ব্ল্যাক আইস; মাহমুদুল হক; ইংরেজি অনুবাদ— মাহমুদ রহমান; প্রথম প্রকাশ: ২০১২; হার্পার- পেরেনিয়াল, নিউ দিল্লী; প্রচ্ছদ- শুকা জৈন; পৃষ্ঠাঃ ৮+১২৩+১৬; ISBN:` 978-93-5029-217-4
|| ১ ||
মাহমুদুল হক (১৯৪১-২০০৮) একজন সাহসী, শক্তিশালী লেখক — এই কথাটি আমি বুঝতে পেরেছিলাম তাঁর লেখা কোনো গল্প উপন্যাস পড়ার আগেই। তার কারণ মূলত: দুটি: প্রথম — মৃত্যুর কয়েক বছর আগে তিনি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তাঁর মনের ইচ্ছে ছিল মাকে নিয়ে একটি উপন্যাস লেখার; এই বিষয়ে সব লেখাই তিনি খুঁজে নিয়ে পড়েছেন এবং তাদের মধ্যে সবার ওপরে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের “জননী”; লেখক নিজে তাঁর মাকে নিয়ে একটি উপন্যাস লেখার সুযোগ পান নি, কিন্তু তাঁর মনে হয় যে লিখতে পারলে সেটি প্রসাদ্গুণে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কেও ছাড়িয়ে যেতে পারতো। এমন কথা বলতে বুকের পাটা লাগে। দ্বিতীয় — জীবনের শেষ যোলো বছর তিনি একটি লাইনও লেখেন নি। তিনি বিশ্বাস করতেন যে লেখক বা শিল্পীর সৃজনশীলতা তাঁর যৌবনের শক্তির সঙ্গে জড়িত; কমবয়েসে মানুষের মনে যে কৌতূহল বা স্বত:স্ফূর্ততা বাসা বাঁধে, যার ফলে সাহিত্য প্রবাহিত হয় স্রোতের মতন। তিনি তাঁর অন্তিম গল্পটি লেখেন ১৯৯০ দশকের সূচনায়। জনপ্রিয় লেখকের পক্ষে লেখা ছেড়ে দেওয়া এক নির্লোভ, নি:স্বার্থ সাহসের পরিচয়। প্রকৃত শিল্পীদের লোভ করা সাজে না।
আমাদের আলোচ্য গ্রন্থটি একটি সত্যিকারের আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা — গ্রন্থের লেখক বাংলাদেশি; ইংরেজি অনুবাদক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী বাঙালি; প্রকাশক আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং তাঁদের অংশীদার ভারতবর্ষের এক প্রধান সাময়িকপত্র। এমন সহযোগিতার দৃষ্টান্ত বিরল — যতদূর জানি মাহমুদুল হকের রচিত কোনো মূল বাংলা গ্রন্থ এখনও ভারতীয় সংস্করণে প্রকাশিত হয় নি।
|| ২ ||
মাহমুদ রহমানের জন্ম ঢাকা শহরে ১৯৫৩ সালে, দেশটির নাম তখন পূর্ব পাকিস্তান; বারো বছর বয়েসে একটি পুরানো টাইপরাইটারে তাঁর সাহিত্য রচনার সূচনা। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁকে শরণার্থী হয়ে চলে আসতে হয় কলকাতায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে তিনি হাই স্কুলের পড়া শেষ না করেই আমেরিকায় আসেন। সেখানে ব্র্যন্ডেইস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর বি. এ. ডিগ্রি; পরে ২০০৪ সালে মিলস কলেজ থেকে সৃজনশীল সাহিত্যে এম এফ এ ডিগ্রি লাভ করেছেন। তিনি বাস করেছেন বস্টন, ডিট্রয়েট, প্রভিডেন্স এবং ওকল্যান্ড শহরে; চাকরিও করেছেন বিভিন্ন রকমের — কারখানার শ্রমিক, সমাজ-উন্নয়ন সংগঠক, ডেটাএনট্রি অপারেটর, ডেটা বেস অ্যাডমিনিস্ট্রেটার এবং অন্যান্য। ১৯৯০-এর দশাব্দ থেকে লিখছেন নিয়মিত, মূলত: কথাসাহিত্য এবং ইংরেজিতে। বাংলায় তিনি কিছু লেখেন নি। বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগও বোধহয় শিথিল হয়ে এসেছিল।
২০০৬ সাল নাগাদ তিনি সিদ্ধান্ত করেন বাংলাদেশের পটভূমিতে একটি উপন্যাস লিখবেন এবং তার জন্যে তথ্যসন্ধানে তিনি স্বদেশে আসেন দীর্ঘ সফরে, বাসা নেন ঢাকায় এবং পড়তে শুরু করেন বাংলাদেশি কথাসাহিত্য। অভিবাসী মানুষকে জীবনের কোনো এক সময় ফিরে আসতেই হয় তাঁর শিকড়ের সন্ধানে। তাঁর নিজস্ব স্মৃতির সঙ্গে বাঙালি লেখকদের সমবেত স্মৃতিকে মিলিয়ে নেবার এই প্রচেষ্টা।
এই সময় তাঁর চোখে পড়লো একটি ক্ষুদ্রপত্রে এক অপরূপ সাক্ষাৎকার — আমেদ মুস্তাফা কামাল সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাহমুদুল হক নামে এক প্রতিষ্ঠিত কথাসাহিত্যিকের। তিনি এই লেখকের নাম আগে থেকে শোনেন নি কিন্তু সাক্ষাৎকারটি পড়ার পরে ঘনীভূত হ’ল তাঁর আগ্রহ- — তিনি জানলেন যে জনাব হক ১৯৫০ দশাব্দের শেষদিকে লিখতে শুরু করেন, প্রচুর ছোটগল্প এবং বেশ কয়েকটি উপন্যাস লিখেছেন পরবর্তী দু দশকে, কিন্তু ১৯৮১ সাল নাগাদ প্রায় সম্পূর্ণভাবেই সরে এসেছেন সাহিত্যের জগত থেকে।
তিনি উৎসাহ নিয়ে হক সাহেবের বইপত্র সংগ্রহের কাজে লাগলেন। ঢাকার নিউ মার্কেটে বিশেষ কিছু পাওয়া গেল না, কিন্তু ডিসেম্বর মাসে শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজিত ঢাকা বইমেলায় তাঁর ভাগ্যে ফিরল — সাহিত্য প্রকাশের স্টল থেকে তিনি মাহমুদুল হকের কয়েকটি বই কিনলেন এবং বাড়ি ফিরেই পড়তে শুরু করলেন “নিরাপদ তন্দ্রা” উপন্যাসটি। আজিজ মার্কেটে গিয়ে খোঁজাখুঁজি করে পাওয়া গেল “মাটির জাহাজ” এবং “কালো বরফ” উপন্যাস দুটি এবং “প্রতিদিন একটি রুমাল” গল্পগ্রন্থ। একদম নতুন ধরনের সাহিত্যসৃষ্টি দেখে তিনি মনস্থির করলেন এই গ্রন্থকারকে ছড়িয়ে দিতে হবে বাংলা ভাষাভাষী জগতের বাইরেও; তিনি নিজের উপন্যাসের কাজের পাশাপাশি ইংরেজি অনুবাদ করবেন মাহমুদুল হকের সাহিত্যের।
প্রথমে তিনি করলেন “ছেঁড়া তার” গল্পের ইংরেজি অনুবাদ — প্রকাশিত হ’ল “দ্য ডেইলি স্টার” সাময়িকপত্রে — পাঠকের প্রতিক্রিয়াও অনুকূল। দ্বিতীয় গল্প নির্বাচন করলেন “প্রতিদিন একটি রুমাল” গল্প-সংকলনের নাম গল্প। বাঙালি অনুবাদকেরা সাধারণত অনুবাদের আগে লেখকের অনুমতি নেবার তোয়াক্কা করেন না, কিন্তু রহমান স্থির করলেন দ্বিতীয় গল্পের অনুবাদ হবে লেখকের অনুমতিসাপেক্ষে। খোঁজ খবর করে তিনি সংগ্রহ করলেন হক সাহেবের ফোন নম্বর। লেখক ফোনে সব কথা শুনলেন ভাবী অনুবাদকের, প্রশ্ন করলেন অল্পই এবং তাঁকে ডাকলেন বাড়িতে। রহমান গিয়ে হাজির হলেন মাহমুদুল হকের জিগাতলার ফ্ল্যাটে — ঘরটি চেয়ার, টেবিল আর বুককেসে ভরা কিন্তু রাশি রাশি বই আর পত্রপত্রিকা দেখে মনে হয় সেগুলিতে হাত পড়েনি বহুদিন। জ্যেষ্ঠ লেখক আর কণিষ্ঠ অনুবাদকের সেই প্রথম দেখা এবং এক ঘনিষ্ঠ ও ফলপ্রসূ সম্পর্কের সূচনা। লেখক সানন্দে অনুমতি দিলেন এবং বাড়ি ফিরেই রহমান গল্পটি পাঠিয়ে দিলেন দ্য ডেইলি স্টারের দপ্তরে — গল্পটি প্রকাশিত হ’ল কাগজের ঈদ বিশেষ সংখ্যায়। লেখক কাগজের কপি পেয়ে শিশুর মতন খুশি।
রহমান চালিয়ে যেতে চান আরও অনুবাদের কাজ — লেখক নিমরাজী, কী হবে ওসব করে, তিনি লেখা ছেড়ে দিয়েছেন, পাঠকেরাও ভুলে গিয়েছে তাঁকে। হাল ধরলেন লেখকজায়া কাজল (হোসনে আরা মাহমুদ) — তিনি চান যে পৃথিবীর মানুষ তাঁর স্বামীর সাহিত্যের পরিচয় জানুক। প্রতি দু সপ্তাহে একবার করতে রহমান যেতে শুরু করলেন লেখকের বাসায় — কোনো দিনই চার-পাঁচ ঘন্টার আগে তাঁদের আড্ডা থামতো না। আগন্তুক চেয়েছিলেন অনুবাদের কাজে সমর্থন ও সহযোগিতা, তার সঙ্গে পেলেন বন্ধুত্ব এবং আজীবন মনে রাখার মতো স্মৃতি।
কিন্তু আনন্দের সঙ্গে সঙ্গেই লেগে থাকে বিষাদ; লেখকের সঙ্গে পরিচয়ের মাত্র ছ’মাস পরেই লেখকজায়া হোসনে আরার মৃত্যু; শোকাতুর লেখক বাসা পালটে চলে গেলেন লালবাগে। কিন্তু অনুবাদকের যাওয়া আসা থামলো না — কালোবরফের ইংরেজি ভাষান্তরের সময় তাঁর মনে নানান প্রশ্ন জাগলো শব্দ, ছবি, অনুষঙ্গ নিয়ে — কখনও স্থানীয় ভাষা আবার কখনও ভঙ্গির রহস্যজাল। লেখকের সঙ্গে আলোচনায় পরিষ্কার হতে থাকলো কাহিনির পটভূমি। ২১ জুলাই ২০০৮ শেষ হ’ল অনুবাদের প্রথম খসড়া; লান্চ রান্নার ফাঁকে তিনি ফোন করলেন লেখকের ফ্ল্যাটে — পুরো অনুবাদটি নিয়ে দেখাতে আসবেন তাঁকে। ফোনে এক অচেনা কন্ঠস্বর — লেখকের মৃত্যু হয়েছে আগের দিন রাতে।
দু:খ বিষাদের মাঝখানেও অনুবাদ পরিমার্জনার কাজ চালিয়ে গেলেন মাহমুদ রহমান। সানন্দে সহযোগিতা জানালেন টরন্টোনিবাসী লেখক কন্যা তাহমিনা মাহমুদ এবং লস এঞ্জেলিস থেকে লেখকপুত্র শিমুয়েল হক শিরাজি। ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে বইটির প্রকাশ নিউদিল্লি থেকে।
|| ৩ ||
মাহমুদুল হকের ডাকনাম বটু, কনিষ্ঠদের কাছে বটুভাই — তাঁর শৈশব কেটেছে অবিভক্ত বাংলার বারাসতে। দেশভাগের তিন বছর পরে পরিবারটি দেশ ছেড়ে আসেন ঢাকায় এবং বাসা নেন নতুন গড়ে ওঠা আজিমপুর কলোনীতে। দশ বছর বয়েসি বটু ভর্তি হলেন ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুলে এবং কয়েক দিনের মধ্যেই জিন্না টুপি মাথায় না দিয়ে স্কুলে আসার অপরাধে মার খেলেন শিক্ষকের হাতে। ফলে প্রথম অভিজ্ঞতা একেবারেই সুখের নয়। তাঁর মাও বারাসতের ধর্মীয় উদারতার পরিবেশ থেকে ঢাকার পর্দানশীন, ধর্মভীরু, বাধানিষেধময় জীবনে এসে হাঁফিয়ে উঠেছিলেন।
খুব কম বয়েসেই তিনি গল্প লিখতে শুরু করেন। ১৯৫০ দশাব্দের শেষদিকে যখন তিনি জগন্নাথ কলেজের ছাত্র, একদিন খবর পেলেন মীজানুর রহমান নতুন একটি মাসিকপত্র প্রকাশ করবেন, কলকাতার “উল্টোরথ” পত্রিকার ধাঁচে। হক সাহেব “দ্রৌপদীর আকাশে পাখি” নামে একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখতে শুরু করলেন সেই কাগজে, তবে প্রকাশিত হ’ল মাত্র তিন কিস্তি। তারপর হারিয়ে গেল বিস্মৃতির অন্তরালে।
কলেজের পাঠ শেষ করে তিনি পারিবারিক গহনার দোকানের পরিচালনার কাজ নিলেন — সেই অভিজ্ঞতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জহুরী হিসেবেও তিনি নাম কিনবেন। তবে দোকানে খদ্দের কম থাকলে তিনি কাউন্টারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই লেখার কাজ চালাতেন। ১৯৬৭ সালে কাজলের সঙ্গে তাঁর বিবাহ এবং নবদম্পতি নতুন বাসস্থান শামীবাগ মহল্লায়। মহরম পরবের সময় কাজল গেলেন পিত্রালয়ে এবং তিনি লিখতে শুরু করলেন তাঁর প্রথম উপন্যাস “অনুর পাঠশালা”, বাইরে খোলা চত্বরে বাচ্চাদের মার্বেল খেলার শব্দ শুনতে শুনতে; দ্য ন্যু ইয়র্কার পত্রিকায় সদ্য পড়া অতীতের পুনরাবৃত্তি (Deja Vu) বিষয়ে একটি প্রবন্ধও তাঁর মনের মধ্যে ছিল। সারা রাত ধরে তিনি লিখে চললেন মধ্যবিত্ত পরিবারের এক অসুখী বালকের কাহিনি; তার মা-বাবার অসুখী দাম্পত্য, তার চোখে দেখা রাস্তাঘাট ও বাইরের জগত এবং সরুদাসী নামের এক চমকপদ বালিকা। উপন্যাসটির প্রকাশ “সমীপেষু” পত্রিকায় ১৯৭০ সালে। গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশের সময়ে নাম ছিল “যেখানে খঞ্জনা পাখি”; সাহিত্য প্রকাশ প্রকাশিত দ্বিতীয় সংস্করণে নাম হয় “অনুর পাঠশালা”।
তিনি লেখক বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন বাংলা বাজারের বিউটি বোর্ডিঙে; আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন কবি শহীদ কাদরী; পরে আড্ডাটি সরে যায় গুলিস্তান মহল্লায়। একটি ঘটনার কথা লেখক বর্ণনা করেছেন মাহমুদ রহমানের কাছে — “ডিটেকটিভ” পত্রিকায় সাম্প্রতিক সংখ্যায় তাঁর গল্প বেরিয়েছে, সঙ্গে শহীদ কাদরী এবং আল মাহমুদের কবিতা; আড্ডায় সকলেই কবিতা দুটি নিয়ে আলোচনা ও মন্তব্য চালিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু তাঁর গল্প নিয়ে নয়। আড্ডা ছেড়ে বেরিয়ে বাইরের কামানের দিকে হাঁটতে হাঁটতে তিনি কাদরীকে প্রশ্ন করলেন, আমার গল্প নিয়ে কিছু বললে না যে? উত্তরে কাদরী হাত-পা নেড়ে বললেন “এতো উপমা কেন?” তারপর আরও নাটকীয় ভঙ্গিতে, “ল্যাংটা করে দে! ল্যাংটা করে দে!” রবীন্দ্রনাথের “আমার এ গান ছেড়েছে তার সকল অলংকার”-এর শহীদ কাদরী সংস্করণ!
হক সাহেব কিন্তু রাগ করলেন না বন্ধুর মন্তব্যে — বাড়ি গিয়ে গল্পটি আবার পড়লেন এবং বন্ধুর সঙ্গে একমত হলেন; তাঁর গদ্য হতে থাকলো নির্ভার এবং অলংকার-বিরল, তাঁর রচনাগুলি সংক্ষিপ্ত থেকে সংক্ষিপ্ততর। তাঁর বেশির ভাগ রচনাই এক থেকে দু হপ্তা সময়ের মধ্যে লেখা। “জীবন আমার বোন” খুব সম্ভবত: তাঁর দীর্ঘতম উপন্যাস (প্রকাশ ১৯৭৬) আকারে দুশো পাতার কাছাকাছি; লিখতে লেগেছিল তিন মাস। তাঁর জটিলতম উপন্যাসটির সময়কাল ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। বরিস পাস্তেরনাক (১৮৯০-১৯৬০)-এর একটি বিখ্যাত কবিতা “Sister, My Life” এই উপন্যাসের অনুপ্রেরণা —
“হে ভগিনী, জীবন উপচে পড়ে আজ,(আমার অক্ষম অনুবাদে তার প্রথম কয়েক পঙ্ক্তি)
কাচের মতন ভাঙে বসন্তের মৃদু বরিষণ,
চোখে ঠুলি জনতার অন্তহীন ব্যর্থ অভিযোগ,
বিনয়ী, ছোবল মারে বিষাক্ত সাপ যেন ঘাসে।"
দুই লেখকের আরেকটি মিলও চোখে পড়ার মতো। পাস্তেরনাক ছিলেন রাশিয়ার নভেম্বর বিপ্লবের বিষয়ে নিস্পৃহ; হক সাহেবের বিষয়েও অভিযোগ — ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উৎসাহ ও উচ্ছ্বাসের অভাব তার রচনায়। উপন্যাসটিতে তিনি বর্জন করেন রোমান্টিক আবেগ, তাঁর ভাষাতেও আসে এক অজ্ঞাতপূর্ব নূতনত্ব।
১৯৭০ দশাব্দের মাঝামাঝি তাঁর উপন্যাসের পটভূমি পালটে যায় — ঢাকা মহানগরের পরিবর্তে মফস্বল এবং পল্লীগ্রাম। তাঁর এক বন্ধু ছিলেন ইছাপুরা কলেজের অধ্যক্ষ — সময় পেলেই তিনি চলে যেতেন বিক্রমপুরে, বন্ধুর বাড়িতে — বর্ষাকালে সেখানে ভীষণ বন্যা — এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে যেতে হয় নৌকা চড়ে। বিক্রমপুরের প্রকৃতিও তাঁর পরবর্তীকালের উপন্যাসের চরিত্র হয়ে ওঠে — “কালোবরফ (১৯৭৭), “মাটির জাহাজ” (১৯৭৭) এবং “খেলাঘর” (১৯৭৮)। ১৯৮১ সালে তিনি লেখেন তাঁর শেষতম উপন্যাস “পাতালপুরী” — তাঁর বয়েস তখন মাত্র চল্লিশ। এর পরে লিখেছেন কয়েকটি গল্প — বন্ধু কায়সুল হকের অনুরোধে লেখা অন্তিম গল্প ‘বনফুল’। তাঁর নিজের কথায়। “Writing it was sheer agony!”
|| ৪ ||
মাহমুদুল হক “কালো বরফ” উপন্যাসটি লিখেছিলেন ১৯৭৭ সালের আগস্ট মাসে — মাত্র দশ দিন লেগেছিল উপন্যাসটি লিখতে। লেখার অল্প কিছুদিন পরেই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় একটি জনপ্রিয় পত্রিকার ঈদ বিশেষ সংখ্যায় — কিন্তু বই হিসেবে প্রকাশিত হতে লেগে যায় আরো পনেরো বছর; জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনীর মফিদুল হক গ্রন্থটির প্রকাশ করেন ১৯৯২ সালে।
উপন্যাসের বিষয় দেশভাগ এবং একজন মানুষের ওপরে তার অভিঘাত। ১৯৭১-এর ঘটনাবলী নিয়ে সঙ্গত কারণেই প্রচুর কালি খরচ হয়েছে, কিন্তু ১৯৪৭ নিয়ে তার তুলনায় কম। মাহমুদ রহমানের জন্ম দেশভাগের কয়েক বছর পরে এবং তার বিশেষ কোনো বিষাদময় প্রতিক্রিয়া তাঁদের পরিবারের ভাগ্যে পড়েনি। বাংলা সাহিত্যে এমন অনেক লেখক আছেন যাঁদের অভিজ্ঞতা পূর্ব বাংলা ছেড়ে পশ্চিমবাংলায় আসার। উল্টোমুখে যাত্রার নজির সেই তুলনায় কম। “কালো বরফ” রহমানকে মুগ্ধ ও প্রভাবিত করেছিল তার প্রধান কারণ তার বিষয়বস্তু — দেশভাগের ফলে এক বালকের পশ্চিম থেকে পূর্বে যাত্রা এবং বাকী জীবনে তার তীব্র প্রতিক্রিয়া। উপন্যাসের ঘন বাঁধুনিও তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। দুটি পরিবর্ত কন্ঠে উপন্যাসটির কথন — একটি উত্তম পুরুষে বর্ণিত বারাসতে শৈশবের ঘটনা, আবেগময়, নিবিড় ও অন্তরঙ্গ; দ্বিতীয়টি প্রথম পুরুষে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে বর্ণনা — প্রধান চরিত্র আবদুল খালেকের দৈনন্দিন জীবন; তার ক্রমবর্ধমান মানসিক বিচ্ছিন্নতা, তার বিবাহিত জীবনের ঘনীভূত পীড়ন।
আবদুল খালেক মফস্বলের একটি ভাঙাচোরা কলেজের অধ্যাপক। দেশভাগ তাঁর জীবনের এক দু:স্বপ্ন। এক বন্ধুর পরামর্শ মতন তিনি লিপিবদ্ধ করতে শুরু করেন তাঁর শৈশবস্মৃতি — তাঁর ডাকনাম পোকা, বাস করতেন কলকাতার শহরতলীতে। অবিভক্ত বাংলার পরিবেশ, তার সবুজ ক্ষেত, পুকুর, গ্রাম, পরিবার, প্রতিবেশী, নানান ধরনের ফেরিওয়ালা, সাধু, ভিখারী — রাস্তায় ঘাটে নানা উত্তেজনাময় ঘটনা — বালকের চোখ দিয়ে তাদের দেখা।
খালেকের বিবি রেখা তার এই উচ্চাকাঙ্খাহীন জীবনে বিতৃষ্ণ; সবসময় অভিযোগ করে যান তাঁর নিষ্ক্রিয়, নিরুদ্যম স্বভাব নিয়ে; এবং বোঝার ওপরে শাকের আঁটি তাঁর এই নতুন দিনলিপি লেখার অভ্যেস রাত জেগে। বাড়তে থাকে দুজনের মধ্যে ব্যবধান; স্মৃতির গহনে তলিয়ে যেতে থাকেন খালেক — যে বালিকা তার প্রথম প্রেম, যে বালিকা কথা বলে মাছ ও পাখিদের সঙ্গে (পুঁটি); মায়ের কথা; মণি ভাইজানের কথা। যদিও বিভিন্ন সম্প্রদায় শান্তিতে বাস করে সেই গ্রামে, সাম্প্রদায়িক টানাপোড়েন ঘটতে থাকে অবিভক্ত বাংলার পটভূমিতে।
প্রিয় বন্ধু, গ্রামের ডাক্তার নরহরির উৎসাহে ও পরামর্শে নৌকাবিহারে যান খালেক ও রেখা, সঙ্গে মাঝি মরণ ঢালি — সেখানে তাঁরা খুঁজে পান একে অন্যকে। “আলো ছায়ার যুগলবন্দী” (“Light and shadow play a duet”) নামক এই অংশে কাহিনির নাটকীয় পরিসমাপ্তি। লেখকের সাবলীল ও রসময় ভাষায় স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্বমধুর সম্পর্কটি কমনীয় ও চিত্তাকর্ষক। পদ্মানদীর তীরের বন্দর-শহর লৌহজং এ পৌঁছে খালেকের মনে পড়ে পুরানো দিনের কথা — ওপার বাংলা থেকে চিরকালের মতন বিদায় নেবার কথা।
মাহমুদ রহমানের অনুবাদে বাংলা গদ্যের সৌন্দর্যের খানিকটা রেশ থেকে গেলেও ইংরেজি গদ্য হিসেবেও তাকে পাঠ করতে অসুবিধে হয় না। যাঁরা বাংলা জানেন না, তাঁদের জন্যে রয়েছে বেশ কিছু পাদটীকা। হক সাহেব লিখেছেন, “একটা ধেড়ে কোলাব্যাঙ তিন লাফে অদৃশ্য হয় আর মাটির হুঁকোবুড়োর মতো মাথা নাড়তে থাকে কালকচুর পাতা। ব্যাঙটা একটা বেহায়া জোকার, রেখা ভাবলো, লাফ মারারও ভেতরও পষ্ট ইয়ার্কি, হাত-পা ছুঁড়ে কেমন যেন তে-ফেরঙা হয়ে লাফাচ্ছিল, ব্যাটার খুব চর্বি হয়েছে, খুব আনন্দে আছে” -
মাহমুদ রহমানের অনুবাদে — “A big frog disappears in three leaps. The leaves of the giant taro nod like the head of a clay huko-buro doll. The frog is a shameless joker, Rekha thinks, there is sport even in its leaps, the fellow has put on a lot of fat, it lives in such joy.”
ব্যাটা= Fellow নিয়ে হয়ত মৃদু আপত্তি তোলা যায়, কিন্তু সব মিলিয়ে মাহমুদ রহমানের ইংরেজি অনুবাদ মূল বাংলার ব্যঞ্জনা ও ভারসাম্য অনেকটাই বজায় রাখতে পেরেছে। কালো বরফের পরেও তিনি মাহমুদুল হকের রচিত সাহিত্যের অনুবাদ চালিয়ে যাচ্ছেন, এটাই আনন্দের কথা।
|| ৫ ||
অনুবাদগ্রন্থটির পরিকল্পনায় চমৎকার মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন লেখক এবং প্রকাশক। যাঁরা গ্রন্থটি আগে বাংলায় পড়েন নি তাঁদের কাছে এই লেখক সম্পূর্ণ অপরিচিত, যেমন আমি নিজে। তাঁদের জন্যে গ্রন্থের পুনশ্চ (P.S.) অংশে রয়েছে দুটি মূল্যবান সংযোজন, একটি হল লেখকের সম্পর্কে অনুবাদকের অনুভূতিনিবিড় স্মৃতিচারণ এবং অন্যটি লেখকের সাক্ষাৎকার — পূর্বে উল্লিখিত আহমদ মুস্তাফা কামালের নেওয়া সাক্ষাৎকারটির সংক্ষেপিত ইংরেজি অনুবাদ করেছেন মাহমুদ রহমান। ফলে লেখকের জীবন ও সাহিত্যকীর্তির, তাঁর চিন্তাভাবনা ও মানসিক টানাপোড়েনের একটা আবছা হলেও রূপরেখা পেয়ে যাবেন অবাঙালি পাঠক।
সাক্ষাৎকার থেকে জানতে পারা যায় যে “কালো বরফ” লেখকের নিজস্ব রচনার মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় উপন্যাস — “I had found a certain delight in writting it. I felt that I had managed to write a novel without excess, devoid of fat, one that flowed smoothly. I consider this novel to be very compact. And it’s good for stories and novels to be compact.” মেদহীন, ঝরঝরে, নির্ভার, কৃশকায় উপন্যাসটি শেষ করে পাঠকের মনে যা যা প্রশ্ন জাগবে তার কিছু কিছু উত্তর মিলতে পারে এই দুই স্মৃতিচারণ ও সাক্ষাৎকারে। ভাষা ও শৈলীর বিষয়ে তাঁর ঘরোয়া মন্তব্যের মাধ্যমেও নিজের লেখক সত্তাকে উন্মোচিত করেছেন মাহমুদুল হক- — “I always strove to surpass myself. I felt that the style of expression in any two consecutive pieces should not be the same. That’s why I tried to write each work in different kind of prose.” বার বার নিজেকে পালটানো, নিজস্ব স্বাচ্ছন্দ্যের এলাকা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে নতুন কিছু করা সাহসী ও শ্রমসাধ্য কাজ — তাঁর মতে নিরীক্ষামূলক কর্মের শক্তি মানুষ অর্জন করতে পারে নবীন বয়েসেই। তাই বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে নিজের পূর্ব রচনার পুনরাবৃত্তি না করে সৎ লেখকের উচিত কলম সরিয়ে রাখা। “Perhaps one reason for why I have not been writting for a long time now is that in my last pieces, I found myself suffering from a certain monotony. I was not able to find a new language or new forms of expression.” বাংলাদেশের সাহিত্যের ভুবনে তাঁর অভিজ্ঞতা সব সময় সুখের ছিল না, কিন্তু তিনি সেই বিষয়ে মন খুলে কিছু বলেন নি, অল্প কথায় সেরে ফেলেছেন, “I was so deeply involved in this world that I became intimate with the private lives of many writers. I came to see how dishonest, hypocritical and wicked they could be as people.” মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন! কেবল একটি সংহত বাক্যে তাঁর জীবন দর্শনের অমোঘ উচ্চারণ — “লেখকের মনে লোভ থাকা ভালো নয়”।
শুকা জৈনের গাঢ় রঙের প্রচ্ছদে উপন্যাসের মূল চরিত্রের মানসিক টানাপোড়েনের প্রতিবিম্ব — কুয়াশার মধ্যে পথ হাঁটা বালকটির মতন আমরা পাঠকরাও ঢুকে পড়তে পারি মাহমুদুল হকের মনোজগতে।
তথ্যসূত্র :
From Kalo Borof to Black Ice : A translator’s journey — by Mahmud Rahman; The Daily star, Eid special, 2012