বাংলায় বামেরা / রাজপথে ও রাজ্যপাটে (১৯২০-২০১১); অঞ্জন বসু; প্রথম প্রকাশ : জুলাই ২০১৭, দীপ প্রকাশন - কলকাতা, পৃষ্ঠাঃ ৭২৭; প্রচ্ছদ : শ্যামল জানা; ISBN : 978-93-86219-69-5
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিনগুলোতে ভারতের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রধান মঞ্চ ছিল ভারতের জাতীয় কংগ্রেস। রক্ষণশীল কায়েমি স্বার্থ আর বৈপ্লবিক প্রগতিবাদীদের আশ্চর্য সমাবেশ ছিল কংগ্রেস। ঠিক রাজনৈতিক দল নয়, যেন এক বৃহৎ পরিবার যার সদস্যরা নানান রাজনৈতিক ভাবাদর্শে বিশ্বাসী হলেও ব্রিটিশ বিরোধিতার সামান্য ন্যূনতম লক্ষ্যে অবিচল। কিন্তু কোনো দলের নির্দিষ্ট শ্রেণিচরিত্র না থাকলে তা কখনোই প্রকৃত রাজনৈতিক দিশা পায় না। কংগ্রেসও সবশ্রেণির মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করতে পারছিল না। তাই প্রথমেই এ দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর এক বিপুল অংশ কংগ্রেস ছেড়ে মুসলিম লিগের পতাকাতলে জোটবদ্ধ হয়। আবার অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের বড়ো অংশ কংগ্রেসের আবেদন-নিবেদনের রাজনীতিতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নেন। মাস্টারদা সূর্য সেন ১৯১৮-য় চট্টগ্রামে কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েও বিকল্প জাতীয়তাবাদের মুখ হিসেবে যেভাবে উঠে এলেন তাতেই বোঝা যায় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম কংগ্রেস নির্দেশিত পথে এগোতে চাইছিল না আর। বামপন্থীরা অবশ্য বহুদিন কংগ্রেসের মধ্যেই থাকতে চেয়েছিলেন। মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা থেকে তাঁদের উপস্থিতি প্রথম নজরে আসতে থাকে। আর অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের মধ্যে অনেকে কারান্তরালে থাকাকালীন বামপন্থী দলগুলিতে যোগদান করায় বামপন্থীরা ক্রমেই জোরালো রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হতে থাকেন। তবে এই বামপন্থীদের মধ্যে বিশেষভাবে স্বতন্ত্র হয়ে ওঠেন কমিউনিস্টরা। দেশভাগ ও স্বাধীনতার আগে-পরের সময়ে কমিউনিস্টরাই ছিলেন ভারতে কংগ্রেস-বিরোধী প্রধান রাজনৈতিক পক্ষ। যদিও অনুশীলন-যুগান্তর ইত্যাদি দলের বিপ্লবীদের মধ্যে যাঁরা পরবর্তী সময়েও রাজনীতিতে থেকেছেন, তাঁরা কমিন্টার্ন তথা সোভিয়েত নির্দেশিত কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংযুক্ত না হয়েও মার্কসবাদের চর্চা ও সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে তার প্রয়োগের নিরীক্ষা চালিয়ে গেছেন। যেমন বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল বা আরএসপি। হয়তো বিপ্লবী জাতীয়তাবাদীদের পূর্বাশ্রমে গীতা ও দেবীমূর্তির প্রভাব