আজ আমার “আমি-দিবস”। একা একা সিনেমা দেখার দিন। ম্যলে ঘুরে বেড়াবার দিন।
আজকাল বিশুদ্ধ সিনেমা হলের পাট একরকম চুকেই গেছে। সবই সিনেমা হলই কোনো না কোনো ম্যলের অংশ—যেখানে একটি সিনেমাহলের বদলে আছে একাধিক হলের একটি মাল্টিপ্লেক্স, দোকানপাট, ফুড-কোর্ট, কফিশপ—সব মিলিয়ে একেবারে জমজমাট একটা ব্যাপার। আমাদের ছেলেবেলার সাদামাটা হলে সিনেমা দেখার সঙ্গে এর তুলনাই হয় না।
আমার কিন্তু বেশ লাগে।
আমি যে সব সিনেমা দেখতে ভালোবাসি, সেগুলো আমার বউ বা মেয়ের পছন্দ নয়। তাই মাসের কোন একটা রবিবার একা একাই চলে আসি বাড়ির পাশের ম্যলে—সিনেমা দেখতে। প্রথমে ম্যলে এক চক্কর, তারপর সিনেমার টিকিটটা কেটে একটা বড়ো পপকর্ন নিয়ে সিনেমা দেখতে ঢুকে পড়ি। বিরতির সময় নিয়ে নি একটা চা-কফি-ঠান্ডা—যেমন মুড, সেইমতো। ছবি শেষ হলে চলে যাই ওপরতলার নতুন-খোলা আমেরিকান কফিশপটাতে। লিফটে করে উঠে ওপরতলার একেবারে একপাশে কফিশপটা—বড়ো চাতাল জুড়ে, অনেকটা জায়গা নিয়ে। ইতস্তত ছড়িয়ে আছে চেয়ার-টেবিল কিম্বা আরামদায়ক সোফা। পাশের দুটো দেয়াল আগাগোড়া কাঁচের, সেখান থেকে গুরগাঁওের বিচিত্রদর্শন বহুতল বাড়ির আর রাস্তায় চলতে থাকা দিয়ে সর্পিল গাড়িদের শ্রেণী দেখা যায়। সেই দেখতে দেখতে আমন্ড বিস্কোটি চিবোতে চিবোতে ক্যাপুচিনোতে চুমুক দিই। বেশ লাগে।
সিনেমা দেখে বেরিয়ে লিফটের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে একসময় আমার সামনে দাঁড়ানো লোকটাকে খেয়াল করলাম।
রোগা। হাফহাতা শার্ট—যেটা কোন একসময় সাদা ছিলো হয়তো, এখন দীর্ঘদিনের ব্যবহারে ঘিয়ে সাদায় রূপান্তরিত হয়েছে। দাড়িটা অন্তত একদিন আগে কামানো, তাই মুখে একটা কালচে ভাব। পায়ে সস্তার চটি। আপন মনে মাথা নিচু করে পায়ের দিকে দেখছে আর শার্টের একটা অদৃশ্য দাগকে আপনমনে খুঁটছে।
লোকটা, সব মিলিয়ে, এই ম্যলে সম্পূর্ণ বেমানান।
কিসসু কিনবে না এখান থেকে, মনে মনে ভাবলাম। ফ্রি-তে ম্যলের ঠান্ডাটা উপভোগ করবে বলে ঢুকেছে। অবশ্য তেমন দোষ দেওয়া যায় না—যা গরম পড়েছে। একটু মায়াই হলো আমার।
লিফট এসে পড়েছে। তাতে চড়ে ওপরে উঠে লম্বা পায়ে পৌঁছে গেলাম কফিশপে। অভ্যস্ত গলায় কাউন্টারে আমার প্রিয় কফির অর্ডারটা দিয়ে দিলাম। তারপর কোনের সোফাটাতে—যেটাতে প্রত্যেকবার বসি, সেটাতে বসে পা’টা লম্বা করে ছড়িয়ে দিয়ে এদিক সেদিক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে থাকলাম জনস্রোত। প্রতিবারের মতন।
ওমা—দেখি ঘিয়ে-সাদা শার্ট এখানেও এসে উদয় হয়েছেন। কাউন্টারে সবচেয়ে সস্তা কফিটা অর্ডার দিলো। তারপর পার্স নয়, পকেট থেকে টাকা বের করে গুনে গুনে বিল মেটালো। তারপর হাঁদাবোকা মুখ করে সোফায় না বসে একপাশে রাখা খাড়া চেয়ারটাতে বসলো। একদম পিঠ সোজা করে—যেন ইস্কুলের ক্লাসে বসেছে। হাসি পেয়ে গেল দেখে।
কফি এসে পড়লো। আমারও, ঘিয়ে জামারও। আড়চোখে দেখলাম লোকটাকে প্লাস্টিকের ঢাকা দেওয়া কাপে দিয়েছে। নির্ঘাত “হ্যাভিং ইট হিয়ার” বলতে ভুলে গেছে। কাউন্টারের লোকগুলো “টেক অ্যাওয়ে” অর্ডারে এরকম দেয়। ওপরে একটা ছোট্ট ছ্যাঁদা, সেই দিয়ে খুব সাবধানে খেতে হয়।
লোকটা অবশ্য অতসব জানে না। জানার কথাও নয়। তাই খুব চাপ দিয়ে ঢাকনাটা খোলার চেষ্টাকরে যাচ্ছে। অভ্যাস নেই, গলদঘর্ম হয়ে যাচ্ছে। তা—কাউন্টারে গিয়ে বললেই তো পারে! তা না...ভাবতে ভাবতেই লোকটা কাপেতে একটু বেশিই চাপ দিয়ে ফেললো। ব্যাস—ঢাকনাটা ছিটকে খুলে গেলো আর পুরো কফিটাই উলটে গেলো। টেবিলে আর মেঝেতেই পড়লো বেশিরভাগটাই, কিছুটা ছিটে ঘিয়ে-সাদা শার্টে। লোকটা হকচকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। কফিশপের কর্মচারীরা দৌড়ে এলো, টেবিল মোছার মপ নিয়ে।
সব জিনিস থিতিয়ে যাবার পর লোকটা দেখলাম কেমন ভ্যাবলা মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো। কফিটা সবটাই পড়ে গেছে। পকেটে নিশ্চয়ই আরেক কাপ কেনার পয়সা নেই। যেভাবে গুনে গুনে টাকা দিচ্ছিলো, মনে তো হয় না।
আমার একটু মায়াই হলো দেখে। কফিশপটাই বা কি—এই সব সময় তো এক কাপ কমপ্লিমেন্টারি কফি দেওয়া তো উচিত! এতো লাভ করছে ব্যাটারা! আজকে ফিডব্যাক দেবার সময় ঠিক ব্যাটাদের কম রেটিং দেবো।যত্তসব!
ভাবতে ভাবতে একসময় মনে হলো কফিশপ যদি নাই দেয়, আমিই নাহয় ওকে এককাপ কফি কিনে দি। দামটা তো গায়ে লাগার মতন নয়। কথাটা মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করতে থাকলাম। সেটা কি ঠিক হবে? লোকটার যদি মনে হয় ওকে ভিক্ষে দেওয়া হচ্ছে? ওর আত্মসম্মানে তো লাগবে পারে? নাকি ওকে বলবো আমার সঙ্গে বসে কফি খান? একদিন এর সঙ্গে কথা বলতে মন্দ লাগবে না হয়তো।
না থাক, বরঞ্চ একটা অন্য কায়দা করি। যদি ওকে বলি যে আমিই এই ক্যাফের মালিক; আর এখানে কোন কাস্টমারের এরকম কফি পড়ে গেলে আমরা তাকে কমপ্লিমেন্টারি কফি খাওয়াই। সঙ্গে কিছু খাবার। হ্যাঁ—এইটা ঠিক হবে। তাহলে আর ঠিক ভিক্ষে হলো না।আমার টেবিলে ডেকে খাওয়াতেও হলো না।
মনঃস্থির করে যতক্ষণে মুখ তুলে তাকিয়ে আঙুলের অভ্যস্ত টোকায় ওয়েটারটাকে ডাকতে যাচ্ছি, ততক্ষনে লোকটা তার কফিতে ভেজা ঘিয়ে-সাদা শার্ট সমেত কোথায় যেন মিলিয়ে গিয়েছে।
গল্পটা আসলে এখানেই শেষ। তবু দুচারটে কথা না বললে ঠিক শেষ হয় না।
দুসপ্তাহ বাদে ওই ম্যলে সস্ত্রীক-সকন্যা গিয়েছিলাম। তেনারা কি সব সাজসজ্জা-প্রসাধন সামগ্রী কিনবেন না পালটাবেন—আমার তাতে বিন্দুমাত্র ভূমিকা নেই। তাই একফাঁকে ওপরে উঠে এলাম একটু কফি খাবো বলে।
ও হরি—দেখি কফিশপটা সাময়িকভাবে বন্ধ আছে। তাদের স্টাফদের কি-সব ট্রেনিং চলছে। কফি-কাউন্টারের সামনে ইয়াবড়ো ওয়াইট-বোর্ড, তাতে “কাস্টমার সেনসিটিভিটি ওয়ার্কশপ” কথাগুলো লেখা। সেদিকে মুখ করে ওয়েটার-ম্যানেজার-কাউন্টারস্টাফরা সবাই কাগজ-কলম বাগিয়ে কফিশপের চেয়ারে ছাত্রসুলভ-পিঠসোজা হয়ে বসে আছে। দুটিক্ষীণমধ্যা-গুরুনিতম্বিনী-স্যুটপরিহিতা তরুণী তাদেরকে কিসব ফর্ম বিলি করছেন।
এদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন যে পিন-স্ট্রাইপ-স্যুট পরা ভদ্রলোক, তিনি বললেন “বেশ—একবার তাহলে বোঝা গেল যে আমরা আমাদের কাস্টমারদের কফি বেচতে চাই না। আমরা বেচতে চাই একটা অভিজ্ঞতা—উপভোগময় একটি স্মরণীয় মুহূর্ত। কফিটা নিমিত্তমাত্র।”
ভালো কথা বলেন ভদ্রলোক। বেশ ভালো। ঝকঝকে স্মার্টনেস ঝলকে উঠছে তার হাঁটা-চলা-কথা—সবেতেই। আজকের শার্টটা রঙ-চটা ঘিয়ে-সাদা নয়—ঠিকরোনো সাদা, তার সঙ্গে চমৎকার মানানসই টাই। দাড়িটাও নিখুঁতভাবে কামানো।
চিনতে তাই একটু সময় লাগলো। আগেরদিনের ক্যাবলা লোকটার সঙ্গে কোন মিলই নেই!
(এই সংখ্যায় অতনু দে-র আরো একটি গল্পঃ 'সমীরবাবুর সিগারেট')