• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৬ | মার্চ ২০১৭ | গল্প
    Share
  • রাজকীয় হালচালের বেয়াদব শিক্ষক--কোতসুকে নো সুকে হর্হে লুইস বোর্হেস (১৮৯৯ - ১৯৮৬) : হর্হে লুইস বোর্হেস
    translated from English to Bengali by অংকুর সাহা



    ই কাহিনির শঠ প্রধান চরিত্র হলেন বেয়াদব রাজসভাসদ কিরা কোতসুকে নো সুকে, যে মানুষটির নিয়তিচালিত অস্তিত্ব ডেকে আনে আকো দুর্গের অধিপতি মহারাজের অধ:পতন ও মৃত্যু, অথচ তিনি নিজে উপযুক্ত প্রতিহিংসার দাবী অনুযায়ী, নিজের প্রাণটিকে বলি দিতে অস্বীকার করেন। তিনি এমনই মানুষ যার কাছে আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত, কারণ তিনি মানুষের মনে জাগিয়ে তোলেন অমূল্য আনুগত্য। সেই আনুগত্য ও কালজয়ী অঙ্গীকার রক্ষার জন্য তিনি এক অশুভ অথচ প্রয়োজনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর আরদ্ধ কর্মের স্মৃতিরক্ষার্থে রচিত হয়েছে শতাধিক উপন্যাস, পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রবন্ধ, ডক্টরেটের সন্দর্ভ এবং অপেরা--এছাড়া চিনেমাটি, শিরাময় নীলকান্তমণি এবং গালার বার্নিশে তৈরি অসংখ্য স্মৃতিচিহ্ন। এমনকী চলচ্চিত্রের মতন বহুমুখী প্রচারমাধ্যমও মাঠে নেমে পড়েছে তার হয়ে, কারণ “চুসিংগুরা অথবা সাতচল্লিশ জন বিশ্বস্ত অনুচরের কট্টর ইতিহাস” (হ্যাঁ, এটাই সেই ফিল্মের নাম) হল জাপানি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুপ্রেরণা। বিশদভাবে বর্ণিত গৌরবগাথাটির প্রতি নিবেদিত আন্তরিক শ্রদ্ধাঞ্জলিই প্রমাণ করে যে কাজটি যথাযোগ্য এবং যে কোন মানুষের মতে, অবশ্যই নীতিনিষ্ঠ।

    আমি এখানে এ.বি. মিটফোর্ড রচিত কাহিনিটিকেই অনসরণ করেছি--তিনি স্থানীয় লোকজনের একটান রঙচড়ানোকে বাতিল করে তাঁর দৃষ্টি সংহত করেছেন গৌরবময় মূল ঘটনার অগ্রগতির দিকে। প্রাচ্যদেশীয় দৃষ্টিভঙ্গির এই প্রশংসনীয় অনুপস্থিতি দেখে সন্দেহ হয় যে তিনি মূল জাপানি কাহিনিটিকেই সরাসরি অনুসরণ করেছেন।

    বাঁধন খোলা রিবন

    ১৭০২ সালের প্রায় ক্ষয়ে আসা বসন্তকালে, আকো দুর্গের স্বনামধন্য অধিপতি আসানো তাকুমি নো কামী, সম্রাটের এক দূতকে স্বাগত জানাতে এবং নিজ গৃহের আতিথ্য দিতে ও তাঁর চিত্তবনোদনের ব্যবস্থা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। দু হাজার তিনশো বছরের একটানা সৌজন্যপ্রকাশের (যার খানিকটা পৌরাণিক) ফলে অভ্যর্থনার সূক্ষ্ম রীতিনীতিগুলি পর্যবসিত হয়েছে বেদনাদায়ক জটিলতায়। আগত দূত যে সম্রাটের প্রতিনিধি, তা খানিকটা পরোক্ষ অথবা প্রতীকী--এবং এই ব্যঞ্জনার তারতম্যে খুব জোর দিলে অথবা তাকে অগ্রাহ্য করলে বিপদের সম্ভাবনা। যাতে সেরকম কোন মারাত্মক ভুলত্রুটি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়, সেজন্যে ইয়েডো রাজসভার একজন অমাত্য আগেভাগেই এসে হাজির যথার্থ রাজকীয় আদবকায়দার শিক্ষা দেবার জন্যে। রাজসভার আরামদায়ক পরিবেশ ছেড়ে এই পাণ্ডববর্জিত গণ্ডগ্রামে আসতে হয়েছে বলে (যেটা তাঁর কাছে ছুটি কাটানোর বদলে মনে হয়েছে নির্বাসন), কিরা কোতসুকে নো সুকে তাঁর শিক্ষাদান করেছেন অত্যন্ত রূঢ় ভাষায়। তাঁর ক্ষমতাদর্পিত কণ্ঠস্বর অনেকেরই মনে হয়েছে অপমানজনক। তাঁর শ্রোতা, এক দুর্গের অধিপতি, চেষ্টা করেছেন এই অপমানগুলিকে অগ্রাহ্য করতে, মুখের মত কোন জবাব দিতেও পারেননি এবং অতিকষ্টে নিজেকে সংযত করেছেন দু-এক ঘা বসিয়ে দেবার থেকে। কিন্তু একদিন সকালে রাজপ্রতিনিধির পায়ের একটি মোজা-বেঁধে-রাখা রিবনটি হঠাৎ খুলে যায় এবং তিনি আকো দুর্গের অধিপতিকে অনুরোধ করেন তা বেঁধে দেবার জন্যে। তিনি বিনীত অথচ ধিক্কারময় ভঙ্গিতে তা বেঁধে দেন। রাজকীয় হালচালের বেয়াদব শিক্ষক তখন তাঁকে বলেন, তিনি শোধরানোর অতীত কেবলমাত্র গ্রাম্য, অশিক্ষিত চাষার পক্ষেই এমন আনাড়ির মতন গিঁট বাঁধা সম্ভব। এই অপমানজনক কথা শুনে আকো দুর্গের অধিপতি তাঁর তরবারি বের করে চালনা করেন--বেগতিক দেখে রাজসভাসদ চম্পট দেন, তাঁর কপালে সুতোর মতন মৃদু রক্তের ধারার লাবণ্যময় অভিব্যক্তি... কয়েকদিন পরে সামরিক আদালত থেকে আক্রমণকারীর শাস্তির বিধান আসে: আকো দুর্গের অধিপতিকে হারাকিরির মাধ্যমে আত্মহত্যার অনুমতি দেওয়া হয়। আকো দুর্গের কেন্দ্রীয় চত্বরে বেদী বানিয়ে লাল চামড়ায় মুড়ে দেওয়া হয়, দণ্ডপ্রাপ্ত মানুষটিকে আনা হয় সেখানে; তাঁরা হাতে দেওয়া হয় স্বর্ণ ও রত্নখচিত ছুরিকা; তিনি জনসমক্ষে অপরাধ স্বীকার করেন, ঊর্ধ্বাঙ্গের পোষাক খসিয়ে কোমর পর্যন্ত উন্মুক্ত করেন, এবং তার পরে প্রথাসম্মতভাবে দুবার ছুরিকাচালনায় কাটেন নিজের তলপেট। প্রকৃত সামুরাইয়ের মতন মৃত্যু তাঁর; দূরে দাঁড়ানো দর্শকমণ্ডলী রক্তপাত দেখতে পান না, কারণ বেদীটি লাল চামড়ায় আবৃত। পদমর্যাদা অনুযায়ী ঠিক তাঁর পরে দ্বিতীয় যিনি এবং খুঁটিনাটির ওপরে কড়া নজর যাঁর--সেই কাউন্সিলার ওইশি কুরানোসুকে তখন খড়গের আঘাতে দুর্গাধিপতির মাথাটি ছিন্ন করেন।

    প্রবঞ্চনার ভান করেন যাঁরা

    তাকুমি নো কামির দুর্গ বাজেয়াপ্ত, তাঁর পরিবার পথে বসল, তাঁর বংশ নেমে গেল পদমর্যাদায়, ভূলুণ্ঠিত হল তাঁর সুনাম। তাঁর সভাসদেরা হয়ে গেলেন “রোনিন” অর্থাৎ “স্বাধীন যোদ্ধা”। কথিত আছে, যেদিন দুর্গাধিপতি হারাকিরি করেন, সেই রাত্তিরেই সাতচল্লিশ জন রোনিন মিলিত হন এক পাহাড়চূড়ায় এবং এক বছর পরে যে ঘটনা ঘটবে তার খুঁটিনাটির পরিকল্পনা করেন। কিন্তু সত্যি কথাটা হল যে সভাসদেরা যথাযথ কারণেই বিলম্ব করেছিলেন তাঁদের কর্মে, এবং অন্তত: একবার তাঁদের সলাপারামর্শ ঘটেছিল দুর্গম পাহাড়চূড়ার বদলে বনের অভ্যন্তরে এক উপাসনাগারে--শাদা রঙ করা কাঠের বাড়ি, চোখে পড়ার মতন কিছু নয়; ভেতরটাও শাদাসিধে কেবল আয়না সমেত একটা কাঠের বাক্স ছাড়া।

    রোনিনেরা প্রতিশোধ নেবার জন্যে উন্মুখ, কিন্তু প্রতিশোধ নেওয়া তখন মনে হয়েছে অসম্ভব। রাজকীয় আদবকায়দার ঘৃণ্য শিক্ষক কিরা কোতসুকে নো সুকে সুরক্ষিত করেছেন তার বাসগৃহ এবং তিনি কোথাও গেলে তার পালকির চারপাশে ছেয়ে থাকে ঝাঁক ঝাঁক তিরন্দাজ তলোয়ারধারী সৈন্য। তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের মধ্যে অনেকেই সততায় অবিচল গুপ্তচর, কোনকিছু তাদের চোখ এড়ায় না এবং যাঁকে তারা প্রতিশোধকামী রোনিনদের সর্দার বলে ভাবে সেই কাউন্সিলার কুরানোসুকের ওপরে তাদের দিনরাত্রি সতর্ক নজরদারি। ভাগ্যক্রমে কুরানোসুকে জানতে পেরেছিলেন এই গুপ্তচরের নজরের কথা এবং তাঁর প্রতিশোধকর্মে তিনি তার বিরুদ্ধে যথাযোগ্য ব্যবস্থা করেছিলেন।

    তিনি বাসস্থান বদল করে চলে গেলেন কিয়োতো শহরে--সারা সাম্রাজ্য জুড়ে যার হেমন্তকালীন রঙবাহার প্রসিদ্ধ। সেখানে তিনি নিজের অধঃপতন ঘটতে দিলেন গণিকালয়ে, জুয়ার আস্তানায় এবং শুঁড়িখানায়। মাথার চুল পেকে আসা সত্ত্বেও তিনি মেলামেশা করতে লাগলেন গণিকা, কবি এমনকি আরও নীচুস্তরের মানুষজনের সঙ্গে। একদিন তাঁকে বহিষ্কার করা হল শুঁড়িখানা থেকে মত্ত অবস্থায়--সকালে ঘুম ভাঙলো পথের ধারে, তাঁর মাথা ডুবে রয়েছে নিজের বমির মধ্যে।

    ঠিক সেই সময় সত্‌সুমা গোষ্ঠীর একজন মানুষ তাঁকে এইভাবে পড়ে থাকতে দেখে রাগ ও ধিক্কারের সঙ্গে বলে উঠলেন, “আপনিই কি সেই ওইশি কুরানোসুকে, যিনি আসানো তাকুমির কাউন্সিলার ছিলেন? আপনি তাঁকে সাহায্য করলেন মরতে, অথচ তাঁর মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবার বদলে ডুবে রয়েছেন মদ আর মেয়েমানুষে! বিশ্বাসঘাতক জানোয়ার! মাথামোটা আর কাপুরুষের বেহদ্দ! আপনি সামুরাই নামের অযোগ্য!"

    বলতে বলতে তিনি লাথি কষালেন ঘুমন্ত কুরানোসুকের মুখে আর থুথু ফেললেন তাঁর গায়ে। কোতসুকে নো সুকের গুপ্তচর গিয়ে তাঁকে সেই সংবাদ জানালে তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

    এখানেই তাঁর দুষ্কর্মের শেষ নয়। কাউন্সিলার তাঁর পত্নী ও দুই শিশুকে নির্বাসনে পাঠিয়ে খরিদ করলেন এক রক্ষিতাকে; এইসব চূড়ান্ত অবিবেচনার কাজকর্ম দেখে শক্রপক্ষের আনন্দ হল খুব এবং কমল তাঁর ভয় এবং সাবধানতা--অর্ধেক প্রহরী আর যোদ্ধাদের বরখাস্ত করলেন তিনি।

    ১৭০৩ সনের এক তীব্রশীতের রাতে, সাতচল্লিশ জন রোনিন সমবেত হলেন ইয়েডো শহরে উপকণ্ঠে এক পোড়ো বাগানবাড়িতে, একটি সেতু এবং তাসের কারখানার সন্নিকটে। তাঁদের সঙ্গে ছিল দুর্গাধিপতির জয়পতাকা এবং ধ্বজা। আক্রমণ শুরু করার আগেই শহরের মুখ্য নাগরিকদের সংবাদ দেওয়া হয়েছিল যে তাঁদের শত্রুতা ইয়েডো শহরের সঙ্গে নয়--শুধুমাত্র ন্যায় বিচার স্থাপন করার জন্যেই তাঁদের এই অভিযান।

    ক্ষতচিহ্ন

    দু দলে বিভক্ত হয়ে তাঁরা আক্রমণ করলেন কিরা কোতসুকে নো সুকের প্রাসাদ। কাউন্সিলার কুরানোসুকের নেতৃত্বে প্রথম দলটি চড়াও হলেন প্রাসাদের সিংহদুয়ারে; কাউন্সিলারের বড় ছেলের বয়স তখনও ষোল পূর্ণ হয়নি--সে নেতৃত্ব দিল দ্বিতীয় দলের এবং সেই রাতের সংঘাতে তার মৃত্যু। অসাধারণ প্রাঞ্জল এক দুঃস্বপ্নের মতন সেই রাতের অনেক মুহূর্তের কথাই ইতিহাসে লিপিবদ্ধ-- দড়ির সিঁড়ি বেয়ে প্রাচীরে উঠে আবার পেন্ডুলামের মতন বিপজ্জনক নেমে আসা, ড্রাম বাজিয়ে আক্রমণের নির্দেশদান, রক্ষীদের ধেয়ে আসা, ছাদের ওপর দাঁড়ানো তিরন্দাজের দল, শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে ধেয়ে আসা অব্যর্থ লক্ষ্যের তীর, রক্তপাতে দূষিত চিনেমাটির তৈজসপাত্র, আগুনে জ্বলে পুড়ে বরফশীতল মৃত্যু--ইহলীলা সংবরণের নির্লজ্জ এবং বিশৃঙ্খল যত উপাদান। রোনিনদের মধ্যে মৃত ন’জন, রক্ষীদের বীরত্বও কোন অংশে কম নয়, কোনমতেই তারা আত্মসমর্পণে রাজী নয়। মধ্যরাত পেরিয়ে ভাঙ্গল তাদের প্রতিরোধ।

    কিরা কোতসুকে নো সুকে--যার প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে রক্ষীদের এই বীরত্ব প্রকাশ, তাঁর টিকির দেখা নেই কোথাও। আক্রমণকারীরা তাঁকে খুঁজে ফেরেন কক্ষ থেকে কক্ষে সেই আবেগমথিত প্রাসাদে--যখন খুঁজতে খুঁজতে তাঁরা হতাশ তখন কাউন্সিলার লক্ষ করলেন বিছানায় ফেলে রাখা রাতপোষাক তখনও উষ্ণ। আবার নতুন উদ্যমে খোঁজার সূচনা--ব্রোন্‌জ নির্মিত আরশির পেছনে তাঁরা সন্ধান পেলেন সরু এক জানলার। নীচে উঠোনের আবছায়ায় শাদা পোষাকের এক মানুষ মাথা তুলে তাঁদের দিকে তাকিয়ে--তাঁর হাতে কম্পমান তরবারি। তাঁরা ঝটপট নেমে গেলেন নিচে--যুদ্ধের চেষ্টামাত্র না করে ধরা দিলেন রাজসভাসদ। তাঁর কপালে স্পষ্ট ক্ষতচিহ্ন -- তাকুমি নো কামির তরবারির পুরনো স্বাক্ষর।

    রক্তাক্ত রোনিনেরা সেই ঘৃণ্য রাজপুরুষের সামনে নতজানু হয়ে জানালেন, যে তাঁরা আকো দুর্গের অধিপতির প্রাক্তন সহচর, যার সর্বনাশ ও অকালমৃত্যুর জন্যে তিনি দায়ী; তাঁকে অনুরোধ করা হ’ল সামুরাইয়ের উপযুক্ত আত্মনিধনে।

    এইভাবে চেষ্টা চালিয়ে গেলেন তাঁরা যাতে রাজপুরুষকে তাঁর ভূলুণ্ঠিত সম্মান পুনরুদ্ধারের সুযোগ দেওয়া যায়। কিন্তু কোন কথাতেই কান দিলেন না তিনি; শেষ পর্যন্ত সূর্যোদয়ের সময়ে তাঁর গলা কাটতে বাধ্য হলেন রোনিনেরা।

    সাক্ষ্য প্রমাণ

    তাঁদের প্রতিশোধস্পৃহা নিবৃত্ত হবার পরে (অথচ কোনপ্রকার ঘৃণা, উদ্বেগ অথবা অনুশোচনা ছাড়াই) রোনিনেরা আস্তে আস্তে রওনা হলেন তাঁদের প্রভুর দেহাবশেষ রক্ষিত ধর্মস্থানের দিকে।

    সঙ্গে তাঁদের পিতলের ডেকচিতে সাজানো কিরা কোতসুকে নো সুকের অভাবনীয় ছিন্ন শির--পালা করে এক এক জন পাহারা দিলেন তাকে। দিনের আলোয় তাঁরা পার হলেন ফসলের ক্ষেত এবং প্রদেশের পর প্রদেশ। পথে মানুষ তাঁদের আশীর্বাদ দেয় আর কাঁদে। সেন্দাই-এর রাজকুমার তাঁদের আমন্ত্রণ জানালেন তাঁর প্রাসাদে, কিন্তু তাঁরা জানালেন যে তাঁদের প্রভু প্রায় দুবছর অপেক্ষায় আছেন, এখন থামা অসম্ভব। অন্ধকার সমাধিমন্দিরে পৌঁছে থামলেন তাঁরা, প্রভুকে উৎসর্গ করলেন শত্রুর ছিন্ন শির।

    সুপ্রীম কোর্টের রায় বেরুল, তাঁরা যেমনটি ভেবেছিলেনঃ রোনিনদের সবাইকে সুযোগ দেওয়া হ’ল আত্মহত্যার। সকলে সেই রায় মেনে নিলেন অবিচলিত মনে--তাঁরাও এখন প্রভুর পাশে চিরনিদ্রায়। এখনও সন্তানসন্ততি সমেত মানুষ সেখানে আসে বিশ্বাসী অনুচরদের সমাধিতে প্রার্থনা করতে।

    সত্‌সুমা গোষ্ঠীর মানুষ

    একদিন সমাধিমন্দিরের তীর্থযাত্রীদের মধ্যে দেখা গেল অনেক দূর থেকে হেঁটে আসা এক ধূলিধূসর ক্লান্ত যুবককে। কাউন্সিলার ওইশি কুরানোসুকের সমাধিফলকের সামনে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে তিনি বলতে লাগলেন, “যখন আপনাকে মত্ত অবস্থায়, কিয়োতোর গণিকালয়ের প্রবেশপথের সামনে পড়ে থাকতে দেখেছিলাম, তখন জানতাম না যে আপনি প্রভুর মৃত্যুর প্রতিশোধের জন্যে এমনটি করেছেন এবং না জেনে আমি চলে যাওয়ার আগে লাথি ও থুথু দিয়েছিলাম আপনার মুখে। এবার আমি হাজির প্রায়শ্চিত্তের জন্যে।” কথা শেষ করেই তিনি হারাকিরিতে মৃত্যু বরণ করলেন।

    মন্দিরের পুরোহিত সত্‌সুমা গোষ্ঠীর মানুষটির সাহস দেখে মুগ্ধ, এবং তিনি দুর্গাধিপতি ও অনুচরদের পাশাপাশি তাঁরও শেষ শয্যার ব্যবস্থা করলেন।

    সাতচল্লিশ জন অনুচরের কাহিনির এখানেই সমাপ্তি--অথবা বলা যায় যে এই কাহিনির কোন সমাপ্তি ঘটে না, কারণ আমরা অন্য মানুষেরা এই পরিমাণ আনুগত্যের প্রকাশে হয়ত অপারগ, কিন্তু মনের মধ্যে এখনও আশা হারাইনি যে ভবিষ্যতে কোনদিন তা সম্ভব হবে--আমরা দিনের পর দিন তাঁদের প্রতি সম্মান জানিয়ে তাঁদের মহান কাহিনি প্রচার করে যাব।


    হর্হে লুইস বোর্হেস (১৮৯৯-১৯৮৬), জন্ম আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেস-এ। বোর্হেস ছিলেন মূলত লেখক, কবি, দার্শনিক, অনুবাদক, সম্পাদক, সমালোচক। বোর্হেসের মূল গল্পটির নাম “এল ইন্সিবিল মায়েস্ত্রো দে সেরিমনিয়াস কোতসুকে নো সুকে। ইংরেজি অনুবাদের নাম: “The Uncivil Teacher of court Etiquette Kotsuke no Suke”

    বাংলা অনুবাদকের টীকা—

    — গল্পটি রচিত হয় ১৯৩৩ সালে - প্রকাশিত হয় প্রথমে "ব্রিটিকা" সাহিত্য পত্রে এবং পরে গ্রন্থাকারে "ইস্তোরিয়া ইউনিভের্সাল দে লা ইনফামিয়া" ("বিশ্বজোড়া পাপকর্মের ইতিহাস") গ্রন্থে ১৯৩৫ সালে। ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণে নতুন গল্প যুক্ত হয়েছে, কিন্তু এই গল্পের কোন পরিবর্তন হয়নি।

    — গল্পের তথ্যসূত্র - ১৯১২ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত এ. বি. মিটফোর্ড রচিত "প্রাচীন জাপানের গল্প" গ্রন্থটি।

    — গল্পের ইংরেজি অনুবাদক পুয়ের্তো রিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক অ্যানড্রু হার্লি। তিনি জাপানি চরিত্রের নামগুলি সঠিক ইংরেজি বানানে লিখতে মিটফোর্ডের গ্রন্থের সাহায্যে নিয়েছেন।

    — "চুসিংগুরা" — এই কাহিনি অবলম্বনে অনেক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। লেখক খুব সম্ভবত: ১৯২৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত শোজো মাকিনো পরিচালিত "জিতসুরোকু চুসিংগুরা" ছবিটির কথা লিখেছেন। একই বিষয় নিয়ে হলিউডের ফিল্ম "৪৭ রোনিন" (ফেব্রুয়ারি ২০১৩)। এখানে বলে রাখা ভাল যে মূল এসপানিওল ভাষার গল্পে "চুসিংগুরা" শব্দটি নেই; সঠিক অনুসঙ্গ বোঝানোর জন্যেই ইংরেজি অনুবাদে শব্দটির ব্যবহার।

    — "রোনিন" - এই শব্দটিও মূল এসপানিওল গল্পে নেই। তবে মিটফোর্ডের কাহিনিতে রয়েছে। ইংরেজি অনুবাদক "অনুগত সহচর" বোঝাতে শব্দটি ধার নিয়েছেন মিটফোর্ডের থেকে। জাপানি ভাষায় "রোনিন" শব্দের আক্ষরিক অর্থ "ঢেউ এর মানুষ"।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ এখান থেকে হর্হে লুইস বোর্হেস-এর ছবিঃ উইকিপিডিয়া থেকে।
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments