দ্য ওয়ার্মথ্ অফ আদার সান্স — দ্য এপিক স্টোরি অফ আমেরিকা’স গ্রেট মাইগ্রেশান; ইসাবেল উইলকারসন; প্রথম প্রকাশ: সেপ্টেম্বর, ২০১০; র্যান্ডাম হাউস; পৃষ্ঠাঃ ৬৪০;
|| ১ ||
১৯১৭ সালে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার সান গ্যাব্রিয়েল পর্বতমালার শীর্ষে অবস্থিত মাউন্ট উইলসন মানমন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হ’ল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ দূরবীন। দু বছর পরে ১৯১৯ সালে সেখানে গবেষণার কাজে যোগ দিলেন তরুণ জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডুইন পাওয়েল হাব্ল (১৮৮৯-১৯৫৩)। যন্ত্র ও মানবের এই অদ্বিতীয় যোগাযোগের ফলে ঘটল বিজ্ঞানের যুগান্তকারী আবিষ্কার। এতদিন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন আমাদের ছায়াপথ অর্থাৎ ‘মিল্কিওয়ে’ হ’ল মহাবিশ্বের একমাত্র তারকাপুঞ্জ অর্থাৎ ‘গ্যালাক্সি’। কিন্তু নতুন শক্তিশালী দূরবীনের সাহায্যে হাব্ল প্রমাণ করলেন আরও অনেক গুলি তারকাপুঞ্জের অস্তিত্ব। অতএব তাদের মধ্যেও সূর্যের মতন নক্ষত্র থাকা সম্ভব এবং সেই সূর্যের চারপাশে সৌরমণ্ডল ও গ্রহ-উপগ্রহ; এবং সেই সব গ্রহ-উপগ্রহে অনুভব করা যেতে পারে অন্য সূর্যের উষ্ণতা। এই তত্ত্ব থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের নামকরণ।
আমেরিকার কৃষ্ণকায় মানুষের ইতিহাসটি করুণ এবং রক্তাক্ত। কলম্বাস আমেরিকা মহাদেশের মাটিতে প্রথম পা রাখেন ১৪৯২ সালে। তার ১২৮ বছর পর ব্রিটেনের প্লিমাথ বন্দর থেকে ১০২ জন যাত্রী এবং ৩০ জন নাবিক সহ রওনা হয় ‘মে ফ্লাওয়ার’ জাহাজ। আমেরিকার মাটিতে তাঁরা গড়ে তোলেন প্রথম ইয়োরোপিয় উপনিবেশ — প্রয়াত কুমারী রাণী এলিজাবেথের সম্মানে তার নাম রাখা হয় ‘ভার্জিনিয়া’। সেখানে বিশাল, উর্বরা ভূখণ্ডের মালিক হয়ে বসলেন ইয়োরোপিয়রা এবং শুরু করলেন তামাকের চাষ। কিন্তু খেতমজুর পাওয়া মুশকিল এবং সেই সূত্রে ক্রীতদাসপ্রথার সূচনা। সপ্তদশ থেকে উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যে এক কোটি কুড়ি লক্ষ কালো মানুষকে আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল থেকে সংগ্রহ করে বলপূর্বক জাহাজের খোলে ভ’রে শৃঙ্খলিত অবস্থায় পাঠানো হয়েছিল আমেরিকা মহাদেশে। তাঁদের বসবাস মূলত: আমেরিকার দক্ষিণের প্রদেশগুলির খেতে-খামারে-বাগিচায় অমানুষিক পরিশ্রম এবং অবর্ণনীয় অত্যাচারের মধ্যে। তাঁদের কেনাবেচা চলত গৃহপালিত গবাদি পশুদের মতন।
এই অমানবিক প্রথাকে কেন্দ্র করে ১৮৬১ সালে আমেরিকার উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ — চার বছর ব্যাপী যুদ্ধে সাড়ে সাত লক্ষ সৈন্য এবং অসংখ্য অসামরিক জনতার মৃত্যুর পরে দক্ষিণের পরাজয়ে ক্রীতদাস প্রথার সমাপ্তি। কিন্তু কৃষ্ণকায় মানুষদের গণতান্ত্রিক অধিকার এবং অন্যান্য মানবাধিকার পুরোপুরি প্রতিষ্ঠার আগেই রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকনের (১৮০৯-১৮৬৫) মৃত্যু আততায়ীর গুলিতে। পরবর্তী রাষ্ট্রপতি অ্যানড্রু জনসনের (১৮০৮-১৮৭৫) কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল দেশের ঐক্য বজায় রাখা। কৃষ্ণকায় মানুষেরা আর ক্রীতদাস থাকলেন না, হলেন সহায়সম্বলহীন খেতমজুর। শ্বেতকায় জোতদার এবং বর্ধিষ্ণু কৃষকেরা দল বেঁধে এবং অসাধু রাজনীতিকদের সঙ্গে স্বার্থপর যোগসাজসে জারী করলেন একের পর এক বর্ণবৈষম্যবাদী আইন — সমসাময়িক এবং ব্যঙ্গাত্মক যাত্রাপালার নামে নতুন আইনগুলির নাম হ’ল “জিম ক্রো আইন”। কৃষ্ণকায় মানুষদের জন্যে সবরকম পরিষেবা আলাদা এবং নিকৃষ্ট — স্কুল, কলেজ, বাস, রেলের কামরা, হাসপাতাল, রেস্তোরাঁ-সমাধিক্ষেত্র এবং জেলখানা পর্যন্ত! দক্ষিণের প্রদেশগুলি কালো মানুষের নরক।
উত্তর প্রান্তের প্রদেশগুলিতে কালো মানুষের সংখ্যা অল্প, কিন্তু মোটের ওপর তাদের সমানাধিকার। সেখানে কলকারখানার সংখ্যা বেড়েই চলেছে দিনের পর দিন এবং সেই সঙ্গে শ্রমিকের চাহিদা। লোকমুখে এবং কালো মানুষের সাময়িকপত্র--সাপ্তাহিক শিকাগো ডিফেন্ডারের সংবাদের মাধ্যমে সেই তথ্য পৌঁছায় দক্ষিণের মানুষদের কাছে। তাঁরা মনিবদের চোখে ধুলো দিয়ে পালাতে থাকেন উত্তর পানে নতুন জীবনের সন্ধানে — “If all of their dreams does not come true, enough will come to pass to identify their actions.” ১৯১৫ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে ষাট লক্ষ গরীব, সম্বলহীন কৃষ্ণকায় মানুষ এক বস্ত্রে চলে আসেন দক্ষিণের প্রদেশগুলি ছেড়ে আমেরিকার উত্তরপূর্ব, মধ্যপশ্চিম ও পশ্চিম অঞ্চলে। এই ‘বিশাল অভিবাসন’ অথবা ‘দ্য গ্রেট মাইগ্রেশান’ এর ফলে ন্যু ইয়র্ক, শিকাগো, ডিট্রয়েট, ক্লিভল্যান্ড প্রভৃতি শহরে কৃষ্ণকায় মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় শতকরা চল্লিশ ভাগ এবং কলকারখানায় কালো শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে হয় দ্বিগুণ।
|| ২ ||
ইসাবেল উইলকারসনের জন্ম ১৯৬১ সালে আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন ডি. সি. শহরে। তাঁর মা-বাবা দুজনেই এই বিশাল অভিবাসনের অংশিদার অর্থাৎ দক্ষিণের ‘জিম ক্রো’ কানুনের হাত থেকে পালিয়ে আসা মানুষজন। মা এসেছেন জর্জিয়া থেকে, বাবা ভার্জিনিয়া থেকে। তাঁদের এবং অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের মুখে তিনি শুনেছেন দক্ষিণের প্রদেশগুলিতে কৃষ্ণকায় মানুষের অসহনীয় দারিদ্রের এবং তাদের ওপরে অমানুষিক অত্যাচারের কথা। হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতার ডিগ্রি করার পর তিনি সাংবাদিকতা করেন সম্ভ্রান্ত সংবাদপত্রে — লস এঞ্জেলিস টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট ও ন্যু ইয়র্ক টাইমস।
১৯৯৩ সালে তিনি যখন শিকাগো শহরে ন্যু ইয়র্ক টাইমস সংবাদপত্রের প্রধান সংবাদদাতা, তখন তুমুল বন্যা হয় সেই অঞ্চলে। ভয়াবহ বন্যার প্রতিবেদন লিখে তিনি ১৯৯৪ সালের পুলিৎসার পুরস্কার পান — সেই প্রথমবার কোনো কৃষ্ণকায় নারী পেলেন সেই পুরস্কার। গত পনেরো বছর ধরে তিনি এই গ্রন্থের জন্যে গবেষণা ও তথ্যসংগ্রহে রত। কাজটির সূচনা হয়েছিল একটি মুখর ইতিহাসের (Oral History) প্রজেক্ট হিসেবে। ১৯৩০এর দশাব্দে এরকম কাজ হয়েছিল সরকারী উদ্যোগে — মুক্তিপ্রাপ্ত প্রাক্তন ক্রীতদাসদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তাঁদের জীবনকাহিনী লিপিবদ্ধ করা — প্রায় ২০০০জন প্রাক্তন ক্রীতদাস-ক্রীতদাসীর গল্প সংগৃহীত হয়েছিল সেখানে। ইসাবেল একাই কাজ শুরু করলেন দক্ষিণ থেকে উত্তরে পালিয়ে আসা কৃষ্ণকায় মানুষজনের কাহিনী সংগ্রহের — অসংখ্য নর-নারীর সঙ্গে কথাবার্তা বলে শেষ পর্যন্ত বেছে নিলেন তিন জনকে — তাঁদের প্রত্যেকের সাক্ষাৎকার নিলেন একশো ঘন্টারও বেশি সময় ধরে। গ্রন্থটি সমসাময়িক ইতিহাসের পটভূমিতে তিনজন মানুষের স্মৃতিচারণ। ৬৪০ পাতার নন ফিকশান গ্রন্থের মধ্যে তিনটি সম্পূর্ণ নভেলা—
(১) আইডা মে ব্র্যান্ডন গ্ল্যাডনি — মিসিসিপি রাজ্যের চিকাসো কাউন্টির একটি গণ্ডগ্রাম ছেড়ে পালিয়ে আসেন ১৯৩৭ সালের অক্টোবর মাসে। পালিয়ে আসতে হয় রাতের অন্ধকারে — স্বামী জর্জ সন্ধের পরেই চলে যান ট্রেন ডিপোতে কাউকে কিছু না বলে। আইডা মে এবং তার দুই সন্তান ভেলমা (ছয়) এবং জেমস (দুই) কে তাঁর ভাসুর গভীর রাতে ট্রাকের পেছনে বসিয়ে পৌঁছে দেন ডিপোতে। সেই প্রথম তাঁদের দূর পাল্লার ট্রেনে চড়া এবং গন্তব্য শিকাগো। তাঁরা ঘর ছাড়েন প্রাণের ভয়ে — মুরগী চুরির মিথ্যে অপরাধে স্থানীয় জোতদারের দলবল তাঁদের এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে মারধোর করে আধমরা করে দেয়; তাঁদের ওপরেও আক্রমণ হ’তে পারে, এই আতঙ্কে তাঁরা পালিয়ে যান। শিকাগোতে জর্জ চাকরি পান ক্যাম্পবেল স্যুপের কারখানায়, আইডা মে স্থানীয় হাসপাতালে। সেখানেই কাটে তাঁদের বাকি জীবন। আর কোনোদিন তাঁদের তুলোর ক্ষেতে সামান্য মাইনেতে দিনমজুরি করতে হয়নি। শেষজীবনে একদিন তাঁদের মহল্লার কমিউনিটি সেন্টারে নাগরিকদের অভাব অভিযোগ শুনতে আসেন স্থানীয় স্টেট সেনেটার — এক দীর্ঘকায় কালো যুবক, নাম — বরাক হুসেন ওবামা!
(২) জর্জ সোয়ানসন স্টারলিং — ফ্লোরিডা প্রদেশের ইউস্টিস গ্রামে তাঁর বসবাস ছিল। জর্জ এবং তার স্ত্রী ইনেজ, দুজনেই খেতমজুর, কাজ করতেন কমলালেবুর বাগিচায় — সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত মই কাঁধে নিয়ে এক লেবুর গাছ থেকে অন্য লেবুর গাছে গিয়ে কমলালেবু পেড়ে ঝুলিতে ভরার হাড়ভাঙা পরিশ্রম। জর্জ লেখাপড়া জানতেন — স্কুলের পড়া শেষ করে অল্প কিছুদিনের কলেজ--কিন্তু অর্থাভাবে পড়া শেষ করতে পারেননি। বাগিচার ম্যানেজাররা কিভাবে নিরক্ষর মজুরদের ঠকায়, তিনি বুঝতে পারতেন এবং সুযোগ পেলেই প্রতিকারের চেষ্টা করতেন। বার বার শ্রমিকদের হয়ে ন্যায্য পারিশ্রমিক দাবী করতে গিয়ে তাঁর জীবনসংশয় ঘনিয়ে আসে। তিনি সংবাদ পান ষড়যন্ত্রের — তাকে ধরে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হবে গ্রাম থেকে ১৮ মাইল দূরের সাইপ্রেস জলাভূমিতে ‘নেকটাই পার্টির’ জন্যে — অর্থাৎ গাছের ডালে তাঁকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে মদ খেয়ে হৈহুল্লোড় করবে শ্বেতকায় ম্যানেজার ও তার সাঙ্গপাঙ্গ গুণ্ডারা। তখন ১৯৪৫ সালে ফ্লোরিডায় সাদা মানুষের হাতে কালো মানুষ খুন হলে (তার নাম ছিল লিনচিং, নরহত্যা নয়) পুলিস তদন্ত করতেও আসে না। মনিবের একজন ভৃত্যের মুখে সংবাদ পেয়ে জর্জ সেইদিনই লুকিয়ে ট্রেন ধরে পালিয়ে যান ন্যু ইয়র্ক। পরে তাঁর স্ত্রী যোগ দেন তাঁর সঙ্গে। জর্জ চাকরি পান রেল কোম্পানিতে — রাতের দূরপাল্লার ট্রেনে মোট বইবার এবং যাত্রী তদারকের। পরবর্তী পাঁচ দশক তিনি চাকরি করেছেন ট্রেনে ন্যু ইয়র্ক থেকে ফ্লোরিডা, কিন্তু কোনোদিন পা রাখেননি তাঁর গ্রামের মাটিতে।
(৩) রবার্ট জোসেফ পার্শিং ফস্টার — ইনি থাকতেন লুইজিয়ানা রাজ্যের মনরো শহরে — অন্য দুজনের তুলনায় শিক্ষিত ও বর্ধিষ্ণু। বাবা কৃষ্ণকায় হাইস্কুলের প্রিন্সিপাল, মা প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা — তাঁরা নিম্নমধ্যবিত্ত এবং উচ্চশিক্ষার মূল্য জানতেন। শৈশব ও ছাত্রজীবন কাটে কড়া ডিসিপ্লিনের মধ্যে — স্কুলের পড়া শেষ করে উজ্জ্বল ফলাফল এবং জর্জিয়া রাজ্যের অ্যাটলান্টা শহরের সম্ভ্রান্ত মোরহাউস কলেজে যোগদান — সেখানে কলেজ প্রেসিডেন্টের কন্যার সঙ্গে প্রেম ও বিবাহ। কলেজ শেষ করে টেনেসি রাজ্যের মেহারি মেডিক্যাল কলেজ — ডিগ্রি পেলেন শল্য চিকিৎসায়, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় চিকিৎসা করলেন ইয়োরোপের সামরিক হাসপাতালে, কিন্তু দেশে ফেরার পরে সুযোগ পেলেন না ডাক্তারির। দক্ষিণের প্রদেশগুলিতে কোনো শ্বেতকায় রোগী (বিশেষ করে রোগিনী) অসুখ করলেও দেখাতে যাবেন না কৃষ্ণকায় ডাক্তারের কাছে। ভালো হাসপাতালের চাকরিগুলিও শ্বেতকায় ডাক্তারদের জন্যে সংরক্ষিত। শেষ পর্যন্ত তিনি লুইজিয়ানা ছেড়ে ক্যালিফোর্নিয়ার দিকে রওনা দিলেন ১৯৫৩ সালে। একা গাড়ি চালিয়ে ২০০০ মাইলের অধিক পথ, রাস্তার ধারের সরাইখানাগুলিতে কালো মানুষের প্রবেশ নিষেধ — তাঁর যাত্রার করুণ, নির্মম বর্ণনা করেছেন লেখিকা। যাত্রা শেষে লস এঞ্জেলিস শহর — সেখানে ডাক্তারির পসার জমানো এবং নতুন করে সংসার পাতা — ভবিষ্যতেও হতাশা আসে অবশ্যই কিন্তু বাকি জীবন মোটামুটি বর্ণ-বৈষম্যহীন।
লেখিকার ভূমিকাটি গল্প বলিয়ের, সাংবাদিকের এবং সমাজ-সচেতন ঐতিহাসিকের — তিনটি কাজেই তিনি সফল। তিন অভিবাসীর কাহিনী তিনি বর্ণনা করেছেন পরম মমতায় — চরিত্রগুলি প্রাণ পেয়েছে তাঁর লেখনীতে — ৬৪০ পাতার বই এক নি:শ্বাস না হলেও সহজেই পড়ে ফেলা যায়। গ্রন্থটির নামের আরও একটি উৎস কৃষ্ণকায় কথাসাহিত্যিক রিচার্ড রাইটের (১৯০৮-১৯৬০) আত্মজীবনী “কৃষ্ণকায় বালক — শৈশব ও কৈশোরের বিবরণ” গ্রন্থের একটি লাইন থেকে — “I was taking a part of the south to transplant in alien soil, to see if it could grow differently, if it could drink new and cool rains, bend in strange winds, respond to the warmth of other suns, and perhaps to bloom.” রিচার্ড রাইট নিজেও জন্মেছিলেন মিসিসিপিতে এবং ১৯২৭ সালে পালিয়ে আসেন শিকাগো শহরে।
|| ৩ ||
আমি জন্মেছি দ্বিখণ্ডিত, বিভাজিত দেশে, গল্প শুনেছি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার, ছিন্নমূল মানুষের দুঃখ দুর্দশার, সংখ্যালঘুর ওপরে খুন, ধর্ষণ, লুঠতরাজের করুণ কাহিনী। আত্মীয়স্বজনের মুখে শুনেছি — আমার মা ১৯৪৬-এর দাঙ্গার সময় প্রাণভয়ে ভীত এবং সংখ্যালঘু বালককে লুকিয়ে রেখেছিলেন আমাদের খাটের তলায়। নিজের চোখে দেখেছি ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর উদ্বাস্তুর স্রোত, ১৯৭১ সালের উদ্বাস্তু শিবির। পড়েছি মান্টোর ‘টোবা টেক সিং’ সমরেশ বসুর ‘আদাব’, গিনসবার্গের ‘যশোর রোডে সেপ্টেম্বর মাস’, ‘কেয়াপাতার নৌকা’ অথবা ‘অর্জুন’। আমাদের ছিন্নমূল মানুষদের নিয়ে ওরাল হিস্ট্রির কাজ হওয়া অবশ্য প্রয়োজন, জানি না হয়েছে কিনা; তবে সেই ইতিহাসকে ধরে রেখেছেন নির্মম সততায় ঋত্বিক, প্রফুল্ল, অতীন, শীর্ষেন্দু, সুনীল, মিহির, শান্তা, সুনন্দা, হাসান, তানভীর — তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই আমাদের।
আমেরিকার সংখ্যালঘুদের ওপরে বৈষম্য ও উৎপীড়নটি ধর্মভিত্তিক নয় — উভয় পক্ষই খ্রীস্টধর্মী — তা অর্থনৈতিক এবং বর্ণভিত্তিক। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে সমগ্র পৃথিবী জুড়ে রাজত্ব করেছে শ্বেতকায় মানুষ — আপন প্রভুত্ব বজায় রাখতে তারা বদ্ধপরিকর — তার সঙ্গে “সাদা মানুষের বোঝা” বিষয়ক অহমিকা এবং নিজ সম্প্রদায়ের শোণিতের বিশুদ্ধতা বজায় রাখার নিষ্ফল প্রচেষ্টা। ১৯৬৫ সালে রাষ্ট্রপতি লিন্ডন জনসনের নেতৃত্বে সর্বজনীন ভোটাধিকার আইন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে দক্ষিণের কালাকানুনগুলি শিথিল হয় অনেকটাই। তবে বর্ণবৈষম্য এবং জাতিভেদের তলানি থেকেই যায় কিছু কিছু মানুষের মনে।
আমেরিকার উল্লেখযোগ্য এবং বিখ্যাত অনেক মানুষই দক্ষিণ থেকে উত্তরে আসা পরিযায়ী পরিবারের সন্তান — লেখিকা টোনি মরিসন, রিচার্ড রাইট, জেমস বল্ডউইন; গায়িকা ডায়ানা রস, আরেথা ফ্র্যাংকলিন, মাইকেল জ্যাকসন, জিমি হেনড্রিক্স; দৌড়বীর জেসি ওয়েন্স, মুষ্টিযোদ্ধা জো লুইস; টেনিস প্রতিভা ভেনাস এবং সেরিনা উইলিয়ামস; আমেরিকার প্রথম রমণী মিশেল রবিনসন ওবামা ও অন্যান্য। এঁরা দক্ষিণে থেকে গেলে এবং বৈষম্যময় কালাকানুনের ছায়ায় মানুষ হ’লে তাঁদের প্রতিভার শীর্ষে পৌঁছাতে পারতেন কিনা বলা মুশকিল।
ভাবতে অবাক লাগে গ্রন্থটি লেখিকার প্রথম। পনেরো বছরের পরিশ্রম, দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত হাজার হাজার মাইল ভ্রমণ, এক হাজার দুশো জনের সাক্ষাৎকার, গ্রন্থাগারে ও অভিলেখাগারে ঘন্টার পর ঘন্টা পুরানো বই ও দলিলপত্র ঘেঁটে এই গ্রন্থের প্রস্তুতিপর্ব। লেখিকা আবার ফিরে গেছেন দক্ষিণে, বাস করেন অ্যাটলান্টা শহরে এবং সাংবাদিকতার অধ্যাপিকার কাজ করেন দুটি সম্ভ্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলাভাষায় তাঁর গ্রন্থের আলোচনা করছি — এই সংবাদ পেয়ে তিনি উত্তেজিত এবং আনন্দিত!