ছোট টুসিকে সুইমিং পুল থেকে বাঁচানো দিয়ে ঋভুর গল্পটা শেষ হতে পারত, কিন্তু না, ঋভুর গল্পটা সেই ঘটনাটা দিয়েই শুরু।
বাবার বসের ছেলের জন্মদিনের পার্টিতে ওরা সবাই গিয়েছিল। যে হল ঘরটায় পার্টিটা হচ্ছিল তার সাথেই লাগোয়া ওদের কমপ্লেক্সের সুইমিং পুল। ঘোষকাকুর মেয়ে টুসি সবার অলক্ষে পুলের ধারে গিয়ে হাজির হয়েছিল। কেউ সেটা খেয়াল করেনি ঋভু ছাড়া। আসলে সে আর হিরু-কাকুর ছেলে অর্জুন ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিল।
টুসিকে পুলের ধারে যেতে দেখে ঋভু, “এই টুসি ওদিকে যাস না!” বলতে না বলতেই টুসি দিল জলে ঝাঁপ! তার বয়স তো তিন বছর, সে মোটেই সাঁতার-টাতার জানে না। ওকে জলে লাফাতে দেখে ঋভুও ভাল জামা ফুলপ্যান্ট পরা অবস্থাতেই জলে ঝাঁপ দিল। টেনে তুলল টুসিকে। ততক্ষণে অর্জুনের চিৎকারে অন্য অনেকেই পুলের ধারে চলে এসেছে, মা, বাবা, ঘোষ-কাকু সবাই। শুধু ঘোষ-কাকিমা আসেননি। উনি বাথরুমে গিয়েছিলেন, সেই জন্যেই টুসি পালিয়ে আসার সুযোগ পেয়েছিল।
যাই হোক তারপর থেকে তো ঋভু হিরো হয়ে গেল। সবার মুখে ওর সেকি প্রশংসা। ব্যস, আর যাবে কোথায়। ওই সব কথাতেই ঋভুর মাথাটা গেল বিগড়ে! সে নিজেকে সুপার হিরো বলে ঘোষণা করে বসল। মিত্র-কাকু ওর ভিজে জামাপ্যান্ট পরে টুসিকে ধরা কয়েকটা ছবি তুলেছিলেন আর সেগুলো বাবাকে দিলেন। ঋভু সেগুলোকে প্রিন্ট করে স্কুলে নিয়ে গিয়ে সবাইকে দেখাতে লাগল। ওর ভাবখানা এমন যেন মোটামুটি সুপারম্যান, ব্যাটম্যান আর স্পাইডারম্যানের পরই ঋভু!
টুসির মা-বাবা, মানে ঘোষ-কাকু আর কাকিমা ওর জন্যে খুব সুন্দর এক সেট জামা প্যান্ট আর এক গাদা চকোলেট উপহার দিয়ে গেলেন। ঋভু সেই চকোলেট কাউকে দিল না, এমনকি নিজের দিদি রিলাকেও না! ওটা নাকি সুপার হিরোদের প্রাপ্য আর কারো নয়! নিজের ফ্ল্যাটের দরজায় ঋভু কাগজে বড় বড় করে লিখে দিল ‘এখানে সুপার হিরো থাকে’।
সব ভালই চলছিল। হঠৎ একদিন বিকেলবেলা ঋভু স্কুল থেকে ফিরে সবে খেয়ে উঠেছে এমন সময় পম্পি ছুটতে ছুটতেএসে হাজির। পম্পিরা ওদের ওপরের তলার ফ্ল্যাটে থাকে।
হাঁপাতে হাঁপাতে পম্পি বলল, “ঋভুদা, এখুনি চলো! ব্ল্যাকিকে বাঁচাতে হবে!”
ব্ল্যাকি পম্পির বেড়াল সেটা ঋভু জানে কিন্তু তা ছাড়া আর কিছু বুঝতে না পেরে সে বলল, “মানে? কী হয়েছে ব্ল্যাকির?”
“ব্ল্যাকি ওই জলার ধারের একটা গাছে উঠে পড়েছে আর নামতে পারছে না। তুমি তো সুপার হিরো, তুমি ঠিক ওকে উদ্ধার করতে পারবে!”
পম্পির কথা শুনে বেশ ঘাবড়েই গেল ঋভু! সে আবার গাছে-টাছে চড়াতে একেবারেই অপটু! কিন্তু সুপার হিরোরা তো আর বলতে পারেনা যে ‘না পারব না!’ তাই ওকে যেতেই হল।যে গাছে ব্ল্যাকি উঠেছে সেই গাছটা কী গাছ জানে না ঋভু কিন্তু বেশ কাঁটা আছে! পম্পি নিচে দাঁড়িয়ে দেখছে তাই আর উপায় না দেখে ঋভু গাছে উঠতে লাগল। কাঁটায় ওর গা হাত পা ছড়ে গেল। ওমা! ওকে গাছে উঠতে দেখে ব্ল্যাকি সুড়সুড় করে গাছ থেকে নিচে নেমে পম্পির কোলে গিয়ে উঠে পড়ল!
পম্পি তখন নিচ থেকে সমানে চেঁচাতে লাগল, “ও ঋভুদা তুমি নেমে এসো, ব্ল্যাকি তো এসে গেছে!”
তাড়াহুড়োতে কাঁটা বাঁচিয়ে নামতে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে পাটা মচকেই গেল ঋভুর! পর দিন ব্যথায় স্কুলে তো যেতেই পারল না, উলটে মার কাছে বকুনি খেল!
“তোমার হিরোগিরি করার স্বাদ মেটেনি দেখছি! এখন বোঝো ঠেলা!”
পরের দিন ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে স্কুলে গিয়ে দেখল পরীক্ষার টাইম টেবল দেওয়া হয়েছে। তাই নিয়ে সবার মধ্যে বেশ চাপা অভিযোগ!
অনুভব বলল, “একই দিনে বিজ্ঞান আর ইতিহাস! আরেক দিন অঙ্ক আর ভূগোল, এই রকম রুটিন হলে তো আমরা সব ফেল করে যাব! অত পড়া এক সাথে পড়া যায় নাকি?”
ঋভু বলল, “চল তাহলে হেড-স্যারকে গিয়ে বলি! উনি চাইলে তো রুটিন বদল করে দিতে পারেন!”
অনুভব ভেবে বলল, “হ্যাঁ, তা পারেন!”
“তবে চল!”
চার পাঁচটা ছেলে মিলে হেড-স্যারের ঘরে গিয়ে কথাটা বলা হবে ঠিক হল। স্যারের ঘরে ঢোকার সময় সবাই ঋভুকে ঠেলে দিল, বলল, “তুই না সুপার হিরো! তোরই সামনে থাকা উচিত!”
ওকে ধাক্কা মেরে স্যারের ঘরে ঢুকিয়ে অন্যরা সবাই দিব্যি সটকে পড়ল! ঋভু ঘরে ঢুকতেই হেড-স্যার জিজ্ঞ্যেস করলেন, “কি চাই?”
“ইয়ে... মানে, স্যার বলছিলাম কি যে এবারের রুটিনটা বড্ড শক্ত হয়ে গেছে! বিজ্ঞান আর ইতিহাস, ভূগোল আর অঙ্ক, ওটাকে কি বদলানো যায় না স্যার?”
“তোমাদের টিচাররাই তোমাদের রুটিন সেট করেছেন! আমি আর তাতে কি বলব! তাছাড়া আমি তো শুনলাম তুমি সুপার হিরো! তোমার তো তাহলে অসুবিধা হওয়া উচিত নয়! তুমি তো চাইলে এক দিনেই সব পরীক্ষা দিয়ে দিতে পারবে, তাই না?” বলে হা হা করে হাসলেন হেড-স্যার!
ঋভু বেরিয়ে আসতে অন্যরা সবাই তাকে ধরল, “কি হল? স্যার কি বললেন?”
“হবে আবার কি! সুপার হিরোরা নাকি এক দিনেই সব পরীক্ষা দিতে পারে!”
