• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৯ | ডিসেম্বর ২০১৭ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • ডাইনি সংবাদ : অনন্যা দাশ


    মালের পীড়াপীড়িতে আমি ওদের গ্রাম মোহনপুরে গিয়েছিলাম। তমাল আমার প্রিয় বন্ধুদের মধ্যে একজন আর অনেকদিন ধরে বলছিল ও। আসলে ও অনেকবার ছুটিতে আমাদের কলকাতার বাড়িতে এসে থেকেছে অথচ আমি কখনও ওর বাড়ি যাইনি তাই এবার আর না করতে পারলাম না। গরমের ছুটি পড়ার পর গেলাম ওদের ওখানে। মোহনপুরে এখনও সবুজ রয়েছে, কেটে ছেঁটে নির্মূল করে দেওয়া হয়নি। দেখলে মন জুড়িয়ে যায়, কী শান্ত নিরুপদ্রব! সাইকেল করে ওর বাড়ি যেতে যেতে সেটাই বললাম তমালকে। ও আমার জন্যে একটা সাইকেল নিয়ে স্টেশানে এসেছিল। মালপত্র তেমন কিছু আনিনি তাই সাইকেলে অসুবিধা হল না।

    আমার কথা শুনে তমাল বলল, “তুই যদি এই কথাটা ছমাস আগে বলতিস তাহলে আমি বলতাম একদম ঠিক বলেছিস! কিন্তু এখন তো আর সেটা বলা যাবে না!”

    “কেন? কী হয়েছে এখন?” আমার কান খাড়া হয়ে গেল।

    “আর বলিস না! এখানে এক উদ্ভট উপদ্রবের উদয় হয়েছে!”

    “কী রকম উপদ্রব শুনি?”

    “ডাইনি! মোহনপুরে এক ডাইনি এসেছে!”

    “ধুস! কী সব আজে বাজে কথা বলছিস! ওগুলো তো কুসংস্কার! ডাইনি আবার সত্যি হয় নাকি?”

    “আমিও মানতাম না জানিস কিন্তু এমন সব ঘটনা ঘটে চলেছে যে আমিও আর না মেনে পারছি না! চল বাড়ি গিয়ে তোকে সব বলব।”

    আমাকে দেখে মাসি মেসো ভারি খুশি! তমালের মুখে আমার কথা শুনে শুনে ওরা যেন আমাকে চিনেই ফেলেছেন প্রায়! হাত মুখ ধুয়ে বারান্দায় বসে মুড়ি চানাচুর নারকেল খেতে খেতে তমাল বলল--

    “সত্যি খুব শান্ত আর নিরুপদ্রব জায়গা ছিল মোহনপুর। এখানকার যিনি সব চেয়ে বড়লোক সেই যশোদানন্দনবাবু এখানকার জন্যে অনেক কিছু করেছেন। স্কুল হাসপাতাল ইত্যাদি তাই আর পাঁচটা গ্রামের মতন আমাদের কথায় কথায় শহরে ছুটে যেতে হত না। কলেজটা অবশ্য নেই তাই স্কুল শেষ করার পর সবাই শহরে পড়তে যায় আমার মতন। তবে এখানকার স্কুলটা বেশ ভাল, ভাল রেজাল্টও হয় বলে কলেজে অ্যাডমিশান পেতে অসুবিধা হয় না। যশোদাবাবু তো কলেজ করার কথাও ভাবছেন, দেখা যাক কী হয়। যাই হোক, যে প্রসঙ্গে বলছিলাম, ছমাস আগে হঠাৎ একদিন এক মহিলা এখানে থাকতে এলেন। বুঝতেই তো পারছিস ছোট জায়গা। সবাই সবাইকে চেনে তার মধ্যে একজন আগন্তুক এসে পড়লে কেউই খুব একটা ভাল ভাবে নেয় না। তবে কেউ যে আপত্তি করল তাও না। রমেশ মণ্ডলের বাড়িটা খালি পড়ে ছিল উনি মারা যাওয়ার পর থেকে। ছেলেরা সব কলকাতা দিল্লিতে সেটেল করে গেছে। ভদ্রমহিলা বললেন ওনার নাম কমলিকা সেন এবং উনি নাকি ওই বাড়িটা কিনেছেন। সেই থেকে ওখানেই রয়েছেন। কারো সাথে মেশেন না, বলেন উনি নাকি একা থাকতে চান। পুজো অনুষ্ঠান ইত্যাদিতেও যোগ দেন না। কেউ নিমন্ত্রণ করলে ভদ্র ভাবে না করে দেন। সত্যি বলতে কী ওনাকে বাড়ির বাইরে কেউই খুব একটা দেখে না। একজন বয়স্ক কাজের লোককে নিয়ে এসেছেন, তার নাম ভোলেরাম। সেও খুব একটা কথা-টথা বলে না, মুখ বন্ধ করে বাজার হাট করে। ওনাদের সম্পর্কে কেউই কিছু জানতাম না। আর আমি তো কলেজ নিয়ে ব্যস্ত আমার ওই সব উটকো লোক নিয়ে মাথা ঘামাবার সময়ও ছিল না।

    “তারপর থেকেই গণ্ডগোলটা শুরু হল। ওনার পাশের বাড়িতে থাকতেন সুধাকর পাত্র। বলতে নেই কিন্তু উনি যে প্রচণ্ড বদমেজাজি আর ঝগড়ুটে প্রকৃতির লোক সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। সুধাকরবাবু করেছিলেন কী রমেশবাবুদের বাড়ি অনেক দিন খালি পড়ে থাকার দরুন ওনাদের জমির কিছুটা অংশ নিজের করে নিয়ে পাঁচিল তুলে দিয়েছিলেন। রমেশবাবুদের বাগানে বেশ কয়েকটা ফলের গাছ আছে সেগুলো থেকে নিয়মিত ফল নেওয়াও ছিল ওনাদের অভ্যাস। ছেলেগুলোকে পাঠিয়ে দিতেন মাঝে মাঝেই পাশের বাড়ির বাগান থেকে ফল নিয়ে আসতে। যতদিন বাড়িতে কেউ ছিল না সেটা নিয়ে কেউ কিছু বলতে আসত না কিন্তু কমলিকা দেবী দেখে ফেলতে ভয়ানক রেগে গেলেন। ভোলেরামকে সুধাকরবাবুর বাড়িতে পাঠালেন। সে বলল, ‘এবার ফল নিয়েছেন নিয়েছেন কিন্তু এর পর যদি আপনার ছেলেরা আমাদের বাগানে ঢোকে তাহলে মেমসাহেব পুলিশ ডাকবেন।’ ব্যস আর যায় কোথায়, সুধাকরবাবু খেপে গিয়ে প্রচুর চিৎকার চেঁচামেচি করলেন। ওমা এক সপ্তাহ বাদে ওনার ছেলেমেয়ে গিন্নির সাথে তাদের মামার বাড়িতে গিয়েছিল, সুধাকরবাবুই বাড়িতে একা ছিলেন তখন বাড়িতে আগুন লাগে। সব কিছু পুড়ে ছারখার হয়ে যায় এবং সুধাকরবাবু সেই আগুনে পুড়ে মারা গেলেন। তখন গ্রামের সবাই টানটান হয়ে বসল। কমলিকা দেবীকে সন্দেহ করার কোন কারণ ছিল না, সুধাকরবাবু সিগারেট খেতেন। পুলিশের ধারণা শোবার সময় সিগারেট খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়েন তাই এই আগুন ধরে যায়।

    “এই ঘটনাটা ঘটেছিল দুমাস আগে তারপর পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানের জন্যে চাঁদা চাইতে ওনার বাড়িতে হাজির হয় বঙ্কু। বঙ্কু গ্রামের মস্তান। পড়াশোনা বিশেষ করেনি কিন্তু সব হুজুগে সে প্রথম। আড্ডা ক্লাব এই সব নিয়েই থাকে। দিব্যি ছলে বলে কৌশলে লোকের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে। সে হেন বঙ্কু ওনার কাছে চাঁদা চাইতে গেল। উনি ১০০ টাকা দিয়ে বললেন, “আমি এর বেশি আর দিতে পারব না!” বঙ্কু নাছোড়বান্দা, সে ৫০০ টাকা নিয়েই ছাড়বে! কথা কাটাকাটি হল দুজনের মধ্যে। দু দিন পর ভদ্রকালী মন্দিরের পাশের খাল থেকে বঙ্কুর মৃতদেহ উদ্ধার হল।

    “তারপর থেকেই কমলিকা দেবীকে ডাইনির খেতাব দিয়ে দিয়েছে মোহনপুরের লোকজন। রাতে নাকি ওনার বাড়ি থেকে বীভৎস সব চিৎকার শোনা যায়। হরেক রকম গল্প ছড়িয়ে পড়েছে। উনি নাকি ব্ল্যাক ম্যাজিক করেন, মুর্গি বা অন্য ছোট জন্তু বলি দেন ইত্যাদি! একটা কুচকুচে কালো তিন পেয়ে বিড়াল আছে, ওই রকম কেউ যে ভালবেসে পুষতে পারে সেটাই আমার জানা ছিল না!”

    সব শুনে আমার তো মাথা ভোঁ, ভোঁ করছিল! আমি বললাম, “হুঁ!”

    ঠিক তক্ষুনি ওখান দিয়ে একজন ভদ্রলোক যাচ্ছিলেন। ঝকঝকে চেহারা, পরনে জিন্স আর টি-শার্ট। ওনাকে দেখে তমাল লাফিয়ে উঠে বলল, “পলাশদা! এই আমার বন্ধু ইন্দ্র। আমরা এক সঙ্গে পড়ি। ওকে অনেক বলে কয়ে এখানে নিয়ে এসেছি। এবারে ও যাতে বোর না হয় সেটা দেখা আপনার দায়িত্ব!” তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, “পলাশদা বছর দুয়েক হল আমাদের এখানে এসেছেন। উনি লেখক। মানে গল্পের বই-টই নয় মোটা মোটা সব মনস্তত্ত্বের বই! এখানে থাকলে শান্ত পরিবেশে নাকি ওনার লিখতে সুবিধা হয়। আমাদের তাতে লাভ হয়েছে আমরা ওনার সঙ্গ পাই!”

    পলাশদা আমার সাথে হ্যান্ডশেক করে বললেন, “তোমরা চলে এসো আমার ওখানে একদিন তারপর না-হয় গল্প-টল্প করা যাবে। বেড়াতেও যাওয়া যেতে পারে। ওকে সাহেববাড়িটা দেখাতে নিয়ে যেতে পারি কালকে। আজ আর বসব না একটু তাড়ায় আছি। ঠিক আছে আসবি যখন একটু ফোন করে জানিয়ে দিস তাহলে বাড়িতেই থাকব।”

    বলে পলাশদা চলে গেলেন।

    তমাল বলল, “খুব মাই ডিয়ার লোক! উনি যে সাইকোলজির ছাত্রদের জন্যে অত মোটা মোটা বই লেখেন বোঝাই যায় না!”

    খাওয়া শেষ করে আমি বললাম, “চল একটু ঘুরে আসি!”

    “আজ থাক সাহেববাড়ি; যেতে এক ঘন্টা ফিরতে এক ঘন্টা রাত হয়ে যাবে!”

    “না, না, আমি তো মোহনপুরের ডাইনির বাড়িটা একবার দেখতে যাব ভাবছিলাম!

    “উফফ! তোকে নিয়ে আর পারা গেল না! এত জায়গা থাকতে তুই কিনা ডাইনির বাড়ি দেখতে চাস!”

    “হ্যাঁ! তুই যা গল্প শোনালি তারপর তো ওটাই দেখতে ইচ্ছে করছে!”

    সাইকেল নিয়ে আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। তখন সন্ধ্যা নেমে আসছে কিন্তু একেবারে রাত হয়নি। বাড়িটায় আহামরি কিছু নেই, সাধারণ একটা দোতলা বাড়ি। সামনের বাগানে যত্নের অভাবে আগাছা, তবে কিছু ফুলগাছও রয়েছে, রাতে ফোটা ফুলের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে ওনার কাজের লোক বাড়ির কাজ সামলে আর বাগানের কাজ করে উঠতে পারছে না। বাড়ির পিছনের দিকে বেশ কিছু বড় বড় গাছ। ওগুলোই সব ফলের গাছ যা নিয়ে সুধাকরবাবুর সাথে বিতর্কের সূত্রপাত। কলাগাছও রয়েছে কিছু। বাঁপাশের বাড়িটা পুড়ে গেছে বলে শুধু ধ্বংসাবশেষ। ডান দিকে অনেকটা খালি জমি, ওদিকটায় কোন বাড়ি নেই। কমলিকা দেবীর বাড়িতে কোন ঘরে তখনও আলো জ্বলে ওঠেনি তাই আমরা ভাবলাম উনি হয়তো বাড়িতে নেই। হঠাৎ আমাদের প্রচণ্ড চমকে দিয়ে বীভৎস একটা চিৎকার ভেসে এলো বাড়ির ভিতর থেকে! ভীষণ ভয়াবহ সেই চিৎকার!

    তমাল বলল, “তোকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম মনে হয়-- এই রকম চিৎকার নাকি প্রায়ই শোনা যায়! চল এখানে আর থেকে কাজ নেই! কী করছেন মহিলা কে জানে!”

    ফিরে এলাম আমরা। রাতের খাওয়ার প্রচুর আয়োজন করেছিলেন মাসিমা তাই পেট পুরে খাওয়া দাওয়া হল। শুতে শুতে বেশ রাত হল বলেই কিনা কে জানে আমার ঘুম আসতে খুব সময় নিচ্ছিল। অবশ্য কানে ওই ভয়ঙ্কর চিৎকারটা বাজছিল। সত্যি বলছি ওই রকম চিৎকার আমি কোনদিন শুনিনি। তাই সাত্যকিদাকে একটা ফোন করলাম। ঘটনাটা জানিয়ে বললাম কমলিকা সেন সম্পর্কে কিছু খুঁজে বার করতে পারে কিনা। সাত্যকিদা যে রাতে জেগে থাকবে সেটা আমার জানা ছিল, ও যে দৈনিক খবরাখবরের সাংবাদিক। কিছু বার করতে পারলে ওই পারবে।

    পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে একরাশ জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম তমালের সাথে। ওদের গ্রামের জাগ্রত মন্দির আর আরো দুয়েকটা টুকিটাকি জিনিস দেখিয়ে তমাল বলল, “সকালে পলাশদার সাথে কথা বলেছি উনি এখন থাকবেন বাড়িতে। সাহেববাড়িটা পলাশদার সাথে গেলেই মজা পাবি। উনি দারুণ গল্প বলতে পারেন। আমার সাথে যাওয়া আর ওনার সাথে যাওয়ায় আকাশ পাতাল তফাৎ!”

    পলাশদার বাড়ি পৌঁছে দেখলাম উনি বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন। তিনজনে মিলে সাহেববাড়িতে গেলাম। ১৮৫০ সালে জনৈক রবার্ট মিলার নাকি ওই বাড়িটা তৈরি করেছিলেন। সেটা সত্যি কিনা বলতে পারব না! তবে বাড়িটা প্রকাণ্ড। বিশাল বিশাল থাম দেওয়া বেশ রাজকীয় দেখতে বাড়ি। এখন অবশ্য অযত্নে একেবারে ভগ্নদশা।

    বাগানে পা রাখার আগে পলাশদা হঠাৎ বলে উঠলেন, “সাবধান, বাগানে প্রচুর সাপ আছে! তুই শহুরে মানুষ তাই জানিয়ে দিলাম!”

    সাপ শুনে আমি একটু থমকালাম। ওই একটা জিনিস আমি একেবারে সহ্য করতে পারি না। সাপ শুনলেই আমার গা হাত পা হিম হয়ে যায়, সারা শরীর রিরি করে, তাছাড়া রাতে ঘুমের মধ্যে ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখি! তমাল তো সেই সব জানে তাহলে কেন আমাকে এই জায়গায় আনল?

    আমি বললাম, “তাহলে তো সাহেব বাড়িকে দূর থেকেই নমস্কার--আমি আর ভিতরে যাব না!”

    সেই শুনে পলাশদা আর তমালের সে কী হাসি! রাগে কান গরম হয়ে গেল আমার!

    অবশেষে তমাল হাসি থামিয়ে বলল, “নারে, এখন আর কিছু নেই! তবে বাগানে সাপ হয়েছিল প্রচুর তাই আমরা সবাই চাঁদা করে সব পরিষ্কার করিয়েছি!”

    আমি ওদের সাথে বাগান পেরিয়ে ঢুকলাম বটে সাহেববাড়িতে কিন্তু ততক্ষণে আমার মেজাজটা খিঁচড়ে গেছে!

    পলাশদা ভালই গল্প বলেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিছুটা তারিণীখুড়ো, কিছুটা নীল সাহেবের কুঠি আর বেশ কিছু ভূতের গল্প মেলানো মেশানো একটা ককটেল পরিবেশন করলেন! আমার যে খুব একটা বিশ্বাস হল তা নয় কিন্তু শুনতে ভালই লাগছিল।

    তমাল দেখলাম পলাশদার গুণমুগ্ধ, আমি গল্পটাকে বিশেষ আমল দিচ্ছি না দেখে ও বলল, “দিনেরবেলা বলে তোর ওই রকম লাগছে, এটা যদি রাতেরবেলা হত না তাহলে পলাশদার গল্প শুনে তোর ভিরমি লাগত!”

    তারপর তমাল আর পলাশদা মিলে আমার পিছনে লাগতে শুরু করল। আর শুরু হল তো হল শেষ যেন আর হয় না! ওরা দুজনে মিলে আমাকে একেবারে নাকাল করে ছাড়ল! আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম যে এই শেষ, আর কোনদিন তমালদের বাড়ি আসব না! এখানে সব সাহসের মূর্তিমান অবতাররা থাকে আমার মতন ভীতুদের এখানে এসে কাজ নেই! আমার যা রাগ হচ্ছিল আমি হয়তো বাড়ি ফিরেই ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যেতাম কিন্তু দেখলাম তমালের দিদি এসেছে তার দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে তাই আর বেরলাম না। তমালের দিদি ওর চেয়ে অনেকটাই বড়; তাই তার ছেলে রুকু দশ বছর আর মেয়ে মন সাত বছরের। দুপুরবেলা দারুণ খেয়ে দেয়ে একটু ঘুমিয়ে নিলাম। ঘুম থেকে উঠে আমি তমালকে একেবারে পাত্তা না দিয়ে রুকু আর ওর বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলতে লাগলাম। ফুটবল যেখানে খেলা হচ্ছিল সেই জায়গাটা তমালদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে। হঠাৎ রাস্তা দিয়ে একটা গাড়ি এসে মাঠের পাশে থামল। সুট পরা এক বয়স্ক ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নেমে জিজ্ঞেস করলেন, “আমি সুরমা দাশগুপ্তর বাড়িটা খুঁজছি। সেটা কোন দিকে তোমরা বলতে পারবে?”

    খেলোয়াড়রা সবাই মাথা নেড়ে বলল, “এখানে তো ওই নামে কেউ থাকে না!”

    ভদ্রলোক বেশ আশ্চর্য হয়ে বললেন, “ও তাহলে কি আমিই ভুল পথে চলে এলাম? তোমরা ঠিক বলছো তো?”

    একটা ছেলে ছুটে গিয়ে পাশের একটা বাড়ির বারান্দায় বসে থাকা এক বয়স্ক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেসও করে এলো।

    “নাহ, জেঠুও বললেন, সুরমা দাশগুপ্ত নামে এখানে কেউ থাকে না!”

    সুট পরা ভদ্রলোক যেন বেশ ঘাবড়ে গিয়ে গাড়িতে উঠে যে পথ দিয়ে এসেছিলেন সেই পথেই ফিরে গেলেন। আর তক্ষুনি আমার ফোনটা বেজে উঠল – সাত্যকিদা!

    বেশ কিছুক্ষণ কথা হল সাত্যকিদার সঙ্গে। যা বলার দরকার ছিল না এমনও অনেক কথা তাকে বলে দিলাম!

    বিকেলবেলা মাসিমা মেসোমশাই একটা গান বাজনার আসরের আয়োজন করেছিলেন। তমালের দিদি আর তমাল দুজনেই ভাল গান গায়। যাই হোক গানটান শুনে তমালের উপর রাগটা কিছুটা কমল। শুতে যাব তখন প্রায় রাত দুটো এমন সময় সাত্যকিদার ফোন! বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে তারপর সে ফোন ছাড়ল। অনেক কিছু করতে হবে কিন্তু তখন আর শরীর চলছে না তাই ঠিক করলাম যা হবার সকালেই হবে।

    সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে তমালকে গিয়ে ধরলাম, “আচ্ছা একটা কথা ঠিক করে বলতো, তুই আমার দলে না পলাশদার দলে?”

    তমাল চমকে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “সে আবার কী রকম কথা! দল হতে যাবে কেন?”

    “না, তুই ঠিক করে বল! আমার দিকে না পলাশদার দিকে?”

    “ও তুই এখনও চটে আছিস! তা তোর দিকেই থাকব! তুই তো আমার বন্ধু। পলাশদাকে আর আমি কতটুকু চিনি! উনি যবে থেকে এখানে থাকতে এসেছেন আমি তো হোস্টেলে।“

    “তাহলে তুই কালকের সব কথাগুলো ফেরৎ নিচ্ছিস তো?”

    “কী হয়েছে তোর বল তো? এখনও রেগে রয়েছিস তোকে খেপিয়েছি বলে?”

    “না, আর রেগে নেই তবে আমি এখন যে কথাগুলো তোকে বলব সেগুলোর উত্তর তোকে ঠিক ঠিক দিতে হবে, পলাশদার সাইড নিলে চলবে না!”

    “ঠিক আছে বল!”

    “সুধাকরবাবুর সাথে পলাশদার চেনাশোনা ছিল?”

    “হ্যাঁ, ছিল মনে হয়। সুধাকরবাবুকে দুয়েকবার আমি পলাশদার বাড়িতে যেতে দেখেছি আর আমি তো এখানে কমই থাকি। তার মানে ওনার পলাশদার বাড়িতে যাতায়াত ছিল।“

    “আর বঙ্কু?”

    “বঙ্কুর পলাশদার সাথে জানাশোনা ছিল কিনা আমি জানি না কিন্তু সুধাকরবাবুর দূরসম্পর্কের আত্মীয় ছিল বঙ্কু। ওনার কাছে তাই চাঁদা চাওয়ার জুলুমবাজি করত না।”

    “হুমম!”

    “কী হয়েছে বল তো?”

    “পলাশ বরণ পাল যিনি মনোবিজ্ঞানের বই লেখেন তিনি ছমাস হল গত হয়েছেন।”

    “ধ্যাৎ! কী সব হাবিজাবি বকছিস!”

    “হাবিজাবি নয় সত্যি কথা! সাত্যকিদা ওনার প্রকাশকের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে জেনেছে। খবরটা খুব সম্ভব তোর পলাশদা জানে না! সেই কারণেই এখানে যে রয়েছে সে বই-লেখা পলাশ পাল হতে পারে না! সে অন্য কেউ!”

    “অ্যাঁ! বলিস কী রে! যদি পলাশ পাল না হয় তাহলে সে মিথ্যে কথা বলল কেন?”

    “সে আমি কী করে জানব? তবে শোন আরো আছে! কমলিকা সেন বলে কারো নামে তেমন কিছু পায়নি সাত্যকিদা। কাল বিকেলে আমরা যখন ফুটবল খেলছিলাম তখন এক ভদ্রলোক সুরমা দাশগুপ্তর খোঁজ করছিলেন। আমার কী মাথায় পোকা ঘুরেছিল আমি সাত্যকিদাকে ওই নামটাও দিয়েছিলাম। কাল রাতে ফোন করেছিল সাত্যকিদা। পাহাড়ে ছুটি কাটাতে গিয়ে খাদে গাড়ি পড়ে গিয়ে বারো বছরের ছেলে আর স্বামীকে হারান সুরমা দাশগুপ্ত! গাড়ির চালকও সেই দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিল।”

    “কী সাংঘাতিক!”

    “আরো আছে! ওই দুর্ঘটনায় সুরমা দেবীর দুটি পা কাটা যায়। উনি এখানে সত্যি একা থাকার জন্যে এসেছেন। ওনার চিৎকার করার কারণ আছে! উনি মোটেই ডাইনি নন!”

    “কিন্তু সুধাকরবাবুর বাড়ি পুড়ে যাওয়া আর বঙ্কুর খুন?”

    “আমি সাহেববাড়িতে তোলা পলাশদার একটা ছবিও পাঠিয়েছিলাম সাত্যকিদাকে। দীনেশ সিংহ নামে এক দাগি ব্যাঙ্ক ডাকাতের সাথে তোর ওই পলাশদার ছবির মিল আছে। একেবারে ১০০ পার্সেন্ট সিওর হতে পারছে না সাত্যকিদা, ওটা পুলিশের কাজ। সুধাকরবাবু পলাশদার বাড়িতে গিয়েছিলেন কয়েকবার তুই বললি। আমার মনে হয় উনি সত্যি কথাটা কোন ভাবে জানতে পেরে তাকে ব্ল্যাকমেল করছিলেন! আর বঙ্কুও সেটা জানত এবং সেই ব্যাপারে সুধাকরবাবুকে সাহায্য করত হয়তো তাই ওদের দুজনকে নিজের পথ থেকে সরিয়ে সুরমা দেবীর ঘাড়ে দোষটা চাপাতে সুবিধা হয়েছিল মিথ্যে পলাশের।”

    ###

    পুলিশও সেটাই বলল যে দীনেশ সিংহই আসলে পলাশ সেজে তমালদের গ্রামে এসে বসেছিল। সুধাকরবাবু কী রকম ভাবে জানি সেটা ধরে ফেলেন এবং সব ফাঁস করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ওর কাছে টাকা চাইতে থাকেন। ব্যাঙ্ক ডাকাতিতে পাওয়া অর্থ থেকে কিছুকাল টাকা দেওয়ার পর বিরক্ত হয়ে সুধাকরবাবু আর বঙ্কুকে পথ থেকে সরিয়ে ফেলে দীনেশ। দোষটা সুরমা দেবীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়াটা খুব সহজ ছিল। ডাইনি অপবাদটা একবার রটিয়ে দিয়ে মজা দেখছিল সে।

    কলকাতা ফিরে আসার আগে সুরমা দেবীর বাড়িতে গিয়েছিলাম একবার। ওনার আসল নাম জানি বলতে দেখা করতে রাজি হয়েছিলেন। কৃত্রিম পা লাগিয়ে এখন ঘরের ভিতর দিব্যি চলাফেরা করতে পারেন তিনি কিন্তু মাঝে মাঝে প্রচণ্ড ব্যথা হয় আর পুরোনো দিনের কথা মনে পড়লেও দিশাহারা হয়ে পড়েন। বললেন, “তখন গলা ছেড়ে চিৎকার করতে ইচ্ছে করে! এবং করেও ফেলি!”

    তারপর বললেন, “আমি কিন্তু লোকের সহানুভূতি কুড়োতে চাই না! সেই জন্যেই নিজের আসল পরিচয়টা গোপন করে রেখেছিলাম আর সেটাই কিনা আমার কাল হতে বসেছিল! ডাইনি হয়ে গিয়েছিলাম! যাক তোমাদের জন্যে তাও আসল অপরাধী ধরা পড়ল!”

    তমাল বলল, “আপনার ব্যাপারটা আমরা কাউকে বলিনি এবং বলবও না! কিন্তু একটা কথা না বলে পারছি না! আপনার মতন সাহসী মহিলা আমি জীবনে দেখিনি!”

    শুকনো হাসি হাসলেন সুরমা দেবী, “মাঝে মাঝে যখন আমি সাহস হারিয়ে ফেলি তখন কাল্লুকে দেখি! ওর তো তিনটে পা, ওকে তো কেউ কৃত্রিম পাও দেয়নি তাও ও কেমন লড়ে যায়!”

    সুরমা দেবীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে তমাল আমাকে বলল, “তুই কী করে পলাশদাকে সন্দেহ করলি?”

    আমি বললাম, “দূর! সন্দেহ-টন্দেহ কিছু নয়! ওর উপর আমার ভয়ানক রাগ হয়েছিল তাই সাত্যকিদাকে ফোনে বলেছিলাম পলাশ পাল সত্যি সাইকলজির বই লেখেন কিনা সেটা খোঁজ নিতে! সেই কেঁচো খুঁড়তে গিয়েই তো সাপ বেরিয়ে পড়ল! ও যদি ওইভাবে আমার পিছনে লেগে আমাকে অপদস্থ না করত তাহলে আমি কোনদিন ওর নামটা যাচাই করে দেখতে বলতাম না!”



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ লেখক
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments