• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৩ | ডিসেম্বর ২০১৮ | গল্প
    Share
  • মুঘলসরাই জংশন : অরুণ কাঞ্জিলাল


    রাতের শেষ প্রহর। আমি যখন মুঘলসরাই স্টেশনে নামলাম, তখন শহরটা ঘুমের আরকে আচ্ছন্ন। মানুষের স্বরূপে কেউ আমার দৃষ্টিগোচর হল না। একমাত্র আমি ও আমার রিক্সাওয়ালা। সে আমাকে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে নিয়ে চলেছে দু-কিলোমিটার দূরের এক অচেনা অজানা গন্তব্যে। সময়টাও অস্থির, কিন্তু রিক্সায় বসে মনে হচ্ছে আমি এই রাজপথের মসিহা। এই মুহূর্তে নিজেকে গুরুত্ব দেবার যথেষ্ট কারণ আছে। সাধারণত এ ধরনের ঘটনা দৈবাৎ ঘটে— এই পাঁচশো বছর পুরনো ঐতিহাসিক মহাসড়ক। আমিই একমাত্র যাত্রী। গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড — যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে শের শাহ্‌ সুরির নাম। যে মহাসড়ক ভারতবর্ষের লাইফ লাইন। যে রাজপথ গাঙ্গেয় সমভূমির সাথে সংযোগ ঘটিয়েছে পঞ্চনদীর দেশকে; আত্মীয়-সূত্রে আবদ্ধ করেছে বাংলার ধীশক্তির সাথে পাঞ্জাবের অদম্য মানসিকতার, এই শীত-ভোরে সেই রাজপথের আমিই এখন একমাত্র যাত্রী।

    ব্রিটিশ আমলের গোড়ার দিকে মুম্বাই-ঠানে, কলকাতা-হুগলী ইত্যাদি ছোটো ছোটো দূরত্বে রেললাইন তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু তামাম ভারতকে দৈর্ঘ্য-প্রস্থে কী ভাবে বাঁধা যাবে? কলকাতার সঙ্গে ইলাহাবাদ, দিল্লী থেকে লাহৌরকে এক লাইনে বাঁধার চেষ্টা হচ্ছিল অনেকদিন। ১৮৬২ সালে তৈরি হল পটনা-মুঘলসরাই ডিভিশন। রাজধানী কলকাতার সঙ্গে বাকি ভারতের যোগাযোগের প্রথম ধাপ। এই রাজপথের পাশেই ব্রিটিশরা স্থাপন করল জংশন স্টেশন। নাম দিল মুঘলসরাই। ১৮৬৫-তে ইলাহাবাদে যমুনার ওপর তৈরি হল রেল সেতু। তখন কলকাতা থেকে বহু লোক ট্রেনে সরাসরি প্রয়াগের মাঘমেলায় যায়। আবার মুঘলসরাই ছাড়িয়ে চুনার বিন্ধ্যাচল। চুনার পেরিয়ে এই মুঘলসরাই-কানপুর লাইন বেয়েই কলকাতা-দিল্লী মেন লাইন।

    আমার একটু নার্ভাস লাগছিল। এখানে আসার আগে আমি শুধু এ শহরের খারাপ দিকটাই শুনে এসেছি। জায়গাটা নাকি অপরাধপ্রবণ। এশিয়ার সর্ববৃহৎ মার্শালিং-ইয়ার্ড মুঘলসরাই। কয়লা সরবরাহের গুরুত্বপূর্ণ বাজার। কোল মাফিয়া আছে। মাঝেমাঝেই গ্যাংওয়ারে রক্তস্নাত হয় রেলওয়ে-ইয়ার্ড। যে শহরের অবস্থান উত্তরপ্রদেশের কিনারায় এবং বিপজ্জনকভাবে বিহারের পশ্চিম কোল ঘেঁষে, আমি এখন ঠিক সেইখানে। রাত ও দিনের এই দুর্বলতম সন্ধিক্ষণে, সম্পূর্ণভাবে এই শহরের অনুপকম্পায় এক কল্পিত হোটেলের খোঁজে চলেছি।

    যতক্ষণ ট্রেনে ছিলাম, ততক্ষণ আমি মরিয়া হয়ে চাইছিলাম, ট্রেন যেন আমাকে পৌঁছে দেয় সূর্যোদয়ের পরে। কিন্তু যখন তুমি কোন একটা অশুভ পরিস্থিতিকে এড়াতে চাইবে, অবধারিতভাবে তুমি দেখবে, তুমি সেই পরিস্থিতিতেই পা বাড়িয়ে ফেলেছ। এটাই ভবিতব্য। যেমন কয়েকঘন্টা আগে আমি মুঘলসরাই স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পা রেখেছি। তখন রাত দুটো বেজে পনেরো। দিল্লীগামী এই ট্রেনটা কিন্তু রোজই দেরী করে। তাই আমি মনেপ্রাণে চেয়েছিলাম আজও এটা দেরী করুক, কিন্তু বাস্তবে তা হল না। গাড়ী আমাকে ঠিক সময়ে মুঘল সরাই-এ নামিয়ে দিয়ে কানপুর দিল্লীর দিকে চলে গেল।

    কিন্তু বছর পঁচিশেক আগে সেই একই প্ল্যাটফর্ম ছিল আমার কাছে আকর্ষণীয়। নি:সন্দেহে কোন ভয়ের কারণ তখন ছিল না। বাবা রেলে চাকরি করতেন। বছরে তিন সেট করে বাঁধা পাস। ফি বছর আমরা উত্তর ভারত বেড়াতে যেতাম। কখনো মথুরা-বৃন্দাবন, কখনো দেরাদুন-মুসৌরি, কখনও বা বেনারসে গিয়েছি। ট্রেন এখানে অন্তহীন বিরতি নিত। এখানেই দুপুরের আহার পরিবেশিত হত, রেলের প্রতীকস্বরূপ প্রকোষ্ঠ বেস্টিত স্টীলের বা এ্যালুমিনিয়ামের থালায় গরম গরম ভাত পরিবেশিত হত। আর কুসুম-কুসুম গরম জল আসত, ঢাকনা বিহীন কাঁচের বোতলে। স্বাস্থ্যবিধি বা হাইজিন কোন অন্তরায় ছিল না, বরঞ্চ রেলের খাবার ছিল আমাদের কাছে চিত্তাকর্ষক। মাথায় পাগড়ি পরা উর্দিধারী সেবকরা, সারি সারি থালা ট্রেনের কামরায় তুলছে। সেই ক্ষুধাবৃদ্ধিকর খাবারের সুবাস আমাদের ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে পৌঁছাবার কয়েকমুহূর্তের মধ্যেই খাবারের থালি কূপে কূপে পৌঁছে যেত। সাহসী কয়েকজনকে দেখেছি, কামরা থেকে নেলে পুল পার হয়ে, স্টেশনের দোতালার ক্যান্টিনে খেয়ে আসত। সে সব দিন এখন কোথায় গেল। এখন সময় অন্য রকম। ট্রেনের এখানে সংক্ষিপ্ত বিরতি। ইঞ্জিন বদলের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। প্রায় প্রতি ট্রেনেই প্যান্ট্রিকার থাকে। অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে মোড়া খাবারের সাথে, কুস্তি করতে করতে সমস্ত মজাটাই নষ্ট হয়ে গেছে। অনমনীয় প্লাস্টিক আধার আর অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল, এরাই এখন রেলওয়ে খাবারের অভেদ্য অংশ।

