মনে হচ্ছে বিকেল থেকে ইলেকট্রিকের তারে যেন ঝুলে আছে কমলা রঙের সূর্যটা। তার নিচ দিয়ে তিনটে ট্রেন চলে গেল পাঁচ মিনিট অন্তর। তবু সে এক চুল নড়লো না।আমার এই তিন তলার একটুকরো বারান্দা, যাকে প্রোমোটার বলেছিল, বারান্দা বললে ভুল হবে, বলতে পারেন উঁকি মারার জায়গা, সেখানেই আসলে থমকে আছে সময়টা। এখান থেকে রেললাইনেরখানিকটা চোখে পড়ে, শব্দটা জানান দিয়ে যায় ট্রেনের আসা যাওয়ার।বারান্দার এক কোনে টবে একটা জুঁইফুলের গাছ, লতিয়ে উঠে বারান্দার পশ্চিম দিকের গ্রিলটা প্রায় ঢেকে ফেলেছে। তারই ফাঁক দিয়ে সূর্যটাকে দেখতে পাচ্ছি। পুবদিকে আমার ইজিচেয়ার। তার পাশে একটা ছোট্ট টুল রাখা। অফিস থেকে ফিরে মাঝে মধ্যে এখানে বসি, ঘুম না এলেও সিগারেট আর এই ইজিচেয়ারই আমার আশ্রয়।
এখন এই অসহায় একাকীত্বের মাঝখানে, টুলের ওপর বিমূঢ় হয়ে পড়ে থাকা কলম আর ঈষৎ মলিন একটা পুরোনো রাইটিং প্যাডের খোলা পাতা নিয়ে যেন হাজার বছর অপেক্ষা করে আছি। অপেক্ষা করে আছি কয়েকটা শব্দের জন্যে — যাকে এক টুকরো চিরকুটের মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারি। হাজার শব্দ বাক্য জড়ো হচ্ছে মনের মধ্যে, যা দিয়ে একটা পুরো ছোটগল্প হয়ে যায়। হয়ে যায় আধখানা জীবনকাহিনী। কিন্তু তার ভেতর থেকে কিছুতেই সঠিক কথাগুলোকে তুলে আনতে পারছি না। যা দিয়ে গলিয়ে দেওয়া যায় চিরকুটের ওই কঠিন ধাতব শব্দ ক’টাকে।
তিনদিন আগে অফিস থেকে ফিরে দরজা খুলবো বলে ল্যাপটপ ব্যাগের পকেটে চাবি হাতড়াচ্ছি, চোখে পড়লো ছাদে ওঠার সিঁড়ির রেলিং-এ হাত রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে অরু, আমার মামাতো ভাই। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে ও? আসার আগে ফোন করেনি কেন কে জানে। আমার বাড়ি ফেরার সময়টা ও জানে, হয়তো সেই জন্যে। আমি ফিরি সাড়ে সাতটা থেকে পৌনে আটটার মাঝামাঝি। আটটা নাগাদ মোম ফেরে। মোমের কাছেও চাবি থাকে, তবু চেষ্টা করি ওর আগেই ফিরতে। ডোরবেল বাজলে মোমকে দরজা খুলে দেয়ার পর ওর একটা চমৎকার হাসি উপহার পাই। মাঝে মধ্যে খুনসুটি চলে দুজনের মাঝে। দরজা খোলার পর আমি দরজা আগলে দাঁড়িয়ে থাকি। ও ওর মাথাটাকে আমার বুকে ঠেকিয়ে ঠেলে সরিয়ে দেয় আমাকে। আমার সারাদিনের ক্লান্তি মুছে যায়।
আজ আমার ফিরতে বারো মিনিট দেরি হয়েছে। অবাক হয়ে অরুর দিকে তাকালাম। নির্বিকার, বলা ভালো নিরেট পাথরের মুখ। মনে হলো ও যেন একটা বোবা চলন্ত লেটারবক্স। কেউ ওর বুকের ভেতর খামে বন্ধ একটা চিরকুট ফেলে রেখে গিয়েছিল, ও সেটার ভার আমার দু’আঙুলের মাঝখানে গুঁজে দিয়ে, আমি কিছু বলার আগেই পালিয়ে গেল। এবং সত্যি সত্যি চিরকুটটা এতটাই ভারি যে সেই ভার আমার দু’আঙুল থেকে ক্রমশঃ গোটা হাতের পাতায়, সেখান থেকে হাত বেয়ে বেয়ে মস্তিস্কের কোষে কোষে ছড়িয়ে পড়েছে। আমার মাইগ্রেনটা আবার তার সাইকল শুরু করেছে। তিনদিন অফিস যাইনি।
অরুকে শুধু ভাই বললে ভুল হবে। ও আমার বন্ধু। আমার আলো অন্ধকার সবটুকুই ওর জানা। আমার সমস্ত দুঃসময়ে ও আমার হাত ধরে থেকেছে। বলা ভালো আগলে রেখেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে ও অন্যপ্রান্তে। আমার বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে আমি জানি। তাতে আমার কোনো অভিযোগ নেই, কেননা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না এখন দুঃসময়টা কার। কে বেশি রক্তাক্ত হচ্ছে, আমি না মোম?
ছ’মাস হলো চাকরিতে ঢুকেছে মোম। খবরের কাগজের অফিস। খুব এক্সাইটেড ছিল। ওর কাজ আর্কাইভে। ‘আগে সিনেমায় যেমন দেখা যেতো কোনো গোয়েন্দা খবরের কাগজের অফিসে এসে বহুবছর আগের পুরোনো কাগজ ঘেঁটে কোনো রহস্যের শেকড় খুঁজছে, এখন তেমনটা নেই’ --মোম বলছিল। ‘পুরোনো ইস্যুগুলো স্ক্যান করে সংরক্ষণের দিন চলে এসেছে। কাজও চলছে সেভাবে। তবু যা আছে এখনও তা বিশাল ভাণ্ডার।’
— তোর কাজ কী?
— ধর কেউ তিরিশ বছর আগে প্রকাশিত কোনো খবর জানতে চায়, প্রপার ওয়েতে তাকে আবেদন করতে হয় কর্তৃপক্ষের কাছে। নির্দেশ পেলে সেই ইস্যুটা আমাদের খুঁজে বার করে, সেটার স্ক্যানড কপি দিতে হয়।
— বিরক্ত লাগে না?
— উঁহু, ইন্টারেস্টিং লাগে। আজ থেকে কুড়ি পঁচিশ বছর আগের সামাজিক চেহারাটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। ধরো কোনো জায়গা, যেটা এমন পালটে গেছে যে চিনতেই পারবে না।
— হুম...
— শুধু তো খবর নয়, অনেক খবরের সঙ্গে ছবিও থাকে। ধরো তখনকার কোনো ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কোনো মানুষ এখনও যে ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাদের চারপাশে, তার বয়স বেড়েছে, কিন্তু তার সেই অল্পবয়সের আইডেন্টিটি থেকে হয়তো আসল মানুষটাকে চিনে নিতে পারি।
— এখানেই ভুল করলি। শুধু খবরের ছবি দেখে আসল মানুষকে চেনা যায় নাকি।
— কেন যাবে না? পারিপার্শ্বিক অনেকগুলো ফ্যাক্টর থেকেই ধারণা করে নেয়া যায় বাবা।
— আমি মানি না।
— আমি মানি। এটা নিয়ে তর্ক করতে চাইনা তোমার সঙ্গে। হাতে অন্য কাজ না থাকলে বসে বসে অনেক সময় পুরোনো কাগজ উলটে পালটে দেখি। কিছুদিন আগে নাইন্টি টু-র একটা কাগজ হাতে এলো। সেই বাবরি মসজিদ ভাঙার সময়কার ঘটনা। একটা বস্তির সামনে জড়ো হওয়া কিছু লোক, তাদের হাতে বিভিন্ন সাইজের ক্যান, মশাল। বস্তিটা জ্বলছে। একজনের হিংস্র উত্তেজিত মুখ ক্যামেরায় স্পষ্ট। ওই মুখটাকে আমি আইডেন্টিফাই করেছি।
— কোথায়?
— আমাদের গলির মুখে যে মেডিক্যাল স্টোরটা আছে, ওখানে। ভদ্রলোকই মনে হয় দেখলে। এখন মধ্যবয়সী। খুব ভালো প্রেসক্রিপশান পড়তে পারে। চমৎকার ব্যবহার। লোকটাকে আমার ভালো লাগতো। বলতে বলতে মোমের মুখটা একটু ম্লান হলো।
— ধ্যাৎ, এতবছর পর চেনা যায় না কি কাউকে। যে তোর সম্পূর্ণ অচেনা অজানা।
— শিওর হওয়ার জন্যে আমি কারণে অকারণে বারবার দোকানটাতে যাই।
— অকারণে কেউ ওষুধের দোকানে যায় নাকি?
— আমি যাই। লোকটাকে দেখবো বলে। কিছু না হলে একটা বোরোলিন, দুটো ভিক্স... ওঁর মুখের প্রতিটা চিহ্ন মেলাই। দেখবে তুমি সেই তখনকার ছবিটা? আমার কাছে আছে। দেখলে তুমিও চিনতে পারবে।
— হতে পারে লোকটার মুখ হিংস্র নয়, শুধু উত্তেজিত। আর তুই ওইরকম একটা পরিস্থিতির মাঝখানে ওকে দেখছিস বলে তোর হিংস্র মনে হচ্ছে। হিংস্রতাটা তোর আরোপিত।
— সেটা হলে আমি খুশি হতাম বাবা।
— কিন্তু এটা নিয়ে তোর সমস্যা কেন?
— জানি না। আমার পরিচিত বলেই হয় তো। লোকটাকে পছন্দ করতাম বলেই হয় তো। আমার কষ্ট হয়।
— দেখ মোম পৃথিবীতে প্রতি মুহূর্তে অনেক অসঙ্গত ঘটনা ঘটে চলেছে, সব কিছু নিয়ে এত রিঅ্যাক্ট করলে বাঁচা যায় নাকি? এই যে এত খুন দাঙ্গা হয় তার সঙ্গে বহু লোক জড়িত থাকে। তারা আমাদের চারপাশে ঘুরেও বেড়ায়।
— কিন্তু তাদের আমি চিনি না বাবা। আমার চেনা একজন মানুষ, যাকে আমি পছন্দ করি, ভালোমানুষ ভাবি, সে ওই রকম বীভৎস একটা কাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল, ভাবলে আমার অস্বস্তি হয়। ইনফ্যাক্ট মানুষটার সবটুকু হয়তো খারাপ না।
মাসখানেক আগে — একদিন অফিস থেকে ফিরে টের পেলাম বসার ঘরে টিভি চলছে। তার মানে মোম আজ আমার আগেই ফিরেছে। বেল না বাজিয়ে নিজেই তালা খুললাম। ও বসার ঘরেই আছে, কিন্তু টিভি দেখছে না। পা দুটো সেন্টার টেবিলে মেলে দিয়ে সোফায় বসে আছে। কোলের ওপর ল্যাপটপ। মন দিয়ে সেখানেই কিছু করছে বা দেখছে। ঘরে ঢুকতেই মোম হাত ইশারায় কাছে ডাকলো।
— দাঁড়া আমি হাতমুখ ধুয়ে আসি।
জামাকাপড় ছেড়ে হাতমুখ ধুয়ে বেরোতেই নীলুর মা এসে জিজ্ঞেস করলো, দাদা তুমি চা খাবে? মামনির জন্যে বানাচ্ছি।
নীলুর মা সকালবেলাতেই দু’বেলার রান্না করে রাখে। সন্ধেবেলায় এসে রাতের খাবার রেডি করে টেবিলে সাজিয়ে দিয়ে চলে যায়। কখনও কখনও নতুন করে মোমের পছন্দের এক আধটা পদও রান্না করে। এই ফ্ল্যাটে আসার পর থেকে ও আছে এখানে। মা-মরা মেয়ে বলেই মোমের প্রতি ওর একটা আলাদা টান।
— দাও তাহলে আমাকেও এক কাপ।
অফিসে আমার এতবার চা খাওয়া হয় যে বাড়ি ফিরে আর চা খেতে ইচ্ছে করে না। নেশা নেই, তবু ফ্রেস হয়ে মাঝে মাঝেই হালকা করে একটু ড্রিঙ্ক করি। একটা সিগারেট ধরাই। তখন আমি বারান্দার ইজিচেয়ারে বসি। ঘরের ভেতর সিগারেট খাওয়ার পারমিশান নেই। আজ সেটা আর হবে না। মোম ডাকছে মানে আমাকে যেতেই হবে। অন্যদিন এই সময়টা ও নিজের মতো থাকে।
ঘড়ি দেখলাম, আটটা কুড়ি। মোমের খুব একটা চা-প্রীতি নেই। অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরলে টিভি দেখতে দেখতে বা ফোনে আড্ডা মারতে মারতে কখনো সখনো কফি খায়। তারপর ন’টাতেই আমরা রাতের খাবার খেয়ে নিই। সকাল বেলায় ব্রেকফাস্টটা এক সঙ্গে হয় না, যেহেতু আমাকে খুব তাড়াতাড়ি বেরোতে হয়। কিন্তু ডিনারটা আমরা একসঙ্গে গল্প করতে করতে খুব রিল্যাক্স করে করি।
আমাকে ঢুকতে দেখে মোম ওর পাশটিতে বসার ইঙ্গিত করলো। বসলাম।
— ছবিটা মন দিয়ে দেখ। তারপর বলো এটা কোথায়?
ওর ল্যাপটপ স্ক্রিন জুড়ে একটা সাদা কালো ছবি। বহু পুরোনো। স্ক্যান করা ছবি বোঝাই যাচ্ছে। কোনো খবরের সঙ্গে হয়তো ছিল ছবিটা। বুঝলাম খবরটা এক্ষেত্রে মুখ্য নয় ওর কাছে।
— বলতে পারছি না।
স্ক্রিনে এবার অন্য একটা ছবি আনলো। সদ্য তোলা। রঙিন ছিল। দুটো ছবির সমতা আনার জন্যে সেটাকে ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইটে দেখালো।
— এবার বলো।
— এটা তো গড়িয়া মোড়।
— আগেরটাও গড়িয়া মোড়, তিরিশ বছর আগের।
— আরেকবার দেখি... সত্যি চেনাই যায় না। এত পালটেছে।
মোড় থেকে চার মিনিট হাঁটা দূরত্বে আমাদের বাড়ি। গড়িয়ার এই ফ্ল্যাটটা কিনেছি সতেরো বছর হলো। মোমের তখন আট বছর বয়েস। ওর স্কুল কাছাকাছি হবে সেই জন্যে এখানে আসা। কাটোয়া ছেড়ে আসার পর বছরখানেক বেহালায় অরুদের বাড়িতেই ছিলাম। বিয়ের পর বিপাশাকে নিয়ে ওদের কাছাকাছি একটা ভাড়া বাড়িতে নিজেদের মতো সংসার পেতেছিলাম। মোমের জন্ম সেখানেই। মোমের যখন দেড় বছর বয়েস তখন বিপাশা চলে যায়। কোলোন ক্যান্সারে। আমার জীবনের একটা ভয়ঙ্কর অন্ধকারের সময়ে নরম আলোর মতো যেমন এসেছিল বিপাশা। তেমনি হঠাৎ করে আরো ঘন অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়ে নিবেও গেল। নিজে কী করে বাঁচবো, আর কী করেই বা অতটুকু একটা মা-হারা শিশুকে বাঁচিয়ে রাখবো, সেই ভাবনায় জীবনে দ্বিতীয়বার একটা অদ্ভুত ডিপ্রেশানে ডুবে যেতে যেতেও মোমকে বুকে আঁকড়ে ফের জীবনে ফিরেছিলাম। জীবনের মানে খুঁজে পেয়েছিলাম।
আলতো করে মোমের মাথাটা নিজের কাঁধে টেনে নিয়ে বললাম, তোকেই কি আর চেনা যায়? আমাদের পুরোনো পাড়ার লোকেরা তোকে দেখে চিনতেই পারবে না।
মোম হঠাৎ উঠে গিয়ে একটা ছোট অ্যালবাম নিয়ে এলো। সবই ওর ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠা বয়সের ধারাবাহিক ছবি। আট দশ বছর বয়স পর্যন্ত। দুজনে মিলে ছবি দেখতে দেখতে ছবির পটভূমি, পুরোনো গল্প উঠে এলো। আমার মন আরো পিছনে হাঁটছিল, জোর করে আটকালাম নিজেকে। মোম আর আমার মাঝখানে সেই সময়ের ছায়াও যাতে না পড়ে।
এর পর থেকে মোম প্রায়ই পুরোনো খবরের কাগজ থেকে একটা করে স্ক্যানড ছবি নিয়ে সেই জায়গাটায় যেতো। ছবি তুলে আনতো। তারপর আমার সামনে স্ক্যানড ছবিটা রেখে বলতো, বলো। চিনতে পারলে ট্রিট দেব, না যদি পারো তুমি আমাকে ট্রিট দেবে।
এটা একটা মজার খেলা ছিল আমাদের। দু’জনেই এনজয় করতাম।
চারদিন আগে, অনেক দেরি করে, আমার টেনশান যখন আমাকে গেটের সামনে রাস্তায় এনে দাঁড় করালো, তারও আধ ঘন্টা পর অফিস থেকে ফিরলো মোম। অন্যদিন ব্যাগ রেখে বাথরুমে ঢোকার আগে ডাইনিং টেবিলে এসে ঢাকনা তুলে তুলে দেখে রাতে কী খাবার। পছন্দ হলে চট করে চেঞ্জ করে নিয়ে স্নানে চলে যায়। না হলে বাইরের জামাকাপড় না ছেড়েই টিভি চালিয়ে বসে। বার বার বলতে হয় খেতে যাওয়ার জন্যে।
সেদিন এসেই নিজের ঘরে ঢুকে গেল। বেশ কিছুক্ষণ সাড়াশব্দ না পেয়ে ওর ঘরের সামনে গিয়ে দেখি দরজা ভেজানো। ফোনে কথা বলছে। ফিরে এসে টিভি চালিয়ে খবর দেখতে দেখতে সময়ের খেয়াল ছিল না। বিজ্ঞাপন বিরতিতে ঘড়ির দিকে তাকালাম — প্রায় ন’টা চল্লিশ বাজে। ডেকে সাড়া পেলাম না। উঠে গিয়ে দেখি ওর ঘরের আলো নেবানো। দরজায় হাত দিয়ে বুঝলাম, বন্ধ। অদ্ভুত লাগলো। ও একটা রিলেশানে আছে জানি, সেখানে কি কিছু গোলমাল? বাড়ি ফিরেই দরজা ভেজিয়ে ফোনে কথা বলাটাও স্বাভাবিক মনে হলো না। উদ্বেগ বাড়ছিল।
দু’তিনবার ডাকার পরেও সাড়া নেই। অস্থির লাগছিল। এবার দরজায় নক করলাম।
— মোম, খাবি না? প্রায় পৌনে দশটা বাজে রে।
— আমি বাইরে খেয়েছি।
— সেটা আগে বলতে কি অসুবিধে ছিল? তোর জন্যে অপেক্ষা করে বসে আছি।
আমার কথার মধ্যে একটু বেশি ঝাঁঝ ছিল, নিজেই সেটা বুঝলাম। উত্তর পেলাম না। রাগ চেপে কোনোরকমে চারটে নাকেমুখে গুঁজে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু মনটা খুব অস্থির হয়ে থাকলো। দেড় বছর বয়েস থেকে আমি ওর মা বাবা দুইই। ওকে প্রসন্ন দেখাই আমার জীবনের জরুরি চাওয়া। ভালো ঘুম হলো না।
মোম একটু বেলা করে ওঠে। অনেক সময় ও ঘুম থেকে ওঠার আগেই আমি বেরিয়ে যাই। অফিসে বেরোনোর আগে একবার ওর ঘরের সামনে গিয়ে ডাকলাম। সাড়া নেই। দরজায় হাত রাখতে খুলে গেল। উঁকি দিলাম। বিছানায় নেই। তার মানে স্নানে ঢুকে গেছে। ওখান থেকেই ডেকে বললাম, মোম আমি বেরোচ্ছি।
ওর গলার স্বরটা শুনতে ইচ্ছে করছিল। পেলাম না।
অরু চলে যাওয়ার পর খামটা হাতে নিয়ে বিমূঢ় হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দরজা খুলে ঘরে ঢুকলাম। আমার মাথা কাজ করছে না। অরু হঠাৎ খামে করে কী পৌঁছে দিয়ে গেল আমার কাছে? ওভাবে চলেই বা গেল কেন? এর সঙ্গে মোমের কোনো যোগ নেই তো? কাঁপা হাতে খামটা খুললাম। একটা ছোট্ট চিরকুট, সঙ্গে একটা ভাঁজ করা স্ক্যানড কাগজ। কাগজটার ভাঁজ খুলতেই আমার পায়ের নিচটা দুলে উঠলো। ... ‘তালা ঝুললো কাটোয়ার জনপ্রিয় কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারে। সহকর্মীকে যৌন হেনস্থার অভিযোগে গ্রেপ্তার টেকনোটাইম এর ...’ সাতাশ বছর কেটে গেছে। তবু সেই একই রকম ভয় আর অসহায়তা জাপটে ধরলো আমাকে। অরুকে ফোন করলাম। ফোন ধরে শুধু ‘মোম আমাদের কাছে আছে’, বলেই ফোনটা কেটে দিল।
তার মিনিট দশেক পরে ও নিজেই ফোন করলো।
— খুব সকালে মোমকে দরজা খুলে দিয়ে আমি ঘাবড়ে গেছি ওকে দেখে। মনে হলো সারারাত ঘুমোয়নি। চোখমুখ ফোলা। খুব ভেঙে পড়েছে। আমি আজ কলেজে যেতে পারিনি, শর্মিও না। মোম নিজেও অফিস যায়নি। অনেকবার ফোন এসেছে, রিসিভ করেনি। বুঝতে পারছি না কী করে সব সামলে নেব।
অরু আর শর্মি তো সব জানে। ওই খবর আর ছবির নিচে না বলা আরো অনেক কিছু চাপা পড়ে আছে। একটা ষড়যন্ত্র, যা সেদিন কেউ শুনতে চায়নি। অভিযোগটাকে সত্যি বলে ধরে নিয়েছিল। অনেক সময় খবরের নিচে আসল গল্প চাপা পড়ে যায়, ওকে কী করে বোঝাবো? কী করে বলবো ওর নিচে একটা সত্যিকারের প্রেমের গল্প ছিল, যা সেদিনও কাউকে বোঝাতে পারিনি।
চিরকুটটার দিকে আর একবার তাকালাম, ‘তোমার মুখের সঙ্গে ছবিটার বড্ড মিল। পুরোনো ছবি চিনতে পারার যে এত কষ্ট আগে বুঝিনি। তাহলে খেলাটা শুরু করতাম না…।’