কথায় বলে বেড়ালদের নাকি নটা প্রাণ থাকে! টমের বন্ধু মাইক অবশ্য ওকে বলে, “তুই তো বেড়াল নোস বটে কিন্তু তোরও মনে হয় নটা প্রাণ আছে!” আসলে টম অনেকবারই গেল গেল করে যেতে যেতেও প্রাণে বেঁচে গেছে তাই।
শুধু মাইক কেন অনেকেই ওকে ঐ কথাটা বলে। সমুদ্রের ধারে জেলেদের বস্তিতে মানুষ টম। খুব ছোটবেলায় নাকি একবার নৌকা থেকে জলে পড়ে গিয়েছিল কীভাবে। টমের অবশ্য কিছুই মনে নেই। সাঁতার কাটতে জানে না ওইটুকুন পুঁচকে কিন্তু একগাদা জল খেয়েও সে বেঁচে গেল। মা বলেন সে নাকি দশ মিনিট জলে ছিল! টমের যদিও সে কথা বিশ্বাস হয় না, মা মনে হয় সময়টাকে অনেকটা বাড়িয়ে ফেলেছেন ভালবাসার টানে!
ওর বয়স যখন সাত তখন দস্যিপনা করতে গিয়ে দোতলার ছাদ থেকে পড়ে যায়। পা ভাঙ্গা ছাড়া কিছুই হয়নি ওর। বারো বছর বয়সে কোন এক অনুষ্ঠান বাড়িতে পচা খাবার খেয়ে প্রায় যায় যায় অবস্থা হয়েছিল কিন্তু শেষমেশ বেঁচে যায় টম। অন্য প্রায় জনা কুড়ি লোক মারা গিয়েছিল ফুড পয়সেনিং হয়ে। সেই থেকেই সবাই টমকে নিয়ে বেড়ালের নটা প্রাণের কথা বলে।
মাইক সবসময় বলে, “এবার একটু সাবধানে থাকিস বাপু! তিনটে জীবন তো ব্যবহার করা হয়ে গেছে এই কদিনেই!”
টম হাসে ওর কথা শুনে, বলে, “দুর! তুই বড্ড সাবধানী!”
গরমের ছুটির দুপুরে খেলাধুলো করে ক্লান্ত হয়ে একটা গাছের তলায় শুয়ে ঘুম দিচ্ছিল দুই বন্ধু। এমন সময় একটা কড়কড়, মড়মড় গুড়গুড় শব্দ হল। পাড়ে বাঁধা সব নৌকাগুলো দুলে উঠল। ধড়মড় করে উঠে বসল ওরা দুজনে। তাকিয়ে দেখতে লাগল। সমুদ্রের বুকে কিছুটা গেলেই কয়েকটা পাহাড় জঙ্গলে ভরা দ্বীপ আছে। তার মধ্যে যেটার নাম স্যান্টো মিগুয়েল সেটা থেকে জন্তু জানোয়ারের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। পাখিদেরও প্রচণ্ড কলরব! একটু বাদেই একটা বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ল স্যান্টো মিগুয়েলের গায়ে আর বড়ো পাহাড়টার একটা অংশ, বেশ কিছু গাছপালা ইত্যাদি সব ভেঙ্গে ভাসিয়ে নিয়ে গেল ওদের চোখের সামনে।
বুড়ো রবার্ট এসে দাঁড়িয়েছিল ওদের কাছে। সে বলল, “এটা কিন্তু ভূমিকম্প নয়। অনেকদিন ধরেই আশা করছিলাম এই রকমটা হবে। নোনা জলের আঘাতে ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছিল পাহাড়টা! শেষমেষ আর সইতে পারল না!”
রবার্টের মতন অনেকেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দূরের দ্বীপে ঘটে যাওয়া কাণ্ড দেখছিল। চারিদিকে প্রচুর জল্পনা কল্পনা।
মাইক বলল, “উফফ! আমি আগে কখনও এই রকমটা দেখিনি! এই ধ্বস নামার দৃশ্যটা সারা জীবন মনে থাকবে!”
টমের মাথায় তখন অন্য চিন্তা, “দ্বীপটায় কেউ ছিল না, তাই না?”
“নাহ, কে আবার থাকবে ওখানে? কিছু তো নেই শুধু পাহাড় আর জঙ্গল। জঙ্গলের গাছ সব লুকিয়ে চুরিয়ে কেটে নিয়ে গিয়ে গিয়ে তো এই হাল হয়েছে!”
কতদিন ধরে গল্প শুনে এসেছে ওরা যে স্যান্টো মিগুয়েলে জলদস্যুদের আস্তানা ছিল এক কালে। তাদের কিছু লুকোনো গুপ্তধন হয়তো আজও ওখানে আছে কিন্তু লোকে জঙ্গলে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে গেছে, কিছুই তো পায়নি। তাই এখন গাঁয়ের লোক বলে জলদস্যুর গল্পগুলো সব মিথ্যে!
টমের চোখ চক চক করছিল, “তোর কাকার নৌকাটা পাওয়া যাবে কিছুক্ষণের জন্যে? ওটা পাড়েই বাঁধা আছে না? চল দেখে আসি!”
মাইক আঁতকে উঠল, “পাগল হয়েছিস! জানিস না একটা ধ্বস নামার পর মাটির নিচে সব এলোমেলো হয়ে যায় তাই আরো ধ্বস নামার সম্ভাবনা থাকে! সেই জন্যেই তো কেউ যাচ্ছে না এখন ওদিকে।”
টম দুষ্ট হাসি হাসল, “কেউ যাচ্ছে না বলেই তো আমি যেতে চাই! ধর যদি জলদস্যুদের লুকোনো গুপ্তধন পেয়ে যাই?”
“তুই আর বদলাবি না!”
“চল না, চল না! তোর কাকার নৌকাটা নিয়ে যাই!”
“কাকা জানতে পারলে কিন্তু... ”
“আরে কিছু জানবে না। কালকেই তো ফিরল, আজ আর বেরোবে না জানি।”
অগত্যা মাইক কাকার নৌকায় গিয়ে উঠল টমকে নিয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজনে পৌঁছে গেল বিধ্বস্ত স্যান্টো মিগুয়েলে। নৌকাটা টেনে গাছের পিছনে আড়াল করে ফেলে টম বলল, “তুই না যেতে চাস এখানে থাক, আমি চট করে ঘুরে আসি!”
“খেপেছিস! আমিও যাবো!”
“চল তাহলে!”
জল, কাদা, পাথর, ভাঙ্গা গাছ মাড়িয়ে, ডিঙ্গিয়ে দুজনে এগিয়ে চলল।
হঠাৎ ওদের চোখে পড়ল ধ্বস নেমে পাহাড়ের গায়ে একটা নতুন গুহার সৃষ্টি হয়েছে! টম পকেট থেকে একটা টর্চ বার করে বলল, “চল ওই গুহার ভিতরে ঢুকতে হবে!”
“ঢুকবি? যদি আবার ধ্বস নামে?”
“আরে চল না! এই যাবো আর এই আসবো!”
গুহার ভিতর ইঞ্চি ছয়েক জল দাঁড়ানো; তাই জুতো খুলে ফিতে বেঁধে কাঁধে ঝুলিয়ে নিল ওরা। খোঁচা খোঁচা পাথর পায়ে ফুটছে। সেই ভাবেই গুহার আরেকটু ভিতরে ঢুকল ওরা দুজন। কেমন একটা গন্ধ! টম টর্চের আলো এদিক সেদিক ফেলে ফেলে দেখছিল। সেই ভাবেই আলোটা একটা জায়গায় পড়তে চমকে উঠল ওরা।
ওটা কী? সাদা মতন? একটা কঙ্কাল! তার পাশেই একটা বড়সড় কাঠের বাক্স!
টম আনন্দে চিৎকার করে উঠল, “পেয়ে গেছি! পেয়ে গেছি! জলদস্যুদের গুপ্তধন পেয়ে গেছি!”
“ওর মধ্যে যাই থাকুক তার জন্যে কিন্তু একজন প্রাণ দিয়েছে সেটা ভুলে যাস না!” মাইকের গলা উত্তেজনায় কাঁপছে।
“আরে সেটা তো আজ থেকে বহু বছর আগেকার কথা। জলদস্যুদেরই একজন হবে। তুই একবার ভেবে দেখ তো যদি সত্যিই এই বাক্সে গুপ্তধন থাকে তাহলে আমরা আমাদের গ্রামটাকে অন্য রকম করে ফেলতে পারব! আমাদের আর গরিব হয়ে থাকতে হবে না! আমাদের বাবাদেরও আর সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতে হবে না জীবনের ঝুঁকি নিয়ে!”
মাইক তাও রাজি হচ্ছিল না কিন্তু টমও নাছোড়বান্দা, তাই শেষ পর্যন্ত ওকে মেনে নিতে হল।
কাঠের সিন্দুকটায় তালা দেওয়া রয়েছে কিন্তু কাঠটা জলে একেবারে পচে গেছে! তাই হাত দিয়ে টুকরো টুকরো কাঠ ভেঙ্গে ফেলতে ওদের কোন অসুবিধা হচ্ছিল না। সিন্দুকটা যখন ওরা প্রায় ভেঙ্গে ফেলেছে তখন আবার বাইরে পাখিদের কলরব উঠল। কিসের জানি একটা শব্দ হল গুহার মধ্যে। মাইক সিন্দুক ছেড়ে চট করে উঠে দাঁড়াল।
“টম, এখুনি বেরিয়ে চল এখান থেকে!”
“না, না এই তো হয়ে এল! কী আছে ভিতরে দেখে নিই!”
“আর সময় নেই!” বলে টমের হাত থেকে টর্চটা ছিনিয়ে নিয়ে দুম করে ওর মাথায় একটা বাড়ি মারল মাইক! মাটিতে লুটিয়ে পড়ল টম! তখন ওকে ঘাড়ের ওপর তুলে নিয়ে কোন রকমে গুহা থেকে বেরিয়ে এল মাইক। ভাগ্যিস ওর চেহারাটা টমের চেয়ে বেশ কিছুটা বড়সড় নাহলে পাথুরে পথে একজনকে কাঁধে তুলে নিয়ে যাওয়াটা তো মোটেই সোজা কাজ নয়! ততক্ষণে পাখি আর জন্তুরা পরিত্রাহী চিৎকার করছে। কোন রকমে টেনে হিঁচড়ে টমকে নৌকায় তুলে ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে স্যান্টো মিগুয়েল দ্বীপটা থেকে দূরত্ব বাড়াতে লাগল মাইক।
একটু পরেই দ্বিতীয় ধ্বসটা নামল। এটা আগেরটার চেয়েও ভয়ঙ্কর! ওরা অনেকটা দূরে চলে গিয়েছিল তখন তাও ভীষণ ভাবে দুলে উঠল ওদের ছোট নৌকা। বিশাল একটা জলোচ্ছ্বাস হল, বিকট শব্দ আর জলে তলায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল পাহাড়ের বাকি অংশটা সহ গাছ, পালা, পাথরের রাশি। সেই সঙ্গে তলিয়ে গেল ভাঙ্গা বাক্স, কঙ্কাল আর বাকি যা কিছু ছিল তার চারধারে। এদিকে ওরা প্রায় নিজেদের গ্রামের পাড়ে পৌঁছে গেছে। টমের জ্ঞান ফিরেছে, সে উঠে বসেছে নৌকায়। বিস্ফারিত চোখে দেখছে সব কিছু।
কাদা মাখা মুখে মাইকের দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে টম বলল, “মাথাটা মনে হয় ফেটে গেছে!”
মাইক গম্ভীর মুখে উত্তর দিল, “আর কোন উপায় ছিল না! লোভে পাপ পাপে মৃত্যু জানিস না?”
“ঠিকই করেছিস তুই! ভয়ানক লোভে পেয়ে বসেছিল আমাকে! মাথায় বাড়ি খেয়ে তবে বুঝতে পারছি যে ভাল বন্ধু যে-কোন গুপ্তধনের চেয়ে বেশি দামি! তোর জন্যেই আমি এ যাত্রা প্রাণে বেঁচে গেলাম রে!”
অস্তগামী সূর্যের সোনালি আলোয় আলোকিত হচ্ছে তখন চতুর্দিক।