    ট্রেন থেকে নেমেই ভীতত্রস্ত হয়ে পড়লাম। এখন দিনের আলোর জন্য অপেক্ষা করে, স্টেশনে সময় কাটানোই নিরাপদ মনে হল। একজন চা-ওয়ালাকে ডাকলাম, সে আমাকে মাটির ভাঁড়ে চা ঢেলে দিল। চায়ের প্রথম চুমুকেই আমি পুলকিত — ‘অদ্রক- ইলাচিওয়ালি’ চাই। আমার ভীতু মনোবৃত্তি ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। আমি স্টেশনের বেঞ্চে স্থির হয়ে বসলাম। বেঞ্চের অন্য প্রান্তটিতে এক বৃদ্ধ দম্পতি ঝিমুচ্ছিলেন। ট্রেন স্টেশন পরিত্যাগ করার সাথে সাথেই প্ল্যাটফর্মের চেহারা, কোন এক সরকারি হাসপাতালের বড় কোনো ওয়ার্ডের চেহারা ধারণ করল। ডজন ডজন তাৎক্ষণিক রচিত শয্যা ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে, বেঞ্চের উপর, দেওয়ালের ধারে। যাত্রীরা সবাই ক্লান্ত-অবসন্ন, যেন এই মুহূর্তে তারা কোনো মহামারী অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে অব্যহতি পেয়েছে। কেউ ঘুমিয়ে পড়েছে, কেউ ঘুমানোর চেষ্টা করছে, কেউ বা আবার নিজেকে জাগিয়ে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করে চলেছে। প্ল্যাটফর্মে নতুন ট্রেনের আগমন, তাদের মধ্যে অতি সামান্যই প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে সক্ষম হচ্ছে। ট্রেন যেন হাসপাতালের নাইট শিফ্‌টে, শেষ রাউন্ডে আসা কোনো এক হাউজ স্টাফ। ট্রেন চলে যেতেই তাদের মধ্যেকার এই গৌণ প্রতিক্রিয়ার অবসান ঘটছে এবং তারা যেন আবার তাদের মানসিক স্থিতি ফিরে পেয়ে ঘুমের আরকে ঢলে পড়ছে।

    আমি আরো এক কাপ চা খেলাম। এরপর প্ল্যাটফর্মের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পায়চারি শুরু করলাম। কিন্তু স্টেশনের ঘড়িটা আমাকে স্বস্তি দিচ্ছিল না। ওটা আজ খুবই ধীরে চলছে। এক সময় আমার ধৈর্যের চ্যুতি ঘটল এবং আমি বহির্গমন/এক্সিট গেটের দিকে এগিয়ে গেলাম। সেখানে এক ঝাঁক ট্যাক্সি-ড্রাইভার আমার অপেক্ষায় ছিল। তারা যেন তাদের অনেক দিনের হারিয়ে যাওয়া আত্মীয়কে সাগ্রহে আলিঙ্গন করতে এগিয়ে এল। আমি একটা ফন্দি আঁটলাম। ওদের এড়িয়ে একটা উঁচু জায়গায় উঠে ঘন ঘন ঘড়ি দেখতে লাগলাম। ভান করছিলাম, যেন আমার কোনো বন্ধু এখনই আমাকে নিতে আসবে। আমার প্রতি ট্যাক্সিওয়ালাদের আগ্রহ কমে যেতেই, আমি স্টেশন চত্বর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। সেখান থেকে একটা সুপরিচিত কন্ঠস্বর, স্টেশনের লাউড স্পীকার থেকে উদ্‌গত হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে, ‘যাত্রীগণ ধ্যান দিজিয়ে, দেরাদুন যানেবালী ১৩০০৯ আপ দুন এক্সপ্রেস ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম.......’।

    ‘সাহাব কাঁহা যানা হ্যায়’।

    ক্ষয়াটে চেহারার একজন মাঝবয়সী রিক্সাওয়ালার এই কঠিন বাস্তব প্রশ্নটি আমায় ছুঁড়ে দিল। আমি শৈশবের স্মৃতি নিয়ে মুঘলসরাই অন্বেষণে এসেছি। কিন্তু কোথায় যাবো, কোথায়ই বা থাকবো তার কোনো সম্যক ধারণাই নেই। এদিকে আমি ক্ষুধার্ত এবং ঠান্ডায় জমে যাওয়ার উপক্রম। আমার অস্থিসার শরীর বিরামহীন শূল ব্যথায় কাতর। একটু আরামাদায়ক বিছানার জন্য আকুল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি স্টেশন চত্বর ছাড়িয়ে জি.টি.রোডে পৌঁছে গেলাম। সেখানে প্রাণের স্পন্দন বলতে একটি মৃত সারমেয়র দেহ ঘিরে তিনটি পথভ্রষ্ট কুকুরের হৃদয়-বিদারক চিৎকার। সম্ভবত কোনো ঘাতক ট্রাক ঘণ্টাখানেক আগে কুকুরটিকে পিষ্ট করে চলে গেছে। কুকুরগুলো তাদের সঙ্গীর নশ্বর দেহটিকে ঘিরে ক্রমাগত প্রতিবাদ করে চলেছে। কুকুরগুলোকে পাশ কাটিয়ে আরো একটু এগিয়ে গেলাম। সেখানে দেওয়াল জুড়ে এক ভোজপুরী সিনেমার পোষ্টার — ‘কব আইবা আঙ্গনা হামার’। ভোজপুরী মূলত পশ্চিম বিহারের উপভাষা — প্রায় ২০ মিলিয়ন লোক এই লব্‌জ্‌ কথা বলে। এই হিন্দি বলয়ের হার্টল্যান্ড-এ ভোজপুরী ভাষায় পথিককে মানবিক আমন্ত্রণ — ‘কবে আসবে আমার গৃহপ্রাঙ্গণে’।

    হোটেলের নাম সরস্বতী লজ। আমার রিক্সা ওখানেই দাঁড়াল। আমি মানসচক্ষে দেখছিলাম — হোটেলের লম্বা করিডর পেরিয়ে আমি রিসেপশনে এসে পৌঁছেছি। সেখানে ঘুম জড়ানো চোখে ম্যানেজার আমাকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে — ‘মুঘলসরাই আসার জন্য ধন্যবাদ’। কিন্তু বাস্তবে তা হল না। দেখলাম হোটেলের প্রবেশদ্বারে মস্ত তালা ঝুলছে। আমি কলিংবেল টিপলাম দু’দুবার। কিন্তু প্রবেশদ্বারের ওপ্রান্ত প্রতিক্রিয়াহীন। রিক্সাওয়ালার কাছে ফিরে এলাম। বললাম, ‘আমাকে আবার স্টেশনে ফিরিয়ে নিয়ে চলো’। সে বলল, ‘একবার ফির্‌ ঘন্টি বাজাইয়ে’। আমি প্রবেশ দ্বারে ফিরে এলাম। ইতস্তত করে বেলটা টিপে ধরলাম, সম্ভবত একটু বেশিক্ষণই ধরা ছিল। সহসা বিল্ডিংয়ের উপর দিক থেকে একটা জানলা খুলে গেল। গ্রীবা সমেত একটি স্ত্রীলোকের মস্তক বেরিয়ে এল। খনখনে গলায় বলল,

    ‘ক্যায়া চাহিয়ে’।

    ‘কামরা চাহিয়ে’।

    ‘কোই কামরা খালি নেহি হ্যায়’।

    জানলা সপাটে বন্ধ হয়ে গেল। আবার আমি জনশূন্য গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের মসিহা। ঐতিহাসিকরা ক্ষুণ্ণই হবে, আমার ধারণা শের শাহ্‌ সুরি গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড তৈরি করেননি। যদিও এমন একটা লৌকিক ধারণা, দীর্ঘকাল ধরে ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে স্থান পেয়ে আসছে। আসলে ইতিহাসের যে তথ্য আমাদের হাতে পৌঁছায়, তা থেকে আপেক্ষিক সত্য বের করা যায়, ধ্রুব সত্য কখনোই নয়। শের শাহের জন্ম বিহারের সাসারামে। ডাক নাম ছিল ফরিদ। তিনি একবার খালি হাতে একটা বাঘ মেরেছিলেন। সেই থেকে নাম শের শাহ্‌। সর্বসাকুল্যে তাঁর রাজত্বকাল পাঁচ বছর। আর তার এই সময়টুকুর বেশির ভাগটাই কেটেছে যুদ্ধবিগ্রহে। তিনি একটানা এক জায়গায় স্থির ভাবে থাকতে পারতেন না। আঁর কর্মক্ষেত্র সমগ্র বিহার-বঙ্গে বিস্তৃত। ওদিকে গৌড়, এদিকে চুনার সবটাই তাঁর যুদ্ধক্ষেত্র। এই সময়ের মধ্যে বড় একটা নতুন রাস্তা তৈরি করে ফেলা দু:সাধ্য। আড়াই হাজার কিলোমিটার এই মহাসড়ক, সোনার গাঁও থেকে আগ্রা, দিল্লী ও লাহৌর হয়ে মূলতান পর্যন্ত বিস্তৃত। আদতে বর্তমান গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড বলে পরিচিত রাস্তাটি এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন ও দীর্ঘতম স্থলপথ। গৌতম বুদ্ধের জন্মের আগে থেকেই এই পথ ‘উত্তর পথ’ নামে পরিচিত ছিল। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের সময় এই মহাসড়ক পেশোয়ার, তক্ষশীলা, হস্তিনাপুর, কান্যকুব্জ, প্রয়াগ ও পাটলিপুত্র হয়ে বাংলার তাম্রলিপ্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। মুঘলরা এটাকে আরো বিস্তৃত করেছিল, পূবে চট্টগ্রাম আর পশ্চিমে কাবুল পর্যন্ত। নাম দেয় ‘সড়ক-ই-আজম্‌’। তবু গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের নামে পরিচিত রাস্তাটির সাথে, শেরশাহ সুরির নাম জুড়ে গেল কেন? কেননা তাঁর সময়ে রাস্তাটি সংস্কার হয়েছিল।

    এখন রাত চারটে বাজে। রিক্সাওয়ালা এবার যেখানে আনল, সেই লজে কোলাপ্‌সিবল গেটের ভিতর থেকে মস্ত আলিগড়ি তালা ঝুলছে। সে আমাকে লজের নাম পড়তে বলল। ‘দেবী লজ’। আমি বললাম, ‘কেন?’ সে বলল যে সে আনপড়, লেখাপড়া কিছুই জানে না। সে বুঝতে চাইছিল যে, সে আমাকে ঠিক জায়গায় এনেছে কি না!

    ‘কিন্তু গেট-তো বন্ধ’।

    ‘আপ সোচো মত্‌’।

    রিক্সা থেকে নেমে সে গেট ধরে ঝাঁকাতে লাগল। একজন হৃষ্টপুষ্ট গোলগাল চেহারার লোক একহাতে লুঙ্গির খুট ধরে, অন্য হাতে চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে এল। তাকে দৃশ্যত বিরক্ত দেখাচ্ছিল। রিক্সাওয়ালা বলল,

    ‘সাব কো কামরা চাহিয়ে’।

    সে আমাদের সামনেই লুঙ্গিতে গিঁঠ দিল। তার পেটটা ধানের গোলার মতন। এরপর কুণ্ঠা নিয়ে তালা খুলে আমাকে ভিতরে আসতে বলল। সবচাইতে ভালো ঘরটা আমি দাবি করলাম। সে একটু ভেবে বলল,

    ‘বেশ সকাল আটটা অবধি সাতশো টাকা পড়বে’।

    এই কথা শুনে আমার মন বলছে, ‘চলো দিবাকর স্টেশনে ফিরে যাই’। কিন্তু আমার ঠান্ডা ক্লিষ্ট হাত ততক্ষণ রেজিস্টার খাতায় লিখতে শুরু করেছে — আমার নাম, জাতিগত পরিচয়, কোথা থেকে আসা, কোথায় বা যাওয়া। ভ্রমনের প্রকৃতি লিখতে গিয়ে একটু সমস্যায় পড়লাম। একটু ভেবে লিখলাম ‘অতীত সন্ধানে মুঘল সরাই’। আমি যখন দেবী লজের বেস্টরুমে অবস্থান করছি তখন নীচে রিক্সাওয়ালার সাথে লুঙ্গি পরিহিত ম্যানেজারের অনুচ্চ স্বরে বচসা চলছে। সম্ভবত রিক্সাওয়ালা জি.টি.রোড পার করে এই সর্পিল গলিতে আমাকে নিয়ে আসার জন্য কিছু বেশি কমিশন দাবি করছে।

    আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় এলাম। আমার সামনে মসীবর্ণ ছায়ায় পরিব্যাপ্ত এক রহস্যজনক শহর। এর সঙ্গে কিভাবে যেন আমার বাল্যকাল অখন্ড ভাবে জড়িয়ে রয়েছে। কলকাতা থেকে উত্তর ভারত যাওয়ার পথে মুঘলসরাই স্টেশনের দীর্ঘক্ষণ বিরতি। এই নিশ্চলতা আমার কাছে যে কী উত্তেজনা পূর্ণ ছিল, তা ভাষায় বোঝানো যাবে না। ট্রেনের কামরাগুলোতে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার হত। এই বিরাট দেশের অনেকগুলো নির্জন দ্বীপকে দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে বেঁধে ফেলেও মনে হত মুঘলসরাই এক মর্মান্তিক-চ্ছেদ। পূব আকাশের কোল ঘেঁষে দেখা দিয়েছে বিন্ধ্যাচলের উঁচু-নিচু মাথা। ভ্রমণকারীরা জানে, ট্রেন ওই চুনার-বিন্ধ্যাচল বেয়েই প্রয়াগের পথে পাড়ি দেয়। এই মুঘলসরাই জংশন ছাড়িয়েই ভিড় ঠাসা ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে কালকুটের সঙ্গে আলাপ হয়, খঞ্জ বৈরাগী বলরামের।

    আমি যখন ঘুম থেকে উঠলাম, তখন আটটা বাজে। সর্বসাকুল্যে সাতশো টাকার বিনিময়ে তিন ঘন্টা ঘুমোতে পেরেছি। সূর্যের আলোয় ঘরের বিষণ্ণতা অনেকটা কেটেছে। বারান্দায় এলাম। শহরটাকে এখন আর রহস্যময় মনে হচ্ছে না — বরঞ্চ উত্তর ভারতের আরও দু-পাঁচটা শহরের মতোই মনে হচ্ছে। যেমন কানপুর, ইলাহাবাদ, হাপুর, মিরাঠ, রায়বেরিলি। কিন্তু মুঘলসরাই আমার প্যাশন। ওদের থেকে ভিন্ন। এই শহরের জন্য আমি দশকের পর দশক আবেগজড়িত প্রবণতা পোষণ করে রেখেছি। কিন্তু মুঘলসরাই এখনও তেমনভাবে আমার কাছে প্রতিভাত হয়নি। জংশন স্টেশন হিসাবে সে কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। নতুন প্রযুক্তিতে ট্রেন এখানে থামে মাত্র কিছুক্ষণের জন্য। কিন্তু শৈশবের স্মৃতিভরা সুবাস নিয়ে উর্দিপরা পরিবেশকরা, এখন আর অ্যালুমিনিয়ামের থালায় গরম ভাত নিয়ে আসে না।

    আমার সামনে এখন দুটো পছন্দ — হয় আরো কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেওয়া, নয়তো আহারের অন্বেষণে রাস্তায় বেরিয়ে পড়া। অবশ্য আর একটা বিকল্প ইচ্ছা প্রচ্ছন্ন ভাবে উঁকি দিচ্ছিল। এখান থেকে চুনার দূর্গ মাত্র তিরিশ কিলোমিটার। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দখল করেছিল, এই চুনার দূর্গ। বারাণসীর রাজা চৈৎ সিংহের সঙ্গে বিরোধের সময় এখানেই তাঁবু ফেলেছিল ওয়ারেন হেস্টিংস। কিন্তু এখন চুনার সরিয়ে রেখে আহারের আবেদনটাই আমার কাছে অধিক গ্রহণীয় মনে হল। আবার আমি শতাব্দী প্রাচীন গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডে বেরিয়ে পড়লাম।

    রাস্তার দুধারের দোকানগুলোর ঝাঁপ উঠছে। ফুটপাথের স্বল্প পরিসরটুকুতে হকাররা তাদের বেসাতি সাজিয়ে বসেছে। কি নেই সেখানে; দড়িদড়া, লন্ঠন, মশলাপাতি, সস্তা জামাকাপড় — একটা ছোট শহরের ঘর-গেরস্থালির প্রতিটি প্রয়োজনীয় পণ্য এখানে সহজলভ্য। আমার চিন্তার ক্যানভাস বিস্তৃত হল। আমি ভাবতে চেষ্টা করছিলাম, ষোলোশো শতাব্দীতে এই শহরটা কেমন দেখতে ছিল। আফগান সৈনিক-প্রশাসক শের শাহ্‌ যখন মুঘল সম্রাট হুমায়নকে, দীর্ঘ পনেরো বছর সিংহাসন চ্যুত করে রেখেছিলেন।

    পুরী-সবজি হিন্দি বলয়ের প্রিয় খাদ্য। আমি এর সাথে হাতের তালুর মাপে বানানো জিলিপি খেলাম। হোটেলে ফেরবার পথে ডেটল সাবান ও একটা লুঙ্গি কিনলাম। ঠিক করলাম, লজের বিছানায় শোওয়ার সময় আমি লুঙ্গিটা পরিধান করব। এবং যেদিন আমি মুঘল সরাই ছেড়ে যাবো, সেদিন ওটাকে পরিত্যাগ করব। হোটেলের রিসেপশনে গতরাতের গোলমাটোল লোকটাকে দেখলাম। সে এখন স্নান করে ঝকঝকে হয়েছে। এবং একটা শার্ট গায়ে দিয়েছে। সে খুব মন দিয়ে একটা হিন্দি দৈনিক পড়ছিল। আমি তার দিকে তাকিয়ে পরিচিতির হাসি হাসলাম। সে হাসিটা ফিরিয়ে দিল, কিন্তু কোন কথা বলল না। সে যেন বলতে চায় তুমি তোমার কাজে মন দাও, আমি আমার কাজে। এই হিন্দি বলয়ের বৈশিষ্ট্য হল, লোকে কথা বলার ছুতো খোঁজে। তাই ওর ব্যবহারটা আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগল।

    আমি নির্দিষ্ট ঘরে ফিরে এলাম। প্রথমে আমি ডেটল সাবান দিয়ে ঘষে ঘষে স্নান করলাম। গতরাতে বিছানা থেকে যত রোগ জীবাণু অর্জন করেছিলাম, সবলে ঘষে তার থেকে পরিত্রাণের চেষ্টা করলাম। এর পর নতুন লুঙ্গি পরে সেই বিছানায় শুয়ে পড়লাম। পুরী সবজির প্রাতরাশের পর ঘুমে আমার চোখ জড়িয়ে আসছিল। মুঘলসরাই অপেক্ষা করুক। এখন আমার ঘুমের প্রয়োজন। আমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম।

    এখানে আসার আগে বিভিন্ন সূত্র ঘেঁটে যেটুকু খবর পেয়েছিলাম, তা হল ব্রিটিশের তৈরি রেল যোগাযোগই মুঘলসরাই স্টেশনের প্রাণভোমরা। শহরটা সে অর্থে অনামি। কখনও মুঘলচক, কখনও বা মঙ্গলপুর। তবে মুঘলসরাইয়ের জনপ্রিয়তার আরও একটা কারণ — বেনারস থেকে এর নৈকট্য, গঙ্গার এপারে মুঘলসরাই ওপারে বেনারস। ১৮৮৭ সালে গঙ্গার উপর তৈরি হল ডাফরিন ব্রিজ। এই সেতুরই পরিবর্তিত নাম মালব্য সেতু। মদনমোহন মালব্য, যিনি ছিলেন বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা, তাঁর নামেই এই পরিবর্তন। মুঘলসরাই জংশন ছাড়িয়ে, মালব্য সেতু পেরিয়ে গেলেই কাশী বেনারস। ‘অপরাজিত’ সিনেমার প্রথম দৃশ্যে নিশ্চিন্দপুরের বালক অপু, বাবা-মার সঙ্গে এই ব্রিজ পেরিয়েই পৌঁছে যাবে সেখানে।

    মশার আক্রমণে ঘুম ভেঙে গেল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। আমি পথে বার হলাম। গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড আলোর মালায় সেজে উঠেছে। শহরটা যেন আকাশের কোনো নভশ্চরের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়। রাস্তার ধারের চাটওয়ালার চারিধারে ঘিরে আছে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা। তাদের মুখে চাপা হাসি। আরও আছে ভীরু দম্পতি। উত্তর ভারতে চাটওয়ালাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারাই মানুষের দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমি থেকে এক ধরনের বিরতি ঘটায়, জীবনে মশলা যুক্ত করে স্বাদুতা আনে।

    আমার জিহ্বার স্বাদগ্রন্থি গুলোকে আপাতত সংযত করলাম। এমন এক স্যাঁতসেঁতে বিষণ্ণ ঘরে আমার দিন কেটেছে, প্রথমে তার থেকে মুক্তি পাওয়া আমার আশু প্রয়োজন। চাটওয়ালার থেকে মাত্র কুড়ি ফিট দূরে, একটা রেস্টুরেন্ট-কাম-বার। কাঁচের দেওয়ালে লেখা ‘উইশিং ইউ হ্যাপি দেওয়ালি’। দেওয়ালি গত হয়েছে মাত্র দু’মাস। কোনো বাঙালি কবি লিখেছিলেন, ‘পাখি উড়ে যায়, পড়ে থাকে পাখির পালক’।

    আমি রেস্তোরাঁর কোনার টেবিলটা বেছে নিলাম। সেখানে একজন কালোপানা ও মজবুত শরীরের লোক আগেই বহাল ছিলেন। তিনি এক কোয়ার্টার হুইস্কি ফরমায়েশ করলেন। তাকে খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল। আমি তার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী হলাম। মুঘলসরাই নিয়ে তখন আমার প্রবল অনুসন্ধিৎসা। যেমন করেই হোক এই শহরের স্থান নামের ইতিহাসটা জানতে হবে। কিন্তু তার আগে কিছু খাওয়া প্রয়োজন। আমি একপ্লেট পনির পকোড়া ফরমায়েশ করলাম। পকোড়া আসতেই তার দিকে প্লেটটা ঠেলে দিলাম। সে প্রথমে প্রত্যাখ্যান করল। এরপর আমার পেড়াপেড়িতে দ্বিধাগ্রস্ত মনে একপিস তুলে নিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে তার গল্প শুরু করল। গল্পটাই তার বিষণ্ণতার কারণ। সেটা আর কিছুই নয় — সে এক বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। সম্পর্কটা তার শালীর সঙ্গে। কিন্তু স্ত্রীকে সে ভয় পায়। তাই ইচ্ছে থাকলেও সে এগোতে পারছে না। নিতান্ত মামুলি গল্প। আমি তার গল্প মন দিয়ে শুনলাম। এরপর আমার পালা। জিজ্ঞাসা করলাম,

    ‘মুঘলদের সময়ে এখানে কোনো সরাইখানা ছিল কি?’

    বিষণ্ণ লোকটা জবাব দিল, ‘কোই সরাই-উরাই নেহি থি। যখন মুঘল সম্রাটরা এই পথে যেত, তখন খুব সহজেই মনোরঞ্জনের উপকরণ পেয়ে যেত। ইহাঁ বড়ি আসানিসে রেন্ডিয়া মিল জাতি থি’।

    এই ব্যাখ্যা পাশের টেবিলের বসা দুজন যুবকের কাছে গৃহীত হল না। তারা যে মন দিয়ে আমাদের আলোচনা শুনছিল বুঝতে পারিনি। একজন বিরক্ত হয়ে মজবুত শরীরের লোকটাকে জিজ্ঞাসা করল,

    ‘কৌন ক্লাস তক পড়া হ্যায় বে’।

    ‘কিঁউ, বি.কম তক পড়া হ্যায়’।

    ‘তেরা পুরা পড়াই বেকার হ্যায়। মুঘলরা এখানে ঘাঁটি গেড়েছিল কারণ জায়গাটা তাদের কাছে সুবিধাজনক ছিল। ইস লিয়ে নহী কী রেন্ডি-ওয়ান্ডি’।

    এতে মজবুত শরীরের লোকটার বিষণ্ণতা আরো বেড়ে গেল। সে অনুমতি চাইল। বলল, ‘তার পরিবার তার জন্য অপেক্ষা করছে’ কোন পরিবার ঠিক জানা হল না। সে চলে গেল। এরপর আমার প্রবল অনুসন্ধিৎসা আমাকে পাশের টেবিলে বসা যুবক ছেলে দুটির সাথে আলাপ করতে প্রলুব্ধ করল। আমি ভাবছিলাম নিজের একটা পরিচয় থাকা ভালো। ‘রাইটার কথাটা আমার ক্ষেত্রে কেমন খাটে। আশ্চর্যের ব্যাপার নিজেকে লেখক হিসাবে পরিচয় করাতে এটা অদ্ভূত ভাবে কাজ করল।

    ওদের মধ্যে একজন সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অবসর সময়ে তরুণ-তরুণীদের বিভিন্ন প্রবেশিকা পরীক্ষার তালিম দেয়। ওপর জন রেলের বুকিং ক্লার্ক। আমি কোচিং টীচারকে একই প্রশ্ন করলাম, ‘এই শহরের নাম মুঘলসরাই কেন?’ টিচার বললেন, ‘আওরঙ্গজেবের সৈন্যরা কাশী আক্রমণের সময় আগে এখানে ঘাঁটি গেড়েছিল। সেই থেকেই এই জনপদ মুঘলচক নাম অর্জন করে’। তবে তিনি এও জানালেন যে, এই ব্যাখ্যায় তিনিও খুব একটা নিশ্চিন্ত নন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন, পরদিন সকালে এই শহরের বরিষ্ঠ নাগরিকের কাছে নিয়ে যাবেন। তিনিই এই প্রশ্নের ঠিক ঠিক উত্তর দিতে পারবেন।

    এরপর আলোচনা জাগতিক প্রসঙ্গে গড়াল। ভারতীয় আতিথেয়তার উন্মেষ ঘটল। কোচিং টিচার বললেন, ‘আগামীবার যখন মুঘলসরাই আসবেন তখন স্ত্রীকে অবশ্যই নিয়ে আসবেন। উঠবেন আমার বাড়িতে’। যখন আমি বললাম, আমি দেবীলজে উঠেছি, ওরা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আরে আপ ওঁহা ক্যায়সে পৌঁছ গয়া’। যখন আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘দেবীলজের দোষটা কোথায়?’ ওরা বলল, ‘জায়গাটা প্রায়ই পুলিশ রেড করে কারণ মানুষ ওখানে কলগার্ল নিয়ে ওঠে’। এতক্ষণে দেবীলজের ব্যাপারটা আমার কাছে জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেল। এই কারণেই লুঙ্গি পরা নাদুসনুদুস লোকটা আমার সাথে বাক্যালাপে অনিচ্ছুক। আমাকে দেবীলজ থেকে উদ্ধারের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। রেলওয়ে বুকিং ক্লার্ক বলল, ‘রেলওয়ে রিটায়ারিং রুমে থাকতে চাইলে, সে ব্যবস্থা করতে পারে। লেখক হিসাবে মুঘলসরাই স্টেশনে উপস্থিত থেকে এর বৈভব উপলব্ধি করার মধ্যে অন্য কিছু আছে। কথায় আছে পৃথিবী ঘুমিয়ে থাকলেও মুঘলসরাই জেগে থাকে’। আমাদের মধ্যে মোবাইল নম্বর বদল হল। সে চলে গেল। তার নাইট ডিউটি আছে। যাবার আগে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেল। সে একঘন্টার মধ্যে ফোনে যোগাযোগ করবে।

    পানশালা প্রায় খালি হয়ে গেল। আমি এবং সিভিল সার্ভিসে আকাঙ্ক্ষী যুবাটি রেলস্টেশন থেকে ফোনের প্রতীক্ষায় রইলাম। একপ্লেট চিকেন পকোড়া ফরমায়েশ করলাম। খেতে খেতে কোচিং টিচার আমাকে বললেন, ‘পরেশান মত হুইয়ে। যতরাতই হোক আপনাকে আমি নতুন হোটেলে স্থানান্তরিত করেই ঘরে ফিরব’। আমি একবার রেলওয়ে ক্লার্ককে ফোন করলাম। দেখতে চাইছিলাম যে সে আমার জন্য কোনো রিটায়ারিং রুম-এর ব্যবস্থা করতে পেরেছে কিনা, কিন্তু তার ফোন বন্ধ করে রাখা।

    রাত এগারোটা। গতরাতের মতন মুঘলসরাই আবার ঘুমের আরকে ঢলে পড়েছে। আমি কোচিং টীচারের মোটরবাইকের পিছনের সিটে বসে দেবীলজ অভিমুখে চলেছি। লুঙ্গি পরা মোটা লোকটা রিসেপশনে নেই; পরিবর্তে অল্পবয়সী একটি ছেলেকে পাওয়া গেল। কোচিং টিচার উৎসাহ ভরে এগিয়ে চলেছে। দেখে মনে হচ্ছে সে এক মহান কাজের ব্রতী হয়েছে — আমাকে এখান থেকে উদ্ধার করতে। সহসা উঠোনে দাঁড় করানো একটা মোটরসাইকেল দেখে সে দাঁড়িয়ে গেল। বিড়াল যেমন ভয়ের কিছু দেখলে সারা গায়ের লোম খাড়া করে নিশ্চল হয়ে দাঁড়ায়, ঠিক তেমন। ‘আরে এতো ওমপ্রকাশকা মোটরসাইকেল হ্যায়; য়ো ইঁহা কেয়া কর রাহা হ্যায়’। ওমপ্রকাশ সেই রেলওয়ে বুকিং ক্লার্কের নাম, যে আমাকে রিটায়ারিং রুম দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পানশালায় বসিয়ে রেখেছিল। বিস্ময় প্রকাশের পর, সে সম্পূর্ণ নির্বাক ছবির নায়ক। সুস্থ মানসিকতার মানুষ মাত্রই জানে, ‘এ ম্যান ইজ নোন বাই হিজ কম্পানি’। এই ভিনদেশি লেখক মানুষটির কাছে তাই সে লজ্জায় পড়ে গেছে।

    কোচিং টিচার যে হোটেলে আমাকে নিয়ে এল সেটা স্পষ্টতই আমার চেনা। এই হল সেই হোটেল, যেখান থেকে আমি ভোরবেলায় প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলাম। ম্যানেজার কোচিং টীচারের পূর্বপরিচিত। তিনি আমাকে সবচাইতে ভালো ঘরটা বিশেষ সুবিধায় পাইয়ে দিলেন। রুম-বয় আদতে এক মধ্যবয়সী মানুষ। যিনি জীবনের ত্রিশটা শীতের সময় এই হোটেলেই কাটিয়েছেন। তিরিশ বছরেও তার ‘বয়’ নামটা ঘুচে যায় নি। সে আমাকে পরিষ্কার তোয়ালে ও বিছানার চাদর এনে দিল। সঙ্গে কিছু রুটি ও ওমলেট। কোচিং টিচার বিদায় নিতেই আমি ভীষণ ভাবে ঘুমের প্রয়োজন বোধ করলাম। কিন্তু সম্পূর্ণভাবে ঘুমের দেশে যাওয়ার আগে যে ক্ষণস্থায়ী সময়টা, সেই সময়টায় আমার অবচেতন মন একটা সঙ্কেত পাঠাল, ‘দিবাকর, কী উদ্দেশ্যে তোমার মুঘলসরাই আগমন?’

    পরের দিন সকালে প্রাতরাশের পর কোচিং টীচারকে ফোন করলাম। একজন মহিলা ফোন ধরলেন। বললেন, ‘উনি ঘুমিয়ে আছেন’। আমি বললাম, ‘উনি আমাকে আজ সকালে এই শহরের একজন বরিষ্ঠ নাগরিকের কাছে নিয়ে যাবেন বলেছেন। মহিলাটি সম্ভবত শিক্ষক ভার্যা বললেন, ‘একঘণ্টা পর ফোন করুন’। একঘণ্টা পর ফোন করলাম, কিন্তু তার ফোনের স্যুইচ বন্ধ পাওয়া গেল। লেখক হিসাবে আমার বোঝা উচিত ছিল, রাতের অন্ধকারে যে প্রতিশ্রুতির জন্ম হয়, দিনের আলোয় তা তুচ্ছ হয়ে যায়।

    আমি হোটেল ছেড়ে মুঘলসরাইয়ের রাস্তায় নেমে এলাম। ডিসেম্বরের রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল। রাতে সুন্দর ঘুম হওয়ায়, শহরটাকে আরো প্রাণবন্ত মনে হচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনের কাছে চলে এলাম। উত্তরপ্রদেশের ট্যুরিজ্‌ম্‌-এর কিয়স্কে একজন মহিলা বসে আছেন। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর জন্মস্থান কোথায়?’ মহিলা বললেন, ‘শাস্ত্রীজি জন্মেছিলেন তাঁর মাতামহের বাড়িতে, কুরখালা সেন্ট্রাল কলোনিতে। কলোনিটা এখনো আছে, তবে উনি যে পুরোনো বাড়িটিতে জন্মেছিলেন তার কোনো অস্তিস্ত্বই নেই। আপনি বরঞ্চ রেলওয়ে ইন্টারকলেজে যেতে পারেন। ওখানে শাস্ত্রীজি পড়াশোনা করেছেন’।

    সকালের রোদে কেমন যেন ঝিম ধরা ভাব নেমে আসছে। এরপরই আসবে দ্বিপ্রহর। আমি ভদ্রমহিলাকে আমার অভিপ্রায় জানালাম। বললাম, ‘মুঘলসরাইয়ের স্থাননামের ইতিহাসটা জানতে চাই’। মহিলা একটু ভাবলেন, এরপর বললেন, ‘রেলওয়ে ইন্টার কলেজের অধ্যক্ষ ডক্টর চতুর্বেদী ইতিহাসের অধ্যাপক। ওনার কাছে আপনি ঠিক ঠিক উত্তর পেয়ে যাবেন। আমি মহিলাটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে স্টেশনের বাইরে এলাম। এতক্ষণে সম্ভবত আমি ঠিক রাস্তায় হাঁটছি। স্টেশনের বাইরে একটা সাদামাটা ব্যানার, তাতে লেখা ‘মুঘলসরাই স্টেশনকা নাম বদলকর পন্ডিতজী কা নাম করনা হোগা’। কে এই পন্ডিতজী? ১৯৬৮ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারী এই স্টেশনের মালগাড়ির ইয়ার্ডে আর.এস.এস নেতা পন্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় নৃশংসভাবে খুন হন। এই মৃত্যুর তিন যুগ পরে, তার অনুগামীরা এই স্টেশনের নাম বদল করতে উদ্যোগী হয়েছেন। পন্ডিতজী নি:সন্দেহে এক যুগপুরুষ। তাকে সম্মানিত করে রাখতে নতুন কিছু মহৎ নির্মাণে তাঁর নাম অঙ্কিত হতে পারত। কিন্তু মুঘলসরাই স্টেশন কেন? এই স্টেশনের নাম তো স্বাভাবিকভাবে কালের প্রবাহে সৃষ্ট একটি নাম! এই সব নাম পরিবর্তনে ভারতের সমন্বয়ী ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির হানি হতে পারে। ইতিহাসকে কী বলা যায় — হে ইতিহাস, তুমি স্তব্ধ হয়ে থাকো।

    একটা রিক্সা ডেকে নিলাম। তপ্ত দ্বিপ্রহর। আমি চলেছি স্বাধীন ভারতবর্ষের সবচাইতে বিনয়ী প্রধামন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর কলেজ পরিদর্শনে। গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড থেকে একটা শাখা রাস্তা রেলওয়ে সাম্রাজ্যে প্রবেশ করল। এখানে আঁকাবাঁকা পথে কয়েকটা রেলের দপ্তর ও কর্মচারীদের আবাস রয়েছে। কিছুক্ষণ পরেই রিক্সার চাকাদুটো পরিত্যক্ত রেলওয়ে লাইন পার হয়ে আমার শিরদাঁড়া ভাঙার উপক্রম করছিল। কবে ও কী কারণে এই লাইন পাতা হয়েছিল, কেনই বা এরা পরিত্যক্ত হল, কেউ জানে না। দ্বিপ্রহরের গোলকধাঁধায় পাক খেয়ে মরছি। অবশেষে রাস্তাটা একটা বাঁক পেরিয়ে সুবিশাল এক বিস্তৃত ভূখন্ডে পৌঁছে গেল। সেখানে দ্বিকচক্রবালে কমলা রঙের সূর্যটা মাটির সঙ্গে মিশে রয়েছে। একটা লাল ইটের তৈরি অট্টালিকার সামনে ভারতীয় বায়ুসেনার একটা যুদ্ধ বিমান স্থাপন করা। বিল্ডিংয়ের সামনে লেখা ‘রেলওয়ে ইন্টার কলেজ’। আমি সরাসরি অধ্যক্ষের ঘরের নিকটে পৌঁছে গেলাম। দরজার বাইরে নেমপ্লেট — ডক্টর পি. এস. চতুর্বেদী। এখানেও আমার লেখক পরিচিতিটা কাজে লাগল। উনি আমাকে সমাদর করে বসালেন। বললেন, ‘শাস্ত্রীজি যখন এই কলেজে পড়তেন তখন আমি স্কুলের ছাত্র মাত্র। উনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর একবারই এই কলেজে এসেছিলেন। কিন্তু তার কোনো স্মারকচিহ্ন এখানে নেই। আমি বললাম ‘আমার আরো একটা জিজ্ঞাস্য আছে’। চতুর্বেদী বললেন, ‘বলুন’।

    ‘কেন মুঘলসরাইকে মুঘলসরাই বলা হয়’।

    প্রশ্নটা নিজের কানেই ‘পাজ্‌ল’-এর মতো শোনালো। চতুর্বেদী স্যার কিন্তু ততক্ষণে ষোলোশো শতাব্দীতে পৌঁছে গেছেন। ‘বিহারের জায়গীরদার ও প্রশাসক শের শাহ্‌ সুরি চুনার দূর্গ দখলে রেখেছিলেন। তিনি ছিলেন মজ্জায় মজ্জায় পাঠান। তাঁর কর্মক্ষেত্র তখন সমগ্র বিহার-বঙ্গে বিস্তৃত। সেই সময় দিল্লীর সম্রাট ছিলেন বাবর পুত্র হুমায়ুন। শের শাহের এই বাড়বাড়ন্ত হুমায়ুনের পছন্দ ছিল না। তিনি চার মাস ধরে চুনার দূর্গ অবরোধ করে রাখেন। শের শাহ্‌কে তাঁর প্রস্তাব — তুমি বাংলাটা আমাদের ছেড়ে দাও। বিনিময়ে চুনার ও জৈনপুর দখলের চেষ্টা মুঘলরা করবে না।

    এতটুকু এক নি:শ্বাসে বলে চতুর্বেদী স্যার একটু থামলেন। এরপর বললেন, ‘আপনি জানেন রাজনীতিতে সবসময় সাধারণ নীতি মেনে চলা সম্ভব হয় না। নীতি বিরোধী দুষ্কর্ম রাজনীতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। বেগতিক দেখে হুমায়ুনের প্রস্তাবে রাজী হলেন শের শাহ্‌। এরপর হুমায়ুন বাংলার দিকে এগোতেই চুক্তিভঙ্গ করে এগিয়ে গেলেন উত্তর ভারতের দিকে। কারণ তিনি জানতেন বাঙলা যতই সমৃদ্ধিশালী হোক না কেন, ক্ষমতার প্রকৃত কেন্দ্রভূমি আগ্রা ও দিল্লীকে ঘিরে। পরবর্তী পাঁচ বছর হুমায়ুন পলাতক, শের শাহ্‌ সম্রাট। শের শাহ্‌কে তাড়া করার সময় এই হুমায়ুন বাহিনী ডেরা ফেলেছিল এই ছোট্ট শহরে, তাই নাম মুঘলচক। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে তৈরি হল জংশন স্টেশন। ব্রিটিশরা নাম দিল মুঘলসরাই। এটা ব্রিটিশের দেওয়া নাম।

    আমি আবার সেই পাঁচশো বছরের পুরোনো জি.টি.রোড ধরে এগিয়ে চলেছি। আমার একটা স্বপ্ন ছিল — সরাইখানা। মানুষের প্রাণস্পন্দনে মুখরিত একটি পান্থগৃহ, ক্লান্ত পথিকের দুদন্ড বিশ্রামের জায়গা। হাঁ-ক্লান্ত পথিকরা আসছে দূর-দুরান্ত থেকে, গোরুর গাড়ি অথবা ঘোড়ার গাড়িতে। আরো দূর থেকে যারা আসছেন পশ্চিমের মরুভূমি পার হয়ে, তারা আসছেন উটের পিঠে। সব মিলিয়ে চলমান জীবনের আশ্রয় — যেখান থেকে নানা দিকে বেরিয়ে পড়া যায়। সব মিলিয়ে মানুষের কোলাহলের মুখরিত এক প্রাণ চঞ্চল পান্থশালা। বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে সেই স্বপ্নটা ভেঙে গেল।

    বিকেল তখনও তপ্ত দ্বিপ্রহরের হাত ছাড়েনি। মুঘলসরাইয়ের আমার শেষ বিকেল। আমার টিকিটে প্রস্থানের সময় লেখা আছে রাত একটা পঞ্চান্ন। আমার হাতে এখন পর্যাপ্ত সময়। একবার ভাবলাম রিক্সাটা ছাড়ব না, শহরটায় কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াই। কিন্তু উদ্দেশ্য বিহীন ভ্রমণে কোনো আনন্দ নেই। হোটেলে ফিরে খাতা-কলম নিয়ে বসলাম। লিখতে লিখতে রাত বারোটা বাজল। কিন্তু সরস্বতী লজের এই আরামদায়ক ঘরটা আমার আর ভালো লাগছে না। আমি ‘চেক আউট’ করে বেরিয়ে এলাম। স্টেশনে পৌঁছোবার আগে আরো একটা ভোজপুরি সিনেমার পোস্টার ‘রঙবাজ আসিক’। রঙবাজ, এই পরিভাষার সঙ্গে আমি ছোটোবেলা থেকে পরিচিত। যারা অযথা মানুষকে ধমকি প্রয়োগ করে বাহবা পেতে চায়। অথবা যাদের সাজসজ্জার বাহার মানুষকে কিছুটা আকৃষ্ট করে, তাদেরকে এই বিশেষণে ভূষিত করা হয়।

    স্টেশনে এসে মানুষ, গরু ও কুকুরের মিশ্রিত ভীড় ঠেলে, এঙ্কোয়ারিতে পৌঁছালাম। অফিসে কেউ নেই। একটা সাদা কাগজে মার্কার পেন দিয়ে ট্রেনের স্থিতি নির্দেশ করা আছে। রাজধানী এক্সপ্রেসের পাশে লেখা ‘গয়া’। হিন্দিতে গয়া শব্দের অর্থ চলে গেছে। বুকের ভিতরটায় তীব্র ভয় ও শিহরনের অনুভূতি হল। চিন্তিত মুখে বার বার ঘড়ি দেখছি। স্টেশনের বড় ঘড়িটায় তখন বারোটা পঞ্চান্ন।

    কিছু মুহূর্ত পার হওয়ার পর আমার খেয়াল হল রাজধানী এক্সপ্রেস তিনদিন পাটনা হয়ে, চারদিন গয়া হয়ে হাওড়া পৌঁছায়। এই ট্রেনটা গয়া হয়ে হাওড়া পৌঁছাবে তাই ওর পাশে ‘গয়া’ লেখা আছে। যদিও আমি তখনকার মতো চিন্তামুক্ত হলাম, কিন্তু অভিঘাতটা দীর্ঘস্থায়ী হল। মাথার কোনো গ্রন্থিতে ‘গয়া’ কথাটা সন্নিবেশিত হয়ে গেছে। পরদিন সকালে হাওড়া পৌঁছিয়েও মানসিক স্থিতি পুনরুদ্ধার হল না।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ উইকিপেডিয়া থেকে
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments