আমার মুখ দিয়া দুর্গন্ধ বাইর হইতেছে। ভয়ানক দুর্গন্ধ। কারো বলতে হয় না, আমি নিজেই বুঝতে পারি। দাঁত ব্রাশ করি না অনেকদিন। করতে ইচ্ছা হয় না। আমার হাতের নখ লম্বা হইয়া হইয়া যখন বিরক্তির কারণ হইয়া দাঁড়ায় তখনি কেবল কাইটা ফেলি। আমার হাত একসময় সুন্দর ছিল। ছোটকালে। তখন আমার মা আমার হাত ধইরা বলতেন রাজপুত্রের হাত, আমার পোলা রাজা হইব। কিন্তু তার এই কথা মিথ্যা হইছে। আমার বাপ রাজা আছিল না, আমি রাজপুত্রও ছিলাম না, বড় হইয়া রাজাও হই নাই।
রাজা, রাজপুত্র এইগুলা বড় জিনিস। আমি মাঝে মাঝে এদের কথা ভাবি। মূলত যখন আমার মায়ের কথা ভাবি তখন এই রাজা এবং রাজার পোলা রাজপুত্রের কথাও আমার মাথায় আইসা পড়ে। আমার মা একজন সহজ মানুষ ছিল। যে ভাবত তার পোলা ধুম কইরা একদিন রাজপুত্র হইয়া যাবে। যে ভাবত তার পোলার মাথার মইধ্যে লুকানো আছে রাজটীকা।
মায়ের রাজা এবং রাজপুত্তুর নিয়া কথা শুনতে শুনতে আমিও ছোটবেলায় ভাবতাম বড় হইয়া এইসব হইতে হবে। এখন চিন্তা করলে হাইসা উঠি একা একাই। মানুষ যখন একা হাসে তখন সে পুরা হৃদয় দিয়াই হাসে। আমি হৃদয় দিয়া যে হাসি দেই তার মধ্যে লুকানো থাকে ধানের মধ্যে মধ্যে লুকায়া থাকা চিটার মত দুঃখ।
অর্থাৎ রাজা এবং তার পোলার কথা আমার ভিতরে কিছুটা দুঃখভাব আইনা দেয়। আমার ভিতরের কোন একটা অংশ হয়ত বিশ্বাস কইরা ছিল এবং এখনো কইরা আছে যে আমার বড় হয়ে রাজপুত্র এবং আরো বড় হয়ে রাজা হওয়ার কথা ছিল।
আমি যখন ইস্কুলে যাইতে শুরু করলাম তখন থিকাই অত্যন্ত আগ্রহের সাথে রাজাদের কথা পড়তাম। এখন ভাইবা দেখলে অবাক হই, শত শত বছরের ইতিহাসে কেবল ঠিইকা আছে রাজা, তার পোলারা, তার নাতিরা। আর সেইসব সময়ের অজস্র অজস্র মানুষরে মনে রাখে নাই কেউ। মরে মিইশ্যা গেছে মাটির সাথে। বাতাসের সাথে।
এই প্রগাঢ় ক্ষমতা নিয়া এই রাজা এবং তাদের বাচ্চাদের জন্মলাভ পৃথিবীরে মহিমান্বিত করছে এমনি মনে হয় পৃথিবীর ইতিহাস পড়লে। বিশাল ইমারত, উদ্যান, স্মৃতিস্তম্ভ ইত্যাদির কথা মনে আইলে আমাদের প্রথমেই মনে আসে রাজা আর তার পোলা মাইয়ার কথা। হেরাই নির্মাণ করছে। আর আমাদের মন মগজ অবজ্ঞা কইরা যায় সেইসব নির্মাণের পিছনের শত শত শ্রমিক কিংবা সাধারণ মানুষের ঘামরে। মনে হয় সবার মনেরই কোন এক অংশ বিশ্বাস করে তাগো সবারই বড় হইয়া রাজার পোলা রাজপুত্র এবং রাজা হওয়ার কথা ছিল। তাই সবার চোখ এবং মনই রাজাদের অবদান দেখতে পায় সব কিছুতে। সবারই পক্ষপাতিত্ব থাকে এদের প্রতি। কারণ অন্তরের অনেক গভীরে সবে নিজে নিজে রাজার পোলা এবং রাজা। বাস্তবের দুনিয়ায় তাগো প্রতিনিধি হইল মূল রাজারা, রাজার পোলারা।
রাজা হইতে না পারায় আমার নিজের উপরে বা রাজাদের উপরে কোন ক্ষোভ নাই। জীবনের পাকেচক্রে আমি আজ যেইখানে, সেইখানের বিচারে আমারে রাজা বলা গেলে যাইতেও পারে। অবশ্য এই রাজা হইছি দেখলে আমার মা খুশি হইতেন না।
এখন আসল কথা বলি। আমি একজন ভয়ংকর পাপী লোক। এই শহরে আমার চেয়ে পাপী লোক আর কেউ আছে কি না আমি জানি না। এক গর্হিত কাজের সাথে আমি জড়িত। প্রথম প্রথম এইধরনের কাজে জড়িয়ে পড়েছিলাম প্রয়োজনের তাগিদে। আমার রাজা হওয়ার ইচ্ছাও তখন কাজ করেছিল। রাজার পোলা কেন বারবার রাজপুত্র হবে! আমি চেয়েছিলাম এই নিয়মের পরিবর্তন। আমার প্রচণ্ড বিশ্বাস ছিল আমার কপালের রাজটীকার প্রতি।
আমি আমার কিছু সঙ্গী জু্টিয়ে বিদ্রোহ করলাম। রাজাদের শাসনের সমাপ্তির জন্য। একপেশে রাজাদের ইতিহাসকে প্রত্যাখান করলাম। শত শত রাজাদের বীরত্বগাথার পুস্তকে বিসর্জন করলাম মূত্র এবং সেগুলো জ্বালিয়ে ফেলা হল আগুনে। তখন তরুণ আমি। আমার সঙ্গীদের বেশিরভাগই তরুণ। রাজার পতনের জন্য তার সৈন্য সামন্তদের দমন করতে হবে—সেই চিন্তা থেকে চলল আমাদের চোরাগোপ্তা হামলা। আমরা খুন করলাম রাজার কিছু লোকদের। প্রতাপশালী রাজা এতে বিব্রত হলেন। আমাদের স্পর্ধা দেখে রাগে তিনি তার সমস্ত শক্তি দিয়ে আমাদের ছত্রভঙ্গ করে দিলেন। আমাদের বেশিরভাগ লোকেরা ধরা পড়ল। তাদের হত্যা করা হল। বাকীরা আমার কাছ থেকে দূরে সরে গেল।
আমি পলাইয়া রইলাম কিছুদিন। তারপর এক সকালে আমারেও জঙ্গল থেকে ধরা হইল। কিছুদিন প্রচণ্ড যন্ত্রণার মধ্যে রাইখা শাস্তি দেয়া হইল। আমি নিশ্চিত ছিলাম আমারে মাইরা ফেলা হবে। কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে রাজা আমারে মারলেন না। আমি নিযুক্ত হইলাম এক রাজকীয় কাজে। সেই কাজ হইল গুপ্তহত্যা।
সেই থেকে আমি এ কাজ কইরা যাইতেছি। আজ হইতে চলল বছর বিশেক। এখন গণতন্ত্র দ্যাশে। হুট কইরা রাজার সৈন্য কাউরে মাইরা ফেলতে পারে না। তাই দরকার হয় আমার।
এই কাজে আমার কোন অসুবিধা হয় না। আমি অভিজ্ঞ লোক। তবে মূল ব্যাপার আমার পাপের বোঝা বাড়তে বাড়তে হইয়া গেছে পাহাড় সমান। প্রতিদিন রাতে মনে হয় আকাশ সমান পাহাড় চাইপা আছে আমার উপর। ব্যাপারটা অস্বস্তিকর।