— কত? মুচকি হেসে ভুরু নাচালো সায়ন।
— সাড়ে তিন।
বিরক্ত মুখে সিঁড়ি দিয়ে প্রায় দৌড়ে নেমে গেল অনু। সায়ন দরজা বন্ধ করে রাস্তার দিকের জানালায় এসে দাঁড়ালো। নিয়ম মতো ওপর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লো অনু,উত্তরে হাতটা সামান্য তুলে সায়ন বললো,
— সাড়ে তিন একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল।
অনু তখন ঊর্ধশ্বাসে ছুটছে। তিন মিনিট হেঁটে এসে বাসরাস্তা। পৌনে ন’টায় বাসটা আসে। এরপর প্রায় পনর মিনিট পর নেক্সট বাস। আটটা তেতাল্লিশ। পারলো না। চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল। কিন্তু বাসটা মিস করলেও সামনে একটা সাটল পেয়ে গেল। সাটল-এর ড্রাইভার এগিয়ে গিয়েও ওকে দেখে একটু ব্যাক করে এসে থামলো। বিরক্তিটা প্রায় নব্বই পার্সেন্ট কমে গেল। উঠে জানালার পাশে বসেই অনু ওর অদৃশ্য গ্রেড স্কেলে আঙুল রাখলো — ছয়...সাড়ে ছয়...শেষপর্যন্ত সাতই দিয়ে ফেললো ছেলেটাকে। যদিও খুব ভালো করেই জানে, ওর গাড়িতে আর কখনো উঠবে কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই, তবু অভ্যেসে দিলো। এটা ওর একটা অ্যাসেসমেন্ট এর খেলা। অল্পবয়সী ছেলে। নির্বিকার মুখে ড্রাইভ করছে। মুখের একটা পাশ দেখতে পাচ্ছে অনু। তাতেই বুঝে নিলো ওর মুখে কোনো বিরক্তি, ক্লান্তি বা কষ্ট নেই।
— ম্যাম কোথায় নামবেন?
— চিংড়িঘাটা।
এবার আড়চোখে সহযাত্রীদের দেখার চেষ্টা করলো অনু। ও ছাড়া আর তিনজন। একজন ড্রাইভারের পাশে। ওকে কেউ লক্ষ্য করলো না। প্রত্যেকে নিজের নিজের মোবাইলে ব্যস্ত। এই এক বিরক্তিকর ট্রেন্ড। মোবাইল এদের প্রাণভোমরা। অন্যকে বলে কী হবে, নিজের ঘরেই সারাক্ষণ দেখছে। পাপাইএরও সব সময় মোবাইল সুইচে আঙুল। দশ বছরের ছেলের হাতেও মোবাইল। অনু মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে বলে, লিখতে গেলে আঙুল ব্যথা হয়, আর সারাক্ষণ মোবাইলে টুকুসটুকুস করতে ব্যথা হয়না?
সায়ন তো ওর সারাদিনের বরাদ্দ কথার আশি পার্সেন্ট মোবাইলেই বলে, এসএমএস-এ। অনু টিপ্পনী কাটে, তুমি তো কথা বলা ভুলে যাবে। এরপর আমার সঙ্গেও এসএমএস-এ কথা বলবে। সায়ন পালটা জবাব দেয়, তোমার সঙ্গে তো মনে মনেও কথা বলি ডার্লিং। তার জন্যে কি আর উচ্চারণের প্রয়োজন আছে?
— ন্যাকা।
— তুমি তো মোবাইলের ব্যবহারই জানো না। ফোন করলে ধরো না।ওটাকে ছুঁড়ে ফেলে দাও।
— দেব, যেদিন তুমি আমাকে কোনো নির্জন দ্বীপে বেড়াতে নিয়ে যাবে। সেদিন শুধু আমারটা না, তোমারটাও ছুঁড়ে ফেলে দেব।
— তারপর দুজনে মুখোমুখি, গভীর সুখে সুখী...তাই তো?
— তুমি তো বাঁচবে না মোবাইল ছাড়া, সেটাই সমস্যা।
— তুমি বাঁচালে বাঁচবো। চব্বিশ ঘন্টা সঞ্জীবনী সুধা পান করিও...।
প্রতিবারই ঠাট্টা-ইয়ার্কির ভেতর দিয়ে অন্যদিকে গড়িয়ে যায় কথা। কিন্তু মোবাইলের কাজ থামে না।
অনু মোবাইলএর ব্যাপারে সত্যিই খানিকটা উদাসীন। সায়ন ওকে একটা বেশ দামী ফোন কিনে দিয়েছে। তার বহুমুখী প্রতিভা। কিন্তু অনু তার মহিমা বোঝে না। ব্যাগের মধ্যে থাকে এই পর্যন্ত। ফোন এলে ব্যাগ থেকে বার করে রিসিভ করতে করতেই কেটে যায় অধিকাংশ সময়। মাঝেমধ্যে শুধু ছবি-টবি তোলে। আর অ্যালার্মএর কাজে ব্যাবহার করে।
রোজ সাড়ে আটটার ভেতর বেরোয় অনু। সায়ন আর পাপাই বেরোয় আরো পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে। আজ ঘুম থেকে উঠতে, রেডি হতে এমনিতেই একটু দেরি হয়ে গেছে। কোনোরকমে সায়নের তৈরি করে দেয়া চা আর বাটারটোস্ট গলাধঃকরণ করে নিয়ে দরজা খুলতেই সামনের ফ্ল্যাটের নীলা প্রায় পথ আগলে দাঁড়ালো। যেন ওঁৎ পেতেছিল।
— অনুদি এক মিনিট একটু এসো প্লিজ, একটা জিনিস দেখাবো।
— ফিরে এসে সন্ধেবেলায় দেখবো? যথাসাধ্য মধুর হেসে বললো অনু।
— না, না, তখন তো ওটা বেরিয়ে যাবে। একটু পরে পাপিয়া আসবে। প্লিজ।
প্রায় হাত ধরে ওর ঘরে নিয়ে গেল। সায়নের দিকে একবার তাকিয়েই বুঝলো ও মজা দেখছে। নীলার বুটিক আছে লেকমার্কেটের কাছে। শান্তিনিকেতন থেকে কিছু খেস শাড়িতে কাঁথাস্টিচ করিয়ে এনেছে। দেখতে সত্যি খুব সুন্দর হয়েছে। অনু ঘড়ি দেখলো, আটটা পঁয়ত্রিশ। একটার পর একটা শাড়ি খুলে সামনে ফেলছে নীলা। ভেতরে অস্থিরতা, কিন্তু চোখ ফেরাতেও পারছে না।
— এটা তোমার জন্যে আলাদা করে সরিয়ে রেখেছি। না না যখন খুশি পে কোরো।
এই কাণ্ডটা নীলা প্রায়ই করে। গছিয়ে দেয়ার জন্যে পীড়াপীড়ি, এমনকি ইমোশনালি কনভিন্স করারও চেষ্টা করে। সেগুলো কোনোরকমে হজম করে নেয়। কিন্তু আজ বিরক্তিটা চরমে উঠে গেল। ওর স্কেলে নীলার গ্রেড নেমে গেল সাড়ে তিনে। একবারও ভাবলো না যে ও নিজেও মুগ্ধ হয়ে দেখছিল শাড়িগুলো। আটটা বিয়াল্লিশ। নিজেকে প্রায় টেনে বাইরে নিয়ে এলো অনু।
শুরুটা হয়েছিল বীরেনকাকুকে দিয়ে। বাবার স্কুলজীবনের বন্ধু। বাবা মারা গেছেন দশ বছর হলো। বীরেনকাকু সম্পর্কটা টেনে চলেছেন। সময় অসময়ে হানা দেন। কখনও আবার বাবার অন্য কোনো পুরোনো বন্ধুকেও সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। মাঝে মাঝে সেটা বেশ চাপের হয়ে যায়।
অনুর কলেজের বন্ধুদের নিয়ে একটা গেট টুগেদার, সাউথসিটির ফুডকোর্টে বসেছিলো ওরা। গুলজার আড্ডা। তারই ফাঁক দিয়ে হঠাৎ কানে এলো, ‘পুঁটি...’ অনুর মনে হলো একটা পাটকেল এসে মাথায় লাগলো। বীরেনকাকুর গলা। বাবার অনেকগুলো আদরের ডাকের মধ্যে এটা ছিল একটা। অন্য কেউ ডাকতো না, বাবার দেখাদেখি বীরেনকাকু ডাকতো। যেটা নিয়ে কোনোদিন মাথা ঘামায়নি সেটাই মহাসঙ্কটে ফেললো। তাকালো না অনু। সুমিত আর দীপাঞ্জনার আড়ালে চেয়ারটা একটু সরিয়ে নিলো। ‘এই পুঁটি’-- এবার সামনে এসে প্রায় আক্রমণ। বন্ধুরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। ওর কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ। একেবারে মুখের সামনে।
— পরশু তোর বাড়িতে গিয়ে তালাবন্ধ দেখে ফিরে এসেছি। কখন ফিরিস স্কুল থেকে?
— ঠিক নেই। তুমি এখানে?
— নাতনির সঙ্গে এসেছি। সে স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে কী একটা সিনেমা দেখতে ঢুকেছে। আমি ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। তাকে তো তার মা একা ছাড়বে না। আমি পাহারাদার। বেরোলে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরবো। তা তোরা আছিস কেমন? যাবো আর একদিন।
— ফোন করে যেও কিন্তু। এখন যাও, দেখ সিনেমা শেষ হলে পিউ আবার তোমাকে খুঁজবে।
কী বুঝলেন কে জানে, হ্যাঁ যাই, তোরা গল্প কর। বলে চলে গেলেন।
হাসাহাসি, পেছনে লাগা, মিমিক্রি-- বন্ধুরা প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লো। গায়ে না মাখলেও ওর আড্ডার মুডটার বারোটা বাজিয়ে দিলেন বীরেনকাকু।
এইসব ছেঁড়া সম্পর্কগুলোকে বয়ে বেড়ানো মাঝে মাঝে বোঝার মতো লাগে। এটাতে তো যাহোক একটা অন্য সেন্টিমেন্ট জড়িয়ে আছে। এর বাইরে আরো আছে। লম্বা ফিরিস্তি — ক্লান্তিকর সামাজিকতা, পরিচিতদের সঙ্গে বিরক্তিকর আড্ডা, অপছন্দের মানুষজনের সঙ্গে বাধ্যতামূলক সময় কাটানো...সেখানে বোকা বোকা ঠাট্টা, কূট-কচাল, ধর্ষণের খবর নিয়ে ইনসেনসিটিভ মুখরোচক আলোচনা, হয় প্লাস্টিক হাসি সহ গিলে নিতে হয়, না-হয় বিরুদ্ধ কথা বলে আড়ালে মুখ বাঁকানো বিদ্রুপ হজম করতে হয়।
স্কুলেও সারাক্ষণ ফিল্মি গসিপ নিয়ে সহশিক্ষিকাদের সিরিয়াস মুখ করে মতামত দেয়া আর হেডমিস্ট্রেসের সামনে অতি বিনয়ে নুয়ে পড়া। ওহ, গা গুলিয়ে ওঠে দেখলে। মাথাটা ভার হয়ে যায়। একটা নেগেটিভ এনার্জি ছেয়ে থাকে মনের মধ্যে। মাঝে মাঝে নিজেই ভেতরে ভেতরে বিদ্রোহ করে — কেন সহ্য করি অবাঞ্ছিত সঙ্গ? যা ভালো লাগে না? কেন বেছে নেব না শুধু ভালোলাগা সাহচর্যগুলোকে? একসময় ঠিক করে ফেললো নিজের মেলামেশার বৃত্তটা ছোট করে আনতে হবে। মনে মনে একটা গ্রেডস্কেল ঠিক করলো। তাতে দশের মধ্যে যার নম্বর অন্তত সাড়ে পাঁচের ওপরে থাকবে, ও শুধু তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে। সম্পর্ক মানে ঘনিষ্ঠতা নয়। কেমন আছো, কী খবর, এই রকম আর কি। ঘনিষ্ঠতার জন্যে সাড়ে সাত থেকে আট দরকার। সেই শুরু।
সায়ন হঠাৎ একদিন জিজ্ঞেস করলো, কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করছি তুমি হঠাৎ হঠাৎ কাউকে খুব তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকো, তখন তোমাকে অন্যমনস্ক লাগে। মনে হয় কিছু একটা হিসেব কষছো। কী ব্যাপার বল তো।
— ব্যাপার আবার কী?
তখনকার মতো এড়িয়ে গেলেও প্রায়ই এটা নিয়ে ঘ্যান ঘ্যান শুনতে শুনতে একদিন বলেই ফেললো সায়নকে। শুনে ও বেশ মজা পেয়েছিল। সেই থেকে সায়ন ব্যাপারটাকে উপভোগ করে।
স্টাফরুমে ঢুকে ঢকঢক করে জল খেলো অনু। চারদিকে তাকালো। আজও দেবযানী আসেনি। তার মানে নাইনের কেমিস্ট্রি ক্লাস ওকেই চাপাবে হেডমিস্ট্রেস। বাড়ি ফিরতে সাড়ে ছ’টা। শিপ্রা এসে ফিরে যাবে। রাতের খাবার ওকেই বানাতে হবে। ফিরে গিয়ে নিজে চা করে খেতে হবে।
মাথাটা গরম হয়ে গেল। দেবযানী প্রায়ই এটা করছে আজকাল। আর ওর ক্লাস অনু ছাড়া আর কেউ নিতে চায় না, এড়িয়ে যায় অজুহাত দেখিয়ে। দেবযানীও অবলীলাক্রমে হেডমিস্ট্রেসকে ফোনে বলে দেয়, ‘অনুশীলার সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে দিদি। ও ক্লাসটা নিয়ে নেবে।’ বন্ধুত্বের খাতিরে এড়াতে পারে না অনু।
অজান্তেই গ্রেড স্কেল অন। রাগ অস্বস্তি দুইই হচ্ছিল। কিছুটা কনফিউজড। গ্রেডেশান করবে কার, দেবযানী না হেডমিস্ট্রেসের! পরে ভাবলো, হেডমিসট্রেস তো তাঁর দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু দেবযানীর এই বন্ধুত্বের ফায়দা তোলাটা আর নেয়া যাচ্ছে না। ফট করে দেবযানীকে পাঁচ দিয়ে দিল। ও ছিল আটে। স্কুলে দেবযানীই ওর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ। দারুন সেন্স অফ হিউমার। ওর সঙ্গে আড্ডা দিতে ভালো লাগে। দুজনে টিফিন শেয়ার করে।
বিকেলে চাকাটা ঘুরে গেল। দেবযানীর ক্লাসটা ওকে নিতে হয়নি। ঠিক সময়ে ঠিক বাস। ঘরে ঢোকার আটমিনিটের মধ্যে শিপ্রা এলো। পাপাই স্কুল আর টিউশনি সেরে ঠিকঠাক সময়ে বাড়ি ফিরলো। সায়ন ফোন করে জানতে চাইল, তাঁত না ঘিচা?
মনে পড়লো, আজ এপ্রিলের দশ তারিখ। নববর্ষের ঠিক আগে এক ভদ্রলোক সায়নদের অফিসে শাড়ি নিয়ে আসেন। অনু উত্তর দেয়ার আগেই শুনতে পেলো সায়ন অন্য কাউকে বলছে — দুটোই দিয়ে যান। আজ সকালে অনুর বিগড়ে যাওয়া মুড দেখেছে সায়ন। কাজেই বৌকে খুশি করার জন্যে দুটোই... মনে মনে আত্মতৃপ্তি অনুভব করলো অনু। ওর এই নিজস্ব ছোট্ট জগৎটুকুর মধ্যেই তো ওর যাবতীয় আনন্দ মজুত করা। কাজেই মেলামেশার বৃত্তটা একটু ছোট করে নিলে ক্ষতি নেই।
কিছুদিন হলো কী যে আরামে আছে অনু। নিজের পছন্দের মানুষদের সঙ্গে বিশ্রামে বিশ্রম্ভালাপে মনেরমতো সময় কাটাচ্ছে। প্লাস্টিক হাসি, অন্যমনস্ক বাক্যালাপ থেকে খানিকটা রেহাই পেয়েছে। ক্লাস শেষ হলেএক মিনিটও দাঁড়ায় না। ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে চোখ নিচু করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায়। পাড়ার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে উড়ে আসা ছোট ছোট প্রশ্ন না শোনার ভান করে। সব ঠিকঠাক চলছে। আপাতত গ্রেডস্কেল বন্ধ।
নববর্ষ নিয়ে মায়ের সেই এক কথা, বছরের এই একটা দিন সক্কলকে একসঙ্গে পাই। সারা বছর তো তোরা নিজের নিজের মতো থাকিস। একটু বড় ছুটি পেলেই তো নিজেদের মতো দে ছুট।
কাজেই যেতেই হয় নববর্ষের দিন। সকাল থেকে সন্ধে। ব্রেকফাস্ট থেকে বিকেলের চা পর্যন্ত। সায়নের হেলদোল নেই। শালাবৌদের যত্নের বন্যায় ভেসে থাকে। পাপাইও খুশি। মামাতো ভাইবোনদের সঙ্গে সারাদিন নরক গুলজার। পয়লা বোশেখে ইচ্ছে থাকলেও অনু নিজস্ব কোনো প্রোগ্রাম করতেই পারে না। মা বুঝতে চান না। যাই হোক মায়ের ওপর তো আর গ্রেডস্কেল প্রয়োগ করা চলে না। ওই তো একটাই জায়গা, সুখ দুঃখ, রাগ বিরক্তি সব নির্দ্বিধায় ঢেলে দেওয়া যায়, নির্বিকার হজম করে নেন।
নববর্ষ আর রোববার পরপর দু’দিন ছুটির একটা তাই মায়ের জন্যে বরাদ্দ ছিল। পাপাই কাল ওবাড়িতেই রয়ে গেছে। অনু ভেবে রেখেছিল আজ ও আর সায়ন একটা নাটক দেখতে যাবে। সায়ন খুব সুন্দর দুটো শাড়ি উপহার দিয়েছে ওকে। সারাদিন থাকতে হবে ভেবে গতকাল তাঁতের শাড়িটাই পরে গিয়েছিল। আজ ঘিচাটা পরবে বলে ব্লাউজ বাছাই করে শাড়িটা ঠিকঠাক করে রেখেছে। শিপ্রাকে দিয়ে ফলসটাও লাগানো হয়ে গেছে। অনুর প্রস্তাব শুনে সায়ন বলল,
— সরি সোনা, আজ বিপুল-সেলিম-বিতস্তাদের কথা দিয়েছি। এরা ওর কলেজ গ্যাং।
— আমাকে তো আগে জানাওনি।
অনুর একবার মনে হলো সায়ন আজকাল বন্ধুদের একটু বেশি কথা দিয়ে ফেলছে না কি? অভিমানটা গিলে নিলো। ও নিজের প্রোগ্রাম ঠিক করে ফেললো। অনেকদিন পর আজ মনীষাদির সঙ্গে ম্যারাথন আড্ডা দেবে।
— ঠিক আছে তুমি আমাকে মনীষাদির বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যেও।
— গুডগার্ল। নিশ্চয় নামিয়ে দেবো, চাইলে উঠিয়েও দিয়ে আসতে পারি। কিন্তু ফিরতে হবে নিজের দায়িত্বে, আমার রাত হবে।
মনীষাদিরা থাকে চারতলায়। লিফট নেই। পুরোনো আমলের বাড়ি।
— ঠিক আছে ঠিক আছে, অত আহ্লাদ দেখাতে হবে না।
অনু খুব যে বিরক্ত, তা নয়। মনীষাদির সঙ্গ ওর কাছে একটা মনোরম অভিজ্ঞতা। জ্যাঠতুতো দিদির বন্ধু। কিন্তু তার কাছে অনুর অঢেল আহ্লাদ আর প্রশ্রয়। যখন তখন গিয়ে হাজির হওয়া যায়। কলেজে পড়ান, গল্প উপন্যাস লিখে বেশ নাম করেছেন। যখন গল্প করেন, মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখেন। নাটক দেখার চেয়ে এটা কম আকর্ষণীয় নয় অনুর কাছে। তবু ফোন করে যাওয়াই ভালো।
— মনীষাদি তুমি বিকেলে বাড়িতে আছো ?
— হুঁ-উ-উ-উ-উ-ম, আছি। কেন?
অনুর একবার মনে হলো বাড়িতে আছে এই কথাটা বলতে মনীষাদি এতটা সময় নিলো কেন? মনে হলো, তবু ভাবনাটাকে উপেক্ষা করে বললো,
— বিকেলে যাচ্ছি তোমার বাড়ি।
— অনু, আজ আসিস না। তুই বোর হবি। আমার দু’তিনজন পুরোনো ছাত্রছাত্রী আসবে। ওরা বেশ কিছুক্ষণ থাকবে। তুই বরং কাল বিকেলে আয়।
ধাক্কা খেলো। মনটা খারাপ হয়ে গেল অনুর। কোনোদিন এমন হয়নি যে, মনীষাদির কাছে যেতে চেয়েও ওর যাওয়া হয়নি। সাড়ে চারটের দিকে সায়ন বেরিয়ে গেল। ভাল্লাগছে না। ফোন বাজলো। পলা, স্কুলের বন্ধু। ভালো বন্ধু। কাছাকাছি থাকে। খুব মজার মেয়ে। ছেলের জন্মদিনে ডাকছে। নেক্সট উইকে।
— চেষ্টা করবো যেতে।
— তার মানে কথা দিচ্ছিস না। পলার গলায় অভিমান।
— আচ্ছা বাবা কথা দিলাম যাবো। আজ তুই চলে আয় না। দুজনে মিলে জমিয়ে আড্ডা দেবো। ফাঁকা বাড়ি।
— বাড়ি ফাঁকা কেন? বরকে ভাগিয়ে দিয়েছিস?
— না রে, বরই কেটে পড়েছে। পাপাইও মামাবাড়ি।
— আজ ইচ্ছে করছে না।পরে কখনো যাবো।
অনুর সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার জন্যে বরাবর মুখিয়ে থাকে পলা, হলোটা কী? এড়িয়ে গেল? আচমকা জেদ চেপে গেল অনুর। কী ভেবে পাপাইকে ফোন করলো, তুই Finding Dory দেখবি বলেছিলি, কাল তো স্কুল খুলে যাবে তোর, চল আজ দেখে আসি। আমি অনলাইনে টিকিট কেটে নিচ্ছি। ছোট মামুকে বল পৌঁছে দিতে।
— মা,মা, প্লি-ই-ই-জ টিকিট কেটো না। আমার আজ যেতে ইচ্ছে করছে না।
হলোটা কী! হঠাৎই অনুর মনে হলো, সবাই কি ওকে এড়িয়ে যেতে চাইছে? ওর সঙ্গ ভালো লাগছে না কারো? অনুও কি বোরিং হয়ে পড়েছে? ওরাও সবাই গ্রেডস্কেল ব্যবহার করছে না তো? সায়ন, মনীষাদি, পলা, এমন কি পাপাই? অনু দেখতে পাচ্ছে, চারপাশে খোলা হাওয়ায় জনকলরোল। শুধু ওর বৃত্তটা ছোট হতে হতে প্রায় একটা বিন্দুতে পরিণত হয়েছে। আর সেই বিন্দুর মধ্যে আটকে পড়ে আছে ও। বড্ড একা। দম বন্ধ লাগছে।