১
জয়তীদের বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় সন্ধে সাতটা হল। জয়তীর মা সিরিয়াল দেখতে দেখতে চোখের জল ফেলছিলেন, ঠিক শোকে নয় মনে হয়, পেঁয়াজ কুটছিলেন।
আমাকে দেখে চিনতে একটু সময় নিলেন। প্রায় পাঁচ-ছয় বছর পরে দেখা তো। সেই কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়বার সময় এ বাড়িতে লাস্ট এসেছিলাম। গৃহপ্রবেশের সময়। নেমন্তন্ন করতে এসে সবাইকে নাম করে করে যেতে বলে গিয়েছিলেন। হাজার হোক, আমরা পুরনো বাড়িওয়ালা তো বটে। তাছাড়া জয়তী আর আমি একই ইস্কুল, একই ব্যাচ বলে আমাদের কোথাও তো একটা কানেকশন ছিল।
আমাকে দেখে বললেন, ও, সুজয়, এতদিন পরে আমাদের মনে পড়েছে বাবা। ও মা রিনি, দেখে যা, কে এসেছে। তুমি যাও না বাবা, রিনি ওঘরেই আছে।
আমি একটু ভ্যাবাচাকা খেয়েই বললাম, তারা দা আসে নি এখনো? আমাকে যে ... বলেই বুঝলাম একটা ছ নামিয়েছি....তারাদাই যে আমাকে আসতে বলেছে সেটা এখনই বলা যাবে না।
জয়তী ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল, আজকাল আমেরিকা ফেরত হয়ে বোধহয় এইসব হয়েছে, এমন একটা খাটো প্যান্ট আর টি—শার্ট পরে আছে যে তাকাতে রীতিমত কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই খলখল করে হাসির ফোয়ারা ছুটিয়ে দিল জয়তী। তুই বাবাকে আবার কবে থেকে দাদা ডাকতে শুরু করেছিস। আজকাল কি ড্রাগস করছিস নাকি!
আগেই বলেছি, আমরা যখন ইসকুলে পড়তাম, জয়তীরা আমাদের বাড়ির একতলায় ভাড়া থাকতো। আমরা একসাথে ইসকুল যেতাম, অঙ্কের জন্য বাদলস্যারের কাছে একই ব্যাচে পড়তাম। তারাকাকু আমার বাবার চেয়ে বেশ অনেকটা ছোট হলেও, বাবাকে দাদা দাদা করেই সম্বোধন করতো। আমরাও তারাকাকু, বেবিমাসি ইত্যাদি ডেকে বেশ নিশ্চিন্ত ছিলাম।
জয়তী জয়েন্টে চান্স পাওয়ার পর ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তে চলে গেল, শিবপুরের হোস্টেলে। আমি ঢুকলাম শ্রীরামপুর কলেজে, ইতিহাস অনার্স। বাংলা নিয়ে পড়বো ইচ্ছা ছিল, কিন্তু অলরেডি জয়েন্টে ধ্যাড়ানোতে বাবা শোকে পাখর হয়ে গেছিলো, এর উপর ছেলে বাংলা অনার্স নিয়ে পড়তে চায় শুনলে হাসপাতালে যেত মানুষটা। বাবার দুর্বল স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করেই আমার ইতিহাসের প্রতি যা কিছু আনুগত্য। এমনিতে সাল তামামিতে আমি চিরকাল কাঁচা। কিন্ত যত দিন যেতে লাগলো, আমি লক্ষ্য করলাম আস্তে আস্তে আমার সঙ্গে বিষয়টার বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো।
যাই হোক, এইসব যুগান্তকারী ঘটনার অল্প পরেই একদিন আমি পাড়ার হাবুলের দোকানে চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে বিষম খেলাম, হাবুলরা আমার ঘাড়—গলা থাবড়ে থাবড়ে সে যাত্রা সামাল দিল, সঙ্গে এই বলে, যে জয়তী নাকি নিশ্চয়ই আমাকে খুব মনে করছে কলেজে বসে।
হাবুল দেখে নি। জয়তীর বাবা তখনই একটা চকরা—বকরা হাফ প্যান্ট আর টি শার্ট পরে বাজার যাচ্ছিল। মাথার কাঁচাপাকা চুল কোন মন্ত্রবলে একদম মিশকালো। এর পর থেকেই আমি লক্ষ্য করলাম, ওনাকে কাকু বলে ডাকলে ওনার ভুরু কুঁচকে যাচ্ছে, অনেক সময় শুনি না শুনি না ভান করে এড়িয়ে যাচ্ছেন। পরীক্ষা হিসেবে একদিন খুব মিহি গলায় যা থাকে কপালে বলে ডেকে দিলাম, তারা দা, আপিস চললেন? উনি অম্লানবদনে, উজ্জ্বলহাস্যে দশদিক আলো করে বললেন, এই যে ভাই , ভাল তো সব, কাকু—কাকীমা ভাল আছেন তো?
আমাদের ভাব হয়ে গেল।
জয়তীর সঙ্গে সোশাল মিডিয়াতে টুকটাক যোগাযোগ থাকলেও সামনাসামনি দেখা—সাক্ষাৎ কমে গেল এরপর। আমারই একটা মেজর ভয় ছিল, জয়তী যদি বাপের বন্ধু হবার সুবাদে ক্লাসমেটকে কাকু ডেকে বসে! সেই গৃহপ্রবেশের দিনটাও বড় উদ্বেগে কাটিয়েছিলাম।
জয়তীর ফাইনাল ইয়ারে ক্যাম্পাসেই চাকরি হয়ে গেল, আমি তখন মাস্টার্স করছি। আই টি সেক্টরের চাকরি তো, বছর খানেকের মধ্যেই বিদেশে পাড়ি। তারাদার সাথে দেখা হলেই মেয়ে আমেরিকার কোন শহরে আছে, সেখানকার সর্বোচ্চ ও সর্ব নিম্ন তাপমাত্রা জেনে জি কে বাড়তে থাকে আমার। জয়তী এলে একদিন দেখা করবো আমার এই সাধু সংকল্প জেনে ফেলার পর অবশ্য তারাদার হাবভাবে একটা আমূল পরিবর্তন এসেছিল।
- ও তো আসে এত কম সময় নিয়ে, যে আমাদের সাথেই ঠিক সময় কাটাতে পারে না, বাইরের লোকের জন্য যে কীভাবে সময় বের করবে বল? আর সত্যিই তো, যার তার সঙ্গে এখন কথা কয়েও সুখ নেই, বুঝলে না। তা তুমি অতি অবশ্য আসবে। শুধু আসার আগে একটা ফোন করে নিও।
প্রোটোকলের বহর দেখে আমারই আর কখনো যাওয়া হয় নি।
ততদিনে আমার এম এ হয়ে গেছে। মনে ইচ্ছে, পি এইচ ডি তে ঢুকবো। খোঁজ খবর নিচ্ছি কোথায় কোন গাইড ছাত্রকে তাড়াতাড়ি বের করে দেয়, কোন গাইডের কাছে আগে বাজার সরকারের ভূমিকায় সাফল্যের সাথে কাজ করে দেখাতে হয়, কোন গাইডের আবার সরাসরি স্কলারের জলপানির টাকায় নজর। বিদেশেও করা যেত, আমার কাজই বিভিন্ন দেশের গৃহযুদ্ধ নিয়ে, বেশ ইন্টারডিসিপ্লিনারি ব্যাপার, বিদেশী কয়েকজনের সঙ্গে কিছু কোলাবোরেশনও করেছি কিন্তু বিদেশে যাওয়ার মত ট্যাঁকের তো জোর নেই। অগত্যা।
কিন্তু খালিপেটে তো এভাবে বেশিদিন গাইড খোঁজা যায় না, কিছু তদবির তদারকি করে একটা চুক্তির কাজ পেলাম, আজকাল অনেক সরকারি দপ্তর এরকম এজেন্সী থেকে লোক নেয়, ফাইফরমাশ, ছুটকো কাজের জন্য, একটা চাকরি হয়েই গেল, ঘটনাচক্রে সরকারের ফিনান্স ডিপার্টমেন্টেই, এখন সল্টটেকের একই ভবনে তারাদা আর আমার আপিস, ভাগ্যিস এক ফ্লোরে নয়।
অনেকদিন আমরা শেয়ারের গাড়ি ধরে বালির দিকে চলে আসি। আজও সেরকম প্ল্যান করেই আপিসের শেষে তারাদার ডেস্কে গেছিলাম। কিন্তু তারাদা দুই হাতে মাথা ধরে বসে ছিল। আমি নিরীহের মত জিজ্ঞেস করলাম, কি তারাদা, আজ কি পকেটমার হয়েছে ?
পরক্ষণেই অনুতাপ হল, তারাদার লাল চোখ, কলপহীন উস্কোখুস্কো চুল দেখে। মায়াই লাগল।
২
প্লেটে করে অমলেট আর রসগোল্লা এনে জয়তী আমার সামনে রেখে বলল, খা, চা আসছে। আমি জয়তীর পরিবর্তনগুলি ধরবার চেষ্টা করছিলাম। যেটা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ছে, সেটা হচ্ছে উপচে পড়া কনফিডেন্স। তারাদাও এইটাই বলেছিল, বুঝলি, বাবাই, আমাদের মেয়েকে যেন আমরাই চিনতে পারছি না আর....
আগের বছরই তারাদার কাছে ওয়াশিংটনে ক’ইঞ্চি বরফ পড়ে শীতকালে তা শুনতে হয়েছে।
কেবল আজকেই আপিসে বসে জীবনে প্রথম তারাদা আমাক কাছে খুব দুঃখ করল, মেয়েটা শেষে সায়েব পছন্দ করলো, তাও যদি একটা পাল্টি ঘর দেখে করতো, আমার কোনো দুঃখ হত না।
—ও তারাদা, সায়েবদের আবার ঘোষ বসু মিত্তির হয় নাকি গো! পাল্টি ঘর সায়েব চাইলেই বা পাচ্ছো কোথায়?
—আরে তা নয়, ঠিকঠক সায়েবও তো নয় ব্যাটাচ্ছেলে। খন্ড ৎ দিয়ে নাম শুরু হয় এমন সায়েব দেখেছিস কখনো, আসলে চাইনিজ, বুঝেছিস, চাইনিজ। ঠিক মনে পডছে না, হয় খন্ড ৎ নাহয় হ্ম। তুই তো রিনির ছেলেবেলার বন্ধু, একবার শুধিয়ে দেখ না বাবা, যদি মতিগতি ফেরাতে পারিস। এর থেকে তো...
মতিগতি ফেরাতে পারবো এতটা কনফি়ডেন্স আমার ঠিক ছিল না। দরকারও নেই। ছেলেটাকে মনে হয় জয়তীর প্রোফাইলে দেখেছি। ভারতীয়ই। নাম ৎশেরিঙ, কার্সিয়াঙের ছেলে।
তবু প্রস্তাবটা লুফে নিয়েছিলাম। এই প্রথম জয়তীর সঙ্গে প্রোটোকল ছাড়া দেখা করা যাবে, এ সুযোগ কি ছাড়া যায়?
—আচ্ছা তোর পি এইচ ডির কদ্দুর? হল! আয়াম টকিং টু য়ু। জয়তীর কথায় আমার সম্বিৎ ফেরে।
—কই আর হল, এখনো ভাবছি, আসলে গাইড ঠিকঠাক না হলে তো বাঁশ হয়ে যাবে! এখনো মনঃস্থির করতে পারছি না।
—আর আইওয়ার সেই ভদ্রলোক? যার সাথে তোর পেপার ছিল?
এবার আমার চোখ কপালে। স্টিফেন জনসনের সাথে আমার যোগাযোগ হয়েছিল, ওনার একটা কাজে আমার কিছু কাজের সাইটেশন ছিল....বেশ একটু গুমোর নিয়ে আমি সোশাল মিডিয়ায় পোস্টও করেছিলাম, কিন্তু সেটা যে জয়তী দেখেছিল, তা তো জানি না!
—হ্যাঁ, পেপার তো ছিল, কিন্তু বিদেশে পি এইচ ডি করতে গেলে খরচ আছে। ওনার কাছে যা গ্রান্ট আছে তাতে কাজ করে, আমাকে দেওয়ার মত কিছু থাকবে না। ওদেশের খরচ চালাবে কে?
—ওখানে একবার গিয়ে পড়লে কিন্তু কিছু না কিছু জুটেই যাবে।
—সেটা উনিও বলেছেন।
—তা হলে তো হয়েই গেল। আমি আইওয়াতে মুভ করছি সামনের বছর।
—তার মানে! কী বলতে চাস?
জয়তী একটা ফিচেল হাসি দিয়ে বললো, তোর এপ্লিকেশনটা জাস্ট পাঠিয়ে দে।
আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, মানে?
—তুই যে আসলে এত বোকা তা তো জানতাম না! বললুম যে, আমিও আইওয়ায় মুভ করছি?
এবার আমার একগাল মাছি! মেয়েটা বলে কি?
—আর সেই খণ্ড ৎ না হ্ম?
জয়তী এমন জোরে হেসে উঠলো যে মাসিমাও একবার উঁকি দিয়ে গেলেন।
—আরে আইডিয়াটা সেই ৎশেরিঙেরই। ওই তো আমাকে বললো, লেটস প্রেজেন্ট ইয়োর পেরেন্টস আ সিনারিও হুইচ ইজ মোর আনএক্সেপ্টেবল টু দেম দ্যান হোয়াট ইউ রিয়ালি ওয়ান্ট টু ডু। আমার খুব ভাল বন্ধু ৎশেরিঙ।
আমি মাথা—টাথা চুলকে বললাম, বুঝেছি। কিন্তু আরেকবার ডাক পাল্টানো....রীতিমত ফ্যাচাং।