• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৭ | জুন ২০১৭ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • গৌরকিশোর ঘোষের 'দাসত্ব নয়, স্বাধীনতা': স্মরণ ও সমালোচনা : চম্পাকলি আইয়ুব

    দাসত্ব নয়, স্বাধীনতা; গৌরকিশোর ঘোষ; সম্পাদনাঃ সোহিনী ঘোষ; প্রথম প্রকাশ: জুন ২০১৫; আনন্দ; পৃষ্ঠাঃ ১৬০; ISBN: 978-93-5040-559-8

    প্রায় বিয়াল্লিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া ‘জরুরী অবস্থা’ নামে ভারতীয় গণতন্ত্রের এক লজ্জাজনক অধ্যায়কে মনে না করিয়ে এই বইটি সম্বন্ধে কিছু বলা সম্ভব নয়। ১৯৭৫ সালের ২৫শে জুন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গাঁধী ভারতবর্ষের অভ্যন্তরীন শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার নামে ‘জরুরী অবস্থা’ জারি করলেন। ফলে, দেশবাসীর মৌলিক অধিকার নানাভাবে খর্ব করা হ’ল। সরকারী অনুমোদন ছাড়া কোন খবর বা রচনা ছাপা নিষিদ্ধ হ’ল, কারারুদ্ধ করা হ’ল বিরোধী দলের অনেক রাজনীতিক ও বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের। স্বভাবতই, নাগরিক অধিকারে হস্তক্ষেপ ও ‘প্রেস সেন্সরশিপ’-এর কারণে সারা দেশে জনগণের মধ্যে – বিশেষত বুদ্ধিজীবী মহলে - জমতে শুরু করে অসন্তোষ। ‘কলমের স্বাধীনতা হরণ’ যে সাংবাদিক-লেখকের কাছে মাতৃবিয়োগ তুল্য সেই গৌরকিশোর ঘোষ প্রথমে মাথা মুড়িয়ে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেন। সরকারী নীতির কড়া সমালোচনা করে লেখা তাঁর দু’টি রচনা সেন্সরশিপ-এর কোপে পড়লে তিনি সেই সেন্সরশিপকে অগ্রাহ্য করে শ্রী জ্যোতির্ময় দত্ত-সম্পাদিত ‘কলকাতা’ পত্রিকায় তা ছাপেন। ঐ পত্রিকায় একই ভাবে প্রকাশিত হয় লেখকের তেরো বছরের পুত্রকে লেখা ‘পিতার পত্র’ খানাও। সম্ভবত এই সমস্ত আইন-না-মানা কাজের ফলে ৬ই অক্টোবর, ১৯৭৫ পুলিশ তাঁকে ‘বিনা গ্রেপ্তারী পরোয়ানায়’ MISA (Maintenance of Internal Security Act)-য় আটক করে। ‘মিসা’-বন্দী হিসেবে কারাবাস-কালে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন ও তাঁকে বেশ কিছুদিন হাসপাতালেও কাটাতে হয়।

    ‘মিসা’-য় বন্দী থাকাকালীন গৌরকিশোর ঘোষ প্রচুর লিখেছেন – গদ্য, কবিতা ও ছড়া, আত্মীয় বন্ধুকে চিঠি, দিনলিপি - নানা কিছু। লেখকের কনিষ্ঠা কন্যা সোহিনী ঘোষ তাঁর পিতার সেইসব লেখা যা ‘নানাখানা হয়ে ছড়িয়ে ছিল’ তাকে শুধু একত্রিত করেননি, সুবিন্যস্ত ভাবে পরিবেশন করেছেন এই বই-এর পাঁচটি পর্বে। এই বইটির মূল্যবান মুখবন্ধটি লিখেছেন শ্রী অশোক মিত্র মহাশয়। সম্পাদনার প্রশংসা করার আগে উল্লেখ করি সম্পাদিকার লেখা অনবদ্য ‘ইতিকথাটি’র। অসাধারণ ভাষায়, ভাবাবেগকে কিছুমাত্র প্রশ্রয় না দিয়ে তিনি পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছেন এক ঐতিহাসিক ঘটনার। বই-এর শেষভাগে পরিমিত শব্দ-ব্যবহারে যে ‘প্রসঙ্গকথা’ রয়েছে তা বইটি পড়ে বোঝার ও লেখককে জানার জন্য সাহায্য করবে।

    প্রথম পর্বেই রয়েছে ‘পিতার পত্র’ যার কথা আগেই উল্লেখ করেছি। এক শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সম্মুখীন হবার আগে লেখকের মনে যে তাঁর দুই সত্তার দ্বন্দ্ব তা প্রকাশ পেয়েছে এই চিঠিতে (...‘একদিকে তোমরা, তোমাদের নিরাপত্তা, আর অন্যদিকে আমি, মানুষ হিসেবে আমার আত্মমর্যাদা। প্রশ্ন উঠেছে কাকে বিপন্ন করে কাকে রক্ষা করব! অহরহ এই প্রশ্ন আমাকে অস্থির করে দিচ্ছে, জর্জরিত করে তুলছে। ...আমি মনে করি আমার লেখার অধিকার, আমার মত প্রকাশের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার অর্থ আমার অস্তিত্বকে হত্যা করা।...’)। ছ’পৃষ্ঠা-ব্যাপী এই পত্রটি পড়লে শুধু যে লেখকের সমাজনীতি ও রাজনীতি বিষয়ে গভীর জ্ঞান সম্বন্ধে পাঠক অবহিত হবেন তাই নয় – তাঁর অপরিমেয় সাহস ও মনোবল সম্বন্ধেও ধারণা হবে। এই পর্বে আর দু’টি বিশেষ রচনা হ’ল ‘প্রধানমন্ত্রীকে খোলা চিঠি (ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন প্রসঙ্গে গুটিকয়েক কথা)’ এবং ‘দাসত্ব নয়, দাসত্ব নয়, স্বাধীনতা’। ‘মিসা’-বন্দী হিসেবে কারাগারে তাঁর ওপর নজরদারির অবধি ছিল না কিন্তু প্রহরীদের চোখ এড়িয়ে শ্রীগৌরকিশোরের লেখা এই সরকার-বিরোধী দু’টি রচনা বাইরে আসে এবং ‘জরুরী অবস্থা’ চলাকালীন নানা ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়ে চারদিকে ছড়িয়েও পড়ে।

    বেশ কিছু চমৎকার ছড়া ও কবিতাও বইটিতে রয়েছে। এই রচনাগুলি যেন অন্য আরেক গৌরকিশোরকে চেনায়। অবিশ্বাস্য রকম শক্তিশালী ‘এই কি নিয়তি (কবি শঙ্খ ঘোষ, প্রিয়বরেষু)’ কবিতাটি। অন্যদিকে, স্ত্রী-কে উদ্দেশ্য করে লেখা কবিতাটিতে (‘পতি বিলাপ’) দক্ষ বাজিকরের মতো শব্দ নিয়ে খেলার মধ্যে দিয়ে তিনি তাঁর অতি-সূক্ষ্ম রসবোধের পরিচয় রেখে গিয়েছেন।

    চতুর্থ পর্বে গ্রথিত পারিবারিক চিঠিগুলি এই সংকলনের এক মহার্ঘ সংযোজন। সেইসব চিঠিপত্র পড়তে পড়তে মনে হয় যে রাজশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত মানুষটির অস্ত্র ছিল তাঁর কলম আর তাঁর বর্ম বোধহয় তৈরী ছিল দাম্পত্যপ্রেম, অপত্যস্নেহ, মাতৃভক্তি ও বন্ধুপ্রীতি দিয়ে। একটি চিঠিতে স্ত্রীকে তিনি লিখছেন ‘...তুলু, তুমি আমার পাশে আছ। তোমার আত্মমর্যাদা বোধ আমাকে সদাই সংগ্রামে সাহস জোগায়। তুমি কারোর কাছে কোনও সুবিধা চাও না - এটাই আমার জোর।...’ স্ত্রীকে লেখা আরেকটি চিঠিতে পাই ‘...যে সুস্থ আবহাওয়ায় আমরা নিঃশ্বাস নিয়েছি, আমাদের ছেলেমেয়েরা তাদেরও নিঃশ্বাসবায়ুর সঙ্গে সেই নির্মলতা অন্তরে গ্রহণ করুক, দায়িত্বশীল পিতা হিসেবে তার ব্যবস্থা করা আমার কর্তব্য বলে বিবেচনা করেছি এবং বিবেকের নির্দেশে সেই কর্তব্য সম্পাদনে এগিয়েছি। এর বাইরে আমি আর কিছুই করিনি। কোনও বড় কাজ নয়, কোনও মহৎ কাজ নয়, শুধুমাত্র কর্তব্যটুকু করেছি। এবং করবও। প্রলোভন, ভ্রূকুটি, আজীবন কারাবাস অথবা শিরশ্ছেদ – কিছুই আমাকে নিবৃত্ত করতে পারবেনা।...’ তাঁর মাকে লেখা চিঠিতে কখনো রয়েছে মায়ের স্বাস্থ্য নিয়ে দুশ্চিন্তা (‘... ওখানে শীত নিশ্চয়ই বেশী পড়েছে। এখন দিনকতক ঠাণ্ডা জলে চান করো না...’) আবার কখনো রয়েছে একটু রসিকতা (‘...দেনা-পাওনা সব তোমার ঠাকুরকে বুঝে নিতে বলো। এতো যে খাওয়ালে পরালে তা এখন সে ব্যাটা এসে বুঝে নিক সব। ...ডাকো ব্যাটাকে। নাকে সর্ষের তেল দিয়ে কোন চুলোয় ঘুমুচ্ছে সেই অকর্ম্মার ধাড়িটা।...’)। পুত্র-কন্যাকে লেখা চিঠিতে তাদের পড়াশোনা নিয়ে উদ্বেগের কথা যেমন আছে তেমনি আছে তাদের নানাকাজে উৎসাহ বা উপদেশ দেওয়া। স্পেশাল সেল-এর বাসিন্দা পিতা তাঁর কনিষ্ঠা কন্যাকে এক চিঠিতে নিজের বাসস্থান নিয়ে লিখছেন ‘...এই তো আমার প্রায় নাগালের কাছেই একটা বিরাট স্বর্ণচাঁপার গাছ। দোতলার ছাদ ছাড়িয়ে তার মগডাল উঠে গিয়েছে – এবং আশ্চর্য, আমি তো স্বর্ণচাঁপা ভালোবাসি, তাই এ-ডালে ও-ডালে একটা দুটো করে ফুল আমার জন্য জমিয়ে রেখেছে এখনও।...’। অনিশ্চয়তা ও অশান্তির মধ্যেও সুন্দরকে খুঁজে নেওয়ার এই ক্ষমতাও বোধহয় তাঁকে রাজশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করবার সাহস জুগিয়েছিল।

    ‘দিনলিপি’র পর্বটি পড়লে বোঝা যায় যে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন লেখকের নিত্যসঙ্গী। তাঁর লেখার অংশবিশেষ কখনো লিখে রাখছেন আবার কখনো বইতেই ‘নোট’ লিখছেন সন্তানদের উদ্দেশ্যে যাতে তারা ঐ অংশটি মুখস্থ করে অথবা ‘মনে গেঁথে রাখে’। মহাত্মা গান্ধী, চিত্তরঞ্জন দাস, সলঝেনিত্‌সিন বা অন্যন্য লেখকের লেখা থেকেও পছন্দের অংশ তিনি লিখে রেখেছেন। ৯।৯।৭৬ ও ১০।৯।৭৬-এ লিখিত দু’টি পাতা বারবার পড়তে হয়। স্নেহময় পিতার পুত্র-কন্যাকে সম্বোধন পাঠকের মনকে আর্দ্র করে। তিনি তাদের শিখিয়েছেন ‘গান ও জ্ঞান লোককে ভালবাসতে শেখায়’, ‘জগতের কোনও কাজই ছোট নয়’, ‘মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণ ভালোবাসা’ ইত্যাদি। এই মানুষকে ভালবাসতে পারার গুণটি তাঁর নিজের মধ্যে যে পরিপূর্ণ-রূপে ছিল তার পরিচয় রয়েছে এই বইটির নানা জায়গায় (যেমন হাসপাতালে ওঁকে যাঁরা পাহারা দিতেন তাঁদের জন্য মশা মারার ওষুধ আনানো, সেখান থেকে ছুটির আগে ডাক্তার নার্স-দের খাওয়ানোর জন্য স্ত্রীর কাছে পেরাকি বানিয়ে আনবার অনুরোধ, ইত্যাদি)। নানারকম জ্ঞান-গম্ভীর লেখালেখির মধ্যে হঠাৎ দেখি সাধারণ সংসারীর মতো একদিন (২।১১।৭৫) তিনি লিখে রেখেছেন জিনিসপত্রের দাম (‘মাংস ৬ টাকা কি, মাছ ৫ টাকা কি, ...চাল ২টাকা কি, দুধ ১ টাকা কি...ইত্যাদি’)! আরতি সেন (অধ্যাপিকা) ও গৌরী আইয়ুব (অধ্যাপিকা ও সমাজসেবী) ছিলেন লেখকের বিশেষ বন্ধু। গৌরী আইয়ুব-এর চিঠি না পাওয়ায় তাঁকে উদ্দেশ্য করে তিনি দিনলিপিতে লিখেছেন

    ‘গৌরী,

    তুমি আর আরতি আমার ডানা,
    একটা ডানা যদি সাড়াই না দেয়
    তবে বুলবুল বেচারি উড়বে কী করে’

    এই তিনটি পঙক্তি বুঝিয়ে দেয় যে কেন সম্পাদিকা আক্ষেপ করেছেন যে ‘বন্ধুদের চিঠিগুলি’ – বিশেষ করে ‘গৌরী আইয়ুবকে লেখা চিঠিগুলি’ উদ্ধার করা যায়নি বলে। বইটি পড়তে পড়তে সে আক্ষেপ আমারও হচ্ছিল। আমার শাশুড়ি-মা গৌরী আইয়ুবের সযত্নে-রক্ষিত বিরাট চিঠির সংগ্রহে কেন যে শ্রী গৌরকিশোর ঘোষের লেখা একখানি চিঠিও নেই তা আমাদের কাছেও এক বিস্ময় হিসেবে রয়ে গেল।


    স্মরণ

    প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সাংবাদিক শ্রী গৌরকিশোর ঘোষের সঙ্গে আমার কবে প্রথম দেখা হয়েছিল তা ঠিক মনে করতে পারি না।


    পূষন ও চম্পাকলির বিবাহ-উৎসবে তোলা ছবি, ৫ পার্ল রোডে।
    উপরে মাঝখানে গৌরী আইয়ুব, বাঁ-দিকে মৈত্রেয়ী দেবী,
    নিচে গৌরকিশোর ঘোষ (১৯৮১)

    তবে আমাদের বিয়েতে (১৯৮১ সাল) উনি অন্যতম সাক্ষী ছিলেন – ঠিক যেমনটি ছিলেন আমার শ্বশুর-শাশুড়ি (শ্রদ্ধেয় আবু সয়ীদ আইয়ুব ও গৌরী আইয়ুব)-র বিয়েতে। আমার স্বামী পূষনের দেখাদেখি আমিও ওঁকে ‘গৌরকাকা’ ও ‘তুমি’ ব’লে সম্বোধন করতাম। ওঁর সঙ্গে আলাপ হবার আগে থেকেই কাকার রচিত গল্প-উপন্যাস-রম্যরচনার আমি বিশেষ অনুরাগী ছিলাম। অন্যদিকে, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ওঁর বিশেষ অবদানের কথাও জানতাম – বিশেষ করে জানতাম ‘জরুরী অবস্থা’-র সময় ‘প্রেস’-এর স্বাধীনতা রক্ষার জন্য ওঁর অপরিসীম চেষ্টা ও কারাবাসের অবিশ্বাস্য সব কাহিনী। আমাদের বিয়ের দিনের কথায় ফিরি। আমি বাবা-মা-র অমতে বিয়ে করেছিলাম বলে আমার পিতৃ-পরিবারের কেউ আমাদের বিয়েতে যোগদান করেননি। রাত্রে প্রীতিভোজ-শেষে আমার শাশুড়ি-মা পূষন্ ও আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, ‘গৌরের সঙ্গে তোমরা চম্পার পিত্রালয়ে যাও। আমার আশা যে গৌর বুঝিয়ে বললে তোমাদের বিবাহ ওঁরা মেনে নেবেন’। অতএব ঈষৎ হতভম্ব ও উৎসবের-সাজে-সজ্জিত আমরা দু’জন গৌরকাকার সঙ্গে রওনা হলাম আমার পিত্রালয়ের উদ্দেশ্যে। গন্তব্যে পৌঁছে শাশুড়ি-মায়ের ব্যবস্থা মতো আমাদের গাড়িতে বসিয়ে রেখে কাকা গেলেন আমার পিতাকে বোঝাতে যাতে উনি এই বিয়ে মেনে নেন। গাড়ির ভেতর থেকেও বুঝতে পারছিলাম যে আমার প্রতিবেশীরা তাঁদের জানলা বা বারান্দা থেকে বেশ উঁকিঝুঁকি দিয়ে আমাদের দেখছেন। সেদিন ছিল শারদ পূর্ণিমা কিন্তু সেবার আমার পিত্রালয়ে পুজো হয়নি। বাড়ির পরিবেশ থমথমে কিন্তু কাকাকে সাদর অভ্যর্থনা করলেন আমার পরিবার। মা নিঃশব্দে কেঁদে চলেছেন, বাবা কখনো রুদ্র আবার কখনো করুণ। কাকা অনেক চেষ্টা করলেন কিন্তু আমার বাবা তাঁর সিদ্ধান্তে অনড়। বাবা ও গৌরকাকা দু’জনেই ছিলেন হৃদরোগী। ফলে, খানিকক্ষণ এহেন উত্তেজনা-পূর্ণ পরিস্থিতি চলার পরে দু’জনেই অসুস্থ বোধ করতে লাগলেন। কাকা পকেট থেকে তাঁর নিত্যসঙ্গী ওষুধ সরবিট্রেট বের করে নিজে একটা ট্যাবলেট মুখে রেখে বাবার দিকে তা সিগারেট এগিয়ে দেবার ভঙ্গীতে বললেন, ‘আপনার কি এটি চলে?’ বাবা বিনা বাক্যব্যয়ে ওষুধটি কাকার কাছ থেকে নিয়ে মুখে দিলেন। এরপর দু’জনে একটু ধাতস্থ হ’লে গৌরকাকা আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। আমার মা-কাকিমা-বৌদি গাড়ির কাছে এসে আমাদের আশীর্বাদ করেন কিন্তু বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারেন না। ফেরার পথে কাকা হাসতে হাসতে আমাদের ঐ সরবিট্রেট-আখ্যান বলেন। আশ্চর্যের কথা অনেক বুঝিয়েও উনি আমার বাবাকে যে রাজী করাতে পারেননি তা নিয়ে ওঁর আচরণে সেদিন বা পরেও আমার বাবার প্রতি বিন্দুমাত্র ক্ষোভের কোনো চিহ্ন দেখিনি। যথাকালে অবশ্য আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয় ও কাকা-কাকিমা আমার শাশুড়ি-মা-সহ আমার পিত্রালয়ে নানা সময়ে নিমন্ত্রিত-ও হ’ন।


    ধুতি-ফতুয়া বা ট্রাউজার্স-হাফ শার্ট-পরা, মাথা-ভরা কোঁকড়ানো চুল, মোটা ফ্রেমের চশমা-পরা গৌরকাকার জীবনে বিলাসিতার কোন স্থান ছিল না। কাকা যে কী অপরিসীম স্নেহপ্রবণ ও রসিক মানুষ ছিলেন সে কথা লিখে বোঝানো কঠিন। উনি ছিলেন আমার দেখা এক বিরল মানুষ যাঁর চোখে হাসির ঝিলিক দেখা যেত। যেকোনো মজার আখ্যান বলবার সময় কাকা নিজেও খুব হাসতেন। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে মিশতে পারার এক অনন্য ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন তিনি। একদিন আমার শাশুড়ি-মাকে বলেছিলেন, ‘জানো গৌরী, লোকজন বাজারে গিয়ে মাছওয়ালার সঙ্গে যতো না দরদাম ক’রে তার চেয়ে বেশী করে স্বল্পপুঁজির শাকওয়ালির সঙ্গে!’ গৌরকাকা ও আমার শাশুড়ি-মা মানুষকে ভালবাসতে জানতেন। দু’জনেরই ব্যক্তিত্ব এমন ছিল যে ওঁদের সঙ্গে একবার আলাপ হ’লেই মানুষের মনে ওঁরা চিরদিনের জন্য থেকে যেতেন। এঁরা দুজনেই হাজার রকমের দায়িত্ব সত্ত্বেও পরিচিত ও বন্ধুদের ছোট-বড় নানারকম সমস্যায় নির্দ্বিধায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন।

    বিয়ের পর যে এক বছর আমি কলকাতায় ছিলাম তখন গৌরকাকা ছাড়া ওঁর স্ত্রী শীলাকাকিমা ও ওঁদের দুই মেয়ের সঙ্গেও আমার খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল। শীলাকাকিমা ছিলেন সহজ, সহানুভূতিশীল ও স্নেহময়ী মানুষ কিন্তু তিনিই আবার ছিলেন সংগ্রামরত স্বামীর শক্তির অন্যতম উৎস। অল্পদিনেই আমি বুঝতে পারলাম যে এই দুই পরিবারের ঘনিষ্ঠতা ‘বন্ধুত্ব’ পার হয়ে ‘আত্মীয়তা’কেও ছাপিয়ে গিয়েছে। এমনি যাতায়াত তো ছিলই তবে আমার শ্বশুরমশাইএর জন্মদিনটিতে অতি অবশ্য ওঁরা আমাদের বাড়িতে, ৫ পার্ল রোড-এ আসতেন। পরে, পূষন্‌ ও আমি মুম্বাইবাসী হ’লেও, কলকাতায় গেলে সব সময় গৌরকাকার বাড়িতে দেখা করতে যেতাম। যথাকালে আমাদের কন্যার সঙ্গেও গৌরকাকা-কাকিমার নাতনীদের বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল।

    আমাদের বিয়ের পরের বছরেই আমার শ্বশুর-শাশুড়ি ও গৌরকাকা-কাকিমা-সহ ওঁদের তিন বন্ধুদম্পতির বিয়ের পঁচিশ বছর পূর্ণ হয়। অন্য দুই দম্পতি হ’লেন নরেশ ও অর্চনা গুহ এবং সুপ্রিয় ও রিক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই উপলক্ষ্যে আমার শাশুড়ি-মা-এর উৎসাহে ও ব্যবস্থাপনায় এই চার দম্পতি আমাদের বাড়িতে একদিন একসঙ্গে হয়েছিলেন। সেই সন্ধেয় খাওয়াদাওয়ার আগে এক অভিনব আসরে এই আট বন্ধু প্রত্যেকে গোড়ের মালা গলায় দিয়ে বসে শুনিয়েছিলেন নিজের নিজের জীবনসাথীর সঙ্গে প্রথম আলাপ হওয়ার কাহিনী। পূষন্ ও আমি ছাড়া আর কারোর ছেলেমেয়ে সেই সন্ধেয় উপস্থিত ছিল না আর আমাদের জন্য সে ছিল হাসি-গল্পে-ভরা এক অবিশ্বাস্য সুন্দর অভিজ্ঞতা! এখন ভাবলে খারাপ লাগে যে সেই অমূল্য সন্ধ্যাটি সম্বন্ধে তখন-তখনি কিছু লিখে রাখিনি।

    বিয়ের এক বছর বাদে মুম্বাইতে এসে আমি পূষনের সঙ্গে ওর হস্টেল-এ থাকতে শুরু করলাম। কোনো কাজে মুম্বাইতে এলে কাকা আমাদের সঙ্গে দেখা করে যেতেন। কখনো কাকিমাও ওঁর সঙ্গে থাকতেন। সেইভাবে আমাদের ঐ এক-ঘরের সংসারে কাকা-কাকিমাকে কয়েকবার আপ্যায়ন করবার সুযোগ পেয়েছিলাম। গৌরকাকা আসবেন জানলে আমাদের সাহিত্য-অনুরাগী বন্ধুরাও এসে হাজির হ’তো আর অনেকক্ষণ ধরে চলতো আমাদের নানা বিষয় নিয়ে জমাটি গল্পের আসর। আমাদের জীবনের সংগ্রহে ঐ দিনগুলো এক উজ্জ্বল সংযোজন। কথায় কথায় কাকা একদিন বলেছিলেন যে কোনো গল্প বা উপন্যাস লেখবার সময় তার চরিত্রদের কথোপকথন উনি শুনতে পান। কী অভিনব কথা অথচ কতো সহজভাবে উনি বলেছিলেন!

    ১৯৯৪-এর ডিসেম্বরে আমরা দু’জন আমার শাশুড়ি-মা ও শিশুকন্যাকে নিয়ে পুরী বেড়াতে গিয়েছিলাম। ওখানে গিয়ে জানলাম যে গৌরকাকা তখন সপরিবারে পুরীতে আছেন। একদিন বিকেলে আমরা চারজন ওঁদের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। কাকার তখন শরীর বেশ খারাপ, কথা বলার ক্ষমতা সীমিত। আমরা যখন রিক্সা থেকে নামছি, বারান্দা থেকে উনি আমাদের দেখতে পান। কাকিমা ভেতরে বিশ্রাম করছিলেন। কাকা তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে কাকিমাকে বলেন, ‘ওঠো, ওঠো – চম্পাকলিরা এসেছে।’ তারপর দুই পরিবারের তিন প্রজন্ম একসঙ্গে হওয়াতে হাসি-গল্পে সেই বিকেলটা আমাদের জমজমাট হয়ে উঠলো। সেদিনটির কথা মনে পড়লে এখনো আমার বড় ভাল লাগে। বিশেষ করে, কাকা যে পুরনো বন্ধু ‘গৌরী’ বা যাকে জন্ম থেকে চেনেন সেই ‘পূষন্’-এর নাম না করে ‘চম্পাকলিরা এসেছে’ বলেছিলেন তাতে সেদিন আমার এক অনির্বচনীয় আনন্দ হয়েছিল! নেহাতই ছেলেমানুষী কিন্তু সেই আনন্দ-মুখর বিকেলটির মতো কাকার ঐ কথাক’টিও আমার জীবনের আরেক মূল্যবান সঞ্চয়।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments