কাঠ-চাঁপা গাছটার তলা দিয়ে যেতে গিয়ে নিচু ডালে মাথা লাগতেই দুটো ফুল ঠিক পায়ের সামনে পড়লো। অমনি অদিতির মনটা ভারি ভালো হয়ে গেলো।
গাছটা ওর টিচার্স কোয়াটার থেকে কলেজে যাবার সোজা রাস্তায় পড়ে না। পীচের রাস্তা ছেড়ে একটা চোরা পথ ডানদিকে চলে গেছে। গাছে মোড়া সবুজ নিস্তব্ধ পথ। কেউ বড় একটা এই রাস্তায় আসে না। অদিতির খুব পছন্দের রাস্তা এটা। ঘাসের ওপর ইট ফেলা পথ, দুপাশের জুঁই আর কামিনী ফুলের ঝাড়, আর থেকে থেকে একটা করে কাঠ-চাঁপা গাছ। কিছুটা রাস্তায় ইটগুলো নেই, সেখানে ঘাসের ওপর পা ফেলে যেতে হয়। ভিজে ঘাসের শিরশিরে ঠান্ডা ভালোলাগাটা মেখে পথ চলতে বেশ লাগে ওর। এটাই ওর কলেজে যাবার নিয়মিত রাস্তা।
আজ দেরি হয়ে গেছে। নতুন সেশন আজ শুরু, নতুন ছেলেমেয়ের দল আজ আসবে। তার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে সকালে খাবার সময় হয় নি। ক্লাসে যাবার আগে চট করে ক্যান্টিনে কিছু খেয়ে নিতে হবে। শাড়ির আঁচল টেনে নিয়ে অদিতি দ্রুত পা চালালো। জুঁইফুলের গন্ধ উপেক্ষা করে। এক ঝলক মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রাখলো চলতে চলতেই।
না, কোন মেসেজ নেই। ওয়াটস-অ্যাপ, ফেস-বুক বা সাবেকি এস-এম-এস - কোনটাই নেই। স্ক্রিন খালি। রোজকার মতন।
দীর্ঘশ্বাস ফেললো অদিতি। অভ্যাস হয়ে গেছে, তবুও বুদ্ধিহীন মানবহৃদয় অকারণে আশা নিয়ে বেঁচে থাকে।
কোথায় যে গোলমালটা, আজো বুঝতে পারে নি অদিতি। ডক্টরেট করবার সময়েই ভালোবাসা হয়েছিলো নীতিনের সঙ্গে, বিয়েও করেছিলো ডক্টরেট করতে করতেই। দুটি পরিবারের একই সামাজিক স্তরের, তাই রুচির মিল ছিলো, মনের তো ছিলই। দুজনেই সাহিত্য ভালোবাসতো, ভালোবাসতো কবিতা, রবীন্দ্রসঙ্গীত। অথচ বিয়ের মাত্র একমাসের মধ্যেই তাদের দাম্পত্যে ভাঁটার টান এসে গেলো। নিঃশব্দে নীতিন কেমন দূরে সরে যেতে লাগলো - অদিতির সঙ্গ তার ভালো লাগে না, এমনকি দৈহিক সম্পর্কেও তার অনীহা। কোন বাকবিতণ্ডা বা ঝগড়া হয় নি কোনোদিন; শুধু নীরবে তাদের বিবাহ রিক্ত হয়ে গেলো। কিছুদিন পরে নীতিন চাকরি নিয়ে চলে গেলো কলকাতার বাইরের একটা ছোটো শহরে – অদিতিকে নিয়ে যাবার প্রস্তাব পর্যন্ত দিলো না। অবশ্য জায়গাটা নিতান্ত অজ পাড়াগাঁ, নিয়ে যেতে চাইলে অদিতি মুশকিলেই পড়তো হয়তো। এই ভাবে বছর-খানেক কেটে গেলো, অদিতির ডক্টরেটও শেষ হলো। চাকরী নিয়ে চলে গেলো কলকাতার বাইরে, নতুন খোলা ইন্দ্রপ্রস্থ ইউনিভার্সিটিতে। ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে থাকে সে, একলাই। দুবছর কেটে গেছে, নীতিন কোন খবর নেয় না। সেই অর্থে বিয়েটা নিতান্ত খাতায় কলমেই টিঁকে আছে। অদিতি সবদিক থেকেই একা।
এখন আর কষ্ট হয় না অদিতির। কাজের মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছে সে - ছাত্রদের পড়ানো, নিজের লেখালেখি, তাছাড়া বাড়ির কাজ তাকে মন খারাপ করার সময় দেয় না। মাঝে মাঝে হলেও আছেন রবীন্দ্রনাথ ও তার গান। সত্যিই সে ভালো আছে।
পুরোনো কথা ভাবতে ভাবতে ক্যান্টিনের সামনে পৌঁছে গিয়েছিলো অদিতি। চটকা ভেঙে মুখ তুলে অদিতি দ্রুত পায়ে ঢুকে পড়লো। সময় বিশেষ নেই।
ক্যান্টিনে বেশি ভিড় নেই। একটি ছেলের গ্রুপ আড্ডা মারছিলো, ওকে দেখে চুপ করে গেলো। কে যেন পেছন থেকে বললো, “অদিতিদি – প্রথম ক্লাসটা ওনারই।” আরেকজন চাপা গলায় বললো “ঘ্যামা দেখতে রে, মাইরি।” অদিতি না শোনার ভান করে এগিয়ে গেলো। এসব অভ্যাস হয়ে গেছে তার।
ক্লাসে এসে দেখলো ওই ছেলের দল প্রথম বেঞ্চে বসেছে। তার দিকে তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে গা-টেপাটেপি, চাপা মন্তব্য চলছে। অদিতি পাত্তা দিলো না। ছাত্ররা তো এসব একটু আধটু করবেই। অতো গায়ে মাখলে চলে না।
ক্লাসে পড়া চলছে। অদিতি পড়াতে ভালবাসে, পড়ায়ও ভালো। নিরসভাবে না পড়িয়ে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করে পড়ায়। এতে ওরাও উৎসাহ পায়, অদিতিরও ভালো লাগে। একটু বাদে অদিতি ওই প্রথম বেঞ্চের ছেলের দলের কথা ভুলেই গেলো।
এক সময় একটু যখন ফাঁকা, অদিতি খেয়াল করলো প্রথম বেঞ্চের একেবারে ডানদিকে বসা ছেলেটিকে। ধারালো মুখ, কোঁকড়ানো চুল, পাতলা ঠোঁট। অল্প একটু দাড়ি তার চেহারায় কেমন যেন এক কোমলতা দিয়েছে। আর তার গভীর দৃষ্টি একাগ্রভাবে তাকিয়ে আছে অদিতির দিকে। মুগ্ধতা, আবেশ আর তীব্রতার এমন মিশ্রণ অদিতি কারোর চোখে আগে দেখে নি। একটা শিরশিরে ভালোলাগা অদিতির শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেলো।
অদিতি জানে সে সুন্দরী। সেই অর্থে ডাকসাইটে সুন্দরী নয়, তবে তার মুখশ্রী মিষ্টি। কাজল-টানা দীঘল চোখ, সুডৌল মুখে ছোট্ট চিবুক আর গালের টোলটি ভারি মনোরম। তার ফিগার চমৎকার – মেদহীন অথচ ভরন্ত শরীর। ছাত্রদের এবং সহকর্মীদের সপ্রশংসদৃষ্টিতে সে অভ্যস্ত। কিন্তু এ তাকানো সেরকম নয়। এমন তীব্র নিবেদন, নিজেকে রিক্ত করে দেওয়া এই দৃষ্টি সে আগে কখনো দেখে নি। কেমন অস্বস্তি আর ভালোলাগা মেশা একটা অনুভূতি হচ্ছিলো অদিতি।
ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে ছেলেটার দিকে গোপনে তাকাচ্ছিলো অদিতি। যতবারই তাকিয়েছে, প্রতিবারই সেই একাগ্র মুগ্ধ দৃষ্টির মুখোমুখি হয়েছে। পরের দিকে অদিতির ওদিকে তাকাতে লজ্জাই করছিলো – পাছে চোখে চোখ পড়ে যায়। ক্লাস শেষ হবার পর যথারীতি একদল পড়ুয়া ন্যাকা ছাত্রছাত্রী ঘিরে ধরলো তাকে – কোন রেফারেন্স বই পড়া উচিত গোছের একঘেয়ে প্রশ্ন নিয়ে। তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতেও অদিতি অনুভব করছিলো যে কারোর দৃষ্টি যেন ওর মুখে স্পট-লাইটের মতন এসে পড়ছে। অজান্তেই ওর গালটা ঈষৎ উষ্ণ আর রক্তিম হয়ে উঠতে লাগলো।
স্টাফ-রুমের দিকে যেতে যেতে অদিতি ভাবছিলো ছেলেটার কথা। ওকে কলেজে আগেও দেখেছে। যেহেতু থার্ড-ইয়ারের নিচে অদিতি পড়ায় না, এই ছেলেটিকেও পড়ায় নি এতদিন। কিন্তু কলেজের নানান অনুষ্ঠানে দেখেছে ছেলেটাকে। কবিতা লেখে, নাটক-ও। খুবই জনপ্রিয়, মাঝে মাঝেই ওর আশেপাশে বেশ কিছু সুন্দরীদের দেখা যায়। অদিতি ওর লেখা পড়েছে কলেজ ম্যাগাজিনে, অন্য দুএকটা পত্রিকাতেও। বেশ লেখা।
হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো নামটা মনে পড়ে গেলো অদিতির - অনির্বাণ। অনির্বাণ রায়চৌধুরী।
সারাদিন একটু আনমনা কাটলো অদিতির। পর পর ক্লাস, সতীর্থদের সঙ্গে আলোচনা, নানান কাজের ফাঁকে ছেলেটার একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকাটা থেকে থেকে মনে পড়ে যাচ্ছিলো। একেবারেই তীর-বিদ্ধ হরিণ, “লাভ-স্ট্রাক” যাকে বলে। হাসিই পাবার কথা, কিন্তু হাসতে ইচ্ছে করছিলো না অদিতির। একটু করুণা আর একটু ভালোলাগা কেমন মিশে যাচ্ছিলো বারবার।
পরদিন ক্লাসে আবার দেখলো অনির্বাণকে। তেমনি ভাবে চেয়ে আছে ওর দিকে। অস্বস্তি কাটাতে জোর করেই ওকে একটা প্রশ্ন করলো অদিতি। সপ্রতিভ ভাবেই উত্তর দিলো অনির্বাণ, কিন্তু ওর চোখে চোখ মিলিয়ে। দৃষ্টিতে তেমনই সকাতর চাওয়া। অদিতির মাথায় একটা কবিতার লাইন ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো “বাসস্টপে তিন মিনিট, কিন্তু তোমায় কাল দেখেছি স্বপ্নে বহুক্ষণ।” সত্যিই কি ওকে স্বপ্নে দেখে ছেলেটা? কি দেখে? ভাবতে গিয়ে মুখ লাল হয়ে উঠলো অদিতির।
দিনের শেষে লাইব্রেরীতে দেখা হলো অনির্বাণের সঙ্গে। সেই রকমই তাকিয়ে আছে ছেলেটা। বই নিয়ে পা চালালো অদিতি। একটু বাদে খেয়াল করলো ছেলেটা পেছন পেছন আসছে। অদিতি ঘুরে তাকাতে দাঁড়িয়ে পড়লো। তারপর বললো “আপনার সঙ্গে হাঁটতে পারি?”
এর কি উত্তর দেবে ভাবতে ভাবতে অদিতি বললো “এসো অনির্বাণ।”
“প্লিজ – আমাকে অনি বলুন। সবাই তাই বলে।”
“বেশ।”
“আপনি কবিতা পড়তে ভালোবাসেন?”
অদিতি একটু হাসলো। “সাহিত্যের ছাত্রী, সাহিত্য পড়াই, কবিতা ভালো তো লাগবেই।”
“তার কোন মানে নেই। আচ্ছা – এই কবিতাটা পড়েছেন –
‘আমার কাছে এখনো পড়ে আছে তোমার প্রিয় হারিয়ে যাওয়া চাবি?’”
“নিশ্চয়ই! ‘লিখিও, উহা ফিরৎ চাহো কিনা?’ - শক্তি চট্টোপাধ্যায়”
“আমার ভগবান। উঃ, কি করে লিখেছেন ওই সব লাইন বলুন তো? আরেকটা শুনুন –
‘আমার সংহারমূর্তি দেখেছে চন্দন একদিন কিশোর বয়সে, সেই অভিপ্রেত সুকালে, সময়ে। দেখেছে এবং একা-একা ভয়ে-রহস্যে কেঁপেছে–- বলেছে, আমার দুটি সুগন্ধি কৌটায় হাত রাখো, পায়ের নখর থেকে জ্বালিও না শিখর অবধি আমি একা, বড়ো একা, চন্দনের গন্ধে উতরোল।’
কি অপূর্ব না?”
কথা বলতে বলতে ওর কোয়াটারের কাছে পৌঁছে গেলো ওরা।
“ভিতরে আসবে?” জিগ্যেস করলো অদিতি। ভালো লাগছিলো অনির সঙ্গে কথা বলতে। অনেকদিন পরে কবিতা শুনতে বেশ লাগছিলো।
“যাবো না আর ঘরের মধ্যে অই কপালে কী পরেছো...”
হেসে ফেললো অদিতি। “এলে ভালো দার্জিলিং চা পাবে। তোমাদের ক্যান্টিনের চেয়ে অনেক ভালো।”
...
সন্ধ্যায় অনি যখন বেরোলো, অদিতির মাথায় তখন অনেক কবিতারা ঝাঁক বেঁধে রয়েছে। অনেকদিন পরে একটা সুন্দর সন্ধ্যা কাটলো তার। কবিতায় মোড়া একটা সন্ধ্যা। মনে গুঞ্জন তুলছে
‘একদিন কবিতা লেখার মত সোজা ছিলে তুমি;
একদিন কবিতা লেখাও বুঝি খুব সোজা ছিল?’
ঠাকুরঘরে চন্দনের ধুপ জ্বালতে গিয়ে অনির বলা কবিতাটা আবার মনে পড়লো
‘আমার দুটি সুগন্ধি কৌটায় হাত রাখো, পায়ের নখর থেকে জ্বালিও না শিখর অবধি’
দুটি সুগন্ধি কৌটা? এখানে কি কবি...? অনি কি জেনে শুনে এটা বললো? হঠাৎ ভারি লজ্জা করলো অদিতির। ভালোও লাগলো।
***
পরের দিন ক্লাসে পড়ার ফাঁকে চোখে চোখ পড়ে যাচ্ছিল বারবার। অনির দৃষ্টিতে সেই তন্ময়তা। অদিতির ভালো লাগছিলো। চুরি করে আচার খাবার মতন নিষিদ্ধ ভালোলাগা। লজ্জা করছিলো।
সারাদিনে অনেকবার অনিকে মনে পড়লো। মনে পড়লো অনেক কবিতাও। একটা ভালো লাগা আবীরের মতো সারা গায়ে লেগে রইলো। সারাদিন।
বিকেলে একা হেঁটে হেঁটে ফেরার সময় পেছন থেকে শুনতে পেলো অনির কণ্ঠস্বর –
“আপনি আমায় দিয়েছিলেন মুঠো ভর্তি বকুল
বলেছিলেন, ফুল না ওরা, কথা।
আমার কোনো কথা ছিল না। কথা বলিনি ---
গতবছর এমনই জুন মাসে।”
“আজ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বদলে শরৎ মুখোপাধ্যায় যে বড়?”
“আরেব্বাস। এক বারে বলে দিলেন?”
অদিতি হাসলো ওর উচ্ছ্বাস দেখে।
“আচ্ছা এটা শুনুন
‘কিছুদিন আমার অসুখী মুখপানে তুমি চেয়ে থাকো
কিছুদিন আমার সুখের মুখপানে তুমি চেয়ে থাকো
চেয়ে থাকো, চোখ ফিরিও না, অন্ধ হবে, যদি বন্ধ করো
চেয়ে-থাকা, দুঃখী মুখপানে, চেয়ে-থাকা, পলক না ফেলে।”
অদিতি আবার হাসলো। “তাই বুঝি আমার মুখের দিকে পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকো?”
অনি লজ্জা পেলো হয়তো। উত্তর দিলো না। তারপর কথা পালটে বললো “আবার শক্তি –
‘ভালোবাসা পেলে সব লণ্ডভণ্ড করে চলে যাবো যেদিকে দুচোখ যায়—যেতে তার খুশি লাগে খুব। ভালোবাসা পেলে আমি কেন আর পায়সান্ন খাবো যা খায় গরিবে, তাই খাবো বহুদিন যত্ন করে।’”
“তাই?” বললো অদিতি। “কিন্তু আমার যে মনে হয় –
‘ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম? লীলাময়ী করপুটে তোমাদের সবই ঝ’রে যায় – হাসি, জ্যোৎস্না, ব্যথা, স্মৃতি, অবশিষ্ট কিছুই থাকে না।’”
এমনি কবিতার খুনসুটি করতে করতে চলতে থাকলো দুজনে। ইটের রাস্তা ফুরিয়ে ঘাসের পথ শুরু হয়ে গেলো। সেখানে জল জমেছে অল্প, থেকে থেতে পা পিছলে যায়। পড়ে যাবার ভয়ে অনির হাতটা ধরলো অদিতি। ধরেই রইলো বাকি পথটা। ভালো লাগছিলো। একটু পরে আবার ইটের পথ এসে যাওয়ায় হাত ছেড়ে দিলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও।
জংলা পথ শেষ হয়ে এলো জুঁই ফুলের গাছের কাছে। ওর কোয়ার্টারের খুব কাছে। দাঁড়িয়ে পড়লো অদিতি। চোখ বুজে। আকাশের দিকে মুখ তুলে দিয়ে দীর্ঘ শ্বাসে ঠান্ডা হাওয়ায় মোড়া জুঁইয়ের গন্ধটুকু বুকের ভিতর অব্দি ভরে নিলো। আঃ, কি অসীম শান্তি!
পিঠে একটা গরম হাতের স্পর্শ পেল অদিতি। কি যেন কি হয়ে গেলো এক পলকে। ওর ঠোঁটের ওপর আরেকজনের উষ্ণ ঠোঁট এসে পড়লো। দুটি হাতের জোরালো বন্ধনে ওর শরীর মিশে যেতে লাগলো আরেকটা শরীরে। ক্রমে সেই দস্যুর মতো ঠোঁটদুটি ওর চিবুকের অপূর্ব চূড়া বেয়ে – তারপর গলার উপত্যকা বেয়ে নেমে এলো। কয়েক মুহূর্ত থামলো সেই দুটি সুগন্ধি কৌটোর কাছে। তারপর অনির উষ্ণ নিঃশ্বাস ওর নাভিতে।
ওর কোমর জড়িয়ে আছে অনির দুটি হাত। অনির কোঁকড়ানো চুলে ভরা মাথাটা অদিতি ধরে রেখেছে দু হাতের তালু দিয়ে। নাভিমূলে বয়ে যাচ্ছে সুবাতাস। সময় থমকে আছে সুন্দরের দরজার প্রান্তে।
কতক্ষন এইভাবে ওরা ছিল, অদিতি জানে না। কখন অনি ওর হাত ছাড়িয়ে চলে গেছে, টের পায় নি। যাবার আগে একবার ওর গাল ছুঁয়ে গিয়েছিলো – সেই স্পর্শটুকু স্মৃতি আর জুঁইফুলের গন্ধ তখনো ওর সর্বাঙ্গ জুড়ে। কখন একটা ঘোরের মধ্যে ঘরে এসে শুয়ে পড়েছে, নিজেও জানে না। আলো জ্বালে নি ঘরে; অন্ধকারে অবিরত রঙের খেলা।
***
সকালে উঠে অদিতি একটু বেশি মন দিয়ে সাজলো। সাজতে ভালো লাগলো আজ অনেকদিন পর। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লম্বা চুলের গোছাকে সযত্নে সাজিয়ে মন দিয়ে টিপ আঁকতে ভালো লাগলো। আয়নার আমির দিকে তাকিয়ে একটা হাল্কা হাসি খেলে গেলো ওর মুখে। একসময় খেয়াল হলো যে দেরি হয়ে গেছে। তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়লো অদিতি। আজো ক্যান্টিনে খেতে হবে।
ক্যান্টিনে সেই ছেলেদের দঙ্গল। কোনোক্রমে পাশ কাটিয়ে চা আর দুটো টোস্ট নিয়ে নিলো। একপাশে বসে চায়ের সঙ্গে পুরু করে মাখন লাগানো টোস্ট দুটো খেতে খেতে বুঝলো যে বেশ খিদে পেয়েছিলো। কাল রাত্রেও তো খাওয়া হয় নি।
খেতে খেতে আড়চোখে দেখতে পেল যে ছেলেদের দলে অনিও আছে। কিন্তু আজ যেন অনিকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। নিখুঁতভাবে দাড়ি কামানো, শার্টটাও পাটভাঙা, হাসিটাও বেশ দিলখোলা। আর সবচেয়ে বড় কথা, অদিতিকে দেখতে পেয়েও তাকালো না। সেই তন্ময় মুগ্ধ দৃষ্টিটা আর নেই।
“এই অনি, ওদিকে দ্যাখ। তোর...” কে যেন একটা বলে উঠলো পেছন থেকে। অনি একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো অদিতির দিকে। তারপর আবার ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের চায়ের কাপে চুমুক দিলো। অদিতি বেরিয়ে এলো ক্যান্টিন থেকে। খাওয়া হয়ে গিয়েছিলো তার।
“কি রে, আজ যে তোর উৎসাহই নেই?” পেছনের কণ্ঠস্বরটা আবার শোনা গেলো ক্যান্টিনের জানলা দিয়ে। আর শোনা গেলো অনির গলা -
“আর ওদিকে উৎসাহ দেখিয়ে কি হবে! কাল রাত্রে তো কবিতাটা লেখাই হয়ে গেছে। লম্বা কাব্য – কাব্য-উপন্যাস বলতে পারিস। জয় গোস্বামীর ‘যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল’ স্টাইলের। এখন ব্যাক টু নর্ম্যাল। লাল্টুদা, একটা ডিম-পাঁউরুটি আর আরেকটা চা দাও গো।”
ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে এলো অদিতি। কালকের বৃষ্টির পর আজকের দিনটা যেন বেশিই উজ্জ্বল। তীব্র রোদ, চারিদিকে আগুন ছড়াচ্ছে। চোখ ঝলসে যায় কেমন যেন। হাওয়াটা ভীষণ শুকনো, রুক্ষ।
আশা রাখে না, তবুও পুরনো অভ্যাসে অদিতি আবার মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রাখলো।
না, কোন মেসেজ নেই। স্ক্রিন খালি। রোজকার মতন। কোথাও কিচ্ছু নেই।
(এই সংখ্যায় অতনু দে-র অন্য গল্পঃ 'দুই পৃথিবী')