সেটা শুনে তো সবাই ঋভুকে এই মারে তো সেই মারে!
“তুই সুপার হিরো হতে পারিস আমরা তো নই!”
ফলে ওই বাজে রুটিনেই পরীক্ষা দিতে হল সবাইকে।
রোজ নানান আবদারে বিরক্ত ঋভু! সুপার হিরো হলে লোকের এটা সেটা চাওয়ার শেষ নেই ওর কাছে! রাস্তার জ্যাম সরাতে হবে, গাছ থেকে ফল পেড়ে দিতে হবে, বৃষ্টি থামিয়ে দিতে হবে, যত্ত সব!
তারপর একদিন রোমান আর টিকু এসে ওর কাছে কেঁদে পড়ল, “ঋভুদা, আমরা ফুটবল খেলছিলাম আর ঝন্টুদা এসে আমাদের ফুটবলটা কেড়ে নিয়ে গেল! বলল কে নাকি পরশু দিন ওদের ঘরের জানালার কাঁচ ভেঙে দিয়েছে! কিন্তু আমরা তো ভাঙিনি! ওই ফুটবলটা তো একেবারে নতুন, ওটা টিকু কালকে ওর জন্মদিনে পেয়েছে! ওর মামা দিয়েছেন! তুমি প্লিজ ওটা ঝন্টুদার কাছ থেকে উদ্ধার করে দাও!”
ঝন্টুদাকে ঋভুরও ভারি ভয়! ঝন্টুদা ক্যারাটে শেখে, কুস্তি করে! গায়ে অসুরের মতন শক্তি আর ব্যবহারটাও সেই রকম! কিন্তু বাচ্চা ছেলেগুলো কাঁদছে দেখে ঋভুর মনে দয়া হল। সে গেল ঝন্টুদাদের বাড়ি!
বেল দিতে ঝন্টুদাই এসে দরজা খুলে হুঙ্কার দিল, “কাকে চাই?”
তারপরই বুঝতে পেরে বলল, “ও ছিঁচকাঁদুনেগুলো বুঝি এবার সুপার হিরোর আশ্রয় নিয়েছে! সুপার হিরো হা হা! আয় দেখি তোর গায়ে কত জোর!” বলে কবজি শুদ্ধু ঋভুর হাতটা খপ করে ধরে একটা মোচড় দিল ঝন্টুদা! ব্যথায় ককিয়ে উঠল ঋভু!
“আহ লাগছে! বাবা গো! ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও!” বলে পরিত্রাহি চিৎকার জুড়ে দিল ঋভু! ভাগ্য ভাল ওর চেঁচানি শুনে ঝন্টুদার বাবা বেরিয়ে এলেন!
“এই ঝন্টু! কি হচ্ছে! মারামারি করবে না বলেছি না! ছেড়ে দাও ওকে!”
বাবার কাছে ধমক খেয়ে ঝন্টুদা ওর হাতটা ছেড়ে দিল। ঋভু এবার সাহস করে ওদের ঘরে পড়ে থাকা ফুটবলটা দেখিয়ে ওর বাবাকে বলল, “মেসোমশাই ওটা পাড়ার বাচ্চাদের ফুটবল, ওটা নিয়ে যেতে পারি?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ! কেন বাচ্চাদের ফুটবল নিয়েছো ঝন্টু? তোমাকে এত করে বলি!” বলে উনি ফুটবলটা এনে ঋভুর হাতে দিয়ে দিলেন।
রোমান আর টিকু বল পেয়ে খুব খুশি কিন্তু ঋভু ঠিক করে ফেলেছে সে আর সুপার হিরো হতে চায় না। ঝন্টুদার ওই ভয়ানক মোচড়ের ফলে ওর হাতের হাড়ে চিড় ধরে গিয়েছিল, এখনও প্লাস্টার লাগান রয়েছে। নিজের ফ্ল্যাটের দরজার বাইরের লেখাটা বদলে সে এখন লিখে রেখেছে ‘এটা ঋভুর বাড়ি, এখানে কোন সুপার হিরো থাকে না’!