আমার শাশুড়িমায়ের সকলের সঙ্গে মিশবার, গল্প করার ক্ষমতা ছিল। একদিন কোন এক পাড়ায় তাঁর সঙ্গে এক উদ্বাস্তু পরিবারের আলাপ হল। তাঁদের পরিবারে একটি শিশুসহ পাঁচজন সদস্য। সেই পরিবারের বুদ্ধিমতী প্রবীণা মহিলাকে খাদ্যের বিনিময়ে কাজ করার জন্য আমার শাশুড়িমা আমাদের বাড়িতে নিয়ে এলেন।
আমার মানসিক ও শারীরিক অবস্থা দেখে মহিলার মনে স্নেহ বা দয়ার উদ্রেক হল। তিনি প্রতিদিন কাজকর্ম, রান্নাবান্না সেরে নিজের খাবার নিয়ে বাড়ি চলে যেতেন। মেয়েজামাই আর দুটি নাতনিকে দেখতে গিয়ে বিকেলে কাজে আসার সময় ছোট্ট নাতনিটিকে সঙ্গে নিয়ে এসে আমার সন্তানহীন কোলে বসিয়ে দিয়ে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করতেন। প্রখর বুদ্ধিমতী মহিলা, এই অছিলায় অভাবের সংসারের শিশুটির ভাগ্যে একবেলার খাবার এখান থেকেই জুটতে লাগল। অবশ্য কিছুদিন পরে সেই মহিলাকে, আমার কর্তা নৈহাটিতে কোন এক সংস্থায় সবেতন কাজের ব্যবস্থা করে দিলেন। আবার আমি সংসারের জোয়াল ধরলাম।
দেখতে দেখতে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে একটি বছর পার হয়ে গেল। ১৯৫১ সালের ১৩ই এপ্রিল নীল পূজার দিন আমার দ্বিতীয়া কন্যার (বর্তমানে সে-ই প্রথম) জন্ম হল। সুন্দর শিশুকে দেখে সকলেই খুশি। শাশুড়ি মা মানত অনুসারে তাকে টাটকা গরুর দুধে স্নান করালেন। তার ঠাকুরদাদা নাম দিলেন ‘আশাপূর্ণা’, ঠাকুমা নাম দিলেন ‘উমা’। সেদিন নীলের সঙ্গে বাসন্তী পূজাও ছিল। তাই মা দুর্গার আরেক নামটি রাখলেন তিনি। সাতমাস বয়সে ঘটা করে মুখেভাত দেওয়া হল উমার।
আর্থিক অবস্থার তখনও বিশেষ উন্নতি কিছু হয়নি। ক্রমাগত দাঙ্গার বিস্তারে আতঙ্কিত শ্বশুরমশায় অতর্কিতে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। জমি জিরেত ইত্যাদি স্থাবর সম্পত্তির কোনো ব্যবস্থা করতে বা বিক্রিবাটা করতে পারেননি। দেশ ছাড়ার সময় তিনি একেবারে নিকট-আত্মীয় এক সম্পন্ন ব্যক্তিকে জমির ‘কাওলা’ দিয়ে এসেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল যখন সেই আত্মীয় (তিনি নিজের ক্ষমতাবান শ্বশুরবাড়ির সাহায্যে বলীয়ান ছিলেন) দেশ ছাড়বেন, তখন নিজের জমিজমার সঙ্গে আমাদের জমিও বিক্রি করে আসবেন, সেজন্য তিনি খানিক অর্থও পাবেন এই কথা ছিল। আপৎকালে যে সহোদরও আত্মীয়তা রাখতে চায় না তার প্রমাণ দিলেন সেই আত্মীয়। নিজের ও আমার শ্বশুরমহাশয়ের জমিজমা বিক্রিবাটা করে প্রভূত অর্থ নিয়ে যখন এদেশে এলেন তারপর আর যোগাযোগ রাখলেন না। দেখা করলে সেই কাওলা দেওয়া সম্পত্তি বিক্রির টাকার নামগন্ধও করলেন না। সদাশয় আমার শ্বশুরমশায় তথাপি জ্ঞাতিত্ব ভুলতে পারলেন না। মনকে প্রবোধ দিয়ে বললেন, ‘কী আর করা, সাপে কাটলেও নির্বংশ আর বাঘে খেলেও নির্বংশ।’ গ্রাম্য প্রবাদ এখানে সার্থক হল। এমনিও জমিজমা ছেড়ে এসেছিলেন, আর কাউকে বিশ্বাস করেও সেই ছাড়তেই হল।
এবার আসি আমাদের নিজস্ব বাড়ির কথায়। এখানে এসে ভাড়া বাড়িতেই ছিলাম বেশ কিছুদিন। শ্বশুরমশায় আমাকে নিয়ে প্রথমবার যখন এদেশে এসেছিলেন আমাকে বরাবরের মত এদেশে রেখে যেতে, তখনই বসতবাড়ি তৈরি করার জন্য কিছুটা জমি কিনে রেখে গিয়েছিলেন। তাঁর বিচক্ষণতার কথা আগেও লিখেছি। সেখানেই টিনের ঘর তোলা হয়েছিল। সে কথায় পরে আসছি।
এদিকে পূর্ববঙ্গের দাঙ্গা থামার কোন লক্ষণ নেই, আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। তখন সরকার থেকে বর্ডার স্লিপ দিয়ে লোক পারাপার শুরু হল দর্শনা বর্ডার দিয়ে। সেই স্লিপ নিয়ে দাঙ্গাপীড়িত, বিধ্বস্ত, সর্বহারা উদ্বাস্তুর ঢল নামল এপারে। কাছেই নৈহাটি, প্রাথমিকভাবে এরা আশ্রয় নিতে লাগল স্টেশনে।
এই সময়ে সন্ধ্যা হতেই ভয়ের বাতাবরণ যেন চারদিক গ্রাস করত। আমার বাবা মা, ভাইয়েরা তখন কাশী থেকে এখানে ফিরেছেন। তাঁদের আবাস হয়েছে তিন নং বিজয়নগর কলোনিতে। আমার