• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৩ | ডিসেম্বর ২০১৮ | গল্প
    Share
  • হাঁসজারু ও বকচ্ছপ : বন্দনা মিত্র


    শ্রীতমাকে নিয়ে ওর মা সুচন্দ্রার যন্ত্রণা শুরু সেই ক্লাস টেন থেকে। একটাই মেয়ে, স্বামী স্ত্রী দুজনেই পড়াশুনোয় রীতিমত ভাল ছাত্র ছিল, দুজনেই ভাল কাজ করে, শ্রীতমার স্কুলের রেজাল্ট বরাবর ভাল, কাজেই মেয়েকে নিয়ে সামান্য কিছু স্বপ্ন দেখার সাহস তাঁরা করতেই পারেন। নোবেল আনতে তো কেউ বলছে না, কিন্তু নিদেন একটা আই আই টি বা এইমস, কিছু না হোক আই আই এস সি ব্যাঙ্গালোর – এটুকু কি খুব বেশি চাওয়া? সব রকম কোচিং দিতে যখন তাঁরা প্রস্তুত; চাইলে কোটাতেই পাঠিয়ে যাবে দু বছরের জন্য। ভদ্রসমাজে বাস করতে গেলে এটুকু না হলে চলবে কেন! অতএব ক্লাস টেনের পরীক্ষায় যথেষ্ট ভাল রেজাল্ট করেও শ্রীতমা যখন এক শুভ প্রত্যূষে ঘোষণা করল “আমি আর্টস নিয়ে পড়ব,” সুচন্দ্রার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। ওর বন্ধুর ছেলে মেয়েরা সেই কবে থেকে কমপিটিটিভ পরীক্ষার জন্য তৈরী হচ্ছে, জয়েন্ট মেন, অ্যাডভানস, নীট, স্যাট ইত্যাদি শব্দপুঞ্জের ভিড় কলকাতার আকাশ বাতাস মাল্টিপ্লেক্স, মেট্রো, অফিসের বোর্ডরুম, টিচারদের কমনরুমে ঘন কুয়াশার মত ঘিরে ফেলেছে, তখন কিনা সুচন্দ্রার কন্যা স্বচ্ছন্দে বলে বসলেন যে তিনি আর্টস নিয়ে পড়বেন।

    - আমার অঙ্ক মাথায় ঢোকে না, দেখলেই তো, অতি কষ্টে কান ঘেঁষে টায়-টায় পাশ করেছি। বায়োলজিও ভাল লাগে না, বড্ড মুখস্ত করতে হয়। আর কমার্স বড় খটখটে, শুকনো।

    - তা ভালটা কি লাগে?

    - খেতে, ভাল ভাল রাঁধতে আর খেতে।

    মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন সুচন্দ্রা, হা ভগবান, এই ছিল কপালে!

    সুচন্দ্রা নিজে বায়োকেমিস্ট্রিতে ডক্টরেট করে এক নামী কলেজের অধ্যাপিকা। শ্রীতমার বাবা অরিন্দম সান্যাল বেনারস হিন্দু ইউনিভারসিটির মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, কর্পোরেট জগতের মই বেয়ে তর তর করে উঠে এই বয়সেই প্রায় শেষ ধাপে পৌঁছে গেছেন, তাদের মেয়ে হয়ে কিনা তমার ভাল লাগে শুধু রাঁধতে আর খেতে!

    অরিন্দম সান্যাল সংসারের কোন ব্যাপারে মাথা গলান না, বিশেষ করে ছেলে মেয়েকে নিজস্ব স্পেস দেওয়াটা তিনি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করেন। কিন্তু এটা যাকে বলে আপদকালীন পরিস্থিতি, কাজেই উইকএন্ডে সময় বের করে মেয়ের মুখোমুখি হলেন তিনি।

    - কি তমা, মা বলছে স্ট্রীম চুজ করার ব্যাপারে কি সব প্রবলেম হচ্ছে তোমার।

    - কই না তো, সমস্যা কেন হবে? আমি বলেছি আর্টস নিয়ে পড়ব, মা’র সেটা পছন্দ হচ্ছে না।

    - আর্টস নিয়ে পড়বে? তারপর? কেরিয়ার প্ল্যানিং কিভাবে করেছ?

    - প্ল্যান তো এখনও করিনি কিছু তেমন তবে সায়েন্স বা কমার্স আমার ভাল লাগে না।

    - তবু, কিছু তো ভেবেছ। ল নিয়ে পড়তে চাও? জাস্টিস ইন্দিরা ব্যানার্জী, সুপ্রীম কোর্টে কিছুদিন আগে যিনি জাজ হলেন, তাঁর মত?

    - নাঃ, আমি ঝগড়া করতে গেলেই কেঁদে ফেলি, আমাকে কেউ সুপ্রীম কোর্টের জাজ করবে বলে মনে হয় না।

    - আই এ এস? আই পি এস?

    - বড্ড পলিটিক্যাল ইন্টারফিয়ারেন্স। দেখছ না, অত পড়াশুনো শিখে ক্লাস এইট নাইন ফেল করা নেতাদের হুকুমে বাঁদরনাচ নাচতে হয়।

    - ইকনমিক্স নিয়ে? অমর্ত্য সেনের মত?

    - আঃ বাবা, তুমি যে কি, কার সঙ্গে কার তুলনা! শুনছ আমি অঙ্কে ডাহা ফেল।

    - তবে কি পরে এম বি এ করার কথা ভাবছ? টপ এক্সিকিউটিভ? ইন্দ্রা নুয়ি বা চন্দ্রা কোচর?

