• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৬ | সেপ্টেম্বর ২০১৯ | গল্প
    Share
  • সন্ন্যাসী : অরুণ কাঞ্জিলাল


    খুব সকালে উঠে বেরিয়ে পড়ল গৌরাঙ্গ। গন্তব্য সাগরদ্বীপ। শহরতলির রাস্তায় দুই-একটা অটো রিক্সা চলতে শুরু করেছে। বেলঘরিয়া থেকে ফার্স্ট ডাউনটা ধরতে পারলে ভালো হয়। অল্পের জন্য মিস্‌ করল। দ্বিতীয়টা পাঁচটা এগারো। স্টেশনে ঢুকতে ঢুকতে পাঁচটা কুড়ি বাজিয়ে দিল। তা হোক, সহযাত্রীরা হৃষ্ট। কারোরই যেন কোন হেলদোল নেই এইটুকু দেরীতে। ফাঁকা ট্রেনে জানলার পাশে একটা সিট নিয়ে বসল সে। শিয়ালদহে প্রথম বিরতি।

    এই ফেব্রুয়ারীর শেষেও আকাশ মেঘলা হয়ে আছে। ভোরবেলা দিব্যি শীতের আমেজ। শিয়ালদহ উত্তর থেকে দক্ষিণ-স্টেশনের ভিতর দিয়ে রাজকীয় হাঁটা। ডায়মন্ডহারবার পর্যন্ত আরও একটা ট্রেন সফর। শিয়ালদা-সাউথে গরম চা খেয়ে ডায়মন্ডহারবার লোকালে উঠে বসল গৌরাঙ্গ। রাস্তাটুকু কম নয়। ঘন্টা দুয়েক সময় লেগে গেল। ডায়মন্ডহারবারে দ্বিতীয় যাত্রাবিরতি।

    চারপাশে জল, মাঝে পড়ছে চর--নাম তার সাগরদ্বীপ। ‘দেবতার গ্রাস’-এর মৈত্র মহাশয়ের সাগরসঙ্গমের ভয়াবহতা আজ আর নেই--পথের দুর্গমতা বহুলাংশে লাঘব হয়েছে। তবে দূরত্বের অনুপাতে যেন সময়ের আধিক্য। অফিসের এক সহকর্মী সাগরদ্বীপ যাবে শুনে বলেছিল--অত ঝামেলা করবেন না মুখার্জীদা, শহীদ মিনার থেকে বাস ধরবেন, সোজা কাকদ্বীপ। হারউড পয়েন্টে যাবার বাসও পাবেন। হারউড পয়েন্টে পৌঁছে ফেরি--ভেসেলে ২৫-৩০ মিনিটে নদী পার হয়ে যাবেন উল্টো দিকের কচুবেড়িয়া ঘাটে। সেখান থেকে সাগর দ্বীপের বাস ধরে নেবেন। ঠিকমত সব মিলে গেলে ভোরবেলা ধর্মতলা থেকে বাস ধরে দুপুরের মধ্যে পৌঁছে যাবেন সাগরদ্বীপে। মাঝপথে হারউড পয়েন্টে দুপুরের খাওয়া সেরে নিতে পারেন। লটঘটের কাছেই ঝুপড়ি হোটেলে দুই টুকরো ইলিশ নিলে ডিম ফ্রি।

    গৌরাঙ্গ কিন্তু ট্রেনে যাতায়াত পছন্দ করে। দুটো সমান্তরাল ভাবে পাতা ইস্পাতের লাইন। তার উপর ইস্পাতের চাকাবিশিষ্ট ‘দ্য আয়রন হর্স’। গমনজনিত ঝাঁকুনিও কম। ডায়মন্ড হারবার স্টেশান লাগোয়া জাতীয় সড়ক। রাস্তাটা কাকদ্বীপ নামখানা হয়েও আরও দক্ষিণে বকখালি পর্যন্ত বিস্তৃত। জাতীয় সড়কে নেমে সে বাস ধরল। এ পথ ভারি সুন্দর। দু’পাশ থেকে গাছগুলো ঝুঁকে পড়ে একেবারে যেন মাথায় মাথায় ছুঁয়ে আছে। সবুজ ছাউনির মত দেখাচ্ছে ওপরটা। ঝকঝকে সোজা রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে বহুদূর। যেন বাস যাচ্ছে পাতা ছাওয়া টানেলের মধ্য দিয়ে।

    কাকদ্বীপের কিছু আগে ডান দিকে বাঁক নিয়েছে হারউড পয়েন্টের রাস্তা। সেখান থেকে ফেরিঘাট চার কিলোমিটার মত। ফেরি ভেসেল যাত্রী বোঝাই। মানুষের সঙ্গে চলেছে গৃহপালিত পশু, সাইকেল, মোটর সাইকেল, চাল, ডাল, চিনি। বসার জায়গা না পেয়ে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে চলেছে অনেকে। গৌরাঙ্গও দাঁড়িয়ে গেল। দুপুর বেলার সূর্যের আলোয় দূরে তাকালে কেমন কাঁপা-কাঁপা ঝাপসা দেখায়। বিশাল জলরাশির উপর দেখা যাচ্ছে দুটো দ্বীপ। একটার নাম ‘ঘোড়া মারা’ অন্যটা ‘সাগরদ্বীপ’। ভেসেলে পার হয়ে আসতে আসতে স্পষ্ট হয়ে আসে দ্বীপের চেহারা। পুবে মুড়িগঙ্গা আর পশ্চিমে ভাগীরথী বেষ্টিত সাগরদ্বীপ। গঙ্গার ধারা সাগরদ্বীপকে ঘিরে এগিয়ে চলেছে বঙ্গোপসাগরে মিলতে। ছোট ছোট ঢেউয়ের উপর চলেছে পালতোলা নৌকা।

    একটা বড়সড় দল একই সঙ্গে নদী পার হচ্ছিল। আলাপ হয়ে গেল। এদের বেশভূষা সম্ভ্রান্ত, কথাবার্তা মার্জিত। কিছুক্ষণ আলাপের পরই জানতে পারল এরা সব লাফিং ক্লাবের সদস্য। নদীর পারে মুক্ত বাতাসে কয়েকদিন প্রাণ ভরে হাসবে তারপর আবার যে যার বাসস্থানে চলে যাবে। প্রাণভরে হাসলে পরমায়ু বাড়ে, রোগভোগ কম হয়।

    এদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ যে, তিনি গৌরাঙ্গকে অনুরোধ করলেন, চলুন না আমাদের সঙ্গে দুপুরে খাওয়াদাওয়া করবেন। তারপর রাত ভোর হলেই ‘হাসি’। হাসতে হাসতে আকাশ বাতাস ভরিয়ে দেব।

    গৌরাঙ্গ একবার ভাবল--দেখি না এদের সঙ্গে গিয়ে মজাটা কি, তারপর একটু ভেবে বলল--আমার উপায় নেই। আমার জন্য হয়তো একজন অপেক্ষা করে থাকবেন, সম্ভবত খাবেন না, আমাকে দুপুরের মধ্যে সাগরদ্বীপে পৌঁছতে হবে।

    এই সম্ভাবনার কথাটা দুবার ব্যবহার করল গৌরাঙ্গ। যার সঙ্গে সে দেখা করতে যাচ্ছে, সে তার দাদা। গৌরাঙ্গ যখন খুব ছোট, তখন দাদা বাড়ি থেকে চলে যান। পরে জানা যায় দাদা সন্ন্যাসী হয়েছেন। দীর্ঘ পঁচিশ বছর দাদার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। এতদিন পর জানা গেছে দাদা সাগরদ্বীপে এক আশ্রমে আছেন। দাদার সত্যি-মিথ্যা যাচাই করতে সে যাচ্ছে না। সে যাচ্ছে ছোটবেলার দাদাকে নিয়ে কিছু টুকরো টুকরো স্মৃতির সঙ্গে বর্তমান দাদাকে মিলিয়ে নিতে।

    ঘটঘট আওয়াজ তুলে ঘাটে ভিড়ে গেল ফেরি ভেসেল। লাফিং লাবের সদস্যরা হইহই করে একদিকে চলে গেল। গৌরাঙ্গ বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগোল। বাসের সীট দখলের জন্য প্রচণ্ড হুড়োহুড়ি। অনেকে বেড়াতে যাচ্ছে দু-একদিনের জন্য, তাই মালপত্রও নিয়েছে ঠেসে। মালপত্রর মধ্যে ইতিউতি উঁকি দিচ্ছে ব্যাডমিন্টনের র‍্যাকেট।

    নিরালা হলেও সাগরদ্বীপ জনহীন নয়। আঠারোশো বাইশে ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টি পড়ে সাগরদ্বীপে। আরাকানের পাঁচটি মগ পরিবার পাঠিয়ে জনবস্তি গড়ে তোলার প্রস্তুতি নেয়। ব্রিটিশ রাজ্যের সেই পরিকল্পনা সফল হয়। সেদিনের পাঁচ আজ দাঁড়িয়েছে পঁচিশ হাজার পরিবারে। তবে বঙ্কিমবাবুর কপালকুণ্ডলার বিবরণের সঙ্গে এই সাগরদ্বীপের কোন মিল নেই। যাতায়াত যেমন সহজসাধ্য, তেমন জঙ্গল পরিষ্কার করে দ্বীপ জুড়ে গড়ে উঠেছে গ্রাম। তবে গাছ আছে প্রচুর। আর হই-হট্টগোল নেই। পিচ বাঁধানো রাস্তাগুলোও চমৎকার। গৌরাঙ্গর ভালো লেগে গেল জায়গাটা। হু-হু করে বাস ছুটছে। প্রায় একঘণ্টার জার্নি। সাগরদ্বীপের শেষ বাসস্টপ ভারত সেবাশ্রম সংঘের কাছে। গৌরাঙ্গ বাস থেকে নেমে পড়ল।

    “ওঁ শ্রীগুরুধাম” দাদার আশ্রমের নাম। সাগর বাসস্ট্যান্ড থেকে বেশ কিছুটা পিছিয়ে আসতে হল। আশ্রমটা সমুদ্র থেকে একটু দূরে কিন্তু সামনে ফাঁকা জমি। তারপর ঝাউগাছের সারির ওপারে সমুদ্রসৈকত। বাঁদিকে দেখা যায় কপিল মুনির মন্দির। যেখান থেকে দেখা যাচ্ছে সমুদ্রে ভেসে চলা বিশাল অয়েলট্যাঙ্কার। আশ্রমে ঢুকতেই গৌরাঙ্গ দেখল একজন গেরুয়া বসনধারী সৌম্য চেহারার সন্ন্যাসী আশ্রমের শান-বাঁধানো বারান্দায় বসে আছেন। গৌরাঙ্গের সারা গায়ে শিহরন হতে লাগল। আশ্রমের আঙিনায় প্রবেশ করতেই সন্ন্যাসী উঠে দাঁড়ালেন। কাছে আসতেই বললেন--তোর চিঠি পেয়েছি। তোর জন্যই অপেক্ষা করছি।

    এক মুহূর্তের জন্য গৌরাঙ্গের মনে হল লাফিং ক্লাবের সদস্যদের সঙ্গে চলে গেলে কী অন্যায়টাই না হত। দাদা তার জন্য অপেক্ষা করে করে অভুক্তই থেকে যেতেন। দাদা বললেন--হাত মুখ ধুয়ে নে, তারপর চল একসাথেই খাব।

    আশ্রমের লাগোয়া ইঁদারায় একজন বালক সন্ন্যাসী এক বালতি জল নিয়ে অপেক্ষা করছিল। তার গায়ে গেরুয়া কাপড় নেই; আছে সাদা উত্তরীয়। পরে জিজ্ঞেস করে জানা গেল এরা ‘শিক্ষানবীশ সন্ন্যাসী’। আশ্রমের ভাষায় এদের বলা হয় ঋত্বিক।

    খাবার মধ্যে ছিল ভাত, ছোলার ডাল আর আলু-কুমড়োর তরকারি। খুব সাদাসিধে মেনু। দাদা খেতে খেতে বললেন--এই চাল, শাক-সবজি সবই আমাদের আশ্রমের ফলন। আশ্রমের লাগোয়া জমিতে এটা চাষ হয়। তাছাড়া দু-চারটে বড় পুকুর আছে। সন্ন্যাসীরা কেউ মছ খান না, পুকুরগুলো সব ইজারা দেওয়া আছে, তার থেকে কিছু অর্থ আসে, এই দিয়েই আশ্রম চলে।

    গৌরাঙ্গ জিজ্ঞেস করল--সব শ্রম, কিছু দান গ্রহণ করুন। এই রকম দান কি এই আশ্রম পায়? দাদা উত্তর করলেন--গৃহীদের থেকে কোন দান আমরা নিই না। গৃহীদের অর্থ অনেক কষ্টে অর্জিত অর্থ। এই অর্থে থাকে তাদের অনেক মায়া। সেই অর্থে সন্ন্যাসীদের কোন দাবি থাকা উচিত নয়।

    কথাটা শুনে গৌরাঙ্গ একটু দমে গেল। সে একটা সামান্য চাকরি করে বিয়ে করেছে, একটা ছেলেও আছে, তার সঞ্চয় বলতে তেমন কিছু নেই। তবুও সে কিছু অর্থ এনেছিল দাদার আশ্রমে দেবে বলে। দাদার এই কথার পর সে আর এগোতে ভরসা পেল না। দাদা বলতে লাগলেন--এই আশ্রম, এই বাড়ি, এই বাড়ির লাগোয়া জমিজমা, পুকুর সবই ছিল এক সন্ন্যাসীর। ওঁর সাথে আমার দেখা হয় কুম্ভমেলায়। উনিই আমাকে এই আশ্রমে নিয়ে আসেন। তিনি পরম ব্রহ্মে বিশ্বাস করতেন। এই আশ্রমের সবাই তাঁর অনুগামী। কোন রকম পৌত্তলিকতায় তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না তাই এই আশ্রমে কোন বিগ্রহ নেই। আছে উপাসনাগৃহ। আমরা পরমব্রহ্মের উপাসক।

    খাওয়া শেষ হতেই বিকেল হয়ে গেল। একজন ওকে নিয়ে একটা বিশ্রামকক্ষ দেখিয়ে দিল, সেখানে ঘণ্টা খানেক এপাশ ওপাশ করে গৌরাঙ্গ বেরিয়ে পড়ল সাগর দেখতে। কপিল মুনির মন্দিরের সামনে দিয়ে হেঁটে সমুদ্রের কাছে যখন সে পৌঁছল, ততক্ষণে অন্ধকার নেমে এসেছে। ঝাউয়ের সারিতে মাখামাখি হয়ে আছে আলো আঁধারি। নির্জন বালির তটে লাল ফুলের মত পড়ে আছে সংখ্য কাঁকড়া। দিগন্তবিস্তৃত জলরাশি গর্জন করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে পাড়ে এসে। ছড়িয়ে পড়ছে ঢেউয়ের সাদা ফেনা। সন্ধের মু্খে জনহীন তটভূমিতে সমুদ্রের সেই রূপ দেখে গৌরাঙ্গ স্তব্ধ।

    পিছনে দূরে কপিলমুনির মন্দিরে তখন আলো জ্বলে উঠেছে। বালির পথ পেরিয়ে সেটা প্রায় এক কিলোমিটার খানেক। পুরাণে মেলে রামচন্দ্রের ১৩শ পিতৃপুরুষ অযোধ্যারাজ সগর শততম অশ্বমেধ যজ্ঞের প্রস্তুতি নেন। ১০০ অশ্বমেধ যজ্ঞের একমাত্র অধিকারী দেবরাজ ইন্দ্র হিংসাপরায়ণ হয়ে যজ্ঞের ঘোড়া ধরে কপিলমুনির আশ্রমে বেঁধে রেখে আসেন। ঘোড়ার খোঁজে বেরিয়ে সগররাজার ষাট হাজার সন্তান ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে আশ্রমে ঘোড়া দেখে মুনিকে চোর সাব্যস্ত করে কটূক্তি করে। ধ্যানে ব্যাঘাত ঘটায় কুপিত মুনির সাপে ভস্মীভূত হয়ে নরকে পতিত হয় ষাট হাজার সগর-সন্তান। পূর্বপুরুষকে শাপমুক্ত করতে তপস্যাবলে দেবী গঙ্গাকে মর্ত্যে আনেন সগর রাজার বংশধর ভগীরথ। সপ্তধারায় স্বর্গ থেকে নামেন গঙ্গা। মূলধারা গঙ্গা ভগীরথের পিছু পছু এসে মোহনায় সগর-সন্তানদের নশ্বর দেহে জীবন দান করে নিজেকে বিলীন করে দেন সমুদ্রে।

    কপিল মুনির মন্দিরে একজন স্থানীয় লোকের সঙ্গে দেখা হল। সে জানাল--আসল কপিল মুনির মন্দির হয়েছিল এখান থেকে প্রায় এক কিলোমিটার ভিতরে, সমুদ্রগর্ভে। যতবার সমুদ্র মন্দিরকে গ্রাস করছে ততবারই নতুন করে গড়া হয়েছে এক মন্দির।

    কপিল মুনির মন্দির থেকে অন্ধকার পথে হাঁটতে হাঁটতে গৌরাঙ্গ চলে এল ভারত সেবাশ্রমের কাছাকাছি। সন্ধ্যাপূজা চলছে, ঘন্টা বাজছে, আরতির নাচ হচ্ছে মন্দিরে। সাগরপারের নিষ্কলুষ আকাশে লক্ষ লক্ষ উজ্জ্বল তারার ভিড়। ঝাউবনের মাঝখান দিয়ে দূর সমুদ্রের উপর জাহাজের বিন্দু বিন্দু আলোর সারি। মোহনার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে জাহাজটা। হিমালয় থেকে বহু পথ বয়ে এসে গঙ্গা সেখানে মিলেছে সাগরে।

    গৌরাঙ্গ যখন আশ্রমে ফিরল তখন সন্ধে গড়িয়ে অনেকটা রাত হয়েছে। দাদা পায়চারি করছিলেন আশ্রমের উঠোনে। গৌরাঙ্গকে দেখে একটু এগিয়ে এলেন। শান্ত গলায় শুধালেন--‘সাগর দেখে এলি? ভিতরে আয়, তোর সঙ্গে কয়েকটা কথা সেরে নিই।’

    দাদাই শুরু করলেন, বললেন--বাবা মারা গেছেন গত বছর শুনেছি। কাকাদের সঙ্গে সম্পত্তি নিয়ে তোর একটা গোলযোগ চলছে এটাও শুনেছি। তবে আমি তো সন্ন্যাসী, আমাদের এইসব সাংসারিক ব্যাপারে থাকতে নেই।

    গৌরাঙ্গ জানে, তাঁদেরই একজন জ্ঞাতি দাদার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। বস্তুত তাঁর কাছ থেকে খবর পেয়েই সে সাগরদ্বীপে ছুটে এসেছে। গৌরাঙ্গ দাদাকে থামিয়ে বলল--থাক দাদা ঐ সব আমিই সামলে নেব।

    দাদা বললেন, শুনেছি বাবা মারা যাবার আগে উইল করে তার সন্ন্যাসী ছেলের জন্যও কিছু রেখে গেছেন, আর সেটা নিয়েই কাকাদের সঙ্গে তোর গোলযোগ বেধেছে। গৌরাঙ্গ এবার খুব শান্ত গলায় বলল--আসলে ব্যাপারটা মামলা-মোকদ্দমার দিকে এগোচ্ছে। কোন ভাবে রেজেস্ট্রী অফিসে গিয়ে বাবার উত্তরাধিকারী প্রমাণ করতে পারলে ব্যাপারটা মামলার দিকে যেত না। আবার বড় ছেলে থাকতে আমি উদ্যোগ নিলে কাকারা জালিয়াতি কেস নিয়ে আসতে পারে।

    দাদা বললেন--তুই কোন ভাল উকিলের সঙ্গে কথা বলছিস না কেন?

    গৌরাঙ্গ বলল--বলেছি, তবে উকিল বলছেন কোন ভাবে কিছুক্ষণের জন্যও যদি তোমার দাদাকে ব্যারাকপুর কোর্টে নিয়ে আসতে পার, তবে তোমার বাবার আইনী উত্তরাধিকারী প্রমাণিত হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে কেসটা কাকাদের অনুকূলে যাবেনা। দাদা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বড় করে নিশ্বাস ফেলে বললেন--আমাদের এসবের মধ্যে যেতে নেই রে। আমরা যে সন্ন্যাসী।

    রাতে খাবারের পাত পড়ল। দুজন ঋত্বিক্‌ পরিবেশন করছিলেন। একদিকে সন্ন্যাসীরা বসেছেন, অন্যদিকে ঋত্বিক্‌রা, তার মধ্যে অতিথির জন্য একটা নির্দিষ্ট স্থানে গৌরাঙ্গ বসেছে। একটু অস্বস্তি গৌরাঙ্গকে পেয়ে বসেছে। সে গৃহী আর এরা সন্ন্যাসী। এরা সব কিছু ছেড়ে এই দ্বীপে এসে পরমব্রহ্মের উপাসনায় নিমগ্ন আর সে এসেছে তার সন্ন্যাসী দাদাকে শরিকী সম্পত্তির বিবাদে টেনে আনতে। নিজের উপর খুব রাগ হল তার। ভাবল কাল সকালে উঠেই চলে যাবে। এবেলা পাতে পড়ল লুচি আর ছোলার ডাল। খাবার পর ইঁদারায় হাত ধুতে গিয়ে একজন ঋত্বিক বললেন--আমাদের আশ্রমে যেদিন বড় অতিথি আসেন সেদিন লুচি হয়।

    খুব ভোরে গৌরাঙ্গ ঘুম থেকে উঠে ওর ব্যাগটা গুছিয়ে নিচ্ছে, দাদা এসে দরজায় দাঁড়ালেন, বললেন--চল তোকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসি।

    বালির পথ পেরিয়ে দুই ভাই এগিয়ে চলেছে। একজন গৃহী, একজন সন্ন্যাসী। প্রকৃতির কোন অজানা খেয়ালে দীর্ঘ পঁচিশ বছর আগে এদের মধ্যে ব্যবধান ঘটেছিল, প্রকৃতির আর এক অচেনা খেয়ালে আজ আবার এদের ক্ষণস্থায়ী মিলন হল।

    বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছবার আগে দাদা গৌরাঙ্গকে বললেন--তুই কাগজপত্র তৈরী করে রাখ, আমি যথাসময়ে যথাস্থানে গিয়ে দস্তখত দিয়ে আসব। সন্ন্যাসী হয়েছি কোন সাংসারিক ব্যাপারে থাকব না বলেই। কিন্তু কাল রাতে অনেক চিন্তা করে দেখলাম, তোর জন্য এইটুকু আমায় করতেই হবে। তুইতো আমার ছোট ভাই।

    কপিল মুনির আশ্রমের পিছনে সেই মুহূর্তে সূর্য উদয় হয়ে দুই ভাইয়ের মুখ রাঙিয়ে দিল।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments