মনোরমা দেবী হাই স্কুলে ভর্তি হয়ে ঝিলিক ভারি সমস্যায় পড়েছে। ওর বাবা এই সদ্য বদলি হয়ে বিহারের চন্দনপুরে এসেছেন এখানকার ব্যাঙ্কের ম্যানেজার হয়ে। একদম ছোট্ট টাউন চন্দনপুর, আশপাশে সব গ্রাম। কলকাতা, দিল্লিতে থাকা ঝিলিকের জন্যে এটা একেবারে এক নতুন অভিজ্ঞতা। চারিদিকে প্রচুর সবুজ, সাইকেল করে স্কুলে যাওয়া, বাড়ির সামনে বড় বাগান, সবই ওর কাছে নতুন। পুরোনো বন্ধুদের জন্যে মন কেমন করছে বটে ওর কিন্তু কী আর করা যাবে, মা বাবা ভাই এখানে চলে আসলে সে একা একা তো আর কলকাতায় থাকতে পারে না!
তা মনোরমা দেবী গার্লস হাই স্কুল এমনিতে বেশ ভাল। বিল্ডিংটা খুব বড় আর প্রচুর খেলার মাঠ। এখানকার স্থানীয় এম এল এ সাহেব তাঁর মার স্মৃতিতে স্কুলটা বানিয়ে দিয়েছেন। শিক্ষক শিক্ষিকারাও বেশ ভাল আর ঝিলিক কয়েক বছর দিল্লিতে থাকার জন্যে হিন্দিটা ভালই জানে, তাই পড়াশোনায় ওর অসুবিধা হচ্ছে না কিন্তু সমস্যাটা হয়েছে ক্লাসের মেয়েগুলোকে নিয়ে! তারা সবাই এই কয়েকদিনেই ওকে ‘শহর থেকে আসা ভিতুর ডিম’ নাম দিয়ে দিয়েছে! আসলে ঝিলিক স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম যেদিন ক্লাসে যায় সেদিনই খোলা জানালা দিয়ে ক্লাসে একটা পায়রা ঢুকে পড়েছিল। ফড়ফড় করে উড়ছিল পায়রাটা আর ঝিলিক প্রথমে বেঞ্চের উপর উঠে লাফিয়েছিল তারপর ভয়ে ক্লাস থেকে ছুটে পালায়! মেয়েগুলো তো ওর কীর্তিকলাপ দেখে হেসেই খুন!
একটা মেয়ে তো বলেই ফেলল, “তুমি কোনদিন পায়রা দেখনি বুঝি?”
প্রথম প্রথম সাইকেল কেনা হয়নি বলে ঝিলিক মার সাথে হেঁটে স্কুলে যাচ্ছিল। তাতেও মেয়েগুলো হাসাহাসি করেছিল, “মাকে সাথে করে নিয়ে আসার কী আছে? এই টুকুনি তো পথ! ও বুঝেছি! ষাঁড় দেখে ভয় করে বুঝি?”
আসলে রাস্তায় একদিন একটা বিশাল শিং-ওয়ালা ষাঁড়কে দেখে ঝিলিক এমন ছুট দিয়েছিল যে একটা জলায় পড়ে যাচ্ছিল প্রায়! সেটাও কোন একটা মেয়ে দেখে ফেলেছিল।
তারপর থেকেই ঝিলিককে আর কেউ নাম ধরে ডাকে না, ডাকে ‘শহর থেকে আসা ভিতুর ডিম’ বলে!
ঝিলিকের ওই নামটায় ভারি আপত্তি। মেয়েগুলো কিন্তু শুনবে না। তারা তো বসে বসে একটা তালিকা তৈরি করে ফেলেছে ‘শহর থেকে আসা ভিতুর ডিম কিসে কিসে ভয় পায়’ – পায়রা, ষাঁড়, গরু, কুকুর, আরশোলা, টিকটিকি, মাকড়সা, যে-কোন-পোকা, সাপ (এটাতে অবশ্য অনেকেই ভয় পায়), ব্যাঙ ইত্যাদি!
ওই লিস্টটা দেখে ভীষণ রেগে গিয়েছিল ঝিলিক। বলেছিল, “আমি মোটেই ভিতু নই!”
মেয়েগুলো চোখ উলটে, খিকখিক করে হেসে বলেছিল, “ও!”
ঝিলিক তখনই ধাঁ করে বলে বসল, “আমি এমন একটা জিনিসে ভয় পাই না যেটাতে তোমরা সবাই ভয় পাও!”
হাসি থেমে গেল, “কী?”
“ভূত! আমি ভূতে ভয় পাই না!”
সন্দেহ ভরা চোখে ওর দিকে তাকাল মেয়েগুলো।
শুভ্রা বলল, “হ্যাঁ, সেটা তো বলে দিলেই হল যে ভূতে ভয় পাই না! প্রমাণ কোথায়?”
“আরে বাবা ভূত আদৌ থাকলে তো প্রমাণ করব!”
ওরা সবাই মিলে বলল, “ভূত আছে তো! এবার দেখাও প্রমাণ করে যে তুমি ভয় পাও না!”
“কোথায় আছে ভূত?”
“ওই তো আমাদের চন্দনপুর আর কাঞ্চনপুর গ্রামের সীমানায় যে পোড়ো বাড়িটা আছে সেটাতেই তো ভূত আছে!”
“ধুৎ, কী সব আজেবাজে কথা বলছ!”
“না, আজেবাজে কথা নয়! ওই বাড়িটায় ভূত আছে। রাতেরবেলা কেউ ওদিকে পা মাড়ায় না! অনেকে বাড়িটা থেকে কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়েছে। ওই পোড়ো বাড়িটা সমাদ্দারদের বাড়ি ছিল। সমাদ্দারের তেরো বছরের একমাত্র মেয়েটা কী একটা অসুখে দুম করে বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। আসলে তখন গ্রামে ডাক্তার হাসপাতাল কিছুই তেমন ছিল না। মেয়ের দুঃখে সমাদ্দারের বউ আত্মহত্যা করেন আর সমাদ্দার ওই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যান, আর বিক্রিও করেননি। কোথায় থাকেন কেউ জানে না। তারপর থেকেই লোকে মনে করে ওই খালি বাড়িতে ভূত থাকে।”
“কবেকার কথা এটা?”
“ঠিক জানি না, হবে বছর পঞ্চাশেক আগেকার কথা। দাদুকে জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবেন। তবে কান্না শুনতে পাওয়া গেছে এই দু তিন মাস আগেও! আমার দাদার বন্ধু গুপিদা বলেছে ওর চেনা কে একজন নাকি পুজোর জন্যে পোড়ো বাড়ির বাগান থেকে ফুল চুরি করতে গিয়েছিল তখন ওই বাড়িটা থেকে কী সব শব্দ শুনতে পায়! মনে হয় কান্নারই শব্দ।”
ঝিলিক হাসতে হাসতে বলল, “বেড়ালের কান্না নয় তো?”
সবাই গম্ভীর মুখে ঝিলিকের দিকে এমন ভাবে তাকাল যেন সে ভয়ানক কিছু বলে ফেলেছে আর এবার তার নিস্তার নেই!
“ঠিক আছে, কাল শনিবার, কাল রাতেই আমি গিয়ে দেখব কী আছে ওই পোড়ো বাড়িতে!”
ঠিক হল ঝিলিক বাড়িতে বলবে যে সে রাত্রিবেলা নন্দিতার বাড়িতে থাকবে, কারণ পোড়ো বাড়িতে যাচ্ছে শুনলে মা বাবা মোটেই যেতে দেবেন না!
“কিন্তু তোমরা বিশ্বাস করবে কী করে যে আমি ওখানে গিয়েছিলাম?”
“পোড়ো বাড়ির বাগানে একটা লতানে গোলাপের গাছ আছে। সেই রঙের ফুল এখানে কারো বাড়িতে নেই। সেই গাছ থেকে একটা ফুল আনলেই হবে!”
“নিয়ে আসব ফুল আর ওই ফুল নিয়ে আসার পর কিন্তু তোমরা আর আমাকে ‘শহর থেকে আসা ভিতুর ডিম’ বলতে পারবে না!”
“ঠিক আছে নিয়ে তো এসো আগে তারপর দেখা যাবে!”
পরের দিন স্কুলের পর বাড়ি গিয়ে রাতে-পরার পোশাক ইত্যাদি নিয়ে নন্দিতার বাড়িতে হাজির হল ঝিলিক। অদিতি, প্রিয়া আর মৌসুমীও এলো নন্দিতার বাড়িতে। সবাই মিলে সাইকেল করে দোলনদের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিল ঝিলিককে।
“এই রাস্তাটা ধরে পাঁচ মিনিট গেলেই ডান দিকে একটা মাঠ পড়বে আর মাঠটা পেরলেই দেখতে পাবে পোড়ো বাড়িটাকে। সন্ধে তো নামছে এখন। আমরা তোমার জন্যে দোলনের বাড়িতেই অপেক্ষা করছি। তোমাকে এক ঘন্টার মধ্যে গোলাপ নিয়ে আসতে হবে।”
অদিতি পকেট থেকে একটা মোবাইল ফোন বার করে ওর হাতে দিয়ে বলল, “এটাতে প্রথমেই দোলনের বাড়ির নম্বর আছে। বিপদে পড়লে এটা ব্যবহার কোরো, আমরা তাহলে লোকজন পাঠাবো।”
অন্ধকারে সাইকেল চালাতে গেলে কিসে হোঁচট খেয়ে পড়বে তাই পায়ে হেঁটেই রওনা হল ঝিলিক।
ফুরফুরে হাওয়া, মাঠ জুড়ে জোনাকির ঝিকিমিকি – ভারি ভাল লাগছিল ঝিলিকের। শহরে এই দৃশ্য তো চোখেই পড়ে না!
মাঠ পেরতেই দেখতে পেল বাড়িটাকে। সাধারণ একটা একতলা পাকা বাড়ি। অনেক দিনের অযত্নে সামনের বাগানটা জঙ্গল হয়ে গেছে! রাতে ফোটা কোন এক ফুলের মিষ্টি গন্ধ আসছে, কিন্তু চারিদিকে তো অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে! মেয়েগুলো বলে তো দিল গোলাপ আনতে কিন্তু এই অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে গোলাপ গাছ খুঁজবে কে?
অমাবস্যার রাত নয়, আকাশে চাঁদ আছে তাই চাঁদের আলোয় কিছুটা দেখা যাচ্ছে। পকেট থেকে টর্চটা বার করে আস্তে আস্তে এগোতে লাগল ঝিলিক। ভূতে ওর সত্যি ভয় নেই কিন্তু সাপে ভয় আছে! এবং সেই ভয় থাকাই ভাল! সাপে কামড়ে দিলে তো আর ক্লাসের মেয়েগুলো বাঁচাতে আসবে না!
সামনের দরজাটাতে আলতো চাপ দিতেই সেটা ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করে খুলে গেল। অনেক দিন কব্জাগুলোতে তেল পড়েনি। ভিতরে উঁকি দিয়ে ঝিলিকের মনে হল এক ঝলক আলো যেন দেখল একটা, মোমবাতির আলো মনে হল! ভূতে কী মোমবাতি ব্যবহার করে নাকি! নিশ্চয় ব্রাউন সাহবের বাড়ির রহস্যের মতন এখানে কোন চোরাকারবারি দল লুকিয়ে আছে। গল্পে যেমন ছিল ঠিক সেই রকম ভাবেই লোকেদের দূরে রাখার জন্যে ভূতের গল্প রটিয়েছে! রহস্যভেদের উত্তেজনায় বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠল ঝিলিক!
টর্চের আলো ফেলে দেখতে লাগল সে। পরিত্যক্ত ভাঙ্গা আসবাব কয়েকটা পড়ে আছে সামনের ঘরটায়। সব কিছু ধুলোয় ভরা!
হঠাৎ একটা শব্দ শুনতে পেল সে, ঝুন ঝুন ঝুন – কে যেন ঘুঙুর পায়ে হাঁটছে! আরে এ তো অবিকল ব্রাউন সাহেবের বাড়ির গল্পটার মতন! ভূত কী পায়ে ঘুঙুর পরে নাচে নাকি! সে সব তো কেবল সিনেমা আর গল্পে হয়-- ভূত গান গায়, পেত্নি নাচে! পরক্ষণেই ছায়ামূর্তিটাকে দেখতে পেল ঝিলিক। আপাদমস্তক সাদা কাপড়ে মোড়া কে একজন ওর সামনে এসে দাঁড়াল! আর কিছু না ভেবেই ঝিলিক মারল এক লাফ, একেবারে সোজা মূর্তিটার ঘাড়ে! ক্যারাটে শিখেছে না ঝিলিক!
অমনি, “ওরে বাবাগো, মাগো, মেরে ফেলল গো!” বলে মেয়েলি গলায় চিৎকার!
“কে তুমি? অমন ভূত সেজে বসে আছ কেন এই পোড়ো বাড়িতে? তুমি কী চোরাকারবার করছ নাকি এখানে?”
মহিলা উল্টে ওকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কে?”
“আমি ঝিলিক। শহর থেকে চন্দনপুরে এসেছি কিছুদিন হল। ক্লাসের মেয়েরা আমাকে ভিতু ভিতু বলে ডাকে তাই আমি সেই নাম ঘোচাবার জন্যে পোড়ো বাড়িতে ভূত নেই সেটা প্রমাণ করতে এসেছি! তা তুমি পোড়ো বাড়িতে রয়েছ বটে কিন্তু তুমি তো ভূত নও, তুমি কে?”
গায়ে জড়ানো সাদা শাড়িটা খুলে ফেলতে ঝিলিক অবাক হয়ে দেখল যে মহিলা নয়, একটা মেয়ে! বয়সে ওর থেকে কিছুটা বড় হবে।
মেয়েটা বলল, “দাঁড়াও, একটা মোমবাতি জ্বালি। এসো ভিতরের ঘরে এসো, সেখানে মোমবাতি জ্বালালে বাইরে থেকে দেখতে পাওয়া যায় না।”
ছোট্ট এক টুকরো একটা মোমবাতি জ্বালাল মেয়েটা।
“বোসো!”
ঝিলিক একটা মোড়া মতন জিনিসে বসে আবার বলল, “তুমি কে সেটা বললে না তো? এখানে একা একা রয়েছ কেন? তোমার নিজের বাড়ি নেই?”
“আছে!”
“তাহলে?”
মাথা নিচু করল মেয়েটা, “আমার নাম সীমা। আমার মা বাবা মারা গেছেন তাই মোতিয়াপুর গ্রামে আমার মামার বাড়িতে থাকতাম আমি। আমি গ্রামের স্কুলে ক্লাস ইলেভেনে পড়তাম। পড়াশোনায় খুব ভাল ছিলাম আমি। আমি বারো ক্লাসে উঠতেই মামা হঠাৎ ঘোষণা করলেন যে আমাকে আর পড়াতে পারবেন না! আমার থেকে এক বছরের ছোট ভাই যে পড়াশোনায় একেবারেই সাধারণ, দুয়েকবার ক্লাসে ফেলও করেছে সে নাকি পড়বে আর আমার বিয়ে দিয়ে দেবেন! আমার জন্যে স্কুলের ফি দিলেন না মামা তাই আমাকে বাড়িতে বসতে হল। স্কুলের টিচাররা জিজ্ঞেস করতে মামা ওদের বললেন আমাকে শহরে আমার এক আত্মীয়র বাড়িতে পড়তে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ওনারা হয়তো বুঝলেন কিন্তু কিছু বললেন না কারণ এখানে মেয়েদের বেশি পড়তে না দেওয়াটা নতুন কিছু নয় বা আঠেরো বছর বয়স হওয়ার আগে বিয়ে দিয়ে দেওয়াটাও সব সময় হচ্ছে। তারপর মামা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেললেন, যার সাথে বিয়ে হওয়ার কথা সে পঞ্চাশ বছরের একজন বুড়ো লোক! তখনই বাড়ি থেকে পালালাম আমি! মাস তিনেক হল এই পোড়ো বাড়িতে লুকিয়ে আছি! কেউ এদিকে আসলে ভূত সেজে ভয় দেখাই। তবে এবার আমার কাছে টাকাকড়ি যা ছিল সব শেষ হতে চলেছে, এর পর কী করব আমি জানি না!”
“চলো আমার সাথে! তোমার এই কাহিনি সবাইকে শোনাতে হবে! তারপর কিছু না কিছু ব্যবস্থা একটা হবেই!”
সীমাকে নিয়ে দোলনের বাড়িতে গেল ঝিলিক। আশ্চর্যে মুখ হাঁ হয়ে যাওয়া মেয়েগুলোকে সে বলল, “অন্ধকারে বাগানের ওই জঙ্গলের মধ্যে লতানে গোলাপ গাছ কোনটা বুঝতে পারিনি তাই পোড়ো বাড়ির ভূতটাকেই ধরে নিয়ে এসেছি!”
সীমার মামার নামে পুলিশের কাছে কেস করেছেন চন্দনপুরের এম এল এ সাহেব। সীমা এখন ঝিলিকদের স্কুলেই ক্লাস টুয়েলভে পড়ছে। ওর জন্যে স্কলারশিপের বন্দোবস্ত হয়েছে আর স্থানীয় এক পরিবারের সাথে ওর থাকার ব্যবস্থাও হয়েছে। মন দিয়ে পড়াশোনা করছে সীমা। ওর ইচ্ছে ও ডাক্তার হবে।
ঝিলিকের এখন ভারি আনন্দ! সে এখন পায়রা, কুকুর, গরু বা যত রাজ্যের পোকাকে ভয় পেলেও কেউ আর ওকে ‘শহর থেকে আসা ভিতুর ডিম’ বলে ডাকতে সাহস করে না!