• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬১ | ডিসেম্বর ২০১৫ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • গ্রন্থ-সমালোচনা: সুধীন দাশগুপ্ত, আদর্শ-চরিত, দুর্গাদাস লাহিড়ি সম্পাদিত বাঙালির গান, মন্নু ভণ্ডারী কী ইয়াদগারী কহানিয়াঁ : ভবভূতি ভট্টাচার্য

    || সেই কদমতলিতে আজও মধুর মধুর বংশী বাজে ||

    সুধীন দাশগুপ্ত---সম্পা. অশোক দাশগুপ্ত; আজকাল পাবলিশার্স, কলকাতা-৯১; ISBN 978-81-7990-083-3

    এমন হয় না?

    কোনো এক চটি বই--ভারে অতি না হয়েও ধারে বড় গভীর কাটে?

    যেমন এ’খানি। ষাট টাকার তন্বী পুস্তক, পৃষ্ঠাসংখ্যায় ডেড়শ’ও নয়। কিন্তু এমন এক প্রাণের-মানুষকে নিয়ে লেখা যে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে মন চলে যায় সেই সুন্দর সোনাঝরা দিনগুলোয়, যখন কোন্‌ সে আলোর স্বপ্ন নিয়ে মনমুগ্ধকর এক ম্যাটিনি শো দেখে গুনগুন করতে করতে ঘরে ফিরতো বাঙালী। ঊনিশশ’ পঞ্চাশ-ষাট-আধাসত্তরের বাঙলা ছবি-গানের সেই স্বর্ণযুগ কি শুধু উত্তম-সুচিত্রার হাত ধরে এসেছিল? হেমন্ত-মান্না-সন্ধ্যা-আরতিদের মাতানো স্বরের পেছনের সুরগুলিও কি এক প্রধান স্তম্ভ ছিল না? নচিবাবু, সুধীন দাশগুপ্ত তাই পেছনে থেকেও পেছনে নন, আড়ালে থেকেও অন্তরের অন্তস্থলে!

    ***

    তিনি ‘সুধীন দাশগুপ্ত’ না হয়ে উঠলে প্রকাশ পাড়ুকোনে হতে পারতেন--শুনলে আজ হয়তো লোকে হাসবে। কিন্তু দার্জিলিংবাসী ধনী পিতার সন্তানটি শুধু যে ঘরে বসে বেহালা-পিয়ানো-ম্যান্ডোলিনে স্বশিক্ষিত হয়ে উঠেছিলেন তা-ই নয়, র‍্যাকেট হাতে কোর্টও কাঁপাতেন। তিনবারের রাজ্য ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়ন! কিন্তু ভাগ্যিস তরুণ সুধীন কর্ক রেখে হাতে ছড় তুলে নিয়েছিলেন, নৈলে থৈ থৈ শাওন আর আসত কৈ? ছেলের সঙ্গীতে আগ্রহ দেখে পিতৃদেব পাঠিয়ে দিলেন লন্ডনের রয়াল মিউজিক স্কুলে। সেখান থেকে পোস্ট-গ্রাজুয়েশন করে সুধীন বম্বে নয়, নলিন সরকার স্ট্রিটের এচ এম ভির দফতরে এসে গেলেন, কমল দাশগুপ্তের সাকরেদি নিয়ে। আবার বলি, ভাগ্যিস এসেছিলেন, নৈলে শেষ বিচারের আশায় বসেই থাকতে হত বসেই থাকতে হত।

    এবং শুধু পাশ্চাত্য-সঙ্গীতের শিক্ষাই নয়। এনায়েত খানের কাছে সেতার শিক্ষা, রীতিমত ভাতখণ্ডে-চর্চা ভারতীয় মার্গ-সঙ্গীতে। দেশিবিদেশি লোকসঙ্গীতের অপার ভাণ্ডার তাঁর হেফাজতে ছিল, ছিল কীর্তনাঙ্গ গানও, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ‘শ্যামও আজ বদলে গেছে’ (সন্ধ্যা) বা ‘ও শ্যাম যখন তখন’ (আরতি)-র মত গানে। এমনকি ছোটদের জন্যেও ‘হিংসুটে দৈত্য’ বা ‘ছোটদের রামায়ণ’-এ’ কী অসাধারণ সুর দিয়ে গেছেন সুধীনবাবু!

    ভুল বুঝবেন না সুধীপাঠক, সুধীন দাশগুপ্তের সঙ্গীতপ্রতিভার মূল্যায়ন করার আধআনা যোগ্যতা আমার নেই, তা করতেও বসিনি। শুধু এই পুরনো বইটি হঠাৎ তাক থেকে পেড়ে মনটা এক লহমায় চলে গেল ‘দূরে দূরে কাছে কাছে এখানে ওখানে ...’--মনে পড়ছে, আরতির গলার সেই অনবদ্য গান? হ্যাঁ, গানখানির গীতিকারও ছিলেন সুধীনবাবু। আর, অন্ততঃ এই একটি নিরিখে উনি আর আর সব সুরকারকে পেছনে ফেলে দেবেনঃ “জীবনে কি পাবো না” বা “হয়তো তোমারই জন্য” বা “এতো সুর আর এতো গান”এর মত গীতমালা আর কোনো সুরকার লিখে যেতে পারেননি। পেনে ও পিয়ানোয় সমান দক্ষ ছিলেন। কিন্তু গীতিকার সুধীন চাপা পড়ে গেছে সুরকার সুধীনে।

    স্বভাবত অন্তর্মুখী মানুষটি। স্বল্পবাক। আপাদমস্তক ভদ্রলোক। তাঁকে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলতে বা ক্রুদ্ধ হতে দেখেনি কখনও কেউ--স্মৃতিচারণ করে গেছেন সুহৃদ পুলক বন্দ্যো থেকে এই বইয়ে দ্বিজেন মুখো., জটিলেশ্বর, সুবীর সেন। বস্তুতঃ, আসামের-বাঙালী সুবীর সেনকে তো তুলেই আনেন সুধীনবাবু। আর মান্না দে জ্যেষ্ঠতর ও তখনই বম্বেতে-প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হলেও বাঙলা ফিল্মিগানে তাঁকে প্রথম ব্রেক সুধীনই দেন। স্বয়ং হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থাকতে ‘শঙ্খবেলা’ ছবিতে উত্তমের ঠোঁটে নতুন গায়ক মান্না গাইবেন সেটা সেই ১৯৬৬তে কেউ মানতে পারেনি; ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’ বদলে দিয়েছিলো ধারাটা। ইতিহাসকার সুধীন নেপথ্যেই থেকে গেলেন--সফল সুরকার হিসেবে। এই জহুরির চোখটা বা কান/বোধটাই না এক মহান স্রষ্টা বানায় ... (প্রথম জীবনে উনি দার্জিলিঙে পারিবারিক জুয়েলারি শপে বসতেন যে)! সলিল চৌধুরির ‘সুহানা সফর’ গান অল ইন্ডিয়া হিট হয়, বিমল রায়ের ‘মধুমতী’ (১৯৫৮) ছবিতে। সুরটা কিন্তু বন্ধু সুধীনের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিলেন সলিল (দ্বিজেনের গাওয়া গানঃ ‘ছায়াঘেরা কালো রাতে’ গানটা আজও শুনি ইউ-টিউবে)।

    ***

    ‘আজকাল’ প্রকাশনার এ’হেন বেশ কয়েকটি তন্বী কেতাব পড়ে আনন্দ পাওয়া গেছে, একটির কথা তো একবার বেরিয়েছিল ‘পরবাস-’এ’ [‘সুরসাগর হিমাংশু দত্ত’]। কোনো মস্ত লক্ষ্য নেই এক সিরিজের বইগুলোর। দু’তিনটি-চারটি প্রবন্ধের মধ্যে দিয়ে ব্যক্তিত্বটির সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেওয়া--সে তিনি গোবর গোহ বা গোষ্ঠ পাল যে-ই হোন। এই বইটির সঙ্গের পরিশিষ্টখানি বড্ড কাজের। যেমন এখানে সুধীন দাশগুপ্ত সুরারোপিত বাঙলা ছায়াছবির গান, আধুনিক গান, অন্যান্য গান ও অ-বাঙলা গানের এক পূর্ণাঙ্গ তালিকা অতি যত্নে প্রস্তুত করেছেন সুশান্ত চট্টোপাধ্যায়। এঁদের সঙ্গীত-সংক্রান্ত বইগুলোর মূল কাজটা করতেন অলক চট্টোপাধ্যায়। যেমন, এখানেও মান্না দের সঙ্গে সাক্ষাতকারটি উনিই নিয়েছেন। সম্পাদক হিসেবে নাম অবশ্য অশোক দাশগুপ্তের রয়েছে। সুধীনজায়া মঞ্জুশ্রী দাশগুপ্তের স্মৃতিচারণাটি বড্ড মন কাড়ে। সুবীর সেন-কৃত সশ্রদ্ধ প্রণিপাতখানিও।

    ***

    কে গাননি সেকালে সুধীন দাশগুপ্তের সুরে? একটা-দু’টো হিট গানের নাম করলেই তালিকা দীর্ঘ হয়ে পড়বেঃ নামী হেমন্ত (‘নীল...নীল...সবুজের ছোঁয়া কিনা’), সতীনাথ (‘এলো বরষা যে সহসা’), শ্যামল (‘কী নামে ডেকে’), সন্ধ্যা (‘ও কথা বলবো না’), লতা (‘আজ মন চেয়েছে’), আশা (‘ডেকে ডেকে চলে গেছি’), গীতা (‘একটু চাওয়া একটু পাওয়া’), প্রতিমা (‘একটা গান লিখো আমার জন্য’), সুবীর (‘এতো সুর আর এতো গান’) থেকে কম-প্রতিষ্ঠা পাওয়া শ্যামশ্রী মজু (‘টিয়া টিয়া টিয়া’) বা, সুজাতা মুখো (‘ললিতা সখী গো’) ... কে নয়? আর নারীকণ্ঠে আরতি ও পুং কণ্ঠে মান্না দে তো ছিলেন সুধীনের সঙ্গে বেজোড় জোড়! কত কত যে হিট গান এঁদের! আর গীতিকার? পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়-সুধীন দাশগুপ্ত ছিলেন অভিন্নহৃদয় সুহৃদ। বহু বহু গানের গীতিকার উনিই। মান্না-সুধীন-পুলক ছিলেন চমৎকার জুটি। তাছাড়াও প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখা ‘সাগর থেকে ফেরা’। যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত (‘থৈ থৈ শাওন এলো ঐ’), যতীন্দ্রমোহন বাগচি (‘বাঁশবাগানের মাথার ওপর’)ও লিখেছেন অনবদ্য গান। আর স্বয়ং তারাশঙ্করই না লিখে দিয়েছিলেন সেই শেষবিচারের আশাভরা গানটি, মান্নাবাবু যেটি আসরে গাইতে শুরু করলেই রাধাকান্ত নন্দী তবলা থামিয়ে রুমাল দিয়ে চোখ মুছতেন?