    - ক্যাট দিয়ে চান্স পাওয়া সহজ নাকি? আর বলছি তো বার বার করে, অঙ্ক আমার ভাল লাগে না।

    - তবে ভালটা কি লাগে ?

    - খেতে। ভাল ভাল রাঁধতে আর খেতে।

    সান্যাল বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে এল। অরিন্দম দোষ দিলেন সুচন্দ্রাকে, “নিজের কেরিয়ার নিয়েই ব্যস্ত। মেয়েটা যে মানুষ হচ্ছে না সে খেয়াল নেই।” সুচন্দ্রা ফুঁসে উঠলেন, “সব আমার দোষ? তুমি মেয়েকে কতটুকু সময় দিয়েছ?” চলতে লাগল চাপান উতোর। এর মধ্যে সুচন্দ্রা বলে বসলেন, “এর জন্য দায়ী তোমার মা। ছোট থেকে তমাকে কোলের কাছে বসিয়ে রান্না করেছেন। নাতনীর হাতে সেই কবে খুন্তি কড়াই তুলে দিয়েছেন রান্নাবাটি খেলার নাম করে। তখন কিছু বলতে পারো নি। আর গাদা গুচ্ছের অদ্ভুত অদ্ভুত রান্না করে সমানে খাইয়েছেন। ওর বয়সী মেয়েরা কেমন পিজা, বার্গার, রোল খায় আর আমার মেয়েকে দেখো - চিংড়ি পোস্ত বাটা, আলুর খোলার চচ্চড়ি, মাসকলাই বড়ি দিয়ে লাউঘন্ট, নারকোল কুচি দিয়ে থোড় চাপড়া – এই সব ওর আহ্লাদের খাদ্য।”

    জিভের উপচে পড়া জল সামলে নিয়ে অরিন্দম সান্যাল স্ত্রীর গুগলির জবাবে পালটা আক্রমণাত্মক হুক করতে শুরু করলেন এবং এই সব ধুন্ধুমারের মধ্যে শ্রীতমা আর্টস নিয়ে ইলেভেনে ভর্তি হয়ে গেল। জোর করা যে যেত না তা নয়, তবে অরিন্দম সান্যালের কারো ওপর জবরদস্তি করাটা প্রিন্সিপলে আটকায় আর সুচন্দ্রা তাঁর প্রাণের বন্ধু দেবযানীকে বললেন, “ও মেয়েকে তুই জানিস না, জোর করে সায়েন্স পড়ালে ও স্রেফ আমাকে জব্দ করার জন্য বছর বছর ফেল করবে!”

    ফলত, সুচন্দ্রা তাঁর ফেসবুকে স্ট্যাটাস আপডেট করলেন, “ফিলিং হ্যাপি, আমার মেয়ে রোমিলা থাপারকে রোল মডেল বেছে নিয়েছে। রি ডিসকভারিং ইন্ডিয়া।” লাইক, লাভ, ওয়াহ এর বন্যায় ভেসে গেল ফেসবুক পেজ। অরিন্দম চেনা মহলে জানালেন, “মেয়ের ইচ্ছে কম্প্যারেটিভ লিটারেচর নিয়ে পড়বে, সেদিন নবনীতা দেবসেনের সংগে আলাপ হওয়ার পরেই এই ডেভেলপমেন্ট। ওর সঙ্গে কথা বলে নবনীতাদি ইজ ভেরি মাচ ইমপ্রেসড।”

    বছর দুয়েক কেটে গেল, কাজে কর্মে থাকলে ঝড়ের মত কেটে যায়। হায়ার সেকেন্ডারিতে যথেষ্ট ভাল রেজাল্ট করল শ্রীতমা, হিস্ট্রি আর ইংলিশ দুটোতেই দারুণ নম্বর। যখন বাবা আর মায়ের মধ্যে টাগ অফ ওয়ার চলছে মেয়ে ভবিষ্যতের রোমিলা থাপার হবে না নবনীতা দেবসেন, ও ঘোষণা করল ও হোটেল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়বে। এবার ঝগড়াঝাঁটি ভুলে অরিন্দম আর সুচন্দ্রা প্রায় জোড়হস্তে মেয়ের পদতলে ধর্না দিয়ে পড়লেন, “ওরে আর আমাদের নাক কাটিস না রে, এভাবে চললে যে সুইসাইড করতে হবে। আমাদের মেয়ে হয়ে তুই শেষে হোটেলের ওয়েটার হবি!”

    - কি মুশকিল, হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়া মানে শুধু হোটেলের ওয়েটার হওয়া নয়, আরো অনেক কিছু। রীতিমত NCHMCT পরীক্ষা দিয়ে চান্স পেতে হয়, তিন বছরের কোর্স, প্রচুর কম্পিটিশন। বড় বড় হোটেলে শেফদের কত টাকা দেয় জানো না?

    - তুই পরীক্ষা দিয়েছিস?

    - আজ্ঞে হ্যাঁ, চান্সও পেয়েছি। তোমরাই ফর্মে সই করেছ, অনেকগুলো পরীক্ষার ফর্ম সই করেছিলে তো তাই বুঝতে পারো নি। আর আমি তো বলেইছি, এই একটা কাজই আমি পারি, ভাল ভাল রাঁধতে আর খেতে। অন্যকিছু আমার দ্বারা হবে না, সে তোমরা যতই চেষ্টা করো না কেন।

    অরিন্দম ও সুচন্দ্রা ভেবেছিলেন পড়ার খরচ না দিয়ে বাধ্য করবেন মেয়েকে এই সব পাগলামি ছাড়তে কিন্তু তমা জানিয়ে দিল সেক্ষেত্রে ও ফেসবুকে একটা ফান্ড ড্রাইভ পেজ খুলবে এবং বন্ধুদের থেকে লোন নিয়ে অ্যাডমিশন নেবে। তারপর পড়ার খরচ ও ধার শোধ - সত্যি সত্যি কোন হোটেলে ওয়েটারের কাজ করে চালিয়ে নেবে। কি হলে কি হবে পরের কথা, কিন্তু যদি ফেসবুকে পেজ খুলে টাকা তোলে মেয়ে, কেলেঙ্কারির শেষ থাকবে না। তাছাড়া সুচন্দ্রা সান্ত্বনা পেলেন, দেবারতির মেয়ে, তমার সঙ্গে একই স্কুলে পড়ত, সায়েন্স নিয়ে পড়ে ফ্যাশন টেকনোলজিতে চলে গেছে। অরুণার ছেলে তো আরো ভাল, অঙ্কে নব্বইএর ওপর নম্বর পেয়ে বাংলায় অনার্স নিয়ে যাদবপুরে ভর্তি হয়েছে। এরপর নাকি বাংলা নাটক নিয়ে পড়াশুনো করতে চায়। কলেজের এক সহকর্মীর ভাইপো, ডেয়ারি আর ফার্মিং এর ওপর পড়ছে, দেশে জমি পুকুর আছে, বিজ্ঞানসম্মত ভাবে চাষ খামার করবে। দারুণ প্রস্পেক্ট, ইনকাম যা হবে সব ট্যাক্স ফ্রি।

    সেদিন অরিন্দম অফিস থেকে ফিরে হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, “সুচন্দ্রা, কি কাণ্ড জানো, দেবেশ, আরে সেই যে দেবেশ রয়, যে বসের বউএর বাজার করে আগের বছর প্রোমোশন পেল আমায় ডিঙিয়ে, তার একেবারে মাথায় হাত, কান্নাকাটি।”

    - কেন, কি হল তার? বাজারের ফেরত পয়সা মেলাতে পারছে না?

    - - দূর কি যে বলো তুমি। ওর ছেলে এবারে টুয়েল্‌ভ দিয়েছে, যাদবপুরে চান্স পেয়েছে, কিন্তু ভর্তি না হয়ে বলছে একবছর গ্যাপ দেবে।

    - কেন? আই আই টির জন্য তৈরি হবে?

    - সে হলে তো ভাল ছিল। তিনি বাবু একবছর পদব্রজে ভারত ভ্রমণ করবেন, বড়োজোর স্লীপার ক্লাস, ভোজনম যত্রতত্র, শয়নম হট্টমন্দিরে।

    সুচন্দ্রা আহ্লাদে ডগমগ হয়ে জানতে চাইলেন, “কি কাণ্ড, এমন সুখে থাকতে ভূতে কিলোনো কেন?” অরিন্দম আনন্দে আটখানা হয়ে উত্তর দিলেন, “কি করে জানবো? আজকালকার ছেলেমেয়েদের বোঝা ভার, তোমার নিজের মেয়েকে দেখছ না?”

    তবু দুঃখ তো থাকেই। পরের ছেলে পরমানন্দ – কে কোথায় উড়ে কোন মগডালে বসছে সে খবরতো ঠিকই কানে আসে। এই সবের মধ্যেই শ্রীতমা ভর্তি হল হোটেল ম্যানেজমেন্ট কোর্সে, দিল্লিতে হোস্টেলে থেকে পড়বে। সুচন্দ্রা সান্ত্বনা পেলেন, যাক তবু লোককে বলা যাবে মেয়ে দিল্লিতে পড়ছে, দিল্লিতে পড়ছে বললেই কলকাতার লোক আর কিছু জানতে চায় না, ভেবে নেয় জে এন ইউ বা দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে কোন হাই ফাই কোর্স করছে, পাশ করলেই অক্সব্রীজ!

    তিন বছরের কোর্স, ঘরের কাজ মানে লন্ড্রি, বাসন মাজা, রান্না, ঘরদোর পরিষ্কার, ফুল সাজানো থেকে একটা বিদেশি ভাষা, আদবকায়দা, কস্টিং, ইকনমিক্স, বুকিং বা বিলিং-এর জন্য সফটওয়ার ট্রেনিং, সেলস, মার্কেটিং – সবই শিখতে হবে এই তিন বছরে। পরে অবশ্য পছন্দের বিষয় নিয়ে কাজ করা যায়। যেহেতু শ্রীতমার ভাল ভাল খাবার রান্না করতে আর খেতে ভাল লাগে, ও ওদিকেই জোর দিল। ঠাম্মার কাছে নিরামিষ রান্না শিখেছে আগেই। নিরামিষ রান্না সুস্বাদু করার প্রধান উপায় হল ঠিকমত কুটনো কোটা। ঝোলের আলু, ঝালের আলু, কালিয়ার আলু, ছেঁচকির আলু, ভাজা আলু, চচ্চড়ির আলু, সব আলাদা আলাদা কাট। ঠাম্মার সম্বল ছিল একটা বঁটি, মাথায় কুরুনি কাটা। তাই দিয়ে ঝিরঝিরে, ঝুরোঝুরো, ফিনফিনে, চাকাচাকা, ডুমো ডুমো কুচি কুচি, চেরা চেরা, হরেক রকমের প্রোডাক্ট বেরত। ঐ জিনিসই কাটার জন্য শ্রীতমাকে এরা দেয় দশ রকমের ছুরি – হাসি পায় ওর। নিরামিষ রান্নার আরেক মজা হল যৎসামান্য মশলা দিয়ে খাবারের তার আনতে হয়, যেন অবনঠাকুরের ছবি, তুলির হালকা টানে সাদা কাগজে লুকিয়ে থাকা চিত্রটি চোখের সামনে তুলে ধরা। সে-বিদ্যেও ঠাকুমার কাছে শেখা তমার। আলু বা লাউ-এর খোসা, শুধুমাত্র পোস্ত, নুন হলুদ শুকনো-লঙ্কা দিয়ে ভাজা ভাজা। ভাল করে ফেটিয়ে নেওয়া নুন, লঙ্কাগুঁড়ো, হিং গোলা বেসনে কুমড়োফুল বা বকফুল হালকা ডুবিয়ে ছাঁকা তেলে মুচমুচে ভেজে নেওয়া। ফুলকপির ডাঁটা, পাতা, শিমের বীচি, কুমড়ো, মুলোশাক ইত্যাদি অল্প পাঁচফোড়ন ও আদা বাটা দিয়ে সাঁতলে নামানোর সময় এক ফোঁটা হিং ভাল করে মিশিয়ে দেওয়া। ছুটিতে বাড়ি এসে ঠাকুমার কাছে প্র্যাকটিকল ট্রেনিং-এর ক্লাস করে তমা। ঠাকুমাও শেখেন কি করে স্যালাড ড্রেসিং করতে হয় অলিভ অয়েল দিয়ে, রান্নায় কারিপাতা দিলে কেমন স্বাদ হয়, দোসা (পাটি সাপটার মত!) ইডলি (এত আমাদের ইলিশভাপা রে!) উত্তপম কেমন করে বানায়, ছুরির অল্প চাপে কেমন ফুলের মত টমাটো, নৌকার মত শসা, পাস্তার মত গাজর কাটা যায়। ন্যাপকিন ভাঁজ হয় কত ভাবে, কাঁটাচামচ কেমন ভাবে বিন্যাস করলে তা কি বার্তা বহন করে। ঠাকুমাকে মাইক্রোওভেনে চাইনিজ রান্না শিখিয়ে, একটা ননস্টিক কড়াই উপহার দিয়ে ফিরে গেল তমা।

    ভর্তি হওয়ার পরের বছর শ্রীতমাকে নিয়মমত কলকাতার এক নামকরা হোটেলে ছয়মাসের জন্য ইন্টার্নশিপে পাঠানো হল। অরিন্দম আর সুচন্দ্রা রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠেন - অরিন্দম স্বপ্ন দেখেন, অফিসের বন্ধুদের সঙ্গে ডিনারে এসেছেন, তমা সেখানে টেবিল ক্লথ পাতছে, অর্ডার নিচ্ছে! কোম্পানির ক্লায়েন্টরা বিজনেস ট্রিপে কলকাতায় এসে হাউসকিপিং-এ ফোন করলে তমা এসে কাচা বেডকভার এনে বিছানা পরিষ্কার করছে! বাথরুমে শ্যামপু, সাবান ঠিকমত নেই বলে তমাকে ডেকে ধমক দিচ্ছে তারা, নেশার ঘোরে টাল খেয়ে তমার হাত ধরে টানাটানি করছে সব ভদ্রলোকের দল! সুচন্দ্রা ভাবেন, ফেসবুক বান্ধবীরা সপরিবারে ছুটি কাটাতে কলকাতায় এসে যখন অভিজাত হোটেলের রেস্তোরায় ডিনার খাওয়ার ছবি আপলোড করবে, যদি ওয়েট্রেসের পোশাকে তমার ছবি চলে আসে কোনমতে! কি সর্বনাশ যে হবে! এরচেয়ে মেয়ে যদি হায়ার সেকেন্ডারিতে ফেল করত, এতদিনে একটা ভাল ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দেওয়া যেত।

    তিন বছর কেটে গেল, কাজে কর্মে থাকলে ঝড়ের মত কেটে যায়! শ্রীতমা ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে কাজ পেল এক নামী অভিজাত হোটেলে যাদের চেন ছড়িয়ে আছে দেশ জুড়ে, পোস্টের নাম আসিস্ট্যান্ট শেফ; মানে বাংলাভাষায় যাকে বলে রাঁধুনীর চার নম্বর জোগাড়ে। শ্রীতমা কাজের ফাঁকে ফাঁকে শিখতে লাগল নতুন নতুন রান্না, ছোটবেলা থেকেই তো রান্না করা দেখে দেখে শিখেছে ও। ওর নিজের পছন্দ ফিউশন ফুড – ঠাকুমার শেখানো রান্নার সঙ্গে ক্লাসে ও হোটেলের কিচেনে শেখা ফরাসী, লেবানিজ, মেক্সিকান, ইটালিয়ান রান্নার মেলবন্ধন, যেন রবিশঙ্কর আর জর্জ হ্যারিসনের যুগলবন্দী। পাঁচফোড়ন, হিং ও অরিগানো দিয়ে অ্যাভোকাডো, গোলমরিচ আর ধনেপাতা দিয়ে সরষে তেলে অ্যাসপ্যারাগাস হালকা আঁচে ফ্রাই, দেশি আলুর দমের রেসিপিতে বিদেশি স্কোয়াশ-এর দম - কোনটা খেয়ে আত্মীয় বন্ধু মহলে হাসির তুফান ওঠে, কোনটা ওরা রায় দেয় সো সো, কোনটা বা লা-জবাব! দো-আঁশলা নিরামিষ রান্নাগুলো ঠাকুমাকে খাইয়ে তাঁর নিজস্ব কিছু টিপস নেয়, ঠাকুমা রান্নার নাম জানেন না কিন্তু জাত রাঁধুনীর কেরামতিতে নাতনীকে বলেন, “একটু ঝাঁঝ আর টক হলে ভাল হত দিদিভাই। লেবানিজ স্যালাড ফাত্তাউসে সরষে কাসুন্দি ঢেলে একটু গন্ধরাজ লেবুর রস মিশিয়ে দেয়, একেবারে সুপারহিট! কাঁঠালবীচি সেদ্ধ করে গুঁড়িয়ে মাটন কিমা মিশিয়ে দিয়ে সুজির মত হুমাস বানালো একদিন, মেডিটেরিয়ান হুমাস হয় নি ঠিকই, কিন্তু সবাই গপাগপ খেয়েছে।

    সময় গড়াচ্ছে, বছর যাচ্ছে একটা একটা করে, সুচন্দ্রা উঠেপড়ে লাগে মেয়ের বিয়ে দেবে, আর নয়, এবার বিয়ে করে ঘর সংসার করো। সুচন্দ্রার অনেক বন্ধুর মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, ভাল ছেলেগুলো সব হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে আর ওর মেয়ে কিনা রান্নাবাটি খেলছে রাতদিন, দুঃখ হবে না?

    কিন্তু মেয়ের বিয়ে দিতে হলে তো একটা কনে দরকার। আর সেই কনের উল্টোদিকে দাঁড়ানোর জন্য একটা ছেলে দরকার। তমা তো নেচে বেড়াচ্ছে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, যেখানেই কোন ভাল শেফ বা বিরল রেসিপির খবর পাচ্ছে ছুটছে শেখার জন্য – কোন পরিবারের চিলেকোঠায় অযত্নে পড়ে আছে তিনপুরুষ আগে দিদিশাশুড়ির নিজস্ব রন্ধনপ্রণালী, তমা হাজির সেখানে, টাকা দিয়ে, ভিক্ষা করে, ধার করে, দরকার হলে চুরি করে সে সব মণিমুক্তো নিজের দখলে আনছে। কেউ একসময় নামকরা রাঁধুনী ছিলেন সাত গ্রাম জুড়ে, এখন বয়েস হয়েছে। তমা তাকে ধরে, মিনতি করে, অর্থ দিয়ে, সেবা করে, সেই জীবনভোর অভিজ্ঞতার ফসল নিজের ঘরে তুলছে। জলের মত অর্থব্যয় করছে, কিচ্ছু জমে না। এই সেদিন ইউরোপ থেকে পনের দিন ঘুরে এল কন্টিনেন্টাল রান্নার কি ওয়ার্কশপ করতে। সুতরাং যা করার সুচন্দ্রাকেই করতে হবে। যতরকম ইন্টারনেট ঘটক আছে প্রত্যেকটাতে রেজিস্ট্রেশন করলেন তিনি, মেয়ের অজান্তেই, এবার অপেক্ষার পালা। যে কজন যোগাযোগ করল তাদের ওপর প্রথম ছাঁকনিটা সুচন্দ্রাই চালালেন। মেয়েকে বিশ্বাস নেই, যদি শোনে কোন ড্রাগ আডিক্ট ছেলের ঠাকুমার কাছে রান্নার সিক্রেট ফ্যামিলি রেসিপি আছে, চোখ কান বুঁজে তাকে বিয়ে করে ফেলবে। দুধের থেকে সর পাত্রগুলিকে ছেঁকে মেয়ের কাছে পাঠালেন সুচন্দ্রা, ফাইনাল করার জন্য। মেয়ে নির্বিকার ভাবে বলল, “অত সময় আছে নাকি? ছেলেগুলোকে বলো আমার ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতে, ফেসবুক প্রোফাইল দেখলেই সবাই সবার নাড়ি নক্ষত্র জেনে যাবে। এমনকি আমার কটা বয় ফ্রেন্ড ছিল, ক্লাস এইটে ইংলিশে কত পেয়েছিলাম, ওরা কে কার সঙ্গে কবার লিভ টুগেদার করেছে, কতবার পিঙ্ক স্লিপ পেয়েছে, কে কি নেশা করে, মাতাল হয়ে সপ্তাহে কবার বাউন্সারের ডান্ডা খায়, সব জেনে নেব।” ব্যস, ঐখানেই সমাপ্তি এই বিবাহমঙ্গল অধ্যায়ের। মেয়ের বয়েস বেড়ে চলে, মেয়ের বাবার কোন হেলদোল নেই, যখন সুচন্দ্রা প্রায় আশা ছেড়ে দিয়েছেন মেয়ের বিয়ের, হঠাৎই শ্রীতমা বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে আনল কিংশুককে। বাবা মায়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল “আমার বন্ধু”। ছেলেটি বয়সে নবীন, সুপুরুষ, বাবার বল বিয়ারিঙ-এর কারখানা, চালু ব্যবসা। ছেলে ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলোয় ভাল, মাউন্টেনিয়ারিঙের ট্রেনিং আছে। গ্র্যাজুয়েশন করে বাবার ফ্যাকটরি দেখার পাশে পাশে নিজে একটা ট্যুর এজেন্সি খুলেছে, দেশ বিদেশের অফবিট জায়গায় ছোট ছোট দলে ট্যুর করায়, ট্রেকিং, ক্যাম্পিং, জঙ্গলের ভেতর টেন্টে থাকার ব্যবস্থা, পাহাড়ি নদীতে র‍্যাফটিং – এইসব একটু আলাদা বিষয় নিয়ে ওর ট্যুর প্রোগ্রাম। এর মধ্যেই অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় তরুণ তরুণী, মধ্যবয়সী ভ্রমণপিপাসু, যারা একলা নিজের মত করে বেড়াতে ভালবাসেন, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, যাঁরা সংসারের ঝামেলা থেকে কয়েকদিন ছুটি নিয়ে নির্জনে দুজনে কাটাতে চান, তাদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ওর ট্যুর এজেন্সি “চরৈবতি ”। ছেলেটিকে ভালই লাগল সুচন্দ্রার, বেশ হাসিখুশি, সকলের সঙ্গে মিশতে পারে, ঘুরতে ভালবাসে খুব। বাবার একমাত্র ছেলে, তাছাড়াও কথাবার্তায় বোঝাই যায়, ভালই চলে ওর এজেন্সি। এরপর থেকে মাঝে মাঝেই ডিনার করতে বাড়িতে আসে কিংশুক, শ্রীতমা খুব যত্ন করে বিভিন্ন পদ রেঁধে খাওয়ায়। বেশ টেনশনে থাকে মনে হয় যেন। যতক্ষণ না খেয়ে ভাল বলে কিংশুক, শ্রীতমা উৎকণ্ঠিত অপেক্ষায় থাকে। দেখে হাসি পায় সুচন্দ্রার, সত্যি, যতই মুখে বলুক বিয়ে করব না, সেরকম পছন্দের ছেলের সঙ্গে আলাপ হলে ঠিকই একটা টান পড়ে। শাশুড়ি বলেন, “বুঝলে মা, কথায় বলে আগুন আর ঘি, ও তুমি চিন্তা করো না, দিদিভাই এর ওখানে মন বসে গেছে।” সুচন্দ্রা ভাবেন যদি মেয়ের পছন্দ হয় আপত্তি করবেন না। মেয়ে তো আঠাশে পড়লো, আর কতদিন! অরিন্দমকে বলেন, “এবার কিংশুকের বাড়িতে কথা বলো, হাজার হোক, আমরা মেয়েপক্ষ!” অরিন্দম সাবধানী, বলেন, “আগে মেয়ের সঙ্গে কথা বলো, ওরা সব ঠিকঠাক বুঝে নিয়েছে তো?” সুচন্দ্রা ভাবেন এবার ডেকে বলবেন মেয়েকে, মুশকিল এই যে মেয়ের নাগাল পেলে তো, সব সময় যেন উড়ছে। একে তো বাঁধাধরা কাজের সময় নেই, কাজের পর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, তারপর ইদানিং সময় পেলেই কিংশুকের সঙ্গে কোথায় না কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, ভাল করে বলেও না, প্রাইভেসির খাতিরে উনিও জিজ্ঞেস করেন না। সেভাবে চেপে ধরলে কেমন এড়িয়ে যায়। এই ভাবে চলতে চলতে যখন সুচন্দ্রার ধৈর্যে টান পড়তে শুরু করেছে, অরিন্দম বলতে শুরু করেছেন ‘আমি জানতাম, কিংশুকের মত এক সাধারণ গ্র্যাজুয়েট ছেলে তমা কিছুতেই পছন্দ করবে না’, শ্রীতমা একদিন লাফাতে লাফাতে বাড়ি ফিরে ঠাকুমার গলা জড়িয়ে চিৎকার করল – “মা মা শুনে যাও, আই ডিড ইট।”

    - কি রে? কি হল? কি রাজ্য জয় করে ফিরলি?

    - কাল কিংশুক আর ওর বাবা আসবে ডিনারে, ভাল করে রান্না করে খাওয়াতে হবে ওদের, তারপর একটা দারুণ সারপ্রাইজ আছে তোমাদের জন্যে।

    - “যাক বাবা ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন, নাতনির সুমতি হয়েছে” – ঠাকুমা ভাবলেন মনে মনে।

    সুচন্দ্রা হাঁফ ছেড়ে বেঁচে মেয়েকে বললেন, “সেতো খুব ভাল কথা, মেনু ঠিক কর, কি খাওয়াবি? তোর বাবাকে বলি কাল একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে।“

    সেদিন রাতে ঘুম আসার আগে অবধি অনেকক্ষণ ধরে সুচন্দ্রা ভাবলেন ব্যাপারটা ফেসবুকে কিভাবে প্রেজেন্ট করবেন, বাবার বনেদী বিজনেস না ছেলের স্টার্ট আপ বিজনেস – কোনটা হাইলাইট করবেন!

    পরেরদিন বাড়িতে বেশ উৎসবের আবহাওয়া, সকাল থেকে শ্রীতমা রান্নাঘরে, ঠাকুমা অনেকদিন পর নিজে খুন্তি ধরেছেন। কাজের লোক বিভা হাতের কাছে সব গুছিয়ে গাছিয়ে দিচ্ছে। স্টার্টার থেকে ডেজার্ট, সব নিজের হাতে বানাচ্ছে ঠাকুমা আর নাতনী। আজকের বিশেষত্ব হল ফিউশন ফুড, বাংলার নিজস্ব রান্নার সঙ্গে বিভিন্ন দেশের রান্নাবান্নার মেলবন্ধন। তমার নির্দেশে সুচন্দ্রা আর বিভাদি বাড়িটাকেও সাজাচ্ছে ঐ রকম ভাবে, বাঁকুড়ার ঘোড়ার সঙ্গে মিলিয়ে চীনা মাটির রাজা রাণী সৈন্য পুতুল, পুরুলিয়ার ছৌ মুখোশ এবং আফ্রিকার মাসাই মুখোস পাশাপাশি, নবদ্বীপের মাটির পুতুল আর জার্মানীর চায়না ডল মুখোমুখি, ডাইনিং টেবিলে টেবিলক্লথের বদলে মেচেদার শীতলপাটির সঙ্গে ফ্রেঞ্চ লেসের কাজ – কোথা থেকে জোগাড় করেছে কে জানে।

    সন্ধ্যাবেলায় কিংশুক এল বাবা কিরণবাবুকে কে নিয়ে। অতি অমায়িক সজ্জন, ভীষণ মিষ্টি কথা, কিন্তু অসম্ভব তুখোড় ব্যবসা বুদ্ধি। শুধু প্রোডাকশনের খুঁটিনাটি নয়, অ্যাকাউন্টসও বোঝেন জলের মত। বললেন, এক পয়সাও বাড়তি ট্যাক্স দিই না আমি, তেমনি সরকারকে ফাঁকিও দিই না এক পয়সা। বাড়ি ঘর সাজানো প্রশংসা করলেন খুব। খাবার টেবিলে অনেক গল্প হল, কিরণবাবু একটা ছোট গ্যারেজে শুরু করেছিলেন কাজ, সামান্য পেরেক আর নাট বল্টু বানানোর কারখানা। সেখান থেকে আজ কয়েক একর জমিতে প্রায় পাঁচশ লোক খাটছে সব মিলিয়ে। ছেলের ব্যাপারে মাথা গলান না সাধারণত, কিন্তু আজকে এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে ছেলে, পাশে তো দাঁড়াতেই হবে!

    ডিনারে সবাইকে বসিয়ে নিজে পরিবেশনের ভার নিল শ্রীতমা, এক একটি পদ পরিবেশন করছে আর পরীক্ষার ফলাফল বেরনোর মত টেনশনে অপেক্ষা করছে কিংশুকের বাবার মতামতের জন্য। ব্যাপারটা ভাল ঠেকল না অরিন্দমের, হাজার হোক হবু শ্বশুর, তাকে এত ভয় পাওয়ার কি আছে? সুচন্দ্রাও লক্ষ্য করেছেন এটা। যাইহোক একসময় ফিলটার কফি ক্যাপিচুনো স্টাইলে নিয়ে ড্রয়িং রুমে বসলেন কিরণবাবু। স্নেহদৃষ্টিতে শ্রীতমার দিকে চেয়ে বললেন, “একেবারে ফুলমার্ক্স, আমার ছেলের ডিশিসন যে ভুল হবে না আমি আগেই জানতাম।” শ্রীতমা আবেগে প্রায় কেঁদে ফেলে –“সত্যি বলছেন আঙ্কেল? আই অ্যাম সো হ্যাপি।” কিংশুক তমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “তা হলে আজ থেকে আমরা পার্টনার!” স্যান্যালদম্পতি দেখলেন নাটকটা থেকে তাঁরা বাদ পড়ে যাচ্ছেন, হাজার হোক তাঁরা তো কিংশুকের হবু শ্বশুর-শাশুড়ি, কিছু গ্রাম্ভারি উপযুক্ত কথাবার্তা তাঁদের বলতে সুযোগ দেওয়া উচিত তমার। এমন সময় কিংশুক বলে উঠল, “তাহলে আপাতত দরকারি ফারনিচার, কিচেনের জিনিসপত্র আর রুমরেন্টের জন্য তিন লাখ তুমি অ্যাডভান্স করে দাও, আর পরে দরকারমত চেয়ে নেব।”

    - কিন্তু প্রত্যেক সপ্তাহে আমি নিজে তোমাদের ডেরায় গিয়ে সবকিছু চেক করবো, যতই কনফিডেনশিয়াল হোক না কেন, এবং বাকি টাকা দেব যদি ছমাস পর মনে হয় তোমরা সত্যিই একসঙ্গে শেষ পর্যন্ত থাকতে পারবে তবেই ...।

    - মানে? আর্তনাদ করে উঠলেন সুচন্দ্রা। অরিন্দম সার্টের আস্তিন গুটোতে লাগলেন, কি ব্যাপার কি মশাই? এরা দু জন কি লিভ টুগেদার করছে নাকি? আপনি সেই ব্যবস্থা করতে এসেছেন? তমা, এটা তোমার সারপ্রাইজ?

    - লিভ টুগেদার? সেটা আবার কি?

    এবার কিরণবাবুর অবাক্ হওয়ার পালা। “আপনার মেয়ে আপনাকে কিছু বলে নি? শ্রীতমা একটা স্টার্ট আপ বিজনেস শুরু করতে চাইছে, ফিউশন খাবারের রেঁস্তোরা, আমায় ধরেছে স্পনসরশিপের জন্য। আসলে আমার ছেলে একদিন তমার হোটেলে ডিনার করতে এসেছিল, ও আবার খেতেদেতে খুব ভালবাসে, নতুন নতুন রান্না খুঁজে বেড়ায়, তা তমার রান্না ওর এত ভাল লাগে যে নিজে খোঁজখবর করে তমার সঙ্গে আলাপ করে একটা নিজেদের রেঁস্তোরা খোলার প্রস্তাব দেয়, জয়েন্ট ভেঞ্চারে। আমি বলেছিলাম খেয়ে রান্না পছন্দ হলে তবেই টাকা ঢালব। আসলে নিয়মমত আমার সই ছাড়া অত টাকা কিংশুক ওর একার সিদ্ধান্তে কোথাও ঢালতে পারবে না, তাই আমাকে এসে ধরেছিল দুজনে। ছেলের অনেক দিনের শখ বিজনেস বাড়াবে, একটা কমপ্লিট প্যাকেজ করবে যেখানে লোকে শুধু অফবিট জায়গায় বেড়াবে না, খাবেও অফ বিট। এটা দুজনের মধ্যে নির্ভেজাল বিজনেস অ্যারেঞ্জমেন্ট, নাথিং পারসোনাল।“

    - আর বিয়ে? সুচন্দ্রার করুণ গলা শোনা গেল।

    - কার বিয়ে? কোন বিয়ের খবর তো আমার কাছে নেই! কিরণবাবু জানান।

    - আমরা ভেবেছিলাম তমা আর কিংশুক ওদের বিয়ের পাকা কথা বলতেই আপনাকে নিমন্ত্রণ করে এনেছে, সুচন্দ্রার গলা কেঁপে গেল।

    - আরে ছি ছি। কি ভুল বোঝাবুঝি বলুন তো! তাই আমি ভাবছি, আপনারা তখন থেকে যাই বলি না কেন অমন বিগলিত মুখে দাঁত খিঁচিয়ে মাথা দোলাচ্ছেন কেন? আর ম্যাডাম আপনাকে দেখে মোটেই এত নিরীহ মনে হয় না, গলার জোরেই বোঝা যায় আপনি বেশ তেজস্বিনী।

    কিংশুক এবার বলে উঠল, “বাবা, বলছিলাম কি—”

    - কি, আর কি বলার আছে? সব তো ঠিক হয়ে গেল, একটা কন্ট্র্যাক্ট করে ফেলব এই সোমবার, ল ইয়ারকে বলা আছে।

    - না, মানে, আন্টি যেটা বলছিলেন, মানে যদি আমি তমাকে বিয়ে করি, তবে চিন্তা করে দেখ, তিনটে বিজনেস থেকে প্রফিট যা হবে পুরোটাই ঘরে থাকবে, ভাগ বাঁটোয়ারা হবে না, আর হিন্দু অবিভক্ত পরিবার হিসেবে দেখালে ইনকাম ট্যাক্স অনেক কম লাগবে!

    - এটা অবশ্য ভেবে দেখার কথা, সত্যিই ট্যাক্স, তা প্রায়, ধর না কেন, ষোল পারসেন্ট। কি মশায় আপনাদের আপত্তি নেই তো?

    - তমা এতক্ষণ পর কথা বলার সুযোগ পেয়ে বলল, “কিংশুক, আমাদের রেস্তোরার নাম দেব হাঁসজারু।”

    - বকচ্ছপ নামটাও খারাপ নয়।

    - আচ্ছা বেশ, নাম থাকবে, হাঁসজারু আর বকচ্ছপ। আর বিয়ের পরে, মানে যদি আমাদের বিয়েটা হয়, আমার অবশ্য আপত্তি নেই, বিয়ে তো যে হোক কারোকে করলেই হল, তোমাকে করলে রেস্তোরাঁটা দাঁড় করাতে সুবিধে হবে, তুমি মাল্লু পার্টি আছো। মানে যদি বাবার আপত্তি না থাকে, আসলে তুমি স্রেফ গ্র্যাজুয়েট তো, বাবার আমার একটু নাক উঁচু, বাবা আবার রাগ কোরো না যেন – হ্যাঁ কিংশুক, যদি বিয়ে হয়, তুমি কিন্তু একদম আমার রান্নার বা রেস্তোরাঁটার ব্যাপারে নাক গলাবে না, আর তোমার ট্যুর এজেন্সির অফিসটা একেবারে যাচ্ছেতাই, ওই জন্যেই ক্লায়েন্ট আসে না, আমি ওটা ভাল করে সাজিয়ে দেব, আজকে বাড়িটা যেমন সাজিয়েছি সেই রকম অফবিট জিনিসপত্র দিয়ে। আঙ্কেল আপনার পছন্দ হয়েছে আমার ডেকোরেশন? এমনই ইন্টিরিয়র করবো আমার “হাঁসজারু”-তে।

    - “হাঁসজারু আর বকচ্ছপ”, কিংশুক বলল।

    - মিসেস স্যান্যাল, আপনার মেয়েও যথেষ্ট তেজস্বিনী, ওকে দিয়ে ব্যবসা হবে, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আঃ কফিটা দারুণ হয়েছে, কিরণবাবু কফির কাপে চুমুক দিয়ে জানালেন।

    - হ্যাঁ, হ্যাঁ আমার মেয়ে বলে কথা, ভবিষ্যতে ইন্ডিয়ার জুলিয়া চাইল্ড বা ক্লারা স্মিথ হবে, সে আপনাকে ভাবতে হবে না, অরিন্দমবাবু বলে ওঠেন।

    এইসব কথার মধ্যে ঠাকুমা গেছেন ঠাকুরঘর থেকে শাঁখটা আনতে, আর সুচন্দ্রা অপলকে শ্রীতমার দিকে চেয়ে ভাবছেন মেয়েটা আমার পাগল ঠিকই কিন্তু বড় ভাল। আহা, ওরা সুখী হোক। জুলিয়া চাইল্ড আর ক্লারা স্মিথ -- নামদুটো মনে করে ফেসবুকে দিতে হবে কিন্তু স্ট্যাটাস আপডেটের সময়!



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ আবোল-তাবোল থেকে
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments