(প্রথমেই বলে রাখি এটা কবি নবনীতা দেব সেনের সামগ্রিক কাব্যজীবন নিয়ে আলোচনা একেবারেই নয়। শুধু ওঁরই একটা কথার সূত্র ধরে ওঁর কবিমনকে একটু ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছি। নিজের স্মৃতি হাতড়ে ওঁর কবিতার ছিটে-ফোঁটা যা পেয়েছি তাকে সম্বল করেই ওঁর কবিতার ঝুলবারান্দায় একটু উঁকি মারার প্রয়াস এটা।)
“ভাষা তো বুনো ঘোড়া, তাকে পোষ মানিয়ে জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে দিয়ে বাজনার তালে তালে লাফ দেওয়ানোর নাম কবিতা।”
সেই বুনো ঘোড়া সহজেই পোষ মেনেছিল তাঁর কাছে, আমরা পাঠকরা সেটা বুঝতে পারি ১৯৫৯-এ প্রকাশিত তাঁর ‘প্রথম প্রত্যয়’ কাব্যগ্রন্থে। শুরুতেই কবিতাপাঠকের হৃদয় ছুঁয়েছিল তাঁর কলমের দৃপ্ত সূচনা।
‘আমি তো চাই কঠিন অসিধারাশুরু করেছিলেন এভাবে। অসাধারণ এই উচ্চারণ। চ্যালেঞ্জ তাঁর মজ্জাগত। ভাষা সাবলীলভাবে তাঁর মুঠোয় বন্দী। হৃদয় আর মেধার মেলবন্ধনের আশ্চর্য উদাহরণ ওঁর কলমে।
দৃশ্যাতীতে অতনু প্রশ্রয়
হলুদ হলে লোহিতে দিশেহারা
দীঘির জলে নয়ন ঢাকে ভয়।
হয়তো ছকে তোমার চেনা ঘুঁটি
এবং খেলা তোমার স্থির জয়
তবুও আমি চতুরতর জুটি
আমার হারে তোমার জিৎ নয়।’
নবনীতা দেব সেন। তিনি কবি, না গল্পকার, না কি ঔপন্যাসিক, কিংবা তাত্ত্বিক প্রাবন্ধিক, রম্য রচনাকার, শিশু সাহিত্যিক, অথবা রূপকথার স্থপতি! কোন অভিধায় তাঁকে চিহ্নিত করা যাবে? সর্বত্রই তাঁর সাবলীল কলমচালনা। পোষ মানানো বুনো ঘোড়ার লাগাম মুঠোয় ধরে সাহিত্যের সব পথেই তাঁর অবাধ যাতায়াত। জন্মেই তো নিঃশ্বাস নিয়েছিলেন কবিতায়। গর্ভধারিণী কবি, সুতরাং কবিতার সঙ্গে নাড়ির যোগ। কবি-দম্পতি নরেন্দ্র দেব-রাধারাণী দেবীর একমাত্র সন্তানটির তাই চক্ষুদান হয়েছিল কবিতার আলোয়। কবিতাকে দর্পণ করেই জীবনের সঙ্গে পরিচয়। কবিতাই তাঁর আদি প্রেম, প্রথম প্রত্যয়।
বাঙালির কাছে নবনীতা দেব সেন একটি বহু পঠিত বইএর মতো। সবাই তাঁর সবটুকু জানে। কারণ মানুষটাই যে অমন উন্মুক্ত। তিনি নিজেই তো তাঁর জীবনের স্তরগুলোকে খুলে খুলে বিভিন্ন সময়ে উপহার দিয়েছেন পাঠককে। পাঠকরাই তাঁর অন্তর বাহিরের পড়শি। সেই তো হাসিখুশি ছটফটে পঁচাত্তরে পনেরোর উচ্ছলতা, প্রাণশক্তিতে ভরপুর একজন মানুষ--সবাই তাকে এভাবেই জানে এভাবেই দেখতে অভ্যস্ত। তাঁর জীবনযাপন, প্রতিদিনের সূর্যোদয় সূর্যাস্তের দিনলিপিও বাঙালির মুখস্থ। তাঁর ঝরঝরে সরস গদ্যসাহিত্য বুঁদ করে রেখেছে আট থেকে আশি বয়সের বাঙালি পাঠককে। সেই বহুচর্চিত জীবনচিত্রের নিচে যে অন্তঃসলিলা কবিতার ফল্গধারা তিনি আগলে রেখেছেন বুকের গভীরে, বিচিত্রধারার গদ্য-যাত্রার শেষে ক্লান্ত মাথা নামিয়ে রাখেন যেখানে, তাঁর সেই কবিতাযাপনকে একটু ছুঁয়ে দেখা যাক।
“‘সৎ কবিতা হলো টাইম ক্যাপসুল। তার মধ্যে অতি সংক্ষিপ্তসারে কবির অন্তর বাহিরের সবটুকুই গুছিয়ে তোলা থাকে"--এটা ওঁর বিশ্বাস। কিন্তু অন্তর যখন বাহির দিয়ে আক্রান্ত হয়, অনুভব যখন উপচে পড়ে কথার ধারায়, তখন শুধু কবিতা আর তাকে ধারণ করতে পারে না। তখন পা রাখতে হয় গদ্যের শক্ত মাটিতে। ওঁর জীবনে এটাও ধ্রুব সত্য।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের মেধাবী ছাত্রীটি তখন বিশ্বসাহিত্যের প্রশস্ত প্রাঙ্গণে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। প্রবল অনুসন্ধিৎসা নিয়ে পৃথিবীকে দেখছেন। লোভীর মতো কোঁচড় ভরছেন চারপাশের ছড়ানো ঐশ্বর্য দিয়ে। যা দেখেন তাতেই তার বিস্ময়, উচ্ছ্বাস। পৃথিবীর তুচ্ছতম ঘাসফুলটির কাছ থেকেও আহরণ করেন আনন্দের উপকরণ। বুকের ভেতর ঢুকে গেছে নতুন স্বপ্নের বীজ। প্রতিদিন নতুন বিস্ময়, নতুন আবিষ্কার। আবিষ্কার নিজেকেও। কবিতায় ভাবা, কবিতায় স্বপ্ন দেখা, কবিতায় জীবনযাপন। ততদিনে ভালোবাসার হাত ধরে কাছাকাছি এসেছেন অর্থনীতির তরুণ কৃতী অধ্যাপকটির। প্রেম আর কবিতা যখন হাত ধরাধরি করে চলছে, তখনি আমরা তাঁর কবিতায় এমন অসামান্য উচ্চারণ পেয়ে যাই
“যখনই আমাকে তুমি ভালোবাসোযখন এমনি জলে স্থলে বাঁশি বাজছে, উচ্চশিক্ষার জন্যে পাড়ি দিলেন অতলান্তিকের ওপারে। মায়ের আগ্রহে এবং বুদ্ধদেব বসুর উৎসাহে--ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে। বিষয় ছিল Reception of Rabindranath Tagore in England, France, Germany and United states. তখন তিনি সদ্য বাগদত্তা। ভালোবাসার মানুষটি কেমব্রিজে। জীবনের পরিধি বেড়ে গেছে। পৃথিবীর যাবতীয় খুঁটিনাটির প্রতি গভীর আগ্রহ। উড়োজাহাজ থেকে ঘাসফুল, সবকিছুতেই তীক্ষ্ণ মনোযোগ। এটা তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কাজেই অভিজ্ঞতার ঝুলি তো উপচে পড়বেই। কবিতার স্পর্শকাতর পরিসরে তখন আর কুলোচ্ছিল না। হাত ধরলেন কথা সাহিত্যের।
এমন কি কপালের উড়োচুলও প্রণয় কাতর
ফ্রয়েডীয় তালিকার নির্দেশ ছাপিয়ে
যৌনতার তীব্রতায় হয়ে ওঠে কামনা কুলীন ...”।
১৯৬০এ অমর্ত্য সেনের সঙ্গে বিয়ের পর ইংল্যান্ডে প্রথম সংসার--স্বপ্নে ভালোবাসায় থইথই। ঘরকন্না সামলে বিদূষী মেয়ের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Comparative Literature-এ ডিস্টিংকশন সহ মাস্টার্স ডিগ্রী লাভ। তখনও তো কলমের ডগায় কবিতা ছিল —
“কোথাও যদি হঠাৎ অসময়ে১৯৬৪-৬৫, বার্কলে-তে পোস্ট-ডক্টর্যাল রিসার্চ ফেলোশিপ, বিষয়--Technique of Oral Composition: A Structural Analysis of the Valmiki Ramayana. হোমারের মহাকাব্য এবং যুগোশ্লাভিয়ার মৌখিক গানের গঠনশৈলী বিষয়ে মিলম্যান প্যারি ও অ্যালবার্ট বি লর্ডের গবেষণালব্ধ যে তত্ত্ব, সেই বিশ্লেষণ-পদ্ধতি তিনি বাল্মিকী রামায়ণে প্রয়োগ করেছিলেন। ভারতীয় মহাকাব্য নিয়ে নবনীতার এই গবেষণা তাঁকে পথিকৃৎ হিসেবে মান্যতা ও সম্মান দিয়েছে। গর্বের বিষয় এই যে, তাঁর কাজের ওপর নির্ভর করে রাশিয়া ও স্কটল্যান্ডে রামায়ণ বিশেষজ্ঞরা মহাভারত নিয়ে কাজ করেছেন।
অবোধ কোনো চড়ুই ডেকে ওঠে
অমনি তুমি ব্লুমিংটনে নেই ...”
এরই মধ্যে প্রথম মাতৃত্বের মধুর বিহ্বলতা। কবিতা তখনও তাঁর হাত ধরে ছিল। নবজাত কন্যাকে ঘিরে একের পর এক কবিতা জন্ম নিচ্ছে। লেখা হচ্ছে 'স্বাগত দেবদূত'।
বিদেশে সংসার সন্তান ভালোবাসা নিয়ে পূর্ণ তাঁর স্বপ্নের বৃত্তটি যখন একদিন দমকা হাওয়ায় ভেঙে গেল, থমকে গেলেন, কিন্তু ভেঙে পড়লেন না। বুকের মধ্যে কবিতার পাখিটি পোষা ছিল, সে তার ডানার নিচে আশ্রয় দিলো।
“অন্যের চৌকাঠে বসে গৃহস্থালি খেলা সাঙ্গ হলো,দাম্পত্য-সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার ক্ষেত্রে সচরাচর দেখা যায় অনেক তিক্ততা, অনেক কাটাকুটি রক্তপাত, কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির মধ্যে দিয়ে সম্পর্কটা ভাঙে। ওঁর ক্ষেত্রে মনে হলো--সমাপন। একটি সম্পর্কের সমাপ্তি। যেন জীবন থেকে দাম্পত্যসম্পর্কটা চুরি হয়ে গেছে। যত্নে ভালোবাসায় গড়ে তোলা একটি মৃৎ ভাস্কর্য অনবধানে হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেল যেন। কিন্তু সেই ভাঙা টুকরো আঁকড়ে তিনি লুটিয়ে পড়েননি, একপাশে সরিয়ে দিয়েছেন শুধু। কোথাও তো ক্ষতচিহ্ন থাকেই, থাকে অশ্রুর দাগও। তাকে সময়ের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। কবিতা সঙ্গে ছিল বলেই শান্তভাবে লিখতে পারলেন--"'বর' 'শ্বশুরবাড়ি' এসব শ্রীছাঁদের সঙ্গে বরণডালায় সাজানো, সিঁদুর মাখানো, লক্ষ্মীর ঝঁপিতে তোলা শব্দগুলি, ধমনীর স্রোতের সঙ্গে যা এক হয়ে গিয়েছিল কখন আবার 'ডিভোর্স' শব্দের প্রবল প্রতাপে তারা খরচ হয়ে গেল। ওই রকম ভয়ঙ্কর খুনখারাবির রঙের নাঙ্গা তলোয়ারের মত শব্দ 'ডিভোর্স' যে কোনোদিন এই আমারই হাতবাক্সে এসে ঢুকবে, এ কেউ ভেবেছিল?"।
এবার নিজের ঘর গড়ো
এবার নিজের হাতে নিজেকে নির্মাণ —
সদর্পে হরণ করো নিয়তির শাড়ি . . . .”
বুকের মধ্যে কবিতার গুঞ্জন না থাকলে শব্দকে এমন ভাবে অনুভব করা, সম্ভব? শব্দ নিয়ে ওঁর এই হৃদয় আলোড়িত করা ব্যঞ্জনা পড়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। 'শব্দ পড়ে টাপুরটুপুর'-নিবন্ধটাকে তাহলে কী বলব, নিবন্ধ না কবিতা?
ডিভোর্স শব্দটা এতকাল আমরা যেভাবে নির্লিপ্ত চোখে দেখতাম, এটা পড়ার পর সে তার সমস্ত নিষ্ঠুরতা ও বিবেকহীনতা নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো। শব্দটা যে সত্যিই নাঙ্গা তলোয়ারের মতো, রক্তপাত ঘটায়, বিশ্বাস করতে বাধ্য হলাম। যদিও ওঁর জীবনে ওটা তেমন শব্দ নয় যা ইরেজার দিয়ে ঘসে মুছে ফেলা যায়। তবু আর পাঁচটা শব্দের পাশে তাকে শুধু একটি অক্ষরগুচ্ছ হিসেবে রেখে দিয়েই নিজের জন্যে নিজের মতো করে আলাদা এক আলোপৃথিবী রচনা করে নিলেন। আসলে ওই কঠিন শব্দটা তাঁর হঠাৎ থমকে যাওয়া জীবনের জন্যে এক চ্যালেঞ্জ ছিল। নিপুণ দক্ষতায় সে চ্যালেঞ্জ তিনি গ্রহণ করেছেন। তাঁর ভেতরে যে এত শক্তি, এত লড়াই করার ক্ষমতা ও জেদ, তা বোধ হয় তিনি নিজেও জানতেন না। কারণ চিরকেলে আদুরে মেয়ে, মাথার ওপরে তখনও তাঁর বটবৃক্ষের মতো মা ছিলেন। যাঁর ছায়া তাঁকে ব্যতিক্রমী চিন্তা ভাবনার অনুপ্রেরণা দিয়েছে, সাহস জুগিয়েছে। মায়ের স্নেহের কোটরে তিনি ছোট্ট মেয়েটি হয়ে ছিলেন। নিজেই এক নিবন্ধে লিখেছিলেন, 'তোমার মেয়েটাকে তুমি বাড়তে দাওনি, অশেষ কৈশোরে বন্দী করে রেখে দিয়েছ। এই হয়েছে মরণ। জিয়ন কাঠিটি ছিল তোমার হাতে। এবার আমাকেই আমার মা হতে হবে'। ("আমার কোনো তাড়া নেই")
সত্যি সত্যি জিয়নকাঠিটি নিজের হাতে তুলে নিলেন। নিজেকে জাগালেন, বাঁচালেন। ভেঙে যাওয়া চার দেওয়ালের ছোট্ট পৃথিবী পিছনে ফেলে, বিরাট পৃথিবীটাকেই নিজের ঘরবাড়ি করে তুললেন। এখান থেকেই প্রকৃতপক্ষে তাঁর কলম বাঁধভাঙা ঝর্নার মতো জলকলরোলে প্রকাশ পেল। কারণ তখন তো তাঁর কবিতা জেনে গেছে,
“এর পর আর কিছু ভার নেই, বিষ নেই আর,অঙ্কুর তো ভেতরে ছিলই, তাকে কঠিন মাটিতে রোপণ করতেই তার ডালপালা পত্রপুষ্পে বিকশিত হয়ে বাংলাসাহিত্যের প্রাঙ্গণে তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করলো অন্যতম প্রধান লেখক হিসেবে। অন্যধারার লেখক।
ভয় বা উদ্বেগ নেই, আর কোনো সর্বনাশ নেই।"
রোদ ঝলমল আকাশের মাঝখানে হঠাৎ কখনও বৃষ্টির দু’একটি বিন্দু চিকচিক করে উঠলে যেমন সেই আলোকিত দিনটি তার বাড়তি লাবণ্য নিয়ে ধরা দেয়, এমনিভাবেই জীবনের অনেক পাওয়ার মাঝে যদি কোথাও লুকিয়ে থাকে ছোট ছোট অপ্রাপ্তি, অল্পসল্প জোড়াতালি, বা হৃদপিণ্ড কামড়ে ধরা কোন অনুভব, সেই অনুভবকে উন্মোচনের যে দরজা, তার এক নাম যদি হয় অশ্রু, অন্য নাম আনন্দ-নির্ঝর। জীবনের অপরিহার্য এই শব্দযুগল তার সমস্ত ঐশ্বর্য নিয়ে প্রচ্ছন্ন আছে যাঁর সাহিত্যকৃতির মধ্যে, তাঁর নামই তো নবনীতা। জীবনের সবকিছুকে একটু অন্যরকম করে দেখাই তাঁর লেখার বীজমন্ত্র, হয়তো জীবনেরও। কালোকে শুধু কালো না দেখে তার মধ্যেও এককণা আলোর সন্ধান করা তাঁর স্বভাব। কোনো দুঃখ হতাশাই যে জীবনের চরম এবং শেষকথা নয়, তাঁর বিচিত্র ও বহুমুখী সাহিত্যরচনার ভিতর দিয়ে এই ইতিবাচক ভাবনাটিকে সঞ্চারিত করেন আমাদের মধ্যে।
যখন জীবনের ভার বড্ড বেশি ভারি হয়ে গিয়েছিল, সুখ অসুখ আনন্দ যন্ত্রণার ভারে উপচে পড়ছিল তাঁর হৃদয়ের ভাঁড়ার। কবিতা এত ভার বইতে পারছিল না। তখন সেই বুনো ঘোড়া তাঁকে বিচিত্র পর্যটনে ছুটিয়ে নিয়ে গেছে। আরো আরো জীবন দর্শনে। পথে ঘাটে ধুলোয় ঘাসে জীবনের খুঁটিনাটি তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনা থেকে রত্ন খুঁজে নিতে, নিয়েছেন। তাকে সহজ স্বাদু গদ্যে সাজিয়ে দিয়েছেন সাহিত্যের পাতায়। রসগ্রাহী পাঠক সাহিত্যের বিচিত্র পথে সঞ্চরণ করেছেন তাঁর হাত ধরেই।
কথাচ্ছলে একদিন আমাকে বলছিলেন, "অনেকে জানতে চান 'আপনি তো কবিতা দিয়ে শুরু করেছিলেন, কবিতা ছেড়ে গদ্যে চলে এলেন কেন?' কী উত্তর দিই বলতো?"
সত্যিই তো, কী উত্তর দেবেন? গদ্যে চলে এসেছেন, এটুকুই সত্যি। কিন্তু কবিতাকে ছেড়ে তো নয়। কবিতা তো বরাবর তাঁর সঙ্গেই থেকেছে। তাঁর সহজ ঝরঝরে মেদহীন গদ্যের তলায় প্রচ্ছন্ন থাকে কবিতার উষ্ণতা। কবিতাতে জারিত থাকে তাঁর ভাবনা, কবিতাই আসলে নিয়ন্ত্রণ করে তাঁকে। কবিতা তাঁর একান্তের গোপন কুঠুরী। নিজের জীবনে বা চারপাশে অহরহ ঘটে চলা আনন্দধারাকে যেমন কবিতার সঙ্গে ভাগ করে উপভোগ করেন, অনেক অসংগতি যা তাঁর ভাবনাকে পীড়িত করে, ঘুমের আরাম আর জাগরণের স্বস্তি বিঘ্নিত করে, তার মুখোমুখি দাঁড়ান কবিতার ভেতর দিয়ে। আর কথাসাহিত্যের হাত ধরে নবনীতা পর্যটনে বেরোন। সে পর্যটনে স্থান, কাল, মানুষ প্রকৃতি সব তাঁর স্পর্শসীমায়, সবই তাঁর কলমের আঁচড়ে প্রাণ পায়। কখনও গল্পে উপন্যাসে, কখনও রম্যরচনায়, কখনও বা ভ্রমণকাহিনীতে। বুকের তলায় সুপ্ত থাকে ঘরে ফেরার টান। ওঁর কাছে “ভ্রমণ মানেই ঘরবসত। শেকড় খোঁজা। ভ্রমণ চলে যাওয়া নয়, ফিরে আসা। প্রতিদিন এই যে চলে যাওয়া, এই যে হারিয়ে যাওয়া ফুরিয়ে যাওয়া, প্রতিদিনকার এই খরচ হয়ে যাওয়া থেকে নিজেকে একটু বাঁচানো। জমার ঘরে একটুখানি তোলা। দু’চামচে আমি।” (বুঝি কালান্তরে যাবে?) ভ্রমণ তাঁর কাছে চৈতন্যে সূর্যোদয়ের মতো। ভ্রমণের মধ্যে দিয়ে বারবার উৎসে ফিরে আসা। যেভাবে গদ্যচারণার শেষে তাঁর কলম কবিতায় ফিরে এসে ক্লান্তি জুড়োয়। তাঁর এই মানস ভ্রমণে আপামর বাঙালি সম্মোহিত হয়ে আছে কয়েক দশক ধরে।
আর প্রকৃত ভ্রমণে? দেশ থেকে দেশান্তরে উড়ে উড়ে বেড়ানোও তাঁর কাছে কবিতা রচনার মতোই। ইচ্ছে আর স্বপ্নকল্পনার মিশেলে এক আশ্চর্য পক্ষীরাজের ডানার ঝটপটানি। তাঁর ভ্রমণের মন্ত্রও রচনা করে দিয়েছে তাঁর কবিতা।
“একঃ এই যাদু অশ্ব। মরুপথে সেই হয় উট,মাত্র ওই দুটি সরঞ্জাম সম্বল করে জয় করে ফেলেন প্রার্থিতকে। শীতবস্ত্র ছাড়াই পূর্ব পরিকল্পনাহীন পৌঁছে যান দুর্গম পার্বত্য এলাকা তিব্বত সীমান্ত তাওয়াং-এ। প্রস্তুতিবিহীন চলে যান কুম্ভমেলায়। অপরিসীম কষ্টের শেষে ভালোবাসার অমৃতকুম্ভ বয়ে নিয়ে ঘরে ফেরেন। এভাবেই তাঁর কাছে আসে পর্যটনের কবিতা, কবিতার পর্যটন।
আকাশে পুষ্পক আর সপ্তডিঙ্গা সাজে সিন্ধুজলে,
তেপান্তরে পক্ষীরাজ। তার নাম রেখেছিঃ বিশ্বাস।
দুইঃ এই খাপে ভরা মন্ত্রপূত অসি
শাণিত ইস্পাতখণ্ড। অভঙ্গুর। নামঃ ভালোবাসা।
কবিতাই তাঁর হাতে তুলে দেয় এই বীজমন্ত্র। বিশ্বাস আর ভালোবাসা। তাই দ্বিধাহীন বলতে পারেন, 'কী পাইনি দেখতে গেলেই দুঃখ। কী দিইনি সেটা দেখতে হয়, সেখানেই সুখ। যে কোন মানবিক সম্পর্কের গোড়ার কথা এবং শেষের কথা এইটে। পাওয়াটা নিজের হাতের মধ্যে নয়, দেওয়াটা নিজের ক্ষমতার মধ্যে।'
খুব কাছে থেকে দেখেছি বলেই বুঝতে পারি কবিতা তাঁর গোপন রক্তক্ষরণ, আত্মকথন, নিজের মুখোমুখি বসা। আসলে কবিতাই ওঁর জীবনের স্থিতি। 'পায়ের তলা থেকে যতবারই মাটি কেড়ে নিয়েছে জীবন, ঠেলে দিয়েছে একটা হিম গর্তে, কবিতা ততবারই এসে হাত ধরেছে, টেনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে শক্ত জমির ওপর, আলোর উষ্ণতায়। কবিতা কবিকে একেবারে পরিত্যাগ করে না, ফিরে ডাকার অপেক্ষা করে।" তাই কবিতা এখনও উজ্জলভাবে আছে। তিনি ডাকলেই ফিরে আসে তাঁর কাছে।
“প্রতিদিন রাত্রি নেমে এলেআগের চেয়ে অনেক বেশি আত্মস্থ কবিতার আবেগ। ঘন কেন্দ্রীভূত। মাটির বাকমূর্তি এখন টেরাকোটা হয়েছে, সব অর্থেই। পুড়েছে জীবনের আঁচে। সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থটি 'তুমি মনস্থির করো' সেকথাই বলে।
আমি তাঁকে খুঁজে আনি
আমি তার চোখে চোখ রাখি।
সকাল হলেই ফের দুই চোখে সংসার জড়ায়
উড়ে যায় অক্ষরের পাখি ।।
“বারবার প্রণয় সম্ভবাপ্রণিধানযোগ্য এটাই যে, শেষ পর্যন্ত কবিতাই তাঁর স্থায়ী প্রেম।
বারবার বিরহে সুন্দর
কবিতার জন্যে বুঝি তুমি
বারবার দুঃখ খুঁজে নাও?
কবিতার জন্যে ভাঙো ঘর?