    তাই সুধীন দাশগুপ্তের (১৯৩০-১৯৮২) নাম উঠলেই আজও সেই কদমতলীতে মধুর মধুর বংশী বেজে ওঠে সন্ধ্যার সোনাভরা স্বরে। রুমাল দিয়ে চোখ মুছি ... মাত্র বাহান্নতেই চলে গেলেন উনি?



    || কেন হে ইঁহারে ‘আদর্শচরিত্র’ বলিব? ||

    আদর্শ-চরিত--দুর্গাদাস লাহিড়ী (সম্পা. মানবেন্দ্র নস্কর); ‘সূত্রধর’ প্রকাশনা, বাগবাজার কলকাতা-৩; কৃষ্ণমোহন বন্দ্যো.র দ্বিশতবার্ষিকীতে প্রকাশ ২০১৩; ISBN নেই।

    ঊনবিংশ শতাব্দী সবে শুরু হয়েছে, তখনো দেড় দশকও কাটেনি। ভারতের অবস্থাটা তখন কী? পেশোয়া দ্বিতীয় বাজীরাও বিঠুরে নির্বাসিত। করুণ দশা লাল-কিল্লায় ‘ভারত-সম্রাট’ দ্বিতীয় আকবরেরও, কয়েক বৎসর পরে পেনশন বাড়াতে রামমোহনকে বিলেত পাঠাবেন। পঞ্জাবে ‘কেশরি’, অবশ্য, তখন বেশ রমরমে। এই সময়ে কলকেতার অবস্থাটা কী? ‘কালেজ’ তখনও হয়নি, তরুণ দ্বারকানাথ কী ব্যবসা শুরু করা যায়, ভাবছেন।

    এই সময়ে ঠনঠনিয়ার এক দরিদ্র কুলীন ব্রাহ্মণের ঘরে তাঁর কনিষ্ঠা কন্যা দ্বিতীয় পুত্রের জন্ম দিলো (২৪ মে, ১৮১৩ খৃঃ)। ঘরজামাই বাবাজীবন তখন তার অন্য অন্য শ্বশুরালয়ে বিবাহ-ব্যবসায় ভ্রমণরত। মাতামহ নবজাতকের নাম রাখলেন কৃষ্ণমোহন।

    মহামতি ডেভিড হেয়ার এই সময় ঘড়ি-ব্যবসায়ের পাশাপাশি কালিতলা-পটলডাঙায় গরিব ছাত্রদের পড়িয়ে বেড়ান। হতদরিদ্র কৃষ্ণমোহনের মধ্যে প্রতিভা ও অধ্যবসায় লক্ষ্য করে হেয়ারসাহেব তাকে ভাগ্যিস ফ্রি-স্টুডেন্ট করে নিয়েছিলেন, নৈলে ‘ইয়ং বেঙ্গল’-এর একটা পায়া খোঁড়াই থেকে যেত। হ্যাঁ, ডিরোজিয়ান রসিককৃষ্ণ-দক্ষিণারঞ্জন-রাধানাথ-রামগোপাল দলের শিরোমণি ছিলেন এই কৃষ্ণমোহন বাঁড়ুয্যে (১৮১৩-১৮৮৫ খৃ.), এগারো বছরের বালক হিন্দু কালেজে ঢুকে যখন বিতর্কিত The Persecuted নাটক লিখলেন (১৮৩১ খৃ) বয়স তার আঠেরো ছোঁয়নি! বস্তুতঃ, ইয়ং-বেঙ্গলিদের মধ্যে কৃষ্ণমোহনই ছিলেন সবচেয়ে প্রতিভাবান, দীর্ঘজীবন ধরে প্রমাণ করে দিয়ে গেছেন তা।

    ***

    এরপর কৃষ্ণের দীর্ঘ জীবনের ধারা বয়েছে নিজস্ব গতিতে, তার লম্বা আলোচনা করতে তো এই নিবন্ধ নয়। বাগবাজারের নতুন প্রকাশনালয় ‘সূত্রধর’ নানা লুপ্তপ্রায় গ্রন্থের নব-প্রকাশনায় ব্রতী হয়ে দুর্গাদাস লাহিড়ীর এই সওয়া-শ’ বছরের প্রাচীন পুস্তকখানির (প্র প্র ১৮৮৫) পুনঃপ্রকাশ করেছে দেখে বইমেলার স্টলে সেটি হাতে তুলে নিই, কারণ জানার ইচ্ছে ছিল, মহাগ্রন্থ ‘বাঙালীর গান’ (১৯০৫ খৃ)-এর সংকলক অস্পৃশ্যতাসমর্থক, গোঁড়াহিঁদু ও নারীশিক্ষাবিরোধী দুর্গাদাস কেন ক্রিশ্চান কৃষ্ণমোহনকে ‘আদর্শ চরিত্র’ বলে মনে করেছিলেন? সম্পাদনাকার শ্রীমানবেন্দ্র নস্কর অবিশ্যি এ’বিষয়ে কোনো আলোকপাত করেননি, না মুখবন্ধকার অধ্যাপক অলোক রায়।

    হ্যাঁ, ১৮৩১-এ তাঁর বাসস্থান শ্যামপুকুর ১১ই গুরুপ্রসাদ চৌধুরি লেনের সেই গোমাংস ছোঁড়ার ঘটনাটি এখানে উল্লেখিত আছে বৈকি, যেটাকে তাঁর জীবনীকারগণ কৃষ্ণমোহনের ধর্মান্তরী হবার কারণ বাৎলান। গল্পটি বহু-উল্লেখিত হলেও ফের লিখি, কারণ এ’হেন বাঁদরামি সেকালে কেন একালে করলেও কেউ মেনে নেবে কী, মিসাইলগুলি গোহাড় না হয়ে চিকেন-বাটার-মশালা হলেও? ঘটনাটি এইঃ প্রাচীন অনড় হিন্দুধর্মের ওপর কষাঘাত করতে ইয়ং বেঙ্গলিগণ গোমাংসভক্ষণকে তাঁদের ধর্মে পর্যবসিত করে ফেলেছিলেন। এ’হেন এক দিনে, তাং ২৩ অগাস্ট, বন্ধুদল কেষ্টার বাড়ির ছাদে মিলিত হয়ে পড়লেন ও রাঁধা গোমাংস কিনে এনে উদরপূজন চললো। গল্পটা এ’পর্যন্তই হলে তো আর ইতিহাস হয় না, কারণ এ’তাদের নৈমিত্তিক ছিল। কিন্তু তার পর তেনারা সেই উচ্ছিষ্ট হাড়গুলি ছুঁড়ে ছুঁড়ে চারপাশে প্রতিবেশিদের গৃহে ফেলতে লাগলো, ও ‘গোমাংস’ ‘গোহাড়’ ‘তোদের জাত গেল’ বলে বলে হিন্দুধর্মের ওপর আঘাত হানতে লাগলো। এর ফলশ্রুতি পাড়াজুড়ে তুলকালাম ও কৃষ্ণমোহনের বিতাড়ন।

    আলেকজান্ডার ডাফসাহেব তখন দু’ দু’বার জাহাজডুবির গাঁট পেরিয়ে স্কটল্যান্ড থেকে এসে ঘাঁটি গেড়েছেন ও বর্ণহিন্দুদের ঈশাদেবের মন্ত্রে দীক্ষিত করতে বদ্ধপরিকর হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তিনি উদ্ভ্রান্ত কৃষ্ণমোহনকে ঠিক স্পট করে ফেল্লেন ও ব্যাপ্‌টাইজড করলেন মিরজাপুর স্ট্রিটের ঘোষালবাড়ির দালানে বসে, ১৭ অক্টো ১৮৩২। কৃষ্ণমোহন অবিশ্যি ডাফের ডিসেন্টার ‘প্রেসবিটারিয়ান চার্চে’ও বেশিদিন থাকেননি। আমহার্স্ট স্ট্রিটের ‘চার্চ অব ইংল্যান্ডে’র স্কুলে বেশি মাইনে পেয়ে সেই চাকুরি নিয়ে নিলেন। ডাফ ক্ষেপে লাল! পরে মধুসূদনকে কেরেশ্চান করারও প্রধান হোতা ছিলেন এই রেভ. কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই ব্যক্তিটিকে দু’চক্ষে দেখতে পারতেন না--সে তাঁর স্বার্থান্বেষীপণার জন্যে। যে হেয়ার সাহেব বালক কৃষ্ণকে পথ থেকে তুলে এনে শিক্ষাদীক্ষা দেন, চাকুরি দেন, তাঁর প্রয়াণের দিন (১ জুলাই ১৮৪২) সারা কলকাতা শোকমিছিলে ভেঙে পড়লেও কৃষ্ণমোহন আসেননি শ্রদ্ধা জানাতে। কারণ তদ্দিনে তিনি মেইনস্ট্রিম ‘চার্চ অব ইংল্যান্ডে’র রেভারেন্ড হয়ে পড়েছেন ও অফিসিয়ালি তার যাজকগণ হেয়ারকে ত্যাজ্য করেছিল তাঁর ‘নাস্তিকতার’ জন্যে; ক্রিশ্চান সমাধিস্থলে দফনাতেও দেয়নি তারা মহামতি হেয়ারের মরদেহ। এই কৃষ্ণমোহনই আবার পরে বার্ষিক ডেভিড হেয়ার স্মারক-বক্তৃতার তুখোড় বক্তা হয়ে পড়েছিলেন। ১৮ বৎসর বয়েস না-পুরোতে অসাধারণ The Enquirer পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন (প্র প্র ১৮৩১ খৃ ১৭ মে), পরবর্তীতে ১৩ খণ্ডে ইংরেজি-বাঙলায় এন্‌সাইক্লোপেডিয়া লেখেনঃ ‘বিদ্যাকল্পদ্রুম’! এশিয়াটিক সোসাইটির সভ্য ছিলেন। ছিলেন বহুভাষাজ্ঞানীঃ গ্রিক লাটিন হিব্রুভাষায় পণ্ডিত!

    ***

    এক প্রতিষ্ঠিত পণ্ডিত ও সমাজে গণমান্যের শতাব্দীপ্রাচীন জীবনীগ্রন্থের পুনঃপ্রকাশে কিছু অস্বস্তিকর প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যাওয়া স্বাভাবিক--সময়ের দূরত্বের জন্য যাকে দেখার দৃষ্টিটা বদলেছে, বিশেষতঃ, যেখানে রয়েছেন এক নামি সম্পাদক ও দু’টি লম্বা মুখবন্ধ। তার সদুত্তর না পেলে মনে হবে না যে ডেড়শ’টি টঙ্কা ব্রেথা গেল? সওয়া-শ’ বৎসর প্রাচীন জীবনীখানি তো পাবলিক ডোমেইনেই চলে গেছে, পড়তে চাইলে নেট খুঁজে অনলাইন পড়ে নেওয়া যায়। কয়েকটি ছবি ছাপা হয়েছে বইটিতে, মান মামুলি। পরিশিষ্টের ‘বিষয়-পরিচিতি’-তে কয়েক ব্যক্তি-সংস্থান-পত্রিকার পরিচিতি ছাপা হয়েছে খাপছাড়াভাবে। ছাপাই-বাঁধাইয়ের মান ভালো। শেষের বিষয়/ব্যক্তিনামের পৃষ্ঠাভিত্তিক তালিকাটিকে ‘নির্দেশিকা’ কেন বলা হল?

    দশে পৌনে তিন দেওয়া যাক বইটিকে। দামটা বড্ড বেশি।



    || ও তুমি আইস রে, দয়াল আমার মুর্শিদ রে ... ||

    দুর্গাদাস লাহিড়ি সম্পাদিত ‘বাঙালির গান’--বর্তমান সংকলনের সম্পাদক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, সহ-সম্পা. সর্বানন্দ চৌধুরি; প্র প্র ১৯০৫, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাদেমি সংস্করণ ২০০১; দামঃ সাতশো টাকা ISBN 81-7751-036-3

    দুর্গাদাসের ওপরের বইটিকে পাশমার্ক না দিতে পেরে মনে খুঁতখুঁতানি; মনে হল, কেন না তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠকীর্তি ‘বাঙালির গান’ মহাগ্রন্থটি সম্বন্ধে দু’কথা লিখি? বালাই ষাট, একে যেন ‘গ্রন্থ-সমালোচনা’ ভেবে না ফেলেন কেউ। না, এ’কোনো ‘গ্রন্থ-পরিচয়’ও নয় কারণ ইতোমধ্যেই এই গ্রন্থ এক আকর সঙ্গীতকোষ হিসেবে মান্য। এ’ হল শুধু একবার ফিরে তাকানো, বিস্ময়ে, শ্রদ্ধায় ও অনুসন্ধিৎসায়! এক হতদরিদ্র স্বল্প/স্ব-শিক্ষিত ব্রাহ্মণসন্তান, অর্থাভাবে যাঁকে বহুদিন অনাহারে কাটাতে হয়েছে, যাঁর কোনো পৃষ্ঠপোষক কখনো ছিলনা, বিজলি আসার আগের কালে কদমতলার (হাওড়া) নিজআবাসে এক কাঠের মুদ্রণযন্ত্র বসিয়ে মহা মহা গ্রন্থ রাজি প্রকাশ করতে ব্রতী হয়েছিলেন তিনি--যাদের লেখক ও প্রকাশক একাধারে দুর্গাদাসইঃ আট খণ্ডে ‘পৃথিবীর ইতিহাস’, বাঙলায় বেদগ্রন্থমালা, এমনকি গল্প-উপন্যাসও, এবং , এবং ... সহস্রাধিক পৃষ্ঠার ‘বাঙালির গান’---এই বইটি! ‘অনুসন্ধান’ ও পরে ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকার সম্পাদক দুর্গাদাস লাহিড়ী (১৮৬৩-১৯৩২) প্রায় রবীন্দ্র-সমসাময়িক ছিলেন। তবু এই বইয়ে (প্র প্র ১৯০৫) রবীন্দ্রনাথেরও ২৮১টি গান স্থান পেয়েছে। ভুললে চলবে না, তখনও কিন্তু রবিবাবুর গান ব্রাহ্ম গণ্ডি ডিঙিয়ে আমজনতার ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’ হয়ে ওঠেনি। লাহিড়ীমশায়ের মূল লক্ষ্য ছিল ‘ফিরে দেখা’---যে-সকল বাঙলাগানের সে-তাবৎ কোনো সংকলন ছিল না, তাদের হারিয়ে যেতে দেওয়া নয়, গ্রন্থিত করে ফেলা। তাই দুর্গাদাসের এই সঙ্গীতকোষে যেমন নিধুবাবু, দাশরথি রায়, রামপ্রসাদ, ভোলা ময়রা, কমলাকান্ত, ভারতচন্দ্র-র মত নামী গীতিকারগণ স্থান পেয়েছেন, তেমনি আছেন, কেষ্টা মুচি, রূপচাঁদ পক্ষী, গোপাল উড়ে, পাবনাবাসী দীন বাউল--যাঁদের গান ইনি সংকলিত করে না রেখে গেলে আজ একেবারেই হারিয়ে যেত। এ’মহাগ্রন্থটিকে তাই শতাব্দীপ্রাচীন এক সেলাম না জানিয়ে উপায় নেই!

    ***

    ২২৭ জন কবি/গীতিকারের ৫৬৬৩টি গান স্থান পেয়েছে ১০৭০ পৃষ্ঠার এই মহাগ্রন্থে (সাইজঃ অক্টেভোর চেয়ে বড়—৬X৯ নয়, ৭X৯ ইঞ্চি)! কবির নামভিত্তিক ও গানের প্রথম লাইনভিত্তিক দু’টি দীর্ঘ সূচিপত্র বড্ড কাজের। প্রত্যেকের সম্বন্ধে স্বল্পকথায় পরিচিতিও ধরা রয়েছে। প্রতিটি গানের রাগ ও তালের উল্লেখ গোড়াতেই রয়েছে। ভাবলে বিস্ময় লাগে না, পাঠক, যেকালের থেকে ইন্টারনেট নামক বস্তুটি একশতাব্দী দূরে ছিলো, কলকাতায় ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি তদ্দিনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলেও তার ক্যাটালগে নিশ্চয়ই এ’হেন গানের কোনো বই ঠাঁই পেতো না, এশিয়াটিক সোসাইটিতেও হয়তো না, সেকালে এক দরিদ্র বাঙালী আদুড়গায়ে পায়ে হেঁটে গ্রামেগঞ্জে ঘুরে ঘুরে লুপ্তপ্রায় গান সংগ্রহ করে বেড়াচ্ছেন?! বঙ্গদেশে এক মাত্র তুলনীয় অভিধানকার হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বা (কিছুটা) দীনেশচন্দ্র সেন/আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ! তবু, মানবেন নিশ্চয়ই, হরিচরণ বা দীনেশচন্দ্রের প্রচার বা স্বীকৃতির আধ আনা পাননি দুর্গাদাস। অনেক খুঁজে খুঁজে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের গায়ে পঃ বঙ্গ বাংলা একাদেমির বিপণিতে বইখানি কিনতে গিয়ে শুধোই, এত স্বল্পমূল্যে কী করে তাঁরা এই কোষগ্রন্থখানি দিতে পারছেন? জানা গেল, লাইব্রেরির অর্ডার ছাড়া বইটির বিক্রি তিনমাসে দেড়খানিও হয় না! বোঝো !

