• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭২ | সেপ্টেম্বর ২০১৮ | গল্প
    Share
  • টুপিওয়ালা : ইন্দ্রনীল বক্সী


    ।। ১ ।।

    বাসস্ট্যান্ডের একটু আগেই নেমে পড়াটাই অভ্যাস সুদীপ্তর, আজও তাই করল সে। তফাতের মধ্যে আজকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই একটা হলুদ শাড়ি পরা বছর পঁচিশ—ছাব্বিশের মহিলাও বাস থেকে নেমে এল পিছু পিছু। এটা কিছুটা নতুন ঘটনা বলা যায়। কারণ রোজকার রুটিনে এই বাস থেকে এই সময় মোটামুটি এখানে শুধু ওই নামে। ‘এই যে শুনছেন ...’ সুদীপ্তর কান সতর্ক হল, ওকেই ডাকল মনে হচ্ছে যে ওই হলুদ শাড়ি মহিলা! আলতো করে ঘাড় ঘোরাতেই দেখল মহিলা হাঁফাতে হাঁফাতে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। সুদীপ্ত দাঁড়িয়ে পড়ল। “আচ্ছা একটা ঠিকানা একটু বলে দিতে পারবেন ... মানে আপনি এখানেই থাকেন কি? তাহলে...” মহিলা একটি রুল টানা কাগজের টুকরো বাড়িয়ে দেয়।

    J B MITRA LANE, BURIBAGAN
    NEAR BAKULTALA KALI MANDIR

    খুব অচেনা ঠেকল না সুদীপ্তর, ও যেদিকে যাবে তার উলটো দিকের রাস্তায় কিছুটা যেতে হবে, হেঁটেই যাওয়া যাবে বুঝিয়ে দিতে মহিলা হন্তদন্ত হয়ে হাঁটা দিল সেইদিকে। কোন ধন্যবাদ—টাদের বালাই না দেখে সুদীপ্ত কিঞ্চিৎ বিরক্ত হল। নিশ্চয়ই মহিলা খুব উদ্বেগে আছেন ভেবে নিতে একটু স্বস্তি—বোধ করল। দূরে রাস্তার বাঁকে অদৃশ্য হতে দেখল মহিলাকে, হলুদ রঙ অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায়। এই ভরদুপুরে এরকম চড়া রঙের শাড়ি কেউ পরে!

    রোদ মাথায় চড়ে বসেছে, কপালটা চিড়বিড় করছে। ছাতা নিয়ে চলাফেরা করা অনেকদিন ছেড়েছে সুদীপ্ত, লাগাতার তিন তিনখানা ছাতা হারিয়ে ও সংকল্প করেছে আর ছাতা নেবে না। এদিকে দুদিন ধরে টুপিটাও ছাই খুঁজে পাচ্ছে না। কোথায় রেখেছে নাকি হারিয়েছে মনে করতে পারছেনা। আবার একটা টুপি কিনতে হবে ওকে! পৌরসভার অফিসের মোড়ের কাছে পৌঁছতেই বাঁদিকের ফুটপাতে মুরগীর দোকানের পাশেই দূর থেকে দেখতে পেল লাল, নীল, কালো, সাদা, চেক চেক ...হরেক নকশার রঙের সমাবেশ, সারি সারি টুপি সাজিয়ে একটা টুলে বসে ঝিমুচ্ছে একটা লোক। এমন নয় যে সুদীপ্ত দোকানটা এর আগে দেখেনি বা এই লোকটাকে চেনে না, যাওয়া আসার পথেই পড়ে দোকানটা। তবে এর আগে কোনদিন এই লোকটার কাছে টুপি কেনেনি। “বলুন স্যার” —টুপিওয়ালা লোকটা সুদীপ্তকে ইতিউতি টুপির দিকে তাকাতে দেখে টুল থেকে নেমে এসে দাঁড়িয়েছে। রোগাটে সাধারণ চেহারার বছর ৩০-৩২ এর, সাধারণ পরিচিত মুখ, এরকম মুখ অজস্র থাকে ভিড়ের মধ্যে –যাদের আলাদা করে মনে রাখা যায় না, সেরকমই একটা...

    —“না ...এই দেখছি ... সব সুতির?”

    —“সুতিরও আছে তবে সব নয় ...কিছু মিক্স রয়েছে স্যার ...পিওর সুতি টেঁকে কম।”

    —“ও ...কিন্তু সুতির মাল গরম কম হয় যে! তাই না?”

    —“সেটা স্যার ঠিকই বলেছেন, তবে আমার কাছে স্যার ভ্যারাইটিস মাল রয়েছে ... এই দেখুন ...এ...এইটা ভেতরে সোয়েট দেওয়া, বেশ টেঁকসই ...রণবীর ক্যাপ” বলে লোকটা হেসে একটা চেক টুপি সুদীপ্তর দিকে বাড়িয়ে দিল। ...সুদীপ্ত লক্ষ্য করল লোকটার একটা দাঁত ধাতব, দুপুরের রোদে কেমন ঝিলিক দিয়ে উঠল।

    —“ধুর ...এটা তো দেবানন্দ ক্যাপ! ...কি রণবীর রণবীর বলছ ...

    —“স্যার ঠিকই বলেছেন ... তবে এটা একটু আলাদা ... আর এটার নাম এখন রণবীর ক্যাপ ... ওই নামেই বিক্রি হয় ... কাস্টমার ওই নামেই চায় ...” আবার এক চোট হাসল টুপিওয়ালা লোকটা ... আচ্ছা ধাতুর দাঁতটা কি সোনার! ...নাকি রুপোর? একটা হলদেটে ছাপ আছে বটে! ...

    —“আর এই হলুদ টুপিটা!”

    —“এটাও স্যার গুড চয়েস ...গলফ ক্যাপ, খুব চালু মাল ...ইচ্ছে মতো ছোট—বড় করতে পারবেন।

    —“ছোট—বড় করে আর কি হবে রোদ আটকাবে কতটা সেটাই আসল ...”

    —“কি যে বলেন স্যার! ...রোদ কি আটকানো যায়! মাথা ঢাকা যায় বলতে পারেন ... তবে স্যার আপনার দিন খারাপ যাবে না একদম ...গেরান্টি ...টুপির দিব্যি ...” সুদীপ্ত একচোট মুচকি হেসে ফেলল, সেলস টকের উত্তম নমুনা – ‘টুপি কিনুন দিন বদলান’, মনে মনে ক্যাপশনটাও আওড়ে নিলো।

    —স্যার হাসছেন! ...মিলিয়ে দেখে নেবেন স্যার ... এই বেকার ভাইটার কথা ...

    —আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে ...এবার বলো কত দক্ষিণা?

    —আপনার জন্য স্যার ৬০...৭০ এর নিচে বেচি না ...

    —ধুস ৫০...

    —হবে না স্যার ...টুপির দিব্যি লস হয়ে যাবে ...

    ৬০-টাকায় আজকাল আর কি হয় তবু ফুটপাতে দর করতে হয় তাই সুদীপ্ত ৫০ বললো। ৬০-টাকায় টুপিটা বেশ একটা খারাপ হয়নি বলেই মনে হচ্ছে! একটু হাল্কার দিকে হলুদ রঙ, সামনে শুধু নাইকির সেই বিখ্যাত ‘রাইট’ চিহ্নের মতো একটা নকশা ...ব্যাস। বেশি হাবিজাবি ভালও লাগে না, এই বেশ।

    মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠেছে এখন। রোদ মরে এসেছে, তবুও এই পশ্চিমা তেরছা রোদ বড্ড মুখে চোখে লাগে। সুদীপ্ত টুপিটা একটু ঘুরিয়ে নামিয়ে নেয় শেডটা। ছটা কালেকশানের চারটেতে গিয়ে দাঁড়াতেই পেমেন্ট দিয়ে দিল! অন্যদিন কত গল্প করবে হ্যাজানীর, চা খাওয়াবে তারপর বলবে “ভাই আজ পাঁচশো জমা করো পরশু এসো একবারটি ...” আজ তাজ্জব ব্যাপার! যেন রেডিই ছিলো ... কুণ্ডু ব্রাদার্সে গিয়ে দাঁড়াতেই বড় কুণ্ডু শুধু একবার চশমার উপর দিয়ে দেখে নিলো তারপর কেমন তেল না পড়া কবজার মতো স্বরে বলে উঠলো “এই মাখন ... দাদাকে ছেড়ে দে ...” লোকটার গলাটা কেমন অদ্ভুত! আর এত সিনিয়ার লোকটা ওকে কেন ‘দাদা’ বলে এটা ভেবে পায় না সুদীপ্ত।

    বাকি তিনটেতেও বেশি বেগ পেতে হলো না পেমেন্ট তুলতে। একদম আপ টু ডেট! সুদীপ্তর বিশ্বাসই হচ্ছে না! আজ ফেরার পথে নটরাজে দু পেগ গলা ভেজাবেই ...একটু রাত করে ফিরলে অসুবিধা নেই, কালেকশানে বেরলে ওর অফিসে রিপোর্ট করা বাধ্যতামূলক নয়, মা—ও ওদিকে রাত হলে রাতের খাবার ওর ঘরে ঢাকা দিয়ে রেখে শুয়ে পড়ে। লোক বলতে তো বাড়িতে দুটো প্রাণী, ও আর মা।

    এই সময়েও নটরাজে বেশ ভিড়। কোণার দিকে একটা টেবল দেখে গ্যাঞ্জাম থেকে দূরে বসেছে সুদীপ্ত। প্রথম পেগের তলানিটা গ্লাসে নাড়তে নাড়তে একটা ফিঙ্গার চিপসে কামড় দেয়, বেশ একটা হাল্কা আমেজ আসতে শুরু করেছে, খুব জোরাল মদ্যপায়ী ও নয়, মাঝে মধ্যে খায় তাই অল্পই কোটা। একদম নিজস্ব বিলাসিতায় মাঝে মধ্যে নিজের সঙ্গে এরকম সময় কাটানো ওর একটা অভ্যাস। দ্বিতীয় পেগটাও নামিয়ে দিয়ে গেছে ওয়েটার, ওতে প্রয়োজন মতো সোডা জল ঢেলে চুমুক দেয় ও। বেশ একটা সুখি সুখি ভাব আসছে ওর, হঠাৎ করে সকালের সেই বাস থেকে নামা হলুদ শাড়ি পরা মহিলাটির কথা কেন জানি মনে পড়ে গেল ওর। খুব অল্পক্ষণ দেখেছে, তাও যতটা মনে পড়ছে বেশ মন্দ নয় চেহারা! দোহারা গড়ন, হাইট মাঝারি, রঙ মাজা। মনে পড়তেই অকারণে একটা ভালোলাগা ছড়িয়ে গেল শরীরে—–মনে। আপনমনে সামনে টেবলে খুলে রাখা ওর হলুদ টুপিটা নাড়াচাড়া করতে লাগল। আপন মনে হেসে ফেললো সুদীপ্ত, কি আশ্চর্য! আজ ওকে হলুদে পেয়েছে! হলুদ শাড়ি, হলুদ টুপি ...গ্লাসের পানীয়টাও হলুদ...


    ।। ২ ।।

    বেশ বেলা হয়ে গেল আজকে ঘুম থেকে উঠতে। কোই বাত নেহি ... সুদীপ্তর এমনিতে কোনো ডিউটি আওয়ার নেই নিয়মমাফিক। মালের অর্ডার আর কালেকশান ঠিকঠাক দিলেই কোম্পানি খুশ! সে বাড়িতে বসে করছে না বারে বসে, কোম্পানি জানতেও চাইবে না। মাথাটা কি একটু ভারি লাগছে! কাল একটু বেশিই টানা হয়ে গেছে। টেবলে নজর পড়তেই দেখল খাবার যেমনকার তেমনই ঢাকা পড়ে আছে। এই মরেছে! মা আসার আগে এগুলোর ব্যবস্থা করতে হবে নইলে গুচ্ছের প্রশ্নের সামনে পড়তে হবে ওকে। বিছানায় উঠে বসে ধারের জানালাটার ভেজানো অর্ধেক পাল্লাটা খুলে দিল সুদীপ্ত, একটা লম্বাটে রোদ অমনি এসে গড়িয়ে পড়লো বিছানার উপর। বেশ ঝলমলে দিন, আজকে বছরের কততম দিন ভাববার চেষ্টা করলো ১৮৯! ১৯২... নাকি ২২৫... ধুস মাথাটা পরিষ্কার হওয়া দরকার, এক কাপ চা দরকার। হঠাৎ বছরে কততম দিন মনে করার কারণ নিয়ে ভাবতে থাকল সুদীপ্ত ...এমন সময় দরজায় মায়ের শব্দ ...

    —“উঠেছিস! বাব্বা! বলিহারি ঘুম তোর, দুবার ঘুরে গেছি আগে ...”

    —“হ্যাঁ একটু দেরি হয়ে গেল ...”

    —“চা নে। ঠাণ্ডা করিস না ...আমি আর গরম করতে পারবো না বলে দিলাম।” চায়ের কাপটা টেবলে নামাতে নামতে খাটের নিচে রাতের খাবারের বাসি থালাটা আড়চোখে একবার দেখে নিল মা। খুব জোর খাবারগুলো জানালা দিয়ে নালার পাশে ফেলেছে সময় মতো! নাহলে ...এতক্ষণে লাল—সাদা নেড়িটা সাবাড় করে দিয়েছে নির্ঘাত! ... নিঃশব্দে মা থালাগুলো তুলে নিয়ে চলে গেল। মায়ের সঙ্গে আজকাল কথা বিশেষ হয়ই না! ওই বাজারের কথা, বাড়ি ভাড়ার কথা, এইসব নিয়ে আজকাল কথা হয়। এমনি বসে গল্প কবে শেষবার করেছে সুদীপ্ত মায়ের সঙ্গে – মনে করতে পারে না।

    যতই দেরি করে উঠুক রেডি হতে সুদীপ্তর সময় বেশি লাগে না। চটপট বাথরুমের কাজ মিটিয়ে ঘরে এসে বসে, কালকের বাসি পেপারটা নিয়ে চোখ বোলাতে থাকে। অফিস থেকে আসার সময় ও প্রায়ই অফিসের পেপারটা নিয়ে আসে। একটা রিয়েল এস্টেট কোম্পানি বিশাল বিজ্ঞাপন দিয়েছে পাতা জুড়ে। মাত্র ১২ লাখে টু বি এইচ কে ফ্ল্যাট! নিচে নম্বর দেওয়া। সুন্দর এনিমেটেড ছবি ফ্ল্যাটের – মানে এরকম হবে আর কি! বিজ্ঞাপনটা খুঁটিয়ে দেখে সুদীপ্ত, এটা ওর অভ্যাস, ভালো লাগে। আরও কিছু মিছিল মিটিং, মন্ত্রীর বিদেশ সফর, খুন, ধর্ষণের খবর পেরিয়ে নজর পড়ে জ্যোতিষের পাতায়। চট করে দেখে নেয়, ওর মেষ রাশি ...

    বাইরে বেশ রোদ বেরিয়েছে। রোদ দেখেই টুপির কথা মনে পড়লো সুদীপ্তর ...টুপিটা! ব্যাগেই ঢুকিয়েছিলো যতদূর মনে পড়ছে, নাকি ফেলে এলো নটরাজে! যা: ... না: হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে পেলো না, মাত্র কালকেই কেনা ওর হলুদ টুপিটা ...ইস! বেশ মায়া পড়ে গেছিল টুপিটার উপর একদিনেই। কাল দিনটাও বেশ ভালোই গেছে ওর ...মনটা খারাপ হয়ে গেল হলুদ টুপিটার জন্য সুদীপ্তর।

    বাস ধরে সোজা অফিসে গিয়ে নামলো সুদীপ্ত। কালকের ক্যাশ জমা দিতে হবে আগে, অতগুলো টাকা বেকার বয়ে বেড়ানো ঝুঁকির। অফিসে ঢুকতেই বাঁ দিকের ডেস্কে বসে থাকা রিসেপশানের বর্ণালী চোখ নাচিয়ে বলে উঠল--

    --“সুদীপ্তদা আপনাকে স্যার এলেই দেখা করতে বলেছে...সোজা কেবিনে চলে যান।” বেশ ঝলমল করছে বর্ণালী যেন আজকে। অথচ রোজই তো সুদীপ্ত দেখে ওকে! আজ ... সকালটা বেশ ঝলমলে হয়তো সেই জন্যই! সমুদ্রনীল রঙের একটা টিপ পরেছে বর্ণালী ...

    কেবিনের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই একটা মিষ্টি গন্ধ নাকে এলো, বেশ ঠান্ডা ঘরটা। সকাল থেকেই এ.সি. চালিয়ে রাখা সামন্তবাবুর, মানে ওদের বসের অভ্যাস। একটু ভারি চেহারা, গরম একদম নিতে পারেন না উনি।

    --“আরে! সুদীপ্ত যে! বোসো ...কথা আছে ...” একবার মাথা তুলে সুদীপ্তকে দেখেই বললেন সামন্তবাবু, বলেই আবার সামনে রাখা ল্যাপটপের পর্দায় মনোনিবেশ করলেন।

    এ তো বেশ মুশকিলে পড়া গেল! কি দরকারে ডেকেছে না জানা অবধি সুদীপ্তর পেট গুড় গুড় করবে। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল, এবার ল্যাপটপটা নামিয়ে সোজা তাকালো সামন্তবাবু সুদীপ্তর দিকে ...

    —“বলছি সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে সারা মাসে গোটা দশেক অর্ডার আর লাখ খানেক কালেকশান আনলেই চলবে! ... নাকি আরও একটু এগোবার ইচ্ছে রয়েছে?” কেমন একটা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কথাগুলো বললেন সামন্তবাবু। সুদীপ্ত নানা সওয়াল-জবাবের মহড়া দিচ্ছিল এতক্ষণ মনে মনে, সম্ভাব্য যা কিছু কথা বলতে পারেন সামন্ত-স্যার ... কিন্তু এরকম একটা প্রশ্ন ওর সিলেবাসে ছিলো না। একটু অবাক হয়েই সামন্ত-স্যারের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, কথাটার তাৎপর্য বা গূঢ় অর্থ কি হতে পারে – এটা বোঝার চেষ্টায়। শেষে একটা কিছু উত্তর দিতেই হয় এমন করে বললো—

    —“সে স্যার এগোবার আর কার না ইচ্ছে থাকে! তবে ইচ্ছে থাকলেই কি আর ...” বেশি কথা বলা ঠিক হবে না, কে জানে ব্যাটা ঘাঘু সামন্ত—স্যার মনে মনে আর এক প্রস্থ টার্গেট বাড়ানোর ফন্দিতে রয়েছেন! ভাবতে থাকে সুদীপ্ত ... “হুম ... তা কোম্পানী তোমায় সে সুযোগ দিতে ইচ্ছুক। এখন তুমি কি করবে সেটা তোমার ব্যাপার; কোম্পানি তোমায় সিনিয়র সেলস সুপারভাইজার হিসেবে দেখতে চায়...” এতক্ষণে যেন সামন্ত-স্যারের চৌকো মুখটায় একটা হাল্কা হাসির রেখা খেলে যায়। সুদীপ্ত বেশ উত্তেজনা অনুভব করে ভিতর থেকে, কোনরকমে সেটা নিয়ন্ত্রণ করে সোজা হয়ে বসে—

    —“অনেক ধন্যবাদ স্যার, কিন্তু এরিয়া কি থাকবে?” এমন ভালো খবরটা শোনার সঙ্গে অনেকগুলো বাস্তবিক চিন্তাও মাথায় চলে এসেছিলো পিছু পিছু সুদীপ্তর।

    —“সেম, তবে সঙ্গে জুড়বে পানাগড়, দুর্গাপুর, আসানসোল। কি, রাজি?”

    —“ঠিক আছে স্যার ... এদিকটা আমি সামলে নেবো ...”

    খুব সাবধানে উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ করে সামন্ত-স্যারের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সুদীপ্ত। উচ্ছ্বাসের ঢেউ ভিতরে উঠছে, কিন্তু তার প্রবল প্রকাশ চলবে না —– এটাই পেশাদারি সহবত। বেরিয়ে একবার মনে হলো রিসেপশানের বর্ণালীকে জোরালো একটা চুমু খায়! ...আহা ...ওই তো বললো সামন্ত-স্যার ডাকছে! ... সুদীপ্ত জানে বাস্তবে সম্ভব নয় তা, তবু এগিয়ে গেল ...পকেট থেকে একটা হ্যাপিডেন্ট চিউংগাম বের করে বর্ণালীর দিকে বাড়িয়ে দিল হাসিমুখে।

    —“এই নাও বর্ণালী। তুমি জানো কিনা জানিনা, তোমার দাঁতগুলো খুব সুন্দর ... এগুলো চিবিও আরও সুন্দর থাকবে ...”

    —“কি ব্যাপার সুদীপ্ত দা! ভালো খবর আছে মনে হচ্ছে!” অবাক বর্ণালী সমুদ্রনীল টিপ মাঝখানে রেখে ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো ...

    আঃ। বেশ ফুরফুরে লাগছে সুদীপ্তর আজকে। চার বছরের পরিশ্রম, সততার ফল বলা যায়। প্রোমোশন! মাইনে কত বাড়বে সেটা নিশ্চিত নয়, তবে টিএ–ডিএ এক লাফে অনেকটা বাড়বে নিশ্চিত। একটা সেলিব্রেশান দরকার, নিজের সঙ্গে নিজের। ডানদিকের ফুটপাতের কিছুটা গিয়েই শহরের এক নম্বর সরবত–লস্যির দোকানে এসে দাঁড়ায় সুদীপ্ত। একটা বড় গ্লাস লস্যিতে চুমুক দিতে দিতে মনে করার চেষ্টা করে কবে শেষ লস্যি খেয়েছিল।

    বেশ যাচ্ছে কাল থেকে! এমন ভালো ভালো ঘটনা পর পর! এলোমেলো চিন্তার মধ্যে ওর আবার হলুদ টুপিটার কথা মনে পড়ে গেল! মন একটু দমে গেল। ওটাই ওর লাকি টুপি ...ব্যাটা টুপিওয়ালাটা বলেছিল বটে! টুপির কথা মনে পড়তেই রোদের তেজও অনুভূত হতে লাগল, এতক্ষণ উত্তেজনায় টের পায়নি। না: একবার যাওয়া দরকার টুপিওয়ালাটার কাছে! কেমন জানি আপনা থেকেই মনে হলো সুদীপ্তর, একটা টুপি ওর দরকার ...খুবই।


    ।। ৩ ।।

    “চিনতে পারছেন?” বেশ একটা মিহি গলা পাশ থেকে ওকে উদ্দেশ্য করেই বেজে উঠলো কিনা দেখবার জন্য ঘাড় ফেরাতেই দেখলো বাসে ঠিক সুদীপ্ত যেখানে দাঁড়িয়ে তার একটা সিট পরেই কালকের সেই হলুদ—শাড়ি মহিলাটি আজ একটা নীলরঙের চুড়িদার পরে দাঁড়িয়ে।

    —“হ্যাঁ ...নিশ্চয়ই, তা কাল কাজ মিটল, খুঁজে পেয়েছিলেন?”

    —“হ্যাঁ, পেয়েছিলাম। আপনি না বলে দিলে খুব সমস্যায় পড়তাম। কাল আপনাকে থ্যাংকস জানানো হয়নি বলে বেশ খারাপ লাগছিলো; যাইহোক, থ্যাংক ইউ।” এতগুলো কথার সঙ্গে মহিলা এক ঝলক হাসি ভাসিয়ে দিল সুদীপ্তর দিকে। সুদীপ্ত একটু মনে মনে তৃপ্ত হলো না এমন নয়, তবু মুখে বললো—

    —“আরে না না ...এ আর এমন কি।”

    আরও কিছুক্ষণ দুজনের খুচরো কথাবার্তা চলতে লাগল, এই যেমন –— আজ খুব রোদ, বাসটা যেন এগোতেই চাইছে না! ...এরকম। দুজনে একই স্টপেজে নামবে এটাও জেনে দুজনেই বেশ অবাক হলো। স্টপেজ আসতে আবার একে একে নেমে এলো দুজনে।

    “ওকে; আমি এগোই ...” বলে এগিয়ে গেলো সুদীপ্ত। কিছুটা যেতেই দূর থেকে ডাক শুনতে পেলো--

    —“দাদা শুনছেন ...এই যে ...আমি ...” হাঁফাতে হাঁফাতে এগিয়ে এলো সেই বাসের মহিলা, নীল চুড়িদার ...

    —“কি ব্যাপার? ... আজও কি ঠিকানা বলে দিতে হবে নাকি!” সকৌতুকে তাকিয়ে বললো সুদীপ্ত।

    —“একদম ঠিক ধরেছেন, আমি যেতে গিয়ে ভাবলাম আজকেও আপনাকেই যদি জিজ্ঞেস করি ...তাই ...” একটা কাগজ বাড়িয়ে দিলো মহিলাটি।

    ১৬ সি পার্কাস রোড, নিয়ার মসজিদ

    “হাঁটতে হবে, পেরিয়ে এসে নেমেছেন, আগেরটা পার্কসার্কাস রোড-মোড়”

    —“যা: ...আবার হাঁটা এই রোদে!” মহিলা একটু দমে গেল। কানের পাশ দিয়ে স্বচ্ছ ঘামের ধারা নামছে গলা বেয়ে গড়িয়ে, ঘামের ধারা হারিয়ে যাচ্ছে নীল কামিজের ভিতরে। কলার বোন স্পষ্ট, কানে একটা ছোট্ট বিন্দুর মতো চিক চিক করছে কানের গয়না, সামান্য হলেও সম্ভবত সোনার। কিন্তু কানে ওটা কি গোঁজা! দেখে তো হিয়ারিং এইড মনে হচ্ছে!

    —“একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? আপনি রোজ রোজ এত ঠিকানা খোঁজেন কেন?” শেষপর্যন্ত কৌতূহল সংবরণ করতে পারে না সুদীপ্ত। মহিলা এক চোট হেসে ওঠে—

    —“আমার যে ঠিকানা খোঁজাই কাজ! আমি কুরিয়ারে সার্ভিস করি ...”

    —“আশ্চর্য! তাই? ...আমি ডেলিভারি বয় শুনেছি, ডেলিভারি গার্ল ...ইয়ে মানে লেডি ...বেশ বেশ।”

    —“যাক তাহলে একজনকে প্রথম দেখলেন তো? যাক আসি, আবার থ্যাংক ইউ ...” নীল সালোয়ার হাঁটতে লাগল। সুদীপ্ত একটু অবাকই হলো, সত্যিই ও মহিলা পিওন কোনোদিন দেখেনি। সেও হাঁটতে লাগল নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। থ্যাংক ইউ-টা ডিঊ থাকলে কি এমন দোষের হতো! ভাবতে ভাবতে খান্নামার্কেটের গলি দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলো।

    কাজ গুটিয়ে যখন সুদীপ্ত ওর পরিকল্পনা অনুযায়ী টুপিওয়ালার কাছাকাছি ফুটপাতে এলো তখন বেলা বেশ গড়িয়েছে। দূর থেকে টুপিওয়ালা ওকে ঠিক দেখতে পেয়েছে, বেশ কেমন একটা রহস্য রহস্য হাসি ঝুলিয়ে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে।

    —“কি স্যার কি খবর! এদিকে কোথায়?”

    —“খবর ভাল, বেশ ভাল বলতে হয় ...”

    —“জানতাম ... কি! বলেছিলাম না? দেখলেন তো! ...”

    —“একদম। বেশ মজার কিন্তু! ...কি অদ্ভুত কটা ভালো ভালো ঘটনা ঘটে গেল পর পর। শুধু একটাই বাজে ব্যাপার হয়েছে ...” এতদূর বলে সুদীপ্ত একটু নিভে এলো।

    —“কি ব্যাপার স্যার? কারো অসুখ-বিসুখ নাকি! ...”

    —“আরে না না ...তোমার দেওয়া টুপিটা ছাই হারিয়ে ফেলেছি আবার এর মধ্যে ...”

    —“যা:! তাই নাকি! ওক্কে নো প্রবলেম, আর একটা নিয়ে নিন, ভালো স্টক তুলেছি কাল।”

    —“সে তো বুঝলাম। কিন্তু ওটার উপর যে মায়া পড়ে গেছিল! তাছাড়া ওটার মতো লাকি যদি না হয়!”

    —“সিওর হবে স্যার। এই বেকার ভাইয়ের কাছ থেকে নেওয়া টুপি আপনার লাকি হবেই হবে। কোনটা দেব বলুন?”

    —“ওই আগেরটার মতোই দাও। গলফ, হলুদ ...

    —“না: স্যার ও মাল আর নেই যে!”

    —“যা:; তাহলে! তুমিই একটা বেছে দাও না হয়।” একটু দমে গিয়েই বললো সুদীপ্ত। টুপিওয়ালা লোকটা দ্রুত একটা লম্বা লাঠি দিয়ে উপরের দিকে ঝোলানো একটা টুপি নামিয়ে আনলো – উজ্জ্বল নীল রঙের। টুপিটা সুদীপ্তর হাতে দিয়ে চওড়া একটা হাসি ফুটে উঠলো টুপিওয়ালার মুখে।

    —“বুলু স্যার, ট্যুরিস্ট ক্যাপ। এটাই আপনার আজকের লাকি ক্যাপ স্যার ...নিশ্চিন্তে নিয়ে যান।”

    সুদীপ্ত বেশ অবাক হলো মনে মনে, সারাদিনের রিপ্লে হলো মুহূর্তে ওর মাথার ভিতরকার পর্দায়। ছেঁড়া ছেঁড়া দৃশ্যে উঠে আসতে লাগল—রিশেপসান, টিপ, সামন্ত—স্যারের জামা, নীল চুড়িদারে সেই মহিলা...! আঃ, আজ সত্যিই তো এই রঙটাই ওকে ঘিরে রেখেছে, ফিরে ফিরে আসছে নানা ভাবে! নিঃশব্দে হাত বাড়িয়ে টুপিটা নেয় সুদীপ্ত, নেড়েচেড়ে দ্যাখে, যন্ত্রচালিতের মতো পার্স বের করে পয়সা মেটায়। একটা ঘোরের মধ্যে ফুটপাথ বেয়ে এগিয়ে যায়। পিছনে টুপিওয়ালার গলা যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসা ধ্বনির মতো মনে হয়, মনে হয় টুপিওয়ালা পাড়ে দাঁড়িয়ে কি যেন বলছে আর ও ডুব সাঁতারে জলের ভিতর ... “ভালো থাকবেন স্যার ... এটাই স্যার আপনার লাকি টুপি ...মিলিয়ে নেবেন ...আবার আসবেন স্যার...”


    ।। ৪ ।।

    প্রমোশন মানে বাঁশ – এটা সুদীপ্ত শুনেছিলো শুধু এতদিন, এখন সত্যিই শারীরিকভাবে টের পাচ্ছে। গত সাত দিন ধরে আসানসোল–দুর্গাপুর করে যাচ্ছে। ওদিকের ইউনিটগুলো যে এত গাম্বাট আর কুঁড়ে জানতোই না ও। ছেলেগুলোকে বাগে আনতে হিমসিম খাচ্ছে। রোজ রাত সাড়ে নটা নাগাদ যখন ৪ নং প্ল্যাটফর্মে আসানসোল লোকাল থেকে নামছে সুদীপ্ত তখন প্রায় ও ধুঁকছে। আজকাল আর সেলসের ছেলেরা সাইডব্যাগ নেয় না, বড় স্কুলব্যাগের মতো পিঠে নেওয়া ব্যাগ অনেক সুবিধের। তবুও মনে হয় কাঁধগুলো ঝুলে এসেছে। সারা শরীর টাটাচ্ছে, মনে হচ্ছে কেউ যদি এই মুহূর্তে ওকে প্ল্যাটফর্মে ফেলে বেশ করে ধোলাই দেয়— তাহলে ব্যথা জুড়োয়।

    তবে সবটাই কি বাজে! না তা নয়, এতদিন একটা শহরের চৌহদ্দির মধ্যেই আটকে ছিলো, এখন রোজ বেশ বেরিয়ে পড়তে পারছে। ট্রেনে বাসে কত রকমের লোকের সঙ্গে যাতায়াত করছে। বিশেষ করে কলেজটাইমে ভিড়ের একটা আলাদা সৌন্দর্য যে রয়েছে সেটা ও টের পাচ্ছে এ কদিনে। ১৮ থেকে ২৪-এর নানা রঙের মেয়েরা কেমন কলকল করতে করতে রোজ কলেজ যাচ্ছে, ইউনিভার্সিটি যাচ্ছে ...প্রজাপতির মতো! সক্কাল সক্কাল ওদের দেখে সুদীপ্তর এযাবৎ অনাঘ্রাত যৌবন বেশ পুলকিত হয়, সারাদিনের উর্জা সংগ্রহ করে ও এই সময়। এছাড়াও রয়েছে জমে চলা টিএ-ডিএ এর চোতা রসিদগুলো, সুদীপ্ত হিসেব করে দেখেছে এ কদিনেই ১২০০-টাকার মতো হয়েছে বিনা জলেই! এটাও বেশ চার্জ আপ করে রাখে ওকে।

    মায়ের শরীর মাঝে মধ্যেই গণ্ডগোল করছে। একদিন তো মাথা ঘুরে পড়েই গেছিল! পাশে বাড়ির মুকুলবৌদি এসে জলটল মুখে ছিটিয়ে মাকে নিয়ে গিয়ে ঘরে শুইয়ে দেয়। সেই সময় সুদীপ্ত বাড়িতে ছিলো না থাকার কথাও নয়, একটু সুস্থ হতেই মা বারণ করে ফোন করে খবর দিতে। বাড়ি ফিরতেই সে কি বিপত্তি! মুকুলবৌদির সে কি ঝাড় সুদীপ্তকে! যেন মায়ের মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার জন্য সে এবং একমাত্র সেই দায়ী! মাসে বারোখানা উপোষ, প্রেশারের ওষুধ ঠিক মতো না খাওয়া ...ইত্যাদি নয়!

    —“অনেক তো বয়স হলো, এবার খ্যামা দাও মাকে! নাকি সারা জীবন দামড়া ছেলের সেবা করেই কাটাবে মা! সারাদিন তো ঢ্যাং-ঢ্যাং করে ঘুরছো রোজগারের ধান্দায় ...কি হবে? এবার একটা বে–থা করো! হাড় জুড়োক বুড়ির ...” এক নিঃশ্বাসে বলে থেমেছিলো মুকুলবৌদি, বৌদি বললেও মায়ের থেকে কয়েক বছর মাত্র ছোট হবে বৌদি। সুদীপ্ত থতমত খেতে খেতে বুঝতে পারে কথাগুলো নেহাত কথার কথা বলার জন্যে বলেনি বৌদি, বেশ ক্ষুব্ধ হয়েই বলেছে, ওরা অনেকদিনের প্রতিবেশী। ‘বে-থা’ নিয়ে একটা যুৎসই জবাব ঠোঁটে ঝুলছিলো ওর, চেপে গেল, এই সিচুয়েশানে বলা ঠিক নয়। চুপ করে ঘাড় নেড়ে ঘরে ঢুকে সোজা মায়ের কাছে চলে যায় সুদীপ্ত।

    এই একটি ঘটনা ছাড়া এ-কদিনে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি। সুদীপ্ত আর টুপি হারায়নি এর মধ্যে, সেই মহিলা পিওনের দেখাও পায়নি এযাবৎ যাতায়াতের পথে। কোথায় যেন উবে গেল মেয়েটা! ইস ...নামটাও তো ...

    শহরের ব্যস্ত এলাকাতেই সুদীপ্তর অফিস। এখন প্রতিদিন রিপোর্ট করতে হয়না ওকে, দু–তিন দিন অন্তর একবার গেলেই হয়। এই রাস্তায় গত ছয় বছর হলো যাতায়াত করছে সুদীপ্ত, প্রতিদিনই কিছু বদল চোখে পড়ে, এই যেমন ফুটের বাঁদিকে পরাণের চায়ের দোকানের ছাউনি প্লাস্টিকটা বদলাল, ‘সুদর্শন হেয়ার কাট’-এর বোর্ড বদলে ‘সুদর্শন জেন্টস পার্লার’ হলো, ‘মিষ্টিমুখ’ মিষ্টির দোকানের বাইরে একটা বাড়তি উনুন হয়েছে সিঙাড়া–কচুরির জন্যই। বদলে যাচ্ছে কিছু বাড়ির রঙও! কিংবা বাড়িটাই হাপিশ! বাড়িটার জায়গায় একটা বেবাক ফাঁকা শুধু ...হুহু করে হাওয়া বইছে, জায়গাটা ঘিরে রাখা হয়েছে টিন দিয়ে। নিচে মার্কেট ওপরে ফ্ল্যাট হবে। ছিলো ‘মিত্র ভিলা’ কিংবা ‘বসু ম্যানসন’ হয়ে যাবে ‘উজ্জ্বয়িনী কমপ্লেক্স’। সেইসব ফ্ল্যাটে হয়তো এক দুটো মিত্র বা বসু থাকলেও থাকতে পারে! সুদীপ্ত দেখে, ওর দেখতে ভালই লাগে এই বদলে যাওয়া, তবে কি সব কিছু বদল ভালো লাগে! তা নয় ...এই যেমন বছর তিনেক আগেও এই রাস্তার প্রথম বাঁকটায় ট্রাফিক সিগন্যাল ছিলো না, এখন হয়েছে, রয়েছে ট্র্যাফিক পুলিশ, কয়েকটা সিভিক পুলিশ ছোঁড়াও, ওদেরও রোয়াব কম নয়! অনভ্যাসে দুবার ঝগড়া হয়েছে । হেঁটে পেরিয়ে যেত দিব্যি হাত দেখিয়ে,এখন আবার হেঁটে পেরোনোর জন্যও সিগনাল মানতে হবে! আজকেও ও নিয়মমতো পেরিয়ে এলো রাস্তা, গরম কমে এসেছে, রোদের তেজ এখন আর সে-রকম নেই। রোদ কমলেও সুদীপ্ত মাথায় টুপি পরাটা অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছে, এখনও মাথায় ওর সেই নীলরঙের টুপি। অফিসের গলির মুখে বাঁক নিতেই প্রায় ধাক্কা লাগছিল! উপর দিকে তাকিয়ে সাইনবোর্ড পড়তে পড়তে হাঁটলে যা হয় আরকি ... কোন রকমে সামলে একটু বিরক্ত হয়ে দুটো কথা বলতে গিয়ে চমকে উঠল সুদীপ্ত, আরে! এ যে পিওন দিদিমণি! উলটো দিকেও তেমনি একহাত জিভ বের করে হেসে ফেলেছেন তিনি ...

    —“সরি ...আমারই দোষ। সাইনবোর্ড দেখছিলাম। ইস ...ধাক্কা লেগেই গেছিল প্রায়, তাও আবার আপনার সঙ্গেই!”

    —“আগে পরিচয় হয়েছে বলে মেনে নিলেন নিজেই যে আপনার দোষ, নইলে ...” একটু কপট রাগ দেখিয়ে ঠাট্টা করার চেষ্টা করল সুদীপ্ত।

    —“না না তা কেন? আমার দোষই ছিল তাই আমার দোষ ...”

    —“তা এপাড়ায় ...আবার ঠিকানা বুঝি!”

    —“হ্যাঁ ...দেখুন না এই গলিটাই কিন্তু ...”

    —“কই দেখি ...”

    একটা খয়েরি কাগজের একটু বড় ভারি প্যাকেট বাড়িয়ে দিল মেয়েটি, একটা হলদে কাজ করা মেটেরঙের কুর্তি পরেছে, জিনসের উপর, গরম কম থাকলেও বেশ গলদঘর্ম দেখলেই বোঝা যাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে চক্কর কাটছে ...

    FORTUNE Pvt Ltd
    7/2A PILKHANA LANE

    যা:! এতো সুদীপ্তর কোম্পানির অফিসের ঠিকানা। সুদীপ্ত এবার হেসে ফেললো ...

    —“ব্যাপার হচ্ছে, আপনার সঙ্গে দেখা হওয়া বা ধাক্কা লাগারই ছিলো মনে হচ্ছে। চলুন ...”

    —“কোথায় যাবো!” বেশ অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করে মহিলা।

    —“আরে বাবা, এ আমার অফিসেরই ঠিকানা, আমিও ওখানেই যাচ্ছি ...”

    —“ওঃ ... হা ভগবান, দেখছেন কি কাণ্ড! সেই কখন থেকে ...চলুন।” অফিসের দরজায় এসে সুদীপ্ত মহিলাকে এগিয়ে দিয়ে তারপরে ঢুকল, রিসেপশানে সঙ্গে গেলও, বর্ণালী ডেলিভারিটা নিয়ে নিল সই করে। কাজ মিটে গেলে আবার তার সঙ্গে বেরিয়ে এলো, বস নেই এখন অফিসে, একটু সময় রয়েছে।

    —“তারপর! বেশ কিছুদিন পরে দেখা কি বলুন?”

    —“হ্যাঁ ...কিছু বললেন!” সুদীপ্ত কয়েক মুহূর্তের জন্য বিস্মিত হল, তারপর মহিলার বাঁদিক থেকে ডান দিকে এলো ...

    —“বললাম, আজ দিনটা বেশ, কি বলেন ...তা একটু চা খেতে আপত্তি নেই নিশ্চয়ই! জানেন তো আমাদের এই অফিস গলির ঐ বাঁদিকের মদনের চা খুব নামকরা ...”

    ওরা দুজনা এগিয়ে গেল মদনের চায়ের দোকানের দিকে, বেশ কিছু কেজো ছেলেমেয়ে আড্ডা দিচ্ছে, চা খাচ্ছে, বেশ গমগম করছে দোকানটা। সবাই বাইরে দাঁড়িয়ে, ওরা চা নিয়ে ভিতরে বেঞ্চে গিয়ে বসল।

    —“এখনও ছটা ডেলিভারি বাকি! উফ কখন যে ছাই শেষ হবে! এদিকে আমি আড্ডা দিচ্ছি আপনার সঙ্গে ...”

    —“ঠিকানাগুলো দেখান। দেখি চিনি কিনা ...”

    —“ও আমি ঠিক খুঁজে নেবো ...”

    মিনিট দশেক কথাবার্তা হলো। মা, ভাই আর ও, মানে পূবালি, এই সংসার। আজ নামটা জেনেছে সুদীপ্ত। পূবালি নিজে বলার আগেই, গলায় ঝোলা আই কার্ডটায় ‘পূবালি কর্মকার’ ...

    সুদীপ্তর পরিচয়ও জেনেছে পূবালি। সারাক্ষণ ডান দিকে বসেই কথা বলেছে সুদীপ্ত, ওই কানেই হিয়ারিং এইড লাগানো যে। ছোট থেকেই কানে কম শোনে।

    ছোট্ট করে ‘আসছি’ বলে কাঁধে ব্যাগটা দ্রুত তুলে এগিয়ে গেল পূবালি। চোখে একটা গভীর ছায়া যেন দেখতে পেল সুদীপ্ত, আবার কবে দেখা হবে জিজ্ঞেস করলো না ও, সুদীপ্ত জানে ওদের শহর এমন কিছু বড় নয়, দেখা ঠিক হবেই। ইচ্ছে করলেই খুঁজে নেবে। হঠাৎ মনটা ভীষণ টল-টল করে উঠল ওর।

    কাজ সেরে হোল-সেল থেকে মায়ের কিছু ওষুধ কিনে পৌরসভার দিকে ফুটপাথে উঠে মুরগীর দোকানগুলোর দিকে এগতে লাগল। এমনি এদিক দিয়েও বাড়ি ফেরা যায়, কিন্তু আজ ওর একটা উদ্দেশ্য আছে, আজ টুপিওয়ালার কাছে একবার যাবে। একটা টুপি নেবে, না: নিজের জন্য নয় ...

    কিন্তু টুপিওয়ালার দোকানের কাছে গিয়ে দেখল, টুল খালি, বন্ধ শাটারের গায় বাঁশের বাতার গায়ে সারি সারি টিশার্ট, কুর্তি টাঙানো!

    —“আরে স্যার যে! এত দিন পর বেকার ভাইটাকে মনে পড়লো?”

    —“আরে টুপি কই!”

    —“সিজন চেঞ্জ, বিজনেস চেঞ্জ স্যার। আমের সময় আম, আঙুরের সময় আঙুর না বেচলে চলবে কি করে স্যার? এখন টি শার্ট, কুর্তি ...ঠান্ডা পড়লে মাফলার, টুপি... তারপর স্যার, এদিকে কি মনে করে?”

    সুদীপ্ত চুপ করে ওর কথা শুনছিল এতক্ষণ এবার হেসে বললো—

    —“আরে এসেছিলাম টুপি কিনতেই, তা আর কি করা ...!”

    —“সরি স্যার ...। ভালো গেঞ্জি দেখাই কটা, কিংবা কুর্তি ...গালফেন্ডের জন্য! ফ্রেশ, পিওর সুতি, বাংলাদেশ মেড স্যার--”

    —“না হে, এখন গেঞ্জি নেবোনা, পরে দেখা যাবে...”

    —“বেকার ভাইটার কথা ফেলবেন না। তবে এটা নিয়ে যান, গেরুয়ার উপর হাল্কা সুতোর কাজ ...যাকে দেবেন, গেরান্টি পছন্দ হবেই স্যার। তাছাড়া এই রঙটাও ...” হাত দেখিয়ে থামিয়ে দেয় সুদীপ্ত ওকে। নেড়েচেড়ে দেখে ব্যাগে ভরে নেয় সুতির কুর্তিটা।

    —“মিলিয়ে নেবেন স্যার, এই বেকার ভাইটার কথা ...”

    সুদীপ্ত ছুটে রাস্তার দিকে এগিয়ে যায়। বাস এসে দাঁড়ায় ওর সামনে, বাসের গায়ে একটা বিরাট হোসিয়ারি কোম্পানির বিজ্ঞাপন জ্বল জ্বল করে ওঠে ওর সামনে, এ-মাথা থেকে ও-মাথা লেখা “আপনা লাক পহেনকে চলো...”

    হাসতে হাসতে টুপিওয়ালার দিকে হাত নেড়ে বাসে উঠে পড়ে সুদীপ্ত। জানালার ধারে বসে বাইরে তাকায়, বেলা পড়ে এসেছে। অস্তমিত সূর্যের আলোয় আকাশের রঙটাও কেমন ভালো লাগার গেরুয়া রঙের হয়ে উঠেছে এই মুহূর্তে। ও জানে ওদের শহর খুব একটা বড় নয়, ও ঠিক খুঁজে নেবে ...



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণ: রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments