“আজ ক্লাসে কী হল?” ঝুম স্কুল থেকে ফিরে যখন খেতে বসল তখন ওর মা জিজ্ঞেস করলেন, যেমনটা রোজ করেন।
“ভালোই মজা হল! কেলি আজকেও খুব দুষ্টুমি করেছে! হেনরি আর ভায়লেটের লাঞ্চ খেয়ে নিয়েছে!”
“সেকি! মেয়েটা তো বেজায় দুষ্টু! তা তোমাদের টিচার ওকে কিছু বলেন না?”
“খুব বকেন। আজও অনেক করে বকলেন কিন্তু কেলি ও সব কথায় কানই দেয় না! উনি ক্লাস থেকে চলে যেতেই আবার ওর দুষ্টুমি শুরু!”
“কী সর্বনাশ! তুমি সাবধানে থেকো ঝুম। তুমি আবার ওর পাশেই বসো! কোনদিন তোমার লাঞ্চও খেয়ে নেবে ওই দুষ্টু মেয়ে!”
“না, আমার খাবার খাবে না! ও আমার বন্ধু তো!”
“আচ্ছা এই কেলি পড়াশোনাতে কেমন?” মা জিজ্ঞেস করলেন।
মার প্রশ্নটা শুনে ঝুম ফিক ফিক করে হেসে বলল, “আর বোলো না! কিছুই পারে না! মাথায় শুধু দুষ্টু বুদ্ধি কিলবিল করলে কী আর পড়াশোনা হয়? কিছু পারে না, সব সময় বকা খায়! টিচার বলেছেন ওকে ক্লাস থেকে বের করে দেওয়া হবে, তাও শোনে না! সব সময় হয় লাফালাফি করে না হয় ঘুমোয়!”
ওর কথা শুনে মা তো বেজায় ভয় পেয়ে গেলেন। ঝুম নতুন স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। প্রথম প্রথম বেচারা খুব মন মরা হয়ে থাকত। ওর পাশে নাকি কেউ বসছে না। রোজ বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে খুব কাঁদত ঝুম, ‘আমার কোন বন্ধু নেই’ বলে। সকালে স্কুলে যেতে চাইত না। মা-বাবা তো ওকে নিয়ে ভয়ানক চিন্তিত ছিলেন। বাবা সবে বদলি হয়ে মার্কিন মুলুকের এই ছোট শহরে এসেছেন কলকাতা থেকে। একদিকে অফিসে কাজের ভয়ঙ্কর চাপ আর অন্যদিকে ঝুমকে নিয়ে টেনসান। মা-বাবা কী করবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না। মা তো একবার বলেই ফেললেন, “আমি ঝুমকে নিয়ে কলকাতায় থেকে গেলেই ভাল হত মনে হচ্ছে। ওখানকার স্কুলে তো ভালোই করছিল। ওদের ক্লাস টিচার গত বার ওর কত প্রশংসা করলেন। যে মেয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্যে আগে ভাগে তৈরি হয়ে নিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত সেই মেয়ে কিনা এখন স্কুলে যেতে চাইছে না!”
বাবা শুনে মাথা নেড়ে বললেন, “এখানে এসেই পড়েছি যখন তখন দু বছরের আগে তো ফেরা যাবে না। অন্তত আমি তো ফিরতে পারব না। যদি এই রকমটাই চলে তাহলে তোমাদের দুজনের জন্যে কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে!”
যাই হোক সেই সব টেনসান ঘুচিয়ে দিয়ে কয়েকদিন পরই ঝুম ঝলমলে মুখ নিয়ে ফিরল স্কুল থেকে। ওর পাশে নাকি কেলি বলে একজন বসছে। তার সঙ্গে ঝুমের দিব্যি ভাব হয়ে গেছে। তাই শুনে ওর মা বাবা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলেন। যাক বাবা বাঁচা গেল বলেছিলেন। ঝুম তারপর থেকে আর স্কুলে যাওয়ার নামে কান্নাকাটি করে না। দিব্যি হাসি মুখেই চলে যায়।
এখন আবার উলটো সমস্যা দেখা দিয়েছে। পরিষ্কার বুঝতে পারা যাচ্ছে যে কেলি মেয়েটা মোটেই সুবিধার নয়! পড়াশোনা তো করেই না উলটে ক্লাসের সবার লাঞ্চ খেয়ে নেয়! দুষ্টুমির একশেষ!
ঝুমের কথা শুনে মা বললেন, “সেকি! ক্লাসে ঘুমোয়?”
ঝুম মুচকি হেসে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ!”
আরো দু গ্রাস মুখে ঢুকিয়ে বলল, “সব থেকে অদ্ভুত ব্যাপার কী জানো? ও না স্নান করে না!”
মা তো আকাশ থেকে পড়লেন, “ও মা গো! কেন?”
“ওর নাকি জলে কী একটা সমস্যা আছে! ওর গায়ে জল দেওয়া চলে না!”
মা তো এবার ভীষণ ঘাবড়ে গেলেন, “এ মা! ওর গা থেকে দুর্গন্ধ বেরবে তো তাহলে! নানা রকম অসুখ হবে! স্নান না করে থাকা যায় নাকি! ওই রকম নোংরা থাকলে তো জঘন্য ব্যাপার!”
ঝুম মুচকি হেসে বলল, “না মা, কেলিকে খুব কিউট দেখতে! সবাই তাই বলে! ওকে দেখলে বুঝতেই পারবে না যে ও স্নান করে না!”
সেদিন ঝুমের বাবা অফিস থেকে ফিরতে ওর মা বললেন, “আচ্ছা আপদ জোগাড় হয়েছে! কেলি বলে যে মেয়েটার পাশে ঝুমকে বসতে দিয়েছে ওর টিচার তার নাকি জলে কী সব সমস্যা আছে তাই সে স্নান করে না!”
বাবা তো শুনে আঁতকে উঠলেন, “অ্যাঁ বলো কী! স্নান করে না মানে? গা কুটকুট করবে না?”
“জানি না বাবা! একটাই বন্ধু জুটল আর সেও আবার ওই রকম!”
ঝুম দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছিল, এবার বলল, “না, এখন আমার আরো কয়েকজন বন্ধু হয়েছে। মায়া, শার্লট, এমা – ওদের সঙ্গেও খেলি আমি তবে কেলি আমার সব চেয়ে প্রিয় বন্ধু!”
“অন্য বন্ধু যখন হয়েছে তখন ওদের সঙ্গে বসো না কেন তুমি?”
তাই শুনে ঝুম বিরক্ত হয়ে বলল, “বা রে! কেলির সঙ্গে বসতেই তো আমার বেশি ভালো লাগে! খুব মজা হয়! ক্লাসের সবাই তো কেলির পাশে বসতে চায়! আমি সুযোগ পেয়েছি তাহলে আমি অন্য কারো সঙ্গে কেন বসব?”
সেদিন রাতে মা-বাবা চুপি চুপি ঠিক করলেন যে পরের সপ্তায় যে পেরেন্ট টিচার মিটিংটা আছে সেটাতে যাবেন এবং ঝুমের টিচারের সঙ্গে কথা বলবেন ঝুমের ওই কেলি বলে মেয়েটার পাশে বসা নিয়ে! এমনিতে ওঁদের পেরেন্ট টিচার মিটিংয়ে যাওয়ার কোন পরিকল্পনা ছিল না কারণ সেটার জন্যে বাবাকে অফিস থেকে কয়েক ঘন্টার ছুটি নিতে হবে কিন্তু সমস্যা এতটাই জটিল হয়ে উঠেছে যে না গেলেই নয়! পেরেন্ট টিচার মিটিংয়ের আগের দিন ঝুম লাফাতে লাফাতে বাড়ি ফিরে বলল, “কী মজা! কেলি আমাদের বাড়িতে আসবে!”
মা তো আঁতকে উঠে চেয়ার থেকে পড়েই যাচ্ছিলেন প্রায়, “মানে? কবে আসবে? কেন?”
“কেন আবার এমনিই আসবে, আমার সঙ্গে খেলবে বলে! পরের সপ্তার শুক্রবার দিন আসবে। শনিবার রবিবার দুদিন থাকবে আমাদের বাড়িতে। শুক্রবার দিন তোমাকে বা বাবাকে স্কুলে যেতে হবে ছুটির সময় ওকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে!”
মা ভয়ানক বিরক্ত হয়ে বললেন, “এ তো মহা জ্বালা হলো! বাড়িতে এসে থাকবে বললেই হলো! মামাবাড়ির আবদার নাকি! বলা নেই কওয়া নেই! এখানকার মেয়ে কী খায় না খায় তাও জানি না!”
“সে তো টিচার লিস্ট করে দেবেন কী কী খেতে পারে আর কখন, সব কিছু!”
“এ তো ভয়ানক সমস্যা হয়ে গেল! আর পারি না বাপু! তা কেলির মা-বাবা কিছু বলছেন না?”
সেটা শুনে ঝুম কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে বলল, “তা তো জানি না!”
পরদিন সকাল সকাল মা-বাবা দুজনে ওর স্কুলে টিচারের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। ঝুমকে নিয়ে যাওয়া বারণ ছিল তাই সে ৩০৪ এর ঘোষ কাকিমার সঙ্গে রইল।
ঝুমের মা-বাবা স্কুলে গিয়ে টিচারের সঙ্গে দেখা করলেন।
ও টিচার বললেন, “আপনারা এসেছেন খুব ভাল হয়েছে। ঝুম এখন ধীরে ধীরে ভালোই মানিয়ে নিচ্ছে। প্রথমের দিকে ও ক্লাসে একদম চুপ করে বসে থাকত, কারো সঙ্গে কথা বলত না তাই আমরা বেশ চিন্তিত ছিলাম ওকে নিয়ে। কিন্তু এখন ও অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। ক্লাসের অন্যদের সঙ্গে ওর বন্ধুত্বও হয়ে গেছে। সেটা খুব ভালো লক্ষণ!” এই ভাবেই আরও কিছু কথা বলার পর টিচার বললেন, “এবার আপনাদের কিছু বলার থাকলে আমাকে বলতে পারেন!”
মা তখন বললেন, “দেখুন এমনিতে তো সব ঠিক আছে কিন্তু ওর পাশে যে মেয়েটা বসছে তাকে নিয়ে আমাদের একটু চিন্তা হচ্ছে! সে ভীষণ দুষ্টু। পড়াশোনা করে না। কারো কথা শোনে না, সবার লাঞ্চ খেয়ে নেয়। সেটা না হয় তার মা-বাবার সমস্যা কিন্তু সে নাকি স্নানও করে না! আর পরের সপ্তায় আমাদের বাড়িতে থাকতে আসবে! আমি সেই নিয়ে খুব চিন্তিত! ওই রকম কারো সঙ্গে মিশলে ঝুমও ওই রকম হয়ে যাবে সেটাই আমার ভয়!”
মার কথা শুনে টিচার বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন, বললেন, “আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। কার কথা বলছেন আপনি? ওই রকম দুষ্টু তো ক্লাসে কেউ নেই!”
“না, না আছে! ঝুম আর যাই করুক মিথ্যে কথা বলবে না! ওই দুষ্টু মেয়েটার নাম কেলি!”
মার কথা শুনে ঝুমের টিচার হো হো করে হেসে ফেললেন, “কেলি? আচ্ছা চলুন কেলির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দি আপনাদের!”
বলে মা-বাবাকে একটা ক্লাসরুমে নিয়ে গেলেন ঝুমদের টিচার। সুন্দর রংচঙ্গে করে সাজানো ক্লাস। দেওয়ালে সব বাচ্চাদের আঁকা ছবি লাগানো। ঝুমের আঁকাও দেখতে পেলেন ওঁরা।
“এই হল কেলি!” বলে জানালার ধারে একটা টেবিলের ওপর রাখা একটা বড়োসড়ো খাঁচার দিকে দেখালেন ঝুমদের টিচার।
ওর মা-বাবা অবাক হয়ে দেখলেন খাঁচার ভিতর রয়েছে একটা ইয়া বড়ো ইঁদুরের মতন দেখতে প্রাণী!
“ওমা ওটা কী? ইঁদুর নাকি?” মা আঁতকে উঠে বললেন।
“না, কেলি হলো চিঞ্চিলা! সাউথ আমেরিকার বাসিন্দা ওরা। অ্যান্ডিজ পাহাড়ে ওদের বাস। পেরু, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া এই সব জায়গায়। অ্যান্ডিজ পাহাড়ের চিঞ্চা প্রজাতির নাম থেকেই ওদের নাম চিঞ্চিলা হয়েছে। ওদের গায়ের লোম খুব নরম আর ঘন। বিংশ শতাব্দীতে ওদের অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়েছিল কারণ ওদের মেরে ওদের লোম দিয়ে ফার কোট তৈরি করাটা ফ্যাশান হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওদের এত বেশি শিকার করা হচ্ছিল যে চিঞ্চিলারা পৃথিবী থেকে প্রায় লুপ্ত হয়ে যেতে বসেছিল। ইদানীং, মানে মনে হয় ২০০৬ থেকে, ওদের ‘এন্ডেঞ্জার্ড স্পিশিস’ বলে ধরা হয় এবং ওদের শিকার করলে শাস্তি দেওয়া হয়। তা কেলি হল আমাদের ক্লাসের পোষ্য! ও ক্লাসের সবার বাড়িতে গিয়ে গিয়ে থাকবে একটা করে উইকেন্ড। আমরা দেখেছি এটা করলে বাচ্চাদের দায়িত্বজ্ঞান বাড়ে! আর ঝুম ঠিকই বলেছে, ওদের জল দিয়ে স্নান করানো যায় না। ওদের গায়ে জল লাগলে এক রকম ফাঙ্গাস হয়ে যায়। ওদের সপ্তায় একদিন করে ছাই দিয়ে ‘ডাস্ট বাথ’ দিই আমরা! সেটাই নিয়ম!”
মা আমতা আমতা করে বললেন, “কিন্তু ঝুমের কথা শুনে আমার তো মনে হয়েছিল কেলি একটা মেয়ে!”
টিচার এক গাল হেসে ফেলে বললেন, “ওটা আমারই দোষ! আমি ক্লাসের সব ছেলেমেয়েদের বলেছিলাম যে কেলিকে তোমরা নিজের বন্ধুর মতন মনে করবে, ওকে জন্তু বা চিঞ্চিলা বলে ডাকলে ওর মনে কষ্ট হবে! তোমাদের যদি কেউ মানুষ বলে ডাকে তাহলে তোমাদের কেমন লাগবে? সেই রকম আর কী! আর ঝুম তো ভালো মেয়ে তাই ও আমার কথা অক্ষরে অক্ষরে শুনেছে!”