ধুত্তোর! আবার সেই রুটি আর কুমড়োর ঘ্যাঁট। টিফিন বক্সটা খুলেই মেজাজ খিঁচড়ে গেল সায়নের। এত ভাল, দামী, খাবার গরম রাখার টিফিন বক্স কিনে দিল গত মাসে, তাতে কোথায় চাউমিন কি কিমার পোলাও থাকবে, নিদেনপক্ষে লুচি পরোটা কিছু—তা না রোজের এই রুটি আর হয় কুমড়ো নয় ফুলকপির চচ্চড়ি।
যাই, আজ বাইরে থেকেই খেয়ে আসি। এই ভেবে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল সায়ন। তিনতলায় বসে, এটুকু রোজ হেঁটেই ওঠানামা করে। আলাদা করে তো এক্সারসাইজ কিছু হয় না কাজের চাপ আর জন্মগত আলসেমি পেরিয়ে, মধ্যবয়েসের স্ফীত মধ্যপ্রদেশকে এইভাবে যেটুকু শাসনে রাখা যায় আর কি!
এই অবধি সব গতানুগতিক। সপ্তাহে নাহোক দুদিন সে এমন বাহানায় অফিসের বাইরে বসা স্টলগুলো থেকে কচুরি আলুর তরকারি, বা এগরোল কিনে খায়। চারতলায় আধখানা ছাত জুড়ে একটা ক্যান্টিন আছে বটে কিন্তু সেখানের পাঁউরুটি ঘুগনি বা সিঙাড়া খাবার সময় হল বিকেলবেলা, ধোঁয়া ওঠা চায়ের সাথে। লাঞ্চে সেসব পোষায় না সায়নের, যদিও অনেকেই খায় অফিসের। তাছাড়া আরেকটা কারণ আছে, কোলেস্টেরল বাড়ছে বলে ডিম তার বিলকুল খাওয়া বারণ, বাড়িতে দেবলীনা তো ডিম ঢুকতেই দেয় না। ফলে স্টলের এগরোল বা ডিমের অমলেটের একটা গভীর আকর্ষণ আছে সায়নের কাছে। ফল ঐ, সপ্তাহে দু তিনদিন বাইরে যাওয়া।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে, অফিস বাড়ির একতলায় পৌঁছেই কেমন একটা খটকা লাগল। বাড়িটার দোতলা তিনতলা জুড়ে তাদের অফিস। একতলায় কিছু দোকান আর পিছনদিকে গুদামঘর। ফলে সারাদিনই লোক যাতায়াত লেগেই থাকে। তার ওপর এটা টিফিন টাইম। তার মত খাদ্যরসিকরা বাইরে খেতে যায়, ধূম্ররসিকরা পান সিগারেটের জন্য বেরোয়। সব ভোঁ ভাঁ হয়ে গেল কি করে? এমনকি টুলে বসে হাই তোলা রামশরণও বেপাত্তা।
তবে বাইরে বেরিয়ে দেখল রাস্তা একদম স্বাভাবিক। ভীড়, গাড়ি ট্যাক্সি, লোকজন আসছে যাচ্ছে ছাতা ওড়না লিপস্টিক ভাসিয়ে, কেউ ওর দিকে ফিরেও চাইছে না। আর মাথা ঘামাল না সায়ন, সোজা কানুর দোকানে গিয়ে চারটে কচুরি দিতে বলে দিল।
বেশ বানায় কানু। কি বা খাস মশলা দেয়, কিন্তু স্বাদ এমন খোলতাই হয় কি করে সে কে বলবে! দেবলীনা বলে ওরা বেশি করে লঙ্কাগুঁড়ো দিয়ে টেস্ট আনে, তাই ওসব না খাওয়াই ভাল। দেবলীনার ঝাল খেলেই পেট ছাড়ে। ঘোষদা অবশ্য বলেন লঙ্কাগুঁড়ো না, ঐ যে রাস্তার ধুলো উড়ে এসে এসে পড়ে সারাদিন ধরে, ওতেই স্বাদ এত খোলতাই হয়। বাড়ির রান্না খারাপ না কিন্তু কেমন যেন পানসে লাগে সায়নের। সাদামাটা, নিরুত্তাপ—দেবলীনার নিজের মতই।
কচুরি শেষ করে পাশে বসা মাসির থেকে দুটো ডিমসেদ্ধ নিল সায়ন। নুন মরিচ ছড়িয়ে আহা, অমৃত! ডিমের নির্জীব, প্রতিরোধহীন, নরম নরম সাদাটায় কামড় বসাতে কেমন অদ্ভুত ভাল লাগে। দেবলীনার ঠোঁটগুলোও এমন নরম ভিজে ভিজে থাকে সবসময়। কেন যে এত ক্লান্ত লাগে আজকাল, উইকেন্ডে প্রেশারটা চেক করাতে হবে একবার।
খাওয়া শেষ করে, পাতা ফেলে পিছন ফিরতেই খটকাটা লাগল আবার। এইটুকু সময়ের মধ্যেই রাস্তা কখন এত ফাঁকা হয়ে গেল, কই খেয়াল হয়নি তো? এদিকের ফুটপাথে ওর বাঁদিকে সিগারেট হাতে তিনটে বাচ্চা ছেলে, আর ওপারে ওর দিকে পিছন ফিরে দাঁড়ানো এক টাটকা গোলাপি সালোয়ার কামিজে তরুণী ছাড়া কেউ নেই। কি জানি, সবাই আজ তাড়াতাড়ি ফিরে গেছে হয়তো, যা গরম!
রাস্তা ক্রস করে দরজা দিয়ে ঢোকার মুখে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল সায়ন। বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল এবার। ডিমওয়ালী মাসি তেমনি বসে আছে কিন্তু পাশের দোকানটায় কানু, রাজু, মিঠুন কেউ নেই। এরকম দোকান ছেড়ে সবাই একসাথে চলে গেল? গেলই বা কোথায়? সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছিল সায়নের, অজানা আতঙ্ক গলা চেপে ধরছিল। হুড়মুড় করে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল সে, কি জানি কোন মারাত্মক খবর এসেছে হয়তো, সবাই জানে সেই শুধু জানে না। হয়তো কোন ভয়ানক টেররিস্ট অ্যাটাক হয়েছে ধারেকাছে? কিংবা মার্কেট ক্র্যাশ করে গেছে একদম? কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ওদের চাকরি কাল থেকে নেই? কি আশ্চর্য, সবাই জানল যদি তো ওকে কেউ একবার জানাল না!
নিজের ফ্লোরে পৌঁছল যখন তখন বুকে হাপর চলছে। হাপর অবশ্য দেখেনি কখনো সে, বইয়ে পড়া কথা, ওটাই বলা দস্তুর—নইলে হয়তো বলত সাইকেলের ন্যাতানো টায়ারকে চাঙ্গা করার আপ্রাণ চেষ্টা করা পাম্পের মত চলছে বুকের কলকব্জা। সিঁড়ির মাথায় একটু দম নিয়ে, একটা শ্বাস ছেড়ে, দরজা ঠেলে ঢুকেই স্থাণু হয়ে গেল সায়ন।
ফাঁকা।
পুরো ঘর ফাঁকা। এসির মৃদুমন্দ গুনগুন ভেসে আসছে। টেবিলে টেবিলে ব্যাগ, জলের বোতল, চায়ের কাপ, সুমেধার টেবিলে চশমা, মৈত্রদার টেবিলে পানমশলার প্যাকেট।
সব আছে, কিন্তু কেউ ঘরে নেই।
এই এগারো বছরের চাকরিজীবনে ভরদুপুরে এমন ব্যাপার কখনো দেখেনি সায়ন। একবার শুধু সেই মিস্টার খান্নার হঠাৎ করে অফিসেই স্ট্রোক হয়ে পরলোকপ্রাপ্তির পর, সবাই সীট ছেড়ে গিয়ে জড়ো হয়েছিল সামনের লবিতে।
কিন্তু এরকম, শূন্য অঙ্গন, শূন্য মন্দির...
গরমে রোদ লেগে মাথা গেছে। নিজেকেই অকথ্য একটা গালাগাল দিল সায়ন। এরকম বিতিকিচ্ছিরি সময়ে কিনা কবতে কপচাচ্ছে। এই না ও দেবলীনাকে নিয়ে হাসত, "তোমরা এমন আদিখ্যেতা করো না, শালা কাপড়ে আগুন লাগলেও পদ্য বলবে!"
ফাঁকা ঘরের দুদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে ন্যাতপ্যাতে টায়ারের মতই হাত পা আলগা হয়ে এল সায়নের।
-----------------
আধ ঘন্টা ধরে গোটা অফিস তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে সায়ন। দোতলা, তিনতলা। লবি। বাথরুম। কেবিনগুলো। তারপর ছাতে এসেছে।
ছাতের ক্যান্টিনে পাখা ঘুরছে, টেবিলে টেবিলে পড়ে আছে অর্ধভুক্ত পকোড়ার প্লেট, উচ্ছিষ্ট চায়ের কাপ, সিগারেটের টুকরো। টিভিটা আপনমনে ধর্না, রাস্তার গাছ কাটা, ধর্ষণ করে খুনের মত আটপৌরে সব খবর দেখিয়ে চলেছে। কেউ দেখছে না, খাচ্ছে না, টাকা নিয়ে কুপন দিচ্ছে না। টিভিতে বিজ্ঞাপনের বিরতি, কি যেন সিনেমার গান হচ্ছে এখন, মেয়েটার দিক থেকে চোখ সরাতে পারে না সায়ন, যেন কোনভাবে একটা জ্যান্ত মানুষ দেখতে পাওয়ার মধ্যে নিশ্চিন্তি আছে, যেন এই এতগুলো লোকের ভ্যানিশ হয়ে যাওয়াটা মেয়েটার উদ্ধত বুক নাচানোর সামনে তুচ্ছ হয়ে যাবে।
ভ্যানিশ। মনে মনেও এ শব্দটা উচ্চারণ করে ফেলে দম আটকে আসতে থাকে সায়নের। অজানা বিপদের ভয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। কোন মন্ত্রবলে যেন অফিসবাড়িটা এক রাক্ষসপুরীতে পরিণত হয়েছে, আর সবাই গেছে সেই মায়ারাক্ষসদের পেটে। হুড়মুড় করে একদম একতলায় নেমে আসে সে, ব্যাগ ছাতা পড়ে থাকে তার সীটে, থাক গে। এখান থেকে আগে পালানো দরকার।
মাসির ডিমের ঝুড়ি পড়ে আছে। মাসি নেই। দুদিকে যদ্দূর চোখ যায় খাঁ খাঁ রাস্তা ফুটপাথ। প্রায় ছুটে রিকশা স্ট্যান্ড-টা অবধি চলে আসে সায়ন দত্তরায়। সারি সারি রিকশা লাইনে। না, কোন রিকশাওলা নেই।
আর কিছু ভাবার মত অবস্থা থাকে না। ভাগ্য ভাল এখান থেকে হাডকোর মোড়ে তার ফ্ল্যাট খুব দূর না। আর একদা ফুটবল-খেলা সায়ন, মধ্য ত্রিশের টাক পড়ি-পড়ি সায়ন এখনো ভালই হাঁটাহাঁটি করতে পারে।
ফ্ল্যাটের দরজায় বেলটা বেশ জোরে জোরে বাজল। এমনই বাজে, নাকি আজ ফাঁকা দুপুর বলে জোর শোনাল? দেবলীনা বোধহয় ঘুমোয় এই সময়টায়। রোগাটে শুকনো চেহারায়ও পেটে কি আর এমনি এমনি এত চর্বি জমছে! আরো দুবার পর পর বেল দেয় সায়ন অস্থির হাতে।
তাতেও দরজা খোলে না। এক ভয়ঙ্কর চিন্তায় গলা শুকিয়ে ওঠে সায়নের। এই এতটা পথ সে আর কোন মানুষ দেখেনি। পি এন বির কাছে দূর থেকে একবার মনে হল দোতলায় কোন অবাঙালি মহিলা ম্যাক্সি পরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু কাছাকাছি আসতে আসতে বারান্দা খালি। যদি ওর ফ্ল্যাটও তেমন খালি হয়ে গিয়ে থাকে? যদি দেবলীনাও অফিসের চ্যাটার্জীদা, রুচি, অভিরূপ, ক্যান্টিনের বাবুলাল, স্টলের কানু, ডিম বেচা মাসির মত গায়েব হয়ে গিয়ে থাকে?
দেবলীনার ছোট্ট টিপ পরা মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বড় বড় পাতার নিচে সেই নিরাসক্ত, বাধ্য চাউনি। টিফিন বানিয়ে গুছিয়ে দেবার পর হটকেসটা সন্তর্পণে মুছে নেওয়ার ওড়না। দরজা দিয়ে বেরোনোর সময় পাশ থেকে অভ্যাসের "সাবধানে যেও" আর হালকা ঘামের গন্ধ। লীনা। নেই?
উদ্বেগে, আতঙ্কে গলা দিয়ে হেঁচকি তোলার মত আওয়াজ বেরিয়ে আসে সায়নের।
"কী হল? অমন করছো কেন গো? এখন চলে এলে, শরীর খারাপ?"
দেবলীনা কখন দরজা খুলে সামনে দাঁড়িয়ে আছে টেরই পায়নি সে। সেই টিপ, সেই চোখ, ভেজা ভেজা, মুখে জল দিয়েছে মনে হয়, আঙুলে গত জন্মদিনে কিনে দেওয়া সোনার আংটি।
নিজের বিহ্বল দশা ঢাকতে গলায় ঝাঁঝ এসে যায়, "এতক্ষণ ধরে বেল দিচ্ছি। থাকোটা কোথায়!"
দেবলীনা বিব্রত গলায় বলে, "এই সবে সব কাজ সেরে একটু গা ধুতে গেছিলুম জানো। আজ লতা রেণুকা দুজনের কেউ কাজে আসেনি, একসাথে কামাই করলো তো, সারতে সারতে বেলা হয়ে গেল।"
দেবলীনাকে দেখে যেটুকু স্বস্তি এসেছিল সেটা উড়ে গেল আবার। লতা ওদের নিয়মিত কাজের লোক, ঘর ঝাড়া মোছা বাসন মাজা করে প্রথম থেকেই। রেণুকা এক বছর হল লেগেছে, দুজনের সংসারে দুটো লোকের কোন দরকার নেই, কিন্তু অনাথ অষ্টাদশী রেণুকা এসে এমন কাকুতিমিনতি লাগাল যে দেবলীনার মন গলে গেল। মেয়েটার মুখটা কালোর মধ্যেও এত মিষ্টি, সায়ন বিরক্ত হতে গিয়েও হতে পারেনি ঠিক। ফলে সে আসে বেলায়, কাপড়চোপড় কেচে শুকোতে দেয়, ছাতে দেবলীনার শখের টবে জল দেয়, বাথরুম বেসিন আয়না সাফ করে। বাড়তি মাইনেটা এখনো দিতে গায়ে লাগে।
"কেউই কাজে আসেনি?"
দেবলীনা জানায়, শুধু দুই লোকই নয়, আজ বেলায় মাছওলা নারায়ণও আসেনি, এমনকি প্রতি বুধবার যে ধূপ বিক্রি মাসীমা আসেন তিনিও নাকি আসেননি।
"তুমি বেরোনোর পর থেকে আর মানুষের মুখই দেখিনি যেন।" তার মত করে রসিকতা করার চেষ্টা করে দেবলীনা।
নিজের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা একটা গলায় সাপের মত হিস হিস করে ওঠে সায়ন, "মানুষ থাকলে তো দেখবে!"
-------
বেলা পড়ে এসেছে। বহুকাল বাদে এই ছাতে এল ওরা দুজন একসাথে। ফ্ল্যাটবাড়ির ছাত যেমন হয়। টপ ফ্লোরের লোকেরাই মূলত ব্যবহার করে। একধারে দেবলীনার শখের গাছপালা, জুঁই, জবা, নয়নতারা, মানিপ্ল্যান্ট। তারে ওদের সামনের ফ্ল্যাটের মল্লিকবাবুর সাদা পাঞ্জাবি পাজামা। একপাশে দোতলার তাতানের ট্রাইসাইকেল। জলের ট্যাঙ্কের পাশে ধাপি, বসা যায়।
সায়ন বসে। দেবলীনা বসে না। মেয়েটা কেমন বজ্রাহত হয়ে আছে। ওরা দুজনে এতক্ষণ গোটা ফ্ল্যাটবাড়িতে ঘুরে ঘুরে খুঁজেছে কোন তৃতীয় মানুষ। শুধু ফ্ল্যাটে কেন, বেরিয়ে রাস্তায় ঘুরেছে, কাছের পার্কে গেছে, এমনকি পাশের ফ্ল্যাটবাড়িগুলোও ঘুরে এসেছে। পায়নি। জনশূন্য এক অপার্থিব শহরে ওরা দুজন কোন মন্ত্রবলে বেঁচে গেছে কে জানে! দেবলীনা ওর অফিসের অভিজ্ঞতা শুনেই বাক্যিহারা হয়ে গেছিল, তারপর খোঁজার ব্যাকুলতাটা ওর যেন সায়নের থেকেও বেশি হয়ে উঠেছিল। সায়নের মায়া হচ্ছিল ওর স্তব্ধ পাথর মুখ দেখে।
"কি ম্যাজিক হল বল দিকি! ভয় পাচ্ছ?"
দেবলীনা নড়ে ওঠে। ঠোঁট ফাঁক হয় কিন্তু কথা বের হয় না। সেই ভেজা ভেজা ঠোঁট ফাঁক হতে দেখে সায়ন দুর্জ্ঞেয় এক সাহস ফিরে পেতে থাকে।
"ভাবো তো, হয়তো গোটা পৃথিবীই সাফ হয়ে গেছে। আছি খালি তুমি আর আমি...আদম আর ইভের মত?"
দেবলীনা ঘুরে দাঁড়িয়ে ডুবন্ত সূর্যের দিকে চেয়ে থাকে। এই আলোকেই কি কনে-দেখা-আলো বলে?
সায়ন উঠে দেবলীনার পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। তার নিজেকে সত্যিই আদিম পুরুষ মনে হতে থাকে, যার ওপর দায়িত্ব মানুষের প্রজাতি দিক দিগন্তে ছড়িয়ে দেবার। এমন তীব্র সে একমেবাদ্বিতীয়ম অনুভূতি যে সে ভয় পেতেও ভুলে যায়, ভুলে যায় মানবসভ্যতা তারই মত মাঝবয়েসী ছিল এই দুপুর অবধি।
দেবলীনার শরীরে সেই ঘামের গন্ধ। কিছু ছোট চুল ক্লিপ ছাড়িয়ে হাওয়ায় এলোমেলো ওড়ে। দেবলীনা একবারও মুখ ফেরাচ্ছে না।
"লীনা? আজ, খোলা আকাশের নীচে? কেউ নেই আমাদের দেখার, দেখো?"
দেবলীনা দু পা সরে যায়। তার পিঠ কেমন কাঁপছে, ঠোঁটদুটি এত চাপা পরস্পরের সঙ্গে যে একটাই ঠোঁট মনে হয়। আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়িয়ে সায়নের মুখোমুখি হয় সে।
খুব ধীর, চাপা কিন্তু স্পষ্ট কাটা কাটা গলায় বলে, "হ্যাঁ। তুমি ছাড়া আর কেউ নেই। কেউ দেখতে আসবে না, কেউ কিছু বলতে আসবে না।"
একটু থেমে, দেবলীনা বলে, "এবার, যেতে পারব।"
সূর্য ডুবছে তখন। লাল আভায় জ্বলজ্বলে আলোয় দেবলীনার তীব্র আবেগমথিত, উল্লসিত, দীপ্ত মুখের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে সায়ন বোঝে, এই তার অপরিবর্তনীয় জীবন পালটে যাবার অলঙ্ঘ্য মুহূর্ত। দেবলীনা তাকে ছেড়ে চলে যাবে এবার। আদিম কেন, সে পৃথিবীর শেষ পুরুষ হলেও দেবলীনা তাকে ছেড়ে চলে যাবে অবলীলায়।
দেবলীনাও বোঝে যে সে অবশেষে বলতে পেরেছে। অবশেষে, এতদিন পর, সেই প্রত্যয়। অদ্ভুত সুখী এক হাসি তার মুখে ফুটে ওঠে। শেষ রবিকিরণটুকু চুলে পিঠে মেখে নিতে নিতে সে ছাতের দরজার দিকে দৃঢ়ভাবে পা বাড়ায়।