স্কুলের চাকরি নিয়ে নীলাক্ষী চলে এসেছে উত্তরবাংলার এই পাহাড়ি শহরে বেশ কয়েকদিন হল। স্কুল থেকে কোয়ার্টার দেওয়ার কথা, কিন্তু সেখানে কিসব মেরামতির কাজ চলছে। তাই কয়েকটা মাস তাকে বাইরেই কোথাও ব্যবস্থা করে নিতে হবে। খুব মুশকিল। নতুন জায়গা, তেমন কাউকেই চেনে না। তারপর কলকাতা শহরের শিকড় বুকের মধ্যে। যাই দেখে ঠিক মনে লাগে না। অত্তবড় জগৎটা কে যদি একটা ঘর, কয়েকটা পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা আর নিস্তরঙ্গ স্কুলের মধ্যেই বেঁধে ফেলতে হয় তাহলে অন্তত থাকার জায়গাটা পছন্দসই হওয়া চাই। শেষে ইংরাজীর রাধিকাদি একটা বাড়ির সন্ধান দিলেন। শহর থেকে একটু বাইরে, পাহাড়ের কিছুটা উপরে। কিন্ত কি স্কুল, কি বাজার-দোকান হেঁটেই যাতায়াত করা যাবে। কয়েকটা পাকদণ্ডী বেয়ে একবার পৌঁছাতে পারলেই সামনে কুয়াশা মাখা নীল পাহাড় আর নীচে পুতুল খেলার ঘরের মত সাজানো শহর। উপর থেকে ম্যালের দুপাশে সাজানো মার্কেট, পোস্ট অফিসের ছোট্ট লাল বাড়িটা, চার্চ, চার্চের পিছনে পুরনো পাড়ার সাহেবী বাংলোগুলো এমনকি পাহাড়ের গায়ে কফিশপটা অব্দি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। এই বাড়ির মালকিন মিসেস অলিভিয়া বিশ্বাস। একমাত্র মেয়ে বিয়ে-টিয়ে করে অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। তিনি আর তার হুইলচেয়ার আবদ্ধ স্বামী থাকেন একতলাটায়। কিন্ত বড্ড একা লাগে। তাই দোতলায় পেয়িং গেস্ট রাখেন শুধু আরেকটা মানুষের সাথে দুটো কথা বলার সুযোগ পাবেন বলে। বাড়িটা অনেকটা ছড়ানো। সামনে ফুলের কেয়ারী করা বাগান। শহরের রাস্তা অজগর সাপের মত পাহাড়কে পাকিয়ে পাকিয়ে নীচ থেকে উঠে সবুজ কাঠের গেটের সামনে দিয়ে আরো উপরে পাইন গাছের বনের মধ্যে ঢুকে গেছে। মিসেস বিশ্বাস অসম্ভব বেশি কথা বলেন। একগাল হাসতে হাসতে আর বকবক করতে করতে ভদ্রমহিলা নীলাক্ষীকে সারা বাড়িটা ঘুরে দেখালেন। তাঁর সাদা রঙের লোম লোম গাবদা বিড়ালটাও সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে। বাড়ির পিছন দিকটায় অতল খাদ। তারপরে দূরে অনেক দূরে আবছা আবছা পাহাড়, তার গায়ে ফিতের মত রাস্তা আর রাস্তার গায়ে লিলিপুট গাড়ি দেখা যাছে। এত সুন্দর এত সুন্দর বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে ভয় করে, কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। শ্বাসরোধকারী সৌন্দর্য কথাটা জীবনে বহুবার শুনেছে নীলাক্ষী। আজ ‘রোজমেরী কটেজের’ ব্যাকইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে প্রথম সেটা অনুভব করল। রোদ পড়ে আসছে, শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়া, লনের এককোণে কি একটা লতাগাছের ঝাড়। খাদের মধ্যে উঁকি মারলে দেখা যায় গাছের ফাঁকে ফাঁকে লাল-নীল-হলুদ-কমলা অসংখ্য বুনো ফুল। তার নীচে পাইন গাছের কালচে-সবুজ ঝিরঝিরে পাতা দেখা যাচ্ছে, তারও নীচে গভীর অন্ধকার। এক মুহূর্তের জন্য চোখের সামনে সব মুছে গেল তার। যেন সব আলো দপ করে একবার নিভেই আবার জ্বলে উঠলো। কেন জানিনা মাঝে মধ্যে এরকম হয়। পিছন থেকে মিসেস বিশ্বাস ডাকলেন “ওখানে অত ঝুঁকো না মিস চৌধুরী, পড়ে যাবে। চল ভিতরে চলো। বিকেলের চায়ের সময় হয়ে গেছে।”
“আমায় নীলাক্ষী বলেই ডাকুন না।”
“আচ্ছা। এস নীলাক্ষী।”
মিঃ বিশ্বাসের এই শহরে তিনটে হোটেল ছিল। ভালোই চলত। বছর কয়েক আগে একটা দুর্ঘটনায় ভদ্রলোক পঙ্গু হয়ে যান। তারপরেই ব্যাবসা গুটিয়ে স্বামী-স্ত্রী এই নিরালায় জীবন যাপন করছেন। যে টাকা ব্যাঙ্কে জমে আছে তার সুদে বাড়ি-গাড়ি-কাজের লোক রেখেও দিব্যি চলে যায়। এ সবই জানা হয়ে গেল মিসেস বিশ্বাসের সাথে চা খেতে খেতে। ভদ্রমহিলা এত বেশি কথা বলেন যে তাঁকে কিছু জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজনই পড়ে না। তার আগেই তিনি সব বলে দেন। মিঃ বিশ্বাস কিন্তু চুপচাপ। ঠিক গম্ভীর বলা যায়না, কিন্তু বিষণ্ণ, ইংরাজীতে যাকে বলে মেলানকোলিক। কাজের মানুষ ছিলেন, প্রতিবন্ধীর পরনির্ভরশীলতা বড় যন্ত্রণার। আর তাছাড়া এই বাড়িতে আর কারোর বোধহয় কথা বলার তেমন সুযোগ নেই।
নীলাক্ষীর জন্য দুতলায় দুটো পাশাপাশি ঘর। মাঝখানে দরজা আছে। বাইরেরটা সিটিং-কাম-স্টাডি, ভেতরের বড়টা বেডরুম। অ্যাটাচড টয়লেট। ভারি সুন্দর সাজানো-গোছানো। কাঠের মেঝেতে নরম কার্পেট পাতা, আগেকার সব সেগুন কাঠের আসবাব, দেওয়ালে চমৎকার পেইন্টিংস, ঝালর দেওয়া ল্যাম্পশেড, বিছানার পাশের টেবিলে চীনামাটির কারিকুরি করা ভাসে একগুচ্ছ ফুল সাজানো। এক্কেবারে পুরনো দিনের সাহেবী কেতার ঘর। দেখলেই মন জুড়িয়ে যায়। মিসেস বিশ্বাসের আবার বাগানের শখ। ফুলে ফুলে প্রজাপতিতে বাড়ির চারদিক একেবারে ঝলমল করছে। এরপর আর কিছু বলার থাকে না। অ্যাডভান্সড টাকা-পয়সা দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘর বুক করে ‘কাল সকালেই বাক্স-বিছানা নিয়ে আসছি’ বলে নীলাক্ষী বেরিয়ে পড়ল।
ভারি আনন্দে লাফাতে লাফাতে নামছিল সে। দুদিকে পাইন গাছের সারির মধ্যে দিয়ে বাঁধানো রাস্তা। দুপাশে পড়ে রয়েছে শুকনো পাইন কোণ। দূরে কিংবা তেমন দূরে নয় হয়ত, একটা মন্দির থেকে ঘন্টার আওয়াজ ভেসে আসছে। একটু একটু কুয়াশা। এসব এত ভালোবাসে নীলাক্ষী! বাবা-মায়ের সঙ্গে রীতিমত ঝগড়া করে এই চাকরিটা নিয়ে এখানে চলে আসা তার একটুও ভুল হয়নি দেখা যাচ্ছে। সামনের এই চুলের কাঁটার মত বাঁকটা কিন্তু বিপজ্জনক। পাহাড়ের গা থেকে একটা জলের ধারা ঠিক এইখানে রাস্তার উপর দিয়ে বয়ে গিয়ে খাদের মধ্যে পড়েছে। শ্যাওলা হয়ে আছে আর অসংখ্য ছোট্ট ছোট্ট নুড়ি-পাথর। খুব সাবধানে পা ফেলতে হয়। বর্ষার সময় খুব সম্ভবত এটা একটা ছোট নালা হয়ে যায়। বাঁকটা ঘুরতেই রাস্তার পাশে এক বুড়ি গরম গরম মোমো বিক্রী করছে। অমনি গনগনে খিদে পেয়ে গেল নীলাক্ষীর। খেতে খেতে বুড়ি একঝুড়ি গল্প করল। বুড়ি আগে ভুট্টা বিক্রী করত নীচে। কিন্তু এখন অতটা আর নামা-ওঠা করতে পারেনা বলে এখানে মোমো বিক্রী করে। এই জায়গাটায় পাহাড়ের অনেকটা দেখা যায়। সরকার থেকে তাই বসার জায়গা করে দিয়েছে। ট্যুরিস্টরা সব বিকেলবেলা বেড়াতে আসে। যদিও সন্ধে হতেই এখন সব নীচে নেমে গেছে। আর এই পিছনের পায়ে চলা পথটা দিয়ে উঠে গেলেই একটা মন্দির পড়বে। খুব পুরনো। বুড়ি, বুড়ির দিদিমা, তার দিদিমা সব্বাই নাকি জন্ম থেকে দেখে আসছে। তারা সব এখানকার আদি বাসিন্দা। এইসব সাহেবী বাড়িঘর, ডাক্তারবাবুর বাংলো, সান্যালবাবুদের গ্রীনভিলা, বিশ্বাসদের রোজমেরী কটেজ এইসব তো এই সেদিন, বুড়ির ছোটছেলে জন্মাবার পর হল। কাল থেকে নীলাক্ষী বিশ্বাসদের বাড়িতে থাকতে আসছে শুনে বুড়ি কেমন অবাক হয়ে গেল।
“ও বাড়িতে তো কেউ থাকেনা তেমন! নীচে ভাল কিছু পেলেনা? চার্চের পাড়ায় তো অনেকে বাড়ি ভাড়া দেয়।”
“কেন দিদিমা...বিশ্বাসরা তো থাকেন। আর কাজের লোকও তো বোধহয় আছে।”
“ঐ তো সুনীল ড্রাইভার আর আরেকটা বৌ। সুনীল তো সারাদিন মদ খায়।”
এখানে, এই পাহাড় দেশে শীতের জন্য অনেকেই সন্ধের পর মদ খায়। এ আর এমন কি!
“এই বাড়িটায় কি কিছু সমস্যা আছে? বিশ্বাসরা কি লোক ভালো নয়?”
“তা তো বলিনি বাপু। কিন্তু এত উঁচুতে, একটেরে বাড়ি... কতটা হেঁটে নীচে যেতে হবে তোমায় প্রতিদিন--” বুড়ি মুখ বেঁকালো।
তা ঠিক। বাকি বাড়িগুলো সব ঝর্ণার বাঁকটার পরে। ঊপরের দিকটা একটু নির্জন। কিন্তু বুড়ি যেন কথা ঘুরিয়ে নিল। নীলাক্ষী আর কথা না বাড়িয়ে দাম মিটিয়ে এগিয়ে গেল। সন্ধেও হয়ে গেছে। আর তাছাড়া বুড়িটা যেন কেমন! শনের নুড়ির মত সাদা সাদা চুল আর কি খ্যানখ্যানে গলা। চোখগুলো বিড়ালের মত, অন্ধকারেও জ্বলছে। তবে বেশি ভেবে লাভ নেই। বাড়িটা এত সুন্দর! টাকাও অ্যাডভান্সড হয়ে গেছে। আর রাধিকাদি বিশ্বাসদের ভালো করে চেনে। সে একবাক্যে বলেছে এরা খাঁটি ভদ্রলোক।
মাসখানেক কেটে গেছে। রোজমেরী কটেজে দিব্যি আছে নীলাক্ষী। এই কয়েকদিনে মিসেস বিশ্বাস কথা বলে বলে তাকে ঝালাপালা করে দিয়েছেন। আর চারটে কথা বলেন তো পাঁচনম্বরটা মেয়ে অ্যানাকে নিয়ে। অ্যানার কিরকম গোলাপ ফুলের মত গায়ের রঙ, অ্যানা কত স্মার্ট, মেলবোর্নে অ্যানার কত বড় বাড়ি! বাপরে বাপ! কিন্ত নীলাক্ষী শেষ অব্দি বিরক্ত হতে পারে না। ভদ্রমহিলা এত সরল সাধাসিধে আর আন্তরিক টাইপ। গোলগাল, ফর্সা চেহারার মধ্যে একটা খুব মিষ্টি মা-মাসীমা ব্যাপার আছে। আর অসামান্য রান্না করেন!! ওনার তৈরি চিকেন গুলাশ, ক্যারামেল পুডিং, সসেজ ফ্রাই এমনকী ব্রেকফাস্টের কফিটার জন্যে অব্দি এই যাবতীয় একঘেয়ে বকবককে তুচ্ছ করা যায়। মিঃ বিশ্বাস আবার অন্যরকম। অনেক পড়াশোনা করেন, বাড়িতে বসে বসেই সারা পৃথিবীর কত যে ব্যাপারের খোঁজ রাখেন ঠিক নেই। ওনার সঙ্গে আড্ডা দেওয়াটা একটা দারুণ ব্যাপার। মাঝেমধ্যে পাশের বাংলোর ডাক্তারবাবু আর তাঁর স্ত্রী আসেন। ভারি মিশুকে দম্পতি। গ্রীনভিলার সান্যাল গিন্নীর সাথে তো আবার মিসেস বিশ্বাসের দারুণ ভাব। শুধু সান্ন্যাল গিন্নী এলেই দুটো কথা বলে নীলাক্ষী নিজের ঘরে গিয়ে কানে হেডফোন গুঁজে নেয়। কারণ মিসেস বিশ্বাসের অ্যানা আর ওদিকে সান্ন্যালের ছেলে... বিদেশে কে কত গুছিয়ে আছে তার তুলনামূলক আলোচনায় তার কোন আগ্রহ নেই। তবে সবকিছু মিলিয়ে এত ভালো কাটছিল দিনগুলো, নীলাক্ষীর আর কোয়ার্টারে ফিরে যাওয়ার কোন ইচ্ছাই থাকল না।
প্রথম ঘটনাটা ঘটল একদিন রাত্রিবেলা। সেদিনটা ছিল একটা তুমুল বৃষ্টি, কুয়াশা আর মেঘের দিন। স্কুল থেকে কাকভেজা হয়ে ফিরল নীলাক্ষী। পাহাড়ি বৃষ্টি যেন গায়ে ছুঁচের মত ফোটে। তাড়াতাড়ি খেয়ে সবাই যে যার মত শুয়ে পড়েছে। সে বিছানায় আধ-শোয়া একটা বই পড়ছিল। ঘুমিয়ে পড়েছিল বোধহয়, হঠাৎ চটকা ভেঙে জেগে উঠে মনে হল বাড়িটা বড় বেশি নিস্তব্ধ। অন্যদিন এইসময় ডিনারের পর মিসেস বিশ্বাস ড্রয়িংরুমে বসে এটাসেটা বকবক করেন। দূরে রান্নাঘর থেকে বাসন ধোওয়ার টুং-টাং আওয়াজ পাওয়া যায়, কাঠের মেঝেতে হুইলচেয়ারের শব্দ। সব নিজের বিছানায় বসে বই পড়তে পড়তে টের পায় নীলাক্ষী। আর তারমধ্যেই কখন জানি ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু আজ কিচ্ছু নেই। শুধু একটানা একঘেয়ে বৃষ্টির শব্দ ছাড়া। বাড়িটা যেন থমকে গেছে। ঘরে একটা বেডসাইড ল্যাম্প জ্বলছে শুধু। আর তার মৃদু হলুদ আলোতে মনে হচ্ছে এই ঘর তার সমস্ত পুরনো দিনের ফার্নিচার, পুরনো দিনের ছবি, ঢালু কাঠের ছাদ, কাঁচের জানলার শার্সিতে বৃষ্টির গড়িয়ে পড়া জলের ধারা আর যাবতীয় আলো-আঁধারি নিয়ে ফিরে গেছে কোন একটা ফেলে আসা সময়ে। সব কিছু এত অচেনা লাগছে কেন! চোখের সামনে একমুহূর্তের জন্য যেন অন্ধকার হয়ে গেল। আর তারপরেই তার শিরদাঁড়া বেয়ে বয়ে গেল একটা ঠান্ডা স্রোত। সে স্পষ্ট দেখতে পেল পড়ার টেবিলে রাখা অ্যাশট্রে থেকে সিগারেটের ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে মিশে যাচ্ছে ঘরের মধ্যে। পাশে একটা কফিকাপ। একটা ছেলে। ২৩-২৪ বছর বয়েস, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, কানে একটা স্টাড, পরনে টী-শার্ট আর ট্রাউজার। তার আলমারী খুলে একটা ব্যাগের মধ্যে যেমন-তেমন ভাবে জামাকাপড় ঢোকাচ্ছে। কিন্তু, কিন্তু জামাকাপড়গুলো তো একটাও তার নয়। এই ঘরের কোনকিছুই তো তার নয়! পর্দার রঙ কখন আলাদা হয়ে গেছে। টেবিলে চীনামাটির ভাসটা আর নেই, ল্যাম্পশেডগুলো অন্যরকম। এমনকি, এমনকি যে কম্বলটা সে গায়ে দিয়ে আছে, যে বালিশটা পড়ে আছে পাশে, সেটাও আলাদা। এরকম সুতোর কাজ করা ফ্রিল দেওয়া ঢাকনা তো তার বালিশের ছিলনা! নীলাক্ষী ধড়মড় করে উঠে বসল। আতঙ্কে তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। চিৎকার করতে চাইছে, কিন্তু গলা দিয়ে কোন স্বর বেরোচ্ছে না। ছেলেটার কিন্ত কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। সে একটা টাকার বান্ডিল হাতে নিয়ে গুনছে। আলমারীর তাকের তলা থেকে আরো কতগুলো বান্ডিল বার করল। তারপর ব্যাগে জামার মধ্যে জড়িয়ে নিল। নীলাক্ষী কি উঠে গিয়ে বড় লাইটটা জ্বালাতে পারবে? কিন্তু, কিন্তু তার তো একটা আঙ্গুল নাড়ানোরও ক্ষমতা নেই। ছেলেটা খুব চিন্তিত মুখে সিগারেট ঠোঁটে দিয়ে বসল চেয়ারে। কফিতে চুমুক দিল। তারপর একটা ধোঁয়ার রিং ছেড়ে সোজাসুজি তাকাল নীলাক্ষীর দিকে। তার ধূসর বাদামী চোখ একটা চাপা আনন্দে জ্বলজ্বল করছে। নীলাক্ষীর শ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। হাত-পা শক্ত। গলা দিয়ে বোধহয় আর কোনদিন কোন আওয়াজ বেরোবে না। সেও একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ছেলেটার দিকে। কতক্ষণ, কতক্ষণ যে এভাবে কাটল কে জানে। আস্তে আস্তে ছবিটা ফ্যাকাশে হতে শুরু করল। ফ্যাকাশে হতে হতে একটা মরা হলুদ রঙ নিয়ে মিশে গেল ল্যাম্পের হলুদ আলোটার মধ্যে। নীলাক্ষী এলিয়ে পড়ে গেল।
পোস্ট-কগনিশন। অতীতের কোন ঘটনা হুবহু চোখের সামনে রিওয়াইন্ড করা। সবসময় না, কখনো-কখনো, কদাচিৎ। সব জায়গাতেও না। কোন পুরনো বাড়ি, কোন পুরনো জায়গা। এমন কিছু পরিবেশ যা ঐ স্থান-কালের মুহূর্তটাকে আবার জাগিয়ে তোলে। সবার জন্যেও না। কেউ কেউ দেখতে পায়। কেউ কোনদিন পায় না।
সকালেও নীলাক্ষীর বুকটা ধকধক করছে। যখন তার জ্ঞান ফেরে তখন ভোরের আলো ফুটে গিয়েছে। ভয়ে-আতঙ্কে ভেতরটা নীল হয়ে আছে। এইজন্যেই, এইজন্যেই কি বুড়িটা বারণ করেছিল তাকে? তার অনেক পড়াশোনার মাঝে পোস্ট-কগনিশন ব্যাপারটা পড়েছে সে। কিন্তু গাল-গল্প মনে হয়েছিল তখন। তাহলে সত্যিই কি এরকম হয়? কোন কোন বাড়ি, তার ইঁট-কাঠ-পাথরের দেওয়াল আর মেঝে আর তার মধ্যে বদ্ধ হয়ে যাওয়া সময় কি ধরে রাখে ধূসর অতীতের খুব গভীর কোন আবেগ, কোন মর্মান্তিক ঘটনা?
ব্রেকফাস্টে কোনরকমে একটু টোস্ট আর কফি খেয়ে মিসেস বিশ্বাসকে যা হোক কিছু একটা বলে তাড়াতাড়ি স্কুলে জন্য বেরিয়ে গেল সে। তার একটু সময় দরকার। ভেতরটা এখনো থরথর করে কাঁপছে। আগে ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে হবে। মিসেস বিশ্বাসকে জিগ্যেস করতে হবে। তবে সবচেয়ে আগে দরকার নিজেকে একটু সাব্যস্ত করা। পাইন বনের মধ্যে একটা পরিষ্কার বাঁধানো জায়গা আছে। খুব শান্ত আর স্নিগ্ধ। নির্জন। সেখানে বসে খুব গভীরভাবে ভাবল নীলাক্ষী। তার একটা বেশ ঝকঝকে বিশ্লেষণধর্মী মন আছে। একটা ছেলে, ঐ ঘরটায় কোন এককালে থাকত, সে কোথাও যাবে বলে ব্যাগ গোছগাছ করছে। ছেলেটা চিন্তিত। কারণ তার কাছে অনেক টাকা। কবেকার ঘটনা এটা? মনে হচ্ছে বহু আগের। পুরনো কালের ব্যাগিস ফ্যাশনের টি-সার্ট, চুলের ছাঁট, ফ্রিল দেওয়া বালিশের ঢাকনা, আলমারীর বার্নিশটা অনেক বেশি চকচকে। অন্তত পঁচিশ বছর আগের। কিন্তু ঘটনাটা তো এমন কিছু অসাধারণ নয়। তাহলে তার ছাপ কেন রয়ে যাবে স্থান ও কালের ফ্রেমে? কেনই বা হঠাৎ করে সেই ছাপ আবার জেগে উঠবে? এই ঘরে আগে যারা পেয়িং গেস্ট ছিল, তারা কি দেখেছে কিছু কখনো? নাকি নীলাক্ষীই শুধু? আর ওই বুড়িটা...বুড়িটা কি আগে থেকেই জানত? ওই ঘরে আর কি নীলাক্ষী থাকতে পারবে?
সেদিন স্কুলে বসে অফ পিরিয়ডে পোস্ট-কগনিশন নিয়ে নেটে অনেক পড়াশোনা করল নীলাক্ষী। কোন কোন খুব গভীর অনুভূতি বা আবেগের ঘটনা তার চারপাশের পরিবেশে একটা তীব্র আলোড়ন তৈরি করে। আর কখন কিভাবে জানি সেই আলোড়নের একটা অংশ পরিবেশে চিত্রিত হয়ে যায়। এইবার ওই আলোড়নের কম্পাঙ্কের সাথে যদি কোন মানুষের মনের কম্পাঙ্ক কোন ভাবে টিউনড হয়ে যায়, অনুরণনের মাধম্যে ওই অজ্ঞাত অতীত তার কাছে আবার ফিরে আসে। আমাদের এই চেনাশোনা জগতের মধ্যেই আর একটা রহস্যময় জগৎ। মাঝেমধ্যে তার সাথে এই জগতের একটা অপ্রাকৃত সমাপতন ঘটে যায়। অ্যানি মোবার্লি আর এলেনর জর্দোঁর অদ্ভুত ঘটনাটার কথাই ধরা যাক। এই দুই প্রৌঢ় শিক্ষিকা ১৯০১ সালের আগস্ট মাসে ফ্রান্সের বিখ্যাত ভার্সেই দুর্গ বেড়াতে গিয়েছিলেন। দুর্গের মধ্যেই আছে ইতিহাসবিশ্রুত রানী মেরী আঁতোয়েনের ব্যক্তিগত প্রাসাদ। সেটি দেখার জন্য তাঁরা বাগানের মধ্যে দিয়ে রওনা দিলেন এবং রাস্তা হারিয়ে ফেললেন। অনেক কষ্টে তাঁরা যখন বাইরে বেরোবার পথ খুঁজছেন তাদের মনে হল আশেপাশের পরিবেশ বদলে গেছে। হাওয়া দিচ্ছে কিন্তু গাছের পাতা নড়ছেনা, আকাশে সূর্য আছে কিন্ত বাগানের মধ্যে আলোছায়ার কোন খেলা নেই। একটা কটেজের দরজায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক নারী ও বালিকা। নারীটির হাতে একটা জলের জাগ। একজায়গায় বসে আছেন এক বৃদ্ধ, তার মুখে গুটিবসন্তের দাগ, পরনে কালো ক্লোক আর মাথায় টুপি। বৃদ্ধ তাদের দিকে তাকিয়ে আছেন কিন্তু তাদের দেখতে পাচ্ছেন না। সবকিছুই যেন ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতন। একটা ব্রীজ পেরিয়ে তারা পৌঁছলেন প্রাসাদের মূল অংশে। রাজকীয় বাগানে এক সুন্দরী মহিলা তাদের দিকে অলস দৃষ্টিতে ফিরে তাকালেন। সোনালী চুল, হালকা রঙের গরমের পোশাক, মাথায় সাদা হ্যাট। রানী মেরী আতোঁয়েন। পরে মোবার্লি বলেছিলেন তাদের মনে হচ্ছিল তারা যেন একটি জীবন্ত চিত্রের মধ্যে হারিয়ে গেছেন। কিন্তু আর কিছুতেই বেরোবার পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। পরে আবার তাঁরা গিয়েছিলেন সেই জায়গায়। কিন্তু সেই কটেজ, সেই ব্রীজ, বাগানের সেই লেনগুলি, সেই বিশেষভাবে ছাঁটা গাছ...তারা আর কিছুই খুঁজে পাননি। খুব সম্ভবত সেইদিন কোনভাবে তাঁরা চলে গিয়েছিলেন অষ্টাদশ শতকের স্থান ও কালের সেই বিন্দুতে যার বছরখানেক পরেই রানী মেরী আঁতোয়েন গিলোটিনে নৃশংসভাবে নিহত হন ।
গা ছমছম করে উঠল নীলাক্ষীর। জীবন্ত চিত্র! যদি এরকম একটা চিত্রের মধ্যে সে ও হারিয়ে যায় আর...আর বেরিয়ে আসতে না পারে!
একসপ্তাহ কেটেছে তারপর। নীলাক্ষী যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে। সেদিন একটু তাড়াতাড়ি ফিরেছে সে। বিশ্বাস দম্পতি বাড়িতে নেই। অদ্ভুত সুন্দর একটা বিকেল। এক পশলা বৃষ্টির পর কাছের পাহাড়গুলো আরো সবুজ আর দূরের পাহাড়গুলো আরো নীল দেখাচ্ছে। আকাশের রঙ লালচে-কমলা। সবুজ কাঠের গেটটা খুলে বাড়ির পিছনের লনে গেল সে। কাজের বউটা বোধহয় রান্নাঘরে, বাসন মাজা আর কল খোলার শব্দ হচ্ছে। গাছের পাতা থেকে টপটপ করে জল পড়ছে। পথের দুপাশে পড়ে আছে ঝরে যাওয়া সাদা সাদা ফুল আর পাতা। বিড়ালটা পাঁচিলের উপর বসে ছিল, নীলাক্ষীকে দেখে ল্যাজটা গুটিয়ে আরো জড়ামড়ি করে বসল। তার সবুজ চোখ একবার নিভে গিয়েই আবার দপ করে জ্বলে উঠল। কিছুক্ষণ নীলাক্ষীর দিকে তাকিয়ে থেকে সে ঘাড় ঘোরালো পাঁচিলের পাশে লতানে ঝাড়টার দিকে। তার দেখাদেখি নীলাক্ষীও তাকালো। ঝাড়ের সামনে লনের উপর একটা ছেলে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। ঝাঁকড়া চুল, কানে স্টাড। সেই একই পোশাক পরা। ছেলেটার গলায় আমূল বেঁধানো একটা ছোরা। কালচে-লাল রক্ত ক্ষত থেকে নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়ছে, মিশে যাচ্ছে সবুজ ঘাসের মধ্যে, মাটির মধ্যে। কোথাও কোন সাড়া-শব্দ নেই। প্রকৃতি থমকে গেছে। সময় স্তব্ধ হয়ে গেছে। জীবন্ত চিত্র। নীলাক্ষী একটা হোঁচট খেতে গিয়ে কোনরকমে সামলে নিল। শক্ত হাতে ধরে আছে পাঁচিলটা। থরথর করে কাঁপছে। আস্তে আস্তে অন্ধকার নেমে এল। দৃশ্যটা আবছা হতে হতে ফিরে চলে গেল। বিড়ালটা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে লাফ দিয়ে চলে গেল পাঁচিলের ওপারে। নীলাক্ষী ঘরে ফিরে এল কোনরকমে আর কাঁপতে কাঁপতে হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ল বিছানার মধ্যে।
পরেরদিন মিসেস বিশ্বাসকে জিজ্ঞেস করতে হল। কিন্ত অন্যভাবে। বাগানে মালীর সাথে কিসব বকবক করছিলেন ভদ্রমহিলা। একটা ঝাঁকড়া চুল ছেলের এই বাড়িতে পেয়িং গেস্ট থাকার কথা কিছুই মনে করতে পারলেন না। কিছুক্ষণ এটা-সেটা বলে নীলাক্ষী স্কুলে চলে গেল। পাঁচিলের উপর গাবদা বিড়ালটা একইরকমভাবে বসে আছে। বিড়ালটা অদ্ভুত। বিড়ালটাও কি দেখতে পায়? নীলাক্ষীর মনে হল বিড়ালটাকে কোনদিন ডাকতে বা খেতে বা ঘুমাতে দেখেনি সে।
পরেরদিন বিকেলে পাকদণ্ডীটা বেয়ে বাড়ি ফিরছিল সে।
“মেয়ে...ও মেয়ে...তুমি এখনো ঐ বাড়িতে আছ?”
খ্যানখ্যানে গলাটা শুনে চমকে তাকাল নীলাক্ষী। সেই মোমো-বিক্রী করা বুড়ি। চুলগুলো কি আরো সাদা হয়ে গিয়েছে!
“এতদিন কোথায় ছিলে দিদিমা? আর দেখতেই পাই না।”
“আমি কিন্তু তোমায় রোজ দেখি মেয়ে...সকাল বিকেল...যাও...আস...” বুড়ির চোখে ঝিলিক দিয়ে উঠল।
“এই জায়গার সব খবর তুমি রাখ, না দিদিমা? অনেকদিন আগে একটা ঝাঁকড়াচুল ছেলে, কানে দুল পরা থাকত কি এখানে...চেন তুমি?”
বুড়ি মুখঝামটা দিয়ে উঠল।
“চিনিনা আবার? ওই বিশ্বাসের ভাইপো, ক্রিস। পাজির পাঝাড়া একটা ছেলে। আমার নাতনীর পিছনে ঘুরঘুর করত। একদিন কুকুর লেলিয়ে দিয়েছিলাম।”
বুড়ির বলার ধরনে হেসে ফেলল নীলাক্ষী।
“এখন সে আর এখানে থাকেনা? কোথায় থাকে?”
“কোথায় থাকে আমি কি করে জানব? কলকাতা চলে গেছে। কিংবা জেলের ঘানি টানছে...কিছু একটা...কিংবা দেখ মরে-টরে গেছে এদ্দিনে--”
নীলাক্ষীর চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা কালচে-লাল রক্তধারা। নিঃশব্দে মিশে যাচ্ছে সবুজ ঘাস আর নরম মাটির মধ্যে। তাহলে ছেলেটার নাম ক্রিস।
কি অদ্ভুত এই মিসেস বিশ্বাস! এদিকে এত কথা বলেন...কই ক্রিসের কথা কোনদিন উল্লেখ অব্দি করেরনি তো! নীলাক্ষী ভেবে অবাক হয়ে গেল।
“ক্রিসের কথা তুমি কি করে জানলে নীলাক্ষী?”
মিসেস বিশ্বাস কি একটু বিরক্ত হলেন!
“একটা ভ্যাগাবন্ড ছেলে। ওর মা মারা যাওয়ার পর কিচ্ছু হচ্ছেনা দেখে মিঃ বিশ্বাস এখানে এনে ওকে হোটেলে ঢোকালেন। কিছুদিন কাজ করল। কিছু টাকা ওড়ালো। তারপর একদিন কি হল...নাকি কলকাতা ছাড়া সে থাকতে পারছেনা এই বলে আবার ফেরত চলে গেল। জানো, ছোটবেলায় বাবা মারা গেছে, মা কোনরকমে মানুষ করেছে। মিঃ বিশ্বাস প্রতি মাসে টাকা পাঠাতেন, এছাড়া স্কুল-কলেজের খরচ, ক্রীসমাসে নতুন জামা, জুতো...সব। কোথায় কি! একটা কাজের চেষ্টা করবে...তা না...”
“এখন সে কোথায়?”
“বললাম না কলকাতা ফিরে গেছে। আমরাও আর খবর নিইনি। যতদিন ওর মা বেঁচে ছিল, ফোনে কথা হত ডোরার সাথে। এখন তো আর সেও নেই। একদিন রাতে ডিনারের সময় বলল কাল কলকাতা চলে যাচ্ছি। গুড নাইট। গুড বাই। তারপরে ভোর না হতেই চলে গেল। যাওয়ার সময় একবার দেখা অব্দি করলনা আমাদের সাথে। এত অকৃতজ্ঞ। ভাবো, তারপরে পরেই মিঃ বিশ্বাসের অ্যাক্সিডেন্টটা হল, উনি মরতে মরতে বেঁচে গেলেন, একবার খবর অব্দি নেয়নি আমাদের। সেই থেকে আমরাও আর ওর কথা ভাবি না।”
এক নিঃশ্বাসে সবটা বলে রাগের চোটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন ভদ্রমহিলা। পিছন ফিরতেই চোখাচুখি হয়ে গেল মিঃ বিশ্বাসের সাথে। ভদ্রলোক কখন যেন বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন।
“অলিভিয়া ক্রিসের নাম অব্দি সহ্য করতে পারে না।” ম্লান হেসে বললেন ভদ্রলোক।
“আসলে ক্রিস যখন ছোট আমার দাদা একটা অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। শাসনের অভাবে ও বখে গিয়েছিল। আমরা চেষ্টা করেছিলাম ওকে একটা ভালো জীবন দেওয়ার, কিন্ত ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল। এখানে এসেও স্বভাব শুধরাতে পারেনি ও। অলিভিয়া ওকে খুব স্নেহ করত কিন্তু ওর জন্য অনেক অপমান সইতে হয়েছে ওকে পাড়া-প্রতিবেশির কাছে। এখন যে ছেলেটা কি করে, কোথায় থাকে...কিছুই জানি না।”
এইসব নিয়ে মাথা না ঘামালেই হয়। কিন্তু তাহলেও অতীত ছাড়বে না। অতীত পাপের ছায়া বড় দীর্ঘ হয়। আর কারোর অতীত পাপের স্মৃতি এই বাড়িটা রেকর্ডারের মত ধরে রেখেছে। কি যেন বাড়িটার নাম? রোজমেরী...রোজমেরী কটেজ। রোজমেরী ফর রিমেমব্রান্স। আগাথা ক্রিস্টীর একটা উপন্যাসে প্রথম পড়েছিল নীলাক্ষী। ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ডে ফুলের একটা গোপন আলাদা ভাষা ছিল। এক একটা অনুভূতির জন্য এক একটা ফুল আর তার এক একটা বিশেষ রঙ। লাল গোলাপ গভীর আবেগের, হলুদ বন্ধুত্ব, সাদা ডেইজী মানে আবার নিষ্পাপ পবিত্রতা, ক্রিসেনথিমাম আনন্দ, ভায়োলেট বিশ্বস্ততা আর আনুগত্য আর রোজমেরী? রোজমেরী ফর রিমেমব্রান্স। আগেকারদিনে ইউরোপে যুদ্ধের সময়ে মৃত প্রিয়জনের সমাধিতে রোজমেরী ফুল দেওয়ার প্রথা ছিল। কারণ...রোজমেরী মনে রাখে মৃতকে, হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিকে। কোন সাহেব কোনকালে কার কথা মনে করে এই বাড়িটা তৈরি করেছিল, কে জানে!
পাইন গাছের বনের মধ্যে বাঁধানো জায়গাটাই বসেছিল নীলাক্ষী। দুপুরের নরম রোদ্দুর আলো-আঁধারির খেলা খেলছে। এদিক-ওদিক আরো কতগুলো তথ্য পেয়েছে সে। ক্রিসের হাতে বেশ কাঁচা টাকা ছিল। রাতের দিকে মদ আর জুয়ার আড্ডায় দেখা যেত তাকে। তবে এখানে এই শান্ত শহরে তার আর মন বসছিল না। কলকাতায় ফেরার জন্য ছটপট করছিল সে।
“তুমি এখানে বসে আছ মেয়ে?”
“এমনি...জায়গাটা বেশ ভালো লাগছে। তুমি কোথায় যাচ্ছ দিদিমা? তোমার বাড়ি কি এদিকে?”
একবোঝা শুকনো কাঠ পিঠে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল বুড়ি। নীলাক্ষীর কথায় একটা পাথরের উপর বসে পড়ল।
“মোটা আর গালফোলা হয়ে যাচ্ছ। বিশ্বাসগিন্নী খুব খাওয়াচ্ছে মনে হচ্ছে।”
“তুমি ওনাকে দেখতে পারোনা কেন বলত দিদিমা? উনি কিন্তু দারুণ রান্না করেন, জানো?”
“খুব জানি। তা কার থেকে শিখেছে?”
“কার থেকে?”
“কার থেকে আবার? ঝড়ুর মা। এককালে ঐ বাড়িতে রাঁধুনী ছিল সে। সারাদিন বিশ্বাসগিন্নীর মোসাহেবী করত। ঝড়ুর মা মরে যেতে মেমসাহেব এখন রান্নাঘরে ঢুকছেন ।”
“ঝড়ুর মা আবার মরে গেল কেন? অনেক বয়েস হয়েছিল বুঝি?”
“বয়েস তো হয়েইছিল। ঐজন্যই তো টাল সামলাতে না পেরে গড়িয়ে পড়ে গেল।”
“সে কি!!! কিকরে!!”
“কি করে আমি কি করে জানব?” খেঁকিয়ে উঠল বুড়ি।
“ঐ ঝোরার ওখানে খাদের মধ্যে পিছলে পড়ে গিয়েছিল। সেই রাতে যা বৃষ্টি আর কুয়াশা। পরেরদিন বিকেলে লাশ পাওয়া যায়। মাথা ফেটে ঘিলু বেরিয়ে পড়েছিল।”
“এটা কবেকার ঘটনা?”
“অত সাল-তারিখ আমি বলতে পারবনা বাপু। তবে যে বছর বিশ্বাসের গাড়ি গাছে ধাক্কা মারল, সেই বছর। তার কয়েকমাস আগে।”
“ওই অ্যাক্সিডেন্টেই উনি পঙ্গু হয়ে যান, না?”
“মরে যাওয়ারই কথা ছিল। কি করে যে বাঁচল!”
মিঃ বিশ্বাস বেঁচে গেছে বলে বুড়ি যেন খুব দুঃখ পেয়েছে। নীলাক্ষী লক্ষ্য করেছে এই সাতকাল গিয়ে এককালে ঠেকা বুড়ি অন্য লোকের দুঃখ-দুর্দশা খুব উপভোগ করে। একটু আগে ঝড়ুর মায়ের দুর্ঘটনাটা কেমন রসিয়ে রসিয়ে বলল। যেন ও নিজের চোখে দেখেছে।
“আচ্ছা, দিদিমা ক্রিসের কি কারোর সাথে ঝগড়া ছিল?”
“কারোর সাথে! সবার সাথে। একমাত্র ওই বিশ্বাসগিন্নী বদমাশটাকে বাবা-বাছা করত। আদিখ্যেতা!”
নীলাক্ষী আগেরদিনে মিসেস বিশ্বাসের তীব্র অভিমানের জায়গাটা ধরতে পারল এবার।
“ওদের ঐ ড্রাইভারটাকে দেখেছ, সুনীল? ওই দেখ এদিকেই আসছে। মনে হয় ও তোমার উপর নজর রাখে। সারাদিন মদ খায় আর লাল লাল চোখ।”
“কেন, নজর রাখবে কেন?”
“তা আমি কি জানি। তবে ঝড়ুর মা বলত ও পারেনা এমন কোন কাজ নেই। আর ভীষণ মিথ্যুক।”
“তুমি তো দেখছি কাউকেই দেখতে পারনা দিদিমা। ঝড়ুর মায়ের সাথেও তোমার ঝগড়া ছিল, তাই না?” হাসতে হাসতে বলল নীলাক্ষী। বুড়ি রেগে গিয়ে গটগট করে হেঁটে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল।
সুনীল ড্রাইভার সত্যি এদিকেই আসছে। লোকটা অবশ্য কোনদিন কোন খারাপ ব্যবহার করেনি নীলাক্ষীর সাথে। চুপচাপ নিজের কাজ নিয়ে থাকে। তবে সত্যিই খুব বেশি মদ খায়।
“দিদিভাই মেমসাহেব আপনাকে ডাকছেন। বাগানে চা দেওয়া হয়েছে।”
ডিনারের পর অস্বস্তিটা যেন বেড়েই চলেছে। আজকে সান্যালরা এসেছিল। ডাক্তারবাবুরাও। অনেক আড্ডা হল। নীলাক্ষী অনেক কিছু বলতে চেয়েও শেষে আর কিছুই বলতে পারল না। মিসেস বিশ্বাস ডেজার্টে একটা অপূর্ব প্লাম পুডিং বানিয়েছিলেন। কি যেন একটা টিকটিক করছে মনের মধ্যে। এই বাড়িতে, এই লনে একটা খুন হয়ে গেছে আর তারা সবাই কি স্বাভাবিকভাবে পুডিং খাচ্ছে। কিন্তু, এই বাড়িটা স্বাভাবিক নেই। এই পালিশ করা কাঠের মেঝে, ঝকঝকে দেওয়াল, কাঁচের জানলা, সবুজ লন...এই সবকিছুর মধ্যে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে লুকিয়ে আছে, মিশে আছে সেই অজ্ঞাত, অপ্রাকৃত জগতের সীমা না। জানেনা, নীলাক্ষী জানেনা, কখন, কোন মুহূর্তে, কোথায় সেই অন্য জগতের সীমানার মধ্যে পা ফেলে দেবে সে। একটা অজানা, অচেনা ভয় এখন সবসময় তার অবচেতনে ঘোরাফেরা করে। সবকিছুই যেন যা দেখছে শুধু তাই নয়। আরো অব্যক্ত কিছু।
সেদিন রাত্রে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল সে। একটা স্টেজের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে। কিছু একটা অভিনয় চলছে। পিছনে গাঢ় লাল ভেলভেটের পর্দা। সে অভিনয়ের মধ্যে দিয়েই পর্দাটা ঠেলে পিছনে ঢুকে গেল। কেউ তাকে দেখল না। কেউ তার দিকে তাকালো না। পর্দার পিছনে আরেকটা স্টেজ। সেখানেও কিছু একটা হচ্ছে। তার পিছনেও গাঢ় লাল ভেলভেটের পর্দা। সে এই পর্দাটাও ঠেলে ঢুকে গেল। এখানেও কেউ তাকে দেখল না। তারপরে আরেকটা স্টেজ, আরেকটা পর্দা। তারপরে আরেকটা, একটার পর একটা। নীলাক্ষী পাগলের মত পর্দা ঠেলে ঢুকে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে সে এই ভুবনে আটকা পড়ে গেছে। আর কোনদিন বেরোতে পারবে না। আতঙ্কে তার মন আচ্ছণ্ণ হয়ে আসছে। সে মরিয়া হয়ে পর্দার পর পর্দা পেরিয়ে ছুটছে। কিন্তু এর যেন শেষ নেই। আর তার মুক্তি নেই। আচমকা দৃশ্যপট বদলে গেল। সবুজ লন, লতানে গাছে বেগুণী ফুল হাওয়ায় দুলছে, খাদের পাশে পাঁচিল, দূরে নীল পাহাড়। লনে পড়ে আছে একটা মৃতদেহ। পাঁচিলের উপর গেটের পাশে বিড়ালটা বসে। কিন্ত তার পিছনে আবার একটা লাল ভেলভেটের পর্দা। নীলাক্ষী পর্দাটা সরিয়ে দিল। আরেকটা সবুজ লন, আরেকটা মৃতদেহ, আরেকটা পাঁচিল, আরেকটা গেট। কিন্তু বিড়ালটা নেই। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে একটা চাদর মুড়ি দেওয়া বয়স্ক মহিলা। চাদরের আড়ালে শুধু তার চোখদুটো দেখা যাচ্ছে। বিস্ফারিত, আতঙ্কিত।
ঝড়ুর মা! ধড়মড় করে ঘুম ভেঙে উঠে বসল নীলাক্ষী। ঝড়ুর মা।
এরপর অনেকটা সময় লাগল তার হৃদস্পন্দনকে স্বাভাবিক করতে। নীচে যখন নামল, জানলার বাইরে আলো ঝলমল করছে, পাখী ডাকছে। বেগুণী ফুলের লতাটা হাওয়ায় দুলছে। বিড়ালটা বসে আছে রান্নাঘরের জানলার তাকে। মিঃ বিশ্বাস সকালের নরম রোদে বসে কাগজ পড়ছেন। কি শান্তিপূর্ণ অথচ কি বিপজ্জনক এই সৌন্দর্য! কত ঊজ্জ্বল অথচ কত ধূসর রহস্যময়! বিড়ালটা গায়ে মুখ ঘসছে। আলগোছে ওর মাথায় হাত বুলাল নীলাক্ষী। পিছনের লোহার গেটের কাছে দাঁড়িয়ে কি একটা করছিল সুনীল। এখন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এই দিকে। যেই নীলাক্ষী তাকাল অমনি চোখ সরিয়ে নিল।
সুনীল কি সত্যি তাকে নজরে রাখছে? নিজে রাখছে নাকি কারোর আদেশ পালন করছে মাত্র? কার? নীলাক্ষী লক্ষ্য করেছে সুনীলের মিঃ বিশ্বাসের প্রতি একটা প্রশ্নহীন আনুগত্য আছে।
“সুনীলদা আপনি কতদিন গাড়ি চালাচ্ছেন এখানে?”
মুখ তুলে নীলাক্ষীকে একবার দেখে নিল সুনীল। বাড়ির সামনে গাড়ি ধুচ্ছিল সে।
“সে অনেকদিন।”
“মিঃ বিশ্বাসের অ্যাক্সিডেন্টটা কিভাবে হয়েছিল?”
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল সুনীল। তারপর প্রায় ফিসফিস করে বলতে শুরু করল।
“সন্ধেবেলা ছিল। কোন বাদলা নেই, কুয়াশা নেই। আমি সাহেবকে একটা পার্টিতে নিয়ে যাচ্ছিলাম। যেই ঐ বাঁকটা ঘুরলাম, কোথা থেকে বুড়িটা খাদ থেকে উঠে সামনে চলে এল। মাথাটা থেঁতলে গেছে, রক্ত পড়ছে। ঝড়ুর মা। আমি আতঙ্কে ব্রেকে প্রাণপণে চাপ দিলাম। কিন্তু থামাতে পারলাম না। সোজা ধাক্কা মারলাম গাছে। সাহেব ছিটকে পড়ে গেলেন। কিন্তু বুড়িটা বেবাক হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। সাহেবের বাঁচার কথা ছিল না। আমারও না। কেউ বিশ্বাস করল না। সবাই বলল মরামানুষ কি আবার ফিরে আসে নাকি! আমিই মদ খেয়ে চালাচ্ছিলাম, এখন মিথ্যে কথা বলছি। শেষ অব্দি সাহেবের দয়ায় আমার চাকরি গেল না। কিন্তু এমনটা তো হওয়ারই কথা ছিল, তাই না দিদিভাই?” সুনীলের গলা আস্তে আস্তে নিভে এল।
“কেন এরকম বলছেন সুনীলদা?”
সুনীল অদ্ভুত চোখে তাকাল।
“ঝড়ুর মা মেমসাহেবের বড় পেয়ারের লোক ছিল। সারাদিন মেমসাহেবের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরত। সে তো ফিরে আসতেই পারে, তাই না? সে তো ফিরে আসবেই, তাই না?”
পাইনবনের মধ্যে থেকে শিরশিরে হাওয়া বয়ে আসছে। নীলাক্ষীর হঠাৎ করে খুব শীত করতে লাগল। গায়ে ভালো করে স্টোলটা জড়িয়ে নিল সে।
কাল পুজোর ছুটিতে বাড়ি চলে যাচ্ছে সে। আবার এখানে ফিরবে কিনা কে জানে! রহস্যটার কোন সমাধান হল না। ক্রিসকে খুন করার কোন যুক্তিগ্রাহ্য কারণ নেই বিশ্বাসদের। বাইরে কারোর সাথে ঝগড়াতে সে খুন হয়েছিল কিনা তাই বা কে জানে! কোন কিছুর কোন বাস্তব প্রমাণ নেই। এই বাড়িটাই তার একমাত্র সজীব সাক্ষী। কিন্তু নীলাক্ষীর অতিলৌকিক অভিজ্ঞতাতে কেউ বিশ্বাস করবে না। বৈজ্ঞানিকভাবে তো এইসব ঘটনার কোন স্বীকৃতি নেই। সেই বুড়িটা বোধহয় কিছু জানত। কিন্তু তাকে তো আজকাল আর দেখতেও পায় না। কতকিছু এলোমেলো ভাবছে নীলাক্ষী। নিজের ঘরে আরামকেদারায় বসে আছে সে। শীত পড়তে শুরু করেছে। বাইরে পাহাড়ের গায়ে একটা-দুটো আলো জ্বলে উঠছে। আস্তে আস্তে ঘরের রং বদলে যাচ্ছে। বিকেলের লালচে-কমলা থেকে সন্ধের ধূসর। পাখীদের কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে। খুব দূরে সেই মন্দিরটা থেকে ভেসে আসছে ঘন্টার ক্ষীণ শব্দ। অন্ধকার হয়ে গেছে। এবার লাইটটা জ্বালানো দরকার। কিন্তু নীলাক্ষী জ্বালানোর আগেই দপ করে লাইটটা জ্বলে উঠল। হালকা হলুদ আবছা আলো। অমনি সব শব্দ কোথায় হারিয়ে গেল। সময় থমকে গেল। একটা অস্বাভাবিক কিছু পরিবর্তন হয়ে গেল ঘরটার মধ্যে। নীলাক্ষীর শ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে, সারা শরীর শক্ত। সামনে কোথা থেকে একটা গদিতে মোড়া পুরনো কালের সোফা চলে এসেছে। তার পাশে একটা দাঁড়ানো ল্যাম্প। সেই ল্যাম্পের হলুদ আলোতে সোফাতে বসে খসখস করে কিছু একটা লিখছে ঝাঁকড়া চুল ছেলেটা। সোফার হাতলের উপরে রাখা একটা নীল, চ্যাপ্টা নোটবুকে। হাওয়ায় পাতাগুলো ফড়ফড় করে উড়ছে। একটা কিসের কাগজ নোটবুকটা থেকে ঊড়ে যাচ্ছিল। ছেলেটা খপ করে ধরে ফেলল। তারপর কাগজটা নোটবুকের মধ্যে যত্ন করে ঢুকিয়ে রেখে এসে দাঁড়ালো কাঁচের পাল্লা দেওয়া একটা আলমারীটার সামনে। হলুদ আলো যেমন দপ করে জ্বলেছিল, তেমনি ঠিক দপ করে আবার নিভে গেল। নীলাক্ষী সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে ঘরের সবকটা আলো ফটাফট জ্বালিয়ে দিয়ে হাঁফাতে লাগল।
কাঁচের পাল্লা দেওয়া কাঠের আলমারীটা এখনো এই ঘরেই আছে। তার মধ্যে রাখা সার সার বই। এই বইগুলো কিছু বিশ্বাসদের নয়। আগের মালিক বা তার আগের মালিকের...মোটকথা বাড়িটার সেই আদিকাল থেকে আছে। এরা কেউ বোধহয় খুলেও দেখেনি কোনদিন। পরপর চামড়ায় বাঁধানো রচনাবলী গোছের বই। একটার পর একটা টেনে বার করে দেখতে লাগল নীলাক্ষী। ভিক্টোরীয়ান যুগের কবিতা। নভেল। প্রার্থনাসঙ্গীত। একটা ব্রাউন চামড়ার মলাটের ভেতরে একটা নীল রঙের চৌকো ডায়েরী। ভেতরে পাতায় পাতায় কতগুলো জটিল হিসেব-নিকেশ করা। মাঝখানে পাতার ফাঁকে রাখা একটা পুরনো সাদা-কালো ছবি আর দুটো হলদে হয়ে যাওয়া ইংরাজী পেপার কাটিং। একটাতে বহুবছর আগে দেশের কোন এক দূরপ্রান্তে সরকারী ব্যাঙ্কে এক দুঃসাহসিক ডাকাতির খবর আর অন্যটায় সেই ডাকাতদেরই একজনের ট্রেন থেকে পড়ে মৃত্যু। ব্রিগাঞ্জা ব্রাদারস। পুলিশের সন্দেহ ভাইকে হত্যা করে অন্যজন সমস্ত টাকা-গয়না নিয়ে ফেরার। ছবিটা একটা বাচ্চার জন্মদিনের গ্রুপ ফটো। কেক কাটা হয়েছে, বছর পাঁচ-ছয়েকের বাচ্চাটিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে খুব সম্ভবত তার বাবা-মা। পাশে একজন বৃদ্ধা মহিলা আর একটা লম্বা ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওয়ালা লোক। অতীতের মিঃ বিশ্বাস। ছোট্ট ছেলেটা কে বুঝতে অসুবিধা হয় না। পিছনের দেওয়ালে রঙিন কাগজ দিয়ে লেখা হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার ক্রিস। ক্রিস। ক্রিসের বাবা-মা। ঠাকুমা। কাকা। সুখী পরিবার।
আরামকেদারাটায় ধপ করে বসে পড়ল নীলাক্ষী। সুখী পরিবার। আর তারপর ব্যাঙ্ক ডাকাতি। এক ভায়ের রহস্যময় মৃত্যু। আর তারপরে নাম-পরিচয় বদলে এই নির্জন পাহাড়ি শহরে মিঃ বিশ্বাসের ব্যবসা, হোটেল, বাড়ি-গাড়ি, নতুন জীবন। খুব সম্ভবত বিশ্বাস পদবীটাও এইজন্য নেওয়া যাতে চট করে কেউ কলকাতার অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পাড়ার সাথে যোগটা না বার করতে পারে। দিব্যি ছিলেন। ওদিকে রিপন স্ট্রীটে পড়ে রইল এক দুঃস্থ মা আর ছেলে। মাঝেমধ্যে, বোধহয় কিছু টাকা পাঠিয়ে দায়িত্ব সারতেন। তারপর একদিন ক্রিস বড় হল। পিতার শাসনের অভাবে বেয়াড়া, বখাটে। তার ঝাঁকড়া চুল আর আচ্ছন্ন চোখদুটো ভেসে উঠল নীলাক্ষীর মনে। মা মারা গেল। আর মায়ের কাগজপত্রের মধ্যে সে খুঁজে পেল এই কাটিং দুটো। আর বোধহয় কোন সূত্র। বিশ্বাসঘাতক জেঠাকে খুঁজে বার করল। এই বাড়িতে এসে ঘাঁটি গাড়ল। মিঃ বিশ্বাস বাধ্য হলেন তাকে ব্যবসায় ঢুকিয়ে দিতে। ক্রিস দুহাতে টাকা খরচ করতে লাগল। এই ছোট্ট শহরের লোকেরা তার অভব্যতায় বিরক্ত হয়ে উঠল। আর তারপর? তারপর একদিন নিঃশব্দে তার রক্ত মিশে যেতে থাকল লনের সবুজ ঘাস আর কালো মাটিতে। সবাই জানল সে কলকাতা ফিরে গেছে। তার বেহিসাবী, বখাটে জীবনে। কোন সস্তা হোটেলের ডান্স বারে। সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কেউ খোঁজ করল না। কেউ জানল না। শুধু একজন ছাড়া। ঝড়ুর মা। আর এই বাড়ি। বাড়ির ইঁট, কাঠ, দেওয়াল, কাঁচের জানলা, সবুজ ঘাস আর লোহার গেট। ঐ কালচে-লাল রক্তের সাথে সাথে সমস্ত অতীত ঐ কালো মাটিতে মিশে গেল, মিশে গেল এই বাড়ির সবকিছুর মধ্যে। কোন একদিন আবার ফিরে আসবে বলে।
“নীলাক্ষী, বই পড়ছো নাকি? চা খাবেনা? তুমি সারাদিন কত বই পড়। আমি তো একটুক্ষণ চুপ করে থাকলেই হাঁফিয়ে যাই।”
মিসেস বিশ্বাস। নীলাক্ষী নোটবুকটা চট করে অন্য বই-এর মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। উনি কি দেখতে পেয়েছেন? মনে হয় না। এই সরল, ভালোমানুষ, কিছুটা বোকা মহিলার জন্য কষ্ট হল নীলাক্ষীর। ক্রিসকে স্নেহ করতেন ভদ্রমহিলা। ক্রিসের ওভাবে না বলে চলে যাওয়াতে বড় অভিমানে লেগেছিল তার। মিঃ বিশ্বাসকে বড় ভালোবাসেন মহিলা। মেয়েকেও। স্বামী, কন্যা, বাগান, বিড়াল, বিকেলের টি-পার্টি সব নিয়ে তার বড় মায়ার সংসার। একদিনও নীলাক্ষীকে বুঝতে দেননি সে এবাড়ির পেয়িং গেস্ট। স্বামীর অজ্ঞাত অতীতের বিন্দুমাত্র ছায়া তার উজ্জ্বল হাসিমুখে নেই। চা খেতে খেতে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। মিসেস বিশ্বাস হাবিজাবি অনেক কথা বলে যাচ্ছেন। সাদা বিড়ালটা খেলা করছে তার চারপাশে। নীলাক্ষী বিড়ালটাকে একটা বিস্কুট দিল। কিন্তু বিড়ালটা খেল না। একটা লাফ দিয়ে পালিয়ে গেল। বিড়ালটা মিসেস বিশ্বাসের এত ন্যাওটা, কিন্তু উনি কোনদিন বিড়ালটাকে আদর করেননা! ফিরেও তাকান না। এমন ভাব করেন যেন দেখতেই পাচ্ছেন না। বহুদিন খেয়াল করেছে নীলাক্ষী। আর তাছাড়া বিড়ালটা এ বাড়িতে কিছু খায় না। কেন? এই অস্বাভাবিক বিড়ালটাও এই অস্বাভাবিক বাড়ির একটা অংশ নয় তো?
সুনীল দূর থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার পরেই বাড়ির ভিতর ঢুকে গেল। অমনি ধক করে বুকে লাগল নীলাক্ষীর। আরে, নোটবুকটা তো ঘরেই আছে! ছুটতে ছুটতে ঘরে এসে নোটবুকটাকে জ্যাকেটের মধ্যে লুকিয়ে ফেলল সে। ভালো লাগছেনা তার আর কিছু। এই চাপ সে আর নিতে পারছে না। এখন নিজের বাড়িতে, মায়ের কাছে, তার একান্ত চেনা জীবনে ফিরতে পারলে বাঁচে সে।
নীলাক্ষী কাল চলে যাচ্ছে শুনে ডাক্তারবাবুরা দেখা করতে এসেছিলেন। এই উপলক্ষ্যে অনেকগুলো ভালো পদ রান্না করেছিলেন মিসেস বিশ্বাস। কিন্তু একটাও মন দিয়ে খেতে পারলনা সে।
“ঝড়ুর মা’র কথা তোমায় বলেছি না, নীলাক্ষী? ঝড়ুর মা একটা খুব ভালো কফি বানাত ক্রীম দিয়ে। আজ তোমার জন্যে সেটা বানিয়েছি, খেয়ে দেখ।”
মিসেস বিশ্বাস বকেই যাচ্ছেন। নীলাক্ষীর কিন্তু কিছুতে মন লাগছে না। তার ভেতরটা এখান থেকে পালানোর জন্য ছটপট করছে। আর আজকের রাত্রিটা খালি! ডাক্তারবাবুরা বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন। মিঃ বিশ্বাস খুব বিষাদের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন।
“মনে হয় কাল ভোরে আর আপনার সাথে দেখা হবেনা মিস চৌধুরী। বেস্ট অফ লাক ফর দ্য জার্নি।”
এলোমেলো অনেক চিন্তা নিয়ে ঘরে ফিরে এল নীলাক্ষী। এখনো কিছু জিনিষ প্যাক করা বাকি। আচ্ছা, ক্রিসের দেহটা কোথায় আছে? এই বাড়িতেই কি? নাকি খাদে ফেলে দিয়েছিলেন মিঃ বিশ্বাস? সুনীল, বিশ্বস্ত সুনীল নিশ্চয় তাকে সাহায্য করেছিল। কিন্তু খাদে ফেলে দিলে কোন না কোন সময় সেটা উদ্ধার হত। কিংবা হয়ত হয়নি কোনদিনই। ক্রিসের অনুপস্থিতি নিয়ে তো আর কেউ মাথা ঘামায়নি। আচ্ছা, নোটবুকটা নিয়ে সে কি করবে? সে কি ওটা নিয়ে যাবে? আনমনে জ্যাকেটটা হাতড়ালো সে। নোটবুকটা নেই! ঘরের কোথাও নেই। তার গুছিয়ে রাখা ব্যাগটাও একটু অগোছালো মনে হল। নীলাক্ষীর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা স্রোত বয়ে গেল! এই নির্জন পাহাড়ি শহরে কত সহজ একজনকে খুন করে লোপাট করে দেওয়া। কত সহজ! সবাই জানে কাল সে কলকাতা চলে যাচ্ছে। কাল ভোরে এই বাড়ির গাড়ি তাকে এয়ারপোর্টে ছেড়ে দেবে। তারপর? সে যদি ক্রিসের মত আর কোনদিন কলকাতা না পৌঁছয়? যদি তার নিথর দেহটা পড়ে থাকে কোন খাদের অতল গহ্বরে? মিঃ বিশ্বাস আর হাঁটতে পারেননা ঠিকই। কিন্তু সুনীল আছে। বিশ্বস্ত, প্রভুভক্ত সুনীল।
কাউকে ফোন করে কোন লাভ নেই। এখানে এখন সিগনাল পাওয়া যাবে না। জ্যাকেটটা গায়ে চড়ালো নীলাক্ষী। মোবাইলটা নিল। জুতোজোড়া হাতে নিয়ে খালি পায়ে নিঃশব্দে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে নেমে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। বিড়ালটা সিঁড়ির উপর বসেছিল। তাকে দেখেই গা-ঝাড়া দিয়ে ঊঠে দাঁড়ালো। যে করেই হোক বাঁকটার ঐদিকে ডাক্তারবাবুর বাড়ি পৌঁছাতে হবে। কুয়াশায় ঢেকে গেছে চারদিক। আন্দাজে, মাঝে মধ্যে মোবাইলের আলোতে সে প্রায় ছুটছে। শীতে হাত-পায়ে কাঁপন ধরে যাচ্ছে। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। বিড়ালটা তার পিছুপিছু আসছে। হঠাৎ চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে গেল। প্রকৃতি পাল্টে গেল। ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে। গাঢ় কুয়াশা। টিমটিম করে রাস্তার খুঁটিতে জ্বলছে একটা বাল্ব। তার মাথাটা ঘুরছে। রাস্তার পাশে একটা গাছে ভর দিয়ে কোনরকমে টাল সামলালো সে। একটু আগের ঝিরঝিরে নালা এখন অবিরাম স্রোতে বইছে। তার সামনে কুয়াশা থেকে বেরিয়ে এল একটা চাদরে মুড়িশুড়ি দেওয়া মহিলা, মনে হচ্ছে বয়স্ক। ঝড়ুর মা। খুব তাড়াতাড়ি হাঁটছে। তার পাশ দিয়ে চলে গেল, তাকে দেখতেও পেল না। পিছনের কুয়াশা থেকে এবার বেরিয়ে এল আরেকটা চেহারা। মিসেস অলিভিয়া বিশ্বাস। তার হাতে একটা মাঝারি সাইজের পাথর। বুড়ি তাকে দেখে ভয়ে ছুটতে শুরু করল। অলিভিয়া বিশ্বাস পাথরটা নির্ভুল দক্ষতায় ছুড়ে দিল বুড়ির মাথা লক্ষ্য করে। বুড়ি নালার উপর পা পিছলে পড়ল আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গড়িয়ে গেল খাদের মধ্যে। তেল কমে গেলে হারিকেনের আলো যেমন দপদপ করে নিভে যায়, অতীতের স্মৃতি হারিয়ে গেল নীলাক্ষীর চোখের সামনে থেকে। চারিদিকে কুয়াশার মধ্যে এখন শুধু একা দাঁড়িয়ে সে। সেই টিপটিপ করে বৃষ্টি। মাথার উপর একটা স্ট্রীট ল্যাম্পে আলো জ্বলছে। একবার চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে নিল সে। শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগছে। মাথা ঘুরছে। যেভাবেই হোক নালাটা পেরিয়ে ডাক্তারবাবুর বাড়ি পৌঁছাতেই হবে। তার কফিতে কি কিছু মেশানো ছিল? বিষ? ঘুমের ওষুধ? যা মেশানো ছিল ক্রিসের কফিতেও? একটা লম্বা-চওড়া চেহারার জোয়ান ছেলেকে মারতে গেলে আগে তাকে ড্রাগড করে দেওয়াটা সুবিধাজনক, না? সেইজন্যই কি প্রথমদিন ক্রিসের কফি খাওয়ার দৃশ্যটা দেখেছিল সে?
সামনে একটা খসখস শব্দ। কেউ যেন এসে দাঁড়িয়েছে। অতি কষ্টে চোখ খুলল নীলাক্ষী। অলিভিয়া বিশ্বাস। ঠোঁটের কোণে একটা অন্যরকম হাসি আর হাতে একটা পাথর। এদ্দিন পরে হঠাৎ করে নীলাক্ষী অনুভব করল অলিভিয়ার কি শক্তপোক্ত চেহারা, কি মজবুত কবজি। ঐ বকবক করা, গিন্নীবান্নি গোছের একটু বোকা অলিভিয়ার আড়ালে একটা নিষ্ঠুর, নির্মম, ঠান্ডা মাথার খুনী। বিড়ালটা নালার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। যেন তার ওদিকে যাওয়ার রাস্তাটা আটকাচ্ছে। নীলাক্ষীর হাত-পা অসাড় হয়ে যাচ্ছে। তাও সে ছোটার চেষ্টা করছে। অলিভিয়া হাতটা মাথার উপর তুলল। আর তারপরেই...তারপরেই নীলাক্ষীর পিছনে কিছু একটা দেখে আতকে ঊঠল। সেই পিছনের কিছু একটা এগিয়ে আসছে। নীলাক্ষী সভয়ে দেখল বিড়ালটা কোথাও নেই। তার জায়গায় ঝড়ুর মা দাঁড়িয়ে আছে। মুখের চাদর সরে গেছে। রক্তে, ঘিলুতে তার মাথার একদিক মাখামাখি, চোখটা ভেবলে গেছে। কিন্তু এই মুখটা নীলাক্ষী চেনে। খুব ভালো করে চেনে। শনের নুড়ির মত চুল। কুঁচকানো চামড়া। জ্বলজ্বলে দৃষ্টি। অলিভিয়াও চেনে। খ্যানখ্যান শব্দ করে হেসে উঠল ঝড়ুর মা। তারপর এগিয়ে আসতে থাকল অলিভিয়ার দিকে। অলিভিয়া একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করে পড়ে গেল নালাটার উপরে। আর তার কোটের পকেট থেকে ছিটকে পড়ল নোটবুকটা। নীলাক্ষী সেটা কুড়িয়ে নিয়ে দিগবিদিক জ্ঞানশূন্যভাবে ছুটতে লাগল ডাক্তারবাবুর বাড়ির দিকে।
কয়েকদিন পর নার্সিং হোম থেকে বেরোতেই পুলিশের বড়বাবু এলেন। শেষবারের মত আর একবার গেল সে রোজমেরী কটেজে। মৃত অলিভিয়ার একটা ছবি হাতে মিঃ বিশ্বাস বসে আছেন। প্রশান্ত মুখ, যেন দীর্ঘদিনের গ্লানি থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
নীলাক্ষীকে দেখে ম্লান হাসলেন।
“অলিভিয়াকে যখন আমি বিয়ে করি, তখন তুমি তাকে দেখনি নীলাক্ষী। অ্যাঞ্জেলিক বিউটি। তাকে একটা সুখী জীবন দিতে আমি বদ্ধপরিকর ছিলাম। তবে ফ্রেডকে আমি ধাক্কা মারিনি, জানো? টাকার আনন্দে মাতাল হয়ে নিজেই ট্রেন থেকে পড়ে গিয়েছিল সে। পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে এখানে চলে এলাম। কিন্তু বিবেককে এড়াতে পারিনি। ডোরাকে গোপনে সাহায্য করে গেছি বরাবর। আর সত্যি সত্যি ক্রিসের জন্য কিছু একটা করতে চেয়েছিলাম। আমি আর অলিভিয়া, দুজনেই। কিন্তু ক্রিস ব্ল্যাকমেল শুরু করল। তার কিছু জুয়াড়ি বন্ধু হয়েছিল। অলিভিয়া ভয় পেয়ে গেল। যদি নেশার আড্ডায় ক্রিস সব ফাঁস করে দেয়? কফিতে বিষ মেশানোর আইডিয়াটা অলিভিয়ারই। ঝড়ুর মা-র ক্ষেত্রে আমার আর কিছু করার ছিল না। অলিভিয়া আমার একটাও কথা শুনল না। ও আমাকে বড্ড ভালোবাসত যে। ও যা যা করেছে সবকিছু আমাকে বাঁচানোর জন্য। ওর আন্তরিকতাটাও মিথ্যে নয়, ওর নিষ্ঠুরতাটাও না। একটু ভেব নীলাক্ষী। তুমি হয়ত ওকে বুঝতে পারবে।”
আস্তে আস্তে চুপ করে গেলেন মিঃ বিশ্বাস। সারা ঘরে এক বিষণ্ণ নীরবতা। জানলার ওপাশের গাছটা থেকে সাদা ফুলগুলো টুপটাপ ঝরে পড়ছে।
“ক্রিসের ডেডবডিটা কোথায় আছে বলবেন?” খুব নরম গলায় জিগ্যেস করলেন পুলিশ ইন্সপেক্টরটি।
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে নীলাক্ষীর দিকে তাকালেন মিঃ বিশ্বাস।
নীলাক্ষী ভেতরের লনের দিকে দরজাটা হাট করে খুলে দিল। সামনে সকালের রোদ্দুরে ঝলমল করছে খাদের পাঁচিলের পাশের লতাটা। এক গুচ্ছ নীল-বেগুণী ফুল হাওয়ায় দুলছে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে তলার একটু উঁচু হয়ে থাকা মাটির ঢিপিটার উপরে। চারিদিকে শেষবারের মত তাকাল নীলাক্ষী। না, বিড়ালটাকে আর কোথাও দেখা যাচ্ছে না। বিড়ালটাকে আর কোনদিন দেখা যাবে না।