সহদেববাবুর গা ছমছম করে উঠলো। জায়গাটা ভারী বিটকেল।
লেকের ধার দিয়ে হেঁটে যেখানে লেক ফুরিয়ে আসে, সেখানে একটা ছোটো ব্রিজ আছে। ব্রিজ পেরিয়ে যেতে হয় ওপারে — সেখানে রেল লাইনের ধারে রিফিউজি কলোনি। বস্তি। লাইনের ধারে গাছের ছায়ায় কিছু মেয়েদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। আর আধো অন্ধকারে তাদের দালালদের। কিন্তু সে-সব ব্রিজ পেরিয়ে।
ব্রিজের আগের জায়গাটা অন্ধকার। অনেক বছর হলো এই জায়গার আলোটা খারাপ। ব্রিজের ওপর একটা আলো অবশ্য আছে, কিন্তু তাতে পুরো ব্রিজটাও আলো হয় না। তখন অন্ধকারে কালো জলের ওপর একটুকরো আলোয় ব্রিজের অংশ দেখা যায়। মনে হয় ব্রিজটা হাওয়ায় ভাসছে।
সাধ করে কেউ এখানে সন্ধের পর আসে নাকি! সহদেববাবু নিরুপায়, তাই এসেছেন। পার্টনার যে তাকে ঠকাচ্ছে সে সন্দেহ সহদেববাবুর অনেকদিন ধরেই হচ্ছিলো। তাকে আটকাবেন কি করে তার ভাবনা চিন্তাও চলছিলো। কিন্তু কাল বাড়িতে ঢোকার আগে বৈঠকখানার জানলা দিয়ে যখন দেখলেন যে পার্টনার সহদেববাবুর স্ত্রীর কানে নতুন দুল পরাচ্ছেন, সেটা সহ্য করতে পারলেন না। সহদেববাবু সত্যি এখন নিরুপায়। পার্টনারকে না সরিয়ে দেওয়া অবদি শান্তি নেই।
সহদেববাবু ব্রিজের ওপরের আলোকোজ্জ্বল অংশটায় এসে দাঁড়ালেন — সেরকমই কথা হয়েছিলো। বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখলেন অন্ধকারে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। মুখ দেখা যাচ্ছে না, তবে লম্বা চেহারা। পাঞ্জাবী পায়জামা পরা, কাঁধে শান্তিনিকেতনী ঝোলা। সহদেববাবু আবার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে সামনে তাকিয়ে রইলেন। এরকমই কথা। “এনেছেন?” — অন্ধকারের মধ্যে থেকে শান্ত কণ্ঠস্বর শোনা গেলো।
“এই তো,” বললেন সহদেববাবু, হাতের খামটা এগিয়ে দিয়ে। “ছবি, ঠিকানা, কিছু ব্যাকগ্রাউন্ড ইন্ফরমেশন, সবই আছে। যা যা চেয়েছিলেন আর কি।"
“ওটা ওইখানে রেখে দিন। মাটিতে। অ্যাডভান্স এনেছেন?”
“এই ছোটো ব্যাগে আছে। এক লাখ। বাকি এক লাখ কাজ হয়ে যাবার পর, তাই তো?”
“ঠিক আছে। সোজা ওই দিকে এগিয়ে যান। তারপর পায়ে লাগার ভান করে নিচু হন। যখন উঠবেন, ব্যাগটা ওইখানে ফেলে রেখে দিয়ে যাবেন।"
“কতদিন লাগবে?”
“এক সপ্তাহের মধ্যে হয়ে যাবে। এক সপ্তাহ বাদে এই একই জায়গায় দেখা করবেন। আর এই এক সপ্তাহ নিজের অ্যালিবাইটা সাজিয়ে রাখবেন।"
“আমি তো কাল বাইরে যাচ্ছি। ফিরবো পাঁচ দিন পরে।"
“ভালো। তার মধ্যে হয়ে যাওয়া উচিৎ।"
দেবযানী দরজা খুলে উঁকি মারল। “হয়ে গেছে?”
“এই — গোটাচ্ছি। অনিকেতবাবু এসেছিলেন একটু আগে, তাই দেরি হয়ে গেলো। সিনেমা কটায়?” শাটডাউন দিতে দিতে বলল সঞ্জয়।
“টাইম আছে। তুমি গুটিয়ে নাও।"
সঞ্জয় আর দেবযানী দুজনেই এই মেডিক্যাল সেন্টরে কাজ করে। দেবযানীর বছর দুয়েক হলো, সঞ্জয় প্রায় প্রথম থেকে। সঞ্জয় অ্যাকাউন্টসে — তবে এসব জায়গায় ওরকম ধরাবাঁধা পজিশন নেই। এক কথায় “পার্ট অব ম্যানেজমেন্ট”। ভালো চাকরি ছেড়ে এখানে পড়ে আছে সঞ্জয় ওই জন্যেই। তাছাড়া সে নিজে ডাক্তার না হলেও এই ধরনের সেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে তার ভালো লাগে।
রাস্তায় বেরিয়ে দেবযানী বলল “অনিকেতবাবু এসেছিলেন — দরকারি কাজ?”
“হ্যাঁ, কিছু টাকা দিলেন।"
“বেশ ভদ্রলোক — অনিকেতবাবু, তাই না? আমার সঙ্গে তো সেরকম আলাপ নেই, কিন্তু একেকজন লোক থাকে না, কথা বললে ভালো লাগে — উনিও সেরকম। ভারী মার্জিত, ভদ্র।" দেবযানী বলল।
“খুব ভালো লোক। আমাদের এই সেন্টারটা তো অনেকটা ওনার টাকাতেই চলে। আমাদের এনজিও-র অন্য ডোনেশান তো তেমন নেই, আর আমরা যেটুকু চার্জ করি, সেটুকু শুধু মিনিমাম–-ওষুধের দাম ইত্যাদি। তাও তো আদ্ধেক সময় নিই না। আর এই ধরনের মেডিক্যাল সেন্টার, যেখানে ChILD এর ওপর কাজ হয়, কটাই বা আছে কলকাতায়?”
“ভদ্রলোকের কি অনেক টাকা?”
“মনে হয় না। তবে যা রোজগার করেন, সবটাই এখানে দিয়ে যান। আসলে ওনার একমাত্র ছেলে ChILD রোগেই মারা গিয়েছিলো আজ থেকে পাঁচ বছর আগে।"
“ইসসস।"
“হ্যাঁ, খুব ট্র্যাজিক। ভদ্রলোক তখন চাকরি করতেন। সীমিত রোজগারে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। বাড়িটা মর্টগেজ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুই হল না। ভদ্রলোক পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলেন তখন। তার প্রায় একবছর বাদে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন।"
“আহা রে। কিন্তু এখন তাহলে টাকা কোথা থেকে পান?”
“ঠিক জানি না। তবে মনে হয় ব্যবসা। কারণ সব টাকাই ক্যাশে দিয়ে থাকেন। আমাদের বাড়তি ঝামেলা ওই কালো টাকাকে সাদা করা। এই আজই তো এক লাখটাকা দিয়ে গেলেন। বললেন সামনের সপ্তাহে আরও এক লাখ দিয়ে যাবেন। ক্যাশ।"