    ***

    নিবন্ধের মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। গান শোনাই থুড়ি, লিখি কয়েকটাঃ

    “খ্রিষ্টে আর কৃষ্ণে কিছু প্রভেদ নাই রে ভাই/শুধু নামের ফেরে মানুষ ফেরে/এ ও কোথা শুনি নাই।”

    তুলনীয়ঃ পান্নালালের গলায় জনপ্রিয় “জেনেছি জেনেছি তারা, তুমি জানো ভোজের বাজি ... ”

    প্রথমটি, না না উত্তম-মান্না-গৌরী-অনিল টেট্রাডের নয়, আসল এন্টনি ফিরিঙ্গি-সাহেবের গান (পৃ. ১৯৬)। আর দ্বিতীয়টির রচয়িতা ত্রিপুরার ভক্তকবি রামদুলাল দেওয়ান (১৭৮৬-১৮৫২ খৃ.)।

    বা,
    জানতাম কি, যে ভোলা ময়রা-নিলু ঠাকুরের সমকালীন এক মহিলা-কবি ছিলেন যজ্ঞেশ্বরী, যিনি কৃষ্ণলীলায় এমন আধুনিকভাবের গান বেঁধেছিলেন, “আমি কুলবতী নারী, পতি বই আর জানিনে ... নাহি চেন ঘর বাসা কী বসন্ত কী বরষা/সতীরে করে নিরাশা, অসতীর আশা পুরাও ...”?

    বা,
    স্বামীজীর এক প্রিয় গান ‘মন চলো নিজ নিকেতনে’-র রচয়িতা ছিলেন আদি-ব্রাহ্মসমাজী অযোধ্যানাথ পাকড়াশী (১৮০১-১৮৭৩ খৃ)--এ’ও তো জানতাম না। এই অযোধ্যানাথকেই মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরবাড়ির মহিলাদের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করেন।

    বা, ... বা, ... বা, ...

    লিখতে বসলে এ’বইয়ের কথা তো শেষ হবার নয়। মনে পড়ে, আজ থেকে এক দশক আগে কলকাতা থেকে এ’বই কিনে নিয়ে গোরক্ষপুরের এক প্রত্যন্ত গ্রামে বসে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে এ’বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টিয়ে উল্টিয়ে সময় কাটাতাম। না, নেট-ফেট তখনও এত ব্যাপ্ত হয়নি, সেখানে সহজে ধরাও যেত না।

    ***

    তবে, বহু খুঁজেও এই সহস্রাধিক পৃষ্ঠার পুস্তকে না’ত সঙ্গীতের কোনো উল্লেখ পাইনি; না, ‘নাথ’ গীতিকা নয়, মহানবীজীর (সাঃ) বন্দনাগীতি না’ত সঙ্গীতের কথা বলছি, না এতে আছে মুহররমের মরমস্পর্শী মর্সিয়া গান (জারিগান)। না, নাথ-গীতিকাও নেই, নেই অন্যান্য ‘নিচুতলা’-র মানুষের গানঃ দীনদয়ালের গান বা যাদুবিন্দু বা দুলালচাঁদের (কর্তাভজা) গান। সে-সবের খোঁজ হয়তো পাননি শহরবাসী উচ্চবর্ণীয় দুর্গাদাস। লালন সাঁইয়ের মাত্র দু’টি গান ঠাঁই পেয়েছে, পঞ্জু শাহের নাম নেই। ত্রিপুরার রামদুলালের মত ময়মনসিংহের কবি লাল মাহমুদও তো গেয়েছিলেন, ‘কেহ তোমায় বলে কালী, কেহ বলে বনমালী/কেহ খোদা আল্লা বলি ডাকে সারাৎসার’। কৈ, এই বইয়ে নেই তো।

    ***

    না, নেই নেই আর বলে না, যা আছে তার থৈ কৈ? দুর্গাদাসের সারস্বতসাধনায় মুগ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ পত্র লেখেনঃ ‘আপনি যে বৃহৎ ব্যাপারে প্রবৃত্ত হইয়াছেন, তদ্দ্বারা দেশের মহৎ উপকার হইবে, সন্দেহমাত্র নাই’! সংকলনটির গোড়াতেই সর্বানন্দ চৌধুরীকৃত ‘ভূমিকা’খানি এক স্বর্ণখনি, নির্দেশিত ‘গ্রন্থপঞ্জী’টিও। প্রকাশক একটা মহান কাজ করেছেন সন্দেহ নেই , কিন্তু বানানগুলি একাডেমির ছাঁচে না ঢেলে অপরিবর্তিত রাখলে পারতেনঃ ‘বাঙালি’ নয়, ‘বাঙালী’; ‘লাহিড়ি’ নয়, ‘লাহিড়ী’---লেখক যেমন লিখে গিয়েছিলেন। এর একটা আর্কাইভাল ভ্যালুও আছে,না?



    || বিনা দীবারোঁ কা ঘরঃ মন্নু ভাণ্ডারী ||

    মন্নু ভণ্ডারী কী ইয়াদগারী কহানিয়াঁ--শ্রীমতী মন্নু ভাণ্ডারী; হিন্দ পকেট বুকস প্রা লি; নঈ দিল্লী-১১০০০৩; ISBN 978-81-216-1492-4

    ডিংডং ডোরবেল বেজে উঠতে ব্যাজার মুখে খুলে দেখি স্যাঙাৎ-প্রবর লগেন চন্দর। চারপাশে ছড়ানো বইখাতায় একবার চোখ বুলিয়ে দেঁতো হেঁসে বল্লে, ‘অ, লিকচিS বুজি?’ তারপর মন্নু ভাণ্ডারীকে দেখে উক্তি, “ক্ষেপেচিS নাকি? ঐ ‘সাহেবি-বাংলা’ কাগজে হিন্দি বইয়ের কথা ছাপবে?”

    পাগল আর সাঁকোর গপ্পো। উঁচু তাক থেকে ভারিভুরি দুগ্‌গাবাবুকে পাড়তে গিয়ে তন্বী মন্নুজীও যে নেমে পড়েচেন, খ্যাল ছিল না। প্রায় সাড়ে তিন দশক আগে দিল্লির এক হিন্দী-সাহিত্যসন্ধ্যা মনে পড়ে গেলঃ মিরান্ডা হাউজের অধ্যাপিকা মন্নু ভাণ্ডারী প্রধান বক্তা! মার্কসবাদে গজগজে মগজে তখন প্যানপ্যানে ও ‘অ-প্রগতিশীল’ সব সাহিত্যকে হেয় করতে শিখেছি। তা সত্ত্বেও, জে এন ইয়ুতে সীতারাম ইয়েচুরির স্টাডি-সার্কেল কেটে গিয়ে যে ছিলুম তা সহপাঠিনী মেধার প্রিয় লেখিকার সভায় যাবার পুনঃপুনঃ অনুরোধে যত না, তার চেয়ে অধিক ছিল সেই স্কুলের-কালে দেখা বিদ্যা সিনহা-অমল পালেকরের মিষ্টি ছবি ‘রজনীগন্ধা’-র (১৯৭৪) লেখিকাকে চাক্ষুষ করার বাসনা। ঢুকতে ঢুকতে শুনি, মন্নুজী বলতে শুরু করে দিয়েছেনঃ ’৫০-এর দশকে তাঁর কলকাতাবাসের দিনগুলো, বালিগঞ্জ শিক্ষাসদনে পড়ানো ... প্রথম ছোটগল্প ছেপে বেরোনোর উত্তেজনা ... বিভোর হয়ে শুনে গেছি এক সিম্পল দিদিমণির অন্তরঙ্গ কথন ... কী আধুনিক (ওঁনার আর আমার পিতৃদেবের একই জন্মদিন, ১৯৩১এ’!) ... ওনার প্রথম প্রকাশিত গল্পমালার নাম ছিল ‘ম্যায় হার গয়ী’!! তারপর লাইব্রেরি থেকে ওঁর বই তুলে ... নাঃ মন্নুজী কক্ষণো হারেননি।

    ***

    বৎস, এটা ‘গ্রন্থ-সমালোচনা’-র কলম, স্মৃতিচারণার নয়। আর, মন্নু ভাণ্ডারী বা কৃষ্ণা সোবতী বা মৃদুলা গর্গের মত হিন্দিভাষার লেখিকারা কে কেমন লিখেছেন তার তূল্যমূল্য বিচার করার মত জ্ঞান নেই আমার ঘটে। সোমা-পিসিমা ছিলেন এক বিধবা-অবীরে মানুষ। পটভূমি পঞ্চাশের দশকের গোবলয়ের কোনো কসবা। সারাদিন বকবক করেন ও না-ডাকলেও এর ওর ঘরে গিয়ে কার পাঁপড় বেলে দিচ্ছেন তো কার ঘরে কাঁথা সেলাই করে দিয়ে আসছেন। নিকটজন চোখ ট্যারায়, ‘কেন তুমি বিনা-বোলে এর-ওর-তার বাড়ি গিয়ে ... ’। “বলিস কী রে রাধা, ও’পাড়ার মাধবের ভাইঝি কি আমার পর হল? নিজের লোক করবে না তো কে ... ?” এ’হেন সোমাপিসিমার প্রয়াত দেবরের মেয়ের বিয়া যখন মস্ত এক ঘরে ঠিক হল ওনার নিজেরই মনে হলো, নাঃ, এখানে অন্ততঃ রবাহূত যাওয়া উচিত হবে না। কিন্তু রাধা যখন জানালো যে সে নিজচোখে নিমন্ত্রিতের লিস্টিতে পিসির নাম দেখে এসেছে,--‘ওরা তোমায় ডাকতে লোক পাঠাবে বিয়ের দিনে ... ’, তখন আনন্দে-উত্তেজনায় ঘরে ঘরে গিয়ে গিয়ে পিসি জানিয়ে এলো, ‘বলেছিলাম না, আমাকে বাদ দিয়ে কখনো ...’ । কিন্তু মহা দুশ্চিন্তায় পড়া গেল, খালি হাতে তো আর যাওয়া যায় না এমন কুটুমবাড়িতে। সম্বল বলতে মৃতপুত্রের এক অঙ্গুঠি ... যেটা শত দারিদ্রেও হাত ছাড়া করেনি পিসি ... এখানটায় ইন্দিরঠাকরুণ মনে পড়ে যায় না, পাঠক ... সেই মরা মেয়ে বিশ্বেশ্বরীর শাড়িটা? কিন্তু ক’দিনই বা আর বাঁচবো ... এখন মানটা তো বাঁচুক ... এই ভেবে সেই আঙটি বেচে উপহারের সিন্দুরদান কেনা ... আর লগ্নের দিন সকাল থেকে পথের মোড়ের দিকে তাকিয়ে থাকা তাকিয়ে থাকা তাকিয়েই থাকা কৈ কেউ ডাকতে তো এলো না ... শেষে রাত ন’টায় ঘরে চুলাটা ধরাতেই হল .... যেন ‘থার্টি সিক্স চৌরঙ্গী লেন’-এর বৃদ্ধা ভায়োলেট স্টোনহ্যাম...[গল্পটার নাম ‘একেলী’]।

    ***

    মন্নু ভাণ্ডারীর একাধিক গল্প-উপন্যাস নিয়ে সফল সিনেমা ও নাটক হয়েছেঃ ‘ইয়ে হি সচ হ্যায়’ (রজনীগন্ধা), ‘স্বামী’ (চিত্রনাট্য), ‘সময় কি ধারা’, ‘মহাভোজ’ (নাটক)। কিন্তু এহ বাহ্য, কোনো বাণিজ্যিক সাফল্য তেমনভাবে ছোঁয়নি সরল দিদিমণি মন্নু ভাণ্ডারীকে ... উনি তখন ঘরে বসে নিবিষ্টি মনে লিখে চলেছেন, ‘ত্রিশঙ্কু’, ‘ছত বানানেবালা’ বা ‘ক্ষয়’-এর মত অনবদ্য সব ছোটগল্প। ওনার সবচেয়ে বিখ্যাত ও জনপ্রিয় উপন্যাস নিশ্চয়ই, ‘আপকা বান্টী’ (১৯৭১), কিন্তু আমাদের নরেন মিত্রমহাশয়ের মত ছোটগল্পই মন্নু ভাণ্ডারীর আসলি তাকতঃ ‘দো কলাকার’, ‘নঈ নৌকরি’, ‘স্ত্রী-সুবোধিনী’--হ্যাঁ, এইস-ব গল্পগুলোই স্থান পেয়েছে বর্তমান সংকলনটিতে। পড়তে বসলে না শেষ করে ওঠা যায় না। সাহিত্যিক-স্বামী রাজেন্দ্র যাদবের সঙ্গে যুগ্মভাবে লেখা ‘এক ইঞ্চ মুস্কান’ও মন্নুজীর এক চমৎকার উপন্যাস। ‘বিনা দীবার কা ঘর’ এক মঞ্চসফল নাটক। এ’সবই, অবশ্য, শুনে-পড়ে লিখলাম--ওনার ছোটগল্প ছাড়া আর কিছু তেমন করে পড়া হয়ে ওঠেনি। কবে আর পড়বো?

    ***

    আমাদের অধিকাংশ বাঙালির একটা মস্ত অসভ্যতা হল যে আমরা হিন্দি সহ ভারতের নানাভাষার সাহিত্যকে হেয় করতে শিখে যাই ছোটবেলা থেকে (‘খোট্টা’ বলে): ভাবটা, আমাদের রবীন্দ্রনাথ আছেন, শরৎচন্দ্র আছেন, জীবনানন্দ আছেন আমরা কেন মহাদেবী বর্মা বা নিরালা বা মান্টো পড়তে যাবো? কী নাম বললে, ফকির মোহন সেনাপতি? উড়ে? সে যেন আমাদের রাঁধুনি বামুন ঠাকুরের সমতুল্য। লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া ... সে কে? আমরা ওয়ার্ডসওয়ার্থ পড়েছি, কামু-কাফকা নিয়ে চায়ের কাপে তুফান তুলি, এদিকে ভারতেন্দু হরিশ্চন্দ্রের নাম শুনিনি; ‘নাদুঙ্গাড়ি কে?’ তো কুইজের প্রশ্ন! ঠিক বৃটিশরা যেমন হেয় চোখে আমাদের ভারতীয়দের দেখতো, তাদের নিকটতম তাঁবেদার আমরা বাঙালীরা সেভাবেই বিহারী-ওড়িয়াদের দেখি।

    ***

    মন্নুজী কিন্তু মেয়েদের গল্পই বেশি শুনিয়ে গেছেন--তাঁর গল্পের প্রধান চরিত্র মেয়েরাই দখল করে আছে। তাঁর রমা-দীপারা আমাদের পাশের বাড়ির মেয়েই। তাদের হাসিকান্না-আনন্দবেদনা আমার বোন বা মেয়েরও হতে পারে। এইমাত্র ইউ-টিউবে ওনার এক পুরনো ইন্টারভ্যু দেখছিলাম। অবলীলায় বললেন, “অত কোনো ইজ্‌ম-টিজম আমি জানিনা, বুঝিনা। আমি মূলতঃ শিক্ষিকা। পড়িয়েই সব থেকে বেশি আনন্দ পাই। পাশাপাশি চারপাশে যা দেখি যাদের দেখি তাদের নিয়ে দু’কলম লিখি। এটা আমার শখ। পড়ানোটাই মূল পেশা।” ভাবুন, এ’কথা বলছেন এক বাণিজ্যসফল লেখিকা, চলচ্চিত্রজগতেও লেখিকা-চিত্রনাট্যকার হিসেবে যিনি অতীব মাননীয়া। কোথায় যেন বেগম রোকেয়া অনুরণিত হন। মন্নুজী কলকাতার মেয়ে, আশাপূর্ণা দেবীর সম্বন্ধে নিশ্চয়ই ওয়াকিবহাল আছেন। কী চোখে ওনাকে দেখেন, জানতে ইচ্ছে করে। দেখি, একটা চিঠি লিখবো।

    ***

    হিন্দি পড়া যদি অভ্যেসে না থাকে, তবে প্রথমেই মধুশীলা বা নিরালা না ধরে মন্নু ভাণ্ডারীর মত সিম্পল লেখা দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। দেবনাগরী লিপির সঙ্গে তো অনেকেরই পরিচয় আছে, বাকিটা পড়তে পড়তে সড়গড় হয়ে যাবে। হিন্দি ব্যাকরণ জানি না বলে কোনো সমস্যা হবে না । এনার ভাষা অত্যন্ত সরল ও কথ্য। তৎসম শব্দ অত্যল্প, ফার্সি শব্দ প্রায় নেইই, ভাব আটপৌরে ...

    এতোটা লিখে ভাবছি, দোস্ত নগেন্দ্রচন্দ্র কি ঠিক বলিয়াছিল? ‘পরবাস’-সম্পাদক কি হিন্দি বইয়ের রিভিউ ছাপবেন?



  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)