ডিউটি সেরে খুব ভোরে বাড়ি ফিরছিল নিতাই। ফ্যাক্টরিতে কাজ করে ফিরতে ফিরতে প্রায় রোজই এই রকম হয়। হাড়ভাঙা খাটুনির পর বাড়ি ফিরে দুটি খেয়ে তারপর ঘুমোতে পারবে সে। ঘুম থেকে উঠে আবার বাজার, রান্না তারপর আবার কাজ। রোজকার এই একঘেয়ে দৈনন্দিন জীবন। কোন পরিবর্তন হয় না তাতে। আগে যখন মা বেঁচে ছিলেন তখন রান্নাটা তিনিই করে দিতেন, কিছুকাল হল মা গত হয়েছেন তাই এখন নিতাই একদম একা। নিজেই সব কিছু করে। ওকে সব সময় নাইট ডিউটি দিয়ে দেওয়া হয়, তাও কিছুই বলে না সে। কোন প্রতিবাদ করে না। মাঝে মাঝে মনে হয় এই রকম জীবনের কোন মানে নেই। অন্য কিছু একটা করা দরকার কিন্তু অন্যরকম কিছুই আর করা হয়ে ওঠে না। ছোটবেলায় কত স্বপ্ন দেখত নিতাই, তার ইচ্ছে ছিল সে খুব বড় একজন জাদুকর হবে। বিশাল বিশাল পোস্টারে ঝলমল করবে তার নাম – জাদুকর নিতাই সামন্ত! সেই মতন চেষ্টা করে শিখেও ছিল অনেক রকম জাদু কিন্তু জাদুকর আর তার হওয়া হয়ে ওঠেনি। বাবার অসুখ, মার অসহায় চাহনি আর সহ্য করতে না পেরে ফ্যাকটরির চাকরিটা নিয়ে নেয় নিতাই। তাতে অবশ্য খারাপ কিছু হয়নি। বাবার ওষুধের টাকা আর সংসার চালানোর মতন খরচ উপার্জন হয়ে গেছে। শুধু মনের ইচ্ছেটার অকালমৃত্যু ঘটেছে। তবে ওসব নিয়ে আর ভাবে না নিতাই – যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। এরই নাম জীবন। জীবনের স্রোতকে তো আর আটকান যায় না! এই সব ভাবতে ভাবতে মাঝে মাঝেই দুঃস্বপ্ন দেখে সে, আর ঘুমোতে পারে না।
বাড়ির পথেই যাচ্ছিল নিতাই। শীতের সকাল তাই এত ভোরে রাস্তায় লোকজন, যানবাহন কিছুই নেই। হঠাৎ ওর চোখ পড়ল বড়ো বাড়িটার দিকে। কাজে যাওয়া আর বাড়ি ফেরার পথে রোজই দেখে বাড়িটাকে সে। তিনতলা একটা প্রকাণ্ড বাড়ি। বড়ো বড়ো সাদা সাদা থাম আর প্রচুর কারুকাজ করা বিশাল কাঠের দরজা। বাগানে চারিদিকে শ্বেত পাথরের মূর্তি, ফুলদানির ছড়াছড়ি। স্থানীয় কোন এক বিশাল বড়লোকের বাড়ি। নিতাইয়ের এ-সবে আগ্রহ নেই তাই কার বাড়ি, কে থাকে সেইসব জানার কোনদিন চেষ্টাও করেনি সে। কিন্তু আজ হঠাৎ সামনের বাগানটায় একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখতে পেল। মেয়েটার বয়স আট কী নয় হবে। বাগানে খাটানো দোলনায় বসে আছে সে। মেয়েটার মুখটা কেমন যেন করুণ, কান্নাভরা। ওই রকম দুঃখ তো এত ছোট বাচ্চার মনে হওয়ার কথা নয়! ফর্সা টুকটুকে মেয়েটার মাথায় লম্বা রেশমি কালো চুল, পরনে সুন্দর একটা জামা আর সোয়েটার কিন্তু তার যে মনে ভারি দুঃখ সেটা তার চোখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারা যায়। বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল নিতাই। ভাবতে চেষ্টা করল মেয়েটার দুঃখের কারণ। না জানি কোন্ কষ্টের কাহিনী লেখা রয়েছে ওর ওই করুণ মুখের পিছনে। নাকি মেয়েটাও নিতাইয়ের মতন দুঃস্বপ্ন দেখে উঠে বসেছে!
যাই হোক, মেয়েটাকে হাসাবার একটা চেষ্টা করতেই হবে নিতাইকে। কাঁধের ঝোলাটা আঁতি-পাঁতি খুঁজে দেখল নিতাই। হ্যাঁ, এই তো রয়েছে! জীবনের অনেক আঘাতের পরও সে রোজ কাঁধে করে সর্বত্র বয়ে বেড়ায় তার অল্প কয়েকটা জাদুর সরঞ্জাম।
হাতছানি দিয়ে মেয়েটাকে গেটের কাছে ডাকল সে। মেয়েটা এলো। তার তো ভয়ের কিছু নেই কারণ গেটে ঢাউস একটা তালা, তাছাড়া নিতাই ভিতরে ঢোকার চেষ্টাও করছে না মোটেই। এমনও হতে পারে মেয়েটা ওকে আগে দেখেছে।
চট করে ভগবানের উদ্দেশ্যে একটা প্রার্থনা করে নিল নিতাই। বলল, “হে ঠাকুর, আমার যা অল্প ক্ষমতা তাই দিয়ে আমি যেন এই দুঃখী মেয়েটার মুখে হাসি ফোটাতে পারি।”
বলেই সে ধাঁ করে ব্যাগ থেকে লাল, সাদা, হলুদ, নীল চারটে ছোট বল বার করে শূন্যে ছুঁড়তে লাগল। বেশ কিছুদিন প্র্যাক্টিস নেই কিন্তু নিতাইয়ের মনে হল এ খেলা যেন সাইকেল চালানোর মতন। এ খেলা সে যেন ভুলতে পারবে না! এর পরের কয়েক মিনিট নিতাইয়ের হাতের ছোঁয়ায় বলগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। মেয়েটা প্রথমে একটু ভয় পেয়েছিল হয়তো কিন্তু খেলা দেখেই ওর চোখে একটা ঝিলিক দেখা দিল। বলের খেলা শেষ হতে সে নিজের থেকেই হাততালি দিয়ে উঠল। নিতাইকেও তখন নেশায় পেয়ে গেছে। এই রকম উৎসাহী একাগ্র দর্শক সে বহুকাল পায়নি। কলেজে বন্ধুদের ম্যাজিক দেখিয়ে বেশ নাম কুড়িয়েছিল সে কিন্তু তারপর তো কলেজ, বন্ধু সব কিছুই ছাড়তে হল।
তার ছোট্ট দর্শকের জন্যে এবার সে ব্যাগ থেকে বার করল রঙ-বেরঙের রিং। সেগুলোকে নিয়ে কিছুক্ষণ লোফালুফি চলল। মাঝে মাঝে তার মধ্যে থেকে একটা করে হাওয়া হয়ে যায়, আবার কখনও অন্য একটার সঙ্গে জুড়ে যায়! সে এক ভারি মজার খেলা। তখন নিতাইয়ের খুদে দর্শকের আনন্দ দেখে কে! তার দুঃখ কোথায় মিলিয়ে গেছে, হাততালি দিয়ে লাফালাফি জুড়ে দিয়েছে সে। ওর এখনকার মূর্তি দেখে কেউ বিশ্বাস করবে না যে একটু আগেই কী মন মরা হয়ে বসেছিল সে!
রিঙের খেলা শেষ হতে কান থেকে একটা এক টাকার কয়েন বার করল নিতাই। মেয়েটা চোখ গোল গোল করে দেখছে। চারিদিক থেকে তখন কয়েন বেরোচ্ছে! হাসলে মুখ থেকে, নাক ঝেড়ে নাক থেকে, কান থেকে! মেয়েটা খিলখিল করে হেসেই চলেছে! খেলা শেষ হতে কুর্নিশ করল নিতাই। মেয়েটা ওকে হাত নেড়ে হাসতে হাসতে বাড়ির ভিতর চলে গেল।
নিতাইয়ের মনে হল সে যেন একটা বিশাল কিছু করে ফেলেছে! একটা মন খারাপ করে বসে থাকা শিশুর মনে আনন্দ দিতে পেরেছে সে! সেদিন বাড়ি ফিরে খেয়ে দেয়ে আর শুতে গেল না নিতাই। ম্যাজিকের সব সরঞ্জাম নিয়ে গুছিয়ে বসল খাটে। ওর শেখা সব জাদুগুলোকে নতুন করে ঝালিয়ে নিতে লাগল। কখন যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল সে খেয়ালই করল না!
ফ্যাকটরির চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে নিতাই। এখন সে বাচ্চাদের স্কুলে, পার্টিতে বা হাসপাতালে জাদু দেখিয়ে বেড়ায়। তাতে আয় হয় অনেক কম কিন্তু মনের তৃপ্তি হয় অনেক বেশি। নিতাইয়ের তেমন চাহিদা কিছু নেই তাই তার চলে যায়। আর ছোট ছোট শিশুদের মনে আনন্দ দিয়ে প্রচণ্ড একটা শান্তি পায় সে মনে। ওর ম্যাজিক দেখে বাচ্চারা তো আহ্লাদে আটখানা হয়ই, তাদের মা বাবারাও ভীষণ খুশি হন। নিতাই জানে সে হয়তো কোনদিন বড়ো জাদুকর হয়ে উঠতে পারবে না। দেশজোড়া নাম তার কোনদিন হবে না কিন্তু তাও সে খুব খুশি। তার জীবন আর একঘেয়ে নয়। জীবনের সঠিক মানে সে খুঁজে পেয়েছে।