আততায়ী নিঃশ্বাস বন্ধ দাঁড়িয়ে আছে একটা থামের আড়ালে। একতলার এই অংশটা গাড়ির পার্কিং – তাই এখানে আলো খুব কম। চট করে কারোর চোখে পড়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই।
এখন অপেক্ষা, কখন রাতের গার্ডরা আসে।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। একটু বাদেই দুদিক থেকে দুজন গার্ড এসে মুখোমুখি দাঁড়ালো। কথা বললো না, শুধু একবার ঘাড় হেলিয়ে একে ওপরের পাশ দিয়ে চলে গেল। সিকিউরিটি প্রোটোকল তাই বলে।
দুজনে দুদিকে একশো গজ যাবার পর টার্ন নিলো। একজন রাইট, একজন লেফট টার্ন। কম্পাউন্ড ওয়াল ধরে। এখন সামনেটা ফাঁকা। মেন সিকিউরিটি চিফ গেটের পাশের অফিসে, সেখান থেকে অনেকটা ঘাড় ঘোরালে তবেই দেখতে পাবে আততায়ীকে। পারফেক্ট ব্লাইন্ড উইন্ডো।
আততায়ী হাল্কা জগিং করে রাস্তাটা পার হলো। এর ফাঁকেই একটা স্মুথ অ্যাকশনে ঘাড় ঘুরিয়ে একঝলকে দেখে নিল পাশের দুটো বিল্ডিঙে কেউ বারান্দায় বা জানলায় দাঁড়িয়ে আছে কিনা।
না, কেউ নেই। অল ক্লিয়ার।
জায়গায় পৌঁছনোমাত্রই আততায়ীর হাতের লম্বা ধারালো ছুরিটা আধখানা চাঁদের আলোয় দুবার ঝলসে উঠলো। একেবারে মাপা থ্রাস্ট অ্যান্ড জ্যাব। কাজ শেষ। নিঃশব্দে।
নিখুঁত কাজ।
এবার ফেরা।
একবার চোখের র্যাডার ঘুরিয়ে বিল্ডিংদুটোকে স্ক্যান মেরে নিয়ে মৃদু জগ করে ফিরতে শুরু করল আততায়ী। উইনচিটারটা কালো, তলায় কালো জগিং ট্র্যাক্স। কাজেই দূর থেকে চোখে পড়বে না। গার্ডদের ফেরার সময়টা মনে মনে ক্যালকুলেট করে নিল একবার। অন্তত পাঁচ মিনিট হাতে আছে।
আধো অন্ধকার পারকিংএ ঢুকে জগিং থামিয়ে লম্বা লম্বা চলতে থাকলো আততায়ী। এক-দুই-তিন-চার- এক-দুই-তিন-চার-এক-দুই-তিন – এই তিন নম্বর সেটের তিনের পদক্ষেপটা লাগলো একটা ধাতব কিছুতে। সঙ্গে সঙ্গে একটা ক্যান-ক্যান শব্দটা নির্জন সন্ধ্যাটাকে একেবারে সশব্দে টুকরো টুকরো করে দিলো।
ডেঞ্জার!
আততায়ী তৈরি ছিলো। এই পরিস্থিতিতে কি করতে হয়, সে ব্যাপারে সে ওয়েল-ট্রেন্ড – চট করে থামের আড়ালে সরে গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চিফ সিকিউরিটির পাঁচ সেলের জোরালো আলো এসে পড়লো এদিকে। আলোটা একবার এদিক একবার ওদিক ঘুরে, কয়েকবার নড়াচড়া করে চলে গেল। চারদিক আবার শান্ত।
আততায়ী জানে যে শান্ত মানেই সব শান্ত নয়। চিফ সিকিউরিটি এখন নিঃসন্দেহে এদিকে তাকিয়ে আছে। বাকি রাস্তাটা সোজা হবে না।
এখান থেকে কুড়ি পা দুরেই লিফট-লবি। তার সামনে তেরছা হয়ে আলো এসে পড়েছে। ওটা পার হয়ে লিফট লবিতে ঢুকে পড়লে আর চিন্তা নেই। লবিটা দেখা যায় না চিফ সিকিউরিটির ঘর থেকে। কিন্তু লিফট লবিতে ঢোকার মুখে ওই তেরছা আলোটা সরাসরি মুখে এসে পড়বে। অর্থাৎ সিকিউরিটি যদি এদিকে তাকিয়ে থাকে তাহলে ওর চেহারাটা সিল্যুয়েটে দেখতে পাবে।
অঙ্কটা কষতে লাগলো ঠিক পাঁচ সেকেন্ড। দুটো ছোট ছোট স্পট জাম্প, তারপর একটি উসায়েন-বোল্ট স্প্রিন্ট। লিফট লবি ক্রস করতেই পেছন থেকে একটা তীব্র “কৌন হ্যায় উধার” শোনা গেল। সেটাকে পাত্তা না দিয়ে আততায়ী একটানা দৌড় বজায় রাখলো — সিঁড়ি বেয়ে। উঠতে হবে তিনতলা — একবারে — থামা নেই।
ঝড়ের মতো তিনতলায় উঠেই দেখলো সামনেই বন্ধ দরজা। অতএব সজোরে দুমদুম করে ধাক্কা।
দরজা খুলে কি-হলো-কি মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা স্ত্রীকে দেখেই মেজাজটা ভয়ানকরকম চড়ে গেল বিধানবাবুর। “দরজাটা খুলে রাখতে কি হয় তোমার? আর দেখছো হাঁপাচ্ছি, একটু জল দেবে তো? নাকি সেটাও বলতে হবে?” বলতে বলতে ভিতরে ঢুকে একটা উল্টো লাথিতে দরজাটা দমাস বন্ধ করে দিলেন তিনি। তারপর জলের গেলাস নিয়ে আসা স্ত্রীকে ঝাঁঝিয়ে উঠে বললেন “এই নাও তোমার কলাপাতা। পরেরবার পাতুরি রাঁধতে হলে নিজে মেট্রো ধরে চিত্তরঞ্জন পার্কে গিয়ে কিনে নিয়ে আসবে। ছি-ছি-ছি-ছি, সিকিউরিটি গার্ডরা দেখে ফেললে সোসাইটির সেক্রেটারি হিসেবে আমার মান-সম্মানটা থাকতো কোথায়, শুনি?”
রত্না পেছন ফিরে রান্নাঘরে চলে গেল।
আদিখ্যেতা! পাতুরি খেতে চায়টা কে, শুনি? কে?
(এই সংখ্যায় অতনু দে-র আরো দুটি গল্পঃ 'ঘুষ' ও 'দুই বুড়োর আখ্যান')