১৯৯৯ সালে, যখন আমি সদ্য ফিরেছি ভেনেসুয়েলা থেকে একদিন স্বপ্ন দেখলাম আমাকে কেউ বা কারা নিয়ে যাচ্ছে এনরিকে লিন-এর অ্যাপার্টমেন্টে, দেশটা হলেও হতে পারে চিলে, এবং শহরটা হলেও হতে পারে সানতিয়াগো, এখানে মনে রাখতে হবে যে চিলে ও সানতিয়াগো — দুটোকেই এক সময় ভাবা হত নরকসদৃশ, এবং বাস্তব শহর ও কল্পনার শহর দুটোর ভূগর্ভস্থ কোন এক স্তরে সেই সাদৃশ্য খোদাই হয়ে থাকবে চিরকাল। আমি অবশ্য ভাল করেই জানি যে লিন মারা গেছেন, কিন্তু লোকগুলো যখন উপযাজক হয়ে আমায় বলল, তার কাছে নিয়ে যাবে, আমি রাজী হলাম এককথায়, বিন্দুমাত্র ইতস্তত: না করে। হয়ত আমি ভেবেছিলাম এটা তাদের এক রসিকতা, মজার খেলা কোন একটা, অথবা কোন অলৌকিক ঘটনা বোধহয় সম্ভব হবে। অথবা হয়ত আমার মাথার গণ্ডগোল হয়েছিল, কিংবা তাদের প্রস্তাবটাকে আমি ভুল বুঝেছিলাম পুরোপুরি। সে যাই হোক, একটা সাততলা বিল্ডিং-এর সামনে এসে হাজির হলাম আমরা, বাড়িটার বাইরের দেয়ালগুলোতে হালকা হলুদ রং এবং পুরো একতলাটা জুড়ে বিশাল একটা বার, সত্যিই বিশাল বারটার আকৃতি, মাঝখানে লম্বা একটা কাঠের কাউন্টার আর চারপাশে অসংখ্য খুপরি খুপরি বুথ এবং আমার বন্ধুরা (লোকগুলোকে বন্ধু বলছি বলে নিজের কাছেই আশ্চর্য লাগছে আমার, বিদঘুটে বললেও অন্যায় হবে না; আমি বলতে চাইছি সেই কয়েকজন অতি উৎসাহী মানবের কথা যারা আমায় কবির সমীপে নিয়ে যেতে চেয়েছিল) আমাকে নিয়ে গেল একটা বুথের সামনে, আর সেখানেই বসে রয়েছেন সেনর লিন। কী আশ্চর্য, আমি তো প্রথমে তাঁকে চিনতেই পারিনি, বইয়ের প্রচ্ছদে বা ডাস্ট জ্যাকেটে যে-মুখ প্রতিনিয়ত দেখা যায়, তার সঙ্গে মিল নেই বললেই চলে; তিনি অনেকটা রোগা হয়েছেন, আর বয়েসটাও কমে গেছে কয়েক দশক, সুদর্শন যুবক তিনি, বই-এর জ্যাকেটের শাদা-কালো ফোটোগ্রাফের চেয়ে তাঁর চোখ দুটো বিশেষ উজ্জ্বলতর। সত্যি কথা বলতে কি, চোখের সামনে দেখা সেনর লিনের সঙ্গে আমাদের পরিচিত কবির একেবারেই মিল নেই; মানুষটাকে দেখতে অনেকটা হলিউডের নায়কের মতন, দ্বিতীয় শ্রেণীর ছবিগুলোর নায়ক, যেসব চলচ্চিত্র তৈরিই করা হয় টিভিতে দেখানোর জন্যে, অথবা অন্য যে-কোন চলচ্চিত্রের মতই, কিন্তু ইওরোপের সম্ভ্রান্ত প্রেক্ষাগৃহগুলোর বদলে মুক্তি পায় মফস্বলে, টিম টিম করে চলে কিছুদিন, তার পরে ভিডিও হয়ে তার পরিণতি। কিন্তু তা বলে তিনি সেনর লিন নন, এমন কথা আমি কিন্তু ঘুণাক্ষরেও বলছি না; আমার কোন সন্দেহই নেই যে তিনিই সেই প্রথিতযশ কবি। আমার উৎসাহী সঙ্গীর দল নমস্কার করল তাঁকে। যেন কতদিনের পরিচিত, ডাকল এনরিকে-দা বলে, কিছু কুশল প্রশ্ন করল তাঁকে, যদিও আমি তার বিন্দুবিসর্গও বুঝলাম না; এবং তার পরে আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিল, যদিও পরিচয় করানোর কোন প্রয়োজনই ছিল না; কারণ বিদেশ থেকে আমি নিয়মিত চিঠি লিখতাম কবিকে, আর কবিও তার উত্তর লিখতেন মাঝে মাঝে এবং সত্যি কথা বলতে কি, আমার দু:সময়ে তাঁর চিঠিগুলোই ছিল অবলম্বন; আমি বলছি ১৯৮১ বা ১৯৮২ সালের কথা, আমি তখন নিসঙ্গচারী হয়ে জেরোনা শহরের উপকন্ঠে একটি পরিত্যক্ত গৃহে বাস করি, সঙ্গে কানাকড়ি নেই এবং ভবিষ্যতে কানাকড়ি উপার্জনের ভরসা পর্যন্ত নেই আর সাহিত্য হল মাইন বসানো যুদ্ধক্ষেত্র, যেখানে ঘাঁটি গেড়ে বসে রয়েছে আমার শত্রুরা। কেবল কয়েকজন ক্ল্যাসিক সাহিত্যের লেখককে ভাবতে পারি বন্ধু বলে, কিন্তু দিনের পর দিন সেই মাইনফিল্ডে আমার চলাফেরা, একটি পদক্ষেপ ভুল হলেই মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী এবং আমাকে পথ দেখানোর সাথী আরকিলোকুসের কালজয়ী কবিতাগুলি। সব তরুণ লেখকের জীবনই অল্পবিস্তর সেই একই রকম। এমন একটা সময় আসে লেখকের জীবনে যখন কোন সমর্থন নেই, অবলম্বন নেই, এমনকী প্রিয় বান্ধবদের পক্ষ থেকে, গুরু বা উপদেষ্টাদের কথা না হয় বাদই দিলাম; কেউ একটা সাহায্যের হাত বাড়ায় না; প্রকাশনা, পুরস্কার, অনুদান — সবই অন্যের কপালে বাঁধা, যারা কথায় কথায় দুহাত কচলে “ইয়েস স্যার!” বলবে অথবা সাহিত্য জগতের পেটমোটা কর্তাব্যক্তিদের গুণগান গাইবে সকাল বিকেল, রাবণের বংশ তারা, বিশাল ঝাড় তাদের — যেমন নিয়মের কঠিন নিগড়ে বাঁধা তারা, তেমনই অসীম তাদের কঠোর শাস্তি দেবার ক্ষমতা, কোন কিছু তাদের চোখ এড়ায় না এবং কোন অপরাধের ক্ষমা নেই। সে যাই হোক, আগে যে কথা বলছিলাম, সেই কথায় ফিরে আসি আবার — সব তরুণ লেখক-লেখিকারই জীবনে এরকম একটা দুটো হতাশার সময় এসে যায়। আমার বয়েস তখন সাতাশ কি আঠাশ হবে এবং কোনভাবেই নিজেকে আর নবীন লেখক মনে করা সম্ভব না। আমি তখন দিশেহারা। মার্কামারা লাতিন আমেরিকার লেখকরা যেরকম নিষ্কর্মা, সরকারী আরামের চাকরি নিয়ে বছরের পর বছর সপরিবারে বাস করে ইওরোপে এসে, আমি একেবারেই তাদের মতন না। কেউ আমায় চেনে না এবং আমিও কারুর কাছে করজোড়ে ভিক্ষে চাইতে যাই না। ঠিক এইরকম মানসিক অবস্থায় এনরিকে লিনকে আমার চিঠি লেখার সূত্রপাত। বলাই বাহুল্য যে প্রথম চিঠিখানা আমিই লিখেছিলাম। এবং উত্তরের জন্যেও অপেক্ষা করতে হয়নি বেশিদিন। দীর্ঘ, খামখেয়ালী চিঠি, চিলেতে আমরা যাকে বলি-- বিষণ্ন, নিরানন্দ, খরখরে। আমি উত্তরে তাঁকে লিখে জানালাম আমার দৈনন্দিন জীবনের কথা — মধ্যযুগের বড়সড় শহর জেরোনা, শহর পেরিয়ে পাহাড়ের মাথায় ছোট ছোট গ্রাম্য বসতি, তার মধ্যে একটিতে আমার বাসা, দূরে গ্রামের পর গ্রাম দিগন্ত অবধি, তার পরে অপার শূন্যতা। আমি তাকে আরো লিখলাম আমার কুকুর লাইকার কথা এবং জানালাম যে আমার মতে চিলের আধুনিক সাহিত্যে, একটি দুটি ব্যতিক্রম ছাড়া, রক্ত আমাশার গুয়ের গন্ধ। এবং তাঁর পরের চিঠিখানা পড়েই বুঝতে পারলাম যে তিনি আমাকে আপন বন্ধু হিশেবে গ্রহণ করেছেন। এবং তারপর যা হওয়া স্বাভাবিক, যখন এক দিকপাল কবির সঙ্গে এক অজ্ঞাতকুলশীল কবির অসম বন্ধুত্ব ঘটে, তাই হল। তিনি আমার একগুচ্ছ কবিতা দেখলেন এবং তার থেকে কিছু কবিতা জুড়ে দিলেন একটি কবিতা পাঠের আসরে — চিলে এবং উত্তর আমেরিকার একটি সৌহার্দ্যমূলক সংস্থায়, চিলের নতুন প্রজন্মের কবিদের কবিসভার অনুষ্ঠানে। এবং পরের চিঠিতে তিনি লিখলেন আমাকে যে চিলের কবিতার জগতে ২০০১ সালে ছয়জন নবীন ব্যাঘ্রের আবির্ভাব ঘটেছে। সেই ছ’জন বাঘ হলাম বের্তোনি, মাকুইএইরা, গনসালো মুনোস, মার্তিনেস, রদরিগো লিরা এবং আমি। যতদূর মনে পড়ছে আমার। এমনও হতে পারে এনরিকে লিখেছিলেন সাতজন বাঘের নাম, কিন্তু আমার মনে রয়েছে ছয়জনের নাম। এবং আমাদের ছয়জনের পক্ষে ২০০০ সালে নতুন একটা সাংঘাতিক কিছু কাণ্ড করে ওঠা ছিল ভীষণ কঠিন; কারণ আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সেরা রদরিগো লিরা ইতিমধ্যে আত্মহত্যা করে ফেলেছে, তার কবিসত্তা আর সীমাহীন প্রতিভা এখন হয় কোন কবরস্থানের ভূগর্ভে শুয়ে শুয়ে পচছে আপনমনে, অথবা ছাই হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে সানতিয়াগোর পথে পথে, ভাবসাব করছে আস্তাকুঁড়ের জঞ্জালের সঙ্গে। বাঘ না হলে বোধহয় মিনিবেড়াল বললেই জমত ভাল। বের্তোনি, আমি যতদূর জানি, হিপির মতন জীবনযাপন করে সমুদ্রের তীরে কোথাও, সে নানারকমের ঝিনুক, শামুক, আর সমুদ্রশ্যাওলা নিয়ে গবেষণামূলক দীর্ঘ প্রবন্ধ, তারপর কোরোনেল উরটেকা সম্পাদিত উত্তর আমেরিকার কবিতা সংকলন গ্রন্থটি নিয়ে সুগভীর আলোচনা, এর ফাঁকে ফাঁকে দুটি কাব্যগ্রন্থ, এখন সে সারাদিন কেবল মদ্যপান করে। গনসালো মুনোস, যতদূর জানি, মেহিকো চলে যায়, সেখানে সে অদৃশ্য হয়েছিল মদ্যপের মহাশূন্যে নয়, বিজ্ঞাপন শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ কাজে। মার্তিনেস লেগেছিল শিল্পসমালোচনায়--মার্সেল দুশাম্পের দাদাইজম-প্রভাবিত চিত্রশিল্পের বিষয়ে একটি প্রবন্ধগ্রন্থ লিখে সাত তাড়াতাড়ি মরে গেল, তর সইছিল না যেন। আর রদরিগো লিরা, তার ভবিতব্যের কথা তো আগেই বলেছি। যেভাবেই আমাদের দিকে তাকান, আমাদের বাঘ না বলে মিনিবেড়াল বলাই ভাল। দূর দূরান্তর গ্রাম থেকে নিয়ে আসা সহায়সম্বলহীন বেড়ালছানা আমরা। এতসব কথার মাধ্যমে আমি যা বলতে চাইছিলাম, তা হল যে আমি সেনর লিনকে ভাল করেই চিনি এবং তার সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও উৎসাহী সঙ্গীরা আলাপ করিয়ে দিল আমাদের এবং সেনর লিন বা আমি কেউই বিন্দুমাত্র আপত্তি করলাম না। সেই বারের ভেতর বুথটির সামনে আমরা সবাই দাঁড়িয়ে, শোনা যাচ্ছে কন্ঠস্বর, ইনি হলেন রোবের্তো বোলানো, তারপর আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম বুথের অন্ধকারে এবং সেনর লিনের হাতটি মুঠোয় ধরলাম করমর্দনে--ইষৎ শীতল তাঁর হাত, বিষণ্ণ মানুষের হাত, আমার হাতকে চেপে ধরল কয়েক মুহূর্তের জন্যে। আমার মনে হল, এই হাত, আর এই করমর্দন, এবং একটু দূরে তাঁর স্বল্পালোকিত মুখমণ্ডল--সব মিলিয়ে একটা আস্ত মানুষ, যিনি খুঁটিয়ে দেখছেন আমাকে। সেই মুহূর্তটি একটু দূরে সরে যাবার পরে উৎসাহী সঙ্গীরা সবাই একসঙ্গে কথা বলতে শুরু করলে, অবসান ঘটল নীরবতার; তারা সবাই মিলে সেনর লিনকে জিজ্ঞেস করতে লাগল নানান বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং বিচার্য বিষয় নিয়ে তাঁর সুচিন্তিত মতামত এবং সেই মুহূর্তে অদৃশ্য হল সেই উৎসাহী দলের প্রতি আমার অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যের ভাব, আমি বুঝতে পারলাম ছেলেগুলোর প্রকৃত অবস্থা--আমি যেমন ছিলাম বেশ কিছু বছর আগে; তরুণ কবির দল যাদের কোন অবলম্বন বা সমর্থন নেই, চিলের নতুন নির্বাচিত মধ্যপন্থী আর বামপন্থীতে মেশানো সরকারও তাদের বিশেষ পাত্তা দেয় না, কোন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের দাক্ষিণ্য বা পৃষ্ঠপোষকতাও নেই তাদের সঙ্গে; তাদের সঙ্গী ছিলেন কেবল সেনর লিন, যিনি এখন মৃত; এই নতুন যে সেনর লিন এখন এইমাত্র আমাদের চোখের সামনে, তিনি জীবন্ত এনরিকে লিন নন, যাঁর অসংখ্য ফটোগ্রাফ দেখা যায় বিভিন্ন বয়েসের; ইনি অনেকটা সুদর্শন, তরুণ, বুদ্ধিদীপ্ত এবং অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক ও হৃদয়গ্রাহী লিন--যিনি তাঁর কবিতাবলীর মাধুরী মিশিয়ে গড়া এক নতুন প্রতিমা, তিনি এই উৎসাহীদাতার সমবয়েসি, যারা তাঁর কবিতার মতনই বিচিত্র উপাদানে গড়া একটি বিলডিঙে বাস করে এবং তাঁর কবিতা যেমন কখনো কখনো শোভন, সুকুমার অথচ অনমনীয় ভঙ্গীতে মিলিয়ে যায় সকলের চোখের সামনে, এই তরুণ কবিদের দলও তেমনি একদিন অদৃশ্য হয়ে যাবে হঠাৎ। আমি যখন এই পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম, আমার ভয় ভাবনা কেটে গেল অনেকটাই। পরিস্থিতিটা পুরোপুরি মাথায় ঢুকল আমার এবং খানিকটা মজাও লাগল। আমার ভয় পাবার কোন কারণ নেই, আমি ফিরে এসেছি নিজ গৃহে, নিজ দেশে, রয়েছি বন্ধুদের সঙ্গে, আমার পরমপ্রিয় এক প্রবীণ কবির সঙ্গে। আমি নিজে কোন বিভীষিকাময় চলচ্চিত্রের চরিত্র হয়ে যাইনি। অথবা চলচ্চিত্রটি মূলত: বিভীষিকার হলেও তার সঙ্গে মিশেল রয়েছে বিষাদময় হাস্যরসের। আর যখনই আমার মনে হল বিষাদময় হাস্যরসের কথা, সেই মুহূর্তে সেনর লিন পকেট থেকে বের করলেন ট্যাবলেট ভরা ওষুধের শিশি। প্রতি তিন ঘন্টা অন্তর আমাকে খেতে হয় একটা করে ডাক্তারের আদেশ, বললেন তিনি। চুপ মেরে গেল উৎসাহীরা। এক গ্লাস জল আনল ওয়েটার। ট্যাবলেটটা বিশাল, আমার দেখে মনে হল। যখন সেনর লিন সেটা জলের মধ্যে ফেললেন। কিন্তু আসলে সেটা বিশাল ঠিক নয়, তবে অসম্ভব ঘন পদার্থে নির্মিত। সেনর লিন চামচে দিয়ে ভাঙতে শুরু করলেন সেটাকে এবং আমি বুঝতে পারলাম যে ট্যাবলেটটা আসলে পেঁয়াজের মতন, অসংখ্য স্তর রয়েছে তার। আমি সামনে ঝুঁকে তাকালাম গ্লাসের জলের ওপর। এক মুহূর্তের জন্যে মনে হল, হলফ করে বলতে পারি, চোখের সামনে দেখলাম এক সীমাহীন ট্যাবলেট। হয়ত কাচের বক্রতার জন্যে একটা লেন্স্ বা আতসকাচের মতন প্রক্রিয়া হয়ে থাকতে পারে; জলের মধ্যে ফিকে নতুন এক বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের। কিছু ছায়াপথের জন্ম বা মৃত্যুর কোন একটা হয় হঠাৎ (আমি ঠিক ভুলে গেছি কোনটা) এবং জলের গ্লাসের বক্রতার ভেতর দিয়ে দেখতে পাই আমি, চোখের সামনে ভেসে উঠছে ধীরগতির চলচ্চিত্রের মতন সৃষ্টির প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি দুর্বোধ্য ধাপ, প্রতিটি সংকোচন প্রসারণ এবং প্রতিটি দীর্ঘ কম্পন, আমার মুখোমুখি। তারপর অসম্ভব ক্লান্তি আসে আমার, বসে পড়ি এবং আমার চোখের দৃষ্টি ওষুধের গেলাস ছেড়ে ওপরের দিকে ওঠে; যখন সেনর লিনের সঙ্গে দৃষ্টিবিনিময় ঘটে, তাঁর চোখ যেন বলতে চায়, আমি মুখ খুলছি না বাপু, এমনিতেই তিন ঘণ্টা অন্তর গিলতে হয় আমায় এই তেতো পাঁচন, তুমি আর এর মধ্যে প্রতীকী, গূঢ় অর্থ খুঁজতে বসো না বাছা--জল অথবা পেঁয়াজ অথবা নক্ষত্রদের ধীরগতি চলাফেরা। উৎসাহী কবিরা উঠে গিয়েছে আমাদের টেবিল ছেড়ে, কয়েকজন গিয়ে বসেছে বারে। বাকিদের আর দেখতে পাই না, দৃষ্টির বাইরে তারা। কিন্তু যখন আমি আবার সেনর লিনের দিকে তাকাই, এক তরুণ কবি তখনও উপবিষ্ট তাঁর পাশে, তবে তাঁর কানে ফিসফিস করে জরুরি কিছু কথা বলেই সে বুথ ছেড়ে উঠে যায় তার সাগরেদদের খোঁজে, যারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে সেই বিশাল কক্ষে। ঠিক সেই মুহূর্তে আমিও বুঝতে পারি যে সেনর লিন কোনভাবে জেনে গেছেন যে মৃত্যু ঘটে গিয়েছে তাঁর। জানো, নিয়মিত কাজ করতে করতে আমার হৃদপিণ্ডটা হাল ছেড়ে দিল একদিন, তিনি বলেন। একটা কিছু নিশ্চয়ই গলদ রয়েছে এখানে, আমি ভাবি, কারণ সেনর লিন মারা গিয়েছেন ক্যানসারে, হার্ট অ্যাটাকে নয়। আমার কাঁধে যেন চেপে বসে বিরাট এক বোঝা। আমি উঠে দাঁড়াই এবং ঝিঁঝিঁ-লাগা পায়ের উপশমের জন্য পায়চারি করতে যাই; কিন্তু বারের দিকে নয়, সোজা রাস্তায়। ফুটপাথগুলো ছাইরঙা আর অসমতল; আকাশটা যেন এক ওলটানো আয়না, যার পেছনে পারদ বা রাংতা লাগান নেই অর্থাৎ যেখানে সব কিছু প্রতিফলন ঘটার কথা, সেখানে শেষ পর্যন্ত ঘটছে না কিছুই। শেষ পর্যন্ত এক স্বাভাবিকতার অনুভূতি ভিড় করল আমার মনে এবং ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। যখন মনে হয় যে আমার খোলা হাওয়ার সাধ মিটেছে এবং এবার সময় হল বারের ভেতর ফিরে যাওয়ার, আমি সিঁড়ি বেয়ে উঠে (পাথরের সিঁড়ি, এক একটা ধাপ হল এক একটি পাথরের চাঙড়, যা গ্রানিটশিলার মতন সুষম এবং মরকতমনির মতন ঝকঝকে) দরজার সামনে পৌঁছালে যে মানুষটার মুখোমুখি আসি, সে আমার চেয়ে লম্বায় খাটো এবং ১৯৫০-এর দশকের গুণ্ডাদলের নেতার মতন পোষাক পরনে আর হাবভাবে পরিহাস এবং ব্যঙ্গকৌতুক, সে মর্যাদামান, অমায়িক খুনী, আমাকে হয়ত সে ভুল করেছে অন্য কেউ বলে, যাকে সে চেনে, তাই আমাকে সে বন্ধুতাপূর্ণ সম্ভাষণ জানায়। আমি সঙ্গে সঙ্গে তার জবাব দিই, যদিও আমি ভাল করেই জানি যে কস্মিনকালেও তার সঙ্গে কোন রকমের পরিচয় ছিল না আমার এবং এটাও জানি যে সে নিজেও ভুলের শিকার, কিন্তু তাও আমি ভান করি যে আমি তাকে চিনি এবং খুব সম্ভবত: তারই মত আমিও তাকে চিনতে ভুল করেছি অন্য কেউ বলে। অতএব আমরা সম্ভাষণ বিনিময়ের পর সেই ঝকমকে অথচ দীন নিরভিমান ধাপগুলো বেয়ে উঠতে থাকি যদিও খুব একটা কার্যকরীভাবে নয়। কিন্তু সেই গুণ্ডাব্যক্তির বিভ্রান্তি দূর হল অল্প সময়ের ব্যবধানে এবং সে বুঝতেই পারল যে সে চিনতে ভুল করেছে আমায়, আমার দিকে তার চোখের চাহনির পরিবর্তন ঘটল অনেকটাই, সে যেন নিজেকেই প্রশ্ন করছে যে আমি হয়ত তাকেও অন্য কোন ব্যক্তি বলে ভুল করেছি, অথবা ঠিক তার উল্টো অর্থাৎ আমি তাকে হাড়ে হাড়ে চিনি এবং প্রথম থেকেই জেনেছি তার আসল পরিচয়, কারণ তার কন্ঠস্বর শোনাল গম্ভীর আর সন্দেহাতুর (যদিও তার নিজের মত স্ববিরোধী ভঙ্গীতে, তীক্ষ্ণ), সে জানতে চাইল আমি কে, আমার নাম কী, বলার সময় তার ঠোঁট জুড়ে এক বিদ্বেষপূর্ণ হাসির ঝিলিক, তখন বাধ্য হয়ে আমায় বলতে হল, মাইরি, হারা, ফিচকেমি রাখ তোর, আমায় চিনতে পারছিস না, আমি বোলানো, এবং তার মুখ দেখলেই বোঝা যাবে যে সাত জন্মে তার নাম হারা নয়, কিন্তু সেও চালিয়ে যায় রহস্য, হঠাৎ যেন বিদ্যুচ্চমকের মতন তার মনে হয় (না, আমি এখানে সেনর লিনের কোন কবিতার পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করছি না, বা আমার নিজের তো নয়ই) যে কিছুক্ষণের জন্যে এই অচেনা হারা নামের মানুষটির জীবন যাপন করলে ক্ষতি কি, যদিও বা কয়েক মিনিটের ব্যাপার, এবং সেইখানে সেই ঝকমকে সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে তার জীবনের একমাত্র সুযোগ হারা বনে যাবার, সে আমায় জিজ্ঞেস করে কুশল প্রশ্ন, আমি কেমন আছি এবং তার সঙ্গে সঙ্গে জুড়ে দেয় (অবশ্যই কাঠের তক্তার মতন মোটা গলায়) আমি কে, তার মানে পারতপক্ষে সে স্বীকার করে নেয় যে সে হল হারা, কিন্তু এমন এক হারা যে তার বন্ধু বোলানোর কথা সম্পূর্ণ ভুলে মেরে দিয়েছে, তাতে অবশ্য আশ্চর্য হবার কিছু নেই, অতএব আমি আমার নাম, ধাম, চোদ্দপুরুষের খবর সব খুলে বলি তাকে এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে তার অর্থাৎ হারার হাঁড়ির খবরও, এইভাবে এক নতুন হারার সৃষ্টি করি, যাতে তার এবং আমার দুজনেরই সুবিধে আর সেই মুহূর্তের পক্ষে খুবই উপযোগী সৃষ্টি হয় এক অভাবনীয়, বুদ্ধিদীপ্ত, সাহসে ভরপুর, ধনী, উদার, ডাকাবুকো হারার যে অপূর্ব সুন্দর রমণীকে ভালবাসে এবং সেই রমণীও তার প্রেমে হাবুডুবু--আর তখন সেই গুণ্ডাব্যক্তি মিষ্টি করে হাসে, তার গভীর বিশ্বাস যে আমি তামাশা করছি তার সঙ্গে, কিন্তু কোনমতেই ভেবে পায় না কিভাবে এই উপাখ্যানটির তার অন্তিম পর্বে পৌঁছাবে, হঠাৎ যেন আমার মনের মাধুরী মিশিয়ে জন্ম দেওয়া এই হারা মানুষটিকে তার পছন্দ হয়ে গেছে খুবই, এবং সে কথাবার্তা চালিয়ে যায়, আমাকে শোনাতে বলে হারার বৃত্তান্ত, শুধু হারার নিজের কেচ্ছাই নয়, তার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সব মিলিয়ে তার ভুবন, যে ভুবন হয়ত হারার মতন একটা মানুষের পক্ষে অতিপ্রশস্ত ও বিস্তৃত, যে ভুবনে আমাদের অতিমানব হারা একটা পিঁপড়ের মতন অকিঞ্চিৎকর, এই ঝকমকে সিঁড়ির ওপর তাকে কেউ পায়ে চেপে মারলে কোন ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না মানুষের; কিন্তু তখন আমাদের এই কথাবার্তার ফাঁকে কখন বেরিয়ে এসেছে তার বন্ধুরা, দুই দীর্ঘকায় ঘাতক, হালকা রঙের ডাবল-ব্রেস্টেড স্যুট তাদের পরনে, তারা মিটমিট করে একবার তাকায় আমার দিকে, একবার নকল হারার দিকে, জানতে চায় আমার পরিচয়, এবং এত সাতকাণ্ড রামায়ণ শোনার পরে তার আর না বলে উপায় থাকে না, এই যে, আমার বন্ধু বোলানো এবং দুই খুনী ঘাতক এগিয়ে এসে প্রীতি সম্ভাষণ জানায় আমাকে। আমি করমর্দন করি তাদের (দামী পাথর বসানো আংটি, মহার্ঘ হাতঘড়ি, সোনার ব্রেসলেট) এবং তারা আমায় এক পাত্তর মদ খেতে আমন্ত্রণ জানালে, আমি দু:খের সঙ্গে বলি, আজকে তা সম্ভব না, এক বন্ধুর সঙ্গে এখনই দেখা হওয়া জরুরি, এই বলে হারাকে পাশ কাটিয়ে আমি দরজা দিয়ে ঢুকে ভেতরে অদৃশ্য হয়ে যাই, তাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে। সেনর লিন তখনো বসে আছেন তাঁর টেবিলে ঠিক আগেকার মতন। কিন্তু উৎসাহী তরুণ কবির দল তাঁর সঙ্গে বসে নেই। জলের গ্লাসটি শূন্য। কবি শেষ করেছেন তাঁর ওষুধ আর অপেক্ষা করছেন আমার জন্যে। একটি কথা না বলে তিনি উঠলেন, আমরা রওনা দিলাম তাঁর অ্যাপার্টমেন্টের দিকে। তিনি বাস করেন সেই বিলডিঙের সাততলায়, আমরা যে লিফটে উঠি তার কক্ষটি বিশাল, অন্তত: তিরিশ জন মানুষ ওঠানামা করতে পারে একসঙ্গে। অ্যাপার্টমেন্টটি ছোট, খুবই ছোট, বিশেষ করে চিলের একজন খ্যাতনামা লেখকের পক্ষে এবং একটিও বই নেই তাঁর ঘরে। আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আর কোন বই পড়ার প্রয়োজন নেই তাঁর, প্রশ্নই ওঠে না তার। কিন্তু ঘরে কিছু বইপত্তর থাকা ভাল, স্বীকার করেন তিনি। তাঁর অ্যাপার্টমেন্ট থেকে স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায় নীচের বার। মেঝেটা যেন কাচ দিয়ে তৈরি। আমি হাঁটু গেড়ে বসে নীচের দিকে তাকিয়ে বারের লোকগুলোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি, জানতে চেষ্টা করি একটু আগে দেখা উৎসাহী তরুণ কবির দল এবং তিনজন খুনী ঘাতক এখনো সেখানে আড্ডা দিচ্ছে কিনা, কিন্তু আমার চোখে পড়ে কেবল অচেনা মানুষ খানাপিনায় রত, ঘুরে বেড়ায় এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে, এক বুথ থেকে অন্য বুথে অথবা বারের কাউন্টারের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, ঠিক যেন বিংশ শতাব্দীর প্রথম অর্ধের এক মহতী উপন্যাসের দৃশ্য। বেশ কিছুক্ষণ পরে আমার বোধোদয় ঘটল, একটা বিরাট কিছু সমস্যা বা গণ্ডগোল রয়েছে। সাততলার এই অ্যাপার্টমেন্ট থেকে দেখতে পাচ্ছি একতলার সেই বার। ধরে নিলাম অ্যাপার্টমেন্টের মেঝে কাচের তৈরি, আর বারের ছাদটাও তাই; কিন্তু মাঝের দোতলা থেকে ছ’তলা--এই পাঁচটি তলা বেমালুম উবে গেল কোথায়; সেগুলোও কি সব স্বচ্ছ কাচের তৈরি? অনেকক্ষণ ধরে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার পর মাথায় ঢুকল পুরো ব্যাপারটা, বোঝা গেল যে কেবল রয়েছে একতলা আর সাততলা, তাদের ফাঁকে আর কিছু নেই, ধু ধু অসীম শূন্যতা। নিজেকে ভীষণ বিপন্ন মনে হল এই আবিষ্কারের ফলে। হায় ভগবান, সেনর লিন, কোন দু:খে আমাকে আপনি এনে হাজির করলেন এখানে, আমি ভাবি প্রথমে। তারপর ভাবি, হায় ভগবান, সেনর লিন, আপনাকেই বা কেন নিয়ে এসেছে ওরা এই পাণ্ডববর্জিত অ্যাপার্টমেন্টে? আমি উঠে দাঁড়াই সাবধানে, সন্তর্পণে, কারণ এই আজব দেশের বস্তুসমূহ বাইরের পৃথিবীর মতন যদি না হয়, যদি তারা হয় মানুষজনের থেকে ভঙ্গুর, ভেঙে না পড়ে পায়ের তলার কাচের মেঝে, এবং অদৃশ্য হয়ে গেছেন সেনর লিন, আমি তাকে খুঁজতে থাকি এঘর থেকে ওঘরে, কিন্তু এতগুলো ঘর এল কোথা থেকে এই অ্যাপার্টমেন্টে, সেটা আর আগের মতন ছোট নেই ইওরোপের নামকরা লেখকদের বাসস্থানের মতন, এখন সেটা প্রশস্ত, বিশাল আর প্রাচুর্যে ভরা, চিলে অথবা তৃতীয় বিশ্বের ধনী লেখকদের আস্তানার মতন, যেখানে ঘুরে বেড়ায় পালপাল ঝি, চাকর আর রাঁধুনি এবং দামী দামী আসবাব এবং শৌখিন সামগ্রী সাজানো থরে থরে, ঘরগুলো আধা আলো আর আধা অন্ধকার, ভ্রাম্যমাণ ছায়ারা ঘুরে বেড়ায় সেখানে শীতলতার মধ্যে, আমি সেখানে দূটো বই দেখতে পেলাম, একটা ক্ল্যাসিক, মসৃণ পাথরের মতন, অন্যটি আধুনিক অথচ সময়ের সীমার বাইরে, তাতে টাটকা গুয়ের গন্ধ, এবং ধীরে ধীরে, সেনর লিনকে খুঁজতে খুঁজতে শীতবোধ হতে থাকল আমার, মাথা ঘুরছে আমার, অথবা এক কাল্পনিক অক্ষে ভর দিয়ে ঘুরে চলেছে পুরো অ্যাপার্টমেন্টটা, তারপর দরজা খুলে গেল একটা এবং সামনে দেখি সুইমিং পুল, লিন যেখানে সাঁতার দিচ্ছেন এবং আমি মুখ খোলার এবং এনট্রপির বিন্যাসহীনতা নিয়ে কিছু বলতে শুরু করার আগেই সেনর লিন মুখ খুললেন আর জানালেন যে তাঁর ওষুধের একটাই বিরাট মুশকিল, যদিও ওষুধটা তাকে সশরীরে বাঁচিয়ে রেখেছে, তিনি ক্রমশ ওষুধ কোম্পানির পরীক্ষাগারের গিনিপিগে রূপান্তরিত হতে চলেছেন, আমি এমন কথাই শুনব তাঁর মুখ থেকে বলে আশা করেছিলাম, যেন পুরো ঘটনাটাই একটা নতুন নাটকের দৃশ্য এবং সেই মুহূর্তে মনে পড়ে যায় আমার নিজের সংলাপ এবং অন্যান্য সহ-অভিনেতাদের সংলাপও, আর তখন সেনর লিন উঠে এলেন সুইমিং পুল থেকে এবং আমরা দুজনে একসঙ্গে নীচের তলায় নেমে সেই বারের মধ্যে প্রবেশ করি, অসম্ভব ভিড় সেখানে, ভিড় ঠেলে আমরা এগোতে থাকি, তখন সেনর লিন বলেন, বাঘেরা সব মরে হেজে গেল একে একে কিন্তু তার আগে পর্যন্ত অনেক উপকার করে গিয়েছে জগতের, আর জানিস, তুই শুনলে বোধ হয় বিশ্বাস করবি না, বোলানো, এই যে মহল্লায় বাস করি আমি, এখানে কেবল মৃত মানুষেদেরই রাস্তায় হাঁটার হুকুম আছে। ততক্ষণে হাঁটতে হাঁটতে আমরা বারের একেবারে সামনে পৌঁছে গেছি, আর জানলা দিয়ে দেখতে পাই রাস্তা, অন্যান্য বাড়িঘর, দোকানপাট, বিচিত্রই বলতে হবে পাড়াটাকে, যখন জেনে গিয়েছি পথচারীরা সবাই মৃত মানুষ। আমরা জানলা দিয়ে তাকাই, তাকাই আর তাকাই। ঘরবাড়িগুলো পাল্টে গিয়ে দাঁড়ায় অন্য এক প্রজন্মের, রাস্তার দুধারে অসংখ্য গাড়ি রয়েছে পার্ক করা, তারা অন্য এক আমলের গাড়ি, যে সময় ধীর নীরব অথচ চলমান (সেনর লিন নিজের চোখে দেখেছেন তার গতি), এক ভয়াবহ সময়, যার সমাপ্তি ঘটে যাওয়ার অন্য কোন কারণ নেই, নির্ভেজাল জড়তা ছাড়া।
এসপানিওল ভাষার খ্যাতনামা কবি ও কথাসাহিত্যিক রোবের্তো বোলানো (১৯৫৩-২০০৩)-এর জন্ম চিলেতে, কিন্তু তাঁর ভবঘুরে জীবন কেটেছে লাতিন আমেরিকা এবং ইয়োরোপের নানান দেশে।২০০৩ সালের ১লা জুলাই স্পেনের বার্সিলোনা শহরের উপকন্ঠে তাঁর বাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়েন রোবের্তো। হেমারেজ রক্তপাতের পর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে এবং দেখা যায় তাঁর যকৃৎ বিকল। নতুন যকৃৎ প্রতিস্থাপনের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে তাঁর মৃত্যু ঘটে ১৫ই জুলাই। সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় “বর্তমান প্রজন্মের লাতিন আমেরিকার সেরা লেখকের” মৃত্যুসংবাদ।
স্বল্পকালের জীবনে তাঁর দুটি কাব্যগ্রন্থ আর ডজনখানেক গল্প উপন্যাসের গ্রন্থ। মৃত্যুর সময় একটিরও অনুবাদ হয়নি ইংরেজিতে। কিন্তু মৃত্যুর পরে হু হু করে বেড়ে চলেছে তাঁর জনপ্রিয়তা ইংরেজি সাহিত্যের পাঠকদের মধ্যে।
১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস “আমেরিকায় নাৎসি সাহিত্য” (“লিতারেতুরা নাৎসি এন আমেরিকা”)--বর্হেস প্রভাবিত রচনা, চরিত্রগুলির প্রত্যেকেই কাল্পনিক লেখক।
ঐ একই বছর প্রকাশিত নভেলা “দূরের নক্ষত্র” (“এসএলা দিসতান্তে”) পূর্বের উপন্যাসের শেষ পরিচ্ছদটির বর্ধিত রূপ। “Distant star” নামে ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর মহতী উপন্যাস, অনেকের মতে তাঁর শ্রেষ্ঠতম রচনা “লস ডিটেকতিভস সালভাহেস” (“হিংস্র গোয়েন্দা”)। “The savage Detectives” নেমে ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয় নভেলা “আমিউলেতো” (“মাদুলি”) এবং আরো একটি উপন্যাস “মসিয়েঁ পাঁই” (“মিস্টার রুটি”)।
২০০০ সালে প্রকাশিত হয় উপন্যাস “নকর্তুনো দি চিলে” (“চিলের রাত”)।
“The Night in Chile” নামে ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
২০০১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় গল্প সংকলন “পুতাস আসেসিনাস” (“খুনী গণিকারা”)। বর্তমান গল্পটি এই সংকলন থেকে গৃহীত।
২০০৩ সালে প্রকাশিত হয় তৃতীয় গল্পগ্রন্থ “এল গাউচো ইনসাফ্রিবল” (“অসহ্য গাউচো”)।
মৃত্যুর কয়েকদিন আগে সমাপ্ত করেন তাঁর অন্তিম উপন্যাস “২৬৬৬” (“ছাব্বিশ শো ছেষট্টি”) পাঁচ খণ্ডে বিভক্ত ১০০০-পৃষ্ঠার উপন্যাস; প্রকাশিত হয় মৃত্যুর পরে ২০০৪ সালে!
জীবনের শেষ দশ-বারো বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন রোবের্তো। তাঁর অপ্রকাশিত রচনাগুলি সংকলিত হচ্ছে গ্রন্থাগারে। ইংরেজি অনুবাদের কাজ চলেছে তাদের।
রোবের্তোর বেশির ভাগ গল্প-উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ করেছেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, অস্ট্রেলিয়াবাসী সাহিত্যিক ক্রিস অ্যান্ড্রুজ (Chris Andrews)। এখানে সংকলিত গল্পটিরও ইংরেজি অনুবাদ করেছেন তিনি। না, চোখের ভুল নয়, পুরো গল্পটিই একটি মাত্র অনুচ্ছেদে রচিত।
বাংলা অনুবাদকের টীকা—
— এনরিকে লিন (১৯২৯-১৯৯৮): চিলের ডাকসাইটে কবি এবং পরবর্তী প্রজন্মের কবি, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের আশ্রয়স্থল।
— আরকিলোসুস (খ্রীষ্টপূর্ব ৬৮০-৬৪৫): গ্রিক কবি এবং ভাড়াটে যোদ্ধা।
— উরতেকো-হোসে: কোরোনেল উরতেকো (১৯০৬-১৯৯৪), নিকারাগুয়ার প্রধান কবি।
— বের্তোনি: চিলের কবি ক্লাউদিও বের্তোনি (১৯৪৬ -- )।
— গনসালো মুনোস: চিলের কবি. জন্ম ১৯৫৬ সাল ।
— রদরিগো লিরা: চিলের কবি, জন্ম ১৯৪৯, মৃত্যু ১৯৮১ সাল।
— "মাকুইএইরা": চিলের কবি দিয়েগো মাকুইএইরা (১৯৫১ -- )।
— "মার্তিনেস": চিলের কবি হুয়ান লুইস মার্তিনেস (১৯৪২ -- ১৯৯৩)