এদিকে কালাসান্দা গ্রামের লোকেরা সংবাদ পেয়ে বিস্ময়ে হতবাক, সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসেছে পায়াসের বাড়ি, বাহবা জানিয়েছে তাকে, কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই কলহপরায়ণ আত্মীয়দের জ্বালায় আর কনুইয়ের ধাক্কা খেয়ে অতিষ্ঠ হয়ে পালিয়েছে। পালায়নি কেবল পায়াসের প্রাণের বন্ধু সালঙ্গোঁ, তার কাজ স্থানীয় রাজা সাসাবালাঙ্গিঁরার সমাধিক্ষেত্রটির দেখাশোনা করা। চোখে সে প্রায় অন্ধ, শক্তপোক্ত এক লাঠি হাতে নিয়ে সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে। বুড়োকে প্রায় একবছর কেউ কবরখানায় তাঁর কুঁড়ের থেকে বেরুতে দেখেনি। কিন্তু এতদিনে সাসাবালাঙ্গিরার অন্তিম শয়নের স্থানটিকে সংস্কার করে তাঁর পূর্বগৌরবে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হলেও হতে পারে, এই আশায় ভর করে সে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে এবং অতিকষ্টে দীর্ঘ পথ হেঁটেছে।
যদি খবরের কাগজের লোকজন ছবি তোলে, এই আশায় নানতোন্দা নামে এক প্রতিবেশী মহিলা সকাল থেকেই ঘুরঘুর করছিল পায়াসের ঘরে। সতর্ক চোখ রেখেছিল সে আলোকচিত্রীর দিকে আর ক্যামেরা ক্লিক করার ঠিক আগের মুহূর্তে সে হড়কে এসে দাঁড়িয়ে যায় পায়াসের ঠিক কাঁধের পাশে। ফলে পরেরদিন উগান্ডার প্রতিটি সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় “মিঃ পায়াস এন্দাউলা এবং তাঁর সহধর্মিণী”র ছবি! পায়াস তো কাণ্ড দেখে রেগে আগুন এবং পুলিসে খবর দেবার আর কোর্ট কাছারি করার হুমকি দিতে থাকে। কিন্তু নানতোন্দা মহানন্দে গ্রামের ঘরে ঘরে বেড়াতে যায় আর সগর্বে সংবাদপত্রের ছবি দেখায়।
“বলুন, মি: এন্দাউলা, বাজি জেতার টাকায় আপনি কি করতে চান ... ?"
“বলুন, মি: এন্দাউলা, মাসে কতবার আপনি ফুটবলের বাজি ধরতেন ... ?”
“বলুন ... বলুন ... বলুন প্লিজ ... "
প্রশ্নের বোমাবর্ষণে মাথা ঘুরতে থাকে পায়াসের, উল্টে পড়ে যাবার উপক্রম আর পাশে-বসা সালঙ্গো ক্রমাগত খোঁচা দিয়ে যায় তাকে আর বিড় বিড় করে বলে, ‘মুখ খুলবি না একেবারে!” তাতে পায়াস ভড়কে যায় আরো। জীবন দুর্বিষহ করে তোলে উঠোনভরা আত্মীয়স্বজন; সবাই কথা বলতে চায় তার সঙ্গে, জানতে চায় তার স্বাস্থ্যের খবর; নাকের কাছে এগিয়ে দেয় ছোট শিশুদের--সব মিলিয়ে তার অবস্থা কাহিল; বন্ধুর সঙ্গে দুটো সুখ-দু:খের গল্প তো দূরের কথা, শান্তিতে নি:শ্বাস ফেলারই উপায় নেই।
যার জীবনের পঁয়ষট্টি বছর কেটেছে একা একা, কেউ তাকে পাত্তাও দেয়নি, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সেই যদি সমাজের সম্মানিত, প্রসিদ্ধ মানুষ হয়ে দাঁড়ায়, তার পক্ষে মাথার ঠিক রাখা মুশকিল; পায়াসের হয়েছে ঠিক তাই।
তার কুঁড়েঘরে তো হেঁশেল বলতে কিছু নেই, ঘরের পিছনে একচিলতে উনুনে হাঁড়ির পর হাঁড়ি চায়ের জল ফুটছে; তার খুড়তুতো, পিসতুতো বোনেরা মিলে বাগানের গাছে যে-কটা কাঁচকলা ছিল সব নির্দয়ভাবে কেটে ফেলেছে কাস্তে দিয়ে--সেগুলো সেদ্ধ করে মাতোকে[১] রান্না হবে সকলের খোরাকির জন্যে। এক মাঝবয়েসি মহিলা নিজের পরিচয় দিয়েছে “সেরা দিদি” বলে; পায়াস পুজোপার্বণে খাবে বলে পাকা কলা আর বজরা মিশিয়ে যে দেশি মদ বানিয়ে রেখেছিল, সেরা দিদি ভাঁড়ারঘরে তার সন্ধান পেয়ে গেছে এবং হঠাৎ উপস্থিত সবাইকে পরিবেশন করতে শুরু করেছে। শুধু তাই নয়। সে ঘরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ঘুরে বেড়ায় আর সবাইকে ডেকে ডেকে মন্তব্য করে, “দ্যাখো তো, ঘরে একটা মেয়েছেলে না থাকলে সংসারের কি হাঁড়ির হাল হয়!” শুনে প্রমাদ গোনে পায়াস এবং সালঙ্গো যখন তার পাঁজরে জোর খোঁচা মেরে বলে, “দেখিস, ওই মহিলার থেকে সাবধান, ছিনে জোঁকের মতন সেঁটে বসে যেতে চায়, ওকে তাড়ানো মুশকিল হবে!”, তার আশংকা বেড়ে চলে বহুগুণ।
সবাই দেখতে আগ্রহী সেই টেলিগ্রাম, যাতে পায়াসের বিজয় সংবাদ এসেছে। আশে-পাশের পনেরো মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে ডাকঘর গোগোমবোলোলা, এই অঞ্চলের প্রতিটি মানুষের ঠিকানা--সেখানে টেলিগ্রামটি এসে পৌঁছায়। পোস্টমাস্টার মুসিসি সঙ্গে সঙ্গে হাতের সব কাজ ফেলে রওনা হয় পায়াসের গ্রামে আনন্দ-সংবাদটি পৌঁছে দিতে। এসব কাজে তার বিরক্তি নেই। পায়াসের অনুরোধে সে ফেরার পথে সালঙ্গোকে খবরটা দিয়ে আসে, তারপর আপিসে ফিরে বাজি ধরতার কোম্পানিকে প্রাপ্তিসংবাদ পাঠায়। জমজমাট আড্ডা ছেড়ে যেতে দু:খ হয় তার। খবর পেয়ে তৃপ্ত সুখী বৃদ্ধ আপন মনে স্বপ্ন দেখা শুরু করে--যদি কফির ছোট্ট খেতটিকে খানিকটা বাড়ানো যায়, সম্ভব হলে তার কুঁড়েঘরের একটা নতুন চাল, অথবা সম্পূর্ণ নতুন একটা ঘর--ইঁটের দেয়াল, সিমেন্টের মেঝে, সামনে একফালি বারান্দা। আর যদি খানকতক মুরগি পালন করা যায়! সালঙ্গো অনেকদিন ধরেই বলে আসছে মুরগির ব্যবসা করতে পারলে প্রচুর পয়সা। এখন আর সেই আগের দিন নেই--মেয়ে-মানুষেরা এখন ইচ্ছেমতো মুরগির মাংস আর ডিম খেতে লেগেছে, কেউ আর নিয়মকানুন মানে না। সালঙ্গো আর পায়াসের তাতে বিন্দুমাত্র সায় নেই। কমবয়েসিরা যাই বলুক, তারা নিজের মনে ভাল করেই জানে, মেয়েরা নিয়মিত মুরগির ডিম আর মাংস খেলে খুব শীগ্গিরই বাঁজা বনে যাবে, ছেলেপুলে হওয়া বন্ধ। নারীকল্যাণ অফিসার যে-ভদ্রমহিলা মাঝে মাঝেই গ্রামে আসেন, তিনি শুনলেই বলবেন, "এসব নির্জলা বাজে কথা; মুরগির মাংস আর ডিম খেলে মোটাসোটা, হাসি খুশি বাচ্চা জন্মাবে।” হ্যাঁ, তা অবশ্য ঠিক, এরকম কিছু উদাহরণও দেওয়া যায় কয়েকটি পরিবারের; কিন্তু সেইসব পরিবারে বাচ্চার সংখ্যা আঙুলে গোনা যায়। অতএব গ্রামের প্রাচীনদের ধারণাটা সত্যি! মাংস আর ডিম খাওয়া একটা দশ ছেলেমেয়ের মা দেখাও তো!
আফ্রিকায় সংবাদ ছড়ায় দ্রুতগতি--হয়তো বাজি ধরার আপিশের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে সংবাদপত্রের। কারণ টেলিগ্রামটা পায়াসের ঘরের চৌকাঠ ছোঁয়ার আগেই ছাপা হয়ে গেছে খবরের কাগজে। সেই খবর পড়েই আসতে শুরু করেছে লোকজন, পায়াস তখনো খবরটা শুনে পুরোপুরি ধাতস্থ হয়নি। নিজের স্বপ্নের জগতেই বাস করেছিল সে, ঠিক বুঝতেও পারছিল না এত মানুষজন কেন চারপাশে আর সবাই তাকে এতটা গুরুত্বই বা দিচ্ছে কেন? যাদেরকে বহু বছর দ্যাখে নি, মুখটাও চেনে না, নামটা পর্যন্ত মনে নেই, তারাই এখন তাকে দেখে আনন্দে আটখানা। “পায়াস-দাদা, অনেক বছর হয়ে গেল আমাদের বাড়ি আসা বন্ধ করেছো!” আর “পায়াস-কাকু, কী আনন্দই না হচ্ছে তোমায় দেখে!”
এত আত্মীয়স্বজন দেখে আর সকলের খাতির পেয়ে পায়াসেরও আনন্দের শেষ নেই। সে লোকজন ভালবাসে আর দেখেশুনে তো মনে হয় এরা সব তার খুব কাছের মানুষ। সে সবাইকে ডেকে বসায়, যতটা পারে সুখ-দু:খের কথা বলে। বিকেলের বাসে হাজির হল আরো একদল নারী পুরুষ--সবাই নাকি তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। কিন্তু দ্বিতীয় দলকে দেখে প্রথম দলের চোখমুখ হয়ে দাঁড়ায় রীতিমত গম্ভীর।
এদিকে বেলা যত গড়াচ্ছে, পায়াসের ঘরে অচেনা অজানা আগন্তুকের স্রোত ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। তার কফির ছোট খেতটিকে দেখলে মনে হবে এক রাজনৈতিক জনসভা--বাড়ির উঠোন থেকে সেদিকে তাকালে সাদা ফতুয়া, রঙিন কুর্তা, কালো টুপি, রঙিন পাগড়ির ভ্রাম্যমান ঢেউ আর ঘরের ভেতরে গায়ে গা ঠেকিয়ে মানুষ, দেশি মদের গন্ধ আর বিড়ির ধোঁয়া।
সবেধন নীলমণি, সাধের টেলিগ্রামটি এর হাত থেকে তার হাতে ফেরে। একবার দেখে কারুর সাধে মেটে না; আস্তে আস্তে দুমড়ে মুচড়ে দলা পাকিয়ে যায়, অস্পষ্ট হতে শুরু করে অক্ষরগুলি--তাতে অবশ্য খুব একটা অসুবিধে নেই সমবেত জনতার, তাদের মোটে দু তিন জনের ইংরেজি অক্ষর পরিচয় রয়েছে।
“মি: এন্দাউলা, আমরা তৈরি আপনার মনের কথা রেকর্ড করার জন্যে।” বললে চেক শার্ট-পরা এক রোগা যুবক, “আমি আপনাকে প্রশ্ন করব কয়েকটা এবং আপনি স্বাভাবিক গলায় তার জবাব দেবেন।” পায়াস ভয়ে ভয়ে তাকাল চামড়ার চকচকে বাক্স আর তার ঘুরন্ত স্পুল দুটোর দিকে, গলা শুকিয়ে এল তার, ঠোঁট চাটল জিভ দিয়ে। “একটা কথাও বলবি না।”-- হেঁড়ে গলায় সালঙ্গার ফিসফিস। যুবকটি বিবিসির ট্রেনিংপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সে গ্রাহ্যও করল না অশিক্ষিত বৃদ্ধের কথা, নিজের কাজ চালিয়ে গেল। “মি: এন্দাউলা, প্রোগ্রামের শুরুতেই শ্রোতাদের পক্ষ থেকে আপনাকে অভিনন্দন জানাই, ফুটবল খেলার বাজি জেতার জন্যে। আপনি বলুন, প্রচুর টাকা হাতে পেয়ে হঠাৎ ধনী হয়ে গিয়ে কেমন লাগছে আপনার?” কয়েক মুহূর্তের অস্বস্তিকর বিরতি, পায়াস সম্মোহিতের মতন চেয়ে রয়েছে ঘুরন্ত স্পুলের দিকে, মুখে বাক্যটি নেই; যুবকটি হন্তদন্ত হয়ে ফাঁক ভরানোর চেষ্টা করে, “ভবিষ্যতের জন্যে আপনার পরিকল্পনা কি?” শব্দ করে ঢোঁক গেলে পায়াস, কথা বলার জন্যে মুখ খোলে, কিন্তু সালঙ্গার “কিছু বলবি না!” গর্জন শুনে চুপ মেরে যায় আবার।
যুবকটি বিরক্ত হয়ে মাথা নাড়ে, সুইচ টিপে রেকর্ডার বন্ধ করে। “দেখুন দাদু, আপনাকে লম্বা কোন ভাষণ দিতে বলছি না, কেবল কয়েকটা কথা বলতে বলছি; যেভাবে বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন, সেইভাবে যন্ত্রের সামনে কথা বলুন। আমি আবার প্রশ্ন করছি, হঠাৎ অনেকটা টাকা পেয়ে কেমন লাগছে আপনার; আপনি বলতে পারেন, 'ভীষণ আশ্চর্য হয়ে গেছি, ভাবতেই পারিনি এমন হবে--খুব আনন্দে আছি এখন।' আর আপনার বন্ধুকে বলুন অন্যের কথাবার্তার মধ্যে বাগড়া না দিতে। বুঝতে পেরেছেন? আচ্ছা ঠিক আছে, শুরু করছি আবার!”
যন্ত্র চালু হল এবং যুবকটির মুখে হাসি ফুটল আবার--নতুন করে তার প্রশ্ন, “বলুন, মি: এন্দাউলা, ফুটবল খেলার বাজি জিতে এখন কেমন লাগছে আপনার?” পায়াস ঢোঁক গিলল এবং মন্ত্রমুগ্ধের মতন একটু বিরস গলায় হলেও বলে গেল, “ভীষণ আশ্চর্য হয়ে গেছি, ভাবতেই পারিনি এমন হবে--খুব আনন্দে আছি এখন। আর আপনার বন্ধুকে বলুন অন্যের কথাবার্তার মধ্যে বাগড়া না দিতে!” যুবকটি প্রায় কেঁদে ফেলে আর কী। রেডিওর জন্যে সাক্ষাতকার নেবার আজই তার প্রথম কাজের দায়িত্ব এবং ব্যাপার দেখে মনে হয় আজকেই শেষ। চাকরিতে ভবিষ্যতের কথা ভেবে মুষড়ে পড়ল সে, গম্ভীর মুখে বন্ধ করল রেকর্ডার। ঠিক সেই মুহূর্তে তার চোখ পড়ে সেরা দিদির দিকে। সুযোগ বুঝে সেরা দিদি ঝাঁপিয়ে পড়ে, “আমি কি কোনো কাজে আসতে পারি, সাহায্য করতে পারি আপনাকে?” তার মুখের হাসি আর ধরে না, “আমি মি: এন্দাউলার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়।” এমনভাবে কথাটা বলে সে যেন ঘর ভর্তি লোকের মধ্যে পায়াসের আর কোন আত্মীয় নেই, সেই একা। উজ্জ্বল হয় যুবকের মুখ, হালে পানি পায় সে। “ম্যাডাম, আপনি যদি আমায় সংক্ষেপে বলতে পারেন, মি: এন্দাউলার ভবিষ্যতের পরিকল্পনা কী, তা হলে আমার এবং রেডিও কোম্পানির খুব উপকার হয়।” সেরা দিদি বুঝতে পারে এই হল সুবর্ণ সুযোগ। বিশাল বক্ষদেশের ওপরে আড়াআড়িভাবে দুহাত রেখে সে গম্ভীর মুখে দাঁড়ায় এবং মেসিন চালু হলেই তার মুখে খই ফোটে। "হ্যাঁ, মি: এন্দাউলা প্রচুর অর্থ পেয়ে ভীষণ খুশি।" "না, এখন অব্দি নতুন কিছুর পরিকল্পনা করার সময় পাওয়া যায়নি--এখন আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আনন্দ করার পালা।" হ্যাঁ, মি: এন্দাউলা একেবারে একা থাকেন এই বাড়িতে, তবে তিনি যখন এসে পড়েছেন এখানে, খুব অসুবিধে হলেও তিনি এখানে থাকবেন এবং মি: এন্দাউলার দেখা শোনা ও সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করবেন, যতদিন প্রয়োজন। (এই সময় ঘরে উপস্থিত অন্য মহিলারা এ তার মুখের দিকে তাকায়, জিভ দিয়ে ক্লিক ক্লিক শব্দ করে আর অবিশ্বাসের দীর্ঘশ্বাস ফেলে।) হ্যাঁ, যতদূর জানা যায়, তিনিই বিবাহসূত্রে মি: এন্দাউলার নিকটতম আত্মীয়া।
তার সাহস আর আত্মবিশ্বাস দেখে পায়াস ঘাবড়ে যায় এবং উদ্বিগ্ন মুখে চারদিকে তাকায়; সালঙ্গো উত্তেজিত হয়ে খোঁচা মারে তার পাঁজরে, “দেখলি তো? বলেছিলাম কি না? এ ছিনে জোঁকের মতন সেঁটে বসে যেতে চায়।”
বিকেলে তিনটে বেজে গেলে আরেকবার জলখাবারের ব্যবস্থা করতে হয়--গরম গরম মাতোকে আর চা; সদ্য রান্না করা টাটকা মাতোকে নতুন কেটে আনা চওড়া কলার পাতায় পরিবেশন; কারণ পায়াসের ভাঁড়ারে প্লেট মোটে তিনটে; আর চা-- হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তাতেই--ভাঙা কাপ, মগ, পুরানো জার, টিনের ক্যান সবেতেই চা খাওয়া চলতে থাকে; কাপেরও অভাব ভীষণ। পায়াস খেল খুব অল্প, কিন্তু গরম চায়ের উষ্ণতায় সে খুশি। সকাল থেকে করমর্দন করতে হয়েছে কয়েকশো বার কম করে, তার হাতে টনটনে বেদনা; আর কথা বলার অভ্যেস নেই তার--লোকজনের অন্তহীন বকবকানিতে সে ক্লান্ত; আর প্রচুর অচেনা মানুষের আসা যাওয়াতে সে বিরক্ত। সবচেয়ে বেশি অবসাদের কারণ সেরা দিদি; সকাল থেকেই তার আতুপুতু আর আদিখ্যেতার শেষ নেই। সে অন্য কাউকে, বিশেষ করে অন্য কোনো বয়স্থা মহিলাকে পায়াসের কাছে ঘেঁষতে দিতে অনাগ্রহী; সে একাই যেন গিলে খাবে বৃদ্ধকে; যখন এক মহিলা তার মোটাসোটা হাবাগোবা শিশুটিকে পায়াসের কোলে বসায়, সেরা হাঁ হাঁ করে ছুটে আসে, টানতে টানতে সরিয়ে নিয়ে যায় বাচ্চাটিকে; যেন তার কোন সংক্রামক ব্যাধি হয়েছে। স্নেহময়ী মায়ের সঙ্গে সেরাদিদির বেশ কিছু চোখা চোখা বাক্য বিনিময় হয়েছে তার ঠিক পরেই, কিন্তু পায়াস ততক্ষণে আর থোড়াই কেয়ার করে।
সন্ধের ঠিক আগে দেখা করতে এল ইয়োসেফু মুকাসা আর কিবুকা, তখন দূরের কিছু আত্মীয়েরা বিদায় নিতে আরম্ভ করেছে, তবে রওনা হবার আগে সাড়ম্বরে ঘোষণা করেছে, সকালে উঠেই আবার আসবে। পায়াসের চোখেমুখে বিধ্বস্ত ভাব দেখে তারা দুজনেই রীতিমত আশংকিত। বৃদ্ধ মানুষটিকে দেখলে মনে হবে ক্লান্ত, অবসন্ন; মলিন এবং অসুস্থ তার ত্বক। সেরা দিদির সেখানে উপস্থিতি দেখে তারা থতমত খেল সবচেয়ে বেশি; সে যে কেবল তাদের দুজনকে জোর জবরদস্তি করা চা খাওয়াল তাই নয়; তার প্রতিটি হাবে ভাবে চলা ফেরায় কোন সন্দেহ নেই, সে নিজেকে ভাবে এই পরিবারের গৃহিণী। “আমার মনে হয়, আমার পরলোকগত স্বামী আপনার পরিচিত ছিলেন", সেরা ইয়োসেফুকে বলে, "তিনি বুয়াগা মৌজায় মিরুকা উপজাতির প্রধান মোড়ল ছিলেন। তাঁর নাম কিভূম্বি।” “ও, হ্যাঁ।” ইয়োসেফু উত্তর দেয়, “কিভূম্বিকে আমি খুব ভাল করে চিনি। আমরা কতবার একসঙ্গে শিকারে গিয়েছি। খুব ভালোমানুষ ছিলেন তিনি। খুব দু:খ পেলাম তাঁর মৃত্যুসংবাদে।” সেরা দিদির তাতে বিশেষ হেলদোল নেই। “হ্যাঁ, মানুষটা ভালো ছিলেন। কিন্তু ঈশ্বর যা দেন, তিনি আবার ফিরিয়েও নেন।” এরপর পরলোকগত কিভূম্বি পুরোপুরি বাদ পড়ে যান কথোপকথন থেকে।
এইসব কথাবার্তা পায়াসের মাথায় ঢুকলে একটা কথা পরিষ্কার হয় তার কাছে--এমনকী কিগান্ডার আত্মীয়তার মান অনুযায়ীও তার এবং সেরাদিদির মধ্যে কোন পারিবারিক সম্পর্ক, বলতে গেলে অনুপস্থিত। কারণ কিভূম্বি হল, যতদূর মনে পড়ে, তার এক লতায় পাতায় দূর সম্পর্কের ভাইএর সৎ ছেলে।
কিবুকা মন্তব্য করে, “তোমার হঠাৎ পাওয়া সৌভাগ্য দেখছি এখানে দুর্ভাগ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, পায়াস।” তাকে এবং ইয়োসেফুকে দুটো খরখরে কাঠের চেয়ারে বসতে দিয়ে সেরাদিদি তখন ভেতরে গিয়েছে।
সালঙ্গো রাগত চোখে তাদের এবং সাধারণভাবে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে গরগর করে ওঠে, “দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কী? সারা দিন কী না ধকল চলেছে মানুষটার! যতসব শেয়াল-কুকুরের দল এসে জুটেছে, তাকে চিবিয়ে খেয়ে হাড়গোড়টাও বাকি রাখবে কিনা সন্দেহ।” পায়াস তাকে থামায়, শিশুকে সংযত করার মতন সন্তর্পণে, “না, না, সালঙ্গো, ওরকম বলিস না; এমন আনন্দের সময়ে আত্মীয়স্বজন আর পরিবারের লোকজন ঘিরে থাকলে তো আপত্তি নেই। তবে সকাল থেকে এত উত্তেজনা আমার বুড়ো শরীরে আর সইছে না।”
সালঙ্গো শূন্যে থুতু ফেলে, দরজা দিয়ে বাইরে গিয়ে পড়ে; সেখানে কিছু আত্মীয়স্বজন মাদুর পেতে শোয়ার ব্যবস্থা করছে, অল্পের জন্যে মিস হয়, আর বলে; “নির্লজ্জ মেয়েমানুষটার তো খেয়াল নেই যে তারও বেলা গড়িয়েছে। পায়াসকে সে ফাঁদে ফেলবেই। এই ধরনের মেয়েমানুষ আমি অন্য জায়গায় অনেক দেখেছি।”
ইয়োসেফু তার সঙ্গে একমত, কিন্তু মনে মনে “অন্য জায়গায়” কথাটি শুনে সে না হেসে পারে না; কারণ সালঙ্গো কখনই তার গ্রামের বাইরে পা দেয়নি, তার সারা জীবন কেটেছে গ্রামের কবরখানায় সাসাবালাঙ্গিরার সমাধি পাহারা দিয়ে ও তার দেখাশোনা করে। মানুষটা কিন্তু খারাপ নয়, কথা বলে যা মনে হয়, সে আনমনে বলে। “কিন্তু দ্যাখো পায়াস, আমার একটা প্রস্তাব আছে, কোন অপরাধ নিও না, কিন্তু যদি তুমি এখন আমাদের সঙ্গে রওনা দাও এবং আজকের রাতটা মুতুন্দাতে আমাদের সঙ্গে থাক, তাহলে কেমন হয়? মিরিয়ামু তোমায় দেখলে ভীষণ খুশি হবে, আর তোমার চোখমুখ দেখলে মনে হয় রাতে একটা ভাল, গভীর ঘুমের প্রয়োজন তোমার। এখানে মনে হয় না তা সম্ভব হবে। ওই দ্যাখো তোমার আত্মীয়রা আগুন জ্বালিয়েছে মাঠে। সারা রাত বোধ হয় মদ খেয়ে আর নেচে গেয়েই কাটাবে।”
‘খুব ভাল বলেছেন, তাই হোক!” হঠাৎ আকাশ ফুঁড়ে সেরা দিদির আবির্ভাব, খালি চায়ের কাপ ফেরত নিয়ে যাবার অজুহাতে, “পায়াস দাদা, তুমি ঘুরে এস মি: মুকাসার সঙ্গে। নতুন জায়গায় গিয়ে মন ভাল হবে আর বিশ্রাম পেলে শরীরটাও চাঙ্গা হবে। আর ঘরের কথা ভেব না, আমি যখন রয়েছি সব সামলে নেব। সংসার দেখা আমার অভ্যেস আছে।” পায়াস ইতস্তত করে, “আমি যেখানেই আছি সেখানেই থাকব--আর মিছিমিছি মিরিয়ামুর কাজ বাড়ানোও ভাল কথা নয় ... ” সালঙ্গো বিড়বিড় করে, “আমি বলি কি, ইয়োসেফুর সঙ্গেই তুই যা, এখানে ওই মেয়েমানুষের সঙ্গে একই বাড়িতে থাকা তোর উচিত হবে না, বিশ্বাস নেই কী বলতে কী করে বসবি ... ” সেরা দিদি ফিরে আসে ঘরে। ঘোষণা করে, “আমি তোমার ব্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছি, পায়াস দাদা, তুমি যাও ঘুরে এস।” এবং কেউ কিছু বলে ওঠার আগেই আবার বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে, যেন তার কথার ওপরে কারুর কিছু বলার নেই; তবে যাবার আগে সালঙ্গোর দিকে এক নিমেষ তাকায়; যদি চোখের দৃষ্টি দিয়ে কাউকে ভস্ম করা সম্ভব হত, এখুনি ছাই হয়ে যেত সালঙ্গো।
অতএব কিছুক্ষণ পরে পায়াস ইয়োসেফুর গাড়ি চড়ে মুতুন্দা রওনা দিল, মনের আনন্দে কারণ আর কারুর কোন প্রশ্নের জবাব দিতে হবে না। পথে সালঙ্গো কেও নামিয়ে দেওয়া হবে কবরখানার কাছাকাছি বড় রাস্তায় - তার বলিরেখাময় মুখে অনেকদিন পরে হাসি ফুটেছে, কারণ পায়াসের প্রতিশ্রুতি - সাসাবালাঙ্গিরার সমাধির সংস্কার করতে সে অর্থসাহায্য করবে। সব মিলিয়ে দিনটা তার খারাপ কাটেনি, সেরা দিদির দুর্ব্যবহার সত্ত্বেও।
মুকাসা-পরিবারের গৃহে পায়াসের একটি মনোরম সন্ধে কাটল। চমৎকার, সুস্বাদু সান্ধ্যভোজনের পর এক গ্লাস করে ঠাণ্ডা বিয়ার হাতে নিয়ে তারা রেডিওতে স্থানীয়-সংবাদ শোনার জন্যে গুছিয়ে বসল।
পায়াসের মন তখন হাল্কা, সারাদিনের উদ্বেগ দূরে সরে গিয়েছে, সে কোনরকম গর্বের ভাব না দেখিয়েই মুকাসাদের বললে আজ সকালেই রেডিও উগান্ডা থেকে তার সাক্ষাতকার নিয়েছে। যখন রেডিওতে স্থানীয়-সংবাদের ঘোষণা হল, ঘরের মধ্যে সবাই উৎকর্ণ তার গলার স্বর শুনবে বলে, কিন্তু পায়াসের বদলে রেডিওতে ভেসে এল সেরা দিদির খ্যানখ্যানে কণ্ঠস্বর। সকালের টেপ রেকর্ডারের ঘটনা সম্পূর্ণ ভুলে মেরে দিয়েছিল পায়াস। এমন কী সেরা দিদির কথাও ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছিল মনের গহনে। সব হৈ হৈ করে ফিরে এল আবার আর সেই সঙ্গে আশংকার কাঁপুনি। সালঙ্গো খাঁটি কথাই বলেছে। ওই মহিলার হাত থেকে তার রেহাই নেই। সংশয়ে আর উদ্বেগে কিছুক্ষণ তার হাত পা ঠাণ্ডা। তারপর সে আবার স্বাভাবিক। সেরা দিদির চিন্তায় তার ঘুমের কোন ব্যাঘাত হল না। নিষ্পাপ শিশুর মতন সে ঘুমাল সে, পৃথিবীতে কোন চিন্তাই যেন তার নেই।
সকালে উঠে তাকে যত হাসিখুশি দেখাল, মিরিয়ামু তাকে আরো একদিন মুতুন্দায় রাখার জন্যে ব্যস্ত। “আমি জানি তোমায় কালকের থেকে চাঙ্গা লাগছে, কিন্তু আরেক দিন ছুটি কাটিয়ে যাও আমাদের সঙ্গে। কাল বাড়ি ফিরবে, তখন তো ব্যস্ততা আছেই, তবে সাময়িক উত্তেজনা হয়ত খানিকটা কমবে”--সে পায়াসকে বোঝায়।
সেদিন দুপুরে খেয়ে দেয়ে পায়াস বারান্দায় চেয়ারে বসে বসে দুলছে, এমন সময় তার ল্যান্ডরোভার গাড়িতে চড়ে মুসিসি এসে উপস্থিত, তার পাশে বসা সেরা দিদি। শশব্যস্ত হয়ে মিরিয়ামু বেরিয়ে আসে, স্বাগত জানায় তাদের--তারও কৌতূহলের শেষ নেই, কাল এই জাঁদরেল মহিলার কথা সাতকাহন শুনেছে। দুই মহিলা চোখের দৃষ্টিতে মেপে নেয় একে অন্যকে এবং আপাতত তারা বন্ধু।
গাড়ি থেকে নেমে মুসিসি এগোয় পায়াসের দিকে; “বোস, বোস” পায়াস চেয়ার এগিয়ে দেয়, “মিরিয়ামুর বাড়িতে খাওয়া দাওয়ার এমন এলাহি ব্যবস্থা, দিবানিদ্রা না দিয়ে উপায় নেই।” “আপনি যে সারাদিনের ঝামেলার পর ভাল বিশ্রাম পেয়েছেন, জেনে খুশি হলাম, দাদু।” মুসিসি তার জ্যাকেটের পকেট হাতড়ায়, “আরো একটা টেলিগ্রাম এসেছে আপনার নামে। আমি কি সেটা পড়ে শোনাব?” বৃদ্ধ মানুষটা আশান্বিত মুখে সোজা হয়ে বসে, “হ্যাঁ, হ্যাঁ নিশ্চয়ই, পড়।”
মুসিসি প্রথমে টেলিগ্রামটা খুলে চুপচাপ পড়ে, তারপর মুখ তুলে পায়াসের দিকে তাকায়, “দাদু, খবর কিন্তু ভাল নয়।”
“খবর ভাল নয়? কেউ কি মারা গেছে?”
মুসিসির ঠোঁটে হাসির ঝিলিক, “না, না, সেরকম খারাপ খবর কিছু নয়, তবে ওই বাজি ধরার কোম্পানি থেকে দ্বিতীয় একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়েছে, জানিয়েছে যে দুর্ভাগ্যবশত তাদের প্রথম টেলিগ্রামে একটা মারাত্মক ভুল ছিল। পুরস্কারের যে টাকার পরিমাণ তারা জানিয়েছেন সেটা আসলে তিনশো জন পুরস্কারবিজয়ীর মধ্যে সমান ভাগে ভাগ হবে।”
পায়াস বিস্ময়ে হতবাক, কথা সরে না তার মুখে। অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে সে মিনমিন করে বলে, “আমাকে একটু খোলসা করে বুঝিয়ে দাও তো এর মানে কী। শেষ পর্যন্ত আমি কত টাকা পাবো? আদৌ কিছু জুটবে তো?”
মুসিসি বলে, “মোট পুরস্কার ১৭০০০ পাউন্ড; সেটা তিনশো ভাগে ভাগ করলে দাঁড়াবে কিছু কম ৫৭ পাউন্ড, অর্থাৎ একহাজার শিলিঙের খুব একটা বেশি নয়।” (পুরানো হিশেবে ২০ শিলিঙ=১ পাউন্ড)
মুসিসি হতবাক হয়ে দেখে পায়াসের চোখেমুখে দু:খ বা হতাশার চিহ্নমাত্র নেই। সে নড়ে চড়ে বসে আর মুখ টিপে হাসে। “বা: বা:, এক হাজার শিলিঙের চেয়েও বেশি! সে তো অনেক টাকা!”
“না, অনেক টাকা নয়। কালকে তো আপনার অনেক বেশি টাকা পাওনা ছিল, তিনশো গুণ।”
“তা ঠিক। তোমার কথা মানতে হবে। কিন্তু কি জানো বাছা, আমি আমার এই বয়েসে অতো হাজার পাউন্ড নিয়ে করব টা কী? আমার বয়েস হয়েছে ভাই, আমার প্রয়োজন খুবই অল্প।”
ইতিমধ্যে মিরিয়ামু একটা মাদুর এনে পেতেছে বারান্দায় এবং সে আর সেরা দিদি আরাম করে বসেছে তাতে। “কী সর্বনাশ! খুব দু:খের কথা!” চেঁচিয়ে ওঠে মিরিয়ামু। কিন্তু সেরা দিদি দীর্ঘশ্বাস ফেললেও, তার পরে বলে ওঠে, “আমি পায়াস দাদার সঙ্গে একমত। মানুষটা জানেই না সতের হাজার পাউন্ড নিয়ে কী করা যায় বা কী করা উচিত। এই বয়েসে বেশি উত্তেজনা ভাল নয়। আর লতায় পাতায় সব গুষ্ঠি এসে জুটবে আর সাদাসিধে মানুষটার কাঁধে চেপে বসবে।”
পায়াসের আত্মীয়স্বজনের প্রসঙ্গ উঠতেই মুসিসি ভুরু কোঁচকায়, “দাদু, আপনাকে আমার আগেই বলা উচিত ছিল, আপনার অতিথিরা কি কান্ডটাই না করেছে। অত জমি সব লণ্ডভণ্ড করে ফেলেছে। বাগান থেকে কাঁদি কাঁদি কাঁচকলা কেটে নামিয়েছে। আর সত্যি কথা বলতে কি, ভাগ্যে মিসেস কিভূম্বি সেখানে ছিলেন, সেরা দিদির দিকে তাকায় সে, “তা না হ’লে আপনার বাগানের সাধের শাঁখালুগুলোকেও খুঁড়ে তুলে সব খেয়ে ফেলেছিল আর কী! উনি গিয়ে যথাসময়ে থামিয়েছেন।”
“একেবারে হক কথা পায়াস দাদা," সেরা গম্ভীর মুখে জুড়ে দেয়, “অনেক দিন সময় লাগবে তোমার ক্ষেত বাগান আগের মত অবস্থায় আনতে। হতচ্ছাড়ারা তোমার সাজানো মাচা থেকে বিনগাছগুলোকেও ছিঁড়েছে!”
“হায়, হায়! কী হবে আমার?” বিলাপ করে পায়াস, “সারা বছর খাব কী?”
“কোনো চিন্তা নেই, সব আমার ওপরে ছেড়ে দাও। আমি ফিরে গিয়েই ঝাঁটা মেরে বিদায় করছি সব অকালকুষ্মাণ্ডগুলোকে। সিধে বলে দেব, পয়সাকড়ি কিছু নেই, লেজ তুলে ভাগো এবার! আর আমার দুটো গাঁট্টাগোট্টা নাতিকে ডেকে পাঠিয়েছি-- বাছারা খুব কাজের। মারধোর করতে বল, ক্ষেতে লাঙল করতে বল, লক্ষ্মী ছেলের মতন করবে। ঘরদোর খালি করে, বাগান পরিষ্কার করে তারা নতুন গাছপালা রুয়ে দেবে।” তার তেজ ও কর্মক্ষমতা দেখে পায়াস মুগ্ধ না হয়ে আর পারে না।
মুসিসি চেয়ার ছেড়ে ওঠে, “আমার অনেক কাজ পড়ে আছে আপিশে। তার আগে দাদু আমি সেরা দিদিকে নিয়ে রওনা দিই। ওঁকে আপনার বাড়ি পৌঁছে দেব আর দরকার হলে লোকজন তাড়াতেও সাহায্য করব। আর কাল খুব সকালে এসে আপনাকে ফেরত নিয়ে যাবো।” সেরা আর সে দুজনে দুদিক দিয়ে ল্যান্ডরোভার গাড়িতে উঠে পড়ে। রাস্তার বাঁকে গাড়িটা সম্পূর্ণ মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সেরা দিদি উৎসাহভরে হাত নাড়ে।
“মহিলা কিন্তু বেশ কাজের, আর মানুষটিও খারাপ নয়,” মিরিয়ামু পায়াসকে বলে, ভেতরে চলে যাবার আগে। পায়াস আধঘুমে ঘোঁত ঘোঁত শব্দ করে, তার খুব একটা খেয়ালও নেই কার প্রশংসা করলে মিরিয়ামু--তার, না সেরাদিদির?
পরের দিন মুসিসি যখন তাকে ফেরত নিয়ে গেল, সে গাড়ি থেকে নেমে দেখল তার বাড়িঘর চুপচাপ। তবে দেখতে পায় তার কফি আর কাঁচকলার বাগিচা ছিন্নভিন্ন, ধ্বংসপ্রায়। বিষণ্ণমনে সে ধপ করে বসে পড়ে বারান্দায়, কয়েক মিনিট পরেই সেরা বড় এক মগ গরম চা এনে তার সামনে ধরলেই আবার সব ভুলে যায়। সেরা মাদুর পেতে তার পায়ের কাছে বসে এবং কিভাবে বাড়িঘর ক্ষেতখামারের পরিচর্যা ও উন্নতি করা যেতে পারে তার জন্যে নানা প্রস্তাব ও হিশেব দাখিল করে। অবশ্যই পুরস্কারের অর্থের সদ্ব্যবহার হবে তাতে। পায়াস অল্প অল্প করে জানায় তার মনের কথা, তার পরিকল্পনা আর শেষ করে এই বলে, “অবশ্যই সব কিছু করা সম্ভব হবে না এখনই, আমি সালঙ্গোকে কথা দিয়েছি সমাধিসংস্কারের জন্যে টাকা দেব তাকে।”
সেরা হাঁড়ি থেকে আরো গরম চা ঢালে, দুজনেই নতুন চুমুক দেবার পর সে মুখ খোলে, “সবার আগে প্রয়োজন বাড়িটার ছাদ, কাল রাতেই দেখেছি, অনেকগুলো ফুটো থেকে জল পড়ছে। আর সেটা যখন করতে হবেই, তার সঙ্গে বাড়তি আরেকটা ঘর এবং বারান্দায় একটা রান্নাঘর বানিয়ে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে। মাটি তো প্রচুর রয়েছে, বাঁশের পাতার দামও বেশি না, তার ওপরে অবশ্য ভাল করে পলেস্তারা করতে হবে। আর তুমি কাজ শুরু করে দাও, কফির ক্ষেতটাকে বাড়াও। মুরগির ব্যবস্থা আমি করব, আমার বাড়িতে ছ’টা ডিম-পাড়া মুরগি আর একটা ষণ্ডা মোরগ রয়েছে। আমি তাদের নিয়ে আসব।”
পায়াস অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে থাকে--বয়েস হয়েছে কিন্তু শরীরের বাঁধুনি রয়েছে; দেখলে কেউই বলবে না অনেক নাতি-নাতনির দিদিমা। গায়ে চেপে বসা নীল পোষাকটি মানিয়েছেও ভাল--কিন্তু আমার সঙ্গে এত আঠা কেন?
“তোমার কথাবার্তা শুনে মনে হয় তুমি এই বাড়িতে এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে চাও, তাই কি?” সে কোন উত্তেজনা দেখায় না, নিত্তনৈমিত্তিক কথাবার্তার মতন করে বলেই ফেলে।
সেরা মাথা ঘুরিয়ে পায়াসের মুখের দিকে তাকায় আর সোজাসুজি বলে, “পায়াস দাদা, আমার মনের কথাটা তোমায় বলি-- মনখোলা কথাবার্তা বলে নেওয়া ভাল। আমার ছোট ছেলের বিয়ে হয়েছে ছ'মাস আগে, বৌমা থাকেন আমাদের সংসারে। মেয়ে হিশেবে সে খুবই ভাল, কিন্তু একই সংসারে দুজন গৃহিণী আমার পছন্দ হয় না। ঝগড়াঝাঁটি অবশ্য কিছু হয়নি। আমার বড় ছেলে থেকে কামপালায়, তার ঘরে স্ত্রী আর তিনটি ছেলেমেয়ে--সে এবং বৌমা আমাকে প্রায়ই ডাকে, কিন্তু সেখানে গিয়ে থাকলেও একই অবস্থা হবে। তোমার হয়ত আমাকে মনে নেই, কিন্তু আমার ঠিক খেয়াল রয়েছে, তুমি আমাদের বিয়েতে এসেছিলে এবং নানান কাজকর্ম একা হাতে করে দিয়ে প্রচুর সাহায্য করেছিলে। তাই তোমার কথা যখন খবরের কাগজে পড়লাম, মনে এল তোমার স্মৃতি। সংসারটা সামলাতে হবে, যত্নআত্তি করতে হবে, আর এখন যখন তোমার অঢেল পয়সাকড়ি, সব ছিনে জোঁকদের তাড়াতে হবে। তাই ভাবলাম একবার ঘুরে যাই, তোমাকে দেখে আসি। এখন দেখছি যে এসে ভালই করেছি। আমাকে প্রয়োজন তোমার।” এবার সে একটু থামে এবং ইত:স্তত করে আবার বলে, “তবে তুমি যদি বাকি জীবন একা থাকতে চাও, তাহলে অন্য কথা। আমি যা বলি তা সবাই শোনে, তাই সে কথাটা আমি একবারও ভাবিনি।”
পায়াস মৃদু কেশে গলা পরিষ্কার করে, “বুকের পাটা আছে তোমার, সে কথা মানতেই হবে।” সে চুপ করে যায়, আর কোনো কথা আসতে চায় না মুখে।
এরপর পায়াস আর কদিন ঘর ছেড়ে বেরোয় না। হপ্তাখানেক পর একদিন সে গুটিগুটি কবরখানার দিকে এগোয়--সেখানে সালঙ্গো ঘষে ঘষে সাসাবালাঙ্গিরার ঢাল তরোয়াল পালিশ করছে। “আমি ভেবেছি তুই পটল তুলছিস," কপট রাগে গরগর করে সমাধিগুলোর তত্ত্বাবধায়ক, “কতদিন আসিস না এখানে, তবে তাতে কিছু আসে যায় না, মরা মানুষদের অযত্নে থাকার অভ্যেস আছে। বুগুন্ডার এই মহাপুরুষের জন্যে কেউ আর কেয়ার করে না।”
“খুব ব্যস্ত ছিলাম রে আমি,” আপনমনে বিড়বিড় করে পায়াস, “কিন্তু তোকে যে কথা দিয়েছিলাম, তা আমি ভুলে যাইনি। এই নে একশো শিলিঙ, রাখ, সম্ভব হলে আরো বেশিই দিতাম। অন্তত: কয়েকটা সিমেন্টের ব্লক কিনতে পারবি সমাধির মন্দিরের জন্যে।”
সালঙ্গো হাত পেতে টাকাটা নিল, কিন্তু এমনভাবে তাকাল যেন তাতে পোকামাকড় আর উকুন কিলবিল করছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ধন্যবাদ জানাল বন্ধুকে আর তার সঙ্গে ফোড়ন কাটল, “জানি তোর খরচাপাতি তুমুল বেড়ে গেছে, বাড়িতে যখন একটা আস্ত, জ্যান্ত মেয়েমানুষ।”
“নানতোন্দো তোকে বলেছে বুঝি?” লাজুক হাসি পায়াসের মুখে।
“কে বলেছে তাতে কার কি আসে যায়?” সালঙ্গো ঝাঁঝিয়ে উত্তর দেয়, “পরে বলিস না যে আমি তোকে সাবধান করে দিইনি। দেখিস কোনোদিন আবার তোর কাছে বিয়ের আংটি না দাবী করে বসে!”
পায়াস বেশ ঘাবড়ে যায়, বোকার মতন হাসে, “আসলে আমার এখানে আসার একটা কারণ সামনের মাসে আমাদের বিয়েতে তোকে নেমতন্ন করা।”
সালঙ্গো খুব সাবধানে হাতের তরোয়ালটা নামিয়ে রাখে এক টুকরো পরিষ্কার চামড়ার ওপর আর এক দৃষ্টে বন্ধুর দিকে তাকায় যেন তার কাঁধে একটা দ্বিতীয় মাথা গজিয়েছে। “তুই একটা বেকুব! বোকা পাঁঠা কোথাকার! যেদিন থেকে ফুটবলের বাজির ছক কাটা কাগজে নানান সংখ্যা বসিয়ে জমা দিতে লেগেছিস, সেদিন থেকে বিপদের শুরু! আমি জানতাম এর থেকে শুভ কিছু ঘটবে না, ঘটতে পারে না। এই বয়েসে তোর অন্তত: কয়েক আউন্স কাণ্ডজ্ঞান হওয়া উচিত মগজে। যদি পারিস, এখনো সময় আছে, প্রাণ নিয়ে পালা--এই আমার শেষ উপদেশ।”
এক মুহূর্তের জন্যে হলেও ধন্দে পড়ল পায়াস, আশংকায় ভরল তার মন। সত্যিই কি সে বোকামি করছে? তারপর ভাবলে সেরার কথা, সে কেমন অল্প সময়ে ভোল ফিরিয়ে দিয়েছে, তার বসতবাটীর, তার খেতখামারের, তার জীবনের। সেরার সঙ্গে থেকে সুখ এসেছে তার জীবনে সন্দেহ নেই। খানিকটা আশ্বস্ত হয় সে। “যাই হোক, বিয়ে করছি আমি; খবর দিয়ে গেলাম আর নেমতন্ন করে গেলাম। গির্জায় আর রিসেপশানে--দুটো জায়গাতেই যেন তোকে দেখতে পাই। না হলে আবার আসব জিজ্ঞেস করতে।” এমন ভারিক্কি চালে নিজেকে কথা বলতে শুনে নিজেই সে তাজ্জব, আর সালঙ্গো? সে তো বিস্ময়ের প্রতিমূর্তি। মিন মিন করে বলে, “ঠিক আছে, চেষ্টা করব যেতে। আর তুই বাড়ি ফেরার আগে গিন্নীর জন্যে পেছনের বাগান থেকে বড় এক কাঁদি কাঁচকলা কেটে নিয়ে যা। আর একটা বড় সড় বাঁধাকপি হয়েছে, সেটাও। হ্যাঁ, মহিলার বুকের পাটা আছে বলতে হবে, আসলে বাজি জিতলে তো সেই।”
[১] মাতোকে--ভাপে সেদ্ধ কাঁচকলা, উগান্ডার প্রধান খাদ্য। খেতে দেওয়া হয় কলাপাতায়, সঙ্গে থাকে শাকসব্জি এবং মাংসের কিমা ও চিনাবাদাম দিয়ে বানানো চাটনি।
বারবারা কিমেনাই-এর জন্ম ১৯২৯ সালে ইংল্যান্ডে, তাঁর মা-বাবা উগান্ডার নাগরিক। তিনি বসবাস করেছেন কেনিয়া, উগান্ডা এবং ইংল্যান্ডে। বারবারা পূর্ব-আফ্রিকার সাহিত্যজগতে এক জনপ্রিয় নাম। মূলত ইংরেজি ভাষায় লেখেন।স্কুলের পড়া শেষ করে তিনি লন্ডনের হ্যামারস্মিথ কলেজে নার্সিং-এর ডিগ্রিকোর্সে যোগ দেন, সেখানে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় তাঁর ভাবী স্বামী তানজানিয়ার এক যুবকের সঙ্গে। বিবাহের পরে দম্পতি ফিরে আসেন উগান্ডায়।
যদিও তিনি স্কুলের নীচের ক্লাশ থেকে শুরু করে নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন এবং মাত্র এগারো বছর বয়েসে নিজের চেষ্টায় একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করেন, বিয়ের পর তিনি পুরোপুরি গৃহবধূ এবং দুই পুত্রের পরিচর্যায় ব্যস্ত। বাচ্চারা একটু বড় হলে তিনি আবার প্রবেশ করেন সাহিত্যের জগতে।
তাঁর প্রথম ছোটগল্প সংকলনের নাম “কালসান্দা”, ১৯৬৫ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। অনূদিত “বিজয়ী” (“The Winner”) গল্পটির নির্বাচন করা হয়েছে সেই গ্রন্থ থেকে। কয়েক বছর পরে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ “কালাসান্দায় দ্বিতীয় বার।” গল্পগুলি উগান্ডার একটি বড় প্রদেশ, বুগুন্ডা রাজ্যের--কালাসান্দা তার একটি কাল্পনিক গ্রাম।
সাংবাদিকতা দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের শুরু--পূর্ব-আফ্রিকার তিনি প্রথম কৃষ্ণকায় মহিলা সাংবাদিক। কেনিয়ার “ডেইলি নেশান” সংবাদপত্রের একটি বিভাগীয় সম্পাদকের পদে উন্নীত হয়েছিলেন। রাজনৈতিক ভাবে শক্তিশালী, আমলা অথবা ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের সঙ্গে চমকপ্রদ সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্যে খ্যাত।
তাঁর কথাসাহিত্যের প্রধান সমালোচনা--তিনি সমাজ সচেতন বা রাজনীতি সচেতন নন। তিনি গল্প বলে যান, সাধারণ মানুষের সুখ দু:খের কথা হাস্যরসের মাধ্যমে সৃষ্টি করেন মাধুর্য। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, স্বাধীনতা আন্দোলন, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য, ঔপনিবেশিক শোষণ সেখানে অনূক্ত থেকেই যায়। পূর্ব-আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশের স্কুল কলেজে তাঁর রচনা অবশ্যপাঠ্য।
পরবর্তী জীবনে তিনি বিখ্যাত হয়েছেন শিশু সাহিত্য রচনায়--বালক বালিকা; অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে তাঁর গল্পের সংখ্যা প্রচুর। “মোজেস” নামে একটি বালক চরিত্রকে কেন্দ্র করে তাঁর গ্রন্থসিরিজটি ইওরোপ ও আফ্রিকায় অতি পরিচিত। বারবারার রচিত একটি উপন্যাস অবলম্বনে “পুণ্য বৃক্ষের সংগ্রাম” নামে ইংরেজি ভাষায় একটি কাহিনীচিত্র পরিচালনা করেছেন কেনিয়ার চিত্রকার ওয়ানজিরো কিনিয়ানজুই। কমেডিচিত্রটি মুক্তি পায় ১৯৯৫ সালে। ১৯৯৮ সাল থেকে তিনি পাকাপাকিভাবে বাস করছেন ইংল্যান্ডে। সেখানে তাঁর মৃত্যু ১২ আগষ্ট, ২০১২।
—অনুবাদক