একবার মায়ের সাথে আমি আর আমার ভাইপোটি আমাদের গ্রাম থেকে মৈমনসিং শহরে ব্রহ্মপুত্র স্নানে গিয়েছিলাম। আমার দুই নম্বর দিদির বাড়ি ছিল মৈমনসিং শহরে। মায়ের কথানুসারে, আমরা ক’জনা মিলে গেলাম বেহারার বাসায় খবর দিতে যে পরদিন সকাল আটটার গাড়ি ধরতে হবে আমাদের। গ্রাম থেকে রেলস্টেশন ছিল আট ক্রোশ দূরে। অতএব খুব ভোরে তাদের পালকি নিয়ে আসতে হবে। গ্রামের উত্তরে শেষপ্রান্তে এক অবস্থাপন্ন লোকের বসতবাড়ির অনতিদূরে অধীনস্থ হিসাবে থাকত কয়েকটি বেহারা পরিবার। ঘরদোর তৈরি করে কয়েক পুরুষ যাবৎ সেখানে বাস করত তারা। তাদের জীবিকা ছিল পালকি, সোয়ারী বহন করা।
পড়ন্ত বেলায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে সন্ধ্যা হয় হয় এমন সময় গিয়ে পৌঁছলাম বেহারাদের বাসায়। বেহারাদের বাসার সামনে ছিল মস্ত উঁচু একটি বড়ই (কুল) গাছ। চৈত্রের শেষ, তবু দু’একটি কুল এখনও গাছে আছে, তা খেতে খুব মিষ্টি। কাজেই কুলতলায় আরেকটু সময় অতিবাহিত করে গিয়ে ঢুকলাম বেহারাদের উঠানে। দীর্ঘ কয়েক পুরুষ বাংলায় বাস করার ফলে, এদের স্ত্রী বা সন্তানসন্ততিরা দস্তুরমত বাংলায় কথাবার্তা বলতে পারত। এদের অবিন্যস্ত খুপরি খুপরি ঘরগুলিতে ছিল খড়ের ছাউনি, মাটির দেওয়াল। উঠান বলতে সরু একফালি জায়গা, তারই মধ্যে দড়ির খাটিয়া পেতে কেরোসিনের চিরাগ (লম্পজাতীয় বাতি, তবে আকারে বড়) জ্বালিয়ে বসে আছে পুরুষেরা, বাচ্চা শোয়ানো আছে পাশে। মেটে দেওয়ালের গায় ছোট্ট ফোকরে চিরাগের লম্বা বাঁকানো হাতলটি ঢুকিয়ে রাখা, যাতে ঘর বাহির দুদিকেই আলো যায়। খাটিয়ায় বসে সবাই মিলে খঞ্জনি, ডুগডুগি বাজিয়ে সান্ধ্য আমোদে মৌজ করে গাইছে তাদের জানা গান। গানের কথাগুলি ছিল—
“রাম রহিম্ না জুদা কর ভাইতখন স্বদেশী হাওয়ার মৃদু দোলা গ্রামদেশে পৌঁছাতে শুরু করেছে। সে-কথায় পরে আসছি। বেহারাদের জানান দিয়ে বাড়ি আস্তে সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। দেরি হবার জন্য এরপর মা যা করার করলেন। আচ্ছা করে উত্তম-মধ্যম দিলেন আমাদের।
দিলটা সাচ্চা রাখ জি
দেশের কথা ভাব ভাইরে
দেশ আমাদের মাতাজি।”
পরদিন প্রাতে সোয়ারী করে গিয়ে পৌঁছলাম রেলস্টেশনে। মনে ভ্রমণের আনন্দ। দাঁড়িয়ে দেখছি, পোঁটলাপুঁটলিসহ বিভিন্ন লোকের সমাগম, রেলের অপেক্ষারত যাত্রীরা গাড়ি যাওয়া-আসার লাইন দুটোর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। মাথার ঘোমটায় মুখ ঢেকে (মেয়েরা বাইরে বেরোলেই ঘোমটায় মুখ ঢেকে নিত) বসে আছে মেয়েরা। তখন রেলগাড়ি চলত কাঠের আগুনে। গাড়ি আসছে, দূর থেকে দেখা যাচ্ছে বিশাল কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী উদ্গীরণ করতে করতে ছুটে আসছে গাড়ি। বিকট আওয়াজে ধেয়ে আসছে যেন বিরাট এক আগুনে কুণ্ড। আশেপাশের মাটি কাঁপছে থরথর করে। স্টেশানের রেলিং-এর বাইরে যত গরু মোষ খোঁটায় বাঁধা অবস্থায় জাবনা থেকে জাব খাচ্ছিল, তাদের দুয়েকটি ভয়ের ঠেলায় দড়ি ছিঁড়ে লেজ উঁচু করে, হাম্বা রবে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে পালাল। লাইনের মাঝখানে অপেক্ষারত যারা ছিল তারা দৈত্যাকার এক অগ্নিকুণ্ড এগিয়ে আসছে দেখে পোঁটলাপুঁটলি ফেলে রেখে দে.... দৌড়। দৌড়ে এসে টিকিট ঘরের সামনের বারান্দায় চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়ল, কেউ বা অজ্ঞান হয়ে গেল। একেবারে অজগাঁয়ের লোকেদের মধ্যে যারা কোনদিন বাড়ির বাইরে বার হয়নি তাদেরই এই অবস্থা হল। যাই হোক ট্রেনে চেপে নির্দিষ্ট সময়ে গিয়ে পৌঁছলাম মৈমনসিং শহরে, দিদির বাড়িতে। শহরের রাস্তাঘাট, দালানবাড়ি বিশেষ করে রাস্তায় রাস্তায় গ্যাসের বাতি দেখে মনে বেশ পুলক জাগল। পরদিন স্নান, রাত্রে সব গোছগাছ করে রাখা হচ্ছে।
ব্রহ্মপুত্রের এই স্নানের জন্য কয়েকটি শানবাঁধানো ঘাট ছিল। বড় বড় জমিদারদের স্মৃতিস্বরূপ তাঁদের অর্থানুকূল্যে তৈরি হত এক একটি শানবাঁধানো ঘাট, পুণ্যার্থীদের সুবিধা হত। যেমন ছিল মুক্তাগাছার ঘাট, আঠারো বাড়ির ঘাট, এই রকম আরো অনেক নামের ঘাট।
পরদিন খুব ভোরে মায়ের সঙ্গে গেলাম স্নানে। গিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য। ব্রহ্মপুত্রের উঁচু পাড়ে দাঁড়িয়ে সেদিন ব্রহ্মপুত্রের রূপ দেখে বিস্ময়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। অবিস্মরণীয় সেই রূপ ভাষায় অবর্ণনীয়, সেহেতু সেই রূপের বর্ণনা করতে পারিনি কোনদিন। তবুও শিশুমনে পাকাপোক্ত ঠাঁই করে নিয়েছিল সেই দৃশ্য যা আজও মনের মণিকোঠায় উজ্জ্বল। প্রবল স্রোতশালী নদ ব্রহ্মপুত্র, নদীর কানায় কানায় ভর্তি কালো জল ব্রহ্মতেজে তোলপাড় করে বয়ে চলেছে। বেলা বেড়ে গেছে। দুপুরের রোদে ঝিকমিক করছে তরঙ্গিত নদীজল। যতদূর দৃষ্টি যায় দেখা যাচ্ছিল অগণিত ঢেউয়ের মাথায় যেন লক্ষ হীরার বিন্দু। দ্বিপ্রহরের সূর্যকিরণ বক্ষে ধারণ করে বন্ধনহীন আনন্দে উদ্দাম নৃত্য করে বয়ে চলেছে ব্রহ্মপুত্র্র।
গ্রামের আলোহাওয়ায় গ্রাম্য শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশে ছোটবেলায় মানুষ হয়েছি। নদীপথে যাতায়াত অনেক করেছি কিন্তু সেদিনের ব্রহ্মপুত্রের সেই ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যকে জীবনেও ভুলিনি। জল থেকে পাড় ছিল অনেক উঁচু। এই উঁচু পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখছি অসংখ্য পুণ্যার্থীর স্নান, শুনেছি সমস্বরে মন্ত্রপাঠ। তার এক লাইন আমার একটু একটু এখনও মনে আছে।
“ব্রহ্মপুত্র মহাভাগে / শান্তনু কুল নন্দন” ইত্যাদি ইত্যাদি।
কেউ বা উৎকৃষ্ট ফল, নারকেল, পৈতা ছুঁড়ে ফেলছে জলে। ব্রহ্মতেজা ব্রহ্মপুত্র নদী নয়। নদ। পুরুষ তিনি, মহাতেজা ব্রাহ্মণ বলেই তাঁকে পৈতে, নারকেল এসব দান করছে পুণ্যলোভাতুর মানুষ। মেলা বসেছে ব্রহ্মপুত্রের উঁচু পাড়ে ফাঁকা জায়গায়। মেলায় নানারকম ফল, খাদ্যসামগ্রী, কাঠের জিনিস, পুতুল, গাড়ি, ঘোড়া ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছে।
এরপর নির্দিষ্ট দিনে পুণ্যার্থীরা স্নান সেরে গাড়ি ধরে যে যার দেশে ফিরে গেল। আমরাও বাড়ি ফিরে এলাম।
ছেলেবেলায় আমাদের এক মজার খেলা ছিল, হাঁড়িকুড়ি নিয়ে রান্নাবাটি খেলা। বিকেলবেলায় এপাড়া ওপাড়ার সমবয়সী মেয়েরা একজোট হয়ে এক জায়গায় শুরু হত খেলা। নানারকম পাতা দিয়ে তৈরি হত নানারকম মাছ। সেই মাছ দিয়ে রান্না হত ঝাল, ঝোল, ভাজা ইত্যাদি। বড়দের অনুকরণ করেই তৈরি হত সবরকম রান্না। নিমন্ত্রিতেরা খেতে বসতেন উঠোনে। উঠোনের সাদা ধবধবে বালি দিয়ে তৈরি হত ভাত।
তবে খেলা আরম্ভ হওয়ার শুরুতে মতানৈক্য শুরু হত মা, কাকিমা, জেঠিমা, পিসিমা বাছাই নিয়ে। খেলায় মা, কাকিমা, জেঠিমা সাজতে নারাজ ছিলাম আমি। আমি সাজতাম পিসিমা, নয় ঠাকুমা। শেষকালে সর্বসম্মতিক্রমে খেলা শুরু হত।
তবে সবচেয়ে ভাল খেলা ছিল পুতুলের বিয়ে। আমাদের গ্রামের উত্তর পাড়ায় এক ডাক্তার ছিলেন, তাঁর মেয়ের নাম ছিল মিনতি, সে ছিল আমারই সমবয়সী। ওর মেয়ে পুতুলের সঙ্গে আমার ছেলে পুতুলের বিয়ে হবে। বারুণী মেলা থেকে কেনা হত সেইসব পুতুল। আমি হতাম ছেলে পুতুলের দাবিদার, মেয়ে পুতুলের বিয়ে দিতে আমি নারাজ ছিলাম। কারণ মেয়ে পুতুল হলে সবসময় তাকে শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে। আর বিয়ে হয়ে পুতুল মেয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবার পর যদি মেয়ের শাশুড়ির সাথে ঝগড়াঝাঁটি হয়ে আড়ি হয়ে যায় তবে মেয়ে পুতুল ফেরৎ পাওয়া মুশকিল হত। যাক্ পুতুলের বিয়ের কথাবার্তা পাকা হল, বিয়ের দিন নির্দিষ্ট হল। বড়দের বিয়ের মত, পুতুলের বিয়েতেও ‘পানেখিল’ অনুষ্ঠান, আশীর্বাদ হত। বনপুলির পাতা দিয়ে হত পান আর ঝাউয়ের বীজ দিয়ে হত সুপুরি।
উঠোনে আলপনা দিয়ে, পিঁড়ি পেতে সামনে ঘট রেখে আমার ছেলে পুতুল বসিয়ে আশীর্বাদ করা হল। গায়ে হলুদের তত্ত্ব তৈরি হল বড়দেরই অনুকরণে। হোমিওপ্যাথি ওষুধের ছোট্ট শিশিতে করে দেওয়া হত আলতা, গন্ধতেল, বারুণী মেলা থেকে কেনা মাছ সাবান। পুরনো ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো শিউলি ফুলের বোঁটার রঙ, পুঁইমেটুলির রস দিয়ে ছোপানো হত। তা দিয়ে তৈরি হত কনের শাড়ি।
সঙ্গে বাজনাও থাকত। নারকেল পাতা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে তৈরি হত সানাই, কলাগাছের পেটো বা মোটা ডাল দুধারে কেটে তিন ভাগ করে নিয়ে তৈরি হত ফটফটি বাজনা, হাতে নিয়ে জোরে জোরে দুপাশে নাড়ালেই ফটফট শব্দে বাজত সেই বাজনা। তাল, লয়হীন অনবরত বাজনার আওয়াজ আর জোকার-উলুধ্বনিসহ পাল্কি চড়ে বর পৌঁছত কনের বাড়ি। সেখানে মেয়ের মা উঠোনে আলপনা দিয়ে চিত্রিত পিঁড়িতে মেয়েকে বসিয়ে তৈরি হয়ে বসে থাকত। বর এলে আশীর্বাদ হবে। এঁটেল মাটি দিয়ে তৈরি করা হত কাদামাটির নাড়ু, সন্দেশ। সেগুলো রোদে শুকিয়ে নেওয়া হত। সেই মিষ্টি পরিবেশন করা হত বরযাত্রীদের।
যথাসময়ে মেয়ের মা গায়েহলুদের তত্ত্ব সবার সামনে বের করে দেখাত এবং নানা আচার, নিয়ম পালনের পর বরকে ঘরে নিযে যেত। বুড়োবুড়িরা সব তত্ত্ব দেখে খুব তারিফ করতেন, আর শিউলি ফুলের বোঁটার রঙে ছোপানো গেরুয়া রঙের শাড়ি দেখে ভগবান বস্ত্র (সাধুসন্তদের পোশাক) নামে আখ্যায়িত করতেন। পরদিন হত বিয়ে। বিকেলে পাড়ার মেয়েরা সব জড়ো হয়ে বিয়ের প্রস্তুতিতে লেগে যেত। পাতাবাহারের পাতাকে আমপল্লবের পরিবর্ত বানিয়ে ঘটির মুখে দিয়ে গীত গাইতে গাইতে যেতাম জল সইতে। বর-কনেকে স্নান করানো হত। রাংতা কাগজ পানের খিলির মত করে মুড়িয়ে বরের টোপর তৈরি হত। বিয়ের আয়োজন হত। কনের মা কনের কপালে রাংতার কপালী পরিয়ে দিত। বিয়ে শুরু হলে ছোট পুতুলের ঘোমটা তুলে শুভদৃষ্টি হত।
বর্তমান সময়ের মতো এত নানারকমের বিনোদনের উপকরণ তখন গ্রামগঞ্জে ছিল না। গ্রামের পরিবেশে মানুষদের বিনোদনের উপকরণের মধ্যে বাচ্চাদের এই পুতুলের বিয়েও ছিল একটা মজা করার বিষয়। এছাড়া ছিল গ্রাম্য মজলিস, বৈঠক, নানা পরিবারের গিন্নিদের একত্রে বসে গল্পগাছা, রামায়ণ, মহাভারত পাঠ, কথকতা, নানারকম পালাগান। দুর্গাপূজার পর নাটক হত যার প্রস্তুতি চলত মাসাধিককাল ধরে। বহু বছর আগেকার ঘটনা হলেও এখনও আমার মনে আছে। সব নাটকের নাম মনে না থাকলেও দু-একটির নাম মনে আছে, যেমন-মেবার পতন, মহারাজা হরিশ্চন্দ্র, তরণীসেন বধ ইত্যাদি।
গ্রামের যে-সব মানুষ কর্মসূত্রে বাইরে থাকতেন, তাঁরা পূজার সময় বাড়িতে আসতেন। তখন নাটকের রিহার্সাল শুরু হত। আমাদের গ্রামে আমার বড়দার সমবয়সী ছিলেন পরেশ সরকার। স্কুলে-পড়া শিক্ষা তাঁর ছিল না, হাতেকলমে কোন বিষয়ে তাঁর শিক্ষা না থাকলেও তিনি ভালো ছবি আঁকতে পারতেন। নাটকের নানা দৃশ্য অনুযায়ী নানা সিন তিনিই এঁকে দিতেন। দৃশ্যচিত্রে আঁকতেন গাছপালা, নদী, রাজপথ, চারিদিকে পাহাড়বেষ্টিত গ্রামের আকাশে অর্ধউদিত সূর্য। নাটকের অঙ্কের সঙ্গে খাপ খাইয়ে আঁকতেন রাজপথ। রাজপথের দুইপাশে থাকত বাড়িঘর, সারি সারি দোকান-পাট, সুরার দোকানে সুরাভর্তি বোতল, সামনের পথে বোতল বুকে চেপে ধরে কোনো মাতাল পথ চলছে মাতোয়ারা হয়ে গানের কলি ভাঁজতে ভাঁজতে। নাটকে হয়ত সেই দৃশ্যে মাতাল চলেছে গান গাইতে গাইতে— ‘আমি কম বয়ছে মদ খেইয়ে মাতাল হয়েছি...ইইই...।’ ড্রপসিনও খুব সুন্দর আঁকতেন।
আরেকটি সিনের দৃশ্যাবলী ছিল এইরকম। একটি অজগ্রামের একটি বাড়ি, বাড়ির চারভিতে চারটি খড়ের ঘর, বাঁশের বেড়া, আধখোলা ঘরের বাঁশের দরজা। বাঁশের মূল দরজা ঈষৎ খোলা। বেড়ার বেতের বাঁধন স্পষ্ট। ঘরের চালে দুটি কাক। রান্নাঘরের দরজায় একটি কুকুর বসে। ভোরবেলার দৃশ্য। বাড়ির বৌটি ঝাঁটা হাতে উঠোন ঝাড় দিচ্ছে। আশেপাশে নানা গাছপালা, ঝুঁকে পড়েছে ঘরের চালে। প্রতিটি দৃশ্যই যথোপযুক্ত নানা রঙ দিয়ে চিত্রিত।
তখনও দেশে বা গ্রামে নাটক, পালাগান বা অভিনয়ে মেয়েদের কোন ভূমিকা ছিল না। দর্শক হিসাবে মেয়েদের বসার জায়গাও ছিল আলাদা, সম্পূর্ণ আব্রুযুক্ত। নাটকের স্টেজের সোজাসুজি কোন একটি ঘরের একদিকের টিনের বেড়ার পেরেক খুলে নিয়ে, সেই ফাঁকা জায়গায় চিকের আড়াল দেওয়া হত। সরু কাঠির তৈরি চিকের বদলে সরু সরু পাটকাঠি দিয়ে আধইঞ্চি ফাঁক রেখে তৈরি হত চিক। সেই চিক ঝুলিয়ে দেওয়া হত ফাঁকা বারান্দার সামনে। টিন খুলে নেওয়াতে ঘর বারান্দা এক হয়ে যেত, সেখানে অনেক মহিলা একসঙ্গে বসতে পারতেন। বাইরে থেকে তাঁদের দেখা যেত না, কিন্ত চিকের ফাঁক দিয়ে মেয়েরা নাটকের দৃশ্য স্পষ্ট দেখতে পেতেন। পুরুষেরা বসতেন স্টেজের একদিকে। মাথার ওপরে শামিয়ানা টাঙানো থাকত। মা ঠাকুমারা শামিয়ানাকে বলতেন ‘সায়বানা’, আমরাও তাই বলতাম। বড় হয়ে এদেশে এসে শামিয়ানা নামটা জেনেছি। ছেলেবেলার আমাদের গ্রামবাংলার সেই সব সুখস্মৃতি আজও সুখানুভূতির সৃষ্টি করে। যদিও ছেলেবেলার স্মৃতি সর্বদাই সুখের হয়।
আবার ফিরে আসি নাটক বা পালাগান প্রসঙ্গে। তরণীসেন বধ নাটক যখন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তখন আমি বেশ বড় হয়ে গেছি। বয়স তেরো কি চোদ্দ। তাই আর বাইরে শামিয়ানার নিচে প্রকাশ্যে বসা যাবে না, বসতে হবে চিকের আড়ালে। সে সময় নাটকে স্ত্রীলোকের ভূমিকায় ছেলেরাই অভিনয় করত। মহিলা চরিত্রে মানিয়ে যেতে পারে এমন ছেলেদেরই বাছা হত স্ত্রীভূমিকায় অভিনয় করার জন্য। স্ত্রীলোকের পোশাকের জন্য বাড়ির বা পাড়ার বউদের বেনারসী, বোম্বাই বা মাদ্রাজি শাড়ি চেয়ে নিয়ে ব্যবহার করা হত। গলার, হাতের আর কানের গয়নার জন্য পুঁতির আর জরির গয়না ব্যবহার করা হত। বেনারসী তো চিরনূতন। বোম্বাই শাড়িগুলি ছিল পাছাপেড়ে, আর এত মসৃণ যে হাতের মুঠোয় পুরো শাড়িটি ধরে রাখা যেত। মাদ্রাজি শাড়ি অবশ্য ছিল খানিকটা মোটা, কিন্তু সব শাড়ির রঙই ছিল উজ্জ্বল। এইসব শাড়ি, গয়নায় সেজে আর মাথায় পরচুলা লাগিয়ে ছেলেরা যখন মেয়েদের ভূমিকায় অভিনয় করতে স্টেজে উঠতো তখন তাদের ছেলে বলে চেনাই যেত না। নাটকের সংলাপ বলা শুরু হতেই গলার স্বরে ধরা পড়ে যেত ছেলেরা কে কোন ভূমিকায় অভিনয় করছে। তরণীসেন বধ নাটকে আমার সেজদা (আমার মেজদার চেয়ে বয়সে ছোট আমার জ্যেঠতুতো দাদা) সেজেছিল মন্দোদরী। উচ্চতায় খাটো আর মোটাসোটা ভারী চেহারার সেজদাকে বেনারসী আর গয়নায় সেজে, পরচুলার দীর্ঘ এলোকেশে খুব সুন্দর মানিয়েছিল। বিভীষণের ভূমিকায় ছিল আমার নিজের ছোড়দা, আর সরমার ভূমিকায় অভিনয় করেছিল গ্রামসম্পর্কে আমাদের এক পিসতুতো দাদা। সে ছিল পাতলা চেহারার খাটো মানুষ। ফর্সা। রুপালী বুটিদার বেগুনী রঙের বেনারসী শাড়ি, জরি আর পুঁতির গয়নায় তাকে খুব সুন্দর দেখাত।
নাটকের মুখ্য চরিত্র রাবণের ভূমিকায় অভিনয় করেছিল আমাদেরই গ্রাম সম্পর্কের এক ভাইপো। চেহারায় অতি সুদর্শন আর অভিনয় ছিল তার অপূর্ব। বর্তমানে সিনেমায় বা টেলিভিশনে যেমন নানারকম বেশভূষায় সজ্জিত, গয়না পরা, বর্ম আঁটা, অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত রাবণকে দেখতে পাই আমাদের দেশের নাটকের রাবণ তেমন ছিল না। সে রাবণের গেরুয়া রঙের ধুতি ছিল হাঁটু পর্যন্ত, অঙ্গে গেরুয়া উত্তরীয়, মাথায় ছিল জটার পরচুলা আর হাতে গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। খড়ম পায়ে, কমণ্ডলু হাতে এক সাধুর মত। প্রত্যেক অভিনেতার প্রতিভা ফুটে উঠত তাদের অভিনয়ে। আজকাল কত উন্নতমানের অভিনয় দেখি, কিন্তু ছেলেবেলায় দেখা সেইসব নাটকের ভাললাগা মুহূর্তগুলিকে আজও ভুলতে পারি না। সময় সময় নিভৃতে স্মৃতির আয়নায় ফিরে দেখে আনন্দ অনুভব করে অন্তত কিছুক্ষণের জন্য মনের সেই অনাবিল আনন্দ, সতেজতা ফিরে পাই।
পদাবলী ছাড়া হত চাঁদবিনোদের পালা, সোনাই দিঘি, গোনাই বিবি, মইশাল রাজা ইত্যাদি পালাগান। মাসাধিক কাল ধরে চলা সেইসব অনুষ্ঠানের সময় আমাদের যে কত আনন্দ হত, তা বলে বোঝাতে পারব না।
অভিনয়ের পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমরা চলে যেতাম পালাটি যেখানে হয়েছিল সেখানে। কুড়িয়ে আনতাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পুঁতির মালা, জরির গয়নার টুকরো। সেসব দিয়েই বানাতাম পুতুলের গয়না। এইসব মিটে যাবার পর আমরা ছোটরা দল বেঁধে সেই সব নাটক আর পালাগানের হুবহু নকল করে শুরু করতাম আমাদের পালাগান। পদাবলী ছিল আমাদের পালাগানের অন্যতম বিষয়। বড়দের কাপড় কুঁচি দিয়ে তারপর সুতো দিয়ে কোমরে বেঁধে তৈরি হত ঘাগরা। ফুল দিয়ে বানাতাম গলার মালা, হাতের বালা। কপালে দিতাম কাচপোকার রঙিন টিপ, পাউডারের অভাব মিটত পূর্বকথিত ‘ঘষি’ দিয়ে। পায়ে পরতাম ফুলের নূপুর।
আমাদের দেশে কাঁকরোলের মত দেখতে একরকম ফল ছিল। এর পাতা আর ফল উভয়ই ছিল খস্খসে। এই কারণে গ্রাম্য ভাষায় এই ফলকে বলা হত ‘খসখইস্যা’। এই লতার পাতাগুলো ছিল ছোট পানপাতার আকারের। এই পাতাগুলিকে সারিবদ্ধভাবে কোমরে জড়িয়ে তার ওপর একটি করে কাচপোকার রঙিন খোলা বসিয়ে দিয়ে তৈরি হত রাধিকার কোমরের চন্দ্রহার। সারা দুপুর ধরে সাজগোজ করে তারপর বাড়ির কোন একটি ঘরে পর্দা টাঙিয়ে, মেঝেতে পাটি পেতে শুরু হত আমাদের পালা। বর্ষাকালে যখন একনাগাড়ে বৃষ্টি চলত তখন এই অভিনয় আর পুতুল খেলা ছিল আমাদের সময় কাটানোর উপায়।
বর্ষাকালে গাঁয়ে জলেস্থলে একরকমের কীট ছিল— জোঁক, শুদ্ধ ভাষায় যাকে বলা হয় জলৌকা। বর্ষায় এই কীটের উৎপাত বেড়ে যেত। এদের একমাত্র ওষুধ ছিল নুন, চুন আর হুঁকোর জল। জলে যেসব জোঁক বাস করত তারা ছিল মারাত্মক। স্নান করার সময়, সুযোগ বুঝে মানুষের পায়ুপথে ঢুকে যেত মানুষের বৃহদন্ত্রে। নামটা তখন জানতাম না। বলতাম পেটের মধ্যে জোঁক ঢুকেছে। আর এই জোঁক পেটের মধ্যে ঢুকে অন্ত্র কেটে দিত আর প্রচুর রক্তক্ষরণ হত, মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হত। জলের জোঁক বেশির ভাগ ছোটদেরই কাবু করত। হাতে পায়ে একবার যদি ধরত তবে হুঁকোর জল আর নুন ছাড়া ছাড়ানোই যেত না। তবে পায়ুপথে জোঁক ঢুকলে রক্তপাত শুরু হবার আগে সেই মানুষকে গামলাভর্তি হুঁকোর জলে কোমর পর্যন্ত ডুবিয়ে বসিয়ে রাখা হত যতক্ষণ না সেই জোঁক বেরিয়ে আসত। এরজন্য গ্রামের সব বাড়ির কর্তাদের হুঁকোর জল এনে ঢালা হত সেই গামলায়। সব মানুষই সহযোগিতা করতেন। কারণ যে কারও বাড়ির ছেলেমেয়ের যে কোনও দিন এই অবস্থা হতে পারে। কারণ সেসব দিনে দিঘি আর পুকুরই ছিল স্নানের জায়গা।
স্থলের জোঁকের বাস ছিল বনেজঙ্গলে, ছোট ছোট ঘাসবনে। এরা বেশির ভাগ আক্রমণ করত উদ্ভিদভোজী পশুদের। রক্ত খেতে খেতে মোটা টসটসে হলে টুপ করে খসে পড়ত মাটিতে। স্থলের জোঁকদের বলত ‘চীনে জোঁক’।
বর্ষাকালে বৃষ্টির আর শেষ ছিল না। বেশিরভাগ সময়েই নাগাড়ে বৃষ্টি চলত মাসাধিক কাল ধরে। আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা আর অবিশ্রান্ত বৃষ্টিতে দিনরাতের প্রভেদ অদৃশ্য হয়ে যেত। চতুর্দিক জলে থই থই করত। সূর্যদেবের হদিশ মিলত না বহুদিন ধরে। তখন আমাদের খেলাধুলা, মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়ানো বন্ধ হয়ে যেত। আমরা অতিষ্ঠ হয়ে বৃষ্টি থামাবার নানা তুকতাক্ করার চেষ্টা শুরু করতাম। এসব তুক্ গ্রামেগঞ্জে প্রচলিত ছিল। পাড়ার কোন বাড়ি থেকে পান খাওয়ার জন্য রাখা চুনের বাটি চুরি করে এনে উঠোনের মাটিতে পুঁতে দিতাম। কখনও নারকেলের মালায় জ্বলন্ত আংরা নিয়ে আরেকটি নারকেলের মালা দিয়ে ঢেকে মাটিতে পুঁতে দিতাম। তাতেও বৃষ্টি না থামলে, রোদ না উঠলে আমরা পুকুরঘাটে গিয়ে গামছার দুপাশ দুজনে ধরে জলে ডুবিয়ে বসে থাকতাম জোঁক ধরবার জন্য। গামছায় জোঁক ধরা পড়লেই বাড়িতে এনে মাঝ উঠোনে মাটিতে রেখে বেলের কাঁটা দিয়ে সেই জোঁকের শরীরের দুপাশে বিঁধিয়ে দিয়ে লম্বা করে জোঁকটিকে মাটিতে আটকে দিতাম। একে বলত ‘জোঁক টানা’ দেওয়া। এই জোঁক টানা দেবার পর না জানি কোন কারণে একটু না একটু রোদ উঠতই। ছোটদের দুরন্তপনায় অতিষ্ট হয়ে অনেক সময়েই বড়োরা বলতেন ‘এইবার তোদের উঠোনে জোঁক টানা দিয়ে রাখব কিন্তু।’
দুপুরের খাওয়া-দাওয়া মিটে যাবার পর বড়দেরও খেলার আসর বসত। সেসব খেলা হত এক জায়গায় বসে। খেলা হত গোলকধাম, দশ-পঁচিশ, লুডো, ষোলঘুঁটি, বাঘ-বন্দী। গোলোকধাম আর লুডো বাদে সব খেলাই হত মাটির মেঝেয় ছক্ কেটে। এইসব খেলার ঘুঁটি ছিল কড়ি।