দিচ্ছে। মাস্কে চোখ ঢাকা আছে বলে গোঁফ দিয়েই লোক চিনে নিতে হচ্ছে। ঝোলা গোঁফ দেখে নিজের বস ভেবে সুব্বু বাজোরিয়া সাহেবকে চোখা চোখা গালাগালি করছিল। ভেবেছিল তাকে মাস্কের আড়ালে কেউ চিনতে পারবে না। বাজোরিয়া সাহেব সুব্বুকে ঠিক চিনে ফেললেন। খপ করে হাত ধরে টানতে টানতে তার আসল বসের কাছে নিয়ে গেলেন। সে এক অদ্ভুত উৎপাত।

    বেয়ারারা রঙ্গিন পানীয় ট্রেতে সাজিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের মাথার তাজে দুপাশে দুটো খাড়া খাড়া কান। নাকের ওপর কালো প্লাস্টিকের টোপলা। পানীয়র পিছনে পিছনে ঘুরছে মুরগীর নবাবি কাবাব, নধর চিংড়ির কোলিওড়া। নিরামিষাশীদের জন্যে ফুলকপির পকোড়া। সেগুলি সসেতে ভিজিয়ে আমরা সড়াৎ করে মুখে টেনে নিচ্ছি। তারপর চুকচুক করে মাল খাচ্ছি। দু একটি ভিজে নিরামিষাশী গৃহপালিত বিড়াল হাতের আড়াল করে কাবাব, চিংড়ি মেরে দিচ্ছে। জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটছে। সাহেব বাড়ির প্রসাদে দোষ নেই। তাছাড়া মাস্কের আড়ালে চিনছে কে?

    খোলা আকাশের নীচে পার্টি, লোকজন, হালকা ভিড়। লনটা বেশ বড়। আলোর বাহারি আয়োজন থাকলেও গাছপালা, ঝোপঝাড়, কোণাঘুপচি অন্ধকার অপর্যাপ্ত। খুঁজলে যুগল-নির্জনতা অনায়াস। মিসেস ছাবারিয়া ঘুরে ঘুরে বাকি অতিথিদের আপ্যায়ন করছেন। মিসেস ছাবারিয়ার মুখখানা গোল, চাঁদপানা। হাসলে শ্বদন্ত দেখা যায়। ভাল লাগে আবার ভয়ও লাগে। ঠোঁট দুখানি সর্বদাই অর্ধোন্মুক্ত। দেখলেই মনে হয় আদর খাবার জন্য আদেখলে হয়ে আছে। সন্ধ্যে ঘন হচ্ছে। সমুদ্র থেকে আমিষ গন্ধ আসছে। চারদিক বেশ একটু টলোমলো হয়ে পড়ছে। মুড বুঝে ডি জে উ-লা-লা, উ-লা-লা গান লাগিয়েছে। সাহেব বিবিরা ঘাসের ওপর দু পাক নেচে নিচ্ছে। ক সাহেবের রঙ্গিনী সঙ্গিনী নাচতে নাচতে গ সাহেবের বেহিসাবি অঙ্গে ঢলে পড়ছে। কেউ দেখেও তেমন গা করছে না। পাশে বৌ নেই দেখে সুযোগ বুঝে মিস্টার ছাবারিয়া শমিতার সঙ্গে ফাঁকতালে দুটো কথা বলে নিচ্ছেন। তিনি বোধ হয় কোন গূঢ রসিকতা করলেন। শমিতা ঘাড় ঝাঁকিয়ে হাসছে। তার চুল কপালের ওপর টান করে বাঁধা। মাথার পিছনে পনি টেল ফিঙ্গে পাখির মত তিড়িং তিড়িং করে নাচছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দুলাল হঠাৎ তার সঙ্গে নাচবার জন্য খ্যেপে উঠলো। এমনিতেই দু ঢোঁক গিলতে না গিলতে দুলাল বাড় খেয়ে যায়। তার ওপর এমন আলু-থালু পরিবেশ। আমরা দু তিন জন মিলে তাকে হাত ধরে টেনে রাখতে পারি না।

    ঘাসের লনের ওপর টেবিল পেতে খাওয়া দাওয়া। ডিনার শুরু হল স্যুপ দিয়ে। উর্দি পরা বেয়ারারা বোল ভরে টলটলে স্যুপ দিয়ে গেল। তবে চামচ নেই। বিড়ালের মত জিভ দিয়ে চেটে খেতে হবে। হাত লাগালে চলবে না। আমরা সবাই মুখ নামিয়ে, জিভ দুলিয়ে চকাস চকাস করে স্যুপ খেতে লাগলাম। অনভ্যাসের জন্য প্রোজেক্টের মালিনীর স্যুপের বাটি প্ল্যানিঙের মীরার কোলে পড়ে গেল। দু’জনের মধ্যে ফাটাফাটি ক্যাট ফাইট শুরু হয়ে গেল। মীরা মালিনীর গালে আঁচড়ে দিল। উত্তরে মালিনী মীরার চুল ধরে ঝাঁকিয়ে দিল। অন্যদিকে দুটি হুলো ঘাড়ের রোঁয়া ফুলিয়ে, থাবার নখ বার করে ফ্যাঁস করে উঠল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখি পাইপিংয়ের সন্তোষ আর সিভিলের সুধীরের মধ্যে হাতাহাতি লেগে গেছে কে টিস্যু পেপার দিয়ে মীরার কোল থেকে স্যুপ মুছে দেবে। এর মধ্যে শানা ভিকি কোথা থেকে খুঁজে পেতে একটা আফটার শেভ নিয়ে এসে হাজির, মালিনীর গালে লাগাবে বলে, যাতে সেপ্টিক না হয়ে যায়। মালিনী রাগ করে ভিকির হাত থেকে সেটা কেড়ে নিয়ে ফোঁস ফোঁস করে বার কতক সন্তোষ আর সুধীরের মুখে স্প্রে করে দিল। তারা রণে ভঙ্গ দিয়ে চোখ ধুতে চলে গেল।

    ফেলাইন পার্টি ধিকিধিকি আঁচে জ্বাল দেওয়া ক্ষীরের মতন জমে উঠছে। আমুদে মাতাল আর আহ্লাদী মেয়েদের মধ্যে বসে থাকতে থাকতে আমার মনটা একটু খুঁতখুঁত করছিল। আগের বারের পার্টিতে ছাবারিয়া সাহেবের ফুটফুটে বাচ্ছা ছেলে মেয়েদুটোকে দেখেছিলাম। তারা সবার সঙ্গে যেচে ভাব করেছিল। আঙ্কল আঙ্কল বলে কোলে চড়ে বসছিল। এবার তারা নজরে পড়ল না। খবর পেলাম সাহেব তাদের ঘেঁটি ধরে পঞ্চগনির রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে ছেড়ে এসেছেন। কথায় বলে বিড়ালকে সাত রাস্তা পার করে দিয়ে এলেও বাড়ি খুঁজে ফিরে আসে। কিন্তু ছেলে মেয়ে দুটির পক্ষে পাহাড় ডিঙ্গিয়ে, রাস্তা চিনে বাড়ি ফিরে আসার সম্ভাবনা কম। আর তাদের বিড়াল বোধও হয় তো বাপ মায়ের মতন তত উগ্র নয়। অবশ্য মিসেস ছাবারিয়ার কোলে ছেলেপুলের বদলে একটি নরম হুলো বিড়াল হলেই বেশ মানায়। তিনি মাঝে মাঝে তার পশমের মত লোমে হাত বোলাবেন, গলায় কাতুকুতু দিয়ে দেবেন। সে কোলের নরম উষ্ণতার মধ্যে আয়েশ করবে। আরামে তার চোখ বুজে আসবে। তেমন তেমন নারীর কোলে বিড়াল হবার সুখই আলাদা।

    হঠাৎ নজর গেল লনের একদিকে একটা তারের খাঁচা রাখা। বেশ বড়সড়। মধ্যে একটি মিশমিশে কালো কেঁদো বিড়াল। বিড়ালটা নিরুপায় বন্দি দশায় ছটফট করছে। খাঁচার সংকীর্ণতার মধ্যেই অসহিষ্ণু হয়ে গোল পাকিয়ে ঘুরছে। লম্বা টুপি, ঝোলা কোট পরা একটা লোক এসে কালো চাদর দিয়ে খাঁচাটিকে ঢেকে দিল। বুঝলাম ম্যাজিক শোয়েরও বন্দোবস্ত আছে। ছাবারিয়া সাহেব মনোরঞ্জনে ত্রুটি রাখেন নি। ম্যাজিশিয়ান ভদ্রলোকের গড়ন পেটন, চালচলন কেমন চেনা চেনা লাগছে। অনেকটা আমাদের লম্পট চাড্ডার মতন। অফিসের ভাল মেয়েরা চালিয়াৎ চালু চাড্ডাকে এড়িয়ে চলে। মন্দ মেয়েদের পট পট প্রোমোশন হয়ে যায়। বড়কত্তার ব্যক্তিগত চামচা বলে কথা। চাড্ডা ম্যাজিকও জানে? সত্যিই তো, এমন সর্বগুণান্বিত না হলে কি এইচ আর ডাইরেক্টর হওয়া যায়? আর কী কী জানে কে জানে?

    চাড্ডা বা চাড্ডার মতন দেখতে সেই ম্যাজিশিয়ান এসে এক ঝটকায় চাদর সরিয়ে নিল। হা হতোস্মি! তারের খাঁচা শুনশান ফাঁকা। কিছুক্ষণ আগেও যেখানে একটা জলজ্যান্ত বিড়াল গাল ফুলিয়ে খ্যাচোর ম্যাচোর করছিল সেখান দিয়ে আরব সাগরের অস্তিত্বহীন লোনা হাওয়া বইছে। আমরা গলায় স্যুপ বেঁধে হিঁক করে হিক্কা তুলে হাততালি দিলাম। সবচেয়ে বেশি হাততালি দিলেন মিসেস ছাবারিয়া। তাঁর চোখ মুখ দেখে বেশ বোঝা গেল বিড়ালঘটিত বিনোদনটি তাঁর যথেষ্ট চিত্তাকর্ষণ করেছে।

    ম্যাজিশিয়ানটি আবার খাঁচার ওপর অন্ধকার রাত্রির মতন কালো চাদরটা ঢাকা দিয়ে দিল। খাঁচা এবং খাঁচার অন্তর্বর্তী রাশিকৃত হাওয়া চাদরের তলায় চাপা পড়ে গেল। আমরা খাওয়া ভুলে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছি। চাদরটা কী মৃদু নড়ে উঠল? নাকি হাওয়ার ঝোঁকা? চাড্ডা বা চাড্ডার মতন লোকটা খাঁচার দিকে তাকিয়ে যাদুকর ম্যানড্রেকের স্টাইলে আঙ্গুল নাড়ছে। মিসেস ছাবারিয়া খাঁচার কাছাকাছি একটা চেয়ার টেনে বসে পড়েছেন। উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে রয়েছেন। তাঁর পাশে এখন মিস্টার ছাবারিয়া নেই। তার বদলে লোথারের মতন দেখতে একটা হাট্টাকাট্টা নেড়া মাথা সিকিউরিটি গার্ড।

    ম্যাজেসিয়ান লোকটা টুপি খুলে টাক চুলকোল। নির্ঘাত চাড্ডা। অমন ছ্যাতলা পড়া মসৃণ টাক সচরাচর চোখে পড়ে না। তারপর টুপিটা যথাস্থানে রেখে একটানে চাদরটা উড়িয়ে দিল। আরে, আবার সেই কালো বিড়ালটা এসে উপস্থিত হয়েছে! খাঁচার মধ্যে বসে ভণ্ড সাধুর মতন চোখ পিটপিট করে চাইছে। মিসেস ছাবারিয়া উত্তেজনায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। আমরাও হতবাক। আবার একপ্রস্থ হাততালি। চাড্ডা মাথা নুইয়ে প্রশংশা নিল। দু একজন অত্যুৎসাহী এগিয়ে গিয়ে খাঁচার শিক টেনে দেখল। মিসেস ছাবারিয়ার চোখ চকচক করছে। তিনি উঠে গিয়ে চাড্ডাকে কিছু বললেন। মনে হল আরো একবার এই-বিড়াল-আছে-এই-বিড়াল-নেই খেলাটা দেখাতে রিকোয়েস্ট করলেন। চাড্ডা বিনীত ভাবে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।

    চাড্ডার কারসাজিতে যথারীতি আবার চাদর ঢাকা খাঁচা থেকে বিড়ালটা অদৃশ্য হয়ে গেল। খাঁচার শিকের মধ্যে দিয়ে বাকায়দা পিছনের গাছপালা, উঁচু পাঁচিল, রাস্তার হ্যালোজেন আলো দেখা যাচ্ছে। কেবল বিড়ালটাই পঞ্চভূতে মিশে গেছে। চাড্ডা মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই অবশ্য তাকে ফিরিয়ে আনল। আর বিপত্তিটা ঘটল ঠিক তখনই। বিড়ালটা বোধহয় বারবার নিরালম্ব শূন্যে মিলিয়ে যেতে যেতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। এবার থাবা দিয়ে হাঁচোড়পাচোড় করে খাঁচার দরজাটা খুলে বাইরে এসে লাফ দিয়ে পালাল। সবাই খাওয়া দাওয়া ছেড়ে ধর ধর করতে করতে দৌড়োল। সে ততক্ষণে পাঁচিল টপকে পগার পার। আমরা সবাই গালে হাত দিয়ে বসে রইলাম। সব থেকে হতাশ হলেন মিসেস ছাবারিয়া। তিনি ফিরে এসে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন। চাড্ডা বেশ আতান্তরে পড়ে গেছে। মিসেস ছাবারিয়ার মুখে মেঘ ঘনাচ্ছে। দেখে আমরাও চিন্তিত হয়ে পড়লাম। জমজমাট পার্টিটা শেষ পর্যন্ত না ভেস্তে যায়। কী দরকার ছিল চাড্ডার আগবাড়িয়ে বিড়ালবাজী করার?

    উপায় বাৎলালেন মিসেস ছাবারিয়া স্বয়ং। তিনি চাড্ডাকে জিজ্ঞেস করলেন, “চাড্ডাজী, তোমার কালি বিল্লি তো ফর্সা হয়ে গেল, এখন কী করবে? আর কী কী হাপিশ করতে পারো?”

    চাড্ডা বল্ল, “ম্যাডাম, এনি থিং এন্ড এভরি থিং, বিশেষ করে আপনার জন্যে।”

    মিসেস ছাবারিয়া ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসলেন, “সব কিছু?” তারপর নিজের বুকে বুড়ো আঙ্গুল ঠেকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আমাকে হাপিশ করতে পারবে?”

    চাড্ডাও ঘাঘু মাল, মুচকি হেসে বল্ল, “চেষ্টা করে দেখতে পারি।”

    মিসেস ছাবারিয়া এগিয়ে গেলেন। লোথার হাঁ হাঁ করে বাধা দিতে গেল, “নেহি নেহি ম্যাডাম। আপ বাপিস নেহি আয়ে তো মেরি নোকরি চলি যায়েগি।”

    কে শোনে কার কথা? ম্যাডাম গটগট করে হেঁটে এগিয়ে গেলেন। চাড্ডা দরজা খোলা খাঁচাটার সামনে তৈরি হয়েই দাঁড়িয়ে ছিল। মিসেস ছাবারিয়া কাছাকাছি যেতেই কালো চাদরটা দিয়ে তাঁকে মাথার টিকলি থেকে পায়ের হাই হিল জুতো পর্যন্ত ঢেকে দিল। তারপর হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তার কেরামতি দেখাতে আরম্ভ করল। আমরা সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে ভাবছি এ আবার কী অসৈরণ? মিসেস ছাবারিয়া মাথায় চাদর ঢেকে দাঁড়িয়ে আছেন। চাড্ডা হাত ঘুরিয়ে যাচ্ছে। কী নাড়ু পাবে কে জানে? সত্যিই কি মিসেস ছাবারিয়া কালো বিড়ালটার মতন হাওয়া হয়ে যাবেন? মিস্টার ছাবারিয়া কোথায়? মিনিট দুই তিন নৃত্য নাট্য চলার পর চাড্ডা বোধহয় মিসেস ছাবারিয়ার ঠিক কত শতাংশ অদৃশ্য হয়েছে সেটা চাদরের একটা কোণা তুলে দেখতে গেল। তখনই ঘটে গেল সেই সাংঘাতিক কাণ্ডটা। চাদরের নীচে থেকে একটা চুড়ি পরা পেলব হাত বেরিয়ে এসে চাড্ডাকে টেনে নিল। আর চাদরটা খুস করে খসে পড়ে গেল মাটিতে।

    ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা এতটাই হতবাক হয়ে গেলাম যে হাততালি দিতে ভুলে গেলাম। সিকিউরিটি গার্ডটা হায় হায় করে ছুটে গিয়ে ঘাসের ওপর থেকে চাদরটা তুলে ধরল। আতঙ্কে তার বোধবুদ্ধি লোপ হয়ে গেছে। চাদরটার একটা কোণ একটু ছেঁড়া। সেটাকে সে দু একবার ঝেড়ে ঝুড়েও দেখল। সব ভোঁ ভাঁ। শুধু ঘাসের ওপর পড়ে থাকা কয়েকটা শুকনো পাতা উড়ে গেল। চারিদিকে মারাত্মক হুলুস্থূল বেঁধে গেল। লোথারের চিৎকারে বাকি সিকিউরিটি গার্ডেরা ছুটে এল। তারপর তারা সমস্বরে গলা মিলিয়ে হায় হায় করতে লাগল।

    চিৎকার চেঁচামেচি শুনে মিস্টার ছাবারিয়া এসে উপস্থিত হলেন। এতক্ষণ তিনি কোন জাহান্নমে ছিলেন কে জানে? তাঁর মাথার চুল উস্কখুস্ক। শার্টের গলার বোতাম খোলা, টাইয়ের নট আলগা, বুকের বোতাম ওপর নীচে, জামার একটা কোণ ট্রাউসার থেকে বেরিয়ে রয়েছে। মনে হল তাড়াহুড়োয় কোন মতে পোষাক পরে বেরিয়েছেন। তিনি হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে?”

    আমরা সবাই একযোগে বললাম, “ম্যাডাম গায়েব হো গয়ি।”

    তিনি সব শুনে টুনে একটা চেয়ারের ওপর ধ্বসে পড়লেন। ক্লান্ত গলায় বললেন, “ঢুঁড়ো উনহে।”

    শমিতাকে এতক্ষণ ধারে কাছে কোথাও দেখা যায় নি। এখন দেখি সে হঠাৎ কোত্থেকে উদয় হয়ে মিস্টার ছাবারিয়াকে ধরে ধরে বাংলোর ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি যথার্থই খুব ভেঙ্গে পড়েছেন। শমিতার কাঁধে ভর দিয়ে কোনমতে হেঁটে যাচ্ছেন। শমিতার ঘাড়ের ওপর পড়ে থাকা খোলা চুল তাঁর হাত লেগে টহস নহস হয়ে যাচ্ছে। আমরা সবাই ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে মিসেস ছাবারিয়াকে খুঁজতে লাগলাম। খাওয়া দাওয়া মাথায় উঠল। ঝোপ ঝাড়ের আড়ালে, ঝুপসি অন্ধকারে জোরালো টর্চের আলো ফেলে ম্যাডামকে খুঁজছি। চাড্ডাকে না পাওয়া গেলেও ক্ষতি নেই। একটা দল গেল বাংলোর পিছন দিকটায়। একটা বাংলোর ভেতরে।

    আধ ঘণ্টা তন্ন তন্ন করে খোঁজাখুঁজি করার পর আমরা যখন নিরাশ হয়ে বসে পড়েছি তখন দেখা গেল মিসেস ছাবারিয়াকে। বাংলো থেকে বেরিয়ে আস্তে আস্তে আমাদের দিকে হেঁটে আসছেন। তাঁকে দেখে খুব একটা বিচলিত লাগল না। মনে হল না মারাত্মক কিছু অঘটন ঘটে গেছে। বরঞ্চ চোখে মুখে একটা তূষ্ণী ভাব। আমরা হর্ষধ্বণি করে তাঁকে ঘিরে ধরলাম। তিনি চুলে একবার হাত চালিয়ে উড়ো চুল সামলে নিয়ে স্বাভাবিক গলায় আমাদের বললেন, “একী আপনারা খাওয়া দাওয়া ছেড়ে উঠে পড়েছেন কেন?”

    আমাদের অনুসন্ধানী দৃষ্টির সামনে পড়ে একটু যেন লজ্জা পেলেন। বললেন, “একটা সামান্য ঘটনায় আপনারা ব্যস্ত হয়েছেন।” তারপর আমাদের আশ্বস্ত করে বললেন, “সব ঠিক আছে। আপনারা খেতে আসুন।”

    ম্যাডামের কথা অমান্য করা আর নিজের পা কুড়ুলে স্থাপন করা একই ব্যাপার। আমরা আবার ডিনার টেবিলে ফিরে এলাম। সাহস করে চালু চাড্ডার কথা কেউ জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। তাকে উদ্ধার করা হল আরও মিনিট পনের পরে। বাংলোর ভেতর থেকে। যে সার্চ পার্টি তাকে উদ্ধার করেছিল তারা রিপোর্ট দিল তাকে বাংলোর অ্যাটিকে বিস্রস্ত বেশবাসে প্রায় সংজ্ঞালুপ্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে। তার হাত পিছমোড়া করে বাঁধা ছিল। আর চোখে কালো কাপড়ের ফেট্টি। মিলিয়ে দেখা গেল চোখের ফেট্টিটা যাদুটোনার কালো চাদরটা থেকে ছিঁড়ে নেওয়া। তাকে যখন ধরে ধরে নীচে নামানো হল দেখলাম তার জামার সবগুলো বোতাম ছেঁড়া। হাতে পিঠে ছড়ে যাওয়ার দাগ। বিড়াল আঁচড়ে দিলে যেমন হয়। বুকের ওপর লাল লাল দাগড়া দাগড়া ছোপ। দুলাল বলল, “আমবাত বেরিয়েছে।” যাইহোক চাড্ডাকে ট্যাক্সি ডেকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হল।

    খাওয়া দাওয়া সারতে সারতে বেশ রাত হল। মাটন রোগন জুসের নলীর হাড় থেকে নরম মাংস চুষে খেতে খেতে দেরি হয়ে গেল। তবে অনেক জল্পনা কল্পনা করেও আমরা ফেলাইন রহস্যের সমাধান করতে পারলাম না। অবশ্য চাড্ডার হেনস্থায় অনেকেই বেশ খুশি হয়েছে দেখা গেল। বিশেষ করে অফিসের ভাল মেয়েরা। অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল বলে মালিনীকে ওর বাড়িতে ড্রপ করে দিলাম। স্টিয়ারিঙে হাত রেখেও মাথায় পার্টির কথা ঘুরছিল। মালিনীকে বললাম, “কী হল বল তো?”

    মালিনী ঝেঁঝেঁ বলল, “বোঝে না যেন, ন্যাকা।”

    ঘাড় ফিরিয়ে তাকালাম। মালিনী সামনে তাকিয়ে। এখনও বেশ রেগে আছে মেয়েটা। ফর্সা গালের ওপর নখ লেগে কাটা জায়গাটায় লাল ক্রিসান্থিমামের মতন দু একটা রক্ত বিন্দু ফুটে আছে। দেখেশুনে আমার আরও গুলিয়ে গেল। পরের দিন অফিস যেতে না যেতেই খবর পেলাম বড়কত্তা চাড্ডাকে বরখাস্ত করেছেন। তার জায়গায় নতুন এইচ আর ডাইরেক্টর নিযুক্ত হয়েছে শমিতা। পুরো ব্যাপারটা এখনও আমার কাছে ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে আছে। মনে হচ্ছিল মালিনী ধরতে পেরেছে। ওকে ফোন করে কফি খেতে ডাকলাম। গত কালকের ঘটনাটা আমায় পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেবার জন্য রিকোয়েস্ট করলাম। মালিনী রাজি হয়ে গেল। আজ সন্ধ্যায় ইন অরবিট মলের কফি শপে আসবে মালিনী। কী বোঝাবে সেই জানে।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments