ঝিলডাঙার কন্যা; প্রচেত গুপ্ত; মিত্র ও ঘোষ - কলকাতা; পৃষ্ঠাঃ ৬৫২; ISBN: 978-81-7293-979-3
প্রচেত গুপ্ত এ সময়ের জনপ্রিয় গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। ছোট গল্পে উতরে যাওয়া হয়ত তুলনায় সহজ। কিন্তু উপন্যাসে অনেক বড়ো জায়গা নিয়ে অনেক চরিত্র নিয়ে অনেক কথাবার্তা নিয়ে কারবার। সেখানে পাঠকমনকে জয় করতে পারা কঠিন ব্যাপার। অনেক সময়ই বই হাতে পেলে দেখি, কটা মুদ্রণ হল। হিসেবের কারচুপি থাকতে পারে। কিন্তু হিসেবের মধ্যে পাঠকের মনটি ধরা আছে কিছুটা তো বটেই। প্রচেত ইতিমধ্যেই পাঠক মহলে পাঠক মনে জায়গা করে নিতে পেরেছে। তার জন্য পুরস্কার, নামী সমালোচকদের তারিফ এসব লাগে নি। তাহলে কি করে এটা সম্ভব হল। প্রচেতের লেখা পড়তে ভালো লাগে, তিনি জানেন কিভাবে পাঠকের মনকে জয় করতে হয়। অথচ পাঠক মন বিরক্ত হয় না, ক্ষুব্ধ হয় না, কোনো বিশেষ টানে চালিত হয় না। এ যেন মুখরোচক জলখাবারের দোকান, জনভোগ্য খাবার, অথচ নানা কারণে এ খাবারে অসুখ করে না। বুদ্ধিজীবিদের মতামত কি জানি না। আমি প্রচেতের বই হাতে পেলেই পড়ি। প্রথম পাঠে মজা পাই — কোনোটা থেকে কম, কোনোটা থেকে বেশি।
কলকাতার এক দৈনিকের রবিবারে প্রচেতের ‘ঝিলডাঙার কন্যা’ বেরিয়েছিল ধারাবাহিক ভাবে ৬৬ সপ্তাহ ধরে। কলকাতার বাইরে যেখানে থাকতাম সেখানে এই কিস্তিবন্দী লেখা পৌঁছাত না। ফলে প্রথম দিকে আগাগোড়া পড়ার সুযোগ হয় নি। কিন্তু যেটুকু পেয়েছি তাতেই আমি আকৃষ্ট হই। কেন? এর উত্তর উপন্যাসটিতে একটা কালের করুণ, হাস্যোদ্রেককারী, বীভৎস, বাস্তব এমন চমৎকার ভাবে হাজির করা হয়েছে যা ইতিপূর্বে পাই নি। অথচ, কোনো পক্ষে ঝোল টেনে কথা বলা নেই, লাল নীল হলুদ পার্টিদের কাউকে মাথায় তুলে নাচা, কাউকে পায়ে দলে ফেলা — স্পষ্টত: নেই। দ্বিতীয়ত: বর্ণনার ভাষায় আছে স্মিত হাস্যরস যা তাঁর অন্য লেখাতেও আছে। তৃতীয়ত: উপন্যাসটির বহুমাত্রিকতা। কিছু কিছু নিশ্চয়ই আলোচনা করব। কিন্তু তার আগে বলি লেখকের কব্জির জোর আছে। লেখকের স্বাতন্ত্র্য আছে।
এই বিরাট উপন্যাসটির গল্পটি দু' কথায় বলে নেওয়া যাক। এ গল্পে গ্রাম আছে শহর আছে, তবে গ্রামই মনোযোগ পেয়েছে বেশি মাত্রায়। ঝিলডাঙা গ্রামের শিশুকন্যা যে-কোনো বিপদের খবর আগাম বুঝতে পারে। ফুলের বাপ নিতাই মা মালতী মনে করে এটা অসুখ। ঝিলডাঙা গ্রামের হাতুড়ে চিকিৎসক গোপীনাথ, আদর্শবান স্কুলমাস্টার চিত্তরঞ্জন খুঁটিয়া, কুচক্রী পুলিশ অফিসার, নিষ্ঠুর লালসাপরায়ণ রাজনীতির দলে-ভেড়া গুণ্ডা কাদু, ধর্মভণ্ড রাজনীতিক মানা সরকার, বেশ্যা শান্তি, এই নিয়ে গ্রামের গল্প। অন্যদিকে শহরের মেয়ে কথাকলি, ঝলমল করা সোমনাথ, আধুনিকা পৃথা, টিভি কোম্পানির মালিক কমল মল্লিক, শরীরসর্বস্ব নায়িকা মোম, তার দাপুটে খামখেয়ালী মা, সংসারবিমুখ কথাকলির প্রাক্তন স্বামী ব্রতীন এই নিয়ে শহরের গল্প। এদের প্রত্যেকের গল্প একে অন্যের গল্পে যুক্ত। ডাক্তার, টিভির লোকজন, নায়িকা গ্রামে আসে চিকিৎসায়, শুটিং করতে। চিত্তরঞ্জন খুন, তার জন্য দরদ দেখিয়ে গুণ্ডা নেতার গাঁয়ের লোকদের তাঁবে রাখা, রিস্ক নিয়ে মোমের ঝিলডাঙা যাত্রা, ফুলের কিডন্যাপিং উপন্যাসকে রিতিমত থ্রিলারের কাছে নিয়ে যায়। কথাকলি ও ব্রতীনের ছিটেফোঁটা প্রেম, সোমনাথের কর্মতৎপরতা, কাদুর ও তার স্যাঙাতদের লালসা, ধূর্ততা, ক্ষমতা নিয়ে অনেক মুহূর্ত, পরিস্থিতি আছে। লেখক বাস্তব গল্পকে অবাস্তব ও অলৌকিকের মায়ায় মণ্ডিত করেন। গল্পকে আশ্চর্য সংহতিগুণে সর্বজনের হাঁটায়, আশ্চর্য মেয়ে ফুলের কাছে যাত্রায় শেষ করেন লেখক। ক্রমান্বয় পরাজয়, হতাশার পর এ গল্প শেষ পর্যন্ত ক্ষতবিক্ষত আপনজনের বাঁচার গল্পের আভাসে শেষ হয়।
ঝিলডাঙার কন্যা উপন্যাসের ন্যারেটর কোনো চরিত্র নয়। বলার কায়দা অনেক সময়ই নাটকীয়। আদ্যন্ত অনেক ধরনের, অনেক পরিবেশের ন্যারেশান আছে। এখানে, দেখানোর মাধ্যমে আভাস ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা আছে।
