যথারীতি ফিরে এল আগস্ট মাস। শোকাবহ এ মাসটা এলেই মনে পড়ে অনেক-অনেক মৃত্যুর কথা, অনেক ঐতিহাসিক কাহিনীর কথা—যার বেশ কয়েকটি অস্বাভাবিক ও মর্মান্তিক। ১৯৪৭ সনের এ মাসে, প্রায় দুশ’ বছর ইংরেজ শাসনের পরে, ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে—দ্বিখণ্ডিত ভারত, ভারত ও পাকিস্তান দুই সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্ম প্রকাশ করে এ মাসেরই ১৪ ও ১৫ তারিখে। ১৬ই আগস্ট ১৯৪৬ ‘ডাইরেক্ট একশন’ ঘোষণার পর হিদু-মুসলিম দাঙ্গায় মৃত্যু বরণ করে হাজার হাজার মানুষ। এ মাসে বাংলা সাহিত্যের দুই মহীরুহ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের তিরোধান (১৯৪১ ও ১৯৭৬)। শহীদ ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয় এ মাসে, ১৯০৮ সনে। এ মাসেই (৬ই আগস্ট ১৯৪৫) জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে প্রথম আণবিক বোমা ফেলে আমেরিকা, যার ফলে জীবন ও সম্পদের অকল্পনীয় দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষয়-ক্ষতি হয়! এবং, ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ নির্মমভাবে সপরিবারে নিহত হন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সনে পাক সেনাবাহিনী ২৫শে মার্চ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে (তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান) যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, আগস্ট মাসে তার কোন বিরতি/কমতি ছিল না। কত লোককে যে ওই নরপিশাচরা হত্যা করেছিল, আর শ্লীলতা হরণ করেছিল কত মা-বোনের তার কোন হিসাব নাই। এত সব অগণিত নিহতদের মধ্যে বেশ জানা-চেনা ও খুবই কাছের, এমন এক অন্তরঙ্গ বন্ধ্রুর কথাই আজ বিশেষভাবে মনে পড়ছে, যাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়—মনে করা হয় এ মাসেই, কারণ তাকে তার ঘর থেকে ধরে নেয়া হয়েছিল ১৯৭১-এর আগস্ট মাসের শেষের দিকে। আমার এ বন্ধুর নামঃ স্বনামধন্য সুরকার-কন্ঠশিল্পী (শহীদ) আলতাফ মাহমুদ ‘ঝিলু’।
পৈতৃক আদি নিবাস বরিশালের মূলাদী উপজিলার ‘পাতার চর’ গ্রামে হলেও, আলতাফের জন্ম বরিশাল শহরে। বাবা মরহুম জনাব নাজেম আলী সাহেব বরিশাল জেলা বোর্ডের সেক্রেটারী হিসেবে কাজ করতেন, থাকতেন বরিশাল শহরের প্রাণকেন্দ্র ‘ফকির বাড়ী’ এলাকায়। ওদের পরিবারের আর কারুর সম্পর্কে আমার তেমন জানা নাই। তবে যতটা মনে পড়ে, ওর ঘরে ছিলেন সৎ-মা—নিজের মা আগেই এন্তেকাল করেন। হয়তো, এ কারণেই, বেশ একটু বাউণ্ডুলে স্বভাবের ঝিলুর ঘরের টানটা আর পাঁচটা ছেলের চেয়ে একটু কম ছিল—সেই বালক কাল থেকেই সে ছিল ঘর-বিমুখ, আড্ডাবাজ!
অপরদিকে, অজ পাড়াগাঁয়ের ছেলে আমি প্রথম বরিশাল যাই পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র হিসাবে, জানুয়ারী ১৯৩৯ সনে। ঝিলুর সাথে প্রথম পরিচয়? অনেক পরে—মনে হয় ১৯৪৩ সনে। বয়সে দু’এক বছরের বড় হলেও, আমার চেয়ে দুই শ্রেণী নীচে পড়ত সে। যেখানে আমরা থাকতাম—বরিশালের ‘আলেকান্দা’—সেখানকার একটি ছেলে (প্রয়াত, ইঞ্জিনিয়ার মকবুল আলী) ঝিলুর সাথে বরিশাল জিলা স্কুলে একই ক্লাসে পড়ত। মাঝে মাঝেই সে মকবুলের সাথে এদিকটায় আসত। ঠিক এ সময়ই, ওরা দু’জনই বরিশাল জিলা ম্যজিষ্ট্রেটের তদানীন্তন স্টেনোগ্রাফার, গৈলা-আগৈলঝাড়ার প্রয়াত (দাদা) সুরেন রায়ের কাছে বেহালা শিখতে শুরু করে। ওদের দুজন যখন মকবুলদের বৈঠকখানায় একযোগে বেহালা চর্চা করতো, ভীষণ উপভোগ করতাম আমি। আমার নিজেরও খুউব শখ হত; কিন্তু হায়! উপায় ছিল না। কারণ দুটোঃ আর্থিক ও ধর্মীয়। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে ঝিলুর খুব ভাল হাত ছিল চারু শিল্পেও—চমৎকার আঁকতো সে! পরবর্তীতে অনেক আন্দোলনের বড় বড় পোষ্টার লেখায়ও থাকতো তার সক্রিয় হাত।
আমি আলেকান্দা ছেড়ে ’৪৫-এ প্রথম বর্ষের ছাত্র হিসেবে বি এম কলেজ হোষ্টেলে চলে যাই; এবং সেখানে পরের বছর, ’৪৬-এ অপ্রত্যাশিতভাবে নতুন করে ঝিলুর সাথে দেখা হয়ে যায় কলেজ হোষ্টেলে—একেবারে আমারই রুমে! কী অদ্ভুত, কল্পনাতীত কাকতালীয় ঘটনা! কী? না, ওর এক আত্মীয় (বেহাই) মূলাদীরই মজিবুল হক আমার রুমমেট—পড়াশুনায় এক শ্রেণী নিচে! ঝিলু তখনও স্কুলে। শুরু হয় ওর ঘন ঘন যাতায়াত, বেড়ে যায় আমার সাথেও অন্তরঙ্গতা। এ সময় থেকে, মাঝে মাঝে সে কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও অংশ নিতে শুরু করে। এ ব্যাপারে ফকিরবাড়ীরই, কলেজের প্রাক্তন এক জাঁদরেল ছাত্রের বিশেষ ভূমিকা ছিল। তিনি ছিলেন সে কালের মুসলিম লীগ ছাত্র-নেতা মরহুম কাজী বাহাউদ্দীন, যার স্থান ছিল বরিশালের বিখ্যাত মুসলিম ছাত্র লীগ নেতা (পরবর্তীতে ‘বাকশাল খ্যাত’) মরহুম মহীউদ্দিন আহমদের পরে পরেই। এ সময়টায় ঝিলুর সাথে খুব ঘনিষ্টতা হয়—ঘরোয়া বৈঠকে গান, কখনও কখনও বেহালা শোনা, একত্রে সিনেমা দেখা, সাধ্যমত রেস্তোরায় চা-সিঙ্গাড়া-পুডিং ... ইত্যাদি।
ঠিক এ সময়ই, একদিন ঝিলু তার নিজের নাম সম্পর্কে একটি কথা বলেছিল যা খুব কম লোকই জানেন। ওর বাপ-মা’য়ের দেয়া আসল নাম ‘আলতাফ মাহমুদ’ ছিল না। কী ছিল তা-ও মনে নাই—হয়তো, বাবার নামের ‘আলী’র সাথে মিল করে ‘আলতাফ আলী’, বা ‘আলতাফ হোসেন’ বা ‘আলতাফ উদ্দীন’। সাংস্কৃতিক মহলে ভাল গায়ক হিসেবে পরিচিতি পাওয়া, এবং নিজের উপর স্থির আস্থা অর্জনের পর, ওর মাথায় একটা খেয়াল আসে। মনে আসে ওর খুব প্রিয়, বিখ্যাত গায়ক ‘তালাত মাহমুদ’ এর কথা। অতঃপর সিদ্ধান্ত নেয় ওই নামের সাথে মিল রেখে, নিজের নাম ‘আলতাফ মাহমুদ’ রাখার! সেই থেকে সর্বত্র ‘আলতাফ মাহমুদ’ নামেই তার পরিচয়! কাগজ-পত্রেও, অবশ্যই।
কলেজের পাঠ সেরে ’৪৯-এ বরিশাল ছাড়ার পর দীর্ঘ দিন আমার যোগাযোগ ছিল না ঝিলুর সাথে। এমন কী, চিঠিপত্র আদান-প্রদানও না!
ইত্যবসরে, গত কয়েক বছরে আমার জীবনে ঘটে যায় অনেক কিছু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাহান্নের ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ এবং সে বছরই মাস্টার্স (পদার্থ বিদ্যা) শেষ করে, ফেব্রুয়ারী, ’৫৩ সনে খুলনা বি এল কলেজে অধ্যাপনা শুরু। মাত্র দু’বছরের মাথায় চলে যাই করাচী। পেটেন্ট অফিসে চাকুরী—‘এগজামিনার অব পেটেন্টস’! ’৫৪ সনের সাধারণ নির্বাচনে যুক্ত-ফ্রন্ট জেতার পরে, অনেক বাংলাদেশী (তদানীন্তন ‘পূর্ব পাকিস্তানী’) করাচী যেতে শুরু করে। ’৫৫ সনের শেষের দিকে কোন এক সময় আমার অফিসে হঠাৎ ফোনে ঝিলুর কন্ঠস্বর শুনে চমকে উঠি। প্রায় ছয় বছর পর (সে সময়ে ফোনের ব্যবহার ছিল বিরল একটা ব্যাপার)! সে জানতই না যে আমি করাচীতে! একজনের কাছে আমার কথা শুনেই এই ফোন। এত দিন পরে আবার যোগাযোগ। দারুণ ভাল লাগলো। আমি তখনও অকৃতদার; আমার সরকারী বাসায় আরও দু’জন বাঙালিদের নিয়ে মেস করে থাকি। আলাপচারী থেকে জানতে পারলাম যে, সে মেহমান হিসেবে একজনের বাসায় আছে—নিয়মিত থাকার মত কোন ব্যবস্থা তখনও হয়নি। সেদিনই বিকেলে দেখা হবার পরে পাকা কথা হল, ঝিলুও থাকবে আমার সাথে—মেসের নতুন মেম্বার হিসেবে। পরের দিনই তার যৎসামান্য মাল-পত্র নিয়ে চলে এল ‘পূর্ব জাহাঙ্গীর রোড'স্থ আমার ‘১৯/৫ ইস্ট’ নম্বর সরকারী ফ্ল্যাট-বাসায়।
এতদিনে, আব্দুল গফফার চৌধুরীর অমর গান, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী' গানের সুরকার হিসাবে প্রতিটি বিদগ্ধ বাঙালির কাছে আলতাফ অতি সুপরিচিত। এখানে বিশেষ ভাবে বলে রাখা অপরিহার্য যে, এ গানটিতে প্রথম সুর দিয়েছিলেন বিখ্যাত গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠ শিল্পী মরহুম আব্দুল লতিফ। পরে, আলতাফ সুর আরোপ করে প্রথমেই যায় লতিফ ভাইয়ের বাড়িতে এবং সর্বপ্রথম তাঁকেই শোনায় নিজের দেয়া সুরে গানটি গেয়ে। আলতাফের দেয়া সুরে, তারই কন্ঠে গানটি শুনে, লতিফ ভাই খুব খুশী হয়ে বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে বললেন, “আলতাফ, আমার দেয়া সুর আমি তুলে নিলাম; এ গান চিরদিন গাওয়া হবে একমাত্র তোমার দেয়া সুরে”! গুণীরাই জানেন এ ভাবে গুণের কদর করতে! এখানে একটি কথা উল্লেখ্যঃ এ চিরস্মরণীয় গানটির রচয়িতা এবং প্রথম ও দ্বিতীয় (চূড়ান্ত) সুরকার তিনজনই বরিশালের সন্তান!
বহুদিন থেকে, বেহালা বাজানো ছেড়ে দিয়ে, ঝিলু শুধু গান করে আসছে। কোন এক সময় বরিশাল থেকে ঢাকায় আসে এবং প্রধানত গণ-সঙ্গীতের দিকে ঝুঁকে পড়ে সে। ভাষা-সৈনিকদের নিয়ে ওর আর একটি গানও খুব জনপ্রিয় হয়েছিলঃ ‘…ওরে বাঙালি, ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি!’
হা, বলছিলাম আলতাফের করাচী অবস্থানের কথা। আমাদের মেসে আমরা সবাই ছোট বড় চাকুরে, মাসের প্রথম তারিখ বেতন পাই—একমাত্র আলতাফ ছাড়া! তখন পর্যন্ত, ওর কোন আয় নাই! এখানে আর একটি কথা না বললেই নয়। এত ভাল গায়ক হওয়া সত্ত্বেও, করাচী আসার আগে—অবশ্যই, রাজনৈতিক কারণে, ঢাকা রেডিওতে কোনদিন গান গাওয়ার সুযোগ তাকে দেয়া হয়নি। ’৫৪-এর সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিপুল জয়লাভে যখন বাংলাভাষারও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পাওয়া নিশ্চিত হয়, তখন পাকিস্তান রেডিওর প্রধান অফিস, করাচী থেকে একটি বিশেষ সঙ্গীতানুষ্ঠান চালু করা হয়, যাতে জনপ্রিয় বাংলা গানের সাথে সাথেই, তার উর্দু (অনুবাদ) সংস্করণ অবাঙালি গায়ক-গায়িকার কন্ঠে প্রচার করা হত আর তেমনি করা হত উল্টোটাও—অর্থাৎ উর্দু গান থেকে বাংলায়। উল্লেখ্য, এখানে আমারও একটু ভূমিকা ছিলঃ আমি বাংলা গানগুলোর ইংরেজি অনুবাদ করে দিতাম, যা থেকে উর্দু গীতিকাররা উর্দুতে গান আকারে লিখে অবাঙালিদের গাওয়ার মত করে দিতেন। এ-রকম একজন গীতিকার ও গায়কের নাম মনে আছেঃ খলিলুর রহমান (উনি বোধ হয় বিহারী ছিলেন)। তেমনি উর্দু গানের বাংলা করতাম যা থেকে বাঙালি লেখকরা বাংলা গান লিখতেন (‘ধামরাই’র মতিউর রহমান ছিলেন এমন সব লেখকদের মধ্যে একজন)। যাই হোক, আলতাফ প্রথম রেডিওতে গান গাওয়ার সুযোগ পায় এ কর্মসূচিতে। এ প্রোগ্রামে অন্য যারা গাইতেন, তাদের মধ্যে শেখ লুৎফর রহমান, বেগম লায়লা এমদাদ (রূনা লায়লার মা), মসিহুর রহমান (উপরোক্ত লেখক মতিউর রহমানের ছোট ভাই) ও বগুড়ার মোস্তাফা নূরুল মোহসীন (বিখ্যাত এম আর আক্তার মুকুল ও সাহিত্যিক মোস্তফা নূরুল ইসলামের ছোট ভাই)-এর নাম মনে পড়ে।
অল্প দিনের মধ্যেই, আলতাফের জুটে যায় কিছু গানের ছাত্র-ছাত্রী। গান শেখানো ও রেডিও প্রোগ্রাম থেকে এ ভাবে যৎকিঞ্চিৎ আয়ে তার মোটামুটি চলার ব্যবস্থা হয়ে যায়। তবে, আসলে আর্থিক দিক দিয়ে বেশ টানা-পোড়েনের মধ্যেই থাকত সে এবং আমি সহ, বন্ধু-বান্ধবের কাছে ধার-উদ্ধারের জন্য হাত পাততে হত প্রায়শঃই। দেশে তার ভাল অবস্থা থাকলেও, কখনও তাকে তার বাবার কাছ থেকে টাকা-পয়সা চাইতে দেখিনি। উল্লেখ্য যে, এ সময়ই ওর বাবা ইন্তেকাল করেন। আগে তার বাবার বিষয়ে কোন কথাই বলতে শুনিনি। টেলিগ্রামে তাঁর মৃত্যু সংবাদ পাবার পর ঝিলুকে খুব শোকাহত দেখেছিলাম। বারবার বলছিল, ‘আমার মা নাই, আমি এতিম সেই ছোট বেলা থেকে; কিন্তু আজ আমি সত্যি সত্যি পূরা এতিম হয়ে গেলাম!’
আলতাফ প্রায় এক বছর আমার ওখানে ছিল। এখানে, এ সময়ের টুকটাক, ছোট-খাট কিছু ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। ঝিলু অসাধারণ রসবোধ সম্পন্ন খুব সহজ-সরল একটি মানুষ ছিল! ছিল অতি সদালাপী ও বিনয়ী। খাওয়া-দাওয়া নিয়ে কোনদিন কোন খুঁতখুঁত বা বায়নাক্কা করেনি। মেসের সকলের সাথে ওর সম্পর্ক ছিল খুবই মধুর। তার আর একটি অদ্ভুত কাণ্ড দেখে প্রথম দিন তো হেসেই অস্থির। লম্বা, ঘন শ্যামবর্ণ সুদর্শন লোকটির চুল ছিল কোঁকড়ানো। তো, সে চুল কাটাতে কখনও নরসুন্দরের দোকানে যেত না—কাঁচি নিয়ে নিজেই কাটতো নিজের চুল! এমন কি, আয়নারও দরকার হত না তার। চুলগুলো দারুণ কোঁকড়ানো হওয়ার কারণে, এলোপাথাড়ি যে ভাবেই কাটা হোক, বাইরে থেকে দেখে বুঝা যেত না এবং মোটেই খারাপও লাগতো না। হা হা হা! এ রকম আরও কেউ করেন কিনা আমার জানা নাই।
আমার রুম-মেটদের মধ্যে আরও একজন গুণী ব্যক্তি ছিলেন, ভাল গায়ক, বরিশালের স্বরূপকাটির (সোহাগদল) হাফিযুর রহমান (শুনু)—পাকিস্তান ষ্টেট ব্যাঙ্কে কাজ করতেন। তার ছিল হারমোনিয়াম! আর, আমি তখন অপটু হাতে একটু-আধটু বাঁশি বাজাতাম এবং এক গোয়ানীজ ওস্তাদের কাছে রীতিমত শেখার চেষ্টা করছিলাম—সেই অনেক দিন আগের ঈপ্সিত—বেহালা বাদন। এ সব আয়োজন দেখে আলতাফ তো মহা খুশী! সে ও হাফিয মাঝে মাঝে গান করতো এবং এখানে বেহালা পেয়ে ঝিলু বহু আগে ছেড়ে আসা বেহালাও মাঝে মাঝে বাজাতো। ওদিকে, আরও আসতো কন্ঠ-শিল্পী মসিহুর ও মোহসীন এবং হাওয়াইয়ান গীটার বাদক (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষক, অটোয়ায় সদ্য-প্রয়াত) আব্দুর রহিম সাহেব। এ ঘরোয়া বৈঠকে বেশ গান-বাজনা হত ছুটির দিনে। কুমিল্লার আব্দুল লতিফ নামে খুব সুকন্ঠী এক জন বয়স্ক গায়কও আসতেন প্রায়ই। লতিফভাইয়ের দুটা গান আমার বিশেষ ভাবে মনে পড়েঃ ‘যবে তুলসী তলায় প্রিয় সন্ধ্যা বেলায় তুমি করিবে প্রণাম …’ ও ‘প্রিয়ার প্রেমের চিঠি লেখনী তরে, হে বলাকা …’। অবশ্যই ঝিলুর সব গানই আমার ভাল লাগতো। তবে ওর কন্ঠে কয়েকটি গান খুব বেশী ভাল লাগতঃ ডি এল রায়ের ‘ধনধান্য পুষ্প ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা…’, নজরুলের ‘কাবেরী নদী জলে কে গো, বালিকা …’, ‘নয়নভরা জল গো তোমার, আঁচল ভরা ফুল …’ ‘ফুলের জলসায়, নীরব কেন কবি …’, এবং ‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই ...’ ইত্যাদি, রবি ঠাকুরের, ‘চক্ষে আমার তৃষ্ণা, ওগো, তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে …’, ‘এমনি ক’রে যায় যদি দিন, যাক না…’, ‘ধ্বনিল রে, ধ্বনিল আহবান, মধুর গম্ভীরে, প্রভাত অম্বর বাজে …’, ‘ওরে ভীরু, তোমার হাতে নাই ভূবনের ভার …’, এবং, ‘ওরা অকাতরে চঞ্চল, ডালে ডালে দোলে, বায়ু হিল্লোলে নব পল্লবদল …’ ইত্যাদি। যখনই সুযোগ হত, অনুরোধ করে, এ সব গানের দু’একটি শুনতাম ওর কন্ঠে! ওর আর একটি অসাধারণ গুণের কথা না বললেই নয়। ঘরোয়া বৈঠকে সে মজা করতো বড় বড় গায়কদের (বিশেষ করে হেমন্ত, তালাত মাহমুদ, জগন্ময় মিত্র, মান্না দে ও মানবেন্দ্র) কন্ঠ নকল করে গান গেয়ে! সে কন্ঠ-নকল করা গানগুলোও কিন্তু বেশ ভাল লাগতো।
১৯৫৬-এর একটি বিশেষ ঘটনা মনে পড়েঃ করাচীস্থ ‘পূর্ব পাকিস্তান সমিতি’ বরাবরের মত ঈদ-উল-ফিৎর-এর পরে ঈদ-পুনর্মিলনী উৎসবের আয়োজন করছে। কে একজন প্রস্তাব করলেন এবারে আলতাফ মাহমুদ আছেন; তো, অনুষ্ঠান সূচীতে তার প্রযোজনায় নতুন বিশেষ কিছু একটা করা যেতে পারে কি না। ঝিলুকে এ কথা বলায়, একটু সময় নিয়ে ঝিলু বলল, “এবার অনুষ্ঠানটি একটি যন্ত্র-সঙ্গীত কন্সার্ট দিয়ে শুরু করলে কেমন হয়?” যথা প্রস্তাব, তথা স্থির সিদ্ধান্ত। আলতাফ কয়েক মিনিটের মধ্যেই ‘কেদারা’ রাগের উপর ‘দাদরা’ তালে একটা কন্সার্টের সুর রচনা করে ফেলল! অংশ গ্রহণে ছিলঃ গিটার (আঃ রহিম), বেহালা (আলতাফ মাহমুদ), তবলা (বাদল রায় চৌধুরী) ও বাঁশি (আমি)। করাচীতে বাঙালিদের কোন অনুষ্ঠানে এ-জাতীয় কন্সার্ট সে বারেই প্রথম এবং আলতাফের পরিচালনায় হওয়ায়, দারুণ প্রশংসা কুড়িয়েছিল দর্শক-শ্রোতাদের কাছ থেকে। এখনও মাঝে মাঝে বাঁশিতে সুরটি বাজাই আর ওর কথা মনে করি।
ঐ সময়ে—বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই—সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিভিন্ন শাখায় আমাদের পরিচিত আরও চার জন খুব বিখ্যাত গুণী ব্যক্তি ছিলেন করাচীতে—দু’জন বাঙালি এবং দুজন মুম্বাই-এর। তাঁরা হলেন ওস্তাদ আলাউদ্দীন খানের সাগরেদ, সরোদবাদক ওস্তাদ তিমিরবরণ (কলকাতা), বংশীবাদক ও সঙ্গীত-পরিচালক দেবু ভট্টাচার্য (খুলনা) এবং ঘনশ্যাম ও তার স্ত্রী শান্তা (দু'জনই নৃত্যশিল্পী, মুম্বাই)। এ চার জনই করাচীর (তখনকার আনকোরা নতুন) উপশহর পি ই সি এইচ সোসাইটিতে একটি বড় বাড়িতে থাকতেন। এর মধ্যে বিশেষ করে দেবু ভট্টাচার্যের সাথে আমার খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল; এবং আমার অফিস ও বাসা দু’জায়গায়ই তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল।
উল্লেখ্য যে, দেবু দা’ তখন ওখানে বেশ কতগুলো উর্দু ছায়াছবির সঙ্গীত-পরিচালক ছিলেন এবং পরবর্তীতে রুনা লায়লার গাওয়া কোন কোন গানে (বিশেষ করে ফিল্মী গানে) সুর আরোপ করেছেন। আলতাফ আমার ওখানে আসার পরে পরেই দেবু ভট্টাচার্যের সাথে তার পরিচয় হয় এবং অবশ্যম্ভাবী ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠে। আলতাফ ওঁদের বাসায় গিয়ে একদিন ওস্তাদ তিমিরবরণের সামনে গান করে্ দারুণ প্রশংসা পায়—সেদিন আমিও সাথে ছিলাম। এর পরে, সে নিয়মিত ওনাদের ওখানে গিয়ে আসর জমাতো! ছুটি-ছাটা থাকলে, মাঝে মাঝে আমিও সঙ্গ দিতাম। এভাবে প্রায় বছর খানেক চলার পর আলতাফ আমার বাসা ছেড়ে ওঁদের ওখানেই থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। ও যে বেশ ভাল আবৃত্তিও করতে পারতো, তা জানা ছিল না। আমার ওখান থেকে যাবার দিন, রবিঠাকুরের সঞ্চয়িতা বইখানা বের করে আমাদের সবাইকে অবাক করে চমৎকার আবৃত্তি করেছিল ‘স্বর্গ হতে বিদায়’ কবিতাটি!
এর পরে খুব বেশিদিন সে করাচীতে ছিল না। তবে ঠিক কখন যে দেশে চলে যায়, আমার তা স্মরণে আসছে না—সম্ভবত, ১৯৫৭-এর শেষে বা ’৫৮-এর প্রথম দিকে। করাচী থেকে দেশে ফিরে ঝিলু প্রথমে পরীবাগে সেখানকার অতি সম্মানিত ‘পরীবাগের পীর-সাহেব’ হুজুরের বাড়ীর কাছেই একটি ভাড়াটে বাসায় থাকত। আমার সাথে নিয়মিত চিঠিপত্র আদান-প্রদান তো ছিলই; তা ছাড়াও যোগাযোগ ছিল আমার মেজো ভাইয়ের মাধ্যমে—ও তখন ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিল। আমার নির্দেশে ও আলতাফের ওখানে যেত মাঝে মাঝে। কিন্তু আস্তে আস্তে এ সবই বন্ধ হয়ে যায়। কয়েক বছর আর কোন খবরই ছিল না। কখন যে পত্রালাপও বন্ধ হয়ে গেল, খেয়ালই আসছে না!
পরবর্তীতে আমি ধাপে ধাপে কয়েকবার আমাদের ঢাকা অফিসে কাজ করি (জানুয়ারী ১৯৬১ থেকে মে ১৯৬৩, জুলাই ১৯৬৪ থেকে জুন ১৯৬৬ পেটেন্ট অফিসে এবং জানুয়ারী ১৯৭০ থেকে ক্রমাগত, কপিরাইট অফিসে); এ-সব সময়ে, রাস্তা ঘাট বা কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ওর সাথে কখনও সখনও দেখা হত। তবে কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি বা তেমন বিশেষ কোন আলাপচারীও হত না। কোন এক সময় যথারীতি বিয়ে-থা’ করে সংসারী হয়। পরে শুনেছিলাম যে মগবাজার এলাকায় সে ‘আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীত নিকেতন (?)’ নামে একটি গানের স্কুল করেছিল এবং যতটা জানি, স্কুলটা এখনও চলছে। তার সন্তান-সন্ততি ক’টি বা তার স্ত্রী বেঁচে আছেন কি না, জানি না। তবে ঢাকায় তার মেয়ে শাওন মাহমুদ এর সাথে কিছুদিন আগে একবার ফোনে আলাপ হয়েছে।
আলতাফ মাহমুদ (ঝিলু) এর সাথে আমার সর্বশেষ দেখা হওয়ার মুহূর্তটি পরিষ্কার মনে আছেঃ ১৯৭১-এর জুলাই মাসের শেষের দিকে, ঢাকা নিউ মার্কেটের উত্তর দিকের গেটের কাছে। তেমন বিশেষ কোন কথা হয়নি। সে ছিল ভীষণ ব্যস্ত; এবং খুব ক্লান্ত লাগছিল ওকে। সে তখন গাড়ির মালিক এবং নিজে গাড়ি চালায়—আমি আগে জানতাম না। খুব তাড়াহুড়া করে চলে গেল তার গাড়ির দিকে। সেটাই ছিল ঝিলুর সাথে আমার শেষ দেখা!
পাক-সেনাদের হাতে ধরা পড়ার অতীব দুঃখজনক খবরটি জানতে পারি আসল ঘটনার বেশ পরে! আরও পরে শুনেছিলাম যে, ওর বাড়ীর পেছনের চত্বরে মাটির নীচ থেকে নাকি কিছু অস্ত্র–পাতি পাওয়া গিয়েছিল, আল-শামস/আল-বদর বাহিনীর কেউ বা কারা যার খবর দিয়েছিল পাক সেনাদের কাছে। আগস্ট ’৭১-এর পরে ওর আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। পৈশাচিক, পাশবিক, শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের পরে, ওকে ঠিক কোন তারিখে হত্যা করা হয়েছিল, আমার জানা মতে, কারুরই তা জানা নাই!
আলতাফ মাহমুদ সরাসরি কোনদিন রাজনীতি না করলেও বিভিন্নভাবে জড়িত ছিল প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে—প্রধানতঃ, তার সাড়া জাগানো, জ্বালাময়ী গণসঙ্গীতের মাধ্যমে। সব কিছুর উপরে ওর অমর, অশ্রু-ঝরানো, শরীরে শিহরণ-জাগানো সুরঃ ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো ...’। ‘আলতাফ মাহমুদ সড়ক’ নামে ঢাকার একটি সড়কের নামকরণ ও ‘আলতাফ মাহমুদ পদক’ নামে একটি পদকের প্রবর্তন করে, বাংলাদেশ সরকার আলতাফকে তার প্রাপ্য সম্মান দেখিয়েছে। কিন্তু ওর প্রাপ্য যে আরও অনেক বেশি!
এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, ওর মত গায়ক বাংলাদেশে হয়তো আরও অনেকই আছেন। কিন্তু একটি মাত্র গানের অপূর্ব, কাল-বিজয়ী সুর দেয়ার জন্যই, মৃত্যঞ্জয়ী শহীদ আলতাফ চিরদিন বেঁচে থাকবে বাংলাদেশী, তথা বাংলা ভাষাভাষী সবার অমলিন স্মৃতিতে!