• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৩ | ডিসেম্বর ২০১৮ | গল্প
    Share
  • ভূতের দাবি : রূপা মণ্ডল



    ।। ১ ।।

    জ সকালেই মনটা তেতো হয়ে গেলো — আমরা ভূত বলে কি মানুষ নই! আমাদের নিয়ে যা খুশি, যাচ্ছেতাই সব লেখা-লেখি হবে? এইমাত্র আমাদের সংবাদদাতা জানালো, অমুক পত্রিকা নাকি আমাদের নিয়ে এবারে একটা স্পেশাল সংখ্যা বের করছে যার শিরোনাম থেকে ব্যাককভার অবধি সবকিছুই নাকি আমাদের নিয়ে। তা ভালো কথা যে আমাদের গুরুত্ব বাড়ছে। কিন্তু যে-সব লেখক লেখিকারা আমাদের নিয়ে লেখালেখি করছেন তাঁদের আস্পর্ধা দেখে আমাদের গা জ্বলে যাচ্ছে। বলে কি না, আমরা নাকি নাঁকি নাঁকি সুরে কথা বলি, গাছের নিচে দিয়ে কেউ খাবার নিয়ে গেলে লম্বা হাত বাড়িয়ে কেড়ে নিই, অন্ধকার হলেই লোককে ভয় দেখাই — যত্তসব মিথ্যে কথা! আমাদের তো একটা প্রেস্টিজ আছে না কি? আমরা ঠিক করেছি আমাদের একটা সংগঠন গড়ে তুলতে হবে — এইসব মিথ্যের প্রতিবাদ করার জন্য।

    আমাদের সম্পর্কে সঠিক করে কেউ কিচ্ছুটি জানে না, জানার চেষ্টাও করে না। আর গল্পের নামে ভুলভাল যা খুশি লিখে হাততালি কুড়োবার চেষ্টা করে। এটা ঠিক যে আমরা দিনের আলোয় কোনো মানুষের আকৃতি ধারণ করতে পারি না, রাতের অন্ধকারে আবছায়া আলোতে আমাদের ছায়া পড়ে, সেই ছায়া দেখে কখনো কখনো মানুষ ভয় পায় — তাও আমরা ভয় দেখাই না। আমরা এখন নিজেদের অস্তিত্বসংকট নিয়েই ব্যতিব্যস্ত। কোত্থাও একটা পুরোনো বাড়ি নেই। আমাদের থাকার জায়গাই নেই! "ভূতের বাড়ি" এখন শুধু গল্পেই শোনা যায়, কেউ আর দেখতেই পায় না। এই তো সেদিনকার কথা, আমাদের একজন ভূত সদস্য একটা বড়গাছের ডালে বসেছিল। শহরে তো বড় গাছও দেখতে পাওয়া যায় না। সে বসেছিল মফস্সল অঞ্চলের একটা বড় গাছে — হঠাৎ দেখলো একজন লোক টেবিলের উপর উপুড় হয়ে কি যেন লিখছে। একটু কৌতূহল হলো — তাই আমাদের সেই সদস্য দেখার জন্য তার চোখের মণিদুটো লেখকের মাথার উপর দিয়ে খাতার উপরে ঝুঁকিয়ে দেখলো আমাদের নিয়ে সেইসব ভুল কথা লিখে যাচ্ছে! তার লেখাটা একটু শুধরে দেবার জন্য যেই না একটু কথা বলেছে অমনি লেখক বাবাজি ভিরমি খেয়ে চেয়ার থেকে উল্টে পড়লো। কি লোক রে বাবা! ভূতের গল্প লিখবে আর ভূত যদি তার লেখার ভুল ধরে অমনি তাকে দেখে উল্টে পড়বে?এ আবার কেমন কথা বলুন তো?


    ।। ২ ।।


    পুলিশের চাকরির শুরুতেই অমর একবার একজন রাজনৈতিক নেতার ছেলেকে ইভটিজিংয়ের অপরাধে ধরে লকআপে পুরে দিয়েছিল। তখন কমবয়সে রক্ত গরম — মনে হতো দুনিয়া থেকে সব অন্যায়, সব পাপকে হঠিয়ে দেবে! কিন্তু সেটা যে কতবড় নির্বুদ্ধিতা সেটা বোঝার মতো অভিজ্ঞতা তখনও অমরের হয় নি। শুরুতেই অমরের প্রমোশন আটকে গেলো। তারপরে তার পোস্টিং হলো মুর্শিদাবাদের এমন একটি পুলিশ স্টেশনে যেখানে সারাদিনে কাজ বলতে একবার বা দু'বার জীপে চড়ে এলাকাটা একটু টহল দেওয়া, দু-চারটি চিঠি পত্রের উত্তর দেওয়া আর দু-একটি রিপোর্ট লেখা। সেই জনমানবহীন এলাকায় অমরের একান্ত কাছের লোক বলতে ও.সি. বিমলবাবু, একজন টাইপিস্ট অশোকবাবু, দুজন কনস্টেবল — সহদেব আর নিরঞ্জন, একজন পিওন — নিবারণ এবং ড্রাইভার মনোজ।

    বিমলবাবু প্রায়ই হাই তুলতে তুলতে বলেন, "জানো অমর, তোমার মতো বয়সে আমারও ওরকম মনে হতো — পৃথিবীটাকে আবর্জনামুক্ত করে দেব। সব অপরাধ মুছে দেব। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না! এখন মনে হয় এই বেশ আছি! কি দরকার ঝুটঝামেলায় গিয়ে? মন দিয়ে সংসার করবা বুঝেছো? একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করবা। যেখানে যা ইচ্ছে হয় হোক। শুধু যেটুকু না করলে নয়, সেইটুকুই করবা। বাকি সব ঈশ্বরের খাতায় তুলে দাও!"

    অশোকবাবু টাইপ করতে করতে মিটিমিটি হাসেন। ওনার টাইপিং স্পিড দেখলে অমরের মনে হয় সে নিজেই বসে টাইপ করে নেয়। কিন্তু সেটা করলে ওনার প্রেস্টিজে লাগবে ভেবে করে না!

    থানা থেকে বেরিয়ে একটু হেঁটে গেলেই অমরের কোয়ার্টার। শুধু মাঝে পড়তো একটা পরিত্যক্ত লাশকাটা ঘর। বরাবরের ডাকাবুকো অমর কোনো কিছুতেই ভয় পেতো না। কিন্তু শুধু ওই ঘরটার দিকে চোখ পড়লেই কেন জানে না, গা-টা একটু ছমছম করে উঠতো!

    কাজ যতই কম থাক, সারাদিন ধরে ডিউটি করে এসে অমরের আর রান্না করতে ইচ্ছা করতো না। স্থানীয় একটি ছেলে গড়াই ওর খাবার দিয়ে যেত — প্রায় প্রত্যেক দিন একই মেনু — ভাত, মুসুরডাল, আলুর চোখা আর একটি ডিমভাজা। কোনো কোনো দিন আলুভাতের বদলে থাকতো একটু তরকারি। এতেই মাসে হাজার টাকা করে নিতো।

    ছেলেটার মুখে শুনেছিল ওর বাবা আগে ওই লাশকাটা ঘরে চাকরি করতো। কিছু বছর হলো সেই মর্গটা এখন দূরে একটা হাসপাতালে স্থানান্তরিত হওয়াতে ওর বাবা রোজ সেখানে সাইকেলে করে যাতায়াত করে। ছেলেটা বলেছিল, "একটু সাবধানে যাতায়াত করবেন বাবু। ওখানে বড্ডো ভূতের আড্ডা।"

    সেটা শোনার পর থেকে রাতে ফেরার সময়ে সেই গা ছমছমে ভাবটা অমরের আরো একটু বেড়ে গিয়েছিল। কোন দিকে না তাকিয়ে সোজা চলে আসত সে।


    ।। ৩ ।।


    এখন যেখানে আমরা আছি সেটা একটা পুরোনো লাশকাটা ঘর। বড় পিচরাস্তার একপাশে এই লাশকাটা ঘর আর অন্য পাশে আদিগন্ত একটা মাঠ ও চাষের জমি। সামনের এই রাস্তা দিয়ে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত হাতে গোনা লোকজন যাতায়াত করে। সন্ধের পর তো নৈব নৈব চ। তবে শহর থেকে একজন নতুন দারোগাবাবু এসেছেন। তিনি রাতের বেলা নিজের বাসায় ফেরেন। কোনোদিকে তাকান না, সোজা হেঁটে, বলতে গেলে দৌড়ে পার হয়ে যান এই জায়গাটা।

    ভোটের আগে ওই মাঠে একটা মিটিং হয়েছিল। তখন একজন জনদরদী নেতা ভক্তিবাবু বলেছিলো এই রাস্তা আরও চওড়া হবে। হাই রোড হবে, সারাদিন ধরে অনেক গাড়ি হু হু করে ছুটবে। রাস্তার দু'ধারে দোকান বসবে। সেদিন আমাদের বিশেষ সংবাদদাতা কানমোড়া বলছিলো, এই রাস্তার জন্য টেন্ডার বেরোবে। আর কিছুদিনের মধ্যেই ভাঙ্গা হবে এই লাশকাটা ঘর! তাই আমাদের মনে খুব দুঃখ — অনেকদিনের ঠাঁই ছেড়ে কোন অচেনা-অজানা জায়গায় আবার আস্তানা গড়তে হবে ভেবে! আমাদের এইসব দুঃখের কথা মানুষ জানেও না, জানতেও চায় না। তারা শুধু আমাদের নিয়ে মজার মজার কথা লেখে; নয়তো বদনাম করে বেড়ায়।

    যাকগে সে-সব দুঃখের কথা। আমাদের অনেকের মনেই নানা ধরনের দুঃখ আছে। অনেকেই খুব কমবয়সে এই ভূতের দলে নাম লিখিয়েছে। যেমন পা-কাটা ভুতোর কথাই ধরা যাক, বেচারা ট্রেনে বাদাম বিক্রি করতো। একদিন চলন্ত ট্রেনে লাফ দিয়ে উঠতে গিয়ে নিচে পড়ে গেল। কাটা গেলো একটা পা। সরকারি হাসপাতালে বিনা চিকিৎসায় ফেলে রাখলো — সারা শরীরটা পচে গিয়ে বেটা মরেই গেলো! কেউ ওর জন্য কিচ্ছু করলো না — শুধু ওর বৌ বাচ্ছারা কেঁদে কেঁদে তাদের চোখের জল একদিন শুকিয়ে গেলো!


    ।। ৪ ।।


    আজ আমাদের পা-কাটা ভুতো এসে খবর দিয়েছে ওই উত্তর দিকে পেয়ারাতলার ওখানে একটা পোড়ো বাড়ির খোঁজ পাওয়া গেছে। খবর পাওয়া মাত্র আমাদের ইনভেস্টিগেশন এজেন্সী সরেজমিন তদন্ত করতে চলে গেলো খবরের সত্যতা যাচাই করার জন্য। আজ সন্ধেবেলায় আমড়াতলায় এসে তারা তাদের রিপোর্ট পেশ করবে। আমরা বেশ উৎকণ্ঠায় আছি — কি হয় জানার জন্য।

    আজ সন্ধেতে আমাদের ইনভেস্টিগেশন এজেন্সী যা রিপোর্ট দিয়েছে তাতে ওই পেয়ারাতলার বাড়িটা আমাদের থাকার পক্ষে সব দিক দিয়ে বেশ উপযুক্ত। আমাদের মধ্যে তাই আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে! আমাদের দলপতি ভবানী বুড়ো থুড়ি ভবানী খুড়ো বলেছে, "এই আনন্দে আজ রাতে পার্টি দেওয়া হবে!" তাই আমরা দলের সদস্য মদনকে পাঠিয়েছি সঞ্জয়ের দোকান থেকে চিকেন আনার জন্য। স্টেশন চত্বরের লাগোয়া সঞ্জয়ের মিট শপ — খুব বিক্রি হয়। ছেলেটা খুব ভালো, পরিশ্রমী। রাতটা একটু গভীর হতে শুরু করেছে। এবার সঞ্জয় দোকান বন্ধ করবে। এখনই চান্স নিতে হবে।


    ।। ৫ ।।


    মদন আমগাছের মগডাল থেকে সুড়ুৎ করে নেমে এলো। একদম শব্দ না করে দোকানের পিছনে রাখা মুরগির খাঁচাটা খুলে যেই না চারটে মুরগি টপাটপ বের করে নিয়েছে অমনি সবক'টা মুরগি মিলে এমন "কোঁকর ক" করে চেঁচিয়ে উঠলো যে মদন অবধি ঘাবড়ে গিয়ে একটা মাটিতে ফেলে দিয়ে বাকি তিনটে নিয়ে একেবারে আমগাছের মগডালে উঠে গেলো! সঞ্জয় "চোর চোর" করে চেঁচিয়ে উঠেছে। অন্যান্য দোকান থেকেও লোকজন ছুটে এলো।

    সবাই দেখে বলল, "চোর তিনটে নিয়ে গেছে রে সঞ্জয়। তোর অনেক টাকা লস হলো! তবে এই মুরগিটাও বাঁচবে বলে মনে হচ্ছে না। এর ডানা ছিঁড়ে দিয়েছে। ঘাড়টাও কেমন বেঁকে গেছে। এটাকে এখনই কেটে এর মাংসটা বেচে দে।"

    — কিন্তু চোর পালাল কোন দিক দিয়ে?এখানে কাদামাটিতে কোনো পায়ের ছাপও নেই তো!

    এবার সবাই সেই নিয়ে পড়লো। অনেকেই হাতের টর্চটা বাগিয়ে ধরে মাটিতে আলো ফেলে তদন্ত করতে লাগলো।

    — সত্যি তো! এ তো ভারি আজব ব্যাপারই বটে! চোরের পায়ের দাগও নেই। কাদামাটি দিয়ে সে ছুটে পালালোই বা কি করে?

    — এতো তাড়াতাড়ি কি মানুষের পক্ষে পালালো সম্ভব?

    — আর দেখো, পায়ের ছাপও কিচ্ছু পড়ে নি। কি তাজ্জব ব্যাপার!

    সবাই যখন এই নিয়ে তদন্ত করছে ততক্ষনে মদনের আনা মুরগিগুলো ড্রেসিং করে আমাদের শেফ কাম হেড অফ দ্যা ফুড ডিপার্টমেন্ট হারাধন মাংসটা ম্যারিনেট করে ফেলেছে। ঘন আমবাগানের গভীরে জঙ্গলের মধ্যে রান্না হচ্ছে বিরিয়ানি। মাটিতে গর্ত করে উনুন বানানো হয়েছে, ডেকোরেটরের দোকান থেকে আনা হয়েছে মস্ত বড় হাঁড়ি। চল্লিশজনের পাত পড়বে আজ! আমাদের দলের সদস্য সংখ্যা মোটেও কম ছিল না। তার উপর এই রিসেন্ট ডেঙ্গিতে আরও কয়েকজন এসে যোগ হয়েছে। তাও তো আমাদের বন্ধু-বান্ধবদের খবর দেওয়া হয় নি, তাহলে সংখ্যাটা আরও বাড়তো।


    ।। ৬ ।।


    দোকানি সঞ্জয় সমেত আরো অনেকে গেছে থানাতে মুরগি চুরির রিপোর্ট লেখাতে। চুরির পদ্ধতি শুনে নতুন এস. আই. অমরবাবু বেশ অবাকই হলেন। মাটিতে চোরের পায়ের ছাপ পড়ে নি? এ কি করে সম্ভব? তাছাড়া এদিকে লোকবসতি কম; চোর এলো কোথা থেকে আর গেলোই বা কোথায়? যাহোক, রিপোর্ট লিখে ওদের বিদায় করে অমরের আজ কোয়ার্টারে ফিরতে একটু বেশি রাত হয়ে গেলো — এখন ঘড়িতে রাত্রি সাড়ে নয়টা বাজে। গ্রামের দিকে রাত্রি সাড়ে নয়টা মানে অনেক রাত। অনেকেই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ে। অমর কোয়ার্টারে ঢুকতে গিয়ে দেখলো গড়াই ভূতের মতো বারান্দায় ওঠার সিঁড়িতে বসে আছে।

    — কি রে কি হলো?

    — আজকে মা রান্না করতে পারে নি। জ্বর হয়েছে তাই। যদি টাকা দেন হোটেল থেকে খাবার এনে দিচ্ছি।

    হোটেল মানে সেই স্টেশনের কাছে। অনেকটা হেঁটে যেতে হয়। তাছাড়া এখন তো হোটেল বন্ধ করার সময় হয়ে এলো। এখন একদম শেষের দিকের চাঁচাপোঁছা খাবারগুলো খেলে পেটের অসুখ করবে। তার থেকে থাক বরং।

    — তুই যা, এখন আর খাবার কিনতে যেতে হবে না। আমি বরং পাঁউরুটি-দুধ খেয়ে নেবো।

    গড়াই চলে গেলো। অমর হাতমুখ ধুয়ে, জামাকাপড় চেঞ্জ করে কেরোসিনের স্টোভটা জ্বালাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু সেটার কেরোসিনের অবস্থা এতটাই খারাপ যে শুধু ধোঁয়ায় ঘর ভরে যেতে লাগলো। অগত্যা জল গরম করে গুঁড়ো দুধ গোলা আর হলো না! একদিনের বাসি, শক্ত, শুকনো পাঁউরুটিটা অর্ধেকটা খেয়ে বাকি অর্ধেকটা ফেলে দিয়ে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে, আলো নিভিয়ে তক্তপোষে শুয়ে পড়লো সে। কোথায় মায়ের হাতের গরম গরম খাবার আর কোথায় এই শুকনো পাঁউরুটি! চোখে জল আসছিলো তার। মনে পড়ছিলো, থানায় দাঁড়িয়ে সেই রাজনৈতিক নেতার হুঙ্কার, "তোকে এমন জায়গায় পোস্টিং করবো যে চোখের জল ফেলতে হবে! আমার ছেলেকে লকআপে ভরা?"

    নিজের পোড়া কপালের কথা ভাবতে ভাবতে সত্যি সত্যি অমরের চোখ বেয়ে দু'ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। হঠাৎ সে কোথা থেকে বিরিয়ানির সুগন্ধ পেয়ে লাফিয়ে উঠে বসলো তক্তপোশের উপর। কয়েকবার নাক টানলো সে, নাঃ, সত্যি সত্যিই বিরিয়ানির গন্ধ! আসছে কোথা থেকে? অমর ওর ঘরের দরজাটা খুলে অবাক হয়ে গেলো, দরজার পাল্লায় একটা পলিথিন প্যাকেট ঝোলানো রয়েছে। তার ভিতরে একটা বাক্স — চাউমিনের বাক্সের মতো। এটা বুঝতে দেরি হলো না যে সুগন্ধটা ওর ভিতর থেকেই আসছে! অমর দ্রুত বাক্সটা খুললো। সত্যিই তার ভিতরে বিরিয়ানি রয়েছে! কিন্তু এলো কোথা থেকে? কে দিয়ে গেলো? তবে কি গড়াই আবার এসেছিলো? কিন্তু এতরাতে বিরিয়ানি পেলো কোথায়? তাকে না ডেকে দরজায় ঝুলিয়ে রেখে গেলো কেন? খাওয়া কি ঠিক হবে? যাক গে, প্রচণ্ড ক্ষিদের মুখে সে আর থাকতে পারলো না। যা হবার হবেখন, এই ভেবে সে খেতে শুরু করলো।

    ওদিকে নিমগাছের ডাল থেকে খিঁক খিঁক করে হাসলো আমাদের শাঁকচুন্নি ক্ষান্তখুড়ি। সে বেচারির দয়ার শরীর। কারো দুঃখকষ্ট দেখতে পারে না। অমর যখন শুকনো পাঁউরুটি চিবোচ্ছিলো তখন ক্ষান্তখুড়ি গাছের উপর থেকে সেটা দেখতে পেয়ে ভীষণ কষ্ট পেয়েছে। আমরা বিরিয়ানি খাবো আর ওই নিরপরাধ ছেলেটা পাঁউরুটি খাবে? দেশে কি বিচার বলে কিছু নেই? তাই আমাদের ক্ষান্তখুড়ি কোথা থেকে একটা চাউমিনের প্যাকেট আনিয়ে তাতে বিরিয়ানি ভরে পাঠিয়ে দিয়েছে!

    খাওয়ার পরে অমর একটা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললো, সত্যি এতো সুন্দর বিরিয়ানি সে বহুকাল খায় নি। কলকাতায় থাকতে সে আরসিয়ানা, আমিনা বা সিরাজের বিরিয়ানি খেয়েছে — কিন্তু এর স্বাদ তার থেকে কিছু কম বলে মনে হলো না!


    ।। ৭ ।।


    আজ আমাদের গৃহপ্রবেশ। নতুন বাড়িতে এসেই যে যার নিজের পছন্দমতো জায়গা বেছে নিচ্ছে। তবে একতলার পুরোনো রান্নাঘরটা হারাধনের দখলেই থাকবে। আমাদের ভবানী খুড়ো থাকবেন তেতলার সবচেয়ে সরেস ঘরখানিতে! কাঠা দশেক জায়গা জুড়ে মস্তবড় বাগান ও বাড়ি। অব্যবহারে ধুলো আর ঝুল জমেছে ঘরে ঘরে, বাড়ির গায়ে চতুর্দিকে বট-অশ্বত্থের চারা জন্মেছে। একদা সুন্দর সাজানো বাগানটা ঝোপজঙ্গলে ভরে আছে।

    গৃহপ্রবেশ উপলক্ষে আমাদের পুজোপাঠ কিচ্ছু হয় না, তবে নাচ-গান, খানা-পিনা হয় খুব! ভবানী খুড়োর কড়া হুকুম আনন্দ অনুষ্ঠান হলেও বেহিসাবী হওয়া চলবে না।

    ভবানী খুড়ো নিজে মাছ-মাংস ছোঁন না — কারণ সাত্বিক ব্রাহ্মণ ছিলেন তো। তবে আজ আমাদের জমিয়ে খাওয়া-দাওয়া হবে। ফ্রয়েড রাইস, কষা মাংস, ফুলকপির তরকারি, চিংড়ির মালাইকারি, আমসত্ত্ব-খেজুরের চাটনি আর প্রথমেই গরমাগরম ডিমের ডেভিল!

    খাওয়া-দাওয়ার পরে আমরা ছাদে এলাম, পুরোনো দিনের নকশা করা থাম আর পাঁচিল দিয়ে ঘেরা মস্তবড় ছাদ — এখানেই বসবে গানের আসর। আমাদের টিমে অনেক নতুন-পুরোনো সংগীত-শিল্পীরা তো আছেই, তার সাথে একজন বাঁশিবাদক নতুন সদস্য হিসাবে যোগ হয়েছে। বুড়ো লোকটা নিজেই বানাতো আড়বাঁশি — রাস্তায় রাস্তায় বাঁশি বিক্রি করতো। কিন্তু কলকাতার ব্যস্ত পথেঘাটে সে বাঁশির কদর করবে কে? একদিন বাঁশি বাজাতে বাজাতে রাস্তার ধার দিয়ে যাচ্ছিলো সে — হঠাৎ একটা বেপরোয়া গাড়ি পিষে দিয়ে যায় তাকে। রাস্তা জুড়ে ছড়িয়ে যায় তার কাঠের বাঁশিগুলি। রক্তমাখা বাঁশিগুলো যেন নীরবে বিচার চাইছিলো! আজ সে আমাদের শোনালো তার সেই মন কেমন করা সুর! চোখবুজে শুনলে মনে হয়, জ্যোৎস্নারাতে অনেক দূরে কোথাও কোনো নদীর ধার ধরে হেঁটে চলেছি। সে রাতে আমাদের জলসা জমে উঠলো খুব। সবার সাথে ভবানী খুড়োও ঘন ঘন তারিফ করতে লাগলেন শিল্পীদের।


    ।। ৮ ।।


    ইতিমধ্যে কোনো প্রাকৃতিক কাজ করতে কেউ ছাদের থেকে নেমে দূরে কোথাও গিয়েছিলো বোধহয় — সে শুনতে পেলো কোনো একটা বাড়িতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে খুব ঝগড়া হচ্ছে। পণ নিয়েই সমস্যা বলে মনে হয়েছে তার। স্বামী স্ত্রীকে খুব মারছিলো — হাতের সামনে যা পাচ্ছে তাই দিয়ে। আর বৌটা পরিত্রাহি চিৎকার করছে! অথচ কোনো বাড়ি থেকে কেউ এসে বৌটাকে বাঁচাচ্ছে না। আমাদের দলের সদস্য একটা বড় লাঠি জানলা দিয়ে গলিয়ে দিলো — বরটাকে বেধড়ক পেটাল। বৌটাকে ছেড়ে সে তখন নিজেকে বাঁচাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

    লোকটা ওরকম অবাক মার খেয়ে ভীষণ ঘাবড়ে গেলো — অজ্ঞানই হয়ে গেলো শেষে! বউটাও জানালার বাইরে কাউকে দেখতে না পেয়ে শুধু দু'হাত জোড় করে একটা পেন্নাম ঠুকলো — কোন দেবতা কিংবা অপদেবতা তাকে রক্ষা করলো বুঝে উঠতে পারল না সে।


    ।। ৯ ।।


    অমর ঘুম থেকে উঠে দেখলো আজ সকালে ঝকঝকে রোদ উঠেছে। শরীরের আড়মোড়া ভাঙার পরে সে অনুভব করলো কাল রাতে বিরিয়ানি খাওয়ার পরেও তার কোনোরকম হজমের গোলমাল হয় নি। শরীর একদম ফিট আছে। কিন্তু কাল রাতে বিরিয়ানিটা কে রেখে গেলো সেটা সে কিছুতেই ভেবে ঠিক করে উঠতে পারলো না।

    এখানে তার পরিচিত বিশেষ কেউ নেই। অনাত্মীয়, নির্বান্ধব এই পরিবেশে তার জন্য কে এতো চিন্তা করতে পারে তা সে ভেবে পেলো না। থানায় গিয়ে পরিচিত সকলকে কথাটা বলতে কেউ বিশ্বাসই করলো না। ও.সি. বিমলবাবু বললেন, "আমার মনে হয় তুমি ওটা স্বপ্নেই দেখেছো।"

    — কিন্তু আমি যে খালি বাক্সটা আজ সকালেও দেখেছি।

    — হয়তো কাকে-টাকে কোথাও থেকে নিয়ে এসেছে।

    আমার চুপ করে গেলো। এদের সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। নিজের কাজে মন দিলো সে। গতরাতে মুরগি চুরির একটা মীমাংসা করতে হবে। হঠাৎ একজন কনস্টেবল এসে খবর দিলো স্টেশনের পিছন দিকের একটা জঙ্গল থেকে কুকুররা মুখে করে মুরগির রক্তমাখা ডানা এনে খাচ্ছিলো — সে নিজের চোখে দেখে এসেছে। ওখানে অনেক মুরগির পালক পড়ে আছে। লোকে ভিড় করেছে সেখানে। শুনেই অমর তার সাথে সেখানে গেলো। সত্যিই সেখানে কয়েকটা মুরগির মাথা, ডানা, রক্তমাখা পালক ইত্যাদি পড়ে আছে।

    সঞ্জয় বলছে, ওগুলো তার দোকানেরই মুরগি। জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে দেখা গেলো, একটা বড় গর্তের মধ্যে পোড়া কাঠ ও ছাই রয়েছে। পাশেই একটা বড় হাঁড়ি। ক্যাটারার দোকানি দাবি করলো হাঁড়িটা তার। অর্থাৎ চোররা মুরগি এবং হাঁড়ি চুরি করে এখানে বসেই পিকনিক করেছে। অনেক খুঁটিয়ে দেখেও অন্য কোনো চিহ্ন, যেমন পায়ের ছাপ, সিগারেট-বিড়ির টুকরো বা অন্য কিছু দেখা গেলো না।

    এ কেমন চোর?


    ।। ১০ ।।


    রাতে কোয়ার্টারে ফিরে গড়াই আসতেই আবার গতরাত্রির বিরিয়ানির কথাটা মাথায় এলো। অমর জিজ্ঞাসা করতেই সে বললো, সে বিরিয়ানির কথা কিছু জানেই না।

    গতরাতে তার মায়ের খুব জ্বর ছিল, তাই সারারাত ধরে সে মায়ের মাথায় জলপট্টি দিয়েছে। ভোরের দিকে জ্বরটা একটু কমতে মাকে নিয়ে নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়েছিলো ডাক্তার দেখাতে। ডাক্তার ওষুধ দিয়েছে। আর রক্ত পরীক্ষা করতে বলেছে। আজকেও ওর মা রান্না করতে পারে নি। তাই হোটেল থেকে রুটি-তরকারি কিনে এনেছে|

    অমর ওকে রুটি-তরকারির দাম দিয়ে দিল। আর বলে দিলো যতদিন না ওর মায়ের শরীর ঠিক হচ্ছে ততদিন যেন হোটেল থেকে রুটি আর তরকারি কিনেই দিয়ে যায়।

    গড়াই চলে যাওয়ার পরেই অমর ভাবতে লাগলো, তবে কি মুরগি চোরেরাই ভাগ দিয়ে গেলো যাতে এই নিয়ে কোনো তদন্ত না হয়? ছি, ছি, সে অজান্তে পাপ করে বসলো, মুরগি চোরেদের কাছ থেকে ঘুষ হিসাবে দেওয়া বিরিয়ানি খাওয়া তার উচিত হয় নি।


    ।। ১১ ।।


    আমাদের এখন বাইরে বেড়োবার উপায় নেই, আমরা যে ভূত! তাই রাতের সৌন্দর্যই আমাদের উপভোগ করতে হয়, দিনের আলো আমাদের সহ্য হয় না মোটে।

    সারাটাদিন ঘুমিয়ে কাটিয়ে আমরা আজ সন্ধেবেলায় আবার সবাই মিলে ছাদে গেলাম। নিচে রান্নাঘরে তখন হারাধনদা আমাদের জন্য ইলিশ পাতুরি আর রুই মাছের মাথা দিয়ে মুড়িঘন্ট বানাচ্ছে! আমাদের মধ্যে রামু যাদবের নাকটা খুব লম্বা — ও অনেক দূর থেকেও গন্ধ পায়। হঠাৎ সে তড়বড়িয়ে উঠলো। সবাই বলে উঠলো, "কি হলো? কি হলো? কোনো খারাপ গন্ধ?"

    সে বললো, "উঁহু, যেন রসগোল্লার গন্ধ পাচ্ছি!"

    — রসগোল্লা? কোথায়? কোথায়?

    হারান পাগলার ডাক পড়লো। সে সেই ভূতের গল্পলেখককে ভুল শুধরে দিতে গিয়ে বিপত্তি বাধিয়েছিল। হারান এসে তার চোখের মণিদুটো লম্বা করে দেখে জানালো — "ওই দূরে একজনদের বাড়িতে বিয়েবাড়ির ভিয়েন বসেছে। ওখান থেকেই আসছে রসগোল্লার গন্ধ।" ব্যাস। আমাদের টিম উঠে পড়ে লাগলো এক গামলা রসগোল্লা আনার জন্য।

    ভিয়েন থেকে ভাঁড়ার ঘরে ট্রান্সফার হওয়া মাত্র আমাদের সদস্যরা এক গামলা রসগোল্লা হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে চলে এলো! আর গরম গরম রসগোল্লা পেয়ে রাতের খাওয়া-দাওয়া আরও জমাটি হলো। এদিকে হলো কি, বিয়ে বাড়িতে যে ভাঁড়ারের দায়িত্বে ছিল সে বেচারা খুব মুশকিলে পড়লো। এক গামলা রসগোল্লা উধাও। এদিকে ভাঁড়ার ঘরে যেমনি তালাচাবি দেওয়া তেমনি আছে! কি করে সম্ভব?

    ভাঁড়ার ঘরের চাবি ছিল তার দায়িত্বপ্রাপ্ত জগুবাবুর কাছে, কোমরের খুঁটে বাঁধা ছিল চাবি। তাই সবাই তাকেই সন্দেহ করছে। অথচ তিনি সশরীরে উপস্থিত ছিলেন ভিয়েনের কাছে। অনেকেই দেখেছে। তাহলে তিনি কি চাবিটা কিছুক্ষনের জন্য কাউকে দিয়েছিলেন? কিন্তু ভাঁড়ার ঘরের সামনেও একজন মজুত ছিল। সে কি কোথাও সরে গিয়েছিলো? এই নিয়ে বিয়ে বাড়িতে চলতে লাগলো ফিসফাস, কানাকানি!


    ।। ১২ ।।


    বাবার সাথে ফোনে কথা বলে অমর জানতে পারলো মায়ের শরীরটা বিশেষ ভালো যাচ্ছে না। ছেলের জন্য চিন্তা করতে করতে তাঁর প্রেসার হাই হয়ে গেছে। সঙ্গে আরো কিছু উপসর্গ দেখা দিয়েছে। একদিন মাথা ঘুরে পড়ে যেতে যেতে বেঁচে গেছে। অমর ভাবলো একবার দিনকয়েকের ছুটি নিয়ে মাকে দেখে আসে। কিন্তু এদিকে দিন দুয়েক পরেই "সরবকণ্ঠ" দলের সভাপতি ও পূর্তমন্ত্রী ভক্তিবাবু আসছেন সদলবলে এখানে মিটিং করতে। তখন অমরকে ডিউটিতে থাকতেই হবে। বেলা সাড়ে বারোটায় ভক্তিবাবু এখানে একটি কলেজ উদ্বোধন করবেন, ভাষণ দেবেন। তারপরে ডি.এম.-এর সাথে একটা মিটিংয়ের পর পার্টির দলীয় কার্যালয়ে দ্বিপ্রাহরিক ভোজ সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে পরিত্যক্ত মর্গের উল্টো দিকের মাঠে মিটিং করবেন। তারপরে টানা ফিরে যাবেন কলকাতায়।

    এই ভক্তিবাবুই হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যাঁর কোপে অমরের এখানে পোস্টিং। লোকটাকে শয়তান বললেও কম বলা হয়। হেন অন্যায় কাজ নেই যা ও করতে পারে না! ওর প্রতি কারো কোনো ভক্তিভাব জন্মায় না, শুধু দলের ছেলেগুলো বাদে। অমরের হাত নিশপিশ করে লোকটাকে আড়ংধোলাই দেবার জন্য; কিন্তু সেটা যে সম্ভব নয় সেটা ও ভালোই বোঝে। ওর ছেলেকে সামান্য কিছুক্ষনের জন্য লকআপে ভরতেই ওকে এমন শাস্তি দিলো! মারধর দিলে তো আর দেখতে হবে না।

    অমর নিমপাতা খাওয়ার মতো মুখ করে। কি কুক্ষণে যে চাকরির শুরুতে ওর ছেলেকে লকআপে ভরতে গিয়েছিলো। নাহলে আজ ওকে এমন বিদেশ-বিভূঁইতে পোস্টিং পেতে হতো না। মায়ের কথা ভাবলে ওর চোখে জল আসে!


    ।। ১৩ ।।


    আমাদের অনাথ স্যার গিয়ে খবর নিয়ে এসেছেন ভূতের গল্পের বইটা প্রকাশের পথে। অবশ্য প্রুফ রিডিং করে তিনি যা বুঝেছেন তা হলো আমাদের কাজ কারবার নিয়ে যাচ্ছেতাই সব কথা লেখা হয়েছে তাতে। আমরা নাকি লোককে অকারণে গলা টিপে মারি, লোককে ভুলিয়ে ভালিয়ে দূরে নির্জনে টেনে নিয়ে গিয়ে রক্ত চুষে খাই ইত্যাদি ইত্যাদি। কি মহা অন্যায় বলুন তো? তাই আমাদের ভবানী খুড়োর নির্দেশে আমাদের একটা সংগঠন তৈরি হলো, নাম দেওয়া হলো "ভুতুড়ে প্রতিবাদী পরিষদ" — আজ আমাদের সংগঠনের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হবে বিকেল ৬ ঘটিকায় আমাদের 'ভূতের বাড়ি'র থুড়ি আমাদের 'ভূত-আবাসন'-এর ছাদে। এতে শুধু আমাদের দলের লোকজনেরাই নয়, কিছু নিমন্ত্রিত অতিথিরাও আসবেন। তাই সকাল থেকেই হারাধনদার ব্যস্ততার শেষ নেই। সে রন্ধনে সহায়ক কর্মীদের নানা রকমের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছে — "এই, তুই এটা কর। সুবল, তুই ভেটকি মাছটা ভাপিয়ে দে। গনু, তুই মশলা বেটে দে।" রান্নাঘরে ও তৎসংলগ্ন বারান্দায় আজ বেজায় ব্যস্ততা। ছাদে প্যান্ডেল হচ্ছে, চেয়ার পাতা হচ্ছে — ভবানীখুড়ো সর্বত্র ঘুরে ঘুরে তদারকি করছেন।

    আজ বিকেলের মেনু ঠিক হয়েছে — চিকেন পকোড়া, ভেটকির ফ্রাই, ডিমের ডেভিল আর গরম গরম কফি। রাতে বসিয়ে খাওয়া দাওয়া। তার মেনু — ভাতের সাথে নারকেল দিয়ে মুগের ডাল, ফুলকপির তরকারি, চিতল মাছের মুইঠ্যা, চিংড়ির মালাইকারি, রুই মাছের কালিয়া, মুড়িঘন্ট, তোপসে মাছ ভাজা, জলপাইয়ের চাটনি, আর শেষ পাতে বড় বড় রাজভোগ আর আইসক্রিম!

    সভার শুরুতে অনাথস্যার উঠে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, "মাননীয় সভাপতি মহাশয় ও উপস্থিত বন্ধুগণ, আজ আমরা একটা বড় সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। তাই এখানে সমবেত হয়েছি। এর একটা প্রতিকার হওয়া দরকার বলে আমরা সবাই মনে করছি! আমরা দেখছি যে, বহুদিন ধরেই আমাদের নিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও গল্পের বইতে যা খুশি তাই লেখা হচ্ছে। অথচ এর কোনো প্রতিবাদ হচ্ছে না বলে উত্তরোত্তর তা বেড়েই চলেছে। আমরা চাই এর একটা বড়োসড়ো প্রতিবাদ হোক — তাই এই সংগঠন। আপনারা সবাই আমাদের সাথে থাকুন — আমরা সমস্ত লেখক, লেখিকা ও সম্পাদক মণ্ডলীকে প্রথমে চিঠি পাঠাবো, তারপর রাস্তা অবরোধ করবো। আমাদের মিছিল আগামী ১৫ই ডিসেম্বর ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড থেকে শুরু হয়ে ভবানী ভবনের সামনে গিয়ে শেষ হবে। আমরা এর প্রতিবাদ করতে চাই! আমরা এর তদন্ত চাই। আশা করি আপনারা সবাই আমাদের সঙ্গে থেকে সাহায্য করবেন। আজ আর বেশি কিছু বলতে চাই না — অন্যরা বলার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে শেষ করছি।"

    আরো অনেকেই অনেক কিছু বললেন। ভবানী খুড়ো বললেন, "দীর্ঘ দিন ধরেই আমাদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টা, মজা-মস্করা হচ্ছে। আমাদের বিরুদ্ধে অনেক খারাপ কথা লেখা হচ্ছে। তাই আমরা এর প্রতিবাদ করতে চাই। আমরা যে ভদ্রলোক এটা মানুষদের বোঝানো দরকার! তাই এই সভা থেকে আমরা শপথ গ্রহণ করছি যে, আমরা বিনা অস্ত্রে, বিনা রক্তক্ষয়ে, অহিংস পদ্ধতিতে এর প্রতিবাদ করবো ...আশা করি আপনারা সবাই আমাদের সঙ্গে থাকবেন।"

    সভা শেষ হওয়ার সময়ে সমস্বরে ধ্বনি উঠলো, "ভূত সমাজ — একজোট হও! অন্যায়ের প্রতিবাদ হোক। ইনকিলাব জিন্দাবাদ! আমাদের নামে যা খুশি লেখা চলবে না, চলবে না।"

    খাওয়াদাওয়ার পর অতিথিরা একে একে বিদায় নিলেন। তারপর আমরা সবাই খেতে বসলাম। ভবানী খুড়ো আর অনাথ স্যার খেতে খেতে আলোচনা করতে লাগলেন কিভাবে ১৫ই ডিসেম্বরের কার্যসূচি সফল করা যায়।


    ।। ১৪ ।।


    একটা আশার কথা অমরের মাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় নি। ওষুধের মাধ্যমেই তিনি অনেকটা সেরে উঠেছেন। প্রেশারটাও অনেকটা কমেছে। আজকে একটু ভালো খবর পেয়ে মনটা ভালো আছে অমরের। এদিকে আজকের সংবাদপত্রের শিরোনামে দেখা যাচ্ছে গতকাল দুপুরে ভক্তিবাবুর আটমাসের নববিবাহিতা পুত্রবধূ মারা গেছে — সেটা আত্মহত্যা নাকি খুন তা বোঝা যাচ্ছে না। সেই নিয়ে ভক্তিবাবু বলেছেন, "ওর একটা অসুখ গোপন করে ওরা বিয়ে দিয়েছিলো, এখন সেটা প্রকাশ পেতে ও নিজেই আত্মহত্যা করেছে!" কিন্তু মিডিয়া ছাড়ছে না। তারা এটাকে খুন বলেই ইঙ্গিত করছে।কারণ কিছুদিন আগে মেয়েটি তার কোনো এক নিকট-আত্মীয়ের বাড়িতে বিয়েবাড়ির অনুষ্ঠানে গিয়ে তার কোনো একটা কথায় এরকম কিছুর আভাস দিয়েছিলো। বিভিন্ন সংবাদের চ্যানেলগুলোতে ও খবরের কাগজে এটাই এখন হট নিউজ। খবরটা জেনে অমরের যেমন দুঃখ হচ্ছিলো না-দেখা সেই মেয়েটির জন্য, তেমনি রাগ হচ্ছিলো ভক্তিবাবুর উপরে, যে তার এই দুর্দশার জন্যেও দায়ী।

    এই আচমকা ঘটনাপ্রবাহের বাঁকে ভক্তিবাবুর কলেজ উদ্বোধন ও মর্গের উল্টোদিকের মাঠে মিটিং দুটোই আপাততঃ স্থগিত হয়ে গেলো। ভক্তিবাবু এখনই আসছেন না শুনে সব থেকে বোধহয় অমরই খুশি হলো। ইতিমধ্যে অনির্বাণদা অমরকে ফোন করে জানালেন একবার ওকে কলকাতায় আসতেই হবে। খুব ভালো খবর আছে। তবে ফোনে সব কথা বলা যাবে না। অমর তো চাইছিলোই মায়ের কাছে যেতে। তার উপরে অনির্বাণদার ফোনটা ওকে আরও বেশি করে টানতে লাগলো কলকাতায়। সে দিন সাতেকের জন্যে দরখাস্ত করেছিল, কিন্তু মিললো চারদিন। তাই চারদিনের ক্যাজুয়াল লিভকে সঙ্গী করে সে কলকাতায় চললো।


    ।। ১৫ ।।


    বাড়ি পৌঁছতেই অমরের মা, ‘খোকা, কতদিন বাদে এলি রে’ বলে প্রথমে খুব কান্নাকাটি করলেন। তারপরে অমরের বাবাকে নানারকম জিনিসের তালিকা দিয়ে বাজারে পাঠালেন। নিজে একটি প্লাস্টিকের টুল নিয়ে রান্নাঘরের সামনে বসে রান্নার-দিদিকে অমরের পছন্দসই খাবার বানাবার জন্য নির্দেশ দিতে রইলেন। অমর স্নান সেরে প্রথমেই অনির্বাণদাকে ফোন করলো। অনির্বাণদা বললেন, "চলে আয়, আমি বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত আছি।"

    অমর বেরোচ্ছে দেখে ওর মা বললেন, "এখনই বেরোবি? একটু খেয়ে যা বাবা।"

    একটু? অমরের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো গেলো! প্লেটে সাজানো কড়াইশুঁটির কচুরি, আলুরদম, জলভরা তালশাঁস সন্দেশ, রাজভোগ, কাঁচাগোল্লা!

    — মা, তুমি কি করেছো? এতো কখনো একসাথে খেতে পারি?

    — পারবি বাবা, খেয়ে নে।না খেয়ে খেয়ে তুই কি রকম রোগা হয়ে গেছিস।

    জলখাবার খাওয়া শেষ করে অমর তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লো।


    ।। ১৬ ।।


    লালবাজারে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে পৌঁছতে বেলা দুটো বেজে গেলো। তখন লাঞ্চ আওয়ার্স। অনির্বাণদা ওকে দেখেই বললেন, "চল, কিছু খেয়ে আসি।"

    অমরের তখনও পেট ভর্তি। সকালের জলখাবারটা হেভি হয়ে গেছে। কিন্তু অনির্বাণদার সাথে কোথাও একান্তে বসে কথা বলা দরকার তাই দুজনে ছোটোখাটো একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলো। অনির্বাণদা একপ্লেট বিরিয়ানি নিলো। সেই দেখে অমরের সেই রাত্রিবেলায় বিরিয়ানির প্যাকেটের কথা মনে এলো। অনির্বাণদাকে সেকথা বলতেই সে হো হো করে একচোট হেসে নিলো। বললো, "তুই বোধহয় এই প্রথম ঘুষ খেয়ে ফেললি রে! তাও আবার অজান্তে। তা তোর মুরগি চোর ধরা পড়লো?"

    — নাহ্‌, মুরগি চোরেরা কোনো স্ট্রেসই রেখে যায় নি।

    — সেটা কি রকম? পায়ের ছাপ বা অন্য কিছু?

    — না গো। আর সেটাই তো রহস্য !

    — যাক গে, এখন যেটা বলছি সেটা মন দিয়ে শোন্। তোর জন্য অনেক তদবির করে কলকাতায় পোস্টিং-এর ব্যবস্থা করেছি! শুধু ধরবাবুকে একটা ট্রিট দিয়ে দিস।

    এরপর গলাটা আরো নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বললো, "ভক্তিবাবুর আর সেই পাওয়ার থাকবে না, দেখে নিস্। মুখ্যমন্ত্রী সাফ বলে দিয়েছেন, অন্যায় করলে শাস্তি পেতেই হবে! দলের লোক-টোক দেখা হবে না। কাজেই আর কিছু দিনের মধ্যেই মনে হয় বাপ্-বেটা দুজনেই জেলে যেতে পারে! শুধু ছেলের বৌয়ের মার্ডার কেসটাই নয়, ভক্তিবাবুর এখন দলের মধ্যেই ভাবমূর্তি নষ্ট হয়ে গেছে নানা কারণে। টেন্ডার স্ক্যামে জড়িয়ে পড়েছেন। স্কুলে প্যারা টিচার নিয়োগ কেলেঙ্কারিতেও ওনার নাম জড়িয়ে গেছে। তাছাড়া ওনার ছেলের সাথে দলের অনেকেরই বনিবনা হচ্ছে না।"

    এরপর অনির্বাণ অমরের কাঁধে একটা হাত রেখে বললো, "আজ রাতে কি করছিস? চলে আয় পার্ক স্ট্রিটে — ডিজে ডিস্কোতে।"

    — আমার ওখানে পোষাবে না অনির্বাণদা।

    — তুই কি রে? এখনো ছাপোষা বাঙালি থেকে গেলি? মদ খাস না, সিগারেট খাস না! তুই এই চাকরিতে টিঁকবি কি করে?

    অমর নিরুত্তর। অনির্বাণদাকে বোঝানো যাবে না। সে একটা আদর্শ নিয়ে বাঁচতে চায়। মদ-সিগারেট সে জীবনেও ছোঁবে না। অবসর সময়ে সে রামকৃষ্ণদেবের বাণী ও স্বামীজীর বাণী পড়ে। প্রতিদিন সকালে যোগাসন করে। স্নান সেরে পুজো করে। তারপর খায়। এখনকার দিনে এসব শুনলে লোকে হাসবে।


    ।। ১৭ ।।


    অনির্বাণদার কথাটা মিথ্যে হলো না। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলেছে, আত্মহত্যা নয়, ওটা খুনই। ভক্তিবাবুর ছেলেকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। আজকের কাগজের শিরোনামে লেখা আছে "মন্ত্রীর ছেলে খুনি: বধূ হত্যা, আত্মহত্যা নয়।" ভক্তিবাবু বলেছেন, "আমার ছেলে নির্দোষ। ওকে ফাঁসানো হয়েছে। এসব চক্রান্ত!"

    অমর কাগজ খুলেই সংবাদ শিরোনামে খবরটা দেখেই অনির্বাণদাকে ফোন করলো। অনির্বাণ বললো, "কিরে, তোকে বলেছিলাম না? এখন দেখ না কি হয়! আর হ্যাঁ, তোর পোস্টিং হচ্ছে তালতলা থানায়।"

    — আমার কিন্তু মনে হচ্ছে ভক্তিবাবু এতো সহজে হার মানবেন না।

    — কিন্তু আইন তো আইনের পথেই চলবে। দেখ না কি হয়।

    অমরের কেন জানি না খুব একটা আনন্দ হচ্ছে না। শুধু মনে একটা চাপা দুশ্চিন্তা। পোস্টিংটা ঠিকমতো হবে তো? অনির্বাণদা খুব একটা ভুল কথা বলে না, এটাই আশার কথা।


    ।। ১৮ ।।


    আগামীকালই অমরকে আবার মুর্শিদাবাদে ফিরে যেতে হবে। তাই আজ দুপুরে সে কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে গোটা কয়েক বই কিনলো। একটা বইয়ের নাম "সায়েন্টিফিক টেকনিকস ইন ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন"। এই বইটা পড়ার খুব ইচ্ছা ছিল ওর। বইগুলো কিনে ও রাস্তা পার হচ্ছে এমন সময়ে একটা সান্ধ্য খবরের কাগজ বিক্রেতাকে হাঁকতে শুনলো, "জোর খবর, জোর খবর! মন্ত্রী মশাইকে সি.বি.আই. তলব — টেন্ডার কেলেঙ্কারি! টেন্ডার কেলেঙ্কারি!" অমর একটা কাগজ কিনে নিয়ে বাসে উঠে পড়লো।

    ভক্তিবাবুর সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। একে ছেলে জড়িয়ে পড়েছে মার্ডার কেসে; আবার গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়ালো এই টেন্ডার স্ক্যাম! অমরের একবার মনে হলো, একেই বুঝি বলে, "ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।"


    ।। ১৯ ।।


    আমাদের নতুন সদস্যা হয়ে এসেছে মন্ত্রীমশাইয়ের ছেলের বৌ টুলটুলি। বেচারির চোখে-মুখে এখনো আতঙ্ক।

    — ওরে, তুই তো মরে ভূত হয়ে গেছিস! এখনো তোর ভয়টা কিসের?

    ওদিক থেকে ক্ষান্তখুড়ি চেঁচিয়ে বললো। ভবানী খুড়ো ঠোঁটের উপরে হাত রাখলো। মেয়েটা সবে এসেছে! এখনই ওকে এভাবে কষ্ট দিয়ে কথা বোলো না।

    ক্ষান্তখুড়ি আস্তে আস্তে ওর সাথে ভাব জমাচ্ছে। মেয়েটা সারাক্ষন চুপ করেই থাকে, কারো সাথে কথা কয় না।

    ছোটবেলা থেকে অনেক কষ্টে বাবা-মা বড় করেছিল। এম.এ. পাশ করে মেয়েটা সবে একটা স্কুলে চাকরিতে ঢুকেছে — অমনি ভক্তিবাবুর ছেলে ওকে বিয়ের প্রপোসাল দিয়ে বসলো। একটা ফাংশানে ওর গান শুনে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলো সে। অতো বড়োলোক মন্ত্রীর বাড়ি থেকে বিয়ের সম্বন্ধ — টুলটুলির বাবা-মা যেন হাতে চাঁদ পেয়ে বসলো। তড়িঘড়ি শুরু হলো বিয়ের আয়োজন। ভক্তিবাবুর প্রধান শর্তই ছিল, "স্কুলের চাকরি ছাড়তে হবে। আমাদের বাড়ির বৌ চাকরি করবে না।"

    ভক্তিবাবুরা অতো বড়োলোক হলে কি হয় — তাদের লোভের সীমাপরিসীমা ছিল না! টুলটুলির বাবা-মা ধারদেনা করে, সমস্ত আত্মীয়স্বজনের কাছে হাত পেতে টুলটুলিকে পার করলো। কিন্তু, ফুলসজ্জার দিন থেকেই সে বুঝে গেলো তার স্বামী একজন মাতালই শুধু নয়, তার নানারকমের চারিত্রিক দোষও আছে।

    শুধু তাই নয়, বিয়ের দুদিনের মাথা থেকেই শুরু হলো শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। ‘তোমার বাবাকে এই পাঠাতে বোলো, ওই পাঠাতে বোলো’ ছাড়াও শ্বাশুড়ির অনবরত বাঁকা বাঁকা কথা — দিনরাত তিনি বুঝিয়ে দিতেন, তুমি গরিব বাড়ি থেকে এসেছো, তোমাকে আমরা দয়া করে থাকতে দিয়েছি।


    ।। ২০ ।।


    একদিন টুলটুলি এসবের প্রতিবাদ করলো। ভক্তিবাবুর ছেলে তাকে থামে বেঁধে চাবুক দিয়ে পেটালো। মেয়েটা দুদিন ওই থামে বাঁধা অবস্থাতেই আধমরা হয়ে পড়ে রইলো। শাশুড়ির বক্তব্য ছিল, "অমন শাসন একটু-আধটু করতেই হয়।" ভক্তিবাবুর নব্বই বছর বয়সী মা একটু দয়াপরবশ হয়ে টুলটুলিকে বাঁধন খুলে দিয়ে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে অনেক সেবা শুশ্রূষা করলো। দিন কয়েক টুলটুলি বিছানাতেই পড়ে রইলো। ডাক্তার ডাকলেন না কেউ।

    টুলটুলি ওর মায়ের সাথে মাঝেমধ্যেই লুকিয়ে লুকিয়ে ফোনে কথা বলতো। দিন কয়েক মেয়ে কথা বলছে না দেখে তারা টুলটুলির খোঁজ নিতে এলেন। অপরিচিত লোকের মতোই তাদের দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়া হলো। তাঁরা প্রথমে থানায় গেলেন, থানা ডাইরি নিতে চাইলো না। তখন তাঁরা সংবাদপত্রের অফিসে গেলেন। তারা সাহস জোগালো।

    একটি এন.জি.ও. ওদের সাথে যোগ দিলো। তারাও সাহস যোগাতে লাগলো। আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী ও এন.জি.ও-র সহায়তায় পুলিশের কাছে ডাইরি করার পরে টুলটুলির খোঁজ মিললো। কিন্তু সে তখন আর জীবিত নেই। তখন সকলে মিলে এর প্রতিবাদ করতে ঝাঁপিয়ে পড়লো। সোশ্যাল মিডিয়ায়, টেলিভিশনে, সংবাদপত্রে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে গেলো।

    এমনিতেই ভক্তিবাবু দল থেকে বহিষ্কৃত, নানান স্ক্যামে জড়িয়ে গেছে নাম, তারপরে এই ঘটনা প্রকাশ পেতেই ব্যাপারটা যেন "গোদের উপরে বিষফোঁড়া" হয়ে গেলো!


    ।। ২১ ।।


    ভক্তিবাবু আর তাঁর ছেলের প্রতি কারো কোনোরকম ভক্তি ছিল না, শুধু সবাই ভয়েই ভক্তি করতো। এখন বেকায়দায় পড়ে গেছে দেখে সবাই তাদের নিজের নিজের ক্ষোভ উদ্গার করে দিতে লাগলো। দলের কিছু লোক বললো, "ওনাকে আমাদের দলে রাখাটাই ভুল হয়েছে! উনি আমাদের দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করে দিলেন।"

    ভক্তিবাবুর বাড়ির কাজের লোকেরা বললো, "আমরা কিছু জানি না, দেখি নি, তবে মাঝে মাঝে বৌদিমনি কাঁদতেন।" তবে টুলটুলি যেদিন মার খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো, সেদিন যে কাজের বৌটি গিয়ে তেতলায় ভক্তিবাবুর মাকে খবর দিয়েছিলো, সে যা যা দেখেছে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে।

    অতএব পাড়ার লোকেরা, আত্মীয়স্বজনেরাও ক্রমশঃ মুখ খুলতে শুরু করলো। চারিদিকে শুধু ছি ছি। ভক্তিবাবু আর তাঁর ছেলে জেলে বসে বসে দাঁত কিড়মিড় করছেন।


    ।। ২২ ।।


    ভক্তিবাবুর ছেলে যখন দেখলো মারের ব্যথা সহ্য করতে না পেরে, খাদ্যাভাবে অপুষ্টিতে রুগ্নতায় ভোগা বৌটা আধমরা হয়ে বিছানায় পড়ে আছে তখন ওকে গলাটিপে শেষ করে সিলিং ফ্যানে ঝুলিয়ে দেওয়াই ভালো। সে সেই সকল দুষ্কর্ম ঘটাবার পরে টুলটুলির ডাইরিটা খুঁজতে লাগলো। ওতে তার নানান অপকর্মের কোনো প্রমাণ থেকে যেতে পারে! কিন্তু সেটার কোনো হদিশ সে বের করতে পারলো না। মনে মনে ভাবলো, মেয়েটা মহা টেটিয়া ছিল! মরবে তবু মচকাবে না!

    পরে খুনের কথা জানাজানি হয়ে যাওয়ার পরেও টুলটুলির ঘর সার্চ করার সময়ে পুলিশ অফিসাররা টুলটুলির ব্যক্তিগত কোনো ডাইরি, চিঠি বা মোবাইল ফোন খুঁজে পান নি। ভক্তিবাবু আর তাঁর ছেলেও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যে এই কেসটাকে আত্মহত্যা বলে চালানো যাবে অনায়াসেই। শুধু কোথাও টাকা, আর কোথাও ক্ষমতার প্রয়োগ দেখাতে হবে।

    টুলটুলি মরার আগে বুঝতেই পারছিলো যে এখানে তার দিন ফুরিয়ে আসছে। এভাবে বেশিদিন চলতে পারে না। বাপের বাড়ি ফিরে যাওয়াটাও তার পক্ষে সম্মানজনক হবে না, যদিও সেটাই সে মনেপ্রাণে চাইছিলো। ওই শয়তানগুলোর হাতে যাতে তার ডাইরি বা মোবাইল না পড়ে তাই সে খুব সতর্ক থাকতো সব সময় — সেগুলো লুকিয়ে রাখতে সে একটা অভিনবপন্থা গ্রহণ করেছিল। পলিথিনের প্যাকেটে ভরে ডাইরি আর মোবাইল ফোনটাকে বাতিল একটা প্যাকিং বাক্সের মধ্যে রেখে তার ওপরে কিছু খবরের কাগজ আর অদরকারি জিনিসপত্র চাপিয়ে সেটাকে বাথরুমের মাথায় পাম্পের ঘরে রেখে দিতো। সেজন্য সে একটা কাঠের টুল ব্যবহার করতো।


    ।। ২৩ ।।


    অমর খামের মুখটা খুলে দেখে আনন্দে লাফিয়ে উঠলো, সত্যিই তার পোস্টিং হয়েছে তালতলা থানায়। প্রথমেই ওর মায়ের মুখটা মনে পড়লো। মা-বাবাকে খবরটা আগে দিতে হবে। বাবার মোবাইলটা বিজি আসছে দেখে ও আগে অনির্বাণদাকেই ফোন করলো। অমরের গলা শুনেই অনির্বাণ বুঝলো তার আনন্দ আর ধরছে না। অনির্বাণ একটু হেসে নিয়ে বললো, "তোকে তো বলেই ছিলাম। তবে ধরদার ইচ্ছেটা একটু অন্যরকম, তোকে উনি ওই মার্ডারকেসের ইনভেস্টিগেটিং অফিসার হিসাবে দেখতে চাইছেন।"

    অমর প্রচণ্ড অবাক হয়ে গেলো। সে তাহলে ভক্তিবাবুর বৌমার মার্ডারকেসের তদন্তকারী অফিসার হবে? ভাবতেই পারছে না।

    এখনই ওর কলকাতায় ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে। তবে ব্যাপারটা বেশি পাঁচকান না হওয়াই ভালো। সাবধানে থাকতে হবে।


    ।। ২৪ ।।


    সকালবেলাতেই একটা খারাপ খবর এলো। আমাদের কিছু সদস্য যারা ওই লাশকাটা ঘরটায় থাকত, তাদের ঘর ছাড়তে হবে। রাস্তা চওড়া হওয়ার জন্য যে টেন্ডার বেরিয়েছিল তাতে ওই বাড়িটাও ভেঙ্গে দিয়ে নতুন রাস্তা হবে। অতএব তাদের আবার নতুন আস্তানা খুঁজতে হবে। চিরকাল তো আমরা এমন ভাড়াটিয়ার মতোই স্থান পরিবর্তন করে যাচ্ছি; কেউ তো আর আমাদের জন্য বাড়ি বানিয়ে দেবে না। আমাদের দুঃখ কেউ বুঝবে না। কেউ না।

    আমাদের হাউস ফাইন্ডাররা বেরিয়ে পড়েছে চারিদিকে। খুব তাড়াতাড়ি খুঁজতে হবে তো?

    ভবানী খুড়ো আশাবাদী। তিনি কেবলই বলে চলেছেন, "কে বলতে পারে বলো, এর থেকে আরও ভালো জায়গা পেতে পারি আমরা।"


    ।। ২৫ ।।


    অমরের আজ থেকে তালতলা থানায় পোস্টিং হলো। ধরদার সাথে আজ বিকেলে একটু দেখা করতে যাবে সে। প্রথম দিনেই কোনো কাজের চাপ নেই। তাই ও.সি. স্যারকে বলে বিকেল চারটে নাগাদ একটা ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে। যাওয়ার সময়ে কে.সি. দাশ থেকে রসগোল্লা কিনলো। ধরবাবুর হাতে কন্টেনারটা ধরিয়ে দিতেই ভদ্রলোক একগাল হাসলেন, "আরে, আরে, এসবের কি দরকার ছিল?" অমন গম্ভীর ভদ্রলোক যে এত সুন্দর হাসতে পারেন, তা অমর আগে বুঝতে পারেনি।

    ধরবাবু মিষ্টির কন্টেনারটা একপাশে সরিয়ে রেখে বললেন, "আমি, একজন অনেস্ট অফিসারকে খুঁজছি যে এই কেসে আমাদের সাহায্য করতে পারবে। তোমার নামটাই অনির্বাণ আমাকে বললো। নাউ, ইয়ং ফ্রেন্ড, আজ থেকেই শুরু করে দাও। তুমি আমাদের আরও দুজন অফিসারের সাথে ভক্তিবাবুর বাড়ি চলে যাও। যে মেয়েটি মারা গেছে তার ঘর সিল করা আছে। তুমি আরো একটু ভালো করে খুঁজে দেখো খুনের কোনো প্রমান পাও কি না।"

    অমর সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল ভক্তিবাবুর বাড়ির উদ্দেশ্যে।


    ।। ২৬ ।।


    নতুন কোনো প্রমাণ তেমন কিছু পাওয়া গেলো না। শুধু দু-একটি ছোটখাটো জিনিস ছাড়া — যেমন, রক্তমাখা নখের টুকরো, কয়েকগোছা ছেঁড়া চুল ইত্যাদি। ওই ঘরের থেকে সবাই বাইরে চলে আসার পরে হঠাৎ অমরের মনে হলে একবার বাথরুমটা দেখে এলে হয়। বাকি দুজনকে বাইরে দাঁড়াতে বলে সে আবার ভিতরে ঢুকলো।

    ফের ঘরে ঢোকার পরেই অন্ধকারে আবছা ভাবে দেখল কেউ যেন বাথরুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ আলো জ্বেলে আর কাউকে দেখতে পেল না। বাথরুমটা খুঁটিয়ে দেখেও উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই নজরে এলো না। শুধু একটা কাঠের টুল একদম কোণে রাখা আছে। বোধহয় কোনো ইলেকট্রিক মিস্ত্রি এলে এতে উঠে লাইট ঠিক করে।

    একবার উপরে তাকিয়ে দেখলো পাম্পের ছোট্ট ঘরটা থেকে কি যেন একটা উঁকি দিচ্ছে। কি ওটা? অমর একটু এগিয়ে গিয়ে দেখার চেষ্টা করলো। ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছে না। একবার ওই টুলটায় উঠলে হতো। টেনে নিয়ে এলো টুলটা। ওতে উঠে দেখলো একটা পরিত্যক্ত প্যাকিং বাক্স। গায়ে ঝুলটুল লেগে ছিল। সেটিকে সদ্য যেন একটু হিঁচড়ে টেনে আনা হয়েছে। প্যাকিং বাক্সটা নামিয়ে খুলতেই দেখল ওপরে একটা ছেঁড়া কাপড়, ছেঁড়া বই, দুটো পুঁথির মালা, একটা আধভাঙা আয়না, একটা চিরুনি, তার নিচে থেকে পুরোনো খবরের কাগজ উঁকি মারছে। অমর ভাবলো, এতো অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এতো যত্ন করে পাম্পের ঘরে প্যাকিং বাক্সে ভরে তুলে রাখার কারণ কি? একবার দেখতে হচ্ছে তো।

    নিচে নামালো বাক্সখানা। ওপরের জিনিসগুলো আর পুরোনো খবরের কাগজ সরাতেই একটা পলিব্যাগ বেরিয়ে এলো। ব্যাগখানা বেশ ভারি, ওর ভিতরে কিছু আছে। প্যাকেটটা খুলতেই বেরিয়ে এলো একটা বড় ডাইরি আর একটা মোবাইল ফোন। ফোনটা সুইচ অফ ছিল। ডাইরিটা কোনো মেয়ের হাতের লেখা — দৈনন্দিন জীবনকাহিনি। গোটা গোটা অক্ষরে সুন্দর হাতের লেখা। এটা সম্ভবতঃ সেই মেয়েটি যে মারা গেছে তার ডাইরিই হবে।

    মোবাইল ফোনটা আর ডাইরিটা সাথে নিয়ে অমর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো।


    ।। ২৭ ।।


    আমাদের হাউস ফাইন্ডার টিম খাস কলকাতার বুকেই একটা পুরোনো ভাঙা বাড়ির সন্ধান পেয়েছে। আপাতত আমরা সবাই এখন সেখানেই এসে পৌঁছেছি। বাড়িটা কোনো একজন ধনী ব্যক্তির বাড়ি ছিল। খুব সুন্দর করে, মনের মতো করে বানিয়েছিলেন তিনি; কিন্তু বেশিদিন বাঁচেন নি তিনি। হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মাত্র ৫৫ বছর বয়সে মারা যান তিনি। তাঁর স্ত্রী আবার অন্য কাকে বিয়ে করে এই বাড়ি ছেড়ে চিরতরে চলে যান। কিন্তু এই বাড়িটা বিক্রির অনেক চেষ্টা করেও পারেন নি। কেউ এখানে এক রাতও থাকতে পারে নি। সবাই জানে এটা ভূতের বাড়ি। কয়েকজন সাহস করে রাতে থাকবার চেষ্টা করে প্রাণ হারানোর পর থেকে এটা "হন্টেড হাউস" বলেই পরিচিত।

    আমাদের আগে থেকে যারা এখানে আছে তারা এই বাড়ির পিছনে আমাদের থাকার জন্য একটা বড় বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে — যেটা একসময়ে এবাড়ির দ্বিতল গেস্ট হাউস ছিল; আজ সেখানে আমরা গেস্ট হয়ে এসেছি।

    আমরা ঠিক করেছি আমাদের ১৫ই ডিসেম্বরের সমাবেশের অ্যাজেন্ডাতেও নারী নির্যাতন ও পণ প্রথার বিরুদ্ধেও একটা সরব প্রতিবাদের দাবি রাখব।


    ।। ২৮ ।।


    আগামীকাল সকালে ভক্তিবাবু আর তার ছেলের কেসটা কোর্টে উঠবে। তাই সারাটা দিন জুড়ে অমরের ব্যস্ততার শেষ ছিল না। নানা ধরনের রিপোর্ট, কাগজপত্র রেডি করতে করতে তার সারাটাদিন কেটে গেলো। রাজ্যের একটি দায়িত্বপূর্ণ পদে আসীন মন্ত্রী আর তার ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাই ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মন্ত্রীর দলের সমর্থকরা প্রচণ্ড বিক্ষোভ দেখাচ্ছিল থানার সামনে। শেষে ধরবাবুর ও অনির্বাণদার বুদ্ধিতে সে নিজের জন্যে প্রটেকশন নিলো। আর্মড ফোর্স নিয়ে বাড়ি ফিরলো।

    খাওয়ার পর খুব ক্লান্ত শরীরে শুতে গেলো অমর। রোজ রাতে সে একটু গল্পের বই পড়ে, তারপর ঘুমোয়। আজ তার শোয়া মাত্রই ঘুম এসে গেলো। কিন্তু একটু গভীর রাতে হঠাৎ কি যেন একটা আওয়াজে তার ঘুম ভেঙে গেলো। মনে হলো খাটটা যেন অল্প অল্প কাঁপছে। তবে কি ভূমিকম্প হচ্ছে না কি? নাইট ল্যাম্পের নীল আলোয় দেখতে পেলো একজন মহিলা ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে আছে বারান্দার দরজার কাছে। অমর তড়াক করে উঠে বসলো খাটের উপর। বন্ধ ঘরে সে ঢুকলো কি করে? বালিশের পাশ থেকে টেনে নিলো রিভলভার।

    মহিলা এবারে কথা বললো, "অমরবাবু, আমি আপনার কোনো ক্ষতি করতে আসিনি। প্লিজ রিভলভারটা রাখুন, আলো জ্বালাবেন না, প্লিজ। আমি আপনাকে কয়েকটা কথা বলতে এসেছি। ওরা সমস্ত কালো টাকা ঠাকুরঘরের মেঝের নিচে ভরে রাখত। দেওয়ালে একটা সুইচ আছে। সেটা টিপলেই মেঝেটা ফাঁক হয়ে যাবে।"

    —আপনি কে? আর কাদের কথা বলছেন?

    —আমি ভক্তিবাবুর ছেলের স্ত্রী। আমাকে ওরা প্রচণ্ড অত্যাচার করতো। আমি ডাইরিতে সব লিখে রেখেছি। সে ডাইরি আপনি পেয়েছেন।

    এবারে অমরের শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল। বোধহয় বিনা মেঘে বজ্রপাত হলেও সে এত বিস্মিত হ'ত না। শেষে কিনা সে ভূতের সাথে কথা কইছে? ডাকাবুকো অমর অনুভব করল যে এ. সি. ঘরের মধ্যেও সে ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে গেছে।

    মেয়েটা কি সত্যিই ভূত? গলার আওয়াজ তো বেশ পরিষ্কার। তবে যে লোকে বলে ভূতেরা নাঁকি সুরে কথা বলে?

    মেয়েটা আবার বলল, "ভয় পাবেন না। আপনার কোন ক্ষতি করব না। অযথা আমরা কারো ক্ষতি করিও না, মানুষ শুধু শুধু ভয় পায়। আমার কথাগুলো দয়া করে মন দিয়ে শুনুন।"

    মেয়েটা যা বলল, তা হ'ল ভক্তিবাবু আর তার ছেলের কেসে সে অমরকে যথাসম্ভব সাহায্য করতে চায় এবং ওদের কঠিন শাস্তি চায় সে।

    মেয়েটার নাম টুলটুলি। যদি দরকার পড়ে তাহলে রাতের বেলা ঘরের আলো নিভিয়ে নীল আলো জ্বালিয়ে তিনবার "টুলটুলি" বলে ডাকলেই সে চলে আসবে।

    টুলটুলির কথা শেষ হবার পর তার অনুমতি নিয়ে অমর ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিল। আর কি আশ্চর্য ঘরে কেউ নেই। দরজা যেমন বন্ধ ছিল তেমনি আছে। অমরের কেমন শীত শীত করতে লাগল।


    ।। ২৯ ।।


    আজ স্মল কজেস কোর্টে প্রচণ্ড ভিড়। লোকেলোকারণ্য। ভক্তিবাবু আর তাঁর আরও ছেলের বিচার প্রক্রিয়া চলছে। অমর সমস্ত প্রমাণ কোর্টে পেশ করেছে। এমন কি ভক্তিবাবুর বাড়ি বারবার তল্লাশি চালিয়েও যে লুকোনো কালো টাকার হদিস প্রথমে পুলিশ করে উঠতে পারে নি, অমর সদলবলে গিয়েই তা খুঁজে বের করে ফেলল, ব্যাপারটা রীতিমত পুলিশ ডিপার্টমেন্টে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে।

    মিডিয়া অমরকে তো প্রায় হিরো বানিয়ে ফেলেছে। সি. এম. দলের ভাবমূর্তি স্বচ্ছ রাখতে ভক্তিবাবুকে ও তাঁর ছেলেকে দল থেকে বহিষ্কৃত করেছেন। অনির্বাণদা বলেছে, "তুই যেভাবে রিভেঞ্জ নিলি, তা কেউ পারে না। তোর অপমানের যোগ্য জবাব তুই দিয়েছিস।"

    —চুপ করো অনির্বাণদা। এমনিতেই আমার শত্রু সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।

    অনির্বাণ তার সবচেয়ে কাছের মানুষ হলেও টুলটুলির প্রেতাত্মার কথা কিন্তু সে তাকে বলে নি।

    দুঁদে ক্রিমিনাল ল'ইয়ারদের দাঁড় করালেও ভক্তিবাবু আর তার ছেলের যে কঠিন শাস্তি হবে সে বিষয়ে কারো কোন সন্দেহ নেই। সমস্ত প্রমাণগুলো এমনভাবে পেশ করা হয়েছে যে তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।


    ।। ৩০ ।।


    ধরবাবুর বিশেষ স্নেহভাজন হয়ে পড়ায় পুলিশ ডিপার্টমেন্টের সবাই ওকে বেশ সমীহ করে চলে। বয়সে কিছুটা বড় হলেও এতদিন অনির্বাণ ছিল অমরের সব চেয়ে কাছের মানুষ। এখন গৌতম নামে একটি প্রায় সমবয়সী ছেলের সাথেও ওর খুব বন্ধুত্ব হয়েছে। তবে অমর সকলের সাথে সমানভাবে মিশলেও নিজের কাজ সম্পর্কে কারো সাথে কোন রকম আলোচনা করে না। নিজের কাজের গোপনীয়তা সে সঠিকভাবেই রক্ষা করে।

    গৌতম ছেলেটা খুব মিশুকে, দিলখোলা এবং কাজে সাহায্যের মনোভাব আছে। আর ভীষণ রকমের বাধ্য। অনির্বাণদা বলে, হয়ত গৌতম মনে করেছে অমরকে কাজে সাহায্য করতে পারলে তারও পদোন্নতি হবে। ধরবাবুর নেকনজরে আসতে পারবে।

    ইদানিং ধরবাবু অমরের উপর বেশ নির্ভর করতে শুরু করেছেন। অনেক দায়িত্বপূর্ণ কাজ দিয়ে বলেন, "আমি জানি তুমি এটা পারবে।"

    একদিন ধরবাবু অমরকে বললেন, "তোমার সিনসিয়ারিটি দেখে আমি ভীষণ প্লিজড। এবারে তোমাকে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ দেব। তবে সেটা খুব সাবধানে করতে হবে। দেখো যেন কোনভাবেই লিক-আউট না হয়।"

    তারপরে বললেন, "দরজাটা আগে বন্ধ করে দাও।"


    ।। ৩১ ।।


    ভক্তিবাবু আর তাঁর ছেলের কেসের ঝামেলা মেটার পরে অমর ধরবাবুর দেওয়া কাজে মুর্শিদাবাদ গেল। যাবার সময় সে শুধু অনির্বাণ আর গৌতমকেই বলেছিল কোথায় যাচ্ছে। কেন যাচ্ছে তা বলে নি।

    পুলিশের গাড়ি তখন একশোর বেশি স্পীডে দৌড়োচ্ছে। সামনে একটা ব্রীজ আসছে গঙ্গার উপর। হঠাৎ উল্টো দিক থেকে একটা মাল বোঝাই লরি খুব কাছাকাছি চলে আসায় ড্রাইভার গাড়িটাকে বাঁ-দিক চেপে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই গাড়িটা অনেকখানি স্কিড করে একটা পাঁচিলে গিয়ে ধাক্কা মারল। তারপরে গাড়িটা উল্টে গেল।

    হাসপাতালে জ্ঞান ফেরার পরে অমর দেখল তার বাম হাতটাই নেই। তবে প্রাণে শুধু সেই বেঁচে আছে। কি করে যে বাঁচল তা সে মনে করতেও পারল না। অমরকে দেখতে এসে ওর বাবা-মা হাপুস নয়নে শুধু কাঁদতে লাগল। উপস্থিত সকলে চোখের জল সামলাতে পারল না। অনির্বাণ রুমালে চোখ মুছে ধরবাবুকে ফোন করে জানালো যে অমরের জ্ঞান ফিরেছে, তবে সুস্থ হতে অনেক দেরি হবে। ডাক্তারবাবুর সঙ্গে ধরবাবুর ফোনে কথা বলিয়ে দিল সে।

    ধরবাবু অনির্বাণকে নির্দেশ দিলেন অমরের কেবিনের বাইরে যেন কড়া পাহারার ব্যবস্থা থাকে। তার প্রাণ সংশয় হতে পারে।


    ।। ৩২ ।।


    এদিকে গৌতম হাত কামড়াচ্ছে। ইস্, ব্যাটা বেঁচে গেল। সে জেনুইন খবর দিয়েছিল চিমনিকে। চিমনি হচ্ছে ভক্তিবাবুর ভাড়াটে গুণ্ডা। ব্রীজে গাড়ি উঠার আগেই ধাক্কা দেওয়ায় গাড়িটা উল্টে গেলেও অমর প্রাণে বেঁচে গেছে। যদি ব্রীজের উপর ধাক্কা লাগতো তাহলে রেলিং ভেঙে নিচে পড়ে গেলে আর বাঁচার চান্স থাকত না।

    এদিকে আর একটা খারাপ খবর হচ্ছে ধরবাবু নিজে মুর্শিদাবাদ গিয়ে ভক্তিবাবুর সমস্ত গোডাউনগুলো সার্চ করিয়েছেন। সেখানে প্রচুর পরিমাণে গাঁজা, চরস, নানারকম মাদকদ্রব্য আর সোনার বিস্কুট পাওয়া গেছে। স্মাগলড গুডস। বাংলাদেশ হয়ে বর্ডার পেরিয়ে ভারতে ঢোকে। এই কাজেই তিনি অমরকে পাঠিয়েছিলেন।

    গৌতমের ফোনে একটা অচেনা নম্বর থেকে কল এল। সে কেটে দিল। এখন কথা বলা যাবে না। পরে সাবধানে কথা বলতে হবে। পিওন নিমাই সেটা লক্ষ্য করে বলল, "কি গার্লফ্রেন্ড ফোন করেছিল বুঝি? অসময়ে ফোন করলে তো কেটে দিতেই হবে।"

    গৌতম একটু হাসল। তারপরে অন্যখানে চলে গেল।


    ।। ৩৩ ।।


    অমরের সব কাজ এখন অনির্বাণকেই দেখতে হচ্ছে। অনির্বাণ ফিরে আসতেই নিমাই ফাইল দেবার অজুহাতে ভেতরে ঢুকে ফিসফিস করে বলল, "ক'দিন ধরে লক্ষ্য করছি গৌতমের ফোন এলেই কেটে দেয়। মাঝে মাঝে বাইরে গিয়ে নিচু গলায় কথা বলে।"

    অনির্বাণ বলল, "ব্যাপারটা খেয়াল রাখুন। আর আমায় রিপোর্ট করবেন।"

    বিকেলে হাসপাতালে অমরকে দেখতে যাবার সময় অনির্বাণ ইচ্ছা করেই গৌতমকে কিছু কাজ দিয়ে গেল। নিমাই বলার পর থেকে গৌতমের উপর অনির্বাণেরও কেমন একটা সন্দেহ জাগছে। ধরবাবু অনির্বাণকে জানিয়েছেন তিনি আজ সন্ধ্যায় ফিরে আসবেন। তারপরে অমরকে দেখতে যাবেন।

    গৌতম মনে মনে অনির্বাণকে গালাগালি দিচ্ছিল ছুটির সময় গুচ্ছের কাজ চাপিয়ে দেওয়ার জন্য। অনিচ্ছাসত্ত্বেও করতে বাধ্য হচ্ছিল সে। হঠাৎ রাস্তায় একটা জোর চিৎকার-চেঁচামিচি শুনে সবাই বারান্দায় যাচ্ছে দেখে সেও গেল। ঠিক সেই সময়ই আবার চিমনির ফোন এল। বাধ্য হয়ে সে হলঘরে ফিরে এল। এখন এখানে কেউ নেই। একটু কথা বলা যেতেই পারে এই ভেবে সে বলল, "বলো কি হয়েছে?"

    —শালা তো বেঁচে গেল। স্যারের নির্দেশ ওটাকে খতম করতেই হবে। কোন হাসপাতালে আছে?

    —পরে বলব। আমিও জানি না। কালকে দেখতে গিয়ে সব জেনে এসে তোমাকে বলে দেব।

    গৌতম জানতেই পারল না যে দরজার আড়াল থেকে নিমাই কথাগুলো শুনছিল।


    ।। ৩৪ ।।


    আজ ধরবাবু গৌতমকে নিজের চেম্বারে ডেকে বললেন, "অমর তো অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে হাসপাতালে। অনির্বাণও খুব ব্যস্ত। তাই তোমাকে একটা কাজ দিচ্ছি। ভক্তিবাবুর নতুন কেস ফাইলের কাগজগুলো তোমাকে ল'ইয়ার মিস্টার বারিকের চেম্বারে পৌঁছে দিতে হবে। এত গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টস আমি আর কারো হাতে পাঠাতে পারছি না।"

    গৌতম তো এটাই চাইছিল। ভক্তিবাবুর কেসের কাগজগুলো হাতে এলেই সে হোয়াটস্‌অ্যাপে বা জেরক্স করে পাঠিয়ে দেবে অ্যাডভোকেট জয়ন্ত বুবনাকে। সে ভক্তিবাবুর ল'ইয়ার।

    গৌতম কাগজগুলো নিয়ে বেরিয়ে যেতেই নিমাই তার পিছু নিল। গৌতম লালবাজার থেকে বেরিয়ে ডালহৌসি গিয়ে কাগজগুলো সমস্ত জেরক্স করিয়ে একটা ফাইলে ভরে ভক্তিবাবুর ল'ইয়ারের ক্লার্ককে চটপট চলে আসতে বলল জেরক্সের দোকানে। হাতে হাতে হ্যান্ড ওভার হয়ে গেল ফাইল। গৌতম দোকান থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সিতে উঠে পড়ল। আড়াল থেকে নিমাই নজর রাখছিল গৌতমের উপর। ট্যাক্সির নম্বরটা সে ফোনে জানিয়ে দিল অনির্বাণকে।

    তারপরে নিমাই জেরক্সের দোকানের একটি ছেলেকে হাত নেড়ে ডেকে হাতে একশো টাকা গুঁজে দিয়ে বলল, "এই যে লোকটা যাকে ফাইল দিল তাকে চেন?"

    —কেন চিনব না? ও তো অ্যাডভোকেট জয়ন্ত বুবনার ক্লার্ক।

    —ওনার চেম্বারটা কোথায়?

    —ওই তো ৬ নম্বর ওল্ড পোস্ট অফিস স্টীটে।

    —আমাকে একবার দেখিয়ে দেবে?

    —চলুন, দেখিয়ে দিচ্ছি।


    ।। ৩৫ ।।


    নিমাই ফিরে এসে অনির্বাণকে সব কিছু জানাল। অনির্বাণ জানাল ধরবাবুকে। ধরবাবু বললেন, "ওর উপর আরো নজর রাখতে হবে। আর অমরের কেবিনে আরো নজরদারি বাড়াতে হবে। অনির্বাণ, কুইক, তুমি এক্ষুনি অমরের কাছে চলে যাও। আমার মনে হচ্ছে আজ রাতেই কিছু একটা ঘটনা ঘটবে।"

    —স্যার, ডকুমেন্টসগুলো যে ভক্তিবাবুর অ্যাডভোকেটের কাছে চলে গেল? ও তো ডিফেন্সটাকে আরো জোরদার করার সুযোগ....

    অনির্বাণকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ধরবাবু হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বললেন, "সে নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। ওতে কোন ইমপর্টেন্ট কাগজই ছিল না। ভক্তিবাবুর কেসের তো কোন কিছু তো নয়ই। আমি আগেই মিস্টার বারিকের সাথে কথা বলে নিয়েছিলাম। শুধু শিওর হতে চেয়েছিলাম গৌতমই ভক্তিবাবুর হয়ে কাজ করছে কিনা।"

    অনির্বাণ দ্রুতবেগে বেরিয়ে পড়ল। অমরের কাছে খুব তাড়াতাড়ি তাকে পৌঁছতেই হবে।


    ।। ৩৬ ।।


    ডাক্তারবাবু অমরকে ভরসা দিচ্ছিলেন, "আরে, আপনি এত ভেঙে পড়ছেন কেন? আমি অনেক দেখেছি যে কৃত্রিম হাতের সাহায্যে মানুষ আগের মত সব কাজ করতে পারছে। ডোন্ট ওরি। সব ঠিক হয়ে যাবে।"

    অমর চোখের উপর এক হাত চাপা দিয়ে শুয়ে আছে। আর চোখের কোল দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।

    ডাঃ ব্যানার্জি নার্সকে কিছু ওষুধপত্রের নির্দেশ দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

    ঠিক তারপরেই দু'জন গ্রুপ ডি স্টাফ একটা ট্রলি নিয়ে এসে হাজির হ'ল, অমরের সিকিউরিটিতে থাকা লোকজনকে বলল, "ডাক্তারবাবু এই পেশেন্টকে একটু ও. টি.-তে নিয়ে যেতে বলেছেন।" ভেতরে নার্স নেই। সিকিউরিটির লোক দু'জন বারণ করল। বলল, "একটু দাঁড়াও। আগে নার্স ম্যাডাম আসুন, তারপরে নিয়ে যাবে।"

    —আমাদের অতো দাঁড়ানোর সময় নেই। ডাক্তারবাবু এক্ষুনি নিয়ে যেতে বলেছেন।

    সিকিউরিটির লোকেরা বেশ মুশকিলে পড়ে গেল।

    এরই মাঝে হঠাৎ অনির্বাণ ঢুকে পড়ে বলল, "কি ব্যাপার? কি হয়েছে? এত চেঁচামেচি কেন পেশেন্টের কেবিনের সামনে?"

    অনির্বাণকে দেখেই ট্রলি বয়ে আনা লোক দুটি চলে যেতে উদ্যত হল...

    —চল রে, তবে নার্স ম্যাডাম এলে তখনই নিয়ে যাব।

    ঠিক সেই সময়ই নার্স ম্যাডাম হাতে ওষুধের চার্ট নিয়ে ফিরে এলেন। চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "কি হয়েছে এখানে?"

    পুলিশ সিকিউরিটি দুজন বলল, "দেখুন না ম্যাডাম এরা পেশেন্টকে ও. টি.-তে নিয়ে যেতে চাইছিল। বলছিল, ডাক্তারবাবুর হুকুম।"

    —কই ডাক্তারবাবু কখন বলেছেন সে কথা? আমি তো এইমাত্র তাঁর কাছ থেকেই আসছি।

    ট্রলিবাহক দু'জন আর না দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে চলতে আরম্ভ করেছে। অনির্বাণ ওদের পিছনে পিছনে যেতে শুরু করেছে।

    —এই দাঁড়াও, হল্ট।

    লোক দুটো এবার পকেট থেকে রিভলভার বের করার আগেই অনির্বাণ বিদ্যুৎ গতিতে ডান-পা দিয়ে ট্রলিটা ঠেলে দিতেই ওদের একজন উল্টে পড়ে গেল। আর একজন কোনমতে টাল সামলে গুলি চালালো। কিন্তু সেটা দেওয়ালে লেগে লক্ষ্যভ্রষ্ট হল।

    পিছনে সিকিউরিটি দুজন প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও পরক্ষণেই তারাও বন্দুক তুলল। ততক্ষণে সারা হাসপাতাল জুড়ে বেজে গেছে রেড অ্যালার্ম। বাইরে থেকে অনেক সশস্ত্র পুলিশ ছুটে এসেছে ভিতরে।

    পালাবার আর পথ নেই দেখে লোক দুটো সারেন্ডার করল।


    ।। ৩৭ ।।


    ধরা পড়েছে চিমনি আর তার সাগরেদ বা ডান হাত বল্টু। লক আপে মারের চোটে সব কবুল করেছে। ভক্তিবাবু আর তাঁর ছেলের নন-বেলেবেল অফেন্স। জেলের ভিতরে বসেই সব খবর পেয়েছে তারা। ভক্তিবাবু তো রাগে চুল ছিঁড়ছে। চিমনি আর বল্টুর যাবজ্জীবন কেউ আটকাতে পারবে না।

    গৌতমকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ডিপার্টমেন্টাল এনকোয়ারি শুরু হয়েছে। ভক্তিবাবু আর তার ছেলের যে কঠিন সাজা হবে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ভক্তিবাবুর স্ত্রী নাকি রাজসাক্ষী হবেন। নাহলে তারও যাবজ্জীবন অবধারিত।

    আমাদের অর্থাৎ ভূতেদের দাবি বিফলে যায় নি। ১৫ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আমরা রাস্তা অবরোধ করেছিলাম। সে এক অদ্ভুত ঘটনা, যা আগে কলকাতাবাসী কেন, সারা পৃথিবীর ইতিহাসে কেউ কখনও দেখে নি। রাস্তায় সারি সারি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কোন গাড়ি স্টার্টই নিচ্ছে না। ট্রাফিক পুলিশ শত চেষ্টা করেও লাল আলোকে সবুজ করতে পারছে না।

    কয়েক ঘণ্টা এমন কাটার পর সি. এম. নিজে এলেন পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে। তখন তিনি পুলিশের মাইক থেকে চিৎকার করে বললেন, "কে এমন সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার ব্যবহার করছেন তা জানি না। হয়ত তিনি কোন আতঙ্কবাদী হবেন। আমার অনুরোধ তিনি আমাদের সাথে আলোচনায় বসুন, এভাবে রাস্তা জ্যাম করে জনসাধারণকে বিপদে ফেলবেন না।"

    ভবানী খুড়ো পাশ থেকে গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, "আলোচনা করব বলেই তো এসেছি।"

    সি. এম. প্রথমে কাউকে দেখতে পেলেন না। বেশ অবাক হয়ে বললেন, "কোথায় আপনি?"

    ঠিক তখনই দেখতে পেলেন ধুতি-পাঞ্জাবী পরা কাঁধে জার্মান শালকে ভাঁজ করে ফেলা একজন নিপাট ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন ঠিক তাঁর পাশেই। সঙ্গে আরও কয়েক জন, প্রত্যেকেই খুব ভদ্র চেহারার। পুলিশের কড়া নিরাপত্তার বেড়া টপকে কি করে তারা তাঁর পাশে চলে এল তা কিছুতেই তিনি বুঝে উঠতে পারলেন না।

    ভবানী খুড়োই বললেন, "চলুন, আমরা কোথাও বসে আলোচনা করি।"

    বিধানসভা ভবনে জরুরী মিটিং ডেকে রাত দুটো পর্যন্ত আমাদের সমস্ত দাবি দাওয়া নিয়ে আলোচনা করা হল এবং তার সাথে অমর নামে ছেলেটিকে যাতে সততা ও সাহসিকতার জন্য পুরস্কৃত করা হয়, তাও বলা হল।

    মজার কথা হল সি. এম.-এর নির্দেশে ওই ধনীর বিশালাকার গৃহটি, যেখানে আমরা আছি, সেটিকে "ঘোস্ট হেরিটেজ" বলে ঘোষণা করা হয়েছে এবং আমাদের পারমানেন্ট বাসস্থানের দাবি এতদিনে সফলতা পেয়েছে। আর হ্যাঁ, আমাদের নিয়ে যা খুশি তাই লেখার আগে প্রুফ দেখিয়ে অনুমতি নেওয়ার কথাও মেনে নেওয়া হয়েছে। এখন থেকে ভূতের গল্প লিখে প্রকাশ করার আগে আমাদের ওয়েব সাইট "হররবুকপারমিশন ডট কম"-এ লেখা আপলোড করে আমাদের থেকে অনুমতি নেওয়া একান্তভাবে জরুরী। নাহলে তার জন্য ভবিষ্যতে কোন সমস্যার সম্মুখীন হতে হলে আমরা কিন্তু দায়ী নই।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)