এ উপন্যাসে চরিত্র সংখ্যা অনেক, তদের উঠে আসা ভিন্ন পরিবেশ থেকে। ফুল, ফুলের বাবা নিতাই, মা মালতী গ্রামের মেয়ে। নিতাই শঙ্কিত একটু বেশি কথা বলে। ছোট্ট মফ:স্বল শহরে (বানের হাট) আসা ডাক্তার সুদর্শন পাকা চুল সৌম্যদর্শন, বিপত্নীক টাইপ। তিনি ডাক্তারি করতে আসেন। নিতাই তাকে গ্রামের পরিস্থিতি জানায়। হারাধনকে ন্যাংটা করে গ্রামে ঘোরানোর ক্ষেত্রে কাদুর সাগরেদদের কাজ। হারাধন আত্মহত্যা করে। কথাকলি চাপা সৌন্দর্যের মেয়ে। রিসেপশনিষ্ট টিভি অডিশনের ভিড় সামলাচ্ছে নন্দিনী। কথাকলি ব্রতীনের ওপর বীতশ্রদ্ধ। ব্রতীন আবার ডাক্তারকে তার কৌতূহলের বই এনে দেয়। ডাক্তার মেয়েকে বোঝায় গ্রামের স্যোশাল স্ট্রাকচার, জমির সমস্যা, চিকিৎসার সুযোগ না থাকা। ব্রতীনের সঙ্গে মেয়ের ছাড়াছাড়িতে ডাক্তার চিন্তিত। টিভি কোম্পানির চঞ্চল যুবক সোমনাথ। তার কথাবার্তায় মজা আছে। মাঝে মাঝে কাজে ডুব দেয়। প্রসঙ্গত: টিভি অডিশনের নানা বিষয়। ব্রতীন ও ডাক্তারের কথায় জ্ঞানের জগৎ। ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দেওয়ায় লোকে বলেছিল মাথার সমস্যা হয়েছে। কথাকলি ও ব্রতীনের বিচিত্র সম্পর্ক। প্রেম আছে কিন্তু ঘনীভূত নয়।
কাদু মেয়েমানুষ নিয়ে ছিনিমিনি শুরু করছে। মেয়ে বড়ো হচ্ছে, পালাবার চিন্তা। একই সঙ্গে মাতাল নিতাই ও সোহাগখোর মালতীর দৈহিকতা। ফুল পিঁপড়ের কথা বোঝে, গাছ ভেঙে পড়ার আগাম খবর বুঝতে পারে। একুশ অধ্যায়ে ও অন্যত্র আছে দলে মিটিঙে পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, চড় মারা। লেখক বলেন--‘সময়, ক্ষমতা, অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে জীবনের স্বাদ, গন্ধ, আদর্শই বদলে যায়।’ দলে মেয়ে-নেতার অভাব। বামপন্থী পার্টির নামোল্লেখ না করে সমালোচনা আছে। ‘সবই আজকাল কেনাবেচা করা যায়।’ দলের ভিতর নানা ঝুটঝামেলা। যারা স্যাক্রিফাইস করেছেন, তারা এখন বোকা বনে গেছেন। আদর্শ হয়ে গেছে গৌণ ব্যাপার। সিট নিয়ে মারামারি, চক্রান্ত। কাদুর মতো নেতারা উদ্দিষ্ট কাজ হাসিল করে অন্যকে দিয়ে। গায়ে কাদা ময়লা লাগতে দেয় না। সে জানে-- ‘ডাইরেক্ট নেতা হল ভোটে দাঁড়ানো নেতা।’ লেখক বিশদ করে বলেন পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রার্থী বাইরে থেকে এলে জিতের পর আর গ্রামে আসে না। কাদু গোপীনাথের কাছে যৌনবর্দ্ধক ওষুধ চায়। হাতুড়ে গোপীনাথ ভয়ে ভয়ে একটা ওষুধ দেয়। কাদু জানে--‘টাকা, মেয়েমানুষ, ক্ষমতা এই তিন জিনিসের প্রতি লোভ বাড়লেই সে বড়ো হয়।' কাদু চরিত্র একেবারেই নানা অপগুণে ভর্তি, তাকে উপযুক্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কাদু ও শান্তি, শান্তি ও মানা এই সম্পর্কায়ন চরিত্রগুলির স্বরূপ তুলে ধরে। কায়দা করে শিক্ষক চিত্তরঞ্জনকে মারা এবং তার কারণে রক্ত দেওয়ার ধূর্ততা দুটোই দেখানো হয়। প্রয়োজনে কাদু হিসহিসিয়ে বলে--‘ঝিলডাঙায় আমি-ই আইন।’ কাদু ও থানার আঁতাত স্পষ্ট দেখানো হয়। চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুতে নিতাই ও গোপীনাথ বিচলিত। লেখক লক্ষ্য করেছেন--গ্রামীণ সভায় গান দেখে কাদের সভা বোঝার উপায় নেই। মানার বাড়ির সামনে শুদ্ধিমঞ্চ, ছেলেদের মাতিয়ে দেওয়া, অথচ নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নাড়া। মানা সরকারের দশের অন্তর্দ্বন্দ্ব বেশ কয়াকটি অধ্যায়ে আছে। দারোগার কাছে ভুল বানানে চিত্তরঞ্জন খুঁটিয়া হত্যার চিঠি আসে। এই সূত্র ধরে কাদু ও তার দলবল ঠিক বার করে ফেলে এ চিঠি লেখা নিতাই-এর। প্রতিশোধলিপ্সু কাদু নিতাই-এর পরিবারের প্রতি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে, ফুলকে তুলে নিয়ে যায়।
গ্রামীণ চরিত্রগুলির সারল্য, কুটিলতা, পার্টিবাজ নেতা সবই দেখিয়েছেন, যদিও গ্রামীণ মানুষের ব্যাপকতা নেই। নিতাই, গোপীনাথ, কাদু, মানা এই চরিত্রগুলি গ্রামীণ জীবনের একটা কালের প্রতিনিধি-স্থানীয় চরিত্র। শহরের চরিত্রগুলির মধ্যে টি.ভি. সংশ্লিষ্ট মানুষগুলি কেনাবেচা একালের অর্থরুচির প্রতিনিধিত্বকার। সুদর্শন ডাক্তার কল্পনাপ্রবণ মানুষ--গ্রাম ও শহরের যোগসূত্র। লেখক কতকগুলো প্রসঙ্গ তুলতে গিয়ে কোনো কোনো চরিত্রকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তাদের স্বরূপ তুলে ধরেছেন। সংলাপে আবরণে মুখ্য ও গৌণচরিত্রগুলি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
প্লটের বিচারে বলতে হয়--ঝিলডাঙার অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ফুলকে কেন্দ্র করে যেসব ঘটনা সেটাই মেন প্লট। তবে কথাকলি ও ব্রতীনের সম্পর্ক সংশয় অবশ্যই সাব-প্লট, সলিল চন্দনার গল্পও সাব-প্লট। লেখকের কৃতিত্ব মেন প্লটের বিকাশের সঙ্গে অন্য অনেক প্রসঙ্গ জুড়ে দেওয়া হলেও বাহুল্য মনে হয় নি। যে-দুটো সাব-প্লটের উল্লেখ করলাম তা অবশ্য খুব অনিবার্য বলা চলে না। ফলে বৈচিত্র্য আনার জন্য, বনানী ও তার ছেলের অর্কর গল্প, সোমনাথ ও পৃথার গল্প, মানা সরকারের গল্প, পার্টিদ্বন্দ্ব প্রসঙ্গ এসেছে। কিন্তু মাত্রা ছাড়ায়নি, যদিও মাত্রা ছাড়ানোর প্রলোভন ছিল যথেষ্ট। মোম তার মা কমল মল্লিক ও টি.ভি. প্রোডাকশন, প্রীতি শর্মা ও কমলের ব্যবসাগত ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে একটা গল্প তৈরি হতে পারত। লেখক সঙ্গত ভাবেই সে-পথে যান নি।
কাঠামো আর প্লট পরস্পর সম্পর্কিত। তবে কাঠামো বললে ঠিক গল্প বোঝায় না, আসে encompassing the work’s total organization as a piece of literature. তবে কাঠামো আর ফর্ম এক নয়। পরেরটাতে থিমগত উপাদান যুক্ত হয় না। কাঠামোর মধ্যে থাকে প্লট, থিম, কৌশল, ও ফর্ম। পাঠকদের কাছে প্রতিভাত হয় সামগ্রিক বিন্যাস ও প্যাটার্ন, যা সমগ্রতা বিধান করে। আমাদের আলোচ্য উপন্যাসে দেখানোর চেষ্টা গ্রামাঞ্চলে ক্ষমতার স্বেচ্ছাচারিতা ও অনন্ত উপার্জন, সব কিছুকে কেনা বেচার অলৌকিকত্বকে আবহাওয়া প্রসঙ্গে ব্যবহারে দূরদর্শিনী কৌশল, ফুলের প্রবণতা নিয়ে শহুরে ডাক্তারের কৌতূহল ও চিকিৎসা, স্বার্থে ঘা লাগলেই নিকেশ এটাই মাথায় রেখে প্রচেত এই বিরাট উপন্যাসটি সাজিয়েছেন। আটান্নটি অধ্যায় জুড়ে ৬৫২ পৃষ্ঠার এই উপন্যাস এগিয়ে গেছে শহর ও গ্রামের পরিসরে, কঠোর বাস্তবকে একটু অবাস্তবের ছোঁয়া দিয়ে গল্প এগিয়েছে। অতি সিরিয়াসের সঙ্গে অতি লঘু, দর্শন বিজ্ঞান কাব্যকথার সঙ্গে পরিহাস, ঠাট্টা কখনও সংলাপে, কখনও ন্যারেশনে এই মিশাল কাঠামোকে আকর্ষণীয় করে রেখেছে। সেটা অবশ্যই লেখকের কৃতিত্ব বলতেই হবে। তের নম্বরে আছে টম ল্যুজের লেখা ‘দ্য কালচারাল অ্যান্ড নেচারাল হিস্ট্রি অফ টিয়ারস’, ২৮-নং অধ্যায়ে অর্গানাইজেশন অব্ গ্লোবাল নেগেশিয়েন, ওয়ার্কস অব্ টমাস হার্ডি, ত্রিশ অধ্যায়ে মোমের হাতে পাওলো কোয়েলার অ্যালকেমিস্ট, এখানেই অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক মেভারতিনিস, তেত্রিশ অধ্যায়ে ওয়ান্ডার ওয়ার্ল্ড অব অ্যান্টি ও বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড উইলসন, আটত্রিশে ফুলকে নিয়ে কবিতা, চল্লিশে কার্ট লিউয়িন, এরিকসন, আনা ফ্রয়েড, মার্গারেট রিড, জাঁপিয়াজ আলেকজাণ্ডার মরিশন, ছেচল্লিশে অ্যান্ট দ্য স্ট্রাকচার, ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড বিহেভিয়ার কিংবা তারকমোহন দাসের পিঁপড়ের জীবনদর্শন, পঞ্চাশ অধ্যায়ে জীবনানন্দ উদ্ধৃতি, চব্বিশে মার্কেজের মেমোরিজ আব মাই মেলানকলি হোরস প্রভৃতির উল্লেখ চরিত্র অনুযায়ী, সিচুয়েশন অনুযায়ী দেওয়া হয়েছে। যদিও সবক্ষেত্রে লাগসই মনে হয় নি। যেমন সাত অধ্যায়ে ডাক্তারের কাব্যিকতা খাপ খায় নি। একেবারে ক্রুড ও সিরিয়াস মার্জিত ভদ্র সভ্য চরিত্রগুলির মধ্যে গল্পটা ঘোরাফেরা করেছে, বাচ্চা, যুবক, যুবতী, ব্যবসায়ী, গুণ্ডা, ডাক্তার, টিভিকর্মী মিলিয়ে চরিত্রবৈচিত্র্যের অবধি নেই, যা কাঠামোকে বর্ণিল ও আকর্ষণীয় এবং সংহত করে রেখেছে।
সেটিং কথাটি উপন্যাস আলোচনা সূত্রে অপেক্ষাকৃত হাল আমলের। ব্যক্তি ও স্থানের সম্পর্কায়নের সেটিং — তারাশঙ্করের হাঁসুলিবাঁকের উপকথার সেটিং যেমন হাঁসুলিবাঁকের কাহারপাড়া। সেটিং বাস্তব, চলনসই, স্টাইলাইজড নানা প্রকার হতে পারে। তবে বিদেশী আধুনিক বা উত্তর-আধুনিক উপন্যাসে দেখা যায় চরিত্ররা নিরাশ্রয়, জাতিহারা, বিচ্ছিন্ন তাদের পরিবেশ থেকে। সেটিং মুড বা মরাল পরিবেশ গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠতে পারে। প্রচেত গুপ্তের ‘ঝিলডাঙার কন্যা’ উপন্যাসের সেটিং স্পেসিফিক কোনো গ্রাম নয়। পশ্চিম বাংলায় এমন অনেক গ্রাম আছে যা ঝিলডাঙা কিংবা বানের হাট হতে পারে। তবে জায়গাদুটো কলকাতার খুব কাছেই, রাস্তা ঘাট ভাঙাচোরা। সেখানেই চিত্তরঞ্জন খুঁটিয়ার প্রাথমিক ভাঙাচোরা স্কুল, ফুলদের বাড়ি, একটু কাছে দূরে কলেজ আছে। পঞ্চায়েত নির্বাচন এলাকা। কাদু বা মানা সরকারের গুণ্ডামি গ্রামে, মফ:স্বলে সহজদৃষ্ট। অন্যদিকে সুদর্শন, কথাকলিদের বাড়ি, ব্রতীন বা সলিলের ঘর-গেরস্থালি স্পেসিফিক নয়। নব্যবঙ্গের রাজনীতির পচন, আদর্শবাদের অপমৃত্যু, দূরদর্শনের বিষপ্রভাব সেগুলোও কোনো নির্দিষ্ট জায়গার নয়। লেখক কিছু গ্রামের কিছু শহরের পর্যবেক্ষণকে ঘটনাবর্ণনা কালে প্রকাশ করেছেন, যাকে নীতি প্রকাশক বলাও যেতে পারে। ফুলদের বাড়িঘর, কাদুর ভোগালয়, ডোবা পুকুর দেখে মোমের বিবস্ত্র স্নানের আগ্রহ, বিবর্ণ চায়ের দোকান, মোটরবাইকে আনাগোনা মিলিয়ে কলকাতার কাছেই গ্রামের আবহনির্মাণ করেছেন লেখক। উপন্যাসের ফুলের ভবিষ্যৎ বলার মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্বিপাক, উপন্যাসের শেষ অধ্যায়ে ভূমিকম্প, সব কিছু দুলে ওঠা আর ক্ষতবিক্ষত আপনজনকে বাঁচাতে গ্রামবাসী ও কিছু শহরবাসীর একযোগে দ্রুত হাঁটা অবশ্যই স্টাইলাইজড, প্রতীকি বলতে আপত্তি ওঠার কারণ নেই। লেখক একের পর এক বিপর্যয় দেখিয়ে তাঁর অভীপ্সিত উপসংহারে পৌঁছে দিয়েছেন পাঠককে — যা ঘটতে পারে। অন্তত: ঘটলে অনেকেরই যারা আপনজনকে ক্ষতবিক্ষত দেখেছেন তাদের ভাল।
এবার আসবে থিম প্রসঙ্গ। কোনো সাহিত্যরচনা থেকে, তার অন্তর্গত বিষয় থেকে যে বিমূর্ত ধ্যানধারণা বেরিয়ে আসে সেটাই থিম। বিষয় বর্ণিত হয় কাজের মধ্য দিয়ে, কিন্তু থিম ফুটে ওঠে বিমূর্ত ভাবে। কখনও তা স্পষ্ট কখনও তা আভাসিত। ‘ঝিলডাঙার কন্যা’ উপন্যাসের শুরুতে রবার্ট ফ্রস্টের একটি পঙ্ক্তি আছে। তা হল--'Some say the world will end in fire, some say in ice.’ এই কাব্যিকতার নিহিত ব্যঞ্জনা আনিবার্য পরিণতির দিকে। এ উপন্যাস বিংশ শতাব্দীর অবসান পর্বের হাল আমলের পচনধরা সমাজের ঘটনাবলিকে তুলে ধরে। স্পষ্ট চিহ্নের রাজনৈতিকতা নেই তবে বামফ্রন্টের ঘুণধরা পর্বের আভাস আছে। ২০০৯-এর পরবর্তী পালাবদলের ছবি নেই। সুকৌশলে রাজনৈতিক যুযুধানত্ব, উগ্র রাজনৈতিকতা ও ক্ষয়ক্ষতি লেখক এড়িয়ে গেছেন। লেখক দেখান গ্রামের মানুষও মতলব ও ধান্দাবাজি শিখে নিচ্ছে। যাত্রী ও রিকশাওলাদের মারপিট, রাস্তার শোচনীয় অবস্থা, হাতুড়ে চিকিৎসা, ভুতে পাওয়ায় বিশ্বাস আছে। অন্যদিকে সিরিয়াল, মেগাসিরিয়াল, গেম শো, টক শো, জোকস, কম্পিটিশন, তদের টি আরপি, তাদের হাতে দেশবাসীর নৃত্য, জুয়োর বোর্ড, ব্লু চালানোর ভিডিও হল চলছে। শহরের সমস্যা কিঞ্চিৎ আলাদা। যেমন — দামি স্কুলে অ্যাডমিশনের সমস্যা। ‘পলিটিক্সে’ এক একটা সময়ে এক একটা বিজনেস দারুণ চলে... ’যেমন বছরভর ইলেকশন। সাইজ বুঝে টাকা।’ ‘পলিটিক্সে রাজার থেকে রাজা বানানোয় দাম বেশি।’ ‘হাসিই হল মানুষের সেই জিনিস যা সব থেকে বেশি বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে।’ ‘ছেলে যতই ভালো হোক আজকাল এখানে চট করে ভালো কাজ পাওয়া যায় না।’ ‘টিভি শো দেখে দেখে বাঙালির রুচি পালটে গেছে।’ ‘এখন যে ব্যবসার যুগ। গোটা দুনিয়া ব্যবসায় মেতেছে।’ ‘সময়, ক্ষমতা, অভিজ্ঞতার সঙ্গে আজকাল পাবলিক হামড়ে পড়ে খাচ্ছে।’ ‘একটা দিন ছিল যখন সভার গান শুনে দল চেনা যেত।’ ‘আমাদের এডুকেশন সিস্টেমে সাজেশনই আসল।’ ‘এই সব লোকের (যেমন--কাদু) রাজনীতিতে ঢুকতে আসুবিধে হয় না। সব দলই নেওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে।’ ‘এইসময় অত প্রাইভেসিতে বিশ্বাস করলে চলে না। যা হবে সব ট্রান্সপারেন্ট।’ ‘এখন তো দাদা বাজারেরই যুগ।’ এই কয়েকটি উদাহরণ থেকে বোঝা যাচ্ছে লেখক — এ-যুগ যে বাজারী, সেটাই নানাভাবে থিম করতে চাইছেন। দ্বিতীয়ত: এই দীর্ঘ উপন্যাসে এসব অনেক পর্যবেক্ষণ আছে (যার কিছু নমুনা দিলাম) যা লেখকের খোলা চোখের সঠিক উপলব্ধিকে প্রকাশ করে। অথচ তার পরিবেশনভঙ্গিটা এমন যে তা কখনও নীতিপ্রকাশক, জ্ঞান দেওয়ার ভঙ্গি — এসব মনে হয় না।
এবার ভাষার কথা। গল্প উপন্যাসে ভাষার ভূমিকা অতুন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্ণনার ভাষা, সংলাপের ভাষা গল্পের বিষয় অনুযায়ী, চরিত্র পাত্র অনুযায়ী বদলে যায়, যাওয়া উচিত। ডেভিড লজ বলেছিলেন উপন্যাসের ভাষা যেন জানালার স্বচ্ছ কাঁচ, যার মধ্য দিয়ে চলতে চলতে উঁকি মারলে গেরস্থালির ভেতরটা দেখা যায়। এ উপন্যাসের অধ্যায়গুলোর উপস্থাপনা অনেকটা ছোটগল্পের মতো কৌতুহলীদ্দীপক। শুরুর বাক্যটি হচ্ছে — ‘লোকটা প্রশ্নের জবাব দিল না’। তাহলে জানতে ইচ্ছে করবে লোকটা কে, কি ছিল প্রশ্ন, কে প্রশ্ন করল? কেন জবাব দিল না। ছয় অধ্যায়ের শুরু ও সেরকম — ‘কমল মল্লিক সোমনাথের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। আট অধ্যায়ে ছেলে অর্কর শরীর পুষ্টি বিষয়ে মা বনানীর সতর্ক একটা দীর্ঘ অনুচ্ছেদ জুড়ে। মাঝে মাঝে বর্ণনার ভাষা বিশেষ উপভোগ্য — ‘বনানীর এটা আরেকটা গুণ, সে নির্লজ্জের মতো স্বামীর প্রশংসা করতে পারে’। কিংবা নয় অধ্যায়ের গোড়ার দিকেই — ‘আজকাল পার্টি পলিটিক্সে নেতাদের জেলা মিটিঙের খুব বাড়বাড়ন্ত চলছে’। একটা রাজনৈতিক লক্ষণসূচক। ‘একাগ্র চিত্তে গীতার বাণী শুনতে শুনতেই মানা সরকার মনে মনে সম্ভাব্য ক্যান্ডিডেটের নাম ঠিক করতে লাগলেন। —এ বাক্য চরিত্রদ্যোতক। ‘রেডিয়ো বিশু এল ঘন্টাখানেক পরে’। এটিও জীবিকা প্রভাবিত চরিত্র। ‘ঝিলডাঙায় বিদ্যুৎ নেই। বিদ্যুতের খুঁটি আছে’। ছোট ছোট বাক্যের তির্যকতা থেকে পরিস্থিতি বোঝা যায়। ১৫ অধ্যায়ে আছে — ‘দর্শকদের ডিমান্ড অনুযায়ী নতুন করে কাহিনী বদলানো হচ্ছে। (বারো জনের একটা সার্ভ টিম) বাড়ি বাড়ি ঘুরে দর্শকদের রিঅ্যাকশন বুঝছে’। আপাত নিরীহ ভঙ্গিতে লেখক টি.ভি প্রোডাকশনের অনুপ্রবেশ বুঝিয়ে দেন। সতেরো অধ্যায় শুরু হয় এই ভাবে — ‘বারান্দার দরজাটা খুলে কথাকলি থমকে দাঁড়াল। আশ্চর্য এক মায়াবী আলো ফুটেছে আজ’। কথাকলি ব্রতীনের দাম্পত্য প্রভাবিত মনের আলোর ব্যঞ্জনা জাগে এখানে। একচল্লিশ অধ্যায়ে প্রথমদিকে — ‘নিজের ওপর রাগ হলে মানুষ সাধারণত: নিজের একগালে চড় মারে। শুদ্ধনাথ দুগালেই মারল’। সিনেমা পরিচালক শুদ্ধনাথের মহাভুলের কথা। প্রচেতের একটা বৈশিষ্ট্য — তিনি বর্ণনার ভাষা, সংলাপের ভাষা দুটিতেই হাস্যরস সৃষ্টি করতে নিপুণ, অনেক সময়ই তা বিশুদ্ধ কৌতুক। এই কৌতুকরসে পাঠক নিমজ্জিত হলে উপন্যাস/গল্প পাঠককে ভাসিয়ে নিয়ে চলে।
বর্ণনার ভাষা অপেক্ষা সংলাপের ভাষায় তাঁর কৃতিত্ব অধিক। এই সংলাপের ভাষা যেমন বক্তব্যের ইঙ্গিত দেয়। তেমনি বক্তার স্বরূপ তুলে ধরে। কিছু উদাহরণ পেশ করি —
ক) গুণ্ডা কাদুও বেশ্যা শান্তির সংলাপ — শান্তি মিথ্যে রাগের ভান করে বলে, ‘হাসবে না কাদুদা, ভালো হবে না বলচি। আমি কিন্তু রেগে যাবো মাইরি। আজ একটা নোট বেশি দিতে হবে। কামড়ে দেওয়ার ফাইন। হ্যাঁ, এই বলে দিলুম।
‘বাপরে কত ছেনালি জানিস শান্তি। টাকা বাগামোর কত রং ঢং। হ্যাঁরে। লাইটারটা কই?...
মনে মনে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, শুয়োরের বাচ্চা, করার মুরোদ নেই এক পয়সা, শুধু ধামসাবে’।
খ) হাতুড়ে ডাক্তার গোপীনাথকে কাদুর ভয় দেখানো — তারপর ধর মেয়েছেলে। লাইসেন্স ছাড়া কারবার করলে মেয়েছেলের টেস্ট হয় অন্যরকম। লাইসেন্স মেয়ের টেস্ট যদি হয় ঝাল, লাইসেন্স ছাড়ার পর নোনতা নোনতা। তবে কী জানো ডাক্তার, লাইসেন্স ছাড়া কাজকম্মে ঝক্কি আছে। কোনোভাবে ধরা পড়ে গেলে সমস্যা। পুলিশ তোমার পিছনে এতখানি ঢুকিয়ে বসে থাকবে। তুমি যতই বল না কেন বের করবে না, ফুসফুস করে দারোগাবাবু বিড়ির ধোঁয়া ছাড়বে। (ডাক্তারের লাইসেন্স নেই তাই ভয় দেখিয়ে অন্য কাজ করানো)
গ) পরিহাসময়ত্ব:
কথাকলি মুখে হাত চাপা দিয়ে হেসে বলল, ওঠবোসের অডিশন। সোমনাথ অবাক হয়ে বলল, ওঠবোসের অডিশন। মানে?
‘শুনেছি একটা প্রোগ্রাম হবে, ওই গেম শো ধরনের কিছু। সেখানে শাস্তি হল কান ধরে ওঠবোস। ক্যামেরার সামনে কান ধরে ওঠবোস করতে হবে। সেই ওঠবোস করতে কত অ্যাপ্লিকেশন জমা পড়েছে জানেন?
ঘ) গ্রাম্য শিশুর সংলাপ:
ফুল মাথা ঝাঁকিয়ে রাগ দেখিয়ে বলল, ‘কী যে বলল না তুমি, ওই কিলিপ তো আমার, পুতুলের জন্য একটা চাই না?
ঙ)সোমনাথের সংলাপ:
এক একটা মেগাসিরিয়ালের কাজ করতে গিয়ে রাতে ঘুমোতে পারি না। ...মনে হয়, ক্যারেক্টারগুলো এক-একটা ড্রাকুলার মতো। কামড়াতে আসছে। নায়ক নায়িকা সবাই। [এই দীর্ঘ উপন্যাসে দূরদর্শন সম্পর্কে পরিহাসের ছলে সংলাপে নানা অ্যাডভার্স কমেন্ট আছে। পাঠক পুরো উপন্যাসের এই অংশগুলো পড়লে আঁচ করতে পারবেন এই সব সংলাপে লেখকের অ্যাটিচুড ধরা আছে]।
চ) আধুনিক বাচ্চা শাসনে মায়েদের দাপট; দিদাদের স্নেহ:
উমা দেবী টেবিলের ওপর প্লেট, গ্লাস রেখে বললেন, ‘ছেড়ে দে, যখন ইচ্ছে হবে খাবে। এই তো বাড়িতে ভাত খেয়ে এসেছে। তারপর আবার ট্যাক্সিতে ছানা, ফেরে ঠেসেঠুসে গেলাচ্ছিস?’
‘ছেড়ে দেব! এটা তুমি কি বললে মা? অর্কর চেহারাটা দেখেছ? হাড় গোনা যায়। আমি কাল রাতে ওর পিঠের হাড় গুণেছি। এইভাবে চললে ওর হবে? চলবে? দু-দিন বাদে স্কুলে ভর্তির ব্যাপার আছে।
ছ) এক সেন্ট্রিক চরিত্র:
সলিল বলল, ‘মানে লাইন বদলেছি মানে? মারব এক চড়। জেনে রাখবি ব্রতীন, আমি একজন বর্ণ কালেক্টর। জন্ম সংগ্রাহক!
‘কালেক্টর অব্ ফুটপাথ? দুজএন একসঙ্গে হেসে উঠল।
জ) ভড়ংদার নেতা — মানা সরকার:
কী যে বল। আমি ছেলেদের বলে রেখেছি, যতো খুশি পার্টিবাজি কর বাপু, চিত্তশুদ্ধিতে কোনো পার্টিবাজি চলবে না। এখানে সবাই সমান। এই যে এত মানুষ আজ এসেছিল, তুমি তো নিজের চোখে দেখলে, তারা কি সব আমার দলের? মোটেও নয়। নিজের টানেই এসেছিল’।
ঝ) শিশুতোষ সংলাপে জীবন তির্যকতা:
সোমনাথ বলল, ‘হ্যাঁ রে ব্যাটা তাই। কারও কাছে খিদে হল বাঁচা, কারও আকছে স্রেফ মজা। এত যে সব মারামারি কাটাকাটি হয়, জেনে রাখবি সবার পিছনে আছে খিদে রাক্ষস’। [বোনপো অর্কর উদ্দেশ্যে]
ঞ) বাম পার্টিতে কেনাবেচা:
‘দুনিয়াদারির যা অবস্থা হয়েছে সবই আজকাল কেনাবেচা করা যায়। এতদিন ভাবতাম, অন্তত দল এই অসুখ থেকে মুক্ত। এখন দেখছি তা নয়’। [বাসকর্মী বিদ্যুৎ আর এক সিনিয়র বিজয়কে]
ট) পুলিসের মেজোবাবু:
‘চলে যাবি না তো কি করবি? আমার গলা ধরে ঝুলবি শুয়ার? কাল বিকেলের মধ্যে যদি চোরাই মাল থানায় এসে জমা না দিয়েছিস মজা টের পাবি’।
ঠ) পার্টিনেতার সাকরেদ: গাব্বুদা ডেকোরেটরকে — ‘চোপ শালা। প্রোগ্রাম ঠিকই হয়েছে কাল বিকেলের পর। তোমাকে আগে কী করে বলব চাঁদু? ...(চড় কষিয়ে) এখন এই পর্যন্ত দেওয়া রইল। বড়ো কিছু ঘটলে তোমার বড়ো বিপদ আছে। তুমি শালা আজ সারাদিন ওখানে দাঁড়িয়ে থাকবে। স্টেজ ভাঙলে তোমার মাথা ভাঙা হবে। ভাঙা মাথা নিয়ে বাড়ি ফিরব’।
এই প্রত্যেকটি উদাহরণে উদ্দিষ্ট ব্যক্তির স্বরূপ, অন্তর্জগৎ পর্যন্ত ফুটে ওঠে। অথচ একটার সঙ্গে আর একটার ফারাক আছে। এই অঙ্কনের ক্ষমতা সব লেখকের থাকে না। কেউ কেউ একটা আধটা দিক তুলে ধরতে আপ্রেন। প্রচেত নানা ভ্যারাইটিতে সিদ্ধহস্ত।
উপমা, প্রতীক, চিত্রকল্প ব্যাপারে প্রচেত উদাসীন নন। তবে এ উপন্যাসে পর সংখ্যা তুলনায় স্বল্প। কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক্ — ক) সাপ আছে। তবে জলের সাপ তো, ভয় নেই। জলের সাপে ভয় থাকে না। ভয় ডাঙার সাপে। (পৃ.৩)[এ উপন্যাসে ডাঙার সাপ কাদু, মানা প্রভৃতি]
খ) লাইসেন্স মেয়ের টেস্ট যদি হয় ঝাল, লাইসেন্স ছাড়ার পর নোনতা নোনতা। [রেজিস্টার্ড নন রেজিস্টার্ড বেশ্যা প্রসঙ্গে] (পৃ.৩৭)
গ) আরে মশাই দুনিয়াটাই একটা বাথরুম, মলমূত্রের ছড়াছড়ি, আপনি আর আলাদা করে বাথরুম বানিয়ে কী করবেন ? (পৃ.৬১)
ঘ) পলিটিক্সে এক একটা মেয়ে এক একটা বিজনেস দারুণ চলে। সিজনের ফলের মতো। (পৃ.১০৪)
ঙ) অপেক্ষা করে আছে জীবনের যাবতীয় সংগ্রহ নিয়ে। লজ্জা, গ্লানি, ক্লান্তির সংগ্রহ। (পৃ ১৪৩) [ছিটগ্রস্থ সলিলের অভাবী বৌ চন্দনা প্রসঙ্গে]
চ) বিজয় হারামজাদা বিদ্যুৎকে খোঁচাচ্ছে। ... খোঁচালে ধিকিধিকি আগুন ভাল করে জ্বলে ওঠে। (পৃ ২৩২) [পার্টির ভেতরকার ঝগড়া ও রাগ বাড়ানো]
ছ) আজকাল গায়ে কাদা ময়লা লাগাতে দিই না মোটে। (পৃ ১৪৮) [শয়তান কাদু তার যাবতীয় ভয়ঙ্কর কাজ অন্যকে দিয়ে করায়]
জ) তুমি হলে নিরামিষ মানুষ। মাংস খাওয়ার দাঁত ঘষে তোমার কী লাভ (পৃ ২৫৩) [নারী সঙ্গ প্রসঙ্গে কাদু অবিবাহিত গোপীনাথ ডাক্তারকে]
ঝ) বায়াররা বড্ড ছটফটে আছে। আপনার দোকানে পছন্দমতো জিনিস না পেলে রিমোট টিপে ঝট্ করে অন্য দোকানে পালিয়ে যাবে। (পৃ ২৭৭) [দূরদর্শন দর্শক প্রসঙ্গে]
ঞ) গর্তে ফেলতে গেলে গর্তের মুখ আগে ইন্টারেস্টিং করতে হয়। গর্ত যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। (পৃ ২৮৫) [মানাকে নারীসঙ্গের গর্তে ফেলার জন্য কাদু]
ট) পাখার অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছেন। হাওয়ার থেকে গান বাজনা বেশি। মনে হয় মালিকের অবস্থা দেখে ব্যাটা সবসময় ফুর্তিতে থাকে। (পৃ ৩৮৮) [ছিটগ্রস্থ অভাবী সলিলের বাড়ির পাখা প্রসঙ্গে]
কিছু নমুনা পেশ করা হল। প্রচেতের এ বিষয়ে কৃতিত্ব সম্পর্কে বলা চলে অনেক ক্ষেত্রেই তিনি নতুন উপমানের ব্যবহার করেছেন। মাঝে মাঝে কিছু শালীনতাবর্জিত উপমাও আছে। চরিত্রের প্রয়োজনেই তা ব্যবহৃত। অবশ্যই সব উপমা সুপ্রযোজ্য নয়, তা হবার কথাও নয়। সেগুলো উদাহরণে সাজালাম না। উপমাগুলো চরিত্রদ্যোতক, সহজবোধ্য, কোথাও কোথাও বিমূর্ত হলেও দুর্বোধ্য বা দ্ব্যর্থবোধক নয়। ফলে পাঠকের সঙ্গে কম্যুনিকেট অসুবিধে হয় না। ইনটেলেকচুয়াল পোজ নেই, অথচ ইনটেলেক্ট আছে।
সেইটাই হল যথার্থ সাহিত্য যেখানে আইডিয়াগুলো খুঁজে বার করা যায়, আবিষ্কার করা যায় তার গোলমেলে জটিলতা নিয়ে। কথাটা আমার নয়। বলেছিলেন Robert Eaglestone তাঁর Contemporary Fiction নামক ছোট্ট বইটিতে। এটা ঠিকই প্রচেতগুপ্তের ‘ঝিলডাঙার কন্যা’ উপন্যাসটিকে আকর্ষণ বিস্তার সরিয়ে দ্বিতীয় তৃতীয়বার পড়তে গেলে কিছু ফাঁক তো চোখে পড়বেই। যেমন ধরা যাক- কাদু বা মানার পরিবারের কোনো ছবি বা তার আভাস নেই, গ্রামের লোকজনের চলাফেরার ছবিটি চোখে পড়ে না। ঠিক তেমনি সল্টলেক ও অন্য অঞ্চলের মানুষজন পাড়া প্রতিবেশি বন্ধু বান্ধব (ব্যতিক্রম ব্রতীনের বন্ধুরা) জায়গা পায় নি। লেখক সুকৌশলে গত ত্রিশ চল্লিশ বছরের পশ্চিমবঙ্গীয় রাজনীতির কেচ্ছা এড়িয়ে গিয়েছেন। গ্লোবাল ইন্টার ফেয়ারের ব্যাপারটা ও নেই, যদি ও গ্লোবাল মার্কেট গ্লোবাল অ্যাটমসফিয়ারের উল্লেখ আছে। উপন্যাসের নাম ঝিলডাঙার কন্যা- যে বাস্তব মেয়ে, এক গ্রাম্যঘরের মাতাল বাপ ও গেরস্থ মায়ের মেয়ে। তার অস্বাভাবিক ভবিষ্যৎ উচ্চারণ উপন্যাসটির ডাইমেনশনকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে। এই ব্যাপারটা লেখক ভেবে চিন্তে এনেছেন বলেই মনে করি। এ উপন্যাসে বুঝবার জানবার চিন্তা করবার অনেক উপকরণ আছে, কিন্তু উপন্যাসটি লেখার গুণে শুধুমাত্র সাধারণ পাঠক পাঠিকাদের কাছে বোরিং করা হয় নি, আবার বুদ্ধিবিলাসীদের জন্যও রসদ রাখা আছে। এটিকে কি genre fiction কিংবা literary fiction বলা যাবে? এই গোত্রনির্ণয় কি খুব জরুরী? তবে এটি globalized novel নয়, যদিও সামান্য কিছু উপকরণ আছে। রবার্ট ঈগলস্টোন তাঁর পূর্ব উল্লিখিত বইয়ের ৫ম অধ্যায়ে বলেন- fiction is bound into its time, it will inescapally be in some way about time of its writing, whether it explicitly addresses the issues of the day or not. এরপর তিনি পাশ্চাত্য সমাজের কিছু প্রাত্যহিক ইস্যুর কথা তুলেছেন। প্রচেতের এই উপন্যাসে আমরা পাই একবিংশ শতকের কয়েক দশকের দৈনন্দিন সমস্যার কথা। চক্ষুষ্মান পাঠক সেগুলো জানেন। আমি শুধু উপন্যাস থেকে কিছু উদ্ধৃতি দেব।
ক) কেনাবেচার বিজনেস। (পৃ ৩৩) এখন হল ব্যবসার যুগ। গোটা দুনিয়া ব্যবসায় মেতেছেন (পৃ ১৮৭) সবই আজকাল কেনাবেচা করা যায়। (পৃ ২৩২) আজকাল কেনাবেচার জগতে একবার ঢুকলে আপত্তি বলে কিছু হয় না।(পৃ ২৮৩) সমাজটাই তো এরকম হয়ে গেছে। কেনাবেচার সমাজ। (পৃ ২৯৯৯) এখন তো দাদা বাজারেরই যুগ। যেদিকে তাকাবেন সেদিকেই বাজার’। (পৃ ৪৯৯)
খ) আজকাল মানুষ যা হয়েছে, এক একটা পাপের পুঁটলি। (পৃ ৫৮) মেয়েছেলে বলে খারাপ লাগচে তো? ...কিন্তু উপায় তো কিছু নাই। (পৃ ১১৩) কাদু পুলিশকে কীভাবে হাত করে রেখেছে তুই জানিস না? (পৃ ১১৬) জাল ডাক্তারি সার্টিফিকেট (পৃ ১১২) সময় ক্ষমতা অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে জীবনের স্বাদ্গন্ধ আদর্শ বদলে যায়। (পৃ ২২৯) টাকা মেয়েমানুষ আর ক্ষমতা এই তিন জিনিসের প্রতি লোভ যত বাড়বে পুরুষ মানুষ তত বড়ো হবে। (পৃ ২৫৪) আজকাল যারা সমাজের মাথা হয় তারা অন্যের মাথা নিয়ে লোফালুফি খেলে। (পৃ ২৮৪) যে মানুষটা ভাঙা একটা স্কুল আর কতগুলো ছোটো ছেলেমেয়ে ছাড়া কোনো সাতে পাঁচে কখনও থাকে নি তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলল। (পৃ ৩৩৫) ঝিলডাঙায় আমিই (কাদু) আইন। (পৃ ৩৩৭)। হ্যাঁগো তুমি শয়তানটার কাছে যাবে না? (পৃ ৬৩৫)
গ) এখন রোজ একটা করে চ্যানেল বাড়ছে। কেউ নিচ্ছে হাসি। কারও ঝোঁক কান্নাকাটিতে।।.. কারও আবার জগাখিচূড়ি চাই। হাসি কান্না ক্রাইমের মিলিজুলি প্যাকেজ (পৃ ৬৬) ...চারপাশে যা শুরু হয়েছে তাতে নিরামিষ জিনিস বেচা খুব হাউ। বেশি নয় দাদা, অল্প সেক্স ছাড়ুন। (পৃ ৭২)চ্যানেল এতদিন নীতিকথা চেয়েছে, আমি নীতিকথা দিয়েছে। এখন বলেছে নুডিটি দাও, আনি তাই দেব। (পৃ ৭৪) দর্শকের ডিমান্ড অনুযায়ী নতুন করে কাহিনী বদলানো হচ্ছে (পৃ ১৭০) সোপ দেখে দেখে বাঙালির রুচি পালটে গেছে। (পৃ ১৭৪) এ বড়ো ডেনজারাস মার্কেট আছে।দর্শকদের বায়ার হিসেবে দেখতে হবে (পৃ ২৭৭) এই জিনিসটা (রিয়ালিটি শো) আজকাল পাবলিক জামড়ে পড়ে খাচ্ছে। (পৃ ২৭৮) শুধু তো টেনশন নয়, তোমরা তো আবার একটু ইয়ে চাও। শুধু তোমরা কেন, কমবেশি সব চ্যানেলেই চাইছে, (পৃ ২৮১) আজকাল টিভিতে জোকস খুব চলছে। (পৃ ৩৩১) টিভি মানেই তো এখন সব গাঁজাখুরি কান্ড’। (পৃ ৪৭৯)
ঘ) আজকাল পার্ট পলিটিক্সে নেতাদের জেলে মিটিঙের খুব বাড়বাড়ন্ত চলছে (পৃ ১০১)। সব মিলিয়ে ওপরে নীচে দেওয়া- থোওয়ার পরও হাতে অনেকটা থেকে যায়। পার্টিরও তো টাকা লাগে। (পৃ ১০৪) ব্রিজগুলোর হাল তো তাকিয়ে দেখা যায় না। গোরুর গাড়ি উঠলেই নড়বড় করে। (পৃ ১০৬) ঝিলডাঙায় বিদ্যুৎ নেই। বিদ্যুতের খুঁটি আছে (পৃ ১১৭) মিড ডে মিলের খিচূড়ি খেয়ে অসুস্থ হওয়ার পরপরই গোটা ব্লকেই এই প্রকল্প আপাতত বন্ধ। (পৃ ১৬২) না ঘোরালে নেতা হওয়া যায় না। যত খুশি পার্টিবাজি কর বাপু চিত্তশুদ্ধিতে কোনো পার্টিবাজি চলবে (পৃ ১৮৩) না। (পৃ ১৮৫) পার্টির লোকেরা যায় না। তাহলে যায় কে? (পৃ ১৮৮) পার্টির কৌশল (২২৮ পৃ) দলের ভেতরের এত ঝটঝামেলায় নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছেন না। (পৃ ২৩৩) ডাইরেক্ট নেতা হল ভোটে দাঁড়ানো নেতা, (পৃ ২৪৯) জিতে গেছে ব্যস, কে মরতে এই অগা পচা জায়গায় আসবে? (পৃ ২৫০) পার্টি পলিটিক্সের এই লোকগুলো শুশু মেয়েছেলের টোপে বড়শি গেলে না, সঙ্গে টাকা পয়সার মধু মেশাতে হয়। (পৃ ২৮৮) একটা দিন ছিল যখন সভার গান শুনে দল চেনা যেত। (পৃ ৩৬৬) এইসব লোকের রাজনীতিতে ঢুকতে অসুবিধে হয় না। (পৃ ৪৬৩)।
এছাড়া এডুকেশন সিস্টেম নিয়ে কটাক্ষ (পৃ ৪০৮) সংসারে বোকা লোকের কদর (পৃ ৩৯৮) বেঁচে থাকার মানে জট পাকিয়ে যাওয়া (পৃ ২৬০) প্রাইভেসিতে অনাস্থা(পৃ ৪৭৩) কোলাবরেশমের প্রোডাকশন (পৃ ৫৫৯) গোটা জীবন ঠকতে ঠকতে শেখা (পৃ ৬৪৭) আরো কত কি আছে। এসবই তো আজকের, হাল আমলেরত, আমাদের পশ্চিমবঙ্গের issues of the day। মজা মস্করা মিঠে কড়া বাস্তবের বুনোটে ঔপ্যনাসিক গত কয়েক দশকের (অতি সাম্প্রতিক বাদে) বাস্তবকে হাজির করেছেন। তার থেকে পরিত্রাণ কিভাবে? হয়তো পরিত্রাণ নেই, তাই অলৌকিকতার আশ্রয়। পার্টি সঙ্ঘ সততা সঙ্ঘবদ্ধতা নির্ভরযোগ্য আর কিছু নেই। অদ্ভুত আঁধার এই বঙ্গদেশ। আমার শুধু বলার কথা এই লেখক আবেগবশত: উপন্যাসের বিষয়কে গুরুগম্ভীর, মুষ্টিমেয় আস্বাদ্য করে তোলেন নি। এ উপন্যাস একই সঙ্গে বিষয়গুণে চিন্তাউদ্রেককারী, রচনাগুণে উপভোগ্য। এই কৃতিত্ব অর্জন করা শক্ত, যা লেখক অর্জন করেছেন বলেই মনে হয়।