মার্ক্স’স জেনারেল: দ্য রিভোলিউশনারি লাইফ অফ ফ্রিডরিখ এংগেলস; ট্রিসট্রাম হান্ট; প্রথম প্রকাশ: আগস্ট, ২০০৯; মেট্রোপলিটান বুকস; পৃষ্ঠাঃ ৪৪৮
|| ১ ||
ফ্রিডরিখ এংগেলসকে সঠিক বুঝতে হলে পাঠককে যেতে হবে রাশিয়ার এক প্রত্যন্ত শহরে। মস্কোর ভাঙাচোরা পাভেলেট্স্কি স্টেশান থেকে দূরপাল্লার ধীরগতি ট্রেন ছাড়ে মাঝরাতে—সেই ট্রেনে দক্ষিণ-পূর্ব বরাবর ১৪ ঘন্টার দূরত্বে ভলগা নদীর তীরে বর্ধিষ্ণু সারাটভ শহর। ব্রিজ পেরিয়ে নদীর ওপারের ছোট শহরটির নাম এংগেলস। দু'লক্ষ মানুষের এই শহরটির কেন্দ্রস্থলে এংগেলস স্কোয়ার—সেখানে এই কমিউনিস্ট পথিকৃতের পনেরো ফুট উঁচু মর্মর মূর্তি, পরনে ট্রেন্চ কোট, হাতে কমিউনিস্ট ইস্তাহার। চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে ভাঙা, পতিত মূর্তি—মার্কস, লেনিন, স্তালিন, এমনকী স্তালিনের সহচর গোপন পুলিশ NKVD এর প্রধান লেভ্রান্তিই বেরিয়া (১৮৯৯ - ১৯৫৩)। সবার মূর্তি শায়িত—কারুর গলা কাটা, কারুর হাত-পা ভাঙা—ট্যুরিস্টরা ছবি তোলেন তাদের; কিন্তু এংগেলস দণ্ডায়মান। তার কারণ কিন্তু এই নয় যে শহরের অধিবাসীরা ভালবাসেন বা শ্রদ্ধা করেন এংগেলসকে। তাঁরা সঠিক জানেনই না, এংগেলস কে। শহরের অনেক মানুষ জার্মান বংশোদ্ভূত—এক জার্মান মনীষীর নামে শহরের নাম—অতএব তাঁকে আর না ঘাঁটিয়ে, অবহেলায় হলেও অক্ষত রেখে দেওয়া হয়েছে শহরের কেন্দ্রস্থলে।
এংগেলস এর জন্মের শহর জার্মানির ভাপারটাল—মহানগর ডুসেলডর্ফ-এর শহরতলী; সেখানেও তাঁকে নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই। তাঁর নামে একটি বড় রাস্তা আর একটি গলি, ব্যস! তাঁর বসতবাটী ১৯৪৩-সালে ব্রিটিশ বোমায় ধ্বংস হয়েছিল—সেটি এখনও ঝোপ-জঙ্গলে ভরা—মলিন ফলকে লেখা রয়েছে—বৈজ্ঞানিক সমাজবাদের যৌথ প্রতিষ্ঠাতার একজনের জন্ম এখানে। কিন্তু যাঁর মতবাদ একদিন পৃথিবীজুড়ে কাঁপিয়ে দিয়েছিল পুঁজিবাদের ভিত, তিনি এখন বিস্মৃতপ্রায়।
অথচ অনেক দশক ধরে রাশিয়া, চিন ও কিউবায়—অথবা পোল্যান্ড, আলবেনিয়া এবং পশ্চিমবঙ্গের সভা-সমিতি-মিছিলে ছিল মার্কস-এংগেলস ও লেনিনের অমোঘ উপস্থিতি। ১৯৭২-সালে পূর্ব-জার্মানি থেকে প্রকাশিত এক সরকারী জীবনীগ্রন্থে লেখক মন্তব্য করেছিলেন—“Now a days, there is hardly a corner of the earth where Engels' name has not been heard of, where the significance of this work is unknown.” তাঁদের নামে রাস্তাঘাট, স্কোয়ার অথবা পার্কের নামকরণ, দেয়াল লিখন, কারেন্সি নোটে তাঁদের ছবি, বিলবোর্ডে এবং মে দিবসের প্যারেডে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন ছিলো সাধারণ মানুষের নিয়মিত রুটিন। ১৯৮৯-সাল থেকে যখন বামপন্থা এবং মার্কসবাদের দু:সময়, মার্কস, লেনিন ও স্তালিনকে পেতে হয়েছে অপমান ও ধিক্কার, কিন্তু মার্কসবাদ বিরোধীরা কোনো কারণে এংগেলসকে ভুলে গিয়েছে পুরোপুরি। তিনি এতটাই অকিঞ্চিৎকর এবং নিরীহ-নির্বিরোধী যে তাঁর মূর্তি ভাঙার জন্যে সময় নষ্ট করতেও কেউ রাজী নয়।