তাঁদের চেতনাকে কমিউনিস্ট নিরীশ্বরবাদীদের প্রতি খানিকটা সন্দিগ্ধ করে থাকবে। কিন্তু প্রকাশ্যে তাঁরা মার্কসবাদের ফলিত প্রয়োগে সোভিয়েত রাশিয়ার খবরদারি আর স্তালিনের উনিশশো চল্লিশোত্তর কার্যকলাপকে সমর্থন না-করার কথা বলতেন। আবার এই বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দলের একটা অংশ তরুণ তুর্কি নেতা শিবদাস ঘোষের নতুন সমাজ ও আদর্শ বিপ্লবী মানুষ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে সোশালিস্ট ইউনিটি সেন্টার বা এস ইউ সি আই (ইদানীং এর সঙ্গে অবিশ্যি কমিউনিস্ট শব্দটিও যুক্ত হয়েছে) গঠন করেন। তবে ভারতের রাজনীতিতে কমিউনিস্ট পার্টির উত্থানের কাছে এরকম বাম দলগুলির বৃদ্ধি নেহাতই সামান্য। বিশেষ করে চল্লিশের দশকে একাধিক গণসংগঠনকে আশ্রয় করে কমিউনিস্ট পার্টি গোটা দেশ জুড়েই ব্যাপক প্রসার পায়। আর চারের দশকে পার্টির এই বহুমুখী প্রসারের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক পি সি জোশি। ফ্যাসিবিরোধী লেখকশিল্পী সংঘ এবং আইপিটিএ-র সাফল্য এক্ষেত্রে অনস্বীকার্য। বস্তুত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মূলত রাশিয়ার হাতে জার্মানির পরাজয় কমিউনিস্ট ব্লকের পক্ষে ছিল সবচেয়ে বড়ো বিজ্ঞাপন। আর সমাজের সবচেয়ে স্পন্দনশীল অংশ, লেখক-শিল্পীরা তাই শ্রেণিহীন সমাজের স্বপ্নে মাতোয়ারা হয়ে ভিড় করেছিলেন আইপিটিএ-র মতো সংগঠনগুলিতে। যদিও তাঁদের এই সিদ্ধান্তে বুদ্ধির তুলনায় হৃদয়ের টান ছিল বেশি। কেননা কমিউনিস্ট পার্টি অহৈতুকী সংস্কৃতিমনস্কতা নিয়ে এই কাজে অবতীর্ণ হয়েছিল, এমনটা আদপেই নয়। বলাবাহুল্য কমিউনিস্ট পার্টি আর পাঁচটা রাজনৈতিক দলের মতোই, সেও বিস্তৃতিকামী হবে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু পার্টি লাইন নামক এক অমোঘ তর্জনী অচিরেই লেখক শিল্পীর স্বপ্নভঙ্গ ঘটায়। তবে পার্টিতে তখন ভরা বর্ষার বেগ। কয়েক বছর পিছিয়ে গিয়ে যদি দেখি— ১৯৪২-এর ২৩ জুলাই কমিউনিস্ট পার্টির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পর বৈধ পার্টি হিসাবে ১৮-২১ মার্চ ১৯৪৩-এ কলকাতায় তৃতীয় বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় ভবানী সেনের লেখা রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্টে ‘পার্টির প্রসার’ অংশে বলা হয়েছে— ‘১৯৩৮ সালের নভেম্বরে যখন দ্বিতীয় পার্টি সম্মেলন হয় তখন সভ্য সংখ্যা ছিল ৩০০। সেই সময় থেকে পার্টির সভ্য সংখ্যা নিম্নলিখিত ভাবে বেড়েছে:—
১৯৩৮ (নভেম্বর) … ৩০০দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়া আক্রান্ত হবার পর কমিউনিস্ট পার্টি এই যুদ্ধকে জনযুদ্ধ বলে চিহ্নিত করে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ব্রিটিশকে বিরক্ত না-করার লাইন নিয়ে কিংবা ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ না-নেওয়ায়, যে-দেশদ্রোহিতার অভিযোগ পার্টির বিরুদ্ধে ওঠে, সেই প্রতিকূল সময়েও কীভাবে বাংলায় পার্টির সদস্য সংখ্যা বেড়েছে তার হদিশ নিতে গেলে বোঝা যায় দুর্বল সাংগঠনিক ক্ষমতা সত্ত্বেও কমিউনিস্ট পার্টির আন্দোলনমুখী চেহারাও মানুষের মনে প্রভাব ফেলেছিল। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ১৯৩৭-এ কানপুরের শ্রমিকরা মূলত কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে ৫৫ দিনের যে সফল ধর্মঘট পালন করে তা মানুষের মন থেকে একেবারে মুছে যায়নি। বাংলার কৃষকদের আন্দোলনে পার্টির সক্রিয়তাও জনমানসে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল সেসময় বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্তের একটা অংশ কংগ্রেস আর লিগের বাইরে তৃতীয় একটি প্রগতিশীল রাজনীতির ধারা খুঁজছিল। এক্ষেত্রে সাম্যবাদী রাজনীতির আন্তর্জাতিক পরিসর, বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে তেভাগার ‘হেই সামালো’ ডাক মানুষকে নতুন এক সম্ভাবনার কথা বলছিল।
১৯৪১ (ডিসেম্বর) … ৫০০
১৯৪২ (জুলাই) … ৯০০
১৯৪৩ (জানুয়ারী) … ২০০০
১৯৪৩ (মার্চ্চ) … ৩০০০’
কিন্তু তেভাগা হোক বা তেলেঙ্গানা, প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ময়দানে ঝড় তোলা মানুষ এক সময় হতবাক হয়ে দেখেছেন কখনো রণনীতি কখনো রণকৌশলের কথা বলে বিদ্রোহের চূড়ান্ত মুহূর্তে পার্টির পশ্চাদপসরণ। ১৯৫৬ সালে কেরালার পালঘাটে (পাল্লাকাড়) ১৯-২৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত পার্টির তৃতীয় কংগ্রেসেই তাই বিভাজনের সমূহ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। এই কংগ্রেসে জোশি ফের তাঁর ‘পপুলার ফ্রন্টে’র তত্ত্ব তুলে ধরেন কিন্তু জোশির লাইনের বিরুদ্ধে আনা অজয় ঘোষের ‘কংগ্রেস বিরোধী গণতান্ত্রিক ফ্রন্টে’র প্রস্তাব শেষমেশ জয়ী হয়। রণদিভে পুনরায় পার্টি নেতৃত্বে ফেরেন। তবে পার্টির ভেতরকার এই দ্বন্দ্ব আদৌ প্রশমিত হয়নি। গণআন্দোলনে, রাজপথে উদ্বাস্তুদের অধিকার অর্জনের লড়াইয়ে, ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলনে, শিক্ষকদের আন্দোলনে, বাংলা-বিহার সংযুক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনে পার্টির গ্রহণযোগ্যতা যেমন বাড়তে থাকে সেই সঙ্গে আন্তঃপার্টি সংগ্রামও বাড়ে। শেষ পর্যন্ত ১৯৬২-র চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষ পার্টি ভাগের চরম মুহূর্তটি এনে দেয়।
তুলনায় বেশি বৈপ্লবিক ভরবেগ সম্পন্ন অংশটি সিপিআইএম নামে নতুন দল গঠন করে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্লোগান দেয়। অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদকে একসঙ্গে ধ্বংস করার আহ্বান। এরপর থেকে অবশ্য সিপিআইএম ক্রমেই জড়িয়ে পড়ে সংসদীয় রাজনীতিতে। কিন্তু একই সঙ্গে গণআন্দোলন চালিয়ে যাওয়ায় মানুষের ব্যাপক সমর্থন পেতে থাকে দলটি। যদিও সিপিআই ভেঙে বেরিয়ে আসা পার্টির বৈপ্লবিক অংশ সংসদীয় পাঁকে ডুবে যেতে না চেয়ে সরাসরি লড়াইয়ের ময়দানেই থাকতে চাইছিলেন। ফলে পাঁচ বছরের মধ্যেই আবার দু-টুকরো হয় পার্টি, তৈরি হয় সিপিআইএমএল। ততদিনে শুরু হয়ে গেছে নকশাল বাড়ির বিদ্রোহ। সেই তিরিশের দশকের পর আর এভাবে কখনো অস্ত্র হাতে তুলে নেয়নি বাঙালি। সত্তরের দশককে মুক্তির দশক বানাতে গিয়ে নানা হঠকারী সিদ্ধান্তের সঙ্গে ব্যক্তি হত্যার রাজনীতি গ্রহণ করায় অমিত সম্ভাবনা যুক্ত এই আন্দোলন গণমানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আর কোনোরকম গণসংগঠন তৈরির তত্ত্বগত আপত্তি নকশালদের সম্পর্কে সন্ত্রাসের রাজনীতি করার অভিযোগ আরও জোরালো করে। সেই সঙ্গে খাদ্য আন্দোলনের মতো নিবিড় গণআন্দোলন সিপিআইএম দলটিকে মানুষের কাছে গ্রহণীয় করে তোলে। কংগ্রেসি অপশাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার পর প্রথমবার বাংলার মানুষ বামপন্থীদের ওপর ভরসা করতে শুরু করেন। ১৯৬৭ ও ১৯৬৯-এর মিলিজুলি সরকার হয়তো চলেনি বেশিদিন কিন্তু বুঝিয়ে দিয়েছিল শাসন মানেই কংগ্রেস, এই ভাবনার অবসান আসন্ন। সমান্তরালে নকশালবাড়ি আন্দোলনের উত্তাল প্রহরে বিপ্লবপন্থীরা মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্তকে যতটা দূরে সরিয়েছে বা সন্ত্রস্ত করেছে, সিপিআইএম-এর অবস্থান ততই মধ্যবিত্তের কাছে তারিফ কুড়িয়েছে। হয়তো সংসদীয় বামে আস্থাশীল হওয়াটাই মানুষের মনে হয়েছে বেশি জরুরি। কিংবা অন্যভাবে বললে, বিপ্লব নয় তথাকথিত রিলিফ গভর্নমেন্টের প্রয়োজনীয়তাই মানুষ বেশি অনুভব করছিল। তাতে আরও ধূপের ধুনো যুগিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় আর তাঁর নব্য যুব কং বাহিনী। একদিকে নকশাল নিধনের নামে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন যা কার্যত বামপন্থীদের নিকেশ করার নীল নকশা, অন্যদিকে সেদিনের কংগ্রেসি প্রচারে ‘এশিয়ার মুক্তিসূর্য’ শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রের রাজনৈতিক দেউলেপনার অবশেষ রাষ্ট্রীয় জরুরি অবস্থা বাংলার মাটি, বাংলার বায়ুকে শুধু কলুষিতই করেনি, বাংলার অবস্থা দাঁড়িয়েছিল শ্বাসরোধী বধ্যভূমির মতো। সেখান থেকে একটুকু খোলা হাওয়ার প্রত্যাশায় বাংলার মানুষ সিপিআইএম ও বামপন্থীদের ফ্রন্টের পক্ষে ১৯৭৭-এর নির্বাচনে ব্যালট বাক্স উপচে দেন। নবযুগ আনবার শপথে বাংলার কমিউনিস্টরা নতুন কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৭৭-এ ভোটে জিতেছিল বামফ্রন্ট কিন্তু তখন তার প্রধান দলের রাজনৈতিক সচেতনতা বা মানবিক চেহারা কতটা জনমুখী ছিল তা বোঝা যায় ১৯৭৮-এ বাংলার ভয়াবহ বন্যায় এই নবোত্থিত রাজনৈতিক শক্তির ইতিবাচক অবস্থান দিয়ে। বলা যায় ১৯৭৭-এ বামফ্রন্ট শুধু ভোটে জিতেছিল আর ১৯৭৮-এর বন্যাত্রাণে বামফ্রন্ট মানুষের মন লুটে নেয়। সেইসঙ্গে একের পর এক জনমুখী রাজনৈতিক তথা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত বাংলার মানচিত্রে নতুন হাওয়া খেলিয়ে দেয়— অপারেশন বর্গা, অবৈতনিক বিদ্যালয় শিক্ষা, সফল পঞ্চায়েতি রাজের মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ইত্যাদি শুধু এক একটা প্রশাসনিক সিদ্ধান্তই ছিল না। নতুন লাল বাংলা গড়ার ভিত ছিল। আর মানুষও উপুর্যপরি নির্বাচনে উজাড় করে ভোট দিয়েছে তাদের। বাংলায় ভোট লুট, রিগিং ইত্যাকার শব্দ রাজনীতির অভিধানে বহুকালই জায়গা করে নিয়েছে কিন্তু লুটপাট করে মানুষের ন্যূনতম সমর্থন ছাড়া, নেতৃত্বের সঠিক রাজনৈতিক দিশা ছাড়া সাড়ে তিন দশক কোনো রাজ্যে সরকার চালানো সম্ভব বলে মনে হয় না।
কিন্তু প্রদীপের নিচেই যেমন অন্ধকার থাকে, তেমনি সিপিআইএম যতই আড়ে-বহরে বেড়েছে ততই সে সেই পৌরাণিক জলচর জীবটির মতো হয়েছে, যে নিজেই নিজের শরীরের অংশ ভক্ষণ করত। এক অদ্ভুত আত্মধ্বংসী দর্শনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়ে, ক্রমাগত মধ্যবিত্ততোষ সিদ্ধান্ত নিতে নিতে, সম্ভাব্য সমস্ত রকম দুর্নীতির সঙ্গে আপোষ করে, এমনকী নেতৃত্বের মাঝারি স্তরে সেই দুর্নীতিতে সরাসরি অংশগ্রহণ করে দলটি জনবিচ্ছিন্ন হতে থাকে। বাংলায় আবার দমবন্ধ পরিবেশ ফিরতে থাকে। এ যেন সেই উলটো রথের কাহিনি। কিন্তু এই আলংকারিক ভাষায় বললে হয়তো বাংলার বড়ো তরফের কমিউনিস্ট পার্টিটির রাজনৈতিক ইতিহাসের বিচারে ভুল থেকে যাবে। তাই বলা দরকার আদর্শচ্যুত হতে হতে দলটির রাজনৈতিক দর্শন বলে আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না। ছিল শুধু গ্রাস করার মানসিকতা। ছিল শিকল দিয়ে বাঁধার ক্ষমতা। মানুষ যে শিকলের নিগড় ২০১১-র নির্বাচনে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। সামাজিক পরিস্থিতি এমনই চূড়ান্ত আধিপত্যবাদী হয়ে উঠেছিল যে তার পরের নির্বাচনগুলোতেও মানুষ ব্যাপক দুর্নীতির ইস্যুকেও উপেক্ষা করছেন। বামফ্রন্টের শেষের কয়েক বছরে পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলাকীর্ণ অংশে তথাকথিত মাওবাদীদের সশস্ত্র রাজনীতির বাড়াবাড়ি, কিংবা নিবিড় শিল্পায়নের ডাকও তখন তাদের রক্ষণভাগকে আর শক্তিশালী করতে পারেনি। বাংলার শেষ কমিউনিস্ট মুখ্যমন্ত্রী তাই অনুভব করতে পারেননি শিল্পায়ন তথা উন্নয়ন আসলে সেই মানুষগুলোর সম্মতির উপর নির্ভর করে যারা এর প্রত্যক্ষ প্রভাবে জীবন যাপন করেন। বাংলার কমিউনিস্টরা ততদিনে আসলে বাংলায় এক নতুন শ্রেণির জন্ম দিয়ে ফেলেছেন, যাঁরা ভুলে গেছেন গণআন্দোলনের দিন কিংবা গ্রামে-গঞ্জে, কলে-কারখানায় ব্যরিকেড গড়ে তোলার দিন। ক্ষমতার অলীক স্বর্গে বাস করতে করতে হাঁটতে ভুলে গেছিলেন বাস্তবের রাস্তায়। যে নতুনের সাধনার প্রত্যাশায় মানুষ বারবার আস্থা রেখেছিল তাদের ওপর সেই আস্থার যথাযোগ্য মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া যায়নি। প্রথম দশ-পনেরো বছরের পর সংগ্রামের সঙ্গী বামফ্রন্ট সরকারের মুখটা কীভাবে যেন পালটে যায়। আজ বাংলার নির্বাচনী রাজনীতিতে, প্রায় পঞ্চাশ বছর পর, কমিউনিস্টদের কোনো তাৎপর্যই থাকছে না। তার দায় তো সিপিআইএম কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারবে না। গোটা দুনিয়া জুড়েই কমিউনিস্ট দর্শনের রক্তাল্পতার যুগে বাংলায় অদূর ভবিষ্যতে বামেরা আর কোনো বিকল্প রাজনীতির সন্ধান দিতে পারবে বলে মনে হয় না। যদিও রাজনীতি মহান অনিশ্চয়তার শিল্প, তবু এ কথা বলাই যায় ৩৪ বছরের প্রতিক্রিয়া এখনও মিলিয়ে যায়নি।
বাংলায় কমিউনিস্টদের উত্থান ও বিকাশ নিয়ে এত কথা বলার কারণ সদ্য হাতে আসা প্রবীণ সাংবাদিক অঞ্জন বসুর সাম্প্রতিক বই ‘বাংলায় বামেরা / রাজপথে ও রাজ্যপাটে (১৯২০-২০১১)’। প্রথমেই বলে রাখা দরকার অঞ্জন বসু বামেদের কথা বলতে বসলেও কার্যত এটি বড়ো তরফ সিপিআইএমের ইতিহাসই মূলত অনুসরণ করেছে। শুরুর দিকে অন্যান্য বাম দলগুলির কথা এলেও ক্রমশ বাম আর সিপিআইএম একাকার হয়ে গেছে। এমনকী বইয়ের প্রতিটি পাতার শীর্ষদেশে প্রকাশক গ্রন্থ নির্মাণের শৈল্পিক গুণ বাড়াতে যে ছোট্ট ছবিটি ব্যবহার করেছেন সেটিও সিপিআইএম দলের নির্বাচনী প্রতীক। যেমন বাংলার কমিউনিস্টরা ৩৪ বছর ধরে ভুলেছিলেন যে দলটির নির্বাচনী প্রতীক আর দলীয় প্রতীক এক নয়। তবে লেখককে ধন্যবাদ জানাতে হয় সমসাময়িক রাজনৈতিক বিষয়ে মতামত দিতে গিয়ে দুর্লভ পরিমিতিবোধের পরিচয় দেওয়ার জন্য। কোনো বিষয়েই তিনি নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলের অনুগামী হয়ে মতামত প্রকাশ করেননি। যে সামাজিক-রাজনৈতিক কারণে কমিউনিস্ট পার্টির প্রয়োজনীয়তা এক সময় অনুভব করা গিয়েছিল, সেই সামাজিক দ্বন্দ্বের মীমাংসা আজও হয়নি। তাই লেখক বাংলায় বামেদের রাজনীতিতে কোনো পূর্ণচ্ছেদ আনতে চান না। এটাও তাঁর বিচক্ষণতার পরিচায়ক। তবে যে নির্মোহ দৃষ্টিতে তিনি সিপিআইএম দলটির কর্মকাণ্ডের কাটাছেঁড়া করেছেন তাকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। দুনিয়ার মজদুর এক হয়নি। সব রাস্তা সমাজতন্ত্রের সড়কমুখী হয়নি। কিন্তু মানুষের বঞ্চনা, শোষণও অবলুপ্ত হয়নি। তাই বাংলায় বামেদের নতুন সমীকরণ যে আবারও কোনো দিন হবে না একথা বলাও মূর্খামি হবে।