‘হোল্ড ইয়োর ব্রেথ, ইউ আর এন্টারিং লাদাখ’।
লালচক থেকে লে। ভুট্টাখেতের মাঝ দিয়ে গন্ধরবল, কঙ্গন, শোনমার্গ ছেড়ে কাশ্মীর-লাদাখ সীমান্তের গুমরিতে ফলকে লেখা এই সতর্কবার্তা। জোঙ্গা জিপে আমরা পাঁচজন যাত্রী। আমার পাশে বসা এক ছন্নছাড়া চেহারার বুড়ো পাদরি। কাঁধে একটা ঝোলা। দূরে সাড়ে তিন হাজার মিটার উঁচুতে জোজি-লা পাস। পশ্চিম হিমালয়ের শেষ গিরিবর্ত্ম। এর পরেই দ্রাস, বিশ্বের দ্বিতীয় শীতলতম জনবসতি। আমার স্মৃতিতে স্বেন হেডিনের লেখা ভ্রমণকাহিনি — ট্রান্স হিমালয়ান এক্সপিডিশন। জোজি-লার চড়াই শুরু হয়েছে। জোঙ্গার ইঞ্জিন ফুঁসছে। গাড়ি ধীরে ধীরে উপরে উঠছে। বেশ দুর্গম পথ। অন্তহীন চড়াই-উৎরাই। চড়াই পথের ডান দিকে গাড়ি দাঁড়াবার একফালি জমি। আমাদের গাড়ি পথ থেকে সরে সেখানে আশ্রয় নিল। ওপর থেকে কনভয় আসছে। কনভয় মানে মিলিটারি ট্রাকের শোভাযাত্রা। ও-পথে ওদেরই অগ্রাধিকার। কারগিল এখান থেকে একশো কিলোমিটারের অধিক। মাঝখানে দুর্গের মতো দাঁড়িয়ে জোজি-লা।
জোজি-লা পার হতেই প্রকৃতিতে সুমেরু-দেশীয় পরিবর্তন। দ্রাস-এ পৌঁছাতেই পাদরিবাবা আমার সঙ্গে আলাপ শুরু করলেন। কোথায় থাকি, যাচ্ছি কোথায়, কী করি ইত্যাদি মামুলি প্রশ্ন। ভদ্রলোক ছোটো-ছোটো ইংরাজি বলছেন। মাঝে মাঝে হিন্দি। কলকাতা থেকে আসছি শুনে দু-একটা বাংলা শব্দ বলার দু:সাহস দেখালেন। গাড়ির ‘উইন্ড স্ক্রিনে’ অবিশ্রান্ত ধারায় তুষার পড়ছে। শক্ত বরফ নয়। নরম তুষার ফ্লেক্স। এমন ভয়ঙ্কর সুন্দর গিরিবর্ত্ম জীবনে দেখিনি। মাইনাস থার্টি ডিগ্রিতে পথের পাশে গরম ধোঁয়া ওঠা বিরিয়ানি বিক্রি হচ্ছে দেখে নেমে পড়লাম। অ্যানিমেল প্রোটিন যুক্ত সেই বিরিয়ানি খেয়ে দু-জনেই উত্তপ্ত বোধ করলাম। দ্রাস-এর চেকপোস্টে যাত্রীদের পরিচয়পত্র দেখাতে হয়। ওঁর পরিচয়লিপিতে দেখলাম বেলজিয়ামের লোক। নাম ফাদার জ্যঁ-লুই। কথা বলতে বলতে বুড়ো ঝোলা থেকে একটা বই বার করে আমায় দিলেন। দেখি সেটা নিউ টেস্টামেন্ট। বাইবেলের দ্বিতীয় ভাগ।
‘কী করব এটা নিয়ে?’
‘পড়বে, তুমি প্রভু যিশুর কথা জানো?’
যিশুর একটা ছবি আমার কাছে পরিচিত। বই-এর পাতায় দেখেছি। মাতা মেরির কোলে যিশু। বিদ্যে জাহির করার এমন সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে বলতে শুরু করলাম,
‘প্রায় দু-হাজার বছর আগে জেরুসালেমের কাছে বেথলেহেমে যিশু জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জাতিতে ইহুদি ছিলেন। আশ্চর্য ও অলৌকিক পরিবেশে যিশুর জন্ম হয়। প্রত্যেক খ্রিস্টান বিশ্বাস করেন, যিশু তাঁদের মসীহা — ত্রাণকর্তা’।
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। ফাদার হাত নেড়ে আমাকে থামিয়ে দিলেন।
‘রেজারেকশান, যিশুর পুনরুত্থান সম্বন্ধে কিছু জানো?'
‘তেমনি কিছু জানি না। তবে শুনেছি তিনি শিষ্যদের কাছে বলেছিলেন, ইহুদি ধর্মের রক্ষকদের হাতে তিনি লাঞ্ছিত হবেন। তাঁকে মৃত্যদণ্ড দেওয়া হবে। তিন দিন পর তিনি আবার আবির্ভূত হবেন।'
ফাদার মাথা নাড়তে লাগলেন। তার পর শুরু করলেন... যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয় শুক্রবার। বদ্ধভূমিটার নাম গলগথা। যার নাম খুলির স্থান। এই জায়গাটাকে অনেকে ‘কালভেরি’ নামে জানে। লাতিন ভাষায়, ‘কালভারিয়া’ মানেও খুলি। এখানে তাকে আঙুরের মদের মধ্যে পিত্ত মিশিয়ে খেতে দেওয়া হয়। তিনি তা ফিরিয়ে দেন। যিশুকে ক্রুশকাঠের সঙ্গে হাতে ও পায়ে পেরেক বিঁধিয়ে সৈন্যরা তার কাপড় নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেয়।
তিন দিন পর রবিবার সন্ধেবেলা যিশুর শিষ্যরা একটা নির্দিষ্ট ঘরে একত্র হয়েছিলেন। ইহুদি নেতাদের ভয়ে তাঁরা ঘরের দরজা-জানলা ভাল করে বন্ধ করে রেখেছিলেন। হঠাৎ যিশু স্বয়ং মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন। শিষ্যরা প্রেতাত্মা দেখেছেন ভেবে খুব ভয় পেলেন। যিশু তাঁদের বললেন, তোমরা আমাকে দেখে উদ্বিগ্ন হচ্ছ? ‘বিহোল্ড মাই হ্যান্ডস অ্যান্ড মাই ফুট, দ্যাট ইট ইজ আই মাইসেলফ; হ্যান্ডল মি অ্যান্ড সি; ফর এ স্পিরিট হ্যাথ নট ফ্লেশ অ্যান্ড বোন্স, অ্যাজ ই মি হ্যাভ।' তিনি তাঁদেরকে হাত দেখালেন। তাঁর পায়ে পেরেকের দাগ দেখালেন। ক্রুশের ঘটনার পর সেখানে টাটকা ক্ষত বিদ্যমান। তবুও তাঁরা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তাই যিশু তাঁদেরকে বললেন, ‘হ্যাভ ইউ এনি মিট।' তাঁরা তখন তাঁকে একখানা মাছ ভাজা দিল। যিশু তা নিয়ে সবার সামনে খেলেন। পরিশেষে বললেন, ‘ডেড ম্যান ক্যান নট ইট।' শিষ্যদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার পর তাঁদেরকে সঙ্গে নিয়ে কাছের পাহাড়টিতে গেলেন। পাহাড়টির নাম মাউন্ট অব অলিভ্স। দু-হাত তুলে শিষ্যদের আশীর্বাদ করলেন। সেই নির্জন পরিবেশে তাঁর মুখ আলোয় ভরে গেল। তাঁর পরনের কাপড় ঝকঝকে সাদা হয়ে উঠল। শিষ্যরা দেখলেন তাঁর সৌম্যমূর্তি, প্রশস্ত ললাট, প্রশস্ত বদন। অবশেষে তিনি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠতে লাগলেন। সহসা আকাশ থেকে মালার মতো মেঘ যিশুকে ঢেকে ফেলল। কিছুক্ষণ পর মেঘমালা অপসৃত হল। কিন্তু তাঁরা তাঁদের ঈপ্সিত মহাপুরুষকে আর দেখতে পেলেন না।
বরফে ঢাকা পাহাড়চূড়া তখন আমায় টানছে। রেজারেকশান নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় নেই। আমি তখন ব্যস্ত অদূরের পাকিস্তান সীমান্ত চিনতে। পাদরিবাবা বললেন, ‘ইউ উইল ফাইন্ড ইন লাদাখ দ্যা কোল্ড অব ফিনল্যান্ড অ্যান্ড হিট অব আফ্রিকা। তবে তুমি দেখো, আমাদের সামনে এক ভয়ংকর দু:সময় এসে দাঁড়িয়েছে। হয়তো এই যাত্রার শেষে এক ভয়াবহ দুর্যোগ এসে দাঁড়াবে। এত বড় দুর্যোগ লাদাখ উপত্যকায় আগে কখনও আসেনি। সব তছনছ হয়ে যাবে। আকাশ থেকে অঝোর ধারা ঝরে পড়বে। ওলটপালট হয়ে যাবে সবকিছু।'
আমি চুপ করে রইলাম। ভারতের শেষ ভূখণ্ড লাদাখ। এই ভূখণ্ডের বিরাট অংশ বন্ধুর পাহাড়। মনুষ্যবাসের অনুপযুক্ত। এখানে মেঘ নেই। বৃষ্টি নেই। সূর্য মেঘে ঢাকা পড়তেই তাপমান ফ্রিজিং পয়েন্টে নেমে আসে। বিশ্বে এমন দেশটি খুঁজে পাওয়া ভার। পাদরিবাবা বলেন কী? সব মানুষই কিছু না কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে। তফাত শুধু যে কেউ জেনে করে, কেউ না জেনে।
সন্ধ্যার প্রাক্কালে জোঙ্গাটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল। শ্রীনগর থেকে ঘন্টা দশেকের পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি। এখন কারগিলে নিশিযাপন। গাড়ি থেকে নেমে ট্যুরিস্ট বাংলোর দিকে হাঁটছি। ঢালু পথ। মাইলটাক পথ শেষে সরু নদীর ধারে ট্যুরিস্ট বাংলো। পাদরিবাবা আমার সঙ্গ ছাড়ছেন না। নাকতুর, হোরকার, ওরজন — এই তিন পাহাড়ে ঘেরা অতীতের খারগিল কালে কালে কারগিল হয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে সন্ধে নেমে এল। মিহি জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়েছে। আমি যে কী ভাবছিলাম কে জানে। পাদরিবাবা হঠাৎ বললেন,
‘যিশাস কেম টু দিস ভ্যালি আফটার হিজ ক্রুশিফিকশন।'
আমার চোখ কেমন যেন আচ্ছন্ন হয়ে গেল। বোধবুদ্ধি তলিয়ে যাচ্ছে কোথাও। অদ্ভুত এক রাস্তা। আশ্চর্য এক সংলাপ। ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার পরে যিশু এই উপত্যকায় এসেছিলেন। আমার হুঁশ থেকেও নেই। শুধু পাদরিবাবার গলার আওয়াজ শুনছি,
‘ক্রুশবিদ্ধ হবার পর যিশু মারা যাননি। কাউকে সোজাসুজি মেরে ফেলার জন্য ক্রুশবিদ্ধ করা হত না। লোকটাকে নরকযন্ত্রণা দেওয়াই উদ্দেশ্য। ক্রুশবিদ্ধ করার পরেই যদি কাউকে ওখানে থেকে নামিয়ে চিকিৎসা করা যায়, খেতে দেওয়া যায়, তাহলে সে বেঁচে যায়। যিশুর ক্ষেত্রে তাই হয়েছিল।'
একটু থেমে পাদরিবাবা আবার শুরু করলেন,
‘যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয় দুপুরে। দিনের কিছু অংশ তখনও বাকি। পরদিন শনিবার। ইহুদিদের পবিত্র ছুটির দিন, সাবাথ ডে। শুক্রবার থেকেই তার তোড়জোড়। এই দিনে কাউকে শাস্তি দেওয়া অপরাধ। তাই সন্ধের আগেই তাঁকে নামিয়ে দিতে হয়। তাঁর মাথাটা ঝুলে পড়েছিল। নি:শ্বাস বইছিল ধীরে। তিনি ক্রুশে মরেননি। তবে অজ্ঞান হয়ে মৃতবৎ হয়েছিলেন। একজন সৈনিক বল্লম দিয়ে তাঁর পাঁজরে খোঁচা দেয়। সেখান থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। মরা মানুষের কিন্তু রক্ত জমে যায়। সৈন্যরা ভাবল, এখনই তিনি মরে যাবেন। ঠিক সেই সময়ে পৃথিবী জুড়ে দারুণ আলোড়ন শুরু হয়ে গেল। ঝড়-ঝঞ্ঝা, ভূমিকম্পে মেদিনী কেঁপে উঠল। মৃতরা জীবিত হয়ে উঠল। সেই সব দেখে প্রহরীরা বিচলিত হয়ে ভাবে যে তারা সত্যিই কোনো মহাপুরুষকে শাস্তি দিয়েছে। ভয় পেয়ে সৈনিকরা যিশুর দেহ তাঁর বন্ধুদের দিয়ে বধ্যভূমি ত্যাগ করে চলে যান।'
ট্যুরিস্ট বাংলোয় পৌঁছে ঘোর কেটে গেল। স্প্যানিশ গিটার আর জাজ ড্রামের আওয়াজে জায়গাটা সরগরম। লুধিয়ানা কলেজের ছাত্রছাত্রীরা এসে ট্যুরিস্ট বাংলোয় আস্তানা গেড়েছে। ইংরাজি গানের সুরে ভাংড়া নাচ। বড় চটুল। পাদরিবাবা ও আমি, দু-জনেরই মেজাজ ভিন্ন ভিন্ন। দু-জনের কাছেই যেন এক ‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত’। একই ঘরে আমাদের আস্তানা হল। পাশাপাশি দুটো খাটে আমি ও পাদরিবাবা। গরম জল এল। জামাকাপড় বদলে, হাত-পা ধুয়ে খাটে উঠে বসলাম। পাদরিবাবা হাত-পা ধুলেন না। জামাকাপড়ও ছাড়লেন না। আর্দালিকে অর্ডার করে পরপর দু-কাপ চা খেলেন। শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলিমদের বাস এই কারগিলে। বালতিক ও লাদাকির মিশ্রণে উদ্ভূত পুরিগ এদের মুখের ভাষা। উর্দুরও চল আছে এখানে। পাদরিবাবা চোস্ত উর্দু বলেন। কত বন-বনান্তর, কত পাহাড়-পর্বত ঘুরে যে মানুষটা এখানে এসেছে, তার ঠিক নেই। কৌতূহল নিয়ে বললাম,
‘দেশ থেকে কতদিন আগে বেরিয়েছেন?'
‘প্রায় চার বছর। প্রথমে যাই প্যালেস্তাইন। সেখান থেকে যিশুর বাল্যভূমি নাজারেথ। সেখান থেকে ইরাকের বাগদাদ, ইরানের তেহরান হয়ে আফগানিস্তানের হেরাত-এ পৌঁছাই। হেরাত থেকে কান্দাহার হয়ে কাবুল। তার পর পেশোয়ার, রাওয়ালপিণ্ডি হয়ে বারামূলা-পাটনের পথ ধরে শ্রীনগর। পুরোটাই সারফেসে — ভাড়ার গাড়িতে, পাবলিক বাসে অথবা পায়ে হেঁটে।'
‘পায়ে হেঁটে কেন?’
‘যিশু এই পথেই পায়ে হেঁটে প্যালেস্তাইন থেকে কাশ্মীরে আসেন।'
‘তাহলে যিশুর সমাধি কোথায়?’
‘যেখানে যিশুকে ক্রুশে দেওয়া হয়েছিল তার কাছেই একটা বাগান ছিল। সেই বাগানে পাহাড়ের গুহায় একটা নতুন কবর খোঁড়া হয়েছিল। যেদিন মসীহাকে ক্রুশে দেওয়া হয়, সেদিন সন্ধেবেলায় যিশুর এক শিষ্য আরিমাথিয়া শহরের যোশেফ রোমান গভর্নর পন্টিয়াস পিলাতের সঙ্গে দেখা করেন। যোশেফ সাহসের সঙ্গে যিশুর দেহটি সৎকারের অনুমতি চান। পিলাত সেই আবেদন মঞ্জুর করেন। বন্ধুরা যিশুর দেহটিকে সাদা কাপড়ে ঢেকে সেই কবরে রাখেন। কবরটি ছিল প্রকৃতপক্ষে মাটির নিচে একখানি প্রশস্ত ঘর। সেখানে প্রচুর আলো-বাতাস যাবার পথ ছিল। ছিল যাতায়াতের পথ। সকলের সামনে সেই কবরে যিশুকে রেখে কবরের মুখে মস্ত এক পাথর রাখা হয়। পরের দিন সাবাথ ডে, বিশ্রামের দিন। তিনদিন পর রবিবার দেখা গেল সমাধির সামনের পাথরটা সরানো হয়েছে এবং যিশু সেখানে নেই।'
‘তাহলে রেজারেকশান — যিশুর পুনরুত্থান?’
‘কর্তৃপক্ষ যিশুর রেজারেকশানের কাহিনি বিশ্বাস করেনি। প্যালেস্তাইনে যিশুর সমাধি খালি পাওয়া গেল। শাসককুল কবর পরীক্ষার পর যোসেফকে বন্দী করল। তাঁকে দায়রায় সোপার্দ করা হল।’
যিশুর আশ্চর্য পুনরুত্থান — এটাই খ্রিস্টীয় বিশ্বাসের প্রধান অঙ্গ। তবু ধর্ম নিয়ে তর্কাতর্কি আমি আদপেই পছন্দ করি না। ভদ্রতার খাতিরে নিজেকে ধমক দিয়ে চোখ বন্ধ রাখলাম। পাদরিবাবা বলে চললেন,
‘রেজারেকশান কোনো স্বর্গীয় ব্যাপার নয়। বরঞ্চ খুব স্বাভাবিক তিনি অন্তর্ধান করলেন। ঈশ্বরের পুত্র হলেও তিনি তো মানুষ। ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার পর নরকযন্ত্রণার কথা তাঁর মনে ছিল। আবার ধরা পড়ে তিনি শত্রুদের শিকার হতে চাননি। পাছে শত্রুরা তাঁকে আবার মেরে ফেলার চেষ্টা করে, তাই তিনি প্রথমে আত্মগোপন করেন। তারপর তিনি পাহাড়ি পথ ধরলেন। দিনের বেলা কোথাও লুকিয়ে থাকতেন। আর সারারাত ধরে পথ চলতেন। তিনি বনের ফলমূল আর ঝরনার জল খেয়ে জীবনধারণ করতেন। এইভাবে তিনি দেশের পর দেশ পেরিয়ে চলতে থাকলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল পারস্য থেকে আফগানিস্তান আসা। এবং ইহুদিদের হারিয়ে-যাওয়া গোত্রগুলোর সন্ধান করা।'
আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘এইরকম একটা মতবাদের কথা কোথায় যেন পড়েছি মনে নেই। ওই মতবাদের সূত্রানুসারে পাঠানরা ইহুদিদের হারিয়ে-যাওয়া উপজাতির একটা। সেই উপজাতি যখন দেখল তাদের কপালে শুকনো, মরা, পাথুরে-কাঁকুরে মাটি পড়েছে তখন তারা ‘ফগান’ করেছিল। অর্থাৎ হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিল। তাই তো তাদের নাম আফগান।'
পাদরিবাবা আবার শুরু করলেন,
‘তিনি কিছুদিন আফগানিস্তানে বাসও করেছিলেন। কিন্তু আফগানিস্তানেও তিনি স্থিত হতে পারলেন না। মানুষের সমাজ তাঁকে আশ্রয় দেয়নি। বরং কিছু মানুষ তাঁর পরিচয় পেয়ে তাঁকে মেরে ফেলার চক্রান্ত করল। অবশেষে যিশু মধ্য এশিয়ার বাণিজ্যপথ ধরে এগিয়ে চললেন। নতুন নাম নিলেন, ইউজা আসফ। পথ চলা অব্যাহত রইল। পৌঁছালেন লাদাখে। লাদাখের মানুষ তাঁকে পরম সমাদরে গ্রহণ করলেন।'
‘ইউজা আসফ? শুনেছি নাথ সম্প্রদায়ের সাধুরা তাঁর অনুগামী?'
‘হ্যাঁ ইশাইনাথ। ‘ইশ’ শব্দের অর্থ শিব। ইউজা আসফকে তাঁর শিষ্যরা বলতেন ঈশাইনাথ বা সংক্ষেপে ঈশা। তিনিই শতবর্ষ পার করে কাশ্মীরে দেহ রাখেন। আমি প্রাচীন শ্রীনগরের অন্ধগলিতে তাঁর সমাধি দেখেছি। ইনিই স্বয়ং যিশু খ্রিস্ট।'
‘এই ইউজা আসফই যে যিশু খ্রিস্ট তা কী করে দাবি করেন?'
‘কলহন-এর রাজতরঙ্গিণীতে পাই মহারাজ গোপাদত্তের সুশাসনে কাশ্মীর তখন শান্তির নীড়। যিশু সেই সময় লে-র হেমিস গুহায়। গভীর আগ্রহে বৌদ্ধশাস্ত্র অধ্যয়ন করছেন। তাঁর কাছে খবর এল তিনি রোম সম্রাটদের কাছে এতটাই ভয়াবহ হয়ে উঠেছেন যেন প্রকাশ্যে কেউ তাঁর নাম নিলে তাকে ভ্যাটিকান পর্বত শিখরে নিয়ে গিয়ে উল্টোভাবে ক্রুশবিদ্ধ করে মেরে ফেলা হচ্ছে। শক্রুদের শক্তির কথা ভেবে যিশু লে-কে আর নিরাপদ বিবেচনা করলেন না। তিনি হিমালয় অতিক্রম করে কাশ্মীরে চলে এলেন। ভ্রাম্যমান মসীহা শেষ পর্যন্ত কাশ্মীরেই স্থায়ী হন।'
‘তাহলে যিশুর সমাধি প্যালেস্তাইনে নয়?’
‘যিশু কাশ্মীরেই শায়িত আছেন। আমি প্রাচীন শ্রীনগরের অন্ধ গলিতে তাঁর সমাধিক্ষেত্র দর্শন করেছি। সমাধিটির নাম ‘রাউজবাল’। ইহুদি স্থাপত্যের অনুকরণে ছোট এক মসজিদ। মসজিদ না বলে সমাধি-মন্দির বলা ভালো। চারিদিকে জালির ঘেরা। জালির উপর হিব্রু ভাষায় খোদিত শিলালিপি। তাতে উৎকীর্ণ হয়ে আছে, হি ইজ যিশাস, প্রফেট অফ দ্য চিলড্রেন অফ ইজরায়েল।'
উচ্চগ্রামের সঙ্গীতধবনি থেমেছিল রাত বারোটায়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ট্যুরিস্ট লজের আলোগুলো নিভে গিয়েছিল। কিন্তু তাতে কোনো অসুবিধে হয়নি। পাদরিবাবা মাথার কাছে মোমবাতি জ্বালিয়ে বাইবেল পড়তে শুরু করলেন। জেনারেটারের যান্ত্রিক শব্দটা থামতেই প্রাণহীন এক নৈ:শব্দের পরিবেশ সৃষ্টি হল। আজকের দিনটার অবসান হল। কিন্তু সেই সময়টা আমি বড় নি:সঙ্গ বোধ করছিলাম। এরপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। বিছানা ছাড়তে হল ভোর চারটেয়। গতকাল সন্ধ্যায় জোঙ্গা থেকে নামার সময় ড্রাইভার শিরিনজি বলে দিয়েছিল, ‘সুবাহ পাঁচ বাজে আ যাইয়ে গা, সওয়া পাঁচমে ছোড়েগা।' তাড়াতাড়ি ছুটে এসেছি। এসে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেললাম। পাঁচজন যাত্রীর মধ্যে আমরাই প্রথম। জোঙ্গার ছাদে মালপত্র তুলে একটা চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালাম। ইয়াকের দুধ মেশানো দুর্গন্ধ চা। এ শুধু লাদাখিদের জন্য। সেই চা-ই হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছি। চারিদিকে পাহাড়ের প্রাচীর। মাঝখানে এই উপত্যকা। পথের ধারে উইলো গাছের সারি। উপত্যকার বুক বেয়ে এই পথ লালচক থেকে লে। ঊষার প্রথম আলোয় আমি কমনীয় কারগিলকে দেখছি। পাদরিবাবা আমার পাশে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনার পর্যটন পরিকল্পনা কী?’
‘দশদিন লে শহরে থাকব। ওখান থেকে হেমিস গুম্ফা দেখব। হেমিসের গ্রন্থাগারের খ্যাতি সুদূর জেরুসালেম পর্যন্ত প্রসারিত। হেমিসে আছে পৃথিবীর প্রাচীনতম পাণ্ডুলিপির সংগ্রহ। তেমনই আছে স্ক্রোল, কাপড়ে আঁকা ছবি।'
আমি আর কথা দীর্ঘায়িত করলাম না। ভয় পাচ্ছিলাম আবার ইশা আর যিশুর বিতর্কে জড়িয়ে পড়ব। শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম।
বাজারের ভিতর দিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলেছে। শীতল দেশ, সবে ভোর হয়েছে। মসজিদ বাঁদিকে রেখে বাজার ছাড়িয়ে এলাম। গতকাল হিমালয় পেরিয়ে এসেছি। আজ এগিয়ে চলেছি কারাকোরামের পথে। পেরতে হবে তেরোহাজার ফুট উঁচু গিরিপথ। প্রতিটি গিরিপথ পার হবার মুখে যাত্রীদের ঠোঁট নড়ে। বিড়বিড় করে কার কী প্রার্থনা করে কে জানে! এ পথ লাদাখের রাজধানী লে নগরের পথ। সুপ্রাচীন কাল থেকে যে নগর হয়ে পথিকের দল তিব্বত, চিন, পূর্ব তুর্কিস্তান থেকে ভারতে এসেছেন। আজকের চেয়ে হাজার গুণ দুর্গম ছিল এই পথ। কিন্তু যাওয়া-আসায় কোনো বাধা ছিল না। ছিল না কোনো ‘ইজম্’-এর বালাই!
প্রভাত সূর্যের প্রথম আলোয় পাহাড়ের রঙ দেখে আমি অভিভূত। কোনোটা কালো, কোনোটা ধূসর, কোনোটা খয়েরি, কোনোটা বা লাল। হরেক রকম রং এই পাথরের। মনে হয় যেন শিল্পীর আঁকার রঙের থালা।
‘মূলবেখ।' ড্রাইভার শিরিনজি সহসা বলে ওঠেন।
পাদরিবাবা মাথা নেড়ে সমর্থন করেন,
‘ইয়া মুলবেক, এ স্লিপিং ভিলেজ।'
জোঙ্গা থেকে নেমে পড়ি। পথের পাশে ঢালু জায়গা। তার পরে একটা ছোটো পাথুরে পাহাড়। সেই পাহাড়ে খোদাই করা সুবিশাল দণ্ডায়মান বৌদ্ধমূর্তি। শুনেছি, সবচেয়ে উঁচু বৌদ্ধমূর্তি বামিয়ানে। কাবুল থেকে ১৯০ কি মি দূরে। পাদরিবাবা ঝোলা থেকে গাইড বুক আর লাদাখের মানচিত্র বার করলেন। বললেন,
‘হিয়ার ইজ্ মৈত্রেয় বুদ্ধ। অ্যাকর্ডিং টু বুদ্ধিস্টস, তথাগত ইজ বুদ্ধা। তাঁর আগেও কয়েকজন বুদ্ধের আগমন ঘটেছে। তাঁর পরেও কয়েকজন বুদ্ধের আগমন ঘটবে।'
গাড়িতে উঠে আবার যিশুখ্রিস্ট প্রসঙ্গে ফিরে এলেন। বললেন,
‘ইউ নো মাই সন, খ্রিস্টের জন্মের পাঁচ-পাঁচটা সেঞ্চুরি আগে ভারতে বুদ্ধের জন্ম। কিন্তু কী সাদৃশ্য তাদের জীবনে। যিশুকে ক্রুশে বিদ্ধ করার পর যেমন ভূমিকম্প, ঝড়ঝঞ্ঝা এসেছিল, তেমনই বুদ্ধ যখন শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন তখন ভূকম্পন ও বজ্রপাত শুরু হয়। মথি ও মার্ক লিখিত বাইবেলে... ’
আমার বাইবেলি কচকচি আর ভালো লাগছিল না। কী যে বুদ্ধিভ্রষ্ট হল জানি না। একজন বিদেশি পর্যটকের সঙ্গে কী ভাষায় কথা বলতে হয় ভুলে গেলাম। গলার স্বর স্বাভাবিকের থেকে উঁচু পর্দায় তুলে বললাম,
‘ফাদার দিজ আর ফেবলস্। যে কোনো মহাপুরুষের জীবনের সঙ্গে অনেক আশ্চর্য-অলৌকিক উপাখ্যান জড়িয়ে থাকে। এগুলোর ঐতিহাসিক মূল্য প্রায় নেই বললেই চলে। বুদ্ধ-যিশু, এঁরা সবাই ঈশ্বরের পুত্র। আবার এঁরা সবাই মানুষ।'
পাদরিবাবা চুপ করে গেলেন। তাঁকে আঘাত করার কোনো উদ্দেশ্যই আমার ছিল না। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে এতকাল ধরে যে ইতিহাস আমি জেনে এসেছি, তার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। ইউজা আসফ আর যিশু খ্রিস্ট যদি এক ব্যক্তি হন, তাহলে যিশুর জীবনের তিন-চতুর্থাংশ সময় তো ভারতেই কেটেছে। তাহলে ভারতে খ্রিস্ট ধর্মের প্রচার তেমনভাবে হল কই?’
ঘড়ি দেখলাম। সকাল আটটা। মানে আড়াই ঘন্টায় চল্লিশ কিলোমিটার পথ। সকালের উজ্জ্বল রোদে চাঁদের মতো রূপ নিয়েছে হালকা হলদে মাটির উঁচু উঁচু খোয়াই ভূমি। বাকি পথটা সিন্ধুনদের কাঁধে ভর দিয়ে, বৃক্ষহীন রঙিন পাহাড়গুলো দেখতে দেখতে সন্ধের আগেই লে শহরে পৌঁছে যেতে পারব আশা রাখি।
এরই মধ্যে বেশ চড়া রোদ। জোঙ্গার অন্য যাত্রীরা প্রত্যেকেই গরম কাপড় খুলে ফেলেছে। পাদরি সাহেব খোলেননি। তাঁর মুখ থমথমে। রোদের তেজ দেখে কল্পনা করা যাবে না সাড়ে তেরো হাজার ফিট উপরে আছি। এ এক অদ্ভুত পৃথিবী। রাতে যেখানে তিনখানা কম্বল লাগে দিনে সেখানে রোদের তাপে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছি। ফাটুলায় উঠে পাদরিবাবার শরীর খারাপ হল। একটু যেন নি:শ্বাসের কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভিতর একটা চাপ ভাব, অনুযোগ করলেন। জায়গাটা জোজি-লা থেকেও দু-হাজার ফিট উঁচু। কিন্তু খটখটে রোদ। হাওয়া বইছে। সম্ভবত অত্যধিক উচ্চতাহেতু অক্সিজেনের অভাব। গুমরির প্রস্তর ফলকে লেখা সে সাবধান বাণী মনে পড়ল, ‘হোল্ড ইয়োর ব্রেথ, ইউ আর এন্টারিং লাদাখ।' জোর করে কোট খুলিয়ে দিলাম। ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে দিল। ড্রাইভারের কথামতো সামান্য কর্পূর রুমালে নিয়ে নাকের সামনে ধরতেই কিছুক্ষণের মধ্যে তাঁর শ্বাসকষ্টের উপশম হল। স্টিয়ারিংয়ে হাত দিয়ে বিজেতার হাসি হেসে শিরিনজী বললেন,
‘দেশি ইলাজ।'
দেখতে দেখতে নেমে এলাম কিছুটা সবুজ সমতলে। বাসগো গ্রাম। আর সেইসঙ্গে দেখা হল সিন্ধুনদের সাথে। আমি গঙ্গাতীর থেকে সিন্ধুতীরে এসেছি। জল দেখে মনটা শান্ত হল। তাহলে এই হল সিন্ধুপ্রদেশ। বাঁয়ে কারাকোরাম। ডাইনে জাঁসকর। সামনে সিন্ধুতীরের সুন্দরী পথ। প্রবল বেগে বাতাস বইছে। গাড়ির ছাউনির উপর অবিরত আছড়ে পড়ছে। গর্জন করছে। মনে হচ্ছে জোঙ্গাটাকে যেন কাৎ করে পথের উপর ফেলে দেবে। মহাভারতের যুগে জয়দ্রথ সিন্ধুপ্রদেশের রাজা ছিলেন। জয়দ্রথ ধৃতরাষ্ট্রের জামাতা এবং তিনিই অভিমুন্যহত্যায় সপ্তরথীদের অন্যতম। সে যুগে সিন্ধুপ্রদেশের ঘোড়াও খুব বিখ্যাত ছিল।
ঘন্টাখানেকের মধ্যেই পাহাড়ি পথে আমার জীবনের দীর্ঘতম মোটরগাড়ির যাত্রা শেষ হবে। আনন্দে সারা শরীর শিহরিত হয়ে উঠেছে। আমি পৌঁছে যাবো লাদাখের জেলা সদর ‘লে’ শহরে।
লে শব্দের অর্থ গোচরণ ভূমি। কুয়াশা আর উঁচু পাহাড়ে ঘেরা পাহাড়ি লে। এ জাদুর দেশ। এখানকার গুম্ফা আর লাল আলখাল্লা পরা লামারা সবসময় মধ্যযুগের কথা মনে করিয়ে দেয়। গতকাল সন্ধ্যায় আমি লে শহরে পৌঁছে একটা মাঝারি হোটেলে উঠেছি। হোটেলের নাম কারাকোরাম। আসার সময় দেখেছি দু-পাশে দোকান-বাজার। লাদাখি মেয়েরা পিঠে বাচ্ছা বেঁধে বাজার করছে। দূরে পাহাড়ের চূড়ায় দূর্গ আর রাজবাড়ি। চারিপাশে ছড়ানো-ছিটানো ছোট ছোট বাড়ি। সে-সব সূর্যের শেষবেলার আলোয় ঝকঝক করছিল। এখনও সেভাবে শহরের পথে নামবার সুযোগ পাইনি। আসার পথে যেটুকু দেখেছি, তাতে বুঝেছি নতুন আর পুরোনোর বিস্ময়কর মেলবন্ধন এই লে শহর। পাদরিবাবাকে ছাড়িনি। পাহাড়ি পথে জীবনের দীর্ঘতম পরিক্রমায় উনি আমার সঙ্গী। পথের পরিচয় সাধারণত পথেই শেষ হয়। কিন্তু এখনও তো এ পথের অনেকটাই বাকি। তাছাড়া উনি অসুস্থ। তাই ওঁকে ছাড়তে পারিনি।
বেকন হাইওয়ে বিশ্বের উচ্চতম পথ। চারটি পথ মিলিত হয়েছে এখানে। পথের পাশে একটা ফলকে লেখা, ‘ইউ ক্যান হ্যাভ্ ডায়ালগ উইথ গড।' ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলা যায় কিনা জানি না। কিন্তু এখান থেকেই একটা পথ লে রাজপ্রাসাদ হয়ে হেমিস গুম্ফায় চলে গিয়েছে। মানবত্রাতা যিশু এই পথেই একদিন হেমিসে পৌঁছেছিলেন। বৌদ্ধশাস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন। হেমিস গুম্ফা লাদাখের সর্বশ্রেষ্ঠ দেবালয়। এই দুই সহস্র বছর পরে তারই এক অনুসন্ধিৎসু শিষ্য অজানা রহস্যের উদ্ঘাটন করতে এসেছে। ঠিক এখান থেকেই পাদরিবাবাকে আমি বিদায় জানালাম। গতকাল রাতেই উনি আমাকে ওর উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে বলেছিলেন,
‘হেমিসের গ্রন্থাগারে প্রায় আট হাজার পুঁথি আছে। বেশিরভাগই পালি ও তিব্বতি ভাষায়। শুনেছি, একটি পুঁথিতে যিশু খ্রিস্টের ভারত ভ্রমণ সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য আছে। দোভাষীর সাহায্য নিয়ে আমি পুঁথিটি অনুবাদ করতে চাই। জানি না ঈশ্বর আমার সহায় হবেন কিনা। তবে অনুবাদ সম্পূর্ণ হলে নাম দেব, দ্য আননোন লাইফ অব্ ইশা।‘
বিদায় মুহূর্তে বেকন হাইওয়ের চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ ভারতীয়দের মতন হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বললেন,
‘মাই সন, টেক কেয়ার। আমাদের সামনে এক ভয়ঙ্কর দু:সময় এসে দাঁড়িয়েছে। মনে রাখবে, যিনি আলো দেখান, তিনিই যিশু।'
সেদিন সন্ধে থেকেই আবহাওয়া খারাপ। শুরু হল টিপটিপ বৃষ্টি। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। আচমকাই বেড়ে যায় বৃষ্টির তীব্রতা। হাওয়ার টানে নুড়ি পাথর আছড়ে পড়ছিল কাচের শার্সিতে। ক্লান্ত আমি শয্যা নিয়েছিলাম। বৃষ্টি শুরু হয়েছিল দূরের পাহাড়ে। সেই বৃষ্টির ঠান্ডা পরশ অনুভব করছিলাম আমার পায়ের পাতায়। দেখতে দেখতে ভিজে গেলাম। ঘোর কাটতেই শুনলাম একটা বুম্বুম্ আওয়াজ। আকাশ গর্জাচ্ছে। শার্সিতে চোখ রেখে দেখলাম সারা লে শহরটা যেন একটা কালো আদিম জন্তুর থাবার মধ্যে ছটফট করছে। মধ্যরাত্রের পরিস্থিতি হল মারাত্মক। প্রচণ্ড ঝড়। প্রবল বৃষ্টি। ভয়ঙ্কর তার শব্দ। মনে হল সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। এরই মধ্যে ইলেট্রিসিটি চলে গেল। তুষার মরুশহর লে। এই শহরের মানুষ ঝড়-বৃষ্টিতে একেবারেই অনভ্যস্ত। বাড়ির নির্মাণে তাই কাদামাটির ব্যবহার। একবার যেন মনে হল বাড়িটা কেঁপে উঠল। ভূমিকম্প নয় তো? আর তো ছাদের তলায় থাকা সংগত নয়। কোমরে চাদরখানা জড়িয়ে নিয়ে ছুটলাম সিঁড়ির দিকে। এখন যত শীঘ্রই নেমে পড়া ভালো। কোথায় যেন বাজ পড়ল। বিকট আওয়াজের ধাক্কা সামলাতে মাঝ সিঁড়িতেই বসে পড়লাম। অকস্মাৎ তীব্র আলোর ঝলকানিতে চোখে পড়ল হোটেলের প্রধান ফটকে জড় হয়েছে বেশ কয়েকজন মানুষ। আবার ভূমিকম্প হল। দৌড়ে ফটক পার হয়ে উন্মুক্ত রাস্তায় এসে পড়লাম। ওদিকে চলছে হুড়োহুড়ি। আতঙ্কে অনেকেই হোটেল থেকে বেরোতে গিয়ে আঘাত পেল। এদিকে ঝড়ের চোটে মাটিতে পা রাখা দায়। ঝাপটায় উলটে ফেলে দিতে চায়। চড়বড় চড়বড় শব্দে বড়বড় ফোঁটা তীরের মতো গায়ে বিঁধতে লাগল। এ বৃষ্টি সমতলের আটপৌরে ঘরোয়া বৃষ্টি নয়। বিরাট বিরাট বালতি করে রাশি রাশি জল কারা যেন ছুঁড়ে মারছে। সঙ্গে বরফের টুকরো। মাথা ফাটার উপক্রম। শুরু হল মহা প্রলয়। সেই ঠ্যাঙাড়ে বৃষ্টির ভয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালিয়ে এলাম হোটেলের ছাদের আশ্রয়ে। কিন্তু পালাবো কোথায়? সেই জ্যান্ত জলপ্রপাত কিছুটা পিছু পিছু ধাওয়া করল। কে যেন চিৎকার করে বলল,
“সাবধান, বাদল ফাট গয়া।'
মেঘ ভাঙার সেই শব্দকেই বিস্ফোরণ বলে মতিভ্রম হয়। তার পর কিছু বোঝার আগেই হড়কা বানের তোড়ে ভেসে যায় সব।
মানুষের ভাগ্য আর ভবিষ্যৎ বাতলাবার বিরাট দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে যারা বেড়ায় তাদের গনৎকার বলে। এর মতো স্বাধীন নিরুপদ্রব পেশা নাকি দুনিয়ায় দুটো নেই। আর দৈবজ্ঞ? যার মধ্যে দৈবশক্তি ভর করে। এটা ঠিক পেশা নয়। দৈবজ্ঞরা দৈববাণী করে থাকেন। তাহলে পাদরিবাবা কী? মানুষটা কি দৈবজ্ঞ? কারগিল থেকে যখন যাত্রা শুরু করেছিলাম তখন তো আকাশে একটাও কালো মেঘ ছিল না।
বৃষ্টি কমলেও শেষ রাতের লে-র বাতাসে শুধু স্বজনহারাদের কান্নার শব্দ। পথঘাট প্লাবিত। যানবাহন শূন্য। পাহাড় ঘেঁষা নতুন বাসস্ট্যান্ডের উপর ধসে পড়েছে পাহাড়ের একাংশ। গুঁড়িয়ে গেছে ট্যাক্সিস্ট্যান্ড। মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছে বহু বাড়িঘর। কোথাও বা কাদা জমে তৈরি হয়েছে স্তূপ। মানুষের দেহ আর দুমড়ে যাওয়া গাড়িগুলো জমা হয়েছে সেখানে। কাদার স্তূপের তলায় এখনও অনেকে চাপা পড়ে থাকতে পারে। বাড়তে পারে মৃত্যুর সংখ্যা। এত মানুষের মৃত্যুতে বিহ্বল লাগছে। বিপদ থেকে আত্মরক্ষার সুযোগটাই পায়নি অনেকে। ‘মেঘ ভাঙা বৃষ্টি’ থেকে ‘হড়কা বান’ তাতেই চরম বিপত্তি। তাতেই বিধ্বস্ত জেলা হাসপাতাল। টেলিফোন এক্সচেঞ্জ। পুলিশের ছাউনি। এমনকী বিমানবন্দরের রানওয়ে। রাস্তাঘাটে যে পরিমাণে কাদা জমেছে, তা সরিয়ে মৃতদেহগুলো উদ্ধার করতে প্রশাসনকে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে। মৃত্যু আর ধ্বংসের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হল, তিন হাজার বছর লেগেছিল ‘লে’ শহরকে থাকার যোগ্য করে তুলতে। প্রকৃতির রোষে বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠতে কিন্তু তিন ঘন্টাই যথেষ্ট।
তিন দিন ধরে লে শহরে ঘুরছি। শান্তিস্তূপ, শে, থিকসে, হেমিস, আলচি, দিসকুত, স্পিতুক, লিকির — শুনেছি প্রত্যেকটা মনাস্ট্রিই স্বতন্ত্র। বাইরে দু-ধারে সারি সারি প্রেয়ার হুইল। নির্জন দুপুরে দমকা হাওয়ায় নিজে থেকে ঘুরে চলে হুইলগুলো। বাসনা ছিল, বেশ কয়েকটা মনাস্ট্রি ঘুরে সিন্ধুনদের পাড়ে দু-দণ্ড জিরিয়ে নেব। আর শুনেছিলাম ম্যাগনাটিক হিলের কথা যেখানে নিউট্রাল গিয়ারেও গাড়ি এগিয়ে চলে দিব্যি। কিন্তু না, আমি এখন চাইছি নির্গমন। এখন ঘরের মায়ার টানে মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। কিন্তু কে দেবে এখানে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। আমি যে এখানে অপরিচিত। কারগিলের রাস্তায় ভেঙে পড়েছে সেতু। রোটাং পাস হয়ে লে-মানালি ঘুরে যে সড়ক, তারও মেরামতির কাজ চলছে। শুনেছি ও-পথের আকর্ষণ কম নয়। আকাশ বিদীর্ণ করে পাহাড় উঠেছে। অনুর্বর বর্ণময় পাহাড়, শিরে তুষারশুভ্র তুষার-কিরীট। সূর্যালোকে ক্ষণে ক্ষণে রঙের বর্ণালি, সেও এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। কিন্তু দু-দিনের বাসযাত্রার ধকল সইবার মতো মানসিক ও শারীরিক অবস্থা, কোনোটাই এখন আর অবশিষ্ট নেই। তাই পথে পথে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
জেলা শহর লে-র ছোট্ট বিমানবন্দর, কুশোক বকুলা রিনপোচি। মূল শহর থেকে একটু দূরে। খবর পেলাম বিমানবন্দরের অবস্থা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে। কারগিল, উধমপুর থেকে সামরিক বিমান ও হেলিকপ্টারে ত্রাণ আসা শুরু হয়েছে। বিমানবন্দরের কাছে মিলিটারি ব্যারাক। অমানুষিক পরিশ্রম করে জওয়ানরা তিনদিনের মধ্যে রানওয়ে পরিষ্কার করে ফেলেছে। টিকিটের অন্বেষণে এসে জনৈক মেজর পাটিলের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল। ভদ্রলোকের পোস্টিং জনবসতিহীন দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল চুসুলে। আকসাই চিন গ্রাস করার পর চিনা আগ্রাসন এই চুসুলেই প্রতিহত হয়। ভদ্রলোক আমার দিল্লি যাওয়ার সমস্ত ব্যবস্থা করে দিলেন। আমার মনে হল ইনিই যিশু।
পাদরিবাবা বলেছেন, যিনি আলো দেখান তিনিই যিশু। লে থেকে দিল্লি যাওয়ার উড়োজাহাজটা যখন হিমালয়ের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিল, তখনই জানলায় এসে ধাক্কা মারছিল সাদা মেঘগুলো। হঠাৎ মনে হল, হিমালয় আমার পায়ের তলায়। নীচে পাহাড়ের চূড়াগুলোকে মনে হচ্ছিল যেন ছোট্ট ছেলের রং-পেনসিলের আঁকা ছবি।
আমার পাদরিবাবার কথা মনে পড়ল। হেমিসের গ্রন্থাগারে চর্বির প্রদীপ জ্বলছে। তাতে আঁধার দূর হয়নি। উৎকট গন্ধে ভরে উঠেছে চারদিক। সৃষ্টি হয়েছে এক ভয়াবহ পরিবেশ। তারই মধ্যে মানুষটি একটি পুস্তক প্রণয়ন করে চলেছেন — দ্য আননোন লাইফ অব্ যিশাস ক্রাইস্ট।