দাসবাবু চশমাটা খুলে চারিদিক হাতড়াতে থাকলেন। এখানেই তো রেখেছিলেন চাবির গোছাটা।
— মনিকা?
— বলো।
— চাবিগুলো দেখেছ?
— আমি আবার কখন তোমার চাবি নিতে গেলাম!
— আহা, নাও নি। কিন্তু দেখেছ কি?
— না, আমি তোমার চাবি দেখিনি! খুঁজে দেখো ভাল করে।
হলুদ মাখা হাতে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে মনিকা অর্থাৎ দাসবাবুর গৃহিণী আবার রান্নাঘরে ফিরে গেলেন। দাসবাবু বিড় বিড় করতে লাগলেন, "এখানেই তো রেখেছিলুম! কোথায় যে গেল!"
হ্যাঁ, এই তো বিছানার তোষকের তলাতেই ছিল, আর উনি সারা ঘর খুঁজে মরছেন! বটুয়াতে না রাখাতেই যত গোলমাল।
পুরোনো দিনের মেহগনি কাঠের মজবুত আলমারি — পিতলের চাবির গোছা থেকে একটা চাবি খুঁজে নিয়ে দাসবাবু আলমারিটা খুললেন। ভিতরে সুন্দরভাবে রাখা জামাকাপড় থাকে থাকে সাজানো। ঠিক তার পাশেই একটা দেরাজ। আর একটি চাবি গোছা থেকে খুঁজে নিয়ে দেরাজ খুললেন। এর মধ্যেই থাকে ২৫০ বছরের পুরোনো সোনার লক্ষ্মীঠাকুর, যা ওনাদের বংশ পরম্পরায় দীপাবলির দিনে পূজিত হয়ে আসছে। আগামীকাল দীপাবলিতে আবার পুজো হবে। তাই আজ দেবীমূর্তির খোঁজ পড়েছে।
দাসবাবু অভ্যেস মতো হাত বাড়িয়ে দিলেন দেরাজের ভিতর। কিন্তু একি! মূর্তির গায়ে হাত ঠেকছে না কেন?
— ম-নি-কা!
******
সিলিং ফ্যানের স্পিডটা বাড়িয়ে মনিকা দাসবাবুকে স্টিলের গ্লাসে করে জল এগিয়ে দেয়। পালঙ্কের ওপরে একটা বালিশে ঠেসান দিয়ে বসে দাসবাবু জানালার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন! বাইরেটা শরতের রোদে ভেসে যাচ্ছে। একটা বড় লেবুগাছের ডালপালার ছায়া এসে বিছানার সাদা চাদরের উপরে আঁকি-বুঁকি কেটেছে যেন। কোথায় চড়ুই আর শালিকের ডাক শোনা যাচ্ছে, একটা ডাহুক এক নাগাড়ে ডেকেই চলেছে! মনিকাই নীরবতা ভঙ্গ করলো,
— গত বছরে দীপাবলির পর তুমি তো নিজের হাতেই আলমারির ড্রয়ারে তুলে রেখেছিলে, তাই না?
— হ্যাঁ।
— শেষ কবে দেখেছিলে?
— এই তো গত পরশু, যেদিন ওই সুভাষ এল না? আমার কাছে টাকা চাইতে এলো?
— তুমি আবার টাকা দিয়েছিলে না কি?
— হ্যাঁ, মানে ওই বেশি নয় আর কি, শ'পাঁচেক হবে। মাসের শেষ, আমার নিজেরই তো হাত ফাঁকা! ও আমার অনেকদিনের বন্ধু, তাই একেবারে মুখের উপর "না" বলে দিতে পারলাম না!
— তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না! তুমি এই অসময়ে কি করে যে অন্যকে টাকা দিয়ে দাও! মনিকা আক্ষেপ করে ওঠেন।
— এখন কী করবে বলো? সোনাইদের একটা খবর দেব?
— না না, ওদের এখন বলার দরকার নেই! তাছাড়া বিদেশ-বিভূঁইয়ে থেকে ওরা কী করবে? আমি ভাবছি পুলিশে একটা খবর দেব। তাছাড়া উপায় নেই!
— আর একটু ভাল করে খুঁজে দেখো, তারপরে না হয় যেও।
দাসবাবুদের পৈতৃক ব্যবসা ছিল — লোহালক্কড়ের বিজনেস। জার্মান স্টিল আসত জলপথে, জাহাজে করে। সেই দিয়ে তৈরি হতো নানারকমের কলকব্জা, যন্ত্রপাতি — খাঁটি ইংরেজদের সাথে ব্যবসা, ঠকালে চলবে না! সেইভাবে দাসবাবুদের পিতৃপুরুষেরা প্রভূত সম্পত্তি করেছিলেন; কিন্তু পরবর্তীকালে ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়াঝাঁটি করে সম্পত্তি ভাগ হয়ে যায় — প্রত্যেকের ভাগে যেটুকু সম্পত্তি পড়েছিল তাও কিছু কম নয়। তাঁরা প্রত্যেকেই বেশ ধনী। দাসবাবুর ঠাকুরদা ছিলেন তাঁর বাবার বড় ছেলে। আবার দাসবাবুর বাবা ছিলেন দাসবাবুর ঠাকুরদার বড় ছেলে। সে সূত্রেই তিনি ওই লক্ষ্মীমূর্তিটা নিজের কাছে রাখার ও পুজো করার অনুমতি পেয়েছিলেন। মূর্তিটা ইঞ্চি দশেক লম্বা, সলিড সোনার, মুকুটে একটি নীলাভ হিরে ও কোমরবন্ধনীতে নয়টি দামি পাথর বসানো — নবগ্রহ নিয়ন্ত্রক— আর গলায় পরানো ছিল একটি মোতির মালা — আসল মুক্তো দিয়ে তৈরি!
সারাদিন খোঁজাখুঁজি করেও মূর্তির কোনো চিহ্ন দু'জনের চোখে পড়ল না। রাত্রিবেলা মেয়ের সাথে ফোনে কথা বলার সময়ে মনিকা কিছুতেই মূর্তি হারানোর কথাটা গোপন রাখতে পারলেন না। বলেই ফেললেন মেয়ের কাছে। সোনাই শুনে হাঁউমাউ করে উঠলো, "তোমরা যে কী করো না! বাবা কিচ্ছু মনে রাখতে পারে না! কোথায় কী রাখে তার ঠিক নেই! তুমিও একটু দেখবে না! সারাদিন কী এতো কাজ করো? দু'জন তো মানুষ!" মেয়ে চেঁচামেচি করছে দেখে জামাই সন্দীপ জিজ্ঞাসা করলো, "কী হয়েছে?" সোনাই ওকে বলল ঘটনাটা। সন্দীপ ফোনে বললো, "মা, বাবাকে বলুন তাড়াতাড়ি পুলিশে একটা কমপ্লেইন করতে।"
— কালকেই থানায় যাবে।
— হ্যাঁ, এ বিষয়ে দেরি না হওয়াই ভালো।
সন্দীপ জার্মানিতে একটা বড় কোম্পানিতে বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার হিসাবে কাজ করছে, তা প্রায় বছর ছয়েক হয়ে গেলো। জার্মান ভাষাটাও ভালোই শিখে নিয়েছে। সোনাইয়ের সাথে বিয়ে হয়েছে বছর দুয়েক আগে, এখনো কোনো ছেলেমেয়ে হয়নি ওদের। সোনাইও পড়াশোনায় খুব ভাল ছিল, ও ওখানে একটা চাকরি নেবে বলছে। বাড়িতে একা থাকতে ওর ভাল লাগে না।
রাত্রিটা কোনোমতে কাটিয়েই সকাল সকাল দাসবাবু আর মনিকা একটা রিক্সা নিয়ে থানায় গেলেন। রিটায়ার্ড পোস্টমাস্টার মশাই দাসবাবুকে অনেকেই চেনেন। থানাতে তখন মেজো দারোগা অংশুবাবু ছিলেন, তিনিই জি. ডি. নেবার ব্যবস্থা করলেন। তারপর মূর্তির একটা ছবি চাইলেন। দাসবাবুর মনে ছিল না, মনিকাই মনে করিয়ে দিলেন, "সেই যে গতবারে লক্ষ্মীপুজোর সময়ে সন্দীপ আমাদের পুজোর কিছু ছবি তুলেছিল না? ওর মধ্যেই ঠাকুরের একটা ছবি আছে।"
পুলিশি জিজ্ঞাসা উস্কে দিল কত স্মৃতি। মনে পড়ল —
গতবারে দূর্গাপুজোর সময়ে মেয়ে-জামাই একমাসের ছুটি নিয়ে কলকাতায় এসেছিল; তখন কালীপুজো-ভাইফোঁটা কাটিয়ে ফিরে গিয়েছিল ওদেশে। কি আনন্দটাই না হয়েছিল! বুড়ো বয়সে কি ধকল সয়? কিন্তু জামাই শুনবে না! সে গাড়ি ভাড়া করে কত ঘুরিয়েছিল, ঠাকুর দেখিয়েছিল, রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়েছিল। সন্দীপের মা-বাবাও এসেছিলেন ওদের বাড়ি। বেশ জমজমাট আনন্দে কেটেছিল দিনগুলি।
দীপাবলির সময়ে সোনাই আর সন্দীপের কিছু বন্ধুবান্ধব এসেছিল — তারা তো এবাড়ির ইতিহাস শুনে, নাটমন্দির, ঠাকুরদালান, চকমেলানো পুরোনো বাড়ি, কড়ি-বর্গার ছাদ, পুরনো আমলের ঝাড়়বাতি — এসব দেখে মুগ্ধ! বিশেষত সন্দীপের খুড়তুতো ভাই জয়দীপ তখন থেকেই এবাড়ির একজন পার্মানেন্ট সদস্য হয়ে গেছে। প্রায়ই আসে এখানে, কয়েক দিন করে কাটিয়েও যায়। এখনো চাকরিবাকরি কিছু করে না--হাতে অফুরন্ত সময়। বিদেশ বিভূঁইয়ে মেয়ে-জামাই থাকে তাই জয়দীপ কাছে থাকলে বুড়ো-বুড়ি একটু ভরসা পান মনে। এই দিন কয়েক আগেও জয়দীপ এসেছিল। দিন দুয়েক আগে পর্যন্ত ছিল। ও এলে মনে হয় বাড়িতে যেন নিজের ছেলে এসেছে। নিজেই পছন্দমতো বাজার করে আনে, বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ায়।
মেজো দারোগাবাবু বললেন, "এখনই এবিষয়ে বিশেষ হৈ চৈ করবেন না। আমাদের তদন্ত করার সুযোগ দিন। এই মূর্তিটা শুধু আপনাদের পারিবারিক সম্পত্তিই নয়, এর একটা অ্যান্টিক ভ্যালুও আছে। আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চুরি যাওয়া মূর্তিটার একটা ছবি আমাদের দিয়ে যান।"
এবছর লক্ষ্মীমূর্তি ছাড়াই ঘটে লক্ষ্মীপুজো হলো। রাত্রে মেয়ে-জামাইয়ের সাথে কথা হতেই ওরা জিজ্ঞাসা করলো, "পুলিশের কাছে গিয়েছিলে?"
দাসবাবু সবিস্তারে পুলিশ কি বলেছে তার বর্ণনা করলেন। এখন এই নিয়ে কাউকে বলতে বারণ করেছে, তাও বললেন।
পরের দিন সকালেই দাসবাবু মূর্তির একটা ছবি নিয়ে আবার থানায় গেলেন। মেজো দারোগাবাবুর কাছে একজন তরুণ অফিসার দাঁড়িয়ে ছিলেন, তার হাতে ছবিটা দিয়ে দারোগাবাবু বললেন, "সমরেশ, খুব কেয়ারফুলি ফটোটা দেখো। আর এটা বহু প্রাচীন মূর্তি, এর অ্যান্টিক ভ্যালুও আছে। কাজেই চটপট এটা খুঁজে বের করতে হবে, মানে এটা গলিয়ে ফেলার আগেই!"
মেজো দারোগাবাবু আলাপ করিয়ে দিলেন, "ইনি হচ্ছেন আমাদের তদন্তকারী অফিসার, মিস্টার সমরেশ জানা। উনি আপনাদের মূর্তিচুরির বিষয়টি দেখবেন এবং আমার মনে হয়, এব্যাপারে উনি খুব এফিসিয়েন্ট পারসন।"
দুজনে দুজনকে প্রতিনমস্কার করলেন। সমরেশ জিজ্ঞাসা করলেন, "মূর্তিটা শেষ কবে দেখেছেন?"
— দিন পাঁচেক আগে, দেরাজ থেকে টাকাপয়সা বের করতে গিয়ে।
— ঠিক আছে। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব। আশা করি মূর্তিটি অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যাবে।
দাসবাবু বাড়ি ফিরে এলেন।
সেদিন বিকেলেই মিস্টার সমরেশ জানা দাসবাবুদের বাড়িতে এলেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সারা বাড়িটা লক্ষ করছিলেন তিনি। দেখলে বোঝা যায় বাড়িটাকে খুব ভাল ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছে। দোতলায় মোট তিনটি ঘর। দুটি শোবার ঘর এবং একটি বসার ঘর। এছাড়া রান্নাঘর ও দুটি বাথরুম আছে। একটি দাসবাবুর ঘরের লাগোয়া এবং একটি তার পাশে। দুটি বাথরুমের মধ্যবর্তী একটি কাঠের দরজা এবং পাশের বাথরুম থেকে বাইরে যাওয়ার একটি দরজা আছে। সেই দরজার বাইরে লোহার ঘোরানো সিঁড়ি আছে জমাদারের জন্য।
সমরেশ প্রথমেই দেখতে চাইলেন কোথায় মূর্তিটা রাখা ছিল। দাসবাবু তাঁকে দোতলায় তাঁদের শোবার ঘরে নিয়ে এলেন। বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকেই সমরেশ লক্ষ করলেন, ঘরটি বেশ বড় — বোধহয় পনেরো ফুট বাই কুড়ি ফুট হবে। বড় দুটি জানালার ঠিক পাশেই মেহগনি কাঠের মস্ত পালঙ্ক। পালঙ্কের বাঁ-পাশে উত্তরদিকের দেয়ালের ধারে মস্ত বড় সোফাসেট। পশ্চিমদিকের দেয়াল ঘেঁষে মেহগনি কাঠের বড় আলমারি, যাতে সেই মূর্তিটা ছিল। দক্ষিণদিকে একটা সুন্দর রাইটিং টেবিল ও চেয়ার। দাসবাবু চাবি দিয়ে আলমারি খুলে, দেরাজ খুলে দেখালেন। ম্যাগ্নিফায়িং গ্লাস দিয়ে সমরেশ পরীক্ষা করার পর সেটা আবার চাবি বন্ধ করে দিলেন দাসবাবু।
— দাসবাবু, আপনাদের এই বাড়িটা কত বছরের পুরোনো?
— প্রায় ১১৭ বছর। আমার ঠাকুরদার বাবারা ছয় ভাই ছিলেন। পৈতৃক সম্পত্তি ভাগাভাগি হওয়ার পরে আমার ঠাকুরদার বাবা এই বাড়িখানা তৈরি করেছিলেন ১৯০০ সালে। যেহেতু তিনি তাঁর পিতার বড় ছেলে ছিলেন তাই লক্ষ্মীমূর্তিটাও পৈতৃক সূত্রে তাঁর কাছেই এসেছিল।
— বর্তমানে এবাড়িতে কে কে আছেন?
— এখন এবাড়িতে শুধু আমি আর আমার স্ত্রী থাকি। আমার বাবারা ছিলেন চারভাই, প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা বাড়ি করে নিয়েছেন, শুধু বাবা এই পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে যাননি। আমার কাকারা প্রত্যেকে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং প্রচুর অর্থ-সম্পদের অধিকারী। ঠাকুরদা এবং বাবার আমলে দুর্গাপুজো হতো; তখন সকলে এই বাড়িতে আসতেন।
— এতবড়ো বাড়িতে শুধু আপনারা দুজন থাকেন?
— না, নিচের তলায় এখন দুটো ভাড়াটে আছে। একজন কোম্পানি সেক্রেটারিশিপ পড়ছে আর একজন কোনো সরকারি চাকরির পরীক্ষা দেবার জন্য এসেছে। এরা গ্রামের ছেলে; দুজনে দুটো ঘরে থাকে। পেয়িং গেস্টের মতো আর কি!
— রান্না কে করেন?
— রান্নার লোক আছে। তবে কিছুদিন আগে আমার শরীরটা একটু খারাপ হয়েছিল — হার্টের প্রব্লেম আর কী। তখন ডাক্তার বলেছিলেন, একটু কম তেলমশলা দেওয়া খাবার খেতে হবে; তাই আমার জন্য রান্নাটা আমার গিন্নিই করেন।
— রান্নার লোক কখন আসে?
— সকালে আটটার সময়ে আর ঘন্টা-দেড়েক থেকেই চলে যায়।
— এছাড়া আর ক'জন কাজের লোক আছে?
— দু'জন -- একজন ঠিকে ঝি, দু'বেলা বাসন মেজেই চলে যায়। আর আছে মানদা, সে অনেকদিনের। প্রায় দশবছর ধরে এবাড়ির কাজ করছে — ঘর মোছে, সাবান কাচে, ফাইফরমাশ খেটে দেয় — এই সমস্ত আর কি!
— মানদা কখন আসে?
— ওই সকালেই আসে, বেলা ন'টা নাগাদ। ঘন্টাখানেক বাদেই চলে যায়।
— এ বাড়িতে আর কার কার যাতায়াত আছে?
— মাঝেমধ্যে আমার জামাইয়ের খুড়তুতো ভাই জয়দীপ আসে, দু-চারদিন করে থেকে যায় আর আমার ছোটবেলার বন্ধু সুভাষ আসে, আমার সাথে গল্পগুজব করেই চলে যায়। ও আগে একটা বড় কোম্পানিতে চাকরি করতো, এখন রিটায়ার্ড। সুভাষের ছেলেও আসে, কখনো সখনো, দরকার হলে।
সমরেশ তাঁর ডায়েরিতে সব নোট করে নিলেন। তারপর জানতে চাইলেন,
— আপনি কি এদের মধ্যে কাউকে সন্দেহ করেন?
— না না, সে কি! জয়দীপ আমাদের নিকট আত্মীয়, সুভাষ আমার ছোটবেলাকার বন্ধু। আর আমাদের ভাড়াটিয়ারা কেউ উপরেই ওঠে না। শুধু ভাড়ার টাকাটা দিতে আসে। কাজের লোকেরা সবাই বিশ্বস্ত এবং বহুদিন ধরে আছে!
— তাহলে কে নিতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
— আমিও সেটাই তো ভেবে পাচ্ছি না!
— আপনাদের বাড়ির সমস্ত দরজাগুলো কি শুধু রাতেই বন্ধ করেন?
— আমরা দুজনেই বয়স্ক মানুষ — রাত্রে ঘুমের ওষুধ না খেলে ঘুম আসে না; এ অভ্যেস আমাদের বহুদিনের। রাত্রে তাই এই ঘরের দরজাটা একটু ভেজিয়ে রেখে শুয়ে পড়ি। দোতলার কোলাপ্সিবল গেটে তালা দেওয়া থাকে এবং ছাদের দরজাও ভেতর থেকে বন্ধ করা থাকে।
সমরেশ ভাবতে থাকে, তাহলে চোর ঢুকল কোথা দিয়ে?
— ঠিক আছে, আজ আমি উঠি। হয়তো কাল বা পরশু আবার আসতে হতে পারে। আপনার কাছে কোনো ছবি আছে যাঁদের আপনার বাড়িতে খুব যাতায়াত আছে?
দাসবাবু অ্যালবাম খুলে কয়েকটা গ্রুপ ফটো দিলেন।
মনিকা একপ্লেট মিষ্টি আর জল নিয়ে ভিতরে ঢুকলেন, "এগুলো একটু খেয়ে নিন!"
— আরে না না, এসব আবার কি!
— বাড়িতে কেউ এলে শুধু-মুখে ছাড়া যায় কি?
— আমি তো ডিউটি করছি।
— তা হোক বাবা, তুমি আমার ছেলের মতো!
এরপর আর আপত্তি করা যায় না। সমরেশ বাধ্য ছেলের মতো বসে সব ক'টা মিষ্টি ধীরে ধীরে খেয়ে নিল। একসময় সে মিষ্টির পোকা ছিল! জল খেয়ে উঠে দাঁড়াল সে। এবারে যেতে হবে। পিছনে পিছনে দাসবাবু আর মনিকা এগিয়ে দিতে এলেন। বাইরে তখন পশ্চিম আকাশে সূর্য অস্ত যাচ্ছে, গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে টলটলে দীঘির পাড়ে সেই সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখে সমরেশ কয়েক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে পারল না! পুলিশি উর্দির ভিতর থেকে একজন চিত্রকরের মন উঁকি দিতে লাগলো! মুখ থেকে আপনিই বেরিয়ে এলো, "অপূর্ব!"
সমরেশ চলে আসার সময়ে একবার বাড়ির চৌহদ্দিটা পরীক্ষা করে দেখল। সারা বাড়িটা উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। মাঝখানে উঠোন, চারিপাশে সুন্দর ফুলের বাগান। বাড়ির পিছনে কয়েকটি বড় বড় গাছ – আম, বাতাবিলেবু, দুটি নারকেল গাছ, পাতিলেবু, কাঁঠাল আরো কয়েকটা। বাড়ির পিছন দিকে একটা লোহার ঘোরানো সিঁড়ি বাথরুম থেকে নেমে এসেছে বাগান পর্যন্ত। বাগানের ভিজে মাটিতে কয়েকটা জুতোর ছাপ। এবারে প্রায়ই নিম্নচাপের ফলে মাটি শুকনো হচ্ছে না। হয়তো এই জুতোর ছাপগুলি জমাদারের তবু সমরেশ জুতোর ছাপ সংগ্রহ করলো।
সমরেশ থানাতে ফিরে গিয়ে একটা রিপোর্ট লিখে জমা দিল মেজো দারোগাবাবুর কাছে। তারপর একটা ফোন করল দাসবাবুকে, "যদি নতুন কোনো ঘটনা ঘটে বা কেউ বাড়িতে আসে তাহলে আমাদের একটু জানাবেন, প্লিজ।"
দাসবাবু মোবাইল ফোনটা রেখে কি বলল সমরেশ সেটা বলার জন্য রান্নাঘরের দিকে মনিকার কাছে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময়েই দেখলেন সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে জয়দীপ।
— জেঠু, আমি বৌদির মুখে শুনে তো অবাক! তাই চলে এলাম! ছি ছি, কি কাণ্ড বলুন তো? কে এমন করতে পারে?
— আগে ভিতরে এসো। বাইরে এসব আলোচনা থাক।
— হ্যাঁ, হ্যাঁ। চলুন ভিতরে যাই আগে।
মেয়ের ওপরে দাসবাবুর বেশ রাগ হচ্ছিল! পেটে কোনো কথা থাকে না! পুলিশ বারণ করেছে কাউকে বলতে! আর ও এদিকে একে বলে বসেছে! হলোই বা নিজের খুড়শ্বশুরের ছেলে! তবে ছেলেটা ভালো! আপদে বিপদে ছুটে আসে, পাশে দাঁড়ায়। আজকাল কেই বা কার জন্য করে?
চারিদিকে খুব বাজি ফাটছে! দাসবাবুর কষ্ট হচ্ছিল খুব! জয়দীপই জানালাগুলো বন্ধ করে মস্কুইটো রিপিলেন্ট মেশিন প্লাগে লাগিয়ে সুইচ অন করে দিল। বলল, "আজকাল যা চারিদিকে ডেঙ্গু হচ্ছে! সাবধানে থাকাই ভালো!"
ছেলেটা বড্ড ভালো!
রাত্রে খেতে খেতে জয়দীপের সাথে অনেক কথা হলো। ও এবারে বেঙ্গালুরু চলে যাবে ভাবছে। ওখানে একজনের সাথে পার্টনারশিপ বিজনেস করবে। ওর বাবা অনুমতি দিয়েছেন। তাছাড়া কলকাতায় চাকরির তো যা অবস্থা তাতে করে কলকাতার বাইরে না গেলে প্রতিষ্ঠা পাওয়াও সম্ভব নয়। যদি ওখানে কোনো চাকরি পায়, তাও করতে পারে। তবে যার সাথে বিজনেস করতে চলেছে সে ওর বাবার বন্ধুর ছেলে — ওদের সবার সাথে যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা আছে।
— কিন্তু বিজনেসটা কিসের? দাসবাবু জানতে চাইলেন।
— এই মোবাইল ফোন এবং আরো কিছু ইলেকট্রনিক্স গুডস — ওখানে মার্কেট বেশ ভালো! সুরেন্দ্র এবং ওর বাবা অনেকদিন ধরেই এই ব্যবসার সাথে যুক্ত। ওদের এখন প্রচুর টাকা! আমি ওখানে গেলে ওরা আমাকে ওদের বাড়িতেই আপাতত একটা থাকার ব্যবস্থা করে দেবে। তারপর আমি উন্নতি করতে পারলে, বাবা বলেছেন, আমাকে ওখানে একটা আলাদা সেট আপ করে দেবেন।
— কিন্তু বিজনেসে তো টাকা ঢালতে হবে?
— সে নিয়ে ভাববেন না। বাবা তো ব্যাংক ম্যানেজার। আমাকে একটা লোনের ব্যবস্থা করে দেবে।
খাওয়া প্রায় শেষের দিকে। মনিকা এবারে জিজ্ঞাসা করলেন, "তোমাকে আর কিছু দেব বাবা?"
— না না। আমার পেট ভরে গেছে। আপনি মাছের ঝোলটা যা বানিয়েছেন না! অসাধারণ!
সবাই এবারে টেবিল থেকে উঠে পড়লেন।
সকালবেলায় দোতলার বসার ঘরে দাসবাবুর কাছে সুভাষবাবু বসে চা খাচ্ছিলেন আর দুজনে কথা বলছিলেন। আজ আর শোবার ঘরে ডেকে আনেননি বন্ধুকে।
— দেখ্, তোর ছেলেকে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতেই চাকরি দেখতে বল। কতদিন সরকারি চাকরির আশায় আর বসে থাকবে?
— সে তো জানি! কিন্তু না শুনলে কি করব!
— তুই তো ভালোই রোজকার করতিস, একটু ভেবে চললে এরকমটা হতো না!
— ঠিকই বলেছিস! আসলে কি জানিস, আমাদের খরচের হাতটা বরাবরই লম্বা! সেজন্যই পস্তাচ্ছি! তবে তুই চিন্তা করিস না, তোর সব টাকা আমি সামনের মাসেই শোধ করে দেব। আমাদের শ্রীরামপুরে একটা জমি ছিল, ওখানে প্রোমোটিং হচ্ছে!
হঠাৎ জয়দীপ ঘরে ঢুকে দাসবাবুকে প্রণাম করল, সুভাষবাবুকেও।
— কোথাও যাচ্ছ? তার বেশ ফিটফাট সাজগোজ দেখে দাসবাবু জিগ্যেস করলেন।
— হ্যাঁ জেঠু, আমি একটা চাকরির পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি।
— তুমি যে কাল বললে একটা বিজনেস করতে যাচ্ছ?
— হ্যাঁ, মানে এইটাই আমার লাস্ট চাকরির পরীক্ষা!
— আজ থাকবে না?
— না জেঠু, আজ আমার পরীক্ষা আছে কি না। পরে একদিন আসব।
সুভাষবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, "কিসের পরীক্ষা বাবা?"
— রেলের। ওই রিট্ন টেস্ট আর কি!
— সে কি! আমার ছেলে যে বললো, ওটা রবিবারে হবে! তবে কি ও ঠিক জানে না?
— না না, মানে হ্যাঁ। রবিবারেও একটা পরীক্ষা আছে। তবে এটা অন্য পরীক্ষা।
জয়দীপ কেমন যেন চমকে গেল! আমতা আমতা করে তাড়াতাড়ি বিদায় নিল। দাসবাবু, মনিকাও অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। সুভাষবাবু বললেন, "আমি ভাই উঠি। দেখি ছেলেটা আবার পরীক্ষা মিস না করে!"
থানা থেকে সমরেশের ফোন এল, "স্যার, কোনো খবর আছে? আপনাদের বাড়িতে কেউ কি এসেছিল?"
— হ্যাঁ, দুজন এসেছিল, জয়দীপ আর সুভাষ। তবে জয়দীপ থাকেনি, ওর রেলে কি একটা পরীক্ষা আছে বলে চলে গেল। সুভাষ বলল, ওর ছেলে...
— স্যার, সুভাষবাবু টাকা-পয়সার কথা কি কিছু বললেন?
— হ্যাঁ, বলছিল, ওদের একটা জমি... শ্রীরামপুরে... প্রোমোটিং হচ্ছে। আমার টাকা সব শোধ করে দেবে।
— ঠিক আছে স্যার, বাড়ির কাজের লোকেরা ঠিকমতো আসছে তো?
— হ্যাঁ, মানদা আজ বলছিল, একদিন আমাদের একটা বাথরুমের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল না! আগের দিন জমাদার এসেছিল। মানদাই দরজা খুলে দিয়েছিল; কিন্তু বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল! পরের দিন দেখতে পেয়ে ও আবার বন্ধ করে দিয়েছে।
— সেটা কোনদিন?
— ১৫ তারিখ হবে বোধহয়।
— ঠিক আছে। ছেড়ে দিচ্ছি।
ফোন রেখে দিল সমরেশ। মেজো দারোগাবাবু জানতে চাইলেন কি কথা হলো। সমরেশ সব বলল।
— ঠিক আছে তুমি জয়দীপকে ফলো করো। আমি যতদূর জানি আজ রেলের চাকরির কোনো পরীক্ষা নেই। আর আমি দেখছি শ্রীরামপুরে সুভাষবাবুদের কোনো জমি সত্যিই প্রোমোটিং হচ্ছে কি না।
হিন্দ্ মোটর থেকে আসা একটা বাসে জয়দীপ উঠল। এই বাসটা মেটিয়াবুরুজ যাবে। একটু দূরত্ব রেখে বাসে উঠেছে সমরেশও, প্লেন পোশাকে। দাসবাবুর কাছ থেকে নেওয়া ছবিগুলো ছিল গ্রুপ-ফটো — সেগুলোকে আলাদা আলাদা প্রিন্ট করানো হয়েছে। জয়দীপের ছবিটা সমরেশের পকেটে। বয়স ২৩ থেকে ২৪-এর বেশি হবে না। নিখুঁতভাবে শেভ করা। পরনে দামি শার্ট ও প্যান্ট। পিঠে একটা দামি ব্যাগ। দেখলে বেশ ধনীর ছেলে বলেই মনে হয়।
আক্রা-ফটক এসে গেছে, এটাই লাস্ট স্টপেজ। কিছু লোক নামল, জয়দীপও নেমেছে। পিছনে পিছনে সমরেশও। জয়দীপ বেশ দ্রুত হাঁটছে। সমরেশ বেশ কিছুটা দূরত্ব রেখে চলেছে।
মেজো দারোগাবাবুর ফোন এলো, "তোমার চিড়িয়া কোথায়?"
— মেটিয়াবুরুজ, আক্রা-ফটক।
— ঠিক আছে। ওকে লক্ষ রাখো। ও হ্যাঁ, সুভাষবাবুর জমি সত্যিই প্রোমোটিং হচ্ছে!
জয়দীপ একটা মাঠ ডানদিকে রেখে ঘুরে গেল বাঁদিকের রাস্তায়। সমরেশ আরো দূরত্ব বাড়িয়ে মোড় ঘুরল, সামনে একটা মসজিদ। মসজিদটাকে বাঁদিকে রেখে জয়দীপ আবার মোড় ঘুরল। জয়দীপ একবার ঘাড় ঘোরাল। কিন্তু সমরেশকে চেনে না। তাই দাঁড়াল না। সমরেশ একটা পান-সিগারেটের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। যদিও সে সিগারেট খায় না, তবু কিনে নিল কয়েকটা। আবার হাঁটতে লাগল।
এবারে জয়দীপ হাঁটছে সংকীর্ণ পথ ধরে। চারিদিকে নোংরা, দুর্গন্ধ। বস্তি এলাকায় ঢুকে পড়েছে। সমরেশ আর বেশি ভিতরে গেল না। একটা লোক ওকে লক্ষ করছে দেখেই সমরেশ মোবাইল ফোনটা বের করে কথা বলতে শুরু করল — "হ্যাঁ, স্যার। আমি দাঁড়িয়ে আছি, আপনি আসুন। হ্যাঁ। আমি জমিটা আজই আপনাকে দেখিয়ে দেব।"
এই বস্তির ভিতরে জয়দীপের কী কাজ থাকতে পারে? সমরেশের কপালে চিন্তার রেখা।
প্রায় আধঘন্টা বাদে জয়দীপ ফেরার পথ ধরল; সমরেশও আবার পিছু নিল। জয়দীপ বড়রাস্তায় এসে একটা ট্যাক্সিতে উঠল। রাস্তার পাশে আর একটা হলুদ ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। চট করে দরজাটা খুলে উঠে পড়ল সমরেশ। ট্যাক্সি ড্রাইভার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। সে চেঁচিয়ে উঠল, "আরে, এ ট্যাক্সি নেহি যায়গা!" সমরেশ দ্রুত ওর পকেট থেকে আইডেন্টিটি কার্ডটা বের করে দেখাতেই ড্রাইভার সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়ল নিজের সিটে—"কাঁহা যায়েঙ্গে?"
— ওই ট্যাক্সিটাকে ফলো করো। আমি বলে দেব।
আকাশবাণীর সামনে দিয়ে ট্যাক্সি গিয়ে থামল হাই কোর্টের কাছে। জয়দীপ নামল সেখানে। সে সোজা একটি ব্যাংকের দিকে হাঁটছে। পিছু নিল সমরেশও। হাই কোর্টের ঠিক পাশেই বিশাল বড় বিল্ডিং, সারাদিন অনেক মানুষের আনাগোনা। ব্যাংকের ভিতরে ও বাইরে অসংখ্য মানুষ নিজের কাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জয়দীপ মিশে গেল সেই ভিড়ে। সমরেশ ভিতরে ঢুকল বটে কিন্তু কোন ফ্লোরে ছেলেটা গেল তা বুঝতে পারল না। বাইরে বেরিয়ে এসে মেজো দারোগাবাবুকে একটা ফোন করল।
মেজো দারোগাবাবু বললেন, "ঠিক আছে। তুমি এখন থানায় ফিরে এস। কালকে একবার সুভাষবাবুর ছেলের উপরে নজর রাখবে।"
থানায় ফিরে আসার পর, সমরেশ দেখল দুটি অল্পবয়সী ছেলে ওর সাথে দেখা করার জন্য বসে আছে। মেজোবাবু আলাপ করিয়ে দিলেন, "এঁরা হলেন দাসবাবুর বাড়ির পেয়িং গেস্ট। এঁদের ডেকে পাঠিয়েছি তার কারণ হল ওই বাড়িতে থাকার সুবাদে ওঁরা হয়তো এই ব্যাপারে কোনো সাহায্য করতে পারেন।"
সমরেশ একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়ে ওদের এক এক করে ডাকল। যে ছেলেটি চাকরির জন্য এসেছে তার নাম অম্লান। বাঁকুড়া জেলায় ওর বাবার একটি রাইস মিল ও একটি ইঁটভাটা আছে। ছেলেটি জানাল সে বরাবরই পড়াশোনায় ভালো। এখন এম.বি.এ. পড়ছে এবং সেই সাথে চাকরির চেষ্টাও চলছে। অম্লান জানাল, মাঝে মাঝে দাসবাবুর একজন ভাইকে সে আসতে দেখেছে। দাসবাবুর চেহারার সাথে খুব মিল আছে। একদিন সন্ধেবেলায় সে দাসবাবুর সাথে তাঁর সেই ভাইয়ের ঝগড়া শুনতে পেয়েছিল। দাসবাবুর ভাই বলছিল, "তুমি আমাদের সবাইকে ঠকিয়েছ! সমস্ত সম্পত্তি তুমি একাই আত্মসাৎ করেছ। এমনকি ওই লক্ষ্মীমূর্তিটাও তুমি নিজের কাছে রেখে দিয়েছ, যেটা আমাদের যৌথপরিবারের সংসারের মঙ্গলের প্রতীক ছিল। আজ তাই তুমিই সব থেকে ভাল আছ!"
দাসবাবুর সাথে সাথে তাঁর স্ত্রীও খুব চিৎকার চেঁচামেচি করছিলেন। তাই ওদের কথা সে ভাল বুঝতে পারেনি। শুধু এটুকু বুঝেছে, ওঁরা বলছিলেন, "আমরা বাবা-মায়ের দায়িত্ব নিয়েছিলাম। তোমরা তো কেউ নাওনি।"
এরপর সমরেশ পরের ছেলেটিকে ডাকল। নিরঞ্জনের বাবা পেশায় শিক্ষক। নদিয়ার একটি গ্রামে প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারমশাই তিনি। সেও চাকরি খুঁজতে এখানে এসেছে। ছেলেটি বি.কম. গ্রাজুয়েট। এখন সি.এস. পড়ার সাথে সাথে চাকরির চেষ্টাও করছে। ওর লক্ষ্য কোম্পানি সেক্রেটারিশিপ পাশ করার পরেই কোনো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ঢুকে পড়া। এই ছেলেটিও পড়াশোনাতে ভালো বলেই মনে হলো। সে অবশ্য কোনো ঝগড়াঝাঁটি শোনেনি। কারণ বেশিরভাগ দিনই সে রাত্রে টিউশন সেরে একজন বন্ধুর মেসে থেকে যায়। সকালে সে বেরিয়েও যায় ন'টার মধ্যে। তবে দাসবাবুর একজন ভাইয়ের যাতায়াত বেড়েছে এই বাড়িতে — সেটা সেও লক্ষ করেছে।
ওদের বিদায় দিয়ে সমরেশ ভাবতে রইল দাসবাবু আর মনিকা দাসবাবুর ভাইয়ের যাতায়াতের কথাটা চেপে গেল কেন?
হয়তো পারিবারিক সমস্যার কথাটা কাউকে জানাতে চান না তাই।
পরের দিন সকালেই সমরেশ রাজন্য সম্পর্কে খোঁজখবর করল। ছেলেটা পড়াশোনায় সাধারণ মানের। এখন বি. কম. কমপ্লিট করার পরে সম্পূর্ণ বেকার। চাকরির অনেক পরীক্ষা দিচ্ছে; কিন্তু পাশ করেনি কোনোটাই। বাবার টাকাতেই সংসার চলে। কিন্তু দুজনের খরচের হাতটাও লম্বা। সুভাষবাবুর স্ত্রী বেঁচে নেই, বছর দেড়েক আগে লাং ক্যান্সারে মারা গেছেন!
সমরেশ সুভাষবাবুর একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর খোঁজ করে তাঁর সাথে গিয়ে দেখা করল। অজয় মিত্র ওই অঞ্চলের একজন নামকরা ব্যক্তিত্ব। তিনি এখন প্রফেসর জীবন থেকে রিটায়ার্ড, ইংরেজি সাহিত্যের উপরে অনেক বই লিখেছেন, বিয়ে করেননি এবং সারাজীবন শুধুই পড়াশোনা নিয়ে থেকেছেন। ইদানিং ভদ্রলোক বেশিরভাগ সময়টা উত্তরপাড়ার একটি লাইব্রেরিতেই কাটান। ফোনেতে সমরেশ নিজের পরিচয় দিয়ে ওনার এপয়েন্টমেন্ট নিয়েছিল। একটি কেসের তদন্তে ওনার সাহায্য চাই শুনে তিনি সানন্দে রাজি হয়ে গেছেন।
প্রায় সকাল দশটা নাগাদ গঙ্গার ধারে একটি সাদারঙের দোতলা বাড়ির সামনে গিয়ে বাইক থেকে নামল সমরেশ। রাস্তা থেকেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল কেউ একজন বাড়ির সামনে বাগানে ফুলগাছের পরিচর্যা করছে। নানান মরশুমী ফুলে সেজে উঠেছে বাগান। বাইরে গ্রিলের গেট খোলার আওয়াজ পেয়েই তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালেন। হাতে একটা খুরপি নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।
— আমি সমরেশ জানা, একটু অজয়বাবুর সাথে দেখা করতে চাই।
— আমিই অজয় মিত্র। বলুন, কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?
— আপনার কাছে আমার কিছু জানার আছে। যদি দয়া করে আমাকে কয়েক মিনিট সময় দেন!
— নিশ্চই, নিশ্চই। ভিতরে আসুন।
বাড়ির সামনে দুটি বারান্দা — একটি একতলায়; আর একটি দোতলায়। একতলার বারান্দায় উঠে তবে ভিতরে বসার ঘরে যাওয়া যায়। সিমেন্টের কালো পাথরের মতো মেঝে যেন চক চক করছে! এমন সিমেন্টের মেঝে এখন দেখাই যায় না!
— একটু বসুন। আমি হাতটা ধুয়ে আসি।
সমরেশ একটা সোফায় বসে দেখল সারা ঘরের দেওয়াল দেখা যাচ্ছে না — চারিদিকে শুধু আলমারি আর সেগুলি নানাধরনের বইতে ঠাসা! একটা মানুষ বুঝি তার সমস্ত রোজগারের টাকা শুধু বই কিনেই খরচ করেছে! দু-একটি তাকে নানারকমের পুরস্কার ও তার ছবি। একটি দেওয়ালের মাথায় জলরঙে আঁকা একটি সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ। নাম লেখা আছে সুনির্মল। হয়তো কোনো ছাত্রের আঁকা গিফট করা ছবি হতে পারে!
প্রায় মিনিট দশেক বাদে অজয়বাবু ভিতর থেকে ফিরে এলেন হাতে দু'কাপ চা নিয়ে। সমরেশ সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠলো, "আরে, এ কি স্যার! আপনি নিজে চা নিয়ে এলেন!"
— বোসো, বোসো। তোমাকে তুমি করেই বলছি। বয়সে তো অনেক ছোট! এবাড়িতে আমি একাই থাকি। নিজের সব কাজ নিজেই করি। আসলে আমি রিটায়ার্ড মানুষ তো! হাতে অফুরন্ত সময়!
চায়ে একটু চুমুক দিয়ে বললেন, "হ্যাঁ, বলো, কি যেন জানতে চাইছিলে আমার কাছে?"
সমরেশ সংক্ষেপে মূর্তি চুরির ঘটনাটা জানিয়ে বলল, "আমার মনে হয়েছে এতে ওঁদের কোনো পরিচিত মানুষের হাত থাকার সম্ভাবনাই বেশি। তাই সকলের সম্পর্কেই খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করছি।"
অজয়বাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন, "আমি যতদূর জানি সুভাষ সে প্রকৃতির লোক নয়, চুরি-টুরি ও করবে না। তবে ও বড্ড বাজে খরচ করে, ভেবেচিন্তে খরচ করা ওর ধাতে নেই! একসময়ে ওর সাথে আমার খুবই হৃদ্যতা ছিল, কিন্তু এখন আর আসে না। ওর ধারণা আমি ইচ্ছা করেই আমাদের কলেজে ওর ছেলের চাকরি করে দিইনি। চেষ্টা করলেই নাকি পারতাম! যাকগে সে-সব কথা।"
অজয়বাবু আরো বললেন, "জ্ঞানেন্দ্র দাসের সাথে আমার তেমন বন্ধুত্ব ছিল না। তবে সুভাষ ছিল আমার খুব কাছের মানুষ। সুভাষের স্ত্রীর সাথে মনিকাদেবীর খুব বন্ধুত্ব ছিল। প্রায়ই যেতেন দাসবাবুদের বাড়ি। দুজনের মধ্যে কথাও হয়েছিল সুভাষের ছেলে আর জ্ঞানেন্দ্রর মেয়ে বড় হলে ওদের বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ করে নিজেদের সখ্যতাকে সম্পর্কের অটুট বন্ধনে চিরস্থায়ী করবেন! ইতিমধ্যে জ্ঞানেন্দ্রর মেয়ে কলেজে পড়াকালীন একটি ছেলের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে এবং তাকেই বিয়ে করে জার্মানিতে চলে যায়। এই নিয়ে সুভাষ ও তার স্ত্রীর সাথে জ্ঞানেন্দ্রর একটু মনোমালিন্য হয়েছিল; তবে বন্ধুত্ব নষ্ট হয়নি। সুভাষের ছেলের থেকে সেই ছেলেটি অনেক যোগ্য। তাছাড়া সুভাষের ছেলে এখনো চাকরি জোগাড় করতেই পারেনি। কাজেই সুভাষের বলার মুখ নেই কিছু। আর আমি যদ্দুর জানি, জ্ঞানেন্দ্র আর সুভাষ দুজনেই খুব সুযোগসন্ধানী মানুষ! স্বার্থ ছাড়া এক পা চলে না!"
সমরেশ জানতে চাইল, "জ্ঞানেন্দ্রবাবুর সম্পত্তি সংক্রান্ত কোনো সমস্যা আছে? আপনি এবিষয়ে কিছু জানেন কি?"
— আমি সুভাষের মুখ থেকে যেটুকু শুনেছি তা হলো, জ্ঞানেন্দ্র ওর সব ভাইকে ফাঁকি দিয়েছে! ওর একজন ভাই বেহালায় থাকে। তার সাথে ওর সম্পর্ক ভাল নয়!
— আচ্ছা, আজ আমি উঠি স্যার। যদি দরকার হয় আবার হয়তো আসব।
— ঠিক আছে, শুধু একটু ফোন করে চলে আসবে।
বেহালার ঠাকুরপুকুর এলাকায় দাসবাবুর মেজোভাইয়ের দোতলা বাড়ির খোঁজ মিলল। বাড়ির একতলায় শুধুই দোকানঘর। পাঁচ-ছ'টা হবে। ডান পাশের গলির দিকে বাড়িতে ঢোকার একটা দরজা আছে। কলিং বেল বাজাতেই আধময়লা পাজামা আর হাফহাতা ফতুয়া গায়ে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক এসে দরজা খুললেন। বলে দিতে হয় না ইনিই দাসবাবুর ভাই — চেহারায় খুব মিল আছে।
— কাকে চাই?
— আপনিই তো হেমেন্দ্রবাবু?
— হ্যাঁ।
— আমি উত্তরপাড়া থানা থেকে আসছি। আমার নাম সমরেশ।
সমরেশ ওর আইডেন্টিটি কার্ডটা দেখালো। ভদ্রলোক কেমন ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, "আমার সাথে কী দরকার?"
— দরকারটা কি সেটা ভিতরে গিয়ে বলি?
— হ্যাঁ, হ্যাঁ। আসুন, ভিতরে।
দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই দুজন মহিলা এসে উঁকি মেরে গেল। একজন বোধহয় হেমেন্দ্রবাবুর স্ত্রী। ডানদিকের একটি ছোট ঘরে হেমেন্দ্রবাবু সমরেশকে নিয়ে ঢুকলেন। ঘরটিতে আলোবাতাস তেমন পৌঁছয় না। সেই ঘরে আলো জ্বেলে একটা সোফাতে বসতে বললেন। সমরেশ সোফাতে বসতে গিয়ে দেখল গদিটা নষ্ট হয়ে গেছে।
হেমেন্দ্রবাবু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, "দেখুন, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, আমাকে আপনার কী দরকার?"
— হ্যাঁ বলছি, আপনি তো জ্ঞানেন্দ্রবাবুর মেজো ভাই?
— হ্যাঁ।
— আপনি কি জানেন আপনার দাদার বাড়ি থেকে একটি সোনার লক্ষ্মীঠাকুরের মূর্তি চুরি গেছে?
— না, জানি না। তাছাড়া দাদার সাথে আমার সেরকম যোগাযোগও নেই।
— যোগাযোগ আছে। আমরা জানি। তবে আপনাদের সমস্যাটা বোধহয় সম্পত্তি নিয়ে, তাই না?
এবারে হেমেন্দ্রবাবু একটু উত্তেজিত হয়ে বললেন, "দাদা আমাদের যৌথ সম্পত্তির সিংহভাগটাই গ্রাস করেছে! শুধু বাবার একটা ব্যাংক একাউন্ট থেকে প্রত্যেককে একলাখ করে টাকা দিয়েছিল! বাবার অনেকগুলো ব্যাংকেই টাকা ছিল! কিন্তু সে টাকা কাউকে দেয়নি! শুধু তাই নয়, বসতবাটি সমেত প্রায় দু'বিঘের মতো জমি, পুকুর — সব নিজে নিয়েছে। পরে কিছুটা জমি প্লট করে বিক্রি করে দিয়েছে। মায়ের চল্লিশ ভরি সোনার গয়না — তাও নিয়েছে! কাউকে কিচ্ছু দেয়নি। শুধু বাবা-মা ওর কাছেই থাকতো বলে ও বাবাকে দিয়ে সব সম্পত্তি নিজের নামে করে নিয়েছিল। আমরা বাকি তিন ভাই নিজেদের ক্ষমতায় বাড়ি করেছি। আমার অবস্থাই সব থেকে খারাপ! নিচে ওই দোকানঘরের ভাড়ার আয়ে আমার সংসার চলে। টাকার অভাবে মেয়েটার বিয়ে দিতে পারছি না, তাই দাদার কাছে হাত পেতেছিলাম! দাদা কিছু দিতে তো চাইলই না, উল্টে বলল, আমরা বাবা-মায়ের দায়িত্ব নিইনি, তাই কিছু দেবার প্রশ্নই আসছে না!"
তিনি একটু থেমে আরো বললেন, "আমাদের পরিবারে ওই লক্ষ্মীমূর্তিটা ছিল সৌভাগ্যের প্রতীক! বাবা বলতেন, ওই মূর্তিটাই আমাদের সৌভাগ্য এনে দিয়েছে! দাদা সেটাও নিজের কুক্ষিগত করেছে! তবে, সেটা কোনোদিন চুরি যেতে পারে, এটা আমি ভাবতেও পারছি না!"
— শেষ কবে আপনি আপনার দাদার বাড়ি গিয়েছিলেন?
— কালীপুজোর তিনদিন আগে।
— সেদিন রাতেই কিন্তু মূর্তিটা চুরি গেছে!
— আপনারা কি আমাকে সন্দেহ করছেন?
— সন্দেহ করাই তো আমাদের কাজ! আমরা কাউকেই সন্দেহ-তালিকার বাইরে রাখছি না। ঠিক আছে, আজ উঠি।
দুপুরবেলায় একজন সুস্থ, সবল ও সক্ষম পুরুষমানুষের পক্ষে শুয়ে-বসে থাকাটা কতটা কষ্টকর রাজন্য তা জানে! আজ কি মনে করে সে আলমারি থেকে সেই পুরোনো অ্যালবামটা বের করল। এখনো জায়গায় জায়গায় আঠার দাগ আছে কিন্তু অনেক ছবি নেই! সোনাইয়ের সাথে ওর যত ছবি ছিল সব সে ছিঁড়ে ফেলেছে, নিজের হাতে! সেই ছোটবেলা থেকে অনেক ছবি ছিল! আজ সেই জায়গাগুলো এখন ফাঁকা, একদম ওর বুকের ভিতরটার মতোই!
রাজন্য আর সোনাই এক সাথে বড় হয়েছে, এক সাথে খেলা করেছে! দুজনে দুজনকে একদিন দেখতে না পেলে চলত না! খুব বন্ধুত্ব ছিল দুজনের! রাজন্য যখন ক্লাস নাইন-এ পড়ে তখন একদিন বিকেলবেলায় জ্ঞান-কাকুদের বাড়িতে গিয়েছিল সোনাইকে একটা ডিটেকটিভ গল্পের বই দিতে। দেখেছিল ওদের দোতলার বসার ঘরে বসে মা আর মনিকা-কাকিমা গল্প করছে। মা বলছে, "দেখো মনিকা, তোমার মেয়েটা ভারী মিষ্টি! আমাকে কাল পাকাবুড়ির মতো বোঝাচ্ছিল ছোলার ডালের হালুয়ার রেসিপি! আমিও মন দিয়ে শুনছিলাম! যেন কখনো শুনিই নি! ওকে আমার রাজন্যর বৌ করে নিয়ে আনবই! আগে ও চাকরি পাক!"
আড়াল থেকে কথাগুলো শুনে রাজন্যর কেমন যেন এক অজানা ভালোলাগার অনুভূতি হয়েছিল! লজ্জাও লাগছিল খুব! পা টিপে টিপে লুকিয়ে ছাদে উঠে গিয়েছিল সে! বিকেলে সোনাই ওখানেই থাকে জানত রাজন্য। দেখল সোনাই পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে; পিঠ পর্যন্ত খোলা চুল হাওয়ায় উড়ছে! সোনাইয়ের চোখদুটো পিছন থেকে চেপে ধরল রাজন্য!
— ছাড়, ছাড়! ছাড় বলছি! সোনাই চেঁচিয়ে ওঠে।
— এই নে তোর বই!
— তুই এতো পাজি না!
— এই সোনাই, আমাকে বিয়ে করবি?
— তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে, না? দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা! সোনাই হাতের সামনে একটা লাঠি জাতীয় কিছু খুঁজতে থাকে।
— শোন না, আমার মা তোর মাকে আজ বলছিল! আমি শুনেছি!
— তুই যাবি এখান থেকে?
— শোন্ না, তোর মাকে আমার মা বলছিল, আমি চাকরি পেলেই তোর সাথে আমার বিয়ে হবে!
— এই, ভালো হচ্ছে না বলছি! যা তুই! ভাগ!
সোনাই একটা কঞ্চি নিয়ে তাড়া করল। রাজন্য দুড়দাড় করে ছাদ থেকে নেমে পালিয়ে গেল।
সেই সোনাই দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল! এম.এস.সি-তে বটানিতে ফার্স্ট ক্লাস পেল। রাজন্য বরাবরই পড়াশোনায় মোটামুটি। গ্রাজুয়েশনের পর থেকেই একটা চাকরির চেষ্টা করতে লাগল হন্যে হয়ে! তার ইচ্ছে ব্যাংকে চাকরি; নাহলে সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের কোনো একটা পোস্টে। এদিকে বাবার রিটায়ারমেন্টের সময় এগিয়ে আসছে! তাড়াতাড়ি চাকরিটা পেতেই হবে! তারপরেই সোনাইয়ের সাথে তার বিয়ে হবে!
কিন্তু সে ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি সোনাই ওদিকে সন্দীপের সাথে প্রেম করছে! জানতে পারল একেবারে বিয়েটা ঠিক হয়ে যাওয়ার পরেই! কথাটা শুনে রাজন্য প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি! বুকটা ভেঙে গিয়েছিল তার! রাজন্যর মা-বাবাও কম ব্যথা পায়নি। কিন্তু তারা বাস্তব পরিস্থিতিটাকে মেনে নিলেন, সন্দীপের মতো ছেলে লাখে একটা মেলে! সে জায়গায় রাজন্য—তুলনাই হয় না!
সোনাইয়ের বিয়ের দিন রাজন্য একটা ইন্টারভিউ আছে বলে সকাল থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। সারাদিন অনেক ঘুরে ঘুরে খুব ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছিল। যায়নি সোনাইদের বাড়ি। সোনাই, দাসবাবু, মনিকা — সবাই ওর কথা অনেকবার করে জিজ্ঞাসা করেছিল! সুভাষ আর ওঁর স্ত্রী খুব অস্বস্তির মধ্যে পড়েছিলেন। কিন্তু রাজন্যকে অনেক সাধ্যসাধনা করেও তাঁরা নিয়ে যেতে পারেননি! সে রাতে চোখের জলে বালিশ ভিজে গেছিল ওর!
সোনাইয়ের বিয়ের পর পরই রাজন্যর মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ধরা পড়ল লাং ক্যান্সার! একেবারে শেষের দিকে! চারমাস ধরে চলল যমে-মানুষে টানাটানি! কোনো মেডিক্লেম ছিল না। জলের মতোই খরচ হল টাকাপয়সা! তবু শেষ রক্ষা হল না! সুভাষবাবু শক্ত মনের মানুষ! কিন্তু রাজন্য দু-দুটো ধাক্কায় একেবারেই ভেঙে পড়ল।
রাজন্য সি.এ.-র ইন্টার অবধি কমপ্লিট করেছিল — কিন্তু মায়ের মৃত্যু তাকে যেন একেবারেই তছনছ করে দিল!
গতবছরে আবার সোনাইদের সাথে দেখা হল। ওরা রাজন্যদের বাড়ি বেড়াতে এসেছিল — জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিল রাজন্যকে!
সোনাইরা এখন ভীষণ সুখী! শুধু সংসারে একটি সন্তান এলেই ষোলোকলা পূর্ণ হয়! ফেসবুকে ওদের ছবিগুলো দেখে রাজন্য জ্বলেপুড়ে মরে! তাও জয়দীপের সাথে মিউচুয়াল ফ্রেন্ডশিপ আছে বলেই দেখতে পায়! সোনাই অনেকবার ওকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল — একসেপ্ট করেনি রাজন্য! এই নিয়ে কতবার অনুযোগ করেছে সোনাই! রাজন্য এড়িয়ে গেছে! গতবারে যখন ওরা কলকাতায় এসেছিল, সোনাই সরাসরি জিজ্ঞাসা করেছিল ওকে — "এই, তুই আমার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করিস না কেন বল তো?"
— আমি কি তোদের যোগ্য?
— বন্ধুত্বের মধ্যে আবার যোগ্যতা কি রে?
— আছে, আছে, অযোগ্যকে কেউ পাত্তা দেয় না!
ওর মনের কোনো একটা ক্ষোভ আঁচ করে সোনাই ওকে সহজ করার চেষ্টা করে। কিন্তু রাজন্য ওদের সাথে সহজভাবে মিশতে পারছিল না! সবাই, বিশেষ করে জ্ঞান-কাকু আর কাকিমা সন্দীপের খুব প্রশংসা করছিলেন! সেসব ওর সহ্য হচ্ছিল না! ওদের হাসি-ঠাট্টা-মজা — কোনোকিছুই ওর ভাল লাগছিল না! গায়ে যেন জ্বালা ধরাচ্ছিল! কখন ওখান থেকে সরে যেতে পারবে সেটাই মনে মনে ভাবছিল রাজন্য!
সুযোগও এসে গেল। ওর এক বন্ধুর জন্ডিস ধরা পড়েছিল, হস্পিটালাইজ করতে হবে বলে বেরিয়ে চলে এল সে!
সোনাইয়ের সাথে ছোটবেলা থেকে মিশলেও তার মনটাকে কোনোদিন জানতে পারেনি রাজন্য! সোনাই আসলে অনেক বড় স্বপ্ন দেখত! এই মফস্বলের সাধারণ জীবন তাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি! তাকে হাতছানি দিত বিদেশের ঝকঝকে, বিলাসবহুল জীবনযাপন! যা সন্দীপ তাকে এনে দিতে পারবে, কিন্তু রাজন্য কোনোদিনই পারবে না। তাই সে রাজন্যর ভালোবাসার দিকে ফিরেও তাকায়নি।
থানায় ফিরতেই মেজোবাবু জানালেন, জয়দীপ সম্পর্কে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর খবর জোগাড় হয়েছে! একজন মেটিয়াবুরুজ থানায় অভিযোগ করেছে যে জয়দীপ তার কাছ থেকে ব্যাংকে চাকরি করে দেবার নাম করে অনেক টাকা নিয়েছে। এর আগেও দু-একজনের কাছ থেকে রেলে চাকরি পাইয়ে দেবার নামে অনেক টাকা নিয়েছিল। বোধহয় চাকরি না পেয়ে ব্যবসা করার জন্য সে এভাবেই টাকা জোগাড় করছিল।
লালবাজারে ভুক্তভোগীদের বয়ান শুনে যে স্কেচ আঁকা হয়েছে তার সাথে জয়দীপের চেহারার ভীষণ মিল আছে! তবে বিভিন্নজনের কাছে তার নাম বিভিন্ন। কেউ বলছে, সুধাংশু। কেউ বলছে, হিরণ। কারো কাছে, অমর্ত্য। কিন্তু তার বিরুদ্ধে নিশ্চিত কোনো প্রমাণ না পাওয়া গেলে তাকে গ্রেপ্তার করা যাচ্ছে না।
আরও খোঁজখবর করে জানা গেছে, জয়দীপের বাবা একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে ম্যানেজার পোস্টে চাকরি করতেন। অন্যায়ভাবে পরিচিত লোকেদের লোন পাইয়ে দেওয়া এবং জালিয়াতির দায়ে কিছুদিন হল স্যাক করা হয়েছে।
মূর্তি চুরির কেসটা ছাড়াও একটি মার্ডার কেসের তদন্ত করছে সমরেশ। খুনটা ঘটেছে একজন রাজনৈতিক দলের সদস্যের। রাত্রি ন’টা-সাড়ে ন’টা নাগাদ পার্টি অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময়ে কয়েকজন দুষ্কৃতী তার মোটরসাইকেল ঘিরে ফেলে এবং খুব কাছ থেকে গুলি চালায়। এই ঘটনায় দুজন ধরা পড়েছে। বাকিরা পলাতক। আগামীকাল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে ধৃতদের তোলা হবে। তাই সেইসব কেসের ডকুমেন্টস সে গুছিয়ে রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
পরের দিন সকাল সাড়ে ন'টার মধ্যে কোর্টে পৌঁছতে হলো। সেখান থেকে বেরোতে বেরোতে বেলা দুটো। থানায় ফিরে এসে সে মনিকাদেবীর বয়ানটা আর একবার পড়ে। মনিকাদেবী বলেছেন, ১৫ তারিখ সকালে টাকা চাইতে এসেছিল সুভাষবাবু। দুই বন্ধু শোবার ঘরে বসে কথা বলেছিলেন — তারপরে দাসবাবু আলমারি খুলে তাঁর বন্ধুকে টাকা দেন। তখনি বেরিয়ে যান সুভাষবাবু। তার মানে তাঁর মূর্তিটা নেবার স্কোপ কম।
অম্লান বলেছে, ওইদিন সন্ধেবেলায় আসেন সুভাষবাবুর ভাই। দুই ভাই ও মনিকাদেবীর ঝগড়া সে নিচে থেকেই শুনতে পেয়েছিল।
সন্ধে আট'টা-সাড়ে আট'টা নাগাদ আসে রাজন্য, তবে সে কয়েক মিনিট থেকেই চলে যায়। বোধহয় পারিবারিক ঝগড়াঝাঁটির মধ্যে সে নাক গলাতে চায়নি। হয়তো সে কোনো দরকারে এসেছিল; কিন্তু পরিস্থিতি সুবিধের নয় দেখে ফিরে গেছে।
কিন্তু অম্লানের বক্তব্য অনুযায়ী রাজন্যর বাইকের আওয়াজ সে পেয়েছিল আরো খানিকটা পরে। হয়তো সে নিচে কোথাও দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল--পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে যে কারণে এসেছে সেটা বলবে; কিংবা সিগারেট খাচ্ছিল।
সমরেশ মনিকাদেবীর কাছ থেকে রাজন্যর ফোন নম্বর নিল। ওর সাথেও একটু কথা বলা দরকার।
সন্ধেবেলায় সমরেশ গেল সুভাষবাবুর বাড়ি। সুভাষবাবু কোথাও বেরিয়েছিলেন। রাজন্য একাই ছিল বাড়িতে। দোতলা বাড়িতে সর্বত্র রুচির ছাপ! এত সুন্দরভাবে সাজানো বাড়ি খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়! রাজন্য বসার ঘরে বসতে বলে কাউকে বোধহয় চা বানাতে বলল।
বসার ঘরে মস্তবড় এল.ই.ডি টিভি এবং হোমথিয়েটার রয়েছে। পোর্সেলিনের টবে সুন্দর সুন্দর গাছ দিয়ে সারা ঘরটা সাজানো। সোফাসেটটার দাম কত হবে? বোধহয় লাখখানেকের কাছাকাছি! এমন সুন্দর ফ্লাওয়ার ভাস আগে দেখেনি সমরেশ — ইমপোর্টেড বলেই মনে হয়! ঘরে লাইটশেডগুলোও ভীষণ সুন্দর! দেওয়ালে একটা মস্ত বড় অয়েলপেন্টিং ঝুলছে, মনে হয় যাঁর ছবি তিনি রাজন্যর মা।
রাজন্য ফিরে আসতেই সমরেশ তার রুটিন ওয়ার্ক শুরু করলো। রাজন্য বললো, ১৫ তারিখ রাত্রি আটটা নাগাদ সে দাসবাবুদের বাড়িতে যায় মনিকাদেবীর মোবাইল ফোন ফেরত দিতে। কিছুদিন আগে সেটি ওনার হাত থেকে পড়ে ডিসপ্লে আউট হয়ে গিয়েছিল। তাই রাজন্যর পরিচিত কোনো দোকান থেকে সারিয়ে আনার জন্য সেটা ওকে দিয়েছিলেন। কিন্তু যখন ও ওখানে পৌঁছায় তখন তিনজন--মানে দাসবাবু, মনিকাদেবী ও দাসবাবুর ভাই মিলে এত চিৎকার চেঁচামেচি করছিলেন যে রাজন্য কিছু না বলেই ফিরে আসে। ও দোতলায় উঠে দেখে বসার ঘরে সবাই মিলে চেঁচিয়ে ঝগড়া করছে! তাই ও আবার সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসে।
— আপনি কি সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে আসেন?
— হ্যাঁ। সঙ্গে সঙ্গে।
— আচ্ছা, ওদের বাড়িতে কি সম্পত্তি সংক্রান্ত কোনো বিবাদ চলছে?
— হ্যাঁ, সে তো অনেকদিন ধরেই!
— আপনার কী মনে হয়, ওদের বাড়ির লক্ষ্মীমূর্তিটা কে নিতে পারে?
— আমি কী করে বলব? হয়তো দাসকাকু নিজেই ওটা কোথাও সরিয়ে রেখেছেন!
এমন সময় রাজন্যর মোবাইলে একটা ফোন এলো। ও "একমিনিট" বলে উঠে গিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। সমরেশ ড্রয়িং রুম থেকেই শুনতে পেলো, রাজন্য বলছে, "জয়দীপ, আমি একটু বাদে তোমাকে ফোন করছি!"
ফিরে আসতেই সমরেশ বললো, "আচ্ছা, আপনার কি মনে হয় যে দাসবাবু নিজেই মূর্তিটা কোথাও সরিয়ে রেখে এই চুরির নাটক করছেন?"
— হতে পারে।
রাজন্যর এমন নির্লিপ্ত উত্তর শুনে সমরেশের মনে হল রাজন্য চাইছে সমরেশ তাড়াতাড়ি চলে যাক।
সমরেশ উঠে পড়ল। বারান্দা দিয়ে বেরিয়ে আসার সময়ে একটা জুতোর র্যাকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, "ইস, আপনার এমন সুন্দর স্নিকারে কাদা লাগল কী করে?"
রাজন্য ভয়ানক অবাক হয়ে বললো, "আপনি কী করে বুঝলেন যে ওটা আমার স্নিকার?"
— পুলিশের চোখ তো, তাই! বাকি জুতোগুলো সাত নম্বর; শুধু আপনার বোধহয় নয় নম্বর, তাই না?
— হ্যাঁ। আসলে ওই জুতোটা পরে বাগানে গিয়েছিলাম তাই।
— বাগানে? আপনাদের তো সবটাই কংক্রিট, টবে গাছপালা!
— না মানে, ওই দাসকাকুদের বাগানে। বাইকটা ওখানে পার্ক করি তো?
— সেই ১৫ তারিখে?
— হ্যাঁ, ওই দিনেই।
থানায় ফিরে মেজো দারোগাবাবুকে সব বলতেই উনি লালবাজারে ফোন করলেন, "হ্যাঁ, এই দুটো নম্বর থেকে কাকে কাকে ফোন করা হচ্ছে একটু জানাবেন। দরকার হলে কল রেকর্ড করতে হবে!"
কল লিস্ট থেকে জানা গেল রাজন্যকে জয়দীপ ফোন করেছিল ঠিক সন্ধে সাড়ে-পাঁচটার কিছু পরেই; যখন সমরেশ রাজন্যর বাড়িতে বসে ছিল। আবার সন্ধে ছ'টা-পনেরোয় ফোন করেছে। তারপর রাত্রি আটটায়। দাসবাবুর জামাইয়ের খুড়তুতো ভাইয়ের সাথে এতবার যোগাযোগের কারণটা কী? এদিকে দাসবাবু কিংবা তার মেয়ে-জামাইয়ের সাথে খুব একটা সুসম্পর্ক নেই রাজন্যর! ব্যাপারটা দেখতে হচ্ছে!
মেজো দারোগাবাবু বললেন, "মনে হচ্ছে, এবারে রহস্যের জাল গুটিয়ে আসছে! যাদের সাথে সদ্ভাব তেমন নেই, তাদের নিকট আত্মীয়ের সাথে এত মধুর সম্পর্ক — কিছুটা অস্বাভাবিক ঠেকছে! তুমি কাল রাজন্যর উপরে নজর রাখো!"
আজ রাজন্য একটু ভাল করে সেজেগুজেই বেরিয়েছে। ও পরেছে ব্লু কালারের ফর্মাল শার্ট আর গ্রে কালারের প্যান্ট, পায়ে ব্রাউন ফর্মাল শু। ওকে আজ পার্ক স্ট্রিট যেতে হবে। ওখানে মিস্টার তৌসিফের সাথে দেখা করবে। রাজন্য জানে না ওকে ফলো করছে লালবাজারের গোয়েন্দা অফিসাররা, সঙ্গে সমরেশও। তৌসিফ পেশায় একজন ব্রোকার। সে বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে চাকরি করে দেবার নাম করে টাকা নেয়।
রাজন্য একটা রেস্টুরেন্টের সামনে ক্যাব থেকে নেমে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। সিকিওরিটি গার্ড সেলাম ঠুকে দরজা খুলে দিল। আগে থেকে তৌসিফ হাজির ছিল সেখানে। সে এখানে বেশ পরিচিত। ওরা একটা কেবিনে ঢুকে বসলো।
— ক্যা লেঙ্গে? চায়ে, কফি?
— নেহি, নেহি, ওনলি কোল্ড ড্রিঙ্কস।
কোল্ড ড্রিংকসে চুমুক দিয়ে কথাবার্তা শুরু হলো।
— দেখিয়ে, ম্যায় আপকো গ্যারান্টি দেতা হুঁ। রুপিয়া মিল জানে সে আপকা নোকরি পাক্কা!
— লেকিন, ইতনা কাঁহাসে দেঙ্গে? মেরা পাস্ ইতনা হ্যায় নেহি!
— আপকো বোল রাহা না? ইয়ে রুপিয়া মুঝে দুসরা কিসিকো দেনা হোগা! নেহি তো ইয়ে চান্স হাথসে নিকাল জায়গি!
— হাম কোসিস কর রাহে! লেকিন ইয়ে বহত মুশকিল হ্যায়! মেরা পাস্ আভি এক লাখ হ্যায়। প্লিজ, ইস্ কো লিজিয়ে! কাম আগে বঢ়াতে রহিয়ে। ম্যায় দে দুঙ্গা!
— দেখিয়ে, হামলোগ এয়সা করতা নেহি, লেকিন আপ জয়দীপ বাবুকা জনপহেচান হ্যায়, ইসি লিয়ে!
হঠাৎ বাইরে একটু গোলমাল শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে কেবিনের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল পুলিশ! "হ্যান্ডস আপ! কেউ পালাবার চেষ্টা করবেন না! আমরা বাইরেটা ঘিরে ফেলেছি!"
তৌসিফ ছাড়বার পাত্র নয়, সেও পকেট থেকে রিভলভার বের করতে যাচ্ছিল। কিন্তু সমরেশ বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপরে! মুহূর্তে তার হাতদুটো পিছনে চেপে ধরল। হাতে পরিয়ে দেওয়া হল হাতকড়া। রাজন্য পালাবার সুযোগই পেল না। সে ঘটনার অতর্কিতে বিহ্বল হয়ে গিয়েছিল! বার বার বলতে লাগলো, "আমি কিছু করিনি!"
অফিসাররা বললেন, "সেটা লালবাজারে গিয়ে প্রমাণ হবে!"
লালবাজারে আসার পর পরিস্থিতি প্রতিকূল দেখে রাজন্য তার সব অপরাধ স্বীকার করে নিল। এমন কি সমরেশের সঙ্গে তদন্তকারী অফিসারদের চাপে সে এটাও স্বীকার করল যে, দাসবাবুর বাড়ি থেকে মূর্তিটা সেই চুরি করেছিল! কিন্তু এখনো সে বিক্রি করার সুযোগ পায়নি। তার কারণ পুলিশ যেভাবে খোঁজাখুঁজি শুরু করেছে, তাতে করে কোথাও বিক্রি করতে গেলে ধরা পড়ে যাবার সমূহ সম্ভবনা। রাজন্য বর্ন ক্রিমিনাল নয়; তাই তার সাথে কোনো মূর্তি পাচারকারির যোগাযোগ নেই। কিন্তু সে ঝোঁকের মাথায় কাজটা করেছিল কিছুটা টাকার প্রয়োজন ও সোনাইদের একটু শিক্ষা দেবার জন্যই এবং ভেবেছিল পরে পরিস্থিতি থিতিয়ে এলে সে মূর্তিটাকে কোনো বিদেশী ক্রেতার কাছে চড়া দামে বিক্রি করে দেবে। তাতে করে টাকাও আসবে এবং সোনাইদের সৌভাগ্যের ওপরে হানা যাবে একটা আঘাত!
ঘুষের অ্যাডভান্স বাবদ একলাখ টাকা সে জোগাড় করেছে তার নিজের একজোড়া আংটি, একটা গলার চেন আর সৌখিন দামি কলম বিক্রি করেই।
তৌসিফের ফোনে অনেকবার কল করেছিল জয়দীপ। কায়দা করে তৌসিফকে দিয়ে ফোন করিয়ে তাকেও ধরা হয়েছে!
জয়দীপ আর তৌসিফ দুজনে মিলে অনেককেই তাদের জালে ফেলেছে। এভাবে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে তারা। তাদের এবারের টার্গেট ছিল রাজন্য। ওরা তাকেও ফাঁদে ফেলে টাকা নিতে চেয়েছিল। আর চাকরির চেষ্টায় হন্যে হয়ে ঘোরা রাজন্য খুব সহজেই ধরা দিয়েছিল তাতে!
রাজন্য একটা চাকরি পেয়ে পরিচিত সমাজের কাছে বিশেষ করে দাসবাবুদের কাছে তার যোগ্যতা প্রমাণ করতে চেয়েছিল। এজন্য সে সব কিছু করতে রাজি ছিল। এমন কি প্রতিনিয়ত সুভাষবাবুর সাথে তার মনান্তর হতে থাকে টাকাপয়সা নিয়ে! শ্রীরামপুরের জমিটা বিক্রি করার পরার্মশ দেয় সে-ই। নাহলে ঘুষের জন্য চারলক্ষ টাকা জোগাড় করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু টাকাটা ঘুষ হিসাবে দিতে হবে শুনে সুভাষবাবু বেঁকে বসেন! ঘুষের কি কোনো প্রমাণ থাকে? টাকা নিয়ে চাকরি না দিলে কী হবে? সেটাই তিনি ছেলেকে বোঝাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু রাজন্য নাছোড়বান্দা! কিছুটা নিমরাজি হয়ে তিনি জমি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু জমির কাগজপত্র খতিয়ে না দেখে প্রোমোটার চট করে টাকা দিতে রাজি হয় না। এদিকে তৌসিফ ও জয়দীপের প্ল্যানমাফিক উপর্যুপরি চাপে রাজন্য দিশেহারা হয়ে পড়ে! ওরা খুব তাড়াতাড়ি দুবাই চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল।
১৫ তারিখ রাতে রাজন্য দাসবাবুদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময়ে তার বাইকটা নিতে বাড়ি ও পাঁচিলের মাঝখানে বাগানের সরু অংশটায় যায়। সে বরাবর লোহার ঘোরানো সিঁড়িটার নিচেই বাইক রাখত। উঠোনে রাখলে চারিপাশে রাখা ফুলের টবে ধাক্কা লেগে ভেঙে যেতে পারে। তখন দাসবাবুর ভাইয়ের সাথে ওনাদের কথা কাটাকাটি হচ্ছে দেখে সে পরে আসবে ভেবে চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ দেখে উপরে বাথরুমের দরজাটা একটু ফাঁক হয়ে আছে! তার মানে আজ জমাদার এসেছিল। সে চলে যাবার পরে কেউ দরজাটা বন্ধ করতে ভুলে গেছে! সাবধান করা দরকার!
রাজন্য আবার ওপরে ওঠে। কিন্তু তখন বসার ঘরে তিনজনে সমানে চেচাঁচ্ছে। দাসবাবুর ভাই বলছেন, "তোমরা সব নিয়েছ! আমাদের তিনভাইকে তোমরা পুরোপুরি ঠকিয়েছ! এমন কি ওই লক্ষ্মীমূর্তিটা — ওটাও তোমরা নিজেদের কুক্ষিগত করেছ! এখন তাই তোমাদেরই কপাল ভালো! আজ আমার মেয়ের বিয়ে, তোমাদের কাছে হাত পাতছি! আর তোমরা বলছ, আমরা দশ হাজারের বেশি দিতে পারছি না!"
রাজন্য দেখতে পায় দাসবাবুর শোবার ঘরে আলো জ্বলছে; কিন্তু কেউ নেই। আলমারিতে চাবি ঝুলছে! হঠাৎ ওর মাথায় খেলে যায় একটা প্ল্যান! এই বাড়িতে ওর অনেকদিনের যাতায়াত। কোথায় কি আছে খুব একটা অজানা নয়! আলমারির পাল্লাটা একটু টানে ... তারপর ড্রয়ার। ওই তো কাপড় জড়ানো সেই মূর্তিটা! ওটার অনেক টাকা দাম! ব্যাস, আর কালবিলম্ব করে না সে! মূর্তিটা শার্টের ভিতরে চালান করে দিয়ে বাথরুমের খোলা দরজা দিয়ে নেমে যায় নিচে। তাই অম্লান তার বাইকের আওয়াজ দেরিতে পেয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয়বার তাকে উপরে উঠতে দেখেনি সে — কারণ ওই সময়ে সে পড়াশোনা বা অন্য কিছুতে ব্যস্ত ছিল।
রাজন্য মূর্তিটা বাইকের ডিকিতে ভরে নিয়েছিল। পরে বাড়ি ফিরে সেটা পোর্সেলিনের বড় টবে গাছের নিচে লুকিয়ে রাখে। মূর্তিটা কোথায় কিভাবে বিক্রি করবে ভেবে ঠিক করতে পারছিল না সে! কারণ তাতে ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা ছিল!
পরের দিন বিকেলে মেজো দারোগাবাবু সমরেশকে বললেন, "চলো, মূর্তিটা ফিরিয়ে দিয়ে আসি। আমার ওদিকে একটা কাজও আছে।"
অগত্যা সমরেশ সঙ্গে চলল। দাসবাবুদের বাড়ি গিয়ে দেখল, কর্তা-গিন্নী বিমর্ষ মুখে বসে আছেন। ওঁরা বোধহয় ভেবেছিলেন মূর্তিটা আর পাওয়া যাবে না! কিন্তু আজ সকালেই ফোনে জানানো হয়েছিল মূর্তিটা পাওয়া গেছে! তবে সেটা কে চুরি করেছে তা তখন জানানো হয়নি। সেটা বলার জন্য আর মূর্তিটা ফেরত দিতেই মেজোবাবুর সাথে সমরেশের আগমন। তবু যতক্ষণ না সেটা হাতে আসছে মানুষের চিন্তা তো কমে না!
মেজোবাবু প্যাকেটটা দাসবাবুকে দিয়ে বললেন, "খুলে দেখে নিন।"
দাসবাবু প্যাকেট খুলে মূর্তিটা নিয়ে বুকে চেপে ধরলেন! মূর্তি ফিরে গেল যথাস্থানে, দেরাজের ভিতরে।
মেজোবাবু বললেন, "আজকের দিনে মানুষ কাউকে আর বিশ্বাস করতে পারছে না এই কারণেই! ঘরের ভিতরেই শত্রু! মানুষের মধ্যেই শয়তান! অর্থের লোভে জয়দীপ যেমন লোক ঠকাতে দ্বিধা করে না; তেমনি রাজন্য আপনাদের এত পরিচিত হয়েও এই মূর্তিটা চুরি করতে দ্বিধা করেনি! ভাগ্য ভাল সে এখনো পর্যন্ত কাউকে মূর্তিটা বিক্রি করে উঠতে পারেনি! তাই আপনারা ফেরত পেলেন!"
দারোগাবাবুর তাড়া ছিল, তাই আর সময় নষ্ট না করে উঠে পড়লেন। কিন্তু মনিকা কিছুতেই সকলকে মিষ্টি না খাইয়ে ছাড়বেন না!
দাসবাবু বললেন, "আপনাদের যে কী বলে ধন্যবাদ দেব!"
— এটা তো আমাদের ডিউটি! আজ উঠি?
সন্ধে হয়ে আসছে। সমরেশ আর একবার দেখতে পেল দীঘির পাড়ে সূর্যাস্তের সেই অপরূপ দৃশ্য! মেজোবাবুরও তা নজর এড়াল না। তিনিও কিছুক্ষণ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, "চলো।"