কিন্তু এংগেলসের এই নিজে অন্তরালে থেকে যাওয়া এবং মার্কস ও তাঁর দার্শনিক ও সামাজিক তত্ত্বকে সামনে তুলে ধরা—এই দুটি বিষয়ই একই সঙ্গে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত এবং পরিকল্পিত। দুজনের বন্ধুত্ব স্থায়ী হয়েছে চার দশকেরও বেশি। একই আদর্শ নিয়ে কাজ করেছেন দুজনে, রচনা করেছেন যুগান্তকারী গ্রন্থ সমূহ, এংগেলস নিজের আয়ের প্রায় অর্ধেকটাই খরচ করেছেন মার্কসের সংসার চালাতে, তাঁর সন্তান-সন্ততিদের ভালো স্কুলে পড়াতে। বন্ধু যাতে শারীরিক আরামে এবং বিলাসে দিন কাটাতে পারেন, টাকাপয়সার জন্যে চিন্তা না করে সময় দিতে পারেন দার্শনিক চিন্তাভাবনায় এবং অর্থনৈতিক তত্ত্বে নিমজ্জিত থাকতে পারেন সেই নিয়ে তাঁর চিন্তার অন্ত ছিল না । নিজের কোন সন্তান ছিল না তাঁর এবং মার্কসের কন্যাদের আপন করে নিয়েছিলেন তিনি। ‘দাস কাপিটাল’ এর প্রথম খণ্ড প্রকাশের পরে মার্কসের মৃত্যু হলে তিনি নিজে দায়িত্ব নিয়েছিলেন পরবর্তী দুটি খণ্ড সম্পূর্ণ করার।
|| ২ ||
ট্রিসট্রাম জুলিয়ান উইলিয়াম হান্টের নামটি যেমন গালভরা—মানুষটিও তেমনি বিদ্বান ও বাগ্মী। তিনি ব্রিটেনের লোকসভায় শ্রমিক দলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের কুইন মেরি কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক, তিনটি গবেষণামূলক গ্রন্থের রচয়িতা, টেলিভিসানে ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানের প্রচারক এবং দুটি নামকরা সংবাদপত্রের (দ্য গার্ডিয়ান এবং দ্য অবজার্ভার) নিয়মিত প্রবন্ধলেখক। অথচ বয়েস এখন তাঁর সদ্য চল্লিশ পেরিয়েছে। তাঁর জন্ম ৩১ মে ১৯৭৪; পিতা জুলিয়ান হান্ট আবহবিদ, শ্রমিক দলের মাঝারি নেতা এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী টেনি ব্লেয়ারের বন্ধু। ট্রিসট্রাম লেখাপড়া করেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজে এবং আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে—বিষয় ইতিহাস। ২০০০-সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শহুরে ইতিহাসের (Urban History) ডক্টরেট; তাঁর থিসিস—“ব্রিটেনের নাগরিক চিন্তাভাবনাসমূহ—১৮২০ - ১৮৬০”।
অধ্যাপনার পাশাপাশি তাঁর অন্য কাজকর্ম টেলিভিসানে ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানের সঞ্চালন ও পরিচালনা—২০০২-সালে ‘ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধ’ নামে অনুষ্ঠানটি দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। একই বিষয়ে তাঁর প্রথম গ্রন্থ 'ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধ: প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে' প্রকাশিত হয় ২০০৩-সালে। ১৬৩৭ থেকে ১৬৫২ সাল ইংল্যান্ডের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ—প্রাচীন গাথা, কাহিনি, কবিতা, তৈলচিত্র, বক্তৃতা, ঘোষণা, উডকাট প্রভৃতির মাধ্যমে তার বর্ণনা।
২০০৫-সালে দ্বিতীয় গ্রন্থ—'জেরুসালেম নির্মাণ—ভিক্টোরীয় শহরগুলির উত্থান এবং পতন'—ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটেনের প্রধান শহরগুলির ইতিহাস, সংস্কৃতি, বাণিজ্য, শাসনব্যবস্থা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য—সব বিষয়ের আলোচনা; তার ফাঁকে ফাঁকে ডিকেন্স, এংগেলস অথবা কার্লাইলের মতন মনীষীদের কথা।
আলোচ্য গ্রন্থটির প্রথম প্রকাশ ২০০৯-সালে—গ্রন্থটির গবেষণার জন্যে তিনি ভ্রমণ করেছেন রাশিয়া ও জার্মানির বিভিন্ন শহরে এবং তাদের গ্রন্থাগার এবং অভিলেখাগারে। ব্রিটিশ সংস্করণের নাম ছিল, 'ফ্রক কোটপরা কমিউনিস্ট—পৃথিবীর প্রথম শ্যাম্পেনপায়ী সমাজতন্ত্রীর জীবন ও সময়'। কিন্তু মার্কিন সংস্করণে নামটি পাল্টে রাখা হয়—'মার্ক্সের জেনারেল—ফ্রিডরিখ এংগেলসের বৈপ্লবিক জীবন'—খুব সম্ভবত: মার্কিন মানুষের কাছে ভিক্টোরীয় যুগের ফ্রক কোট অচেনা মনে হবে বলে।
|| ৩ ||
১৮২০-সালের ২৮ নভেম্বর এংগেলসের জন্ম প্রাশিয়া সাম্রাজ্যের বারমেন শহরে (বর্তমান কালের জার্মানির ভাপারটাল অঞ্চলে) এক ধনী, খ্রীষ্টধর্মী জার্মান পরিবারে—বাবা-কাকারা অনেকগুলি কাপড়ের কারখানার মালিক। ৫ আগস্ট ১৮৯৫ লন্ডন শহরে তাঁর মৃত্যু গলার কর্কট রোগে। মধ্যবর্তী ৭৪ বছর ৮ মাসে তিনি পরমবান্ধব কার্ল মার্ক্সের সঙ্গে যৌথভাবে পাল্টে দিলেন ইয়োরোপের অর্থনৈতিক তত্ত্ব, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী, মালিক-শ্রমিক ও ধনী-দরিদ্রের পারস্পরিক সম্পর্ক। পরবর্তী শতাধিক বছরে ঘটবে তার প্রভাবে রাজনৈতিক ভারসাম্য এবং পৃথিবীর মানচিত্রের পরিবর্তন এবং প্রায় একশো কোটি (এক বিলিয়ন) মানুষের শোচনীয় অকাল মৃত্যু অনাহারে, শৈত্যে, বুলেটে।
কেমন ছিলেন মার্ক্সবাদের যুগ্মজনক এবং দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের স্রষ্টা এই মানুষটি? আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের স্মৃতিতে—বিশালহৃদয়, বন্ধুবৎসল, আমুদে, কৌতুকপ্রিয়, বিলাসী, স্নেহপ্রবণ; ভালবাসতেন কবিতা পড়তে দুই ভাষায় (শেলী, কিটস, বায়রন, হাইনে); প্রিয় গৃহকর্ম ছিল শ্যাম্পেনের বোতল খোলা; রবিবারের রাত্তিরে তাঁর বাড়িতে আসর বসত লন্ডনের বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের—সেখানে পান-ভোজন গান-গল্পে অনেক সময়ই রাত গড়িয়ে যেত ভোরের দিকে।
এংগেলস পরিবারটি অসম্ভব ধর্মভীরু—কিন্তু ফ্রিডরিখ ছেলেবেলা থেকেই ধর্মবিরোধী এবং ঈশ্বর-অবিশ্বাসী—স্কুলে পড়ার সময় থেকেই তাঁর মনে বিপ্লবী চিন্তাভাবনা। বাবা রাগ করতেন এবং মা দু:খ পেতেন তাঁর হাবভাবে। কিন্তু ক্রমশ প্রসার ঘটল তাঁর বৈপ্লবিক কাজকর্মের এবং পত্রপত্রিকায় জ্বালাময়ী প্রবন্ধ রচনায়—তাঁর সঙ্গী স্থানীয় হেগেলপন্থী যুবকেরা। ১৭ বছর বয়েসে স্কুল থেকে তাঁর নাম কাটিয়ে তাঁকে যুক্ত করা হ’ল পারিবারিক ব্যবসায়ে। ২১ বছর বয়েসে সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেন—তাঁকে পাঠানো হ’ল বার্লিন শহরে—সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়েও হেগেলপন্থীদের রমরমা।
সদ্য-প্রকাশিত বামপন্থী সংবাদপত্রে (‘রাইনিশে সাইটুং’ অর্থাৎ ‘রাইন অঞ্চলের সংবাদ’) তিনি ছদ্মনামে প্রবন্ধ লিখতে লাগলেন স্থানীয় শ্রমিকদের দারিদ্র্য ও দু:খদুর্দশা নিয়ে। ১৮৪২-সালের শেষ নাগাদ তাঁকে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে পাঠানো হল পরিবারের সেখানকার কাপড়ের কারখানায় কাজ করার জন্যে। যাবার আগে দেখা করে গেলেন সংবাদপত্রের আপিশে যাতে ইংল্যান্ড থেকে সেখানে নিয়মিত লেখার ব্যবস্থা করতে পারেন—পরিচয় হল কাগজের অন্যতম সম্পাদক, সমবয়েসি যুবক কার্ল হাইনরিখ মার্ক্স (১৮১৮ - ১৮৮৩)-এর সঙ্গে। এই বন্ধুত্ব স্থায়ী হবে চার দশক।
ইংল্যান্ডে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটল, যার প্রভাব তাঁর জীবনে সুদূর প্রসারী। প্রথম, ম্যাঞ্চেস্টারের ও আশেপাশের কাপড় কলের শ্রমিক ও তাদের পরিবারের শোচনীয় অর্থনৈতিক অবস্থা এবং করুণ, মনুষ্যেতর জীবনযাপন খুব নিকট থেকে দেখলেন—সেই হতকুৎসিত, ন্যক্কারজনক অভিজ্ঞতার ফলশ্রুতি তাঁর প্রথম মহতী গ্রন্থ—'ইংল্যান্ডে শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা', রচনা—সেপ্টেম্বর ১৮৪৪ - মার্চ ১৮৪৫; জার্মানিতে প্রথম প্রকাশ ১৮৪৫—ইংরেজি ভাষায় গ্রন্থটির প্রথম প্রকাশ ঘটবে চার দশক পরে। দ্বিতীয় ঘটনা, অনভিজাত, শ্রমিক রমণী মেরি বার্নস (১৮২৩-১৮৬৩)-এর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা—বিবাহ ছাড়াই তাঁরা এক সঙ্গে বসবাস করবেন সারা জীবন। মেরি তাঁকে নিয়ে গেলেন শ্রমিক বস্তিতে, চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন দারিদ্র, অনাহার; নিয়ে গেলেন বিভিন্ন কারখানায়—দেখালেন কী রকম বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে কাজ করে শ্রমিকেরা। দেখলেন নিরক্ষর মানুষ, দেখলেন শিশু-শ্রমিক, তাদের ছিন্ন পোষাক, ভাঙা ঘর। লেখকের মতে, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে এংগেলসের মতামতটি সারা জীবনের জন্যে গড়ে দেওয়ার ব্যাপারে মেরির অবদান অসামান্য। প্রায় একই রকম দৃশ্যগুলি দেখে ডিকেন্স অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তাঁর অমর সাহিত্য সৃষ্টিতে; এংগেলস উঠে পড়ে লাগলেন বিপ্লবের কাজে।
ইংল্যান্ডে থাকার সময়েই চিঠিপত্রে মার্ক্সের সঙ্গে বন্ধুত্ব গাঢ় হল; ১৮৪৪-সালে জার্মানি ফেরার পথে প্যারিসে মার্ক্সের সঙ্গে সময় কাটালেন। ১৮৪৫ থেকে ১৮৪৮ দুজনেই ব্রাসেলস শহরে, শ্রমিক সংগঠনের কাজে। স্থানীয় কমিউনিস্ট লিগের তরফ থেকে তাঁদের ওপরে ভার দেওয়া হল পার্টির নীতিসমূহের বর্ণনা ও ব্যাখ্যা সমেত একটি পুস্তিকা রচনার। দুজনের সেই যৌথ কর্মের নাম 'কমিউনিস্ট ইস্তাহার'—প্রকাশ হ’ল ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৮৪৮।
ওই একই সময়ে জার্মানিতে শ্রমিক বিদ্রোহ শুরু হ’লে তাঁরা দুজনেই দেশে ফিরলেন; সেখানে তাঁরা বিপ্লবের নেতৃত্ব দেবেন এবং প্রিয় সংবাদপত্রে লিখবেন। কিন্তু দেড় বছরের মধ্যেই ভেঙে পড়ল শ্রমিক বিদ্রোহ—দুজনেই পালিয়ে গেলেন দেশ ছেড়ে। মার্ক্স বাড়িভাড়া নিলেন লন্ডনে, শুরু করলেন “দাস ক্যপিটাল” এর জন্যে গবেষণা; এংগেলস গেলেন ম্যানচেস্টারে—ভার নিলেন পরিবারের মালিকানায় একটি কারখানা পরিচালনার।
১৮৪৯ থেকে ১৮৬৯—এই দুই দশক এংগেলসের দ্বৈতজীবন। দিনের বেলায় তিনি ঘোর বুর্জোয়া, কারখানার মালিক, বিলাসী, শোষক—অন্য অভিজাত মানুষদের সঙ্গে মদ্যপান, জঙ্গলে শৃগাল শিকার। অবসর সময়ে বিপ্লবের কাজ, জার্মানির সংবাদপত্রের জন্যে সমাজতন্ত্রী প্রবন্ধ; চিঠিপত্রের মাধ্যমে মার্ক্সের সঙ্গে যোগাযোগ এবং পুঁজিবাদের মূলোচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্র। অর্জিত বিপুল অর্থে বন্ধুকে স্বচ্ছন্দ জীবনযাত্রায় দরাজ হাতে সাহায্য। লেখক নিপুণ বিশ্লেষণে উপস্থাপিত করেছেন এংগেলসের মানসিক অন্তর্দ্বন্দ্ব, মহত্ত্ব, বিরল বন্ধুতা ও আত্মত্যাগ।
|| ৪ ||
এংগেলস এর জীবনের একটি কলংকময় ঘটনার পরিমিত বিবরণ দিয়েছেন হান্ট। ধনী ও বিলাসী যুবক এংগেলস ছিলেন সুলভ নারীসঙ্গ এবং যৌনমৃগয়ায় পটু—তার অশোভনতম ঘটনাটি ঘটে ১৮৪৬ সালের জুলাই মাসে। মার্ক্স ও এংগেলস এর অগ্রজপ্রতিম বান্ধব মোজেস হেস (১৮১২ - ১৮৭৫)—তিনি দুজনকেই দীক্ষা দিয়েছিলেন সমাজতন্ত্রে ও কমিউনিস্ট আদর্শে। গোয়েন্দা পুলিশের তাড়নায় তাঁকে আচমকা পালিয়ে যেতে হয় জার্মানি ছেড়ে ব্রাসেলস ঘুরে ফ্রান্সে। হেস-এর পত্নী সিবিলের পাসপোর্ট ছিল না বলে তিনি আটকা পড়ে যান ব্রাসেলসে। অশিক্ষিত ও অনভিজাত সিবিলের পক্ষে তখন অশান্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একা দেশ ছেড়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তিনি বন্ধু এংগেলসের সাহায্য প্রার্থনা করেন। এংগেলস পাসপোর্টহীন সিবিলকে সঙ্গে নিয়ে গোপনে সীমান্ত পার করে, তাঁকে নিয়ে যান ফ্রান্সে, কিন্তু পথিমধ্যে সিবিলের অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে তাঁকে শয্যাসঙ্গিনী করেন। মার্ক্সকে লেখা কয়েকটি অসংস্কৃত ভাষার চিঠিতে এই বিষয়ের আত্মাভিমানী উল্লেখ রয়েছে । হেস ক্ষমা করে দেন স্ত্রীর এই পদস্খলন, তাঁরা বাকি জীবন একসঙ্গেই কাটান, কিন্তু বন্ধু এংগেলসের সঙ্গে তার সম্পর্ক চিরকালের জন্যে ছিন্ন হয়। হেস দাবী করেন যে এংগেলস বলপূর্বক ধর্ষণ করেছেন সিবিলকে—কিন্তু লেখকের বিশ্লেষণ অনুযায়ী সেই দাবী খুব সম্ভবত: সত্যি নয়।
মার্ক্সের জীবনের একটি গোপন ও বিতর্কিত ঘটনারও বর্ণনা দিয়েছেন লেখক, যাতে প্রকাশ পেয়েছে এংগেলসের বন্ধুবৎসল উদারতা। মার্ক্স ও তাঁর স্ত্রী জেনি ভন ওয়েস্টফলেন বাস করতেন লন্ডনে—তাঁদের জীবনযাত্রার খরচ যোগাতেন এংগেলস। সাতটি সন্তান তাদের, কিন্তু চারজনের মৃত্যু হয় শৈশবে। পরিবারের আরেক সদস্যা পরিচারিকা হেলেন ডিমুখ (১৮২০-১৮৯০)—তিনি আবার জেনির শৈশবের বান্ধবী। ১৮৫০-সালে জেনি ইয়োরোপে গেলেন দীর্ঘ সফরে পার্টির জন্যে অর্থসংগ্রহের কাজে। সেই সুযোগে ঘনিষ্ঠ হলেন মার্ক্স এবং হেলেন। জেনি যখন ঘরে ফিরলেন, হেলেন তখন মা হতে চলেছেন। ২৩-শে জুন ১৮৫১ জন্ম হ’ল তাঁদের পুত্র সন্তান ফ্রেডেরিক লুইস ডিমুখ (১৮৫১-১৯২৯)। বন্ধুর সম্মান ও বিবাহকে রক্ষা করতে শিশুটির পিতৃত্ব স্বীকার করে নিলেন অকৃতদার এংগেলস যদিও জন্মপঞ্জিকায় কোন পিতৃনাম থাকল না। খুব হেলাফেলার সঙ্গে মানুষ হলেন এই শিশু পুত্রটি—কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি এংগেলসকে সাহায্য করেছেন মার্ক্সের রচনাবলীর সম্পাদনায়। ১৮৯৫-সালে এংগেলস যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন তিনি প্রকাশ করেন ‘ফ্রেডি’র পিতার প্রকৃত নাম। পরবর্তীকালে মার্ক্স কন্যাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের প্রভূত উন্নতি ঘটে। বিষয়টি ঘিনঘিনে সন্দেহ নেই, কিন্তু এর থেকে বোঝা যায় বন্ধুর জন্যে এবং কমিউনিজমের স্বার্থরক্ষায় তিনি কতোটা দুর্নাম বহন করতে এবং আত্মত্যাগ করতে রাজী।
|| ৫ ||
কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে এংগেলসের স্থান দ্বিতীয়, অনুজ অথবা কনিষ্ঠের; মার্ক্সের স্থান সর্বদা প্রথমে, এংগেলস তাঁর অনুগত সহকারী। “Marx was a genius; we others were at best talented, without him the theory would not be by far what it is today. It therefore rightly bears his name”—বন্ধুর মৃত্যুর মুহূর্তকাল পরে এংগেলস জানিয়েছিলেন। কিন্তু মার্ক্সবাদের অন্তিম রূপটি রচিত হয়েছিল তাঁরই হাতে মার্ক্সের মৃত্যুর পরে। বিংশ-শতাব্দীতে স্তালিন ও মাও-এর দীর্ঘস্থায়ী দু:শাসনের দু:স্বপ্নের জন্যে অনেকেই পরোক্ষভাবে দায়ী করেছেন এংগেলস প্রচারিত দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদকে। মার্ক্স হলেন সত্যানিষ্ঠ, পণ্ডিত, তাত্ত্বিক; এংগেলস হলেন নিয়মতান্ত্রিক, যান্ত্রিক, নির্মম, যোদ্ধা। অতএব তাঁকে যত নষ্টের গোড়া করতে অসুবিধে নেই। মার্ক্সের ছিল প্রতিভা, ব্যক্তিত্ব, কিন্তু তাঁর অবলম্বন মূলত: পুঁথিপড়া জ্ঞান । এংগেলসের অভিজ্ঞতা ছিল মালিক ও শ্রমিক—উভয়ের জীবনযাত্রা সম্পর্কে; তিনি কারখানা চালিয়েছেন, শ্রমিক মজুর খাটিয়েছেন, অংশগ্রহণ করেছেন সশ্রস্ত্র সংগ্রামে। অর্থনীতির তত্ত্বই মার্ক্সের প্রধান শক্তি—এংগেলস পদচারণা করেছেন বিভিন্ন ও বিচিত্র বিষয়ে—উপনিবেশবাদ, নারীবাদ, ধর্ম, আধুনিকতা, পরিবেশ, গণতন্ত্র থেকে শুরু করে জাতিভেদ, সামরিক ইতিহাস এবং ডারউইনের তত্ত্ব। লেখক মোটামুটিভাবে সফল হয়েছেন মার্ক্সের দীর্ঘ ছায়ার অন্তরাল থেকে তাঁকে বার করে এনে নিজস্ব রূপে তাঁকে প্রকাশ করতে।
রাজনৈতিক নেতাদের জীবনী পড়ে প্রায়শই হতাশ হতে হয়—জীবনীকারদের ব্যক্তিগত পক্ষপাত অনুযায়ী তাঁরা হয়ে দাঁড়ান দেবতা অথবা দানব। কিন্তু বেশিরভাগ মহান ব্যক্তিই দোষে-গুণে ভরা মানুষ। হান্টের একটা বড় সাফল্য এই যে তাঁর রচনায় এংগেলস রক্তমাংসের মানুষ—তাঁর দ্বন্দ্ব-দ্বিধা, তাঁর কামনা-বাসনা, তাঁর লোভ-ঘৃণা, তাঁর ব্যক্তিগত খামখেয়াল, তাঁর উদ্ভাবনী শক্তি ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা, তাঁর স্বার্থহীনতা ও আত্মত্যাগ—সবই পাঠকের সামনে প্রকাশ পায় এই গ্রন্থে। নারী-সুরা-বিলাসিতায় আসক্ত ভিক্টোরিয়ান যুগের এই অভিজাত মানুষটিকে দাস-দাসী পরিবৃতগৃহে মার্ক্সের কন্যাদের ও তাঁদের সন্তানদের সঙ্গে স্নেহময় খুনসুটিতে মগ্ন অবস্থায় দেখলে বিশ্বাসই করতে ইচ্ছে হবে না, এই মানুষটিই পৃথিবীময় পুঁজিবাদকে মূলসমেত উপড়ে ফেলতে উদ্যত হয়েছিলেন ।
১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পরে লেনিন ও স্তালিন উভয়েই এংগেলস ও তাঁর দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের তত্ত্বকে ব্যবহার করেছেন তাঁদের ক্ষমতা করায়ত্ত এবং কেন্দ্রীভূত করার জন্যে। ফলে অনেক ঐতিহাসিকই তাঁদের শাসনকালীন সন্ত্রাস ও অত্যাচারের জন্যে এংগেলসকে দায়ী করেন। অথচ যে রুশ বিপ্লবী নেতা এংগেলসের সব থেকে কাছের মানুষ ছিলেন, সেই গেওর্গি প্লেখানভ (১৮৫৬-১৯১৮)-ই বলশেভিক পার্টির ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি বলশেভিক বিপ্লবকে “A political abortion after the manner of the ancient Chinese or Persian empires—a renewal of Tsarist despotism on a communist basis” বলে অভিহিত করেন এবং বিরোধী মেনশেভিক দলে যোগ দেন। অর্থাৎ ওসামা বিন লাদেনের গণহত্যার জন্যে যেমন নবী মহম্মদ দায়ী নন, ধনতন্ত্রে ধনী-দরিদ্রের আয়ের তীব্র বৈষম্যের দায় যেমন অ্যাডাম স্মিথের ওপরে পড়ে না, তেমনি স্তালিন ও মাও-এর শাসনকালীন নারকীয় ঘটনাবলীর দায়িত্ব সম্পূর্ণ তাঁদের—লন্ডন-নিবাসী দুই দাড়িওয়ালা, প্রৌঢ় দার্শনিকের নয়।