বিধানবাবু সবে বাড়ীতে ঢুকেছেন, অমনি সঞ্জয় এসে উপস্থিত। “দাদা, জরুরী দরকার। একটু কথা বলতেই হবে।”
“ভিতরে এসো” বললেন বিধানবাবু। জুতোটা শুধু খুলেছেন, ট্যুরের ব্যাগটা তখনো বাইরের ঘরেই রয়েছে। তা হোক, সঞ্জয় তো ওনার ঘরের ছেলে। সোসাইটির সেক্রেটারি বলে কথা। যে সোসাইটির প্রেসিডেন্ট আবার বিধানবাবু স্বয়ং।
দিল্লির একটি মাঝারি সাইজের হাউসিং সোসাইটি এটি। দশটা বাড়ী, প্রত্যেকটিই চার তলা, দুটি করে ফ্ল্যাট। মাঝখানে একটা পার্ক, বেশ বড়ো সাইজের। এছাড়া আছে সোসাইটি অফিস, মেন্টেনেন্স অফিস, সামনে বড়ো গেট - সঙ্গে গার্ড রুম। পেছন দিকে একটা ছোট গেট আছে পদচারীদের জন্যে – আর তার লাগোয়া ছোট গুমটি ঘর – গার্ডের জন্যে। বেশ ছিমছাম সুন্দর সোসাইটি।
সোসাইটির শুরু থেকেই বিধানবাবু এটির প্রেসিডেন্ট, সঞ্জয় সেক্রেটারি। পাঁচ বছর হয়ে গেলো। সকলেই স্বীকার করে যে সোসাইটির ম্যানেজমেন্ট খুব ভালো। দু চারজন রাইভাল তো আছেই, তারা আড়ালে নিন্দে করে, সুযোগ পেলে পেছনে লাগে কায়দা করে।
“ওই বিক্সাপতি আবার ঝামেলা শুরু করেছে। এবার ধর্মীয় সঙ্গীত নিয়ে।”বললো সঞ্জয়, চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে।
“ধর্মীয় সঙ্গীত ? সোসাইটিতে ?” বিধানবাবু অবাক হলেন। কপালে ভাঁজ পড়লো ওনার।
এখানে একটু বলে রাখা উচিৎ যে বিধানবাবুদের সোসাইটিতে একটা কড়া নিয়ম – সোসাইটি কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান করবে না, করতে দেবেও না। অর্থাৎ দুর্গাপূজা, সরস্বতী পুজো, দোল, কীর্তন, ক্রিসমাস এসব হয় না ওঁদের সোসাইটিতে । তার বদলে হয় কালচারাল অনুষ্ঠান, রক্তদান শিবির, বার্ষিক মেলা ইত্যাদি। কমিটি মেম্বারদের (প্রধানত বিধানবাবু আর সঞ্জয়) বক্তব্য যে এই সোসাইটিতে কিছু মুসলমান ও খ্রিষ্টান থাকেন – তাই কোন হিন্দু অনুষ্ঠান করলে তাদের মনে আঘাত লাগতে পারে। তেমনি ঈদ বা ক্রিস্টমাস এসব পালন করাও চলবে না। এতোটা বাড়াবাড়ি না করলেও চলতো, কিন্তু প্রথম থেকেই এই প্রথা চালু আছে।
“হ্যাঁ।”সঞ্জয় বললো। “আমাদের এক সিকিউরিটি গার্ড নাকি ভোরবেলায় মা দুর্গার স্তোত্র গায়, তাতে ওর ঘুম ভেঙ্গে যায়। এবং ডিউটি চলাকালীন গায় – অর্থাৎ এটা তার ব্যক্তিগত ধর্মচর্চা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।”
“হুম। তা এই সিকিউরিটি গার্ডটির নাম কি গুপী নাকি ?” ঠাট্টার সুরে জিজ্ঞেস করলেন বিধানবাবু।
“প্রমোদ সরখেল। বাঙালি। পিছনের গেটে ডিউটি। নাইট ডিউটি চলছে মাসখানেক হোলো।”
“ঠিক আছে” বললেন বিধানবাবু। “কাল আমি ভোরে উঠে এক চক্কর হেঁটে নেবো অখন। ব্যাপারটা সরোজমিনে তদন্ত করে নেবো সেই সময়।”
“ওকে বস!”
***
পরদিন ভোরে উঠে হাঁটতে বেরোলেন বিধানবাবু। এমনিতে উনি ঘুমকাতুরে, কিন্তু সোসাইটির যাকে বলে সেক্যুলার চরিত্রটি যেখানে বিপন্ন, সেখানে সকালে তো উঠতেই হয়। হাফ চক্কর দিয়ে পেছনের গেটে এসে পৌঁছেই দেখলেন – ঠিক বটে – সিকিউরিটির গুমটি ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসছে গানের সুর। মায়ের আগমনী গান। “মা গো আনন্দময়ী, নিরানন্দ করো না...”। গলা মন্দ নয়।
বিধানবাবু গুমটির কাছে পৌঁছে একটা গলা খাকরানি দিলেন। গান বন্ধ হয়ে গেলো। গার্ডরুম থেকে একটু দরজা ফাঁক করে কে যেন উঁকি মারলো। তারপর ধড়মড় করে গার্ড ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে লম্বা সেল্যুট করলেন।
প্রমোদ সরখেল। বিধানবাবু দেখলেন একটি বুড়োটে রোগামতন লোক - আদ্যন্ত নিরীহ গোবেচারা গোছের দেখতে। এই ছিরির গার্ড দিয়ে কীরকম সিকিউরিটি হচ্ছে সে প্রশ্নটা আপাতত মনের পেছন দিকে ঠেলে দিয়ে আসল কথায় আসবার চেষ্টা করলেন বিধানবাবু।
“তুমি গান গাও নাকি ?”
“হ্যাঁ স্যার।”হাত কচলে বলে উঠলো প্রমোদ।
বিধানবাবু একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন। এই ধরণের নিরীহ লোকজনকে কড়া কথা বলতে ওনার একটু খারাপ লাগে। তায় আবার গান গাওয়ার মতো একটা তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে। শেষমেশ বার দুয়েক গলা খাকরে বললেন
“তা, রোজ গাও?”
“আসলে স্যার, পুজো আসছে তো। ওই পেছনের মাঠে ওরা প্যান্ডেলের কাজ শুরু করে দিয়েছে। আমার খুব ইচ্ছে ওই পুজো প্যান্ডেলে আমি একটা আগমনী গান গাইবো। পঞ্চমীর দিন রাত্তিরে সিলেকশান হবে। ওঁরা বলেছেন যদি আমার গাওয়া ভালো হয় তবে ওঁরা আমাকে গাইতে দেবেন। তাই কদিন খুব প্র্যাকটিস করছি।”এক নিঃশ্বাসে বলে ফেললো প্রমোদ।
বিধানবাবু কি বলবেন ভেবে পেলেন না। একে তো গলা এমন কিছু ভালো নয়, তায় সিকিউরিটি গার্ড হয়ে এই স্ট্যাটাস-সর্বস্ব দিল্লীতে পুজো প্যান্ডেলে গান গাওয়ার সুযোগ পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তার ওপর আবার ওই বিক্সাপতিটা গানের প্র্যাকটিসের ব্যাপারেই আপত্তি জানিয়েছে। মুশকিল ব্যাপার।
এই ফাঁকে প্রমোদ আবার বলতে শুরু করেছে - “আসলে স্যার আমার খুব পুজোর সময় আগমনী গান গাইতে ভালো লাগে। পুজোতে তো মা দুগগা তাঁর বাপের বাড়ী আসেন। সেই সময় আমারও মনে হয় আমার মেয়েটাও আমার কাছে বেড়াতে এসেছে। বিয়ে হওয়া ইস্তক ওকে দেখি নি তো। পাঁচ বছর হয়ে গেলো। ওর শ্বশুরবাড়ীর লোকেরা আসতে দেয় না। তাই চোখ বুজে মায়ের মূর্তির সামনে গান গাই আর মনে হয় এই আমার মেয়েটা সামনে এসে বসলো। তখন চোখে জল এসে যায় স্যার!”
***
বিধানবাবু বাকি রাউন্ডটা শেষ করছিলেন। মনটা বেশ খুশী খুশী। সমস্যাটার সুষ্ঠ সমাধান করতে পেরে একটা উড়ুউড়ু মেজাজ। ঘোর কম্যুনিস্ট হওয়া সত্ত্বেও নিজের অজান্তেই গুনগুন করে উঠলেন “সকলি তোমারই ইচ্ছা, ইচ্ছাময়ী তারা তুমি...”।
রাউন্ড শেষের মুখেই ওই বিক্সাপতিটার সঙ্গে মুখোমুখি দেখা। বিক্সাপতি কিছু বলবার আগেই বিধানবাবু একেবারে ফ্রন্টফুটে গিয়ে সাড়ে চুয়াত্তরের ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্টাইলে বলে উঠলেন
“আপনি মশায় বড়ো বেশী কথা কন!”
উত্তেজিত হলে বিধানবাবুর খাঁটি বাঙাল আত্মাটা জেগে ওঠে।
“কিউ কিউ, বিধানবাবু”, থতমত খেয়ে বললে বিক্সাপতি। বিক্সাপতি বেশ কিছুদিন কলকাতায় চাকরী করেছে, বাংলাটা কিছুটা বুঝতে পারে।
“আরে আপনাকে কে বলেছে ওই প্রমোদ – আই মিন ওই সিকিউরিটি গার্ড দুর্গাস্ত্রোত্র বা ধর্মীয় গান গাইছে ?” বিধানবাবু তেড়ে উঠলেন।
“হামি যে সুনলাম...” বিক্সাপতি মিনমিন করে বললো।
“তুমহারা মুণ্ডু সুনা। উও তো আসলমে মানে আপনি লাড়কি কে লিয়ে গানা গা রাহা থা। আমরা বাঙালীরা আপনা মেয়েকো মা বোলকে ডাকতা হ্যায়, সমঝা ? কিছু বোঝেন না, যা হয় একটা হুল্লোড় করে দিলেই হলো। হেঃ।”
একেবারে মাঠ-পার-করা-কভার-ড্রাইভে বিক্সাপতিকে সম্পূর্ণ বাকরুদ্ধ করে দিয়ে বিধানবাবু এগিয়ে চললেন। মেন গেটের বাইরের চা-ওয়ালাটা আজকাল নাকি সিঙ্গাড়া ভাজছে সকালের দিকে। নাই বা হলো সেই বাঙালি ছোট্ট ছোট্ট সিঙ্গাড়া – তবুও সিঙ্গাড়া তো! আজকে ওই কটা কিনে নিয়ে যাবেন সকালের জলখাবারের জন্যে।
আজকের দিনটা বড্ডো ভালো!!
(এই সংখ্যায় অতনু দে-র অন্য গল্পঃ 'ক্যাম্পে')