প্লেনের বাথরুমে হাত ধুতে ধুতেও মিস্টার মিত্র শাশ্বতকে কী ভাবে জব্দ করা যায় সেই নিয়ে ভাবছিলেন। শাশ্বত ওনার কম্পানিতে অ্যাকাউন্টেন্ট। এমনিতে ছেলেটা খারাপ না, কাজও জানে ভাল কিন্তু আজকাল যেন বড্ড বেশি ছুটি নিচ্ছে। আজ মার শরীর খারাপ কাল বাবাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে এই সব বলে বলে। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই কিছু না কিছু লেগে আছে! আরে বাবা উনি তো কম্পানি চালান, দানছত্র তো খুলে বসেননি! ওর ওই ছুটি নেওয়ার জন্যে এবারে বম্বেতে ক্লায়েন্টের সঙ্গে মিটিঙয়ে কী লজ্জায় না পড়তে হল মিস্টার মিত্রকে! মিটিঙয়ের জন্যে আনা কাগজের ফিগারগুলো ধ্রুপদকে দিয়ে করাতে হয়েছিল শাশ্বত ছুটিতে ছিল বলে। ধ্রুপদ ছেলেটা নতুন, এখনও কাজগুলো ঠিক মতন শিখে উঠতে পারেনি তাই বেশ কয়েকটা ভুল ধরা পড়ল আর ক্লায়েন্টদের সামনে ওনার মাথা হেঁট হল। সেই থেকে মিস্টার মিত্রর সব রাগ গিয়ে পড়ল শাশ্বতর ওপর, কেন ব্যাটাকে এই সময়েই ছুটি নিতে হল? উনি ঠিক করলেন কলকাতা ফিরে গিয়ে আচ্ছা করে দেবেন তাকে। ঠিক কী কী বলে তাকে অপদস্ত করবেন সেটা বম্বে থেকে কলকাতার ফ্লাইটে মাথায় ঝালিয়ে নিতে লাগলেন। চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দেওয়ার হুমকিটা দিলেও মন্দ হয় না। ব্যাটা নিজেকে অপরিহার্য মনে করতে শুরু করেছে! সৎ কিন্তু বদমেজাজি বলে দুর্নাম আছে ওনার সেটা উনি ভালই জানেন কিন্তু কেয়ার করেন না। বাবার আকস্মিক মৃত্যুর পর শক্ত হাতে সব কিছু না ধরলে কম্পানিটাকে দাঁড় করানো যেত না।
এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কাগজের তোয়ালে দিয়ে হাত মুছছিলেন মিস্টার মিত্র এমন সময় ঝাঁকুনিটা হল। ভয়ঙ্কর একটা ঝাঁকুনি, সে প্লেনের টারবুলেন্সের সাধারণ ঝাঁকুনি নয় বলেই মনে হল। নিয়মিত প্লেনে যাতায়াত করেন মিস্টার মিত্র তাই ওনার বুঝতে বাকি রইল না যে কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে। প্রায় পড়েই যাচ্ছিলেন উনি কোনমতে পাশের তাক আর দরজাটাকে ধরে নিজেকে সামলালেন। প্লেনটা অস্বাভাবিক ভাবে দুলছে। মিস্টার মিত্রর মনে হল এই বুঝি সব শেষ! প্লেনের বাথরুমেই প্রাণটা দিতে হবে তাঁকে! কোন রকমে দরজাটা খুলে বাইরে বেরলেন তিনি। এত দুলুনির মধ্যে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না তাই প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে আইল ধরে এগোতে লাগলেন। এয়ারহোসটেসরা ততক্ষণে যে যার আসনে বসে পড়ে বেল্ট টেল্ট বেঁধে ফেলেছে। ওনাকে ওই অবস্থায় দেখে তারা আঁতকে উঠে চিৎকার করতে লাগল, “কী করছেন আপনি! নিজের জায়গায় ফিরে যান এখুনি!”
আরে বাবা সীটে ফিরে যাওয়ার চেষ্টাই তো করছেন! যত্ত সব! কোন রকমে ওই একই ভাবে হামাগুড়ি দিতে দিতে নিজের আসনে ফিরে এলেন তিনি। প্লেনের সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে ওনার সেই চেষ্টা দেখল। তবে সহযাত্রীদের সবার দৃষ্টি বিহ্বল, করুণ। যেন বলছে এই আমাদের শেষ যাত্রা।
মিস্টার মিত্র সীটে এসে বসতে ওনার পাশে বসা উদ্ভট চুল, কানে দুল আর হেডফোন গোঁজা ছেলেটা ফ্যাকাসে মুখ করে বলল, “কী হল কে জানে। প্লেনে মনে হয় বাজ পড়েছে। আর আজ বাড়ি ফিরতে পারব না!” এই ছেলেটাকেই উনি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ওনার কাঁধে হেলান দিয়ে ফেলার জন্যে বেশ দুকথা শুনিয়ে দিয়েছিলেন।
ছেলেটার অন্য পাশে বসা মেয়েটা (খুব সম্ভবত ওর বোন) আস্তে আস্তে ফোঁপাচ্ছিল। প্লেনটা তখনও সমানে দুলে চলেছে।
ছেলেটা আবার বলল, “আমার বোনের এটাই প্রথম প্লেন সফর। ‘সুরের জাদু’ শোটায় অংশগ্রহণ করার জন্যে সিলেক্ট হয়েছে ও তাই ওকে নিয়ে কলকাতা যাচ্ছিলাম আমি।”
আইলের ওপাশের এক ভদ্রলোক একটু আগে পর্যন্ত কম্পিউটারে কী সব জানি টাইপ করছিলেন এখন ভয়ভীত ভাবে হাত জোড় করে বসে বিড়বিড় করে কী সব জানি বলছেন।
পাইলটের ঘোষণা এল কী সব। অত ভয়ের আর গন্ডগোলের মধ্যে অর্ধেক কথা বুঝতেই পারলেন না মিস্টার মিত্র। অস্পষ্টভাবে শুনলেন, “দ্বিতীয় ইঞ্জিন...এমারজেন্সি ল্যান্ডিং” কথাগুলো। ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্টের গলার স্বরে এমারজেন্সি ল্যান্ডিঙয়ের পদ্ধতিগুলো ঝালিয়ে নেওয়া হচ্ছিল। প্লেন টেক অফের আগে ওগুলো শুনেছেন। একবার নয় অসঙ্খ্যবার কিন্তু কখনও ঠিক মতন মনোযোগ দিয়ে শোনেননি। মনে করেছেন ও সব তো অন্য লোকেদের জন্যে, ওনার নিজেরই এমনটা ঘটবে কোনদিন ভাবেননি।
ঘন কালো মেঘের মধ্যে দিয়ে প্লেনটা লাফিয়ে চলছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে মিস্টার মিত্রর, প্রচন্ড ঝাঁকুনির চোটে গা গোলাচ্ছে। হঠাৎ পাশে বসা দুই ভাই বোনকে দেখে কেমন জানি মায়া হল ওনার। নিজের ভয়ের কথাটা মন থেকে দূরে সরিয়ে রেখে ভাবলেন ওনার তো পঞ্চাশ বছরের ওপর হয়ে গেছে এই পৃথিবীতে, আর ওদের? ওদের বয়স মেরে কেটে পঁচিশ! গোটা জীবনটাই পড়ে রয়েছে ওদের সামনে। প্লেনটা ভেঙ্গে পড়লে কিছুই আর দেখা হবে না বেচারাদের! ওই ভাবনাটা ভেবে সেই দুর্বল মুহূর্তে একটা অস্বাভিক কাজ করে ফেললেন মিস্টার মিত্র।
পাশে বসা ছেলেটার হাতটা চেপে ধরে বললেন, “এক বার ভেবে দেখো কী রকম অভিজ্ঞতাই না হচ্ছে তোমাদের! বাড়ি ফিরে সবাইকে কেমন রোমহর্ষক গল্প শোনাতে পারবে!”
ছেলেটা খুব একটা কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি দিয়ে ওনার দিকে তাকাল। এত ভয়ের মধ্যেও বেশ একটা উষ্ণতা অনুভব করলেন মিস্টার মিত্র। আর কিছু না ভেবে অন্য হাতটা বাড়িয়ে আইলের অন্য পাশে বসে থাকা বিড় বিড় করা লোকটার এক হাত ধরলেন। সান্ত্বনার একটা শৃঙ্খল তৈরি হল।
মিস্টার মিত্র বললেন, “আপনি ঠিক আছেন তো?”
ভদ্রলোক উত্তর দিলেন, “যে সব সমস্যাগুলো নিয়ে আমি প্লেনে উঠেছিলাম সেই সব এখন খুব গৌণ বলে মনে হচ্ছে। কেন যে আমরা ছোট খাটো তুচ্ছ জিনিস নিয়ে এত মাথা খারাপ করি!”
ঝরঝর করে নড়া প্লেনটাতে বসে থাকতে থাকতে মিস্টার মিত্রর মনে হল ভদ্রলোক একদম ঠিক কথাই বলেছেন! ক্লায়েন্টের জন্যে ফিগার তৈরি নিয়ে এতটাই মশগুল ছিলেন তিনি যে শাশ্বতকে একবারও জিজ্ঞেস করেননি ওর মা-বাবা কেমন আছেন। অথচ শাশ্বত ওনাকে কতবার নিজের বাড়িতে ডেকেছে। ওর মা প্রচুর যত্ন আত্তি করে অনেক পদ রেঁধে ওনাকে খাইয়েছেন। ওর বাবা সামনে বসে থেকে সেই খাওয়া তদারক করেছেন। সেই সবের বদলে মিস্টার মিত্র শাশ্বতকে বলেছেন, “কী হে শাশ্বত, তুমি কী আমাকে খাইয়ে ঘুষ দিতে চাইছ নাকি?”
ভীষণ লজ্জা পেয়ে শাশ্বত বলেছিল, “না স্যার, গতকাল আমার জন্মতিথি গেল তো তাই...”
ওর কথার তখন কোন উত্তর দেননি মিস্টার মিত্র, এমনকি ওকে একটা শুভ জন্মদিনও বলেননি! এখন ওর ওই কাঁচুমাঁচু মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতে কেমন একটা অস্বস্তি অনুভব করলেন তিনি।
(২)
এর পরের কুড়ি মিনিটের জন্যে মিস্টার মিত্র বেশ গর্ব অনুভব করেন – নিজের জন্যেও আর অন্য সহযাত্রীদের জন্যেও। ওই রকম ভয়ের সময়ও প্রথম ধাক্কা সামলে নেওয়ার পর আর কেউ সাহস হারিয়ে অযথা চেঁচায়নি বা প্যানিক করেনি। যা হবার হবে মেনে নিয়ে সবাই একে অপরকে সান্ত্বনা দিয়ে যে যার নিজের সীটে বসে থেকেছে অসম্ভব ঝাঁকুনির মধ্যেও। চারিদিকে শুধু সান্ত্বনার মৃদু গুঞ্জন শোনা গেছে মাঝে মাঝে।
মিস্টার মিত্র আগাগোড়া পাশের কিশোর ছেলেটার আর অন্য পাশের ভদ্রলোকের হাত ধরে থেকেছেন অথচ উনি ওদের নাম পর্যন্ত জানতেন না, বা জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনও মনে করেননি।
দক্ষ পাইলটরা একটা ইঞ্জিনের অভাবেও প্লেনটাকে ওই ভয়ানক ঝড় বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে সঠিকভাবে রানওয়েতে নামাতে সক্ষম হয়েছিল। বাইরে অ্যাম্বুলেন্স এবং কর্মকর্তাদের ভিড় কিন্তু যাত্রীরা কেউ যেন প্লেন থেকে নামতে চাইছিল না! সবাই পরস্পরকে আলিঙ্গন করে বেঁচে থাকার আনন্দে ডুবে ছিল। ভয়ঙ্কর বিপদের কিছু সময় একসঙ্গে কাটিয়ে আসার অভিজ্ঞতা সবাইকে যেন নিকট আত্মীয় করে তুলেছিল। গায়িকা মেয়েটা ভাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল, আনন্দের কান্না!
মিস্টার মিত্র যার হাত ধরেছিলেন সেই কম্পিউটারে কাজ করা ভদ্রলোক বললেন, “বাড়ি ফিরেই মেয়ে দুটোকে জড়িয়ে ধরে অনেক আদর করব কিন্তু কাজের চাপে ওদের জন্যে কোন উপহার কিনতে ভুলে গেছি!”
সেটা শুনে ওনার পাশে বসা এক বয়স্ক মহিলা তাঁর ব্যাগ থেকে এক বাক্স দামি চকোলেট বার করে ওনাকে দিয়ে বললেন, “এগুলো আমার তরফ থেকে ওদের দিয়ে দেবেন! বললেব প্লেনের এক আন্টি দিয়েছেন। নিজের জন্যে লুকিয়ে এগুলো কিনেছিলাম অথচ আমার চকোলেট খাওয়া একেবারে বারণ!”
সবাই মোবাইলে প্রিয়জনদের সঙ্গে কথা বলছিল। কী ভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে ওরা। মিস্টার মিত্র বিয়ে করেননি, কম্পানিটাই ওনার সব কিছু এই ভেবে আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গেও সম্পর্ক রাখেননি তেমন। তাই ওনার কাউকে কিছু জানাবার নেই। তাও কী ভেবে উনি পকেট থেকে ফোনটা বার করে অন করে শাশ্বতকে একটা ফোন করলেন।
“বলুন স্যার!”
“তোমার মা-বাবা কেমন আছেন শাশ্বত?”
(৩)
ওই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পরও কম্পানির কাজে প্লেনেই যাতায়াত করেন মিস্টার মিত্র। যদিও বাড়িতে বসে প্লেনের শব্দ শুনলে প্রায়ই সেই সব সহযাত্রীদের কথা মনে পড়ে যায়। পরে শুনেছিলেন যে খারাপ আবহাওয়া আর বজ্রবিদ্যুতের জন্যে প্লেনটার ওই দশা হয়েছিল। বাজ সেদিন আরেকটাও পড়েছিল, এবং সেটা পড়েছিল মিস্টার মিত্রর মনে। অন্যকে সাহায্য করার আনন্দটা তিনি সেদিন মোক্ষমভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। সেই থেকেই আমূল বদলে গেছেন মিস্টার মিত্র।