।। এক ।।
জলিল চাচা বলল, “সে কথা আর কী বলব! এর আগে কাউকেই বলিনি, কারণ আমি জানি কেউ বিশ্বেস করবেনে। একমাত্র তোমাকেই বলা যায়, কারণ তোমরা এখেনে ছিলে দীর্ঘদিন। বিশ্বেস করলে একমাত্র তোমরাই করবে।”
কথাগুলো বলে জলিল চাচা থামল। কাঁধের গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মুছল। রোহন কোন প্রশ্ন করল না। কেবল উৎসুক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। ঠিক কী শোনানোর জন্য এতটা সময় নিচ্ছে জলিল চাচা?
তারপর আপনমনে চাচা বলে, “ঘোড়া চেপে এক লোক আসে। সে রাজার ডাকহরকরা। সে আসে চিঠি নিতে। বন্ধ ফটকের সামনে সে দাঁড়ায়, ফটকের গায় শব্দ করে। ফটক খুলে যায়, সে ভেতরে চলে যায়। ফটক ফের ভেতর থেকে বন্ধ হয়ে যায়।”
একটানা কথাগুলো বলে জলিল মন্ডল থামল। দশ বছর পর দেখা হচ্ছে তাদের। রোহনের তো চাচার কথা মনেই ছিল না। যখন ট্রেকার থেকে দিঘির পাড় স্টপেজে নেমে পিচ রাস্তা পেরিয়ে তারা দিঘির পাড়ের কুলগাছের নিচে দাঁড়াল, জলিলচাচাই কথাটা বলল, রোহনবাবু তো?”
হাঁটু অবধি নীল চেক লুঙ্গিটা গুটিয়ে রাস্তার ধারেই বসেছিল বুড়োটা। উবু হয়ে, খালি গা, কাঁধে গামছা। একমাথা কাঁচা পাকা চুল। গালে খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি গোঁফের আড়ালে রোহন লোকটাকে চিনতে পারছিল না। সে উৎসুক চোখে তাকালে চাচা বলল, “হোমের সামনের এই জমিটা যে আমার—ভুলে গেলে? রোজ অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে এক পাল্লা করে শসা কিনে নিয়ে যেতে—চারটাকা পাল্লা তখন—মনে নেই?”
এবার মনে পড়ল রোহনের। আরে, হ্যাঁ, এতো সেই বুড়োই। দেহে বয়সের ছাপ পড়েছে বটে, কিন্তু একবার দেখলেই তাকে চেনা যায়। এক সময় লোকটার সঙ্গে অফিস ফেরতা সে কত গল্প করেছে। হাঁটতে হাঁটতে তারা রাস্তা ধরে চলে গেছে অনেকদূর। বুড়োটা তাকে বলেছে এই দিঘির গল্প। নীল আকাশ কীভাবে হাজার রঙের রামধনুর আকাশ হয়ে ওঠে মাঝরাতে—সেই কথা। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে কোথায় যেন হারিয়ে যেত রোহন। আর সেই লোকটাকেই দশ বছরের ব্যবধানে সে চিনতে পারল না! আর লোকটা তাকে চিনে নিল এক লহমায়!
রোহন মাটিতে বসে পড়ল। ঘাসের উপর। বলল, “চাচা, আছ কেমন?”
“এই, চলে যাচ্ছে। তুমি কিন্তু একটু মোটা হয়েছ রোহনবাবু, চেহেরা খোলতাই হয়েছে।”
রোহন কী বলবে? হাসল।
“কোথায় চাকরি করছ এখন?”
“একটা সরকারি চাকরি পেয়েছি।”
“সে তো বটেই। তোমরা সব লেখাপড়া জানা ছেলে, সরকারি চাকরি তোমরা করবে না তো, কে করবে।”
হাসল রোহন। বলল, “তেমন কিছু নয় চাচা, নিচের দিকের পোস্ট। মাইনে তেমন নয়।”
“কিসের চাকরি?”
“পিওনের।”
“যাই হোক, সরকারি চাকরি, এই হোমের থেকে ভাল তো!” বলে চাচা উদাস হয়ে বলল, “তবু তুমি এলে—অনেকদিন পর হলেও এল—কেউ তো আসে না। কম লোক কাজ করে গেছে এখানে। কেউ এর ছায়াও মাড়ায় না! এই হোম এখন অভিশপ্ত!”
গাছের ধারে রোহন চুপ করে বসে রইল। বেরুবার সময়ই তো সে মাঝে মাঝে শসা নিত। কখনও বেগুন। মাল দিত চাচা, আন্দাজে মেপে। এই মাঠে সে দাঁড়িপাল্লা কোথায় পাবে? যাই হোক, বাজার দরের চেয়ে অনেক সস্তা পড়ত তখন।
চাচা আপন মনেই বলে চলল, “সবচেয়ে খারাপ লাগে কার জান? আমার। আমার কাছে এতটুকু জমিই সব। অথচ হোমের বুড়ো মালিক কত কায়দা করে এটি কিনে নেবার চেষ্টা করেছিল। মাত্র বারো কাঠা জমি। তাই নেবার জন্য পার্টির লোক অবধি আমার পিছনে লাগিয়ে দিল। আমিও তেমন তেএটে লোক। মরণপন করলুম, জমি কিছুতেই ছাড়বুনি, সে যাই হোক না কেন। তখন বুড়োকে দেখলেই গাল পাড়তুম। আর এখন দেখ, আমার সাথে ঝগড়া করার লোক নাই!”
রোহন চুপ করে শুনছিল। এই ঘটনাটা সে জানে। সে এখানে থাকতে থাকতেই এই ঘটনাটা শুনেছিল। জমিটা চাচা যদি বুড়োকে বেচে দিত, হোমটা একদম রাস্তার ধার থেকে শুরু হতে পারত। আর এখন তো হোমটাই নেই। চাচা কিন্তু রয়ে গেছে, আগের মতই, বহাল তবিয়তে।
চাচা আবার উদাসীন হয়ে গেল। বলল, “পুলিশ এসে যেদিন সিল করে দিয়ে গেল, তারপর থেকেই এমন সব দেখা আমার শুরু। গেরামের লোক বলে, ও তোমার বুড়ো বয়সের মতিভ্রম।”
চাচাকে সঙ্গে নিয়ে হোমের ভেতর ঢুকে পড়ল রোহন। বাঁ হাতি চাচার ওই এক টুকরো জমি, ডানহাতি একটা ঝিল। মাঝে সরু আলপথ বেয়ে হোমের দরজায় পৌঁছতে হয়। সররকারি লোক ভিজিটে এলে মোরাম রাস্তার গায়ে গাড়ি রাখতে হোত। যদিও বাইরেটা সিল করা, কিন্তু গ্রামবাসীরা হোমের পাঁচিলে একটা ফোকর করে চুরি করা শুরু করেছে। প্রথমে হোমের দরজা-জানালা-খাট-টেবিল-চেয়ার। তারপর অন্যান্য সব সরঞ্জাম। আর এখন কিছু না পেয়ে হোমের দেওয়াল ভেঙ্গে ইঁট নেওয়া শুরু হয়েছে।
ভেতরে ঢুকে চাচা বলল, “তবে আমি যতক্ষণ জমিতে থাকি, গেরামের কেউ ঢুকতে সাহস করে নে। কিন্তু আমি সরে গেলেই যা যা প্রোজন, সব নিয়ে সরে পড়ে। কত অনাথ সব মেয়ে এখানে ছিল বলত! আর এখন দেখ, সব ভোঁ-ভাঁ। হোমের সেই সব মেয়েরা বসে বসে আমার চাষ করা দেখত, জানালা দিয়ে ডাকত। সেই সব দিন কোথায় চলে গেল!”
রোহন ঘুরে ঘুরে সব দেখছিল। এখন দেখলে কে বলবে এই হোম একদিন গমগম করত। পঞ্চাশজন সমাজ পরিত্যক্তা নানা বয়সের মেয়ের আবাস ছিল। বছর শেষে তিনদিন ধরে অনুষ্ঠান হোত এই হোমের উঠোনেই। স্থানীয় মান্যগণ্য অতিথিরা আসতেন। হোমের মেয়েরা যেমন নাচত, অভিনয় করত, তেমনি স্থানীয় ছেলে মেয়েরাও নাটক, আবৃতি, ছড়াপাঠ করত। রোহনরা তার সাতদিন আগে থাকতে নাওয়া-খাওয়ার সময় পেত না। কাজ, গল্প, হাসি, মজা—কী হোত না! কিছু লোকের তৃতীয় রিপুর তাড়নায় গোটা হোমটাই কালো তালিকাভুক্ত হয়ে গেল। যে কয়টি মেয়ে ছিল, তাদের অন্য হোমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
চাচা পুরো বাড়িটার দিকে আঙ্গুল বাড়িয়ে বলল, “এত বড় বিলডিং, কত যে ঘর! আজ সব শূন্য। কত বড় বড় ঘাস জন্মে গেছে। বট-অশত্থ মাথা তুলেছে এখানে ওখানে।”
রোহন গাছের ছায়ায় দাঁড়াল। বলল, “কিসের চিঠি নিতে আসে ডাকহরকরা? কার চিঠি?”
“সে আর আমি কি জানি বাবু, মুখ্যু মানুষ। তবে দেখ গিয়ে কোন চিঠি হয়ত ফেলা হয়নি, হোম তার আগেই বন্ধ হয়ে গেল। সে চিঠিই নিতে আসে ডাকহরকরা। যাক, রোহনবাবু, আমি একটু জমির কাজে যাই। আর একটা কথা, ছবিকে মনে আছে তোমার? ও এদিকেই বাড়ি করেছে। ও আসে এখানে। তোমার কথা, তোমাদের কথা, সেই সময়ের কথা বলে।”
এক দেবদারু গাছের নিচে বসে পড়ল রোহন। গাছের গায়ে ঠেস দিল। তখন যেন বাতাস থেকে কেউ বলে উঠল, কতদিন আমাদের দেখা হয়নি, বল। কত করে মনে পড়ে, আর মন কেমন করে। ইচ্ছে করে তোমায় ছুঁই, ছুঁয়ে থাকি। কিন্তু জানি এ জীবনে তা ঘটবে না আর। তুমি কাছে নেই, তবু আমি তোমায় নিয়ে আছি। আমার সবখানেই তুমি আছ।
কই তবে ছুঁয়ে দেখাও দিকি—ফিসফিস করে উঠল রোহন। বাতাস বলল, ছোঁব তো, তার আগে সেই চিঠিগুলো বার করতো দেখি।
।। দুই ।।
“তোমরা যখন এখানে কাজ করতে মেয়েদের বাড়ির লোক ভাবতে। বাড়ির পুরানো জামাকাপড় আনতে। সোয়েটার আনতে। চাঁদা তুলে হোম থেকে দুটি মেয়ের বিয়েও দিয়েছিলে। একটা মেয়েকে যোগাড়-যাত করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোও হয়েছিল। পরে জেঠু মারা গেল, হোমের পরিবেশ অন্যরকম হয়ে গেল। জেঠু মারা যেতে বড়দা দায়িত্ব নিল হোমের। জেঠুর আমলে ছেলেরা বিকেল পাঁচটার পর হোমে থাকতে পেত না। বড়দার আমলে সব ঘুচে গেল। বাইরের লোকের হাতে ক্ষমতার রাশ চলে গেল।”
রোহন চুপ করে রইল। ছবি তেমনি আছে। সেই নাতি উচ্চ দেহ, না মোটা-না রোগা। তবে দেহে শ্বেতীর পরিমাণ বেড়েছে। রোহনের মনে আছে, হোমের কোটায় ছবি চাকরি পেয়েছিল। অঙ্গনওয়াড়ি ইস্কুলের দিদিমণি। পোশাক দেখে তার মনে হল, ছবি বোধহয় এখনও দশ বছর আগের সেই চুরিদারগুলোই পড়ে।
ছবি মন খারাপের গলায় বলল, “তবু তুমি দেখতে এলে, দাদা। ভালোই জান, কি দেখবে—তবু এলে তো। ভেতরের টান না থাকলে কী আর আসো?”
ছবির ভাইবউ শিপ্রা। এই গ্রামেরই মেয়ে। এই যে বাড়িটা ছবি ও তার ভাই মিলে করেছে—জমিটা শিপ্রার বাবার। শিপ্রা মেয়েটি ভাল, বছর কুড়ি বয়স হবে। কিভাবে সে রোহনকে তোয়াজ করবে তার ফিকিরেই ঘুরে বেড়াচ্ছে সর্বক্ষণ। একবার রান্নাঘর থেকে খুন্তি হাতে এসে জানাল, “রান্না প্রায় হয়ে গেছে। আধঘন্টার মধ্যেই ভাত দিয়ে দেব।”
“এখুনি? এই তো এক পেট মুড়ি খাওয়ালে। সঙ্গে দারুণ একবাটি আলুরদম। এর পর কি আর খিদে পায়?”
শিপ্রা খিল খিল করে হাসল। বলল, “ও বললে চলবে কেন দাদা? এতটুকু মুড়ি খেয়ে যদি বলেন পেট ভরে গেছে — তাহলে আর কিছু বলার নেই। শহরের লোকরা যে কিরকম খায় তা কি আমরা জানি না? আপনি ত আমাদের সঙ্গে খাওয়াতে এঁটেই উঠতে পারবেন না। কত খেটেখুটে রান্না করেছি, সব খেতে হবে, ফেললে চলবে না।” বলেই সে রান্না ঘরের দিকে ছুটল।
ছবির দিকে ফিরে রোহন বলল, “চাচা তোর কথা খুব বলছিল। তুই মাঝে মাঝে হোমে যাস, গিয়ে ভেতরে ঢুকে বসে থাকিস।”
ছবি নিচু গলায় বলল, “কি করব—পুরানো স্মৃতি—জীবনের অনেকগুলি বছর যে ওখানে কেটেছে। বাড়িতে খেতে পেতুম না, বাবার কাজ নেই, মা অসুস্থ, দাদারা ভাত দিত না। হোমই ছিল আমাদের ঘরবাড়ি—ভুলি কি করে! কেউ তার অসহায় বিধবা মেয়েকে রেখে যেতে চায়, যাকে দেখার কেউ নেই, ভাত দেবার কেউ নেই। কেউ তার মাথা পাগল বোনকে এখানে রেখে নিস্কৃতি পেতে চায়।”
“চাচা এক ডাকহরকারকে সে ঢুকতে দেখে হোমের ভেতর। কিন্তু বেরুতে দেখে না। হোমের ঢুকে সেই কথাই হচ্ছিল। সেখানে এখন এত গাছ! আমাদের বুড়ো স্যার গাছ ভালবাসতেন। কত ফুলগাছ করেছিলেন। এখন সব জঙ্গল। আমাকে দেখে একটা সাপ সরে গেল—এ ও দেখেছি আমি। কি ছিল, আর কি হয়ে গেল। মনটা খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছিল, জানিস! তখন চাচা বললে তোর কথা। পুরানো অনেক মেয়েই তো আমরা থাকতে থাকতেই ঘরে ফিরে যায়। কেউ বা হোমের কোটায় সেলাই শিখতে, নার্সের ট্রেনিং নিতে চলে যায়। তারপর তো আমরা ছেড়েই দিলাম। আমি, সোম, মাস্টার, দেবিকাদি, পারুল—সব এক এক করে চলে যেতে থাকল অন্যান্য নানা এনজিও’তে। সবাই চলে গেল, হোমের মায়া তুই কাটাতে পারলি না। তাই তো হোমের এত কাছে জায়গা কিনে বাড়ি করেছিস, ছোট ভাইটার সঙ্গে আছিস। চাচাই একটা ভ্যানে তুলিয়ে তোর বাড়ি পাঠিয়ে দিলে।”
“এসে খুব ভাল করেছ দাদা। কতদিনের সেই সব পুরানো কথা—বলবার লোক নাই, কইবার লোক নাই—তাই ওই শিপ্রাকেই বলি। ও খুব মন দিয়ে শোনে। আর এই জমিটা ওর বাবারই। ভাই বাড়ি করার খরচটা দিয়েছে।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলে চলে, “তোমরা চলে যেতে যে স্টাফরা এল না, তারা তেমন নয়। তাদের মধ্যে মানবিকতা কম। আমাদের সঙ্গে বসে কথা বলত না। যখন বড়দাদা ক্ষমতায় আসে, তার পেটোয়া লোকরাই হোম চালাতে শুরু করল। রাত বিরেতে লোক চলে আসত। তারপর তো সবই কাগজে পড়েছ।”
“হোমে গিয়ে তুই চাচার মত কিছু দেখিসনি?”
“রাজার পিওন? না। চাচা বলে, আমি শুনি। কেউ বিশ্বাস করে না, আমি করি। তবে আমি দেখি অন্য জিনিস।”
“কি বলত?”
“অজস্র সাদা বক ওড়ে হোমের ভেতর। হোমের জমিতে যে মেহগনি, দেবদারু গাছ—তাদের ভেতর ভেতর গজিয়ে ওঠা বট-নিম-অশ্বত্থের ফাঁকে ফাঁকে সেই সব বকেরা উড়তে থাকে। সে এক দেখার মত দৃশ্য।”
“অত বক? হোমের ভেতর তারা কি বাসা করেছে?”
“না। ব্যাপারটা আসলে তা নয়।”
“তবে?”
“দেখি, বকেরা উড়ছে। একদিন, দুইদিন, তিনদিন—এইভাবে দেখতে দেখতে বুঝি — ও গুলি আসলে সাদা বক নয়; সাদা পাতা—আসলে তা অজস্র চিঠি! হোমের ভেতর তারা উড়ছে, ভাসছে, ঘর-গাছপালা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। এত চিঠি যে তা কল্পনাও করা যায় না। আমি প্রথম প্রথম খুব অবাক হয়ে যেতাম, ভাবতাম মনের ভুল। এমন যদি হবে তবে চাচাও দেখত। কিন্তু কই চাচাও তো এইসব দেখে না; চাচা তো ঢোকে হোমের ভেতর, হোমের নোনা লাগা দেওয়ালে পিঠ দিয়ে ছায়া পোহায়, রোদ মাখে। কিন্তু কোন চিঠির কথা আমি চাচার মুখে শুনিনি। তবে চাচা কেবল পিওন দেখে, চিঠি নয়। এত চিঠি কোথা থেকে আসে? কে লেখে? কাকে লেখে? কেনই বা? কিন্তু এ কথা আমি কাউকে বলতে পারিনি, দাদা। এই প্রথম তোমাকেই বললাম—এই নাও, খাবার এসে গেছে, হাত ধুয়ে নাও।”
।। তিন ।।
কত কিছু রান্না করেছে শিপ্রা। রেশনের দু’টাকা চালের মোটা ভাত। পিঁয়াজ ফোড়নের মুসুরি ডাল, ডাঁটা-আলু-পোস্ত তরকারি। সঙ্গে বেগুন ভাজা, ডিমের ডানলা। শুকনো ভাতের জন্য পলতা ভাজা। গাছের কাঁচা আমের চাটনি। এত কিছু খাবার একসঙ্গে দেখে রোহনের চক্ষু চড়কগাছ!। এত সব একসঙ্গে খাওয়া যায় নাকি? শিপ্রা একগাল হেসে বলে, “চুপ করুন তো! এ আর কি রান্না হল? তাও পাতে মাছ দিতে পারলাম না। আপনি আসার খানিক আগেই জেলেরা পাড়া থেকে ঘুরে গেল। কাল মাছ হয়েছে বলে আজ আর কিনিনি। তখন কি আর জানতাম, আপনি আসবেন? নইলে তার কাছ থেকে দুটি ল্যাটা আর দুটি চ্যাং কিনে নিলে ভাল করে ঝাল করে দিতুম।”
“এ যে রাজকীয় খাওয়া—হাজার রান্না। এত খাব কখন?”
“কি যে বলেন দাদা! আপনারা হলেন শহুরে মানুষ। বাড়িতে কত ভাল ভাল খাবার খান, সে সব কি আর আমরা রেঁধে দিতে পারি?”
বলে শিপ্রা হাসতে লাগল। খুব হাসে মেয়েটা। কথায় কথায় হাসে। পরিবেশন করতে করতেই বলছিল, “আপনার কত শিক্ষিত ছেলেমেয়ে এখানে কাজ করতেন—সব এমএ পাশ—আমি ছবিদির মুখে সব শুনেছি। সময় পেলেই ছবিদি আপনাদের কথা বলে।”
“নীলিদির সঙ্গে যোগাযোগ আছে তোমার?”
ছবির কথাটা শেষ হওয়া মাত্র খুব বড় বিষম লাগল রোহনের। সে কেশেই যেতে থাকল। শিপ্রা ঘর থেকে তাড়াতাড়ি পাখা এনে বাতাস করতে থাকল মাথায়। ছবি বারবার বলতে থাকল, “একটু জল খাও দাদা, জল খাও—।”
শিপ্রা মাটিতে থাকা জলের গ্লাস তুলে নিয়ে রোহনের মুখের সামনে ধরে বলল, “নিন, জলটা খেয়ে নিন। এখন আর কথা বলতে হবে না। চুপ করে খান। যা বলার খেয়ে উঠে বলবেন।”
রোহন বলল, “না না, ঠিক আছে। শ্বাসনালিতে একটা ভাত চলে গেছিল—।”
“আর একটু টক দিই দাদা?”
“আরে না” বলে রোহন ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে তার পাত আড়াল করল।
“খান না, কিছু হবে না” বলে শিপ্রা আরও এক হাতা টক রহনের বাড়ান হাত এড়িয়ে বাটিতে ঢেলে দিল। বলল, “নীলিদির তো এদিকেই বাড়ি। দুটি গ্রাম পরে—শ্রীপুর। ওর ছেলে তো এবার ইঞ্জিনীয়ারিং এ ভর্তি হল। বেরুলেই চাকরি পেয়ে যাবে। আমি তো নীলিদির কাছ থেকেই শাড়ি সায়া যা লাগে কিনে নিই।”
রোহন মুখ তুলে তাকাল। অবাক হয়ে বলল, “মানে?”
ছবি বলল, “নীলিদি তো এখন কাপড়ের ব্যবসা করে। সংসার তো চালাতে হবে। ছেলেকে খরচ করে পড়াচ্ছে। ও ছেলেকে মনে আছে তো? ফাংসানে আবৃত্তি করতে আসত। তখন খুব ছোট ছিল। টু থ্রি তে পড়ে। সেই ছেলেকে ইঞ্জিনীয়ারিং পড়াতে নীলিদি জমি বেচে দিল। ভাল দাম পেয়েছে, জান তো। হাইরোডের ধারে জমি—এখন হুহু করে দাম বাড়ছে। সব কলকারখানা হয়ে যাচ্ছে—হাইরোডের ধারে চাষ আর হবে না—সব কল-কারখানার কেরামতি চলবে। নীলিদি ত এসে বলে, ছেলেটা চাকরি পেলেই ব্যাস, জামা-কাপড়ের ব্যবসা ছেড়ে দেব। বিএ পাশ করে লোকের বাড়ি বাড়ি ঘুরে শাড়ি বেচতে আর ভালো লাগে না। ওর বরটা তো জানো দাদা, ওরকম। কাজকর্ম কিছুই করে না, ঘুরে বেড়ায়। সব ঝক্কি নীলিদির। হোম যখন বন্ধ হয়ে গেল, বহুবার নীলিদিকে সাক্ষ্য দিতে কোর্টে যেতে হয়েছে, থানায় যেতে হয়েছে। প্রথম প্রথম ভয় পেত খুব। তারপর সয়ে যায়। এখন নিজের মনে ব্যবসা করে, বেশ আছে। আর—”
“কি?”
“তোমার কথা বলে।”
ছবি চুপ করে গেল। রোহন উঠোনের দিকে তাকিয়ে দেখল একটা বেড়াল ঘুরছে, আর দূর থেকেই জুলজুল করে দেখছে গৃহে উপস্থিত নতুন লোককে। বেড়ালের হাবভাব দেখে মনে হয়, এবাড়িতে তার অবারিত দ্বার। হয়ত সে শিপ্রার পায় পায়ে, আঁচলের তলায় তলায় ঘুরে ফিরে বেড়ায়। রোহন থাকায় সে উঠে আসতে পারছে না।
একটু চুপ করে থেকে রোহন বলল, “তুই তবে কবে হোম ছাড়লি?”
“সে অনেকদিন। তোমরা চাকরি ছেড়ে দিলে, আর ভাল লাগত না।” এই বলে সে চুপ করে গেল। কিছু বলতে গিয়েও রোহন মুখ খুলল না আর। সব কথা বলা যায় না। সে মুখ নিচু করে খেতে থাকল। শিপ্রা কোন একটা কাজে রান্নাঘরের দিকে সরে গেলে ছবি সেদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, “এই তো একবছর হল ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে। মেয়েটা খুব ভাল। কোন কিছুতেই কোন অসুবিধে নেই। সবই মানিয়ে গুছিয়ে নেয়, আর খুব হাসিখুশি।” ছবি বলল।
ছবির গলার টোন এমনি ছিল যে খাওয়া থামিয়ে রোহন মুখ উঁচু করল। ছবি আরও কিছু বলতে চায়। রোহন ছবির মুখের দিকে চেয়ে রইল।
একটু থেমে ছবি যেন নিজের মনে বকে যাচ্ছে এমনি করে বলতে থাকল, “ওর বাচ্চা আসছে না। ডাক্তার দেখিয়েছে। ডাক্তার বলেছে, চকোলেট সিস্ট আছে, সময় লাগবে।”
রোহন বলল, “এখুনি বাচ্চা কী, এত কম বয়স! চিকিৎসা চলছে, চলুক না।”
“এটা গ্রাম দেশ দাদা। ষোল বছরের মেয়ের বাচ্চা হয়। সরকারি পয়সা পেতে গেলে আঠারো হবার দরকার—তাই
বয়স বাড়িয়ে হাসপাতালে দেখায়। আর ওর তো ষোলোর চেয়ে বেশি, তাও একবছর হয়ে গেল বিয়ে হয়েছে। এখুনি ওকে পাড়া প্রতিবেশিদের কথা শুনতে হয়।”
রোহন দেখল, শিপ্রা ফিরে আসছে। আগের মতই, প্রায় দৌড়ে। এই ব্যাপারটা এড়াতে প্রশ্ন করল, “কী হল তারপর? চিঠিগুলি কি কুড়িয়ে আনলি ছবি?”
“না দাদা, কুড়ানো গেল না। ইচ্ছে থাকলেও তা ঘরে নিয়ে আসা গেল না।”
“কেন?” রাহুল বিস্মিত।
“চিঠিগুলি তারপর হল কি, ঘাসে-লতায়-পাতায় মিশে যেতে থাকল। আমার কী মনে হয় জান দাদা, চিঠিগুলি কারু জন্যে অপেক্ষা করে, সেই ডাকহরকরার জন্য নয়। কিন্তু ডাক না আসায় সেগুলি ঝরে ঝরে পড়ে। মাটিতে, গাছে পালায় মিশে যায়। একদিন আমি আর নীলিদি বসে আছি দেবদারু গাছেদের নিচে, তখন দেখি চিঠিরা সব ঝরে ঝরে পড়ছে। নীলিদিকে আমি তখন চিঠির কথা বলি। নীলিদি অমনি সেই চিঠিগুলি ধরার জন্য ছোটে, পায় না—হাতে উঠে আসে শুকনো পাতার দল। তা দেখে নীলিদির কান্না পায়। বলে, এই জন্যে এখানে আমি আসি না ছবি; না দেখি চিঠি ঝরে পড়তে, না তাদের একটিও হাতে পাই। এত মন কেমন করে যে বলার নয়—খালি তুই বললি বলেই এলাম—আজকের পর আর আসব না।”
।। চার ।।
বিকেলের দিকে রোদ পড়তে রোহন বেরুল। ছবিরা ছাড়তে চাইছিল না। অনেক করে বলছিল একটা রাত থেকে যেতে। বিকেলে নীলদির বাড়িতে নিয়ে যাবে। সেখানে বসে পুরানো দিনের কথা হবে কত।
আসার সময় না হয় জলিলচাচা একটা ভ্যান ঠিক করে দিয়ে ছিল। কিন্তু এখন সে রকম নেই। রোহন বলল, “হাঁটতে থাকি। কোন ভ্যান পেলে উঠে পড়ব। ততক্ষণ হাঁটি। কতদিন পর এলাম। জানি না আর আসতে পারব কি না।”
শিপ্রা অমনি ছবির আগেই তড়বড় করে বলে ওঠে, “আসতে পারবেন না মানে? আমরা আছি কী করতে? আমাদের জন্য আসতেই হবে।”
রাস্তা থেকে ছবিদের বাড়িটি হলুদ একতলা বাড়িটি দেখা যায়। মাথায় টালি। বাড়ি ঘিরে নানা ফল-ফুলের গাছ। বিরাট এক খেলার মাঠের ধারেই তার বাড়ি। সেটা পেরিয়ে সর্টকাটে মূল রাস্তায় আসা যায়। ছবি বলছিল, “ঢালাই করতে পারিনি দাদা। প্রচুর খরচ। হয়ত পরে হবে। দেখা যাক।”
রোহন হাঁটতে থাকল। ছবি ও শিপ্রা বাড়ির ছাচে দাঁড়িয়ে হাত নাড়তে থাকল। কিছু দূর যেতেই এক ভ্যান তাকে পেরিয়ে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল। সকালের সেই ভ্যানওয়ালা। হাতে চাঁদ পাওয়ার মত অবস্থা রোহনের। ভ্যানওলা বললে, “ইস্টিশন যাবেন তো? উঠুন।”
উঠে পড়ল রোহন। ভ্যানওলা প্যাডেলে চাপ দিয়ে বলল, “আপনি এদিকে এসেছিলেন কোথায়?”
“ওই হোমে।”
“সে তো বন্ধ হয়ে আছে আজ পাঁচ বছর। ওর মালিক জেল খাটছে। ফাঁসির সাজা নাকি হোত, কিন্তু কপাল জোরে বেঁচে গেছে। এখন সারা জীবন জেল খাটতে হবে। বুড়ো মালিক খুব ভাল লোক ছিল। ছেলেটা একদম ওঁচাটে। মেয়েদের উপর কম অত্যাচার করেছে! শেষে কয়টি মেয়েকে তো মেরেই দিল। মেরে রাতের অন্ধকারে নদীচরে পুঁতে দিয়েছে। ভেবেছিল কেউ জানবে না। কিন্তু মাথার উপর যে ভগবান আছেন, তিনি যে সব দেখছেন—লোকে সেটা ভুলে যায়। এখন সেই পাপের শাস্তি ভোগ করছে।”
রাহুল চুপ করে রইল।
লোকটা নিজের মনেই বলে চলল, “তা এখেনে আপনার কী দরকার? কেন এসেছিলেন?”
“আমি কিছু চিঠি নিতে এসেছিলাম।”
“হোমের চিঠি আপনি কার কাছ থেকে নেবেন? এখানে কেউ কাজ করে না, কোন অফিস চলে না। হোম কি আবার খুলবে তবে?”
“সেই পুরানো দিনের চিঠি।”
“সে আর কোথা পাবেন। সেখেনে আজ আর তো কিছুই নেই—নিজের চোখেই দেখলেন। গ্রামের লোকজন সব খুলে খুলে নিয়ে গেছে। এদ্দিন হয়ে গেল—এখন কি আর ওসব পাবেন? পরের বার এসে দেখবেন, গোটা বাড়িটাই লোপাট হয়ে গেছে। তা বাবু আপনি আসছেন কোথা থেকে?”
“মোড়পুকুর ডাকঘর থেকে।”
“মোড়পুকুর ডাকঘর? নাম শুনিনি কোনদিন। অনেক দূর বুঝি?”
“হ্যাঁ। তুমি কখনও হোমের ভেতর যাওনি?”
“গেছি তো। বহুবার গেছি।”
“তুমি দেখনি আকাশ থেকে অজস্র চিঠি ঝরে পরতে?”
“না তো বাবু। আমি যাই ঘরের জন্য টুকটাক ইঁটের দরকার হলে। জলকাদা হলে উঠোনে ইঁট পাততে হবে, পুকুরঘাটের জন্য দরকার থাকে—কি উনুন বানাতে কাজে লাগে। পাঁচিলের দেওয়াল এখন নরম হয়ে গেছে, দুই চারিটি লাথি মারলেই ইঁট খসে আসে। তবে কোন চিঠি পড়ে থাকতে দেখিনি।”
“কোন ডাকহরকরাকে দেখ? ঘোড়া নিয়ে ঢুকে যাচ্ছে হোমের ভেতর, চিঠি আনতে।”
শুনে একচোট হাসল লোকটা। বলল, “এই কাহিনি আমি শুনেছি, চাচাই বলেছে। এখানের অনেকেই জানে। ওকে সবাই বলে, হোমের পাহারাদার। অথচ দেখুন, ওর জমিই একদিন জোর করে কিনে নিতে চেয়েছিল বরদার বাবা। এ হল ওর বুড়ো মনের খেয়াল। ওর কথা ধরবেন না, বাবু। ওর ছেলেরা ওকে দেখে না, জমি আর হোম নিয়েই ওর দিন কাটে।”
।। পাঁচ ।।
কথা কথা স্টেশন এসে গেল। স্টেশনের গায়ে, রাস্তার ধারের দোকানগুলি সব একই রকম আছে। খড়, বা ছিটে বেড়ার দোকান। বেচাকেনাও হয়ত একই—আগের মতন। মনে পড়ে রোহনের, কতদিন এখানে বসে সে চা খেয়েছে, চপ-মুড়ি কিনেছে। টুকটাক গল্প করেছে এদের সঙ্গে।
প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে বসল রোহন। এখনও আগের মতই নির্জন ও একই রকম আছে স্টেশনটা। সেই বকুল গাছ, নিচে আদিবাসী যুবক বাপির চায়ের দোকান। কিছুই বদলায় নি। বাপির কাছে গিয়ে দাঁড়ালে সে কি এতদিন পর আর চিনতে পারবে?
সাইড ব্যাগে জলের বোতলের জন্য হাত দিতেই ব্যাগের ভেতরটা খড়মড় করে উঠল। ব্যাগ খুলে রোহন অবাক। দেখে শুকিয়ে যাওয়া অজস্র দেবদারুর পাতায় ব্যাগ ভরে আছে। অবাক হয়ে সে ভাবল, গাছ থেকে এত শুকনো পাতা ঝরে ব্যাগে সেঁধিয়ে গেল কখন যে সে বুঝতেও পারল না!
রোদ্দুর মরে গিয়ে সমস্ত বাতাস ফিকে হয়ে আসে। তার মনে হল এই স্টেশন, ওই চা দোকান, সামনের প্রশস্ত আকাশ—সব মাড়িয়ে যেন তুমি হেঁটে যাচ্ছ স্টেশনের ওই পাতা ঝরার রাস্তায়। হ্যাঁ, এই তো তুমি, তোমার স্পর্শ; তোমায় হলুদ পায়ে রুপোর সাদা নুপূর, স্থানে স্থানে তাতে নীল পাথর। একদিন, মনে আছে—তুমি বললে, এত ভালোবাসা রাখব কোথায়! তাই তো সব লিখে রাখি—পাতার পর পাতা—লিখে রাখি তোমাকে, তোমার কথা—যা গচ্ছিত রাখি হোমের ঘরের এক গোপন কুঠুরিতে—আমি সে সব তোমার পড়াব না, পাঠাব না কোন পোস্ট অফিসের কোন ডাক পিওনের হাত দিয়ে। আমি অপেক্ষা করব সেদিনের জন্য যেদিন এইসব লেখাদের আবিষ্কার করবে তুমি—হ্যাঁ, সেই জন্যে এখানে একদিন ফিরে আসতেই হবে তোমায়—সে সেদিনই হোক না কেন।
ব্যাগ ভর্তি দেবদারু পাতা নিয়ে ট্রেনের অপেক্ষায় চুপ করে নির্জন সেই প্ল্যাটফর্মে বসে থাকে রোহন। ভাবে, ফিরে গিয়ে মোড়পুকুর ডাকঘর থেকে সে এই সব চিঠিগুলির মধ্যে অন্তত একটা পোস্ট করে দেবে শ্রীপুরের ঠিকানায়।
কেউ তো জানুক, এতদিন পর সে আসলে কেন এসেছিল এখানে।