লিয়ার আজ ভারি আনন্দ। স্কুল থেকে ফিরে কাঁধের ব্যাগটা রাখতে না রাখতেই মাকে বলল, “জানো মা, আজ না স্কুলে খুব মজা হয়েছে। আমাদের স্কুলে একটা কী প্রোজেক্ট থেকে কয়েকজন লোক এসেছিল। তারা বলেছে তারা সারা ইন্ডিয়া ঘুরে ঘুরে বেশ কিছু স্কুলে যাচ্ছে আর সেখানকার বাচ্চাদের কাছ থেকে গল্প নিচ্ছে। তারপর সেই গল্পগুলোর মধ্যে থেকে যেগুলো সব চেয়ে ভাল হবে সেইগুলোকে নিয়ে ওরা একটা বই করবে। বাচ্চাদের লেখা গল্প অন্য বাচ্চারা পড়তে ভালবাসবে তাই নাকি ওরা এটা করছে। আমাদের স্কুলেও তাই প্রতি ক্লাস থেকে দুজন করে লেখা দেবে। তারপর টিচার পড়ে দেখে যেটা ভাল সেটা ওদের পত্রিকার জন্যে দেবেন। ক্লাস থ্রি থেকে আমাকে আর অঙ্গনাকে বেছে নিয়েছেন টিচার। আমাদের দুজনকে গল্প লিখতে হবে, কী মজা না? আর গল্পটা যদি ভাল হয় তাহলে ওদের বইতে বেরবে!”
মা শুনে বললেন, “বাহ, বেশ ভাল তো! লেখা কবে দিতে হবে?”
“সামনের সোমবার, দশ তারিখ,” লিয়া বলল।
বিকেলবেলা বাবা কাজ থেকে ফিরতে লিয়া বাবাকেও কথাটা বলল। বাবাও শুনে খুব খুশি, বললেন, “হ্যাঁ, বাচ্চাদের লেখা গল্প নিয়ে বই করলে বেশ ভালই হবে। অন্য বাচ্চারা পড়ে আনন্দ পাবে। তা তুমি কী নিয়ে গল্প লিখবে ঠিক করেছো?”
লিয়া উত্তর দিল, “হ্যাঁ, এটা অনেকদিন আগেকার গল্প হবে। তখনও এরোপ্লেনের আবিষ্কার হয়নি। একজন লোক সে পাখির মতন আকাশে উড়তে চায়, তাকে নিয়েই গল্প।"
লিয়ার গল্প বলার ক্ষমতা নিয়ে ওর মা বা বাবার কারো কোন চিন্তা নেই কারণ সে প্রচুর গল্প বানাতে পারে। ভাই টোকনকে সে সব সময় যত রাজ্যের হাবিজাবি গল্প বানিয়ে বানিয়ে বলে। সেগুলো যদিও মা-বাবা কোনদিন মন দিয়ে শোনেননি কিন্তু টোকন হাঁ করে শোনে! ওই গল্প শুনিয়ে লিয়া ভাইটিকে অনেকক্ষণ চুপটি করে বসিয়ে রাখতে পারে।
লিয়ার গল্প তরতর করে এগোতে লাগল। নিজে নিজেই লিখছিল সে, যেমন হোমওয়ার্কও সব নিজে নিজেই করে নেয়।
মাঝে মাঝে মাকে জানায় কেমন চলছে লেখা, যেমন সেদিন বলল, “জানো মা, আজকে লোকটা না অনেক পাখির পালক দিয়ে দুটো বিশাল ডানা বানিয়ে কাঁধে লাগিয়ে একটা উঁচু জায়গা থেকে লাফ দিয়ে পাখিদের মতন ওড়ার চেষ্টা করছিল! কিন্তু সেটা কী আর পারে? দুম করে মুখ থুবড়ে পড়েছে বেচারা!”
“ওমা, সেকি কাণ্ড! তা লোকটা উড়তে চাইছে কেন?”
“আসলে লোকটা নিজে চাইছে না, রাজামশাই চাইছেন। রাজার খুব শখ পাখির মতন উড়বেন তাই ওই লোকটাকে উনি কিছু দিনের সময় দিয়েছেন আর বলেছেন ওনার ওই ইচ্ছেটাকে সত্যি করতে হবে! তাই লোকটা মুশকিলে পড়ে গেছে আর চেষ্টা করে চলেছে!”
“বাহ, সুন্দর গল্প!”
মার কাছে উৎসাহ পেয়ে লিয়া খুশিতে ঝলমল করতে করতে বাকি গল্পটা লিখতে চলে গেল। ওর কখনও মনে হল না যে মা-বাবা বা বড়দের কারো সাহায্য নেওয়া উচিত, এটা তো ছোটদের জন্যে গল্প, ছোটরাই লিখবে সেটাই জানে ও।
ঠিক সময় গল্পটা শেষ করে টিচারকে দিল লিয়া। ইতিমধ্যে অঙ্গনাও তার গল্পটা নিয়ে এসেছে।
টিচার খুশি হয়ে বললেন, “তোমাদের দুজনের গল্পই নিশ্চয়ই খুব ভাল হবে কিন্তু মুশকিল হল ওরা প্রতি ক্লাস থেকে একটা করেই গল্প নেবে। তোমরা দুজনে ক্লাসে ফার্স্ট আর সেকেন্ড হও তাই আমি তোমাদের দুজনকে বলেছিলাম। এবার আমি দুটো গল্পই পড়ে দেখব। যেটা সব থেকে ভাল হবে সেটাই দেওয়া হবে। তোমাদের দুজনকেই গুডলাক। আমি আজকে পড়ে তোমাদের কালকে জানাবো।”
পরদিন লিয়া আর অঙ্গনার সঙ্গে ক্লাসের অন্য সবাইও ফলাফলের অপেক্ষায় ছিল। টিচার ক্লাসে আসতেই সবাই হইহই করে উঠল।
টিচার বললেন, “হ্যাঁ, আমি জানি তোমরা কার গল্প নেওয়া হল সেটা জানার জন্যে উদগ্রীব হয়ে রয়েছো! আমি দুটো গল্পই খুব মন দিয়ে পড়েছি। শোনো লিয়া, তোমার গল্পটা পড়ে আমি বুঝতে পেরেছি যে ওটা তুমি নিজেই লিখেছো। তুমি তো ক্লাস থ্রিতে পড়ো, তোমার বয়সে বা বুদ্ধিতে যতটা ভাল লেখা যায় তুমি ততটাই ভাল লিখেছো কিন্তু অঙ্গনার গল্পটা অনেক সুন্দর করে সাজানো। আমি বুঝতে পারছি যে ওর মা-বাবা নিশ্চয়ই ওকে সাহায্য করেছেন। একটা আপেল গাছ আর একটা বাচ্চা ছেলের কী ভাবে বন্ধুত্ব হল সেই নিয়ে গল্পটা। এখানে যেহেতু স্কুল আর ক্লাসের নাম জড়িয়ে আছে তাই আমি অঙ্গনার গল্পটাই নিতে বাধ্য হচ্ছি। লিয়া তুমিও যদি কোন একজন বড় কারও সাহায্য নিতে তাহলে তোমার গল্পটাও অসাধারণ হয়ে যেতে পারত, কিন্তু এখন তো আর সময় নেই।”
খুব মন খারাপ নিয়ে সেদিন বাড়ি ফিরল লিয়া। এদিকে মাও বাড়িতে ছিলেন না। কাজের লোক আরতিমাসি খাবার দিতে দিতে বলল, “দিদি টোকনকে নিয়ে তোমার মামার বাড়ি গেছে। তোমার মামিমা ফোন করেছিলেন মামার কী একটা শরীর খারাপ হয়েছে, তাই ওনাকে দেখতে গেছে। একটু বাদেই চলে আসবে।”
লিয়া চুপচাপ খেয়ে নিল। মাসিকে কী আর বলবে? মাসি তো কিছুই জানে না। খেয়ে উঠে সে ওদের ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদে গিয়ে এককোণে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। বাড়িতে কাঁদলে মাসি আবার হাজারটা প্রশ্ন করবে! এখন যা গরম ছাদে কেউ খুব একটা আসে না! কিছু ফুলের টব ইত্যাদি রয়েছে।
হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদছিল লিয়া হঠাৎ শুনল ফুলদাদু ওকে ডাকছেন, “আরে লিয়া যে এত গরমে ছাদে কী করছ? ওমা তুমি কাঁদছ কেন? কী হয়েছে?”
ফুলদাদু আর দিদা ওদের নিচের তলার ফ্ল্যাটে থাকেন। লিয়া আর টোকনকে খুব ভালবাসেন।
ফোঁপাতে ফোঁপাতে লিয়া ওনাকে সব বলল। দাদু ওর কথা শুনে প্রথমে একটু গম্ভীর হয়ে উঠলেন তারপর বললেন, “কাজটা তোমার টিচার ভাল করেননি, কিন্তু এর জন্যে কান্নার কী আছে? আরে তোমার টিচার লেখা নেননি তো কী হয়েছে আমি নেবো! আমি তো ‘শব্দজাল’ পত্রিকার সম্পাদক! আমাদের পত্রিকার কচি-কাঁচাদের আসরেতে তোমার লেখাটা ছেপে দেবো। তুমি কিছু ভেব না। আর তুমি লেখাটা নিজে লিখেছো বলেই আমি ওটা নেবো। তোমার মা-বাবা যদি তোমাকে সাহায্য করতেন তাহলে আমি ওই লেখা ছুঁয়েও দেখতাম না, সেটা তো তাহলে ওদের লেখা হয়ে যেত! তোমার টিচারের তো ভারি অন্যায়, নিজের কাজ যে নিজে করতে হয় উনি বুঝি জানেন না? যাও চোখ মুছে ঘরে গিয়ে লেখাটা আমাকে এনে দাও দেখি। পুজোসংখ্যাতেই দিয়ে দেবো।”
লিয়া চোখের জল মুছে ছুটে নিচে চলে গেল গল্পটা নিয়ে আসতে।
###
‘চিকু খরগোশের কেরামতি’ গল্পটার শেষ লাইনটা লিখে চশমাটা খুলে টেবিলে নামিয়ে রাখলেন লেখিকা ক্যামেলিয়া সেন। চিকু খরগোশ সিরিজের চতুর্থ বই হবে এটা। প্রকাশক আশ্বাস দিয়েছেন যে প্রথম তিনটে বই বেশ হই হই করে বিক্রি হচ্ছে। ফুলদাদু গল্পটা ওনাদের পত্রিকাতে ছাপা থেকে শুরু, তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। আর এখন তো তিনি পুরোদস্তুর লেখিকা। অনেক নামকরা পত্র-পত্রিকাতে লেখেন। অঙ্গনাই বরং ওই একটা গল্পের পর আর কিছুই তেমন লেখেনি।