সেদিন রাঙাদিদার বাড়ি গিয়েছিল মিল্টি বলে এত কিছু হল। এমনিতে রাঙাদিদার বাড়িতে গেলে মা মিল্টিকে খুব একটা নিয়ে যান না। কারণ একে তো কিছুটা দূর তাছাড়া ওখানে ওর বয়সের কেউ নেই, দিদা একাই থাকেন। মিল্টির অবশ্য যেতে ভালই লাগে; সে নিজের মনে বাগানে বা ছাদে খেলা করে। মা ভয় পান যে ছাদে খেললে পড়ে যেতে পারে আর বাগানে খেলতে গিয়ে মিল্টি একবার মাটি খুঁড়ে দিয়েছিল! তাতে রাঙাদিদা যদিও কিছু বলেননি কিন্তু মার মনে হয়েছিল উনি একটু অখুশি হয়েছিলেন। তবে তখন মিল্টি অনেকটাই ছোট ছিল। এখন সে বড় হয়েছে, মোটেই ওই রকম কাজ সে আর করবে না। সেটা মাকে বলতে মা ওকে নিয়ে যেতে রাজি হলেন। রাঙাদিদা আসলে মার নিজের কেউ না। মা যখন ছোট, স্কুলে পড়তেন, তখন রাঙাদিদারা মাদের বাড়ির পাশে থাকতেন। মাকে নাকি খুব ভাল বাসতেন রাঙাদিদা। তাই মা বাবা মাঝে মাঝে যান দিদাকে দেখতে। গরমের ছুটি চলছে আর সেদিন বাবার অফিসে কাজ ফিরতে দেরি হবে তাই মা মিল্টিকে নিয়ে দুপুর বেলাতেই গেলেন। ওকে একা বাড়িতে রেখে যেতে চান না মা। কখন কি করে বসে সেই ভয়ে!
ট্রেনে করে যেতে ভালই লাগল মিল্টির। দুপুরবেলা, তাই ট্রেনে ভিড় ছিল না তত। রাঙাদিদা নিমকি আর মিষ্টি বানিয়ে রেখেছিলেন ওদের জন্যে।
তাই দেখে মা বললেন, “রাঙাপিসি কেন আপনি এত ঝামেলা করতে গেলেন আমাদের জন্যে! আমরা তো ভাত খেয়েই বেরিয়েছি।”
“তাতে কি হয়েছে! এতটা পথ, আর তাছাড়া আমার ভালই লাগে এই সব করতে। একা একা আর কত খাবো, তোরা খেলে আমার ভাল লাগবে। গগনের জন্যেও নিয়ে যাস না হয় কিছু।”
মিল্টি জিজ্ঞেস করল, “রাঙাদিদা আমি বাগানে খেলতে যাব? আর মাটি খুঁড়ব না কথা দিচ্ছি! তখন ছোট ছিলাম তো! এই যে পড়ার জন্যে গল্পের বই এনেছি।”
“আরে না না মিল্টিদিদি, তুমি নিশ্চয়ই বাগানে যাও। মাটি খুঁড়লেও কিছু হবে না! তোমরা এসেছ আমার খুব ভাল লাগছে!”
এক মুঠো নিমকি নিয়ে মিল্টি বাগানে চলে গেল। বাগানের কিছুটা অংশ বাড়ির পিছনের দিকেও চলে গেছে; সেদিকটা গিয়ে দেখল। একটা বড় গাছের তলায় বসে বইটা খুলে বসল সে। গাছের ছায়ায় বসতে খুব ভাল লাগছিল। একটা সুন্দর ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। পড়তে পড়তে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল ওর নিজেরই খেয়াল নেই।
হঠাৎ কী একটা শব্দে ঘুম ভাঙল। ধড়মড় করে উঠে বসল মিল্টি।
“এই যে, তোমাকেই ডাকছি! শুনতে পাচ্ছ না?”
চমকে উঠল মিল্টি! আসপাশে তো কেউ নেই! তাহলে কে ডাকছে?
“এই যে আমি এখানে! তোমার পায়ের দিকে তাকাও!”
মিল্টি তাকিয়ে দেখল, সত্যি তো! ওর পায়ের কাছে এক আঙুল সমান লম্বা একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে!
মিল্টি ওই সাইজের মানুষ কোনদিন দেখেনি, তাই সে অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল।
মেয়েটা এবার বলল, “কি হল? ওই রকম হাঁ করে দেখছ কেন?”
“না, মানে ইয়ে অত ছোট মানুষ কোনদিন দেখিনি তো তাই!”
“ঠিক আছে দেখে নিয়েছ! এবার আমার সাথে চল! ওদিকে পরিদিদা ভীষণ কষ্ট পাচ্ছেন!”
মিল্টি মনে মনে ভাবল, ‘পরিদিদা আবার কে রে বাবা?’ মুখে অবশ্য কিছু বলল না। মেয়েটার সাথে গিয়ে দেখল একটা ফুলের টবের তলায় চাপা পড়ে গেছে একজন এক আঙুলে! শুধু মুখটা জেগে রয়েছে! পাশে আরো তিন চার জন এক আঙুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। টবটা সরান মনে হয় ওদের ক্ষমতায় কুলোচ্ছে না!
“একটু আগে দমকা হাওয়ায় ওই টবটা ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে পরিদিদার উপর গড়িয়ে পড়েছে! ওনার কি অবস্থা ভাব তো!”
“ওমা এ তো খুব সোজা!” বলে টবটা তুলে সরিয়ে দিল মিল্টি! ওরা সবাই মিলে ধরাধরি করে পরিদিদাকে তুলতে লাগল।
“তুমি দিদার প্রাণ বাঁচালে। সেই জন্যে আমরা কৃতজ্ঞ। এই নাও! এটা জাদুর শাঁখ। এই শাঁখ তোমার যে কোন একটা ইচ্ছে পূরণ করবে। তুমি যা চাইবে তাই! শুধু ইচ্ছেটা বলে ফুঁ দেবে।”
“মিল্টি! এই মিল্টি! মেয়ের কাণ্ড দেখো! এখানে পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে! ওঠো, এবার চলো আমাদের যেতে হবে, অনেকটা পথ যাওয়ার আছে।”
মার ডাকে মিল্টির ঘুম ভাঙল। ও মা! তাহলে এক আঙুলেদের ব্যাপারটা সত্যি নয়! স্বপ্নই দেখছিল মিল্টি! কিন্তু কি বিদঘুটে স্বপ্ন রে বাবা! ওপাশটায় তাকিয়ে দেখল মিল্টি, ছোট মানুষদের দেখতে পেল না বটে কিন্তু টবটা সত্যি ছাদ থেকে পড়েছে!
“আজ আসি রাঙাদিদা। তবে আপনি না ছাদের পাঁচিলে টব রাখবেন না, ওই দেখুন একটা পড়ে গেছে। কারো আঘাত লেগে যেতে পারে।”
রাঙাদিদা টবটা দেখে বললেন, “এ বাবা, নিশ্চয়ই ভোলার কাজ! আমি তো পাঁচিলে কোনদিন টব রাখি না। ওকে বলেছিলাম ছাদে কিছুটা মাটি তুলে দে, আর নতুন কয়েকটা টবে মাটি দিয়ে দে, আমি ছাদে গিয়ে আর কয়েকটা গাছ পুঁতব আর ও কিনা টবগুলোকে পাঁচিলে রেখেছে! কি আক্কেল দেখ তো! আসু্ক, কাল ওর হবে! তুমি কিছু ভেবো না দিদি আমি এখুনি গিয়ে সব টব নিচে নামিয়ে দিচ্ছি। মিত্রা তোর মেয়ে বড় হয়ে গেল রে!”
মা আর মিল্টিও রাঙাদিদার সাথে ছাদে গিয়ে পাঁচিল থেকে সব টব নামাতে সাহায্য করল।
ফেরার পথে ট্রেনে বসে মিল্টি আবার স্বপ্নটার কথা ভাবল।
গরমের ছুটি শেষ হয়ে গেল মিল্টির। কয়েকদিন বাদে স্কুল থেকে ফেরার পর মিল্টি যখন খাচ্ছে তখন মা বললেন, “তোমার জামার পকেটে একটা ছোট শাঁখ ছিল। আমি কাচার জন্যে দিতে গিয়ে দেখতে পেলাম। তোমাকে বলেছি না পকেট থেকে জিনিস বার করে রাখবে। তা এই শাঁখটা কোথা থেকে পেলে?”
মিল্টি বেশ অবাক হল কিন্তু চটপট নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “এক বন্ধু দিয়েছে। কোথায় সেটা?”
“তোমার পড়ার টেবিলে রেখেছি।”
কোন রকমে খেয়ে মিল্টি ছুটে গেল পড়ার ঘরে। হ্যাঁ, সত্যি তো শাঁখটা রয়েছে! একদম ছোট্ট, কিন্তু খুব সুন্দর একটা গোলাপি আভা রয়েছে।
একটা ইচ্ছে পূরণ হবে ভেবেই দারুণ একটা উত্তেজনা অনুভব করল মিল্টি! যে-কোন ইচ্ছে!
বিকেল বেলা নিজের প্রাণের বন্ধু শ্রীতমাকে ব্যাপারটা বলল মিল্টি। শ্রীতমা তো শুনেই লাফিয়ে উঠল, “আরে কালকেই তো অঙ্কের ক্লাস টেস্ট আছে, তুই সব চেয়ে বেশি নম্বর পাবি চেয়ে নে!”
মিল্টি শুনে মাথা নাড়ল, “না, ওটা তো মোটে কুড়ি নম্বরের ক্লাস টেস্ট! ওটাতে হাইয়েস্ট পেয়ে কি হবে? শুধু শুধু ইচ্ছেটা নষ্ট হবে!”
“তাহলে ফাইনাল পরীক্ষায় ফার্স্ট হবি সেটা চেয়ে নে! তাহলে প্রাইজও পাবি আর পড়াশোনাও করতে হবে না। অথবা অনেক অনেক সুন্দর জামা বা সারা বছরের জন্যে আইসক্রিম!”
কিন্তু মিল্টির ঠিক মনে ধরল না। বলল, “না, আর একটু ভাবি! নিজের জন্যে ওই রকম কিছু চাইতে ঠিক ইচ্ছে করছে না। পড়াশোনা না করে ফার্স্ট হয়ে যাব সেটা তো ঠিক নয়! সারা বছর আইসক্রিম খেলে সর্দি কাশি হবে, আমার এমনিতেই ঠান্ডার ধাত! আর জামা তো প্রচুর আছে। দু দিন বাদে লম্বা হয়ে যাব তখন আর একটাও গায়ে হবে না!”
“ও নিজের জন্যে চাইবি না? তাহলে আমার জন্যে চা!”
“না, তোরও কিছুর দরকার নেই!”
“তাহলে অন্য কিছু চা, ধোনির সেঞ্চুরি চা, ঋত্বিকের পরের সিনেমাটা যেন হিট হয় সেটা চা!”
“দূর তুই বড্ড ফাজিল! আমি বাড়ি চললাম।”
পরদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে মিল্টি দেখল মার মুখ আঁধার।
“কি হয়েছে মা?”
“রাঙাপিসি ফোন করেছিলেন। কি একটা নতুন বড় রাস্তা হবে তাই পিসির বাড়িটা ভাঙা হবে। সেই জন্যে রাঙাপিসির খুব মন খারাপ। মানে ওরা ক্ষতিপূরণ দেবে আর অন্য জায়গায় জমিও দেবে কিন্তু এই বাড়িটা পিসেমশাই নিজে প্ল্যান করে দাঁড়িয়ে থেকে তৈরি করিয়েছিলেন। রাঙাপিসির কত স্মৃতি জড়ানো ওই বাড়িটার সাথে! খুব কাঁদছিলেন। আমি কি বলব বুঝতে পারলাম না। দেখি কাল বা পরশু না হয় এক বার গিয়ে দেখা করব। আর আমি কিই বা করতে পারি।”
“কালকে হবে না। কাল শ্রীতমার জন্মদিন। বিকেলে ওদের বাড়িতে যেতে হবে।”
“ও হ্যাঁ, সেটা তো ভুলেই গিয়েছিলাম। তাহলে পরশু।”
সেদিন রাতে শাঁখটাকে বার করে নিজের ইচ্ছেটা বলে ফুঁ দিল মিল্টি। এক বার, দু বার, বার বার। বলবার মতন কিছুই হল না, কোন আলো না, ধোঁয়া না, কিছুই না। মিল্টি মনে মনে ভাবল, যাক আলো ধোঁয়া হতে হবে না, কাজটা হলেই হল!
পর দিন স্কুল থেকে ফিরে ভাবছিল কিছু খবর পাবে কিন্তু মা কিছুই বললেন না। মনটা খারাপ হয়ে গেল মিল্টির। তাহলে হয় তো ওটা স্বপ্নই ছিল। শাঁখটা হয় তো বাগানেই ছিল সেখান থেকেই ঘুমের মধ্যে সেটাকে কুড়িয়েছে সে। এদিকে রোজ একটা কিছু না কিছু এসে যাওয়ায় রাঙাদিদার বাড়িতেও যাওয়া হয়ে উঠল না মার।
মাস খানেক বাদে এক দিন স্কুল থেকে ফিরে মিল্টি দেখল রাঙাদিদা বাইরের ঘরে বসে আছেন হাসি হাসি মুখে।
ওকে দেখে বললেন, “এসো দিদি, স্কুল কেমন হল?”
মিল্টি মাথা নেড়ে বলল, “ভাল।”
মা বললেন, “জানো মিল্টি রাঙাপিসির বাড়ি আর ভাঙা হবে না। পিসিরা সবাই মিলে দরখাস্ত দিয়েছিলেন। পিসির দুটো বাড়ি পরে যে দম্পতিটা থাকে তাদের ছেলে আবার এম এল এ। সে ওই দরখাস্ত নিয়ে চেষ্টা চরিত্র করে নতুন রাস্তাটাকে অন্য দিক দিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্ল্যানটাকে মঞ্জুর করিয়েছে। সেটা একটু ঘুর পথ হবে কিন্তু কারো ঘর বাড়ি ভাঙা হবে না। রাঙাপিসি তাই মিষ্টি নিয়ে খবরটা আমাদের দিতে এসেছেন!”
খুশিতে ঝলমল করে উঠল মিল্টির মুখ! সে সত্যি সত্যি শাঁখটাকে ভাল কাজে লাগাতে পেরেছে! একটা নির্মল আনন্দে ভরে গেল তার বুক।
মাকে অবশ্য সে শুধু বলল, “কোথায় মিষ্টি? দাও খাই, ভীষণ খিদে পেয়েছে!”