• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৯ | ডিসেম্বর ২০১৭ | গল্প
    Share
  • অনুরণ : রোহণ কুদ্দুস


    র্ণবের বামহাতের কনুই আর কবজির মাঝামাঝি হাতের ভেতরের দিকে এবড়োখেবড়ো অক্ষরে একটা উল্কি আঁকা হয়েছিল — আই লাভ অনি।

    অনি মানে অনির্বাণ। ক্লাস নাইন থেকে অর্ণবের সহপাঠী। ক্লাস এইট পর্যন্ত কলকাতার কোন এক স্কুলে পড়ত সে। পরে তার বাবার অসুস্থতার কারণে ফিরে আসে গ্রামে। অনির্বাণ সুদর্শন, পড়াশোনায় চৌকশ, আবৃত্তিতে ঈর্ষণীয় — সব মিলিয়ে ক্লাস টেনের কিছু আগে এবং কিছু পরে তার প্রতি অর্ণবের বিশেষ অনুরাগ নিয়ে ক্লাসের বন্ধুরা হাসাহাসি করত। মাধ্যমিকের পর একই স্কুলে থেকে তারা ক্লাস ইলেভেন শুরু করেছিল। অর্ণব আর্টস আর অনির্বাণ সায়েন্স। টিফিনের পর সেকেন্ড হাফে অনির্বাণের ল্যাব থাকত। অর্ণবের অধিকাংশ দিনই শেষ দুটো পিরিয়ড থাকত না। সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত ল্যাবরেটরির বাইরে। মাঝে মাঝে ফিজিক্স ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট কুঞ্জদা টিপ্পনি কাটত – “রাধেশ্যাম, রাধেশ্যাম।” অন্য ছাত্ররা মুখ টিপে হাসত। অর্ণব গায়ে মাখত না সেসব। ল্যাবের দরজার দিকে পিঠ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে খেলার মাঠে রোদ দেখত। অনির্বাণ অবশ্য এসবে বিব্রতই হত। অর্ণবকে এড়িয়ে চুপি চুপি সে নেমে যেত নিচের তলায়। খেলার মাঠের সাইডলাইন ধরে তাকে স্কুলগেটের দিকে হেঁটে যেতে দেখে অর্ণব গলা ফাটিয়ে ডাকত — অনি, অনি-ই-ই-ই-ই। কিছুদিন পরে তার সেই ডাকে আর জোর ছিল না।

    আরও কিছুদিন পর বাজারের হেমন্তর কাছে বসে অর্ণব বামহাতে উল্কিটা আঁকিয়েছিল। রটেছিল, অনির্বাণের উপেক্ষার ধাক্কায় অর্ণব নাকি গাঁজা ধরেছে। বাজার ছাড়িয়ে ছোট খালের ধারে কালীপদর ঝুপড়ি। সেখানে নাকি তার অবারিত যাতায়াত। কালীপদ দিনে সবজি বেচত আর সন্ধে নামলে গাঁজায় দম দিত। বাপ-মা মরা হেমন্ত তারই ভাইপো। কাকার সবজির ঝাঁকার পাশে উল্কি আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে বসত সে। বিদ্যেটা কোত্থেকে সে শিখেছিল কেউ জানত না, তা নিয়ে কারও মাথাব্যথাও ছিল না। সেই সময় অনেকেই হাতে বা বুকে হেমন্তর থেকে মা, ওঁ বা ত্রিনয়ন, ত্রিশূল, সাতশ ছিয়াশি আঁকিয়ে নিয়ে যেত। সেইসব খুচরো কাজের তুলনায় অর্ণবের হাতের ‘আই লাভ অনি’ ছিল হেমন্তর সিস্টিন চ্যাপেল। ফলে সুযোগ পেলেই সেই উল্কিটা সে তার প্রতিভা এবং/অথবা ইংরেজি অক্ষরজ্ঞানের বিজ্ঞাপন হিসাবে ব্যবহার করত। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ছোট মফস্বলটিতে আলোচনার বিষয় হিসাবে অর্ণবের উল্কি এবং উল্কির আগে ও পরে তার গাঁজাসেবন প্রথম তিনের মধ্যে জায়গা করে নিল। আর যেটা এতদিন স্কুলের গণ্ডির মধ্যেই ছিল, অনির্বাণের প্রতি তার মতিচ্ছন্ন ভালোবাসা, এবার ডালপালা বিস্তার করে কুৎসিত হয়ে উঠল। ফলে উচ্চমাধ্যমিকের আগেই জেদ করে স্কুল বদলে অনির্বাণ ফেরত চলে গেল কলকাতায়।

    বলা হয়ে থাকে, মানুষ তার শেষ সময়ে তার সমস্ত জীবনটা চোখের সামনে দিয়ে দ্রুত চলে যেতে দেখে। গত দু’দিন তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় অর্ণব তার জীবনের এই অংশটুকু আরও কিছু ঘটনার সঙ্গেই বেশ কয়েকবার দেখেছে। একগুঁয়ে রেকর্ড প্লেয়ারের রিওয়াইন্ড আর প্লে বাটনে চাপ পড়েছে ক্রমাগত। অবচেতনে ভেবেছিল হয়তো সে মারা যাচ্ছে। কিন্তু তৃতীয়দিন কিছুটা রোদ আড়াআড়ি তার চোখে পড়ায় বুঝল, সে ধীরে ধীরে মৃত্যু থেকে ফিরে আসছে। তেষ্টা পাচ্ছে। শুকনো ঠোঁট চেটে ঘরের আশেপাশে দেখল একবার। খাটের পাশে কিছু উঁচুতে স্যালাইনের বোতল। পাশে একটা ধাতব টেবলের ওপর তিন-চারটে বোতল। জানালার অর্ধেক টানা পর্দার রঙ খসখসে সবুজ। একটা হাসপাতালের কেবিনে শুয়ে আছে সে। পায়ের কাছে সামান্য দূরে একটা চেয়ারে কাগজ মেলে বসে আছেন বাবা। কাগজের প্রান্তে দু’হাতের আটটা আঙুল ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। অর্ণব ডাকতে চেষ্টা করল। অস্ফুট গোঙানি বেরিয়ে এল। এমন সময় একজন মাঝবয়সি নার্স ঘরে ঢুকে নির্লিপ্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, “এখন কেমন লাগছে?” তাঁর কথায় বাবা কাগজটা সরিয়ে অর্ণবের দিকে তাকালেন। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, “বেশি নড়াচাড়া করার চেষ্টা কোরো না। ব্যান্ডেজটা এখনও সপ্তাখানেক থাকবে।”

    অর্ণব ব্যান্ডেজের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করে। হাত দিয়ে মাথাটা স্পর্শ করতে গিয়ে আবিষ্কার করল ডানহাতটা সাড়া দিচ্ছে না। সেদিকে তাকিয়ে দেখল তার ডান কাঁধ থেকে হাতের ওপরের কিছুটা অংশ ব্যান্ডেজে বাঁধা। তারপর শুরু হয়েছে চামড়া ছাড়া ধাতব একটা অবলম্বন। তার শেষ প্রান্তে শুয়ে আছে পাঁচটা চকচকে আঙুল। লাল-নীল-হলুদ রঙের পাতলা কিছু তার আঙুল থেকে উঠে পেঁচিয়ে আছে কৃত্রিম হিউমেরাস, রেডিয়াস আর আলনাকে। ডানহাতের জায়গায় ইস্পাতের এই কাঠামোতে তার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে নার্স বললেন, “তোমার হাতটা বাঁচানো যায়নি।” তারপর সামান্য উজ্জ্বল মুখে বললেন, “ক’দিনের মধ্যেই সড়গড় হয়ে যাবে।” এরপর অর্ণবকে তিনি বোঝাতে লাগলেন, কীভাবে এই এ-এল মডেল টু-ফিফটি-সিক্স তার কাঁধ থেকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে নিপুণ কারিগরিতে। মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোবের মোটর কর্টেক্সে বসানো হয়েছে কন্ট্রোল চিপ। একটা ইলেকট্রনিক সারকিটের মতোই ওই চিপ আর এই এ-এল বা আর্টিফিসিয়াল লিম্বটি যুক্ত হয়েছে সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমে কিছু কৃত্রিম এক্সটেনশান যোগ করে। অর্ণবের মনোযোগ থেকে এইসব খুঁটিনাটি গড়িয়ে পড়ছিল। নার্সের কথার মাঝেই বাবা উঠে গেছেন কাগজ বন্ধ করে। অর্ণব নার্সকে জিজ্ঞাসা করল, “আমি এখন কোথায়?” কথার খেই হারিয়ে একটু থতমত খেয়ে তিনি উত্তর দিলেন, “হাসপাতালে।” অর্ণব ঘাড় নাড়ল, “না, মানে এটা কি কলকাতা?” নার্স ঘাড় নাড়লেন, “হ্যাঁ।” তারপর ব্যস্ত হয়ে বললেন, “আমি বরং ডক্টর সিনহাকে ডেকে দিই। তোমার জ্ঞান ফিরলে উনি জানাতে বলেছিলেন।”

    ডক্টর সিনহার বদলে এ-এল মডেল টু-ফিফটি-সিক্সের মেন্টর দীপের সঙ্গেই অর্ণবের কথা হয় বেশি। সে এই হাসপাতালের কর্মী নয়; কলকাতায় কৃত্রিম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরির নতুন একটা সংস্থা এ-এল ইনকর্পোরেটেড থেকে এসেছে। দীপের কাজ অর্ণবকে তার নতুন হাতের ব্যবহারে সাহায্য করা। তার থেকেই অর্ণব জানতে পেরেছে, এই কৃত্রিম হাতটা পরীক্ষামূলকভাবে লঞ্চ করা হয়েছে। আগের এ-এলগুলো ছিল কাঠের হাত-পায়ের মতোই ভোঁতা। কিন্তু এই নতুন মডেলে যোগ করা হয়েছে মাথার ওই চিপ, যাতে ব্যবহারকারী ইচ্ছামতো চালাতে পারে তার অঙ্গটাকে। এই এক্সপেরিমেন্টে অংশ নেওয়ায় অর্ণবের অপারেশন বা অন্যান্য চিকিৎসার খরচ পুরোটাই বহন করছে ওই সংস্থা। বাবার সঙ্গে কোনওদিনই বিশেষ কথা হয় না তার। তাই অর্ণব প্রথমে বুঝতে পারেনি এমন ব্যয়বহুল হাসপাতালে এই অত্যাধুনিক চিকিৎসার বন্দোবস্ত তার পোস্টমাস্টার বাবা কী করে করল। অবিশ্বাস্য হলেও ভেবেছিল কোনও মেডিকেল ইনসিওরেন্স হয়তো বা। এখন সেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল তার কাছে। অবশ্য দুর্ঘটনার পর সে কীভাবে এখানে এল আর কেনই বা এ-এল ইনক তাকেই এ-এল মডেল টু-ফিফটি-সিক্সের গিনিপিগ হিসাবে বেছে নিল, সেটা তার কাছে পরিষ্কার হল না। ওসব চিন্তা করার মতো যথেষ্ট উৎসাহও তার নেই।

    এখন তার দিন শুরু হয় বাবাকে দেখে। আটটা-সাড়ে আটটায় ঘুম থেকে উঠে অর্ণব দেখে মুখের সামনে খবরের কাগজ মেলে ধরে চেয়ার বসে আছে বাবা। তাদের বাড়ি থেকে কলকাতা পৌঁছতে ঘণ্টাদুয়েক লাগে। বাবা তাহলে কত সকালে বের হয় বাড়ি থেকে? বাসে আসতে আসতে ঘুমিয়ে নেয় কি? অত ভোরে উঠে চান করতে গিয়ে ঠান্ডা লেগে যাবে না তো? কিন্তু এসব কথা বাবাকে জিজ্ঞাসা করা হয় না। নার্স আর ডক্টর সিনহা রুটিনমাফিক চেক-আপে এলে বাবা কাগজটা গুটিয়ে নিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে বলে, “আমি একটু খেয়ে আসছি।” অর্ণব জানে না বাবা কোথায় খেতে যায়। হয়তো নিচে কোনও ক্যান্টিন আছে। বাবা অবশ্য ওই খেতে যাওয়ার নাম করে সেই যে যায়, ফেরে একেবারে দুপুর দুটো নাগাদ। আবার খবরের কাগজ মেলে বসে থাকে। দুপুরে খাওয়ার পর অর্ণব কোনওদিন ঘুমোয়। কোনওদিন জানালার বাইরে তাকিয়ে পুরনো কথা ভাবে। তার বামহাতের উল্কি। অনির্বাণের চলে যাওয়া। তার উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হওয়া।

    মা চলে গিয়েছিল সেই কোন ছোটবেলায়, মনেও পড়ে না। তারপর বাবা কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে, এমন কথা জোর দিয়ে বলতে পারে না অর্ণব। অনির্বাণের ব্যাপারটাও বাবা জেনেছিল বছরখানেক পরে। তাদের পুরো মফস্বল শহরে সবাই যা জানত, বাবা কী করে সেই ব্যাপারটাও সময়ে জানতে পারেনি কে জানে। পরে কোনও শুভানুধ্যায়ী হয়তো বাবার কানে তুলেছিল। অর্ণব তখন সবে কলেজে ঢুকেছে। বাড়ি ফিরে পাড়ার লাইব্রেরিতে গিয়ে বসে থাকত বিকেলবেলা। বাবা নির্জন রিডিংরুমে এসে বসেছিল অর্ণবের সামনে। তারপর দেওয়ালের আলমারির দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করেছিল, “তুমি কি সত্যিই...” অর্ণব প্রথমে কিছু বুঝতে পারেনি। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল বাবার দিকে। ওই সময় ওই জায়গায় বাবার এমন আকস্মিক উপস্থিতির ধাক্কাটা সামলাতে সামলাতেই বাবা তার হাতের দিকে ইশারা করে বলেছিল – “উল্কি!” অর্ণব ফুলহাতা জামা পরত উল্কিটা ঢেকে রাখতে। বাঁ হাতের হাতা সরিয়ে দেখিয়েছিল। চাপা আর্তনাদ আর দীর্ঘশ্বাসের মাঝামাঝি একটা আওয়াজ বেরিয়ে এসেছিল বাবার গলা থেকে। আরেকটু চুপ করে থেকে বলেছিল, “আর নেশাভাঙ?” উত্তর না দিয়ে অর্ণব মাথা নিচু করে বইয়ের পাতায় তাকিয়েছিল একমনে। বাবা আস্তে আস্তে উঠে চলে গিয়েছিল।

    কলেজ শেষ করে মাস্টার্স। তারপর সরকারি স্কুলে পড়ানোর চাকরি। বাবাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা দেখানোর পর জিজ্ঞাসা করল, “কী ঠিক করলে?” অর্ণব প্রশ্নটার মানে বুঝতে না পেরে একটু চুপ করেছিল। তারপর জিজ্ঞাসা করেছিল, “চাকরিটা নেব কিনা?” বাবা মাথা নাড়ল। অর্ণব বলেছিল, “নিয়েই নিই।” বাবা উত্তর দিয়েছিল, “আসলে অনেকটা দূর তো।” অর্ণব বলেছিল, “রোজ যাতায়াত করা সম্ভব হবে না। ওখানে ঘরভাড়া নিয়ে থাকতে হবে।” বাবা আর কিছু বলেনি। এরপর একদিন নিজের সামান্য কিছু জিনিসপত্র নিয়ে অর্ণব তার বাড়ি থেকে তিরিশ কিলোমিটার দূরের স্কুলে পড়াতে চলে গেল। ছুটিছাটায় আসত। আর খেয়াল করার চেষ্টা করত তাদের বাড়িটা আরও একটু পুরনো হয়ে গেছে? বাবা কি আরও চুপচাপ?

    “আজ শুনলাম দুপুরে প্রায় নিজে হাতেই খেয়েছ। গুড!” দীপ আফটারনুন সেশনের জন্যে এসে গেছে। বাবা সকালের মতোই খবরের কাগজটা পাট করে হাতের ছোট ব্যাগে ঢুকিয়ে বলে, “আমি তাহলে আসি।” অর্ণব বলে, “কাল আসার দরকার নেই। আমি তো ঠিকই আছি এখন।” বাবা দরজার দিকে তাকিয়ে বলে, “আচ্ছা, দেখি।”

    দীপ তাকে এখন লিখতে শেখাবে। আজ সকালে শিখিয়েছিল কলম ধরা। অর্ণব কাগজ নিয়ে কসরত করে। বলপেনের পয়েন্ট ঢুকে যায় কাগজের মধ্যে। অনেকক্ষণের চেষ্টায় ইংরাজি বর্ণমালার প্রথম কয়েকটা অক্ষর লেখা হয়। দীপ হেসে বলে, “তোমার উল্কির অক্ষরগুলোর কাছাকাছি গেছে হে।” হাসপাতালের ইউনিফর্মে অর্ণবের উল্কি আর ঢাকা থাকে না এখন। সে লজ্জা পেয়ে হাত আড়াল করার চেষ্টা করে। দীপ আবার হেসে জিজ্ঞাসা করে, “গার্লফ্রেন্ড?” বিব্রত অর্ণব হাসার চেষ্টা করে, “তেমন কিছু না।” ঘণ্টাখানেক দীপের তত্ত্বাবধানে লেখালেখির পর্ব চলল। যাওয়ার আগে সে বলে গেল, “খুব ভালো হচ্ছে। ইন ফ্যাক্ট, তুমি যে এত তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে আমরা কেউই ভাবিনি।”

    অর্ণব বালিশে হেলান দিয়ে কেবিনের টিভিটা চালিয়ে দেয়। বিনা আওয়াজে পর্দায় একের পর এক ছবি আসতে থাকে। এমন সময় তার হাতটা, ডান হাতটা, শিরশিরিয়ে উঠল। কাল রাতে ঘুমের মধ্যেও কয়েকবার হয়েছে। স্বপ্ন মনে হয়েছিল। একটা ঢেউয়ের মতো অনুভূতি। না, হাতে এসে জলের ঢেউ লাগা নয়। তার হাতটাই একটা ঝিল। তাতে বাতাসের টানে ঢেউ লাগছে অল্প অল্প। ছোটবেলায় ঝিল দেখেছিল অর্ণব। পাশের বাড়ির মণিজ্যেঠুদের সঙ্গে পিকনিক করতে গিয়েছিল সে আর বাবা। একটা ঝিলের ধারে ঘাসের সবুজ গালিচাপাতা মাঠ। তার একদিকে তারা বসেছিল শতরঞ্জি মেলে। কিন্তু এই ঝিলটা তেমন নয়। এর কোনও পারে কোনও মাঠ নেই। যতদূর চোখ যায় জল, শুধু জল। মন হু হু করা বাতাস বয়ে যায় সারাবেলা। শিরশির করে ওঠে ঝিলের জল। কোথাও কোনও মাছ ঘাই দিয়ে ওঠে না। মেঘছাওয়া আকাশের ছাই রঙে জলের দিকে চাইলে মন কেমন করে। স্টিলের তৈরি হাতটার দিকে তাকিয়ে অর্ণবের গা ছমছম করে ওঠে।

    রাতের খাবার খাইয়ে দিতে আসেন এক দিদি। চামচে খাইয়ে যত্ন করে মুখ মুছিয়ে দেন তিনি। মিষ্টি হেসে বলেন, “আরেকটু খেতে?” অর্ণব আজ নিজের হাতে খেতে চাইল। দুপুরে তার নিজের হাতে খাওয়াটা ছিল রুটিন এক্সারসাইজ। কিন্তু এখন সে একটু একা হতে চাইছে। তার নতুন হাতটা গভীর এক ঝিল। তার পাশে অর্ণব শুয়ে থাকে মনখারাপ নিয়ে।

    হাসপাতাল থেকে ছুটির দিন এগিয়ে আসে। এখন অর্ণব ব্রাশ করা, খাওয়া, লেখালেখি, এমনকী কম্পিউটার কিবোর্ডে টাইপ করা — সবই করতে পারছে। হ্যাঁ, তার পুরনো হাতের মতো নিখুঁত নয় একেবারে। তবে বেশিরভাগ খুঁটিনাটিই সে আয়ত্ত করে ফেলেছে। দীপ তাকে জিজ্ঞাসা করে, “তুমি আবার পড়াতে যাবে?” অর্ণব কাঁধ ঝাঁকাল, “যেতে তো হবেই।” দীপ দুষ্টুমি মাখিয়ে হাসে, “তোমার এমন হাড় সর্বস্ব হাত দেখে যদি তোমার স্কুলের ছেলেমেয়েগুলো ভয় পায়?” অর্ণব সত্যিই এই দিকটা ভাবেনি। সে তার জামার বোতাম আটকাতে আটকাতে বলল, “বলব, আমি সাইবর্গ।” দীপ শুধরে দেয়, “বায়োনিক।” তারপর মাথা নাড়ে, “না হে, সত্যিই আমি ভাবিনি এত সহজে তুমি হাতের ব্যবহার শিখে নেবে।”

    জামা পরা শেষ করে অর্ণব চিরুনি হাতে টেবলে রাখা আয়নার দিকে এগিয়ে গেল। মাথায় চিপ বসানোর জন্যে যেটুকু কাটা হয়েছিল, সেটা নিখুঁতভাবে এরা ঢেকেও দিয়েছে। সেখানেও এখন স্বাভাবিক চুল। ধীরে ধীরে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা দীপ, এর কিছু সাইড এফেক্ট আছে কি?” দীপ সতর্ক গলায় বলল, “কেমন সাইড এফেক্টের কথা বলছ?” অর্ণব গলাটা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে, “এই যেমন ধরো, তুমি বলছিলে, হাতটার নিজের কিছু সেন্সর আছে। তাপমাত্রা ইত্যাদি...” তাকে মাঝরাস্তায় থামিয়ে দিয়ে দীপ বলল, “হ্যাঁ, ওটা তো এ-এল-এর এ-আই। বাইরে বেরোলে মজা পাবে দেখো। তোমার হাতের আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স তোমায় কত কিছু শেখাবে।”

    ব্যাপারটা মজার না মনে হলেও নতুন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বাড়ি ফেরার সময় গাড়ির জানালার বাইরে হাতটা রাখল অর্ণব। তার হাত মস্তিষ্কে ফিড দিতে থাকল। বাইরের তাপমাত্রা ত্রিশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, আর্দ্রতা ৮৩ শতাংশ। কাছাকাছি কোথাও বৃষ্টি হয়েছে। বাতাস দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে একুশ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা বেগে বইছে। কারোর গলা শোনা যাচ্ছে না, কোথাও লেখা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু অর্ণব জানতে পারছে। তার হাতের সেন্সর তাকে জানান দিচ্ছে।

    বাড়ি ফিরে তার শোবার ঘরে বহুদিন পরে ঢুকে একটু থমকে গেল অর্ণব। কিছুই পালটায়নি। সমস্ত কিছু পরিপাটি করে রাখা, যেমন সে ছেড়ে গিয়েছিল। ড্রেসিং টেবলের বড় আয়নার কাছে গিয়ে জামা খুলে দাঁড়াল সে। তার কাঁধের কাছে একটা আলাদা চামড়ার খোল লাগানো হয়েছে। তার থেকে বেরিয়ে এসেছে ইস্পাতের হাড়গোড়। পাঁজরের হাড়গুলো যেন একটু বেশিই প্রকট এখন। আসলে হাসপাতালের শেষ দশ-বারোদিন সে নিজে নিজেই খেয়েছে। চামচ গুনে গুনে। সে কোনও কালেই ভোজনবিলাসী ছিল না। কিন্তু খাওয়া ব্যাপারটা এখন আর পাঁচটা কাজের মতোই অ্যাক্টিভিটি।

    একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জামাটা আবার গায়ে গলিয়ে অর্ণব তার বইয়ের আলমারির দিকে এগিয়ে যায়। সাবধানে একটা বই টেনে নিয়ে পাতা উলটোতে গিয়ে আটকে গেল সে। তার নতুন হাত বইয়ের পাতা ওলটাবার শিক্ষা পায়নি এখনও। ঝিলের ঢেউগুলো যেন সামান্য বড় তরঙ্গে আসছে এখন। হাতটা কেমন যেন অশান্ত হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। বইটা পড়ে গেল মেঝেতে। বসে পড়ে বইটা তুলে মলাট উলটে দেখল, প্রথম পাতায় লেখা – ‘অনি পড়বে বলে...’ এক লাইন পরে অর্ণবের নামের তলায় বছর দশেক আগের একটা তারিখ। অনির্বাণ বইটা নেয়নি। ফেরত দিয়েছিল। বলেছিল, “আমার পড়া।”

    স্কুলে ফিরে গিয়ে প্রথম কয়েকদিন একটু অসুবিধা হয়েছিল। ফুলহাতা জামায় তার ডানহাতটা ঢাকাই ছিল। নতুন বলতে একটা গ্লাভস পরতে হয়েছে। ব্ল্যাকবোর্ডে লিখতে গিয়ে প্রথম প্রথম হাতের চাপটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারত না অর্ণব। ফলে পটাপট চক ভাঙত। বেশি চাপ দিয়ে লেখার ফলে কিঁচ কিঁচ করে বিরক্তিকর একটা আওয়াজ তৈরি হত। এখন এগুলো সামলে উঠেছে সে। নিচু ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ একটু বেশি। তারা অর্ণবের দুর্ঘটনা আর এ-এল-এর ব্যাপারে শুনেছে। সেসব পল্লবিত হয়ে নানা ধরনের রঙিন কাহিনিতে পরিণত হয়েছে। ক্লাস ফাইভের একটা বাচ্চা মেয়ে একদিন ক্লাসের মাঝেই তাকে জিজ্ঞাসা করে বসল, “স্যর, তোমার হাত থেকে নাকি আগুন বেরোয়?” পাশ থেকে একটা ছেলে তাকে ধমক দিল, “আগুন নয়, কারেন্ট শক হয়। না স্যর?” অর্ণব তাদের উৎসাহে জল ঢেলে দিয়ে যা হোক একটা উত্তর দেয়। মনে মনে হাসে।

    পুজোর ছুটিতে বাড়ি ফিরে পাড়া-প্রতিবেশীর ব্যবহারে এবার একটু পরিবর্তন দেখতে পায় অর্ণব। আগে তাকে যারা এড়িয়ে চলত, তারা নিজে থেকে এসে কুশল জিজ্ঞাসা করে। বহুদিন পরে বাজারে গিয়ে কালীপদর সঙ্গে দেখা হয়। সে এখনও সব্জির ঝাঁকা নিয়ে বসে। তার পাশে হেমন্তও বসেছে আলু-পেঁয়াজ নিয়ে। জানা গেল, এখন শুধু বেস্পতিবার সে উল্কির পসরা নিয়ে বসে।

    মানুষজনের মধ্যে যেন এতদিনে ফিরে আসছে সে। কিন্তু রাত হলেই বিছানায় তার পাশে শুয়ে থাকে সেই ঝিল। আজকাল যেন ফিসফিসে হাওয়ার শব্দে তার সঙ্গে কথা বলারও চেষ্টা করে হাতটা। অর্ণব ভাবে একবার সাইকায়াট্রিস্ট দেখাবে। কিন্তু কী বলবে সে? আমার হাত আমার সঙ্গে কথা বলে! আমার হাত একটা ঝিল! মাঝরাতে উঠে সে আলমারির মাথা থেকে পুরনো ড্রয়িং খাতা নামায়। তারপর টেবলের নিচের ড্রয়ার থেকে ক্ষয়াটে মোমপেনসিল বের করে একমনে নীল রঙ ঘষতে থাকে। রাতের নৈঃশব্দ্যে খিসখিস আওয়াজ ওঠে। খাতার পাতা থেকে একটা ঝিল যেন হাওয়ার শব্দে কথা বলতে চাইছে।

    অনেকদিন পরে এবার পুজোতে ঠাকুর দেখতে বের হল। এখন এই এলাকায় বেশ কয়েকটা পুজো হয়। বাড়ির সবথেকে কাছের পুজো প্যান্ডেলে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল অনির্বাণের সঙ্গে। কিছুটা দূরত্ব থেকে দেখল অনির্বাণের পাশে হাত ধরে দাঁড়িয়ে এক যুবতী। বুঝতে অসুবিধে হয় না তার স্ত্রী। অর্ণবের বুকে কী একটা যেন চলকে উঠল। ঈর্ষা? রাগ? কিন্তু অনির্বাণকে সে কেন ঈর্ষা করবে! কেন রাগ করবে! অনির্বাণ তার বন্ধু। নিজেকে সহজ করতে সে এগিয়ে গেল — “অনি, কেমন আছিস?” অনির্বাণ সামান্য চমকে উঠে সামলে নিল — “ভালো রে।” তারপর একটু থেকে বলল, “আমি শুনেছিলাম তোর অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারে। কিন্তু তখন ব্যাঙ্গালোর থেকে শিফট করা নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম।” অর্ণব তাকে হাত তুলে থামাল, “আলাপ করাবি না?” অনির্বাণ তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলে, “আমার স্কুলের বন্ধু অর্ণব।” তারপর অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বলল, “এ হল অরুন্ধতী। বছর দুয়েক হল বিয়ের।” অর্ণব জানত না। সে শোনেওনি অনির্বাণের বিয়ের কথা। হয়তো কলকাতাতেই হয়েছিল। অরুন্ধতী বলল, “আপনার কথা শুনেছি আগে। একদিন আসুন না আমাদের বাড়ি। আমরা তো এখন কলকাতাতেই।” অনির্বাণের স্ত্রী অর্ণবের কথা শুনেছে! কী শুনেছে সে? জানতে বড় আগ্রহ হয় অর্ণবের।

    এ কথা সে কথার পর অর্ণব বহু পুরনো সেই রাস্তা ধরে। পুজোর আলোয় মোড়া বাজারটা পেরিয়ে খালের ধার ধরে পায়ে হাঁটা রাস্তা। ঝুপড়িটা এখনও একই রকম। অর্ণব বাইরে থেকে হাঁক পাড়তে গিয়ে দেখে ঝুপড়ি থেকে সামান্য দূরে একটা খিরিশ গাছের তলায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল ফুলের মতো লাল একটা আলো। তাতে আবছা হল দুটো অবয়ব — কালীপদ আর হেমন্ত বসে আছে।

    অনেক রাতে ফিরে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়েছিল অর্ণব। তার সারা শরীরটাই তখন ঝিলের মতো ঢেউয়ে কাঁপছে। সোঁদা একটা গন্ধে অনুভব করল ঝিলের পাড় খুঁজে পাচ্ছে সে। সেই পাড়ের সবুজ ঘাসজমিতে দাঁড়িয়ে আছে অনির্বাণ আর অরুন্ধতী। অরুন্ধতী বলছে, “এই ঝিলটার কথা আমি শুনেছি আগে।” অর্ণব জল থেকে হাত বাড়াতে যায়। অশান্ত হয়ে ওঠে জল। আর ফিসফিসিয়ে নয়, খলবল করে কথা বলতে চাইছে যেন। ঢেউ ভাঙছে — “আয়! আয়! আয়!” কে আহ্বান করছে গভীর থেকে? অর্ণব একবার চেঁচিয়ে উঠতে চাইল — “অনি, অনি-ই-ই-ই...”

    অর্ণবের জ্ঞান ফিরল হাসপাতালের বিছানায়। বাবার সামনে আর খবরের কাগজ ধরা নেই। তার বিছানার পাশেই চেয়ারটা নিয়ে বসে। তাকে চোখ খুলতে দেখে সামান্য স্বস্তি এল চোখে মুখে। তারপর একটু সময় নিয়ে বলল, “ওরা তোমার মাথায় একটা ছোট অপারেশন করেছে আবার।” মাথাটা ভারী হয়ে আছে। হাত দিয়ে সেটা ছুঁতে গিয়ে অর্ণব অনুভব করলে তার ডানহাতে কোনও জোর নেই আর। সেটা চুপচাপ শুয়ে আছে। কাঁধের পাশ থেকে কিছুটা ব্যান্ডেজে মোড়া। বামহাত তুলে অনুভব করল মাথাতেও ব্যান্ডেজ। বাবা ব্যাখ্যা করার মতো করে বলল, “ডাক্তার বলল, চিপটা থেকে ইনফেকশান হয়েছিল। তবে এখন আর ভয়ের কিছু নেই। ওরা বদলে দিয়েছে।” তারপর আবার থেমে বলল, “এখন ক’দিন হাতটাকে বিশ্রাম দিতে হবে। মাথার কাটাটা না শুকিয়ে যাওয়া পর্যন্ত।”

    বহুদিন পরে অর্ণব নিশ্চিন্তে ঘুমোলো। তার বিছানার পাশে আর ঝিল নেই, ঢেউ নেই, জলের ফিসফিসিয়ে কথা বলা নেই। আরও কয়েকদিন পরে তার ডানহাত ব্যবহারের অনুমতি মিলল। স্বাভাবিক একটা হাত। ইস্পাতের কঙ্কাল-সর্বস্ব একটা হাত যেমন হয় আর কী। বাড়ি ফেরার সময় গাড়ির জানালার বাইরে হাতটা রাখতে যথারীতি জানান দিল — তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বাতাসের গতি। কিন্তু সেই ঝিলটা নেই আর। তার হাত ঝিল নয় আর।

    ভোররাতে অর্ণব স্বপ্ন দেখল তার বাদ পড়ে যাওয়া রক্তমাংসের হাত তার প্রাক্তন ঝিলটার জলের নিচে শুয়ে আছে। আর তার সদ্য বাদ পড়া চিপটা মাছের মতো গিয়ে ঠুকরে ঠুকরে জাগাতে চাইছে হাতটাকে। অনুরণন। আচমকা ঘুম ভেঙে এই শব্দটাই মাথায় এল তার।

    ভোরের নরম আলোয় ডানহাতটা দিয়ে তার বামহাতের সেই অসুন্দর উল্কিটার ওপর হাত বোলাল সে। এই বেস্পতিবার হেমন্তর কাছে যাবে সে। অনির ‘আই’-টাকে একটু বাড়িয়ে নিয়ে ‘ইউ’ করে দেওয়া যায়। তারপর একটা ‘আর’, তার পাশে একটা ‘এ’, তারপর ‘এন’। একটু থমকাল সে। শেষে আরও একটা ‘এ’ আর ‘এন’ লেখার জায়গা নেই। পরমুহূর্তেই বুকটা খুশিয়াল হয়ে উঠল, অনুরণ-ই থাক।

    ভালোবাসা ডাকনামেই মানায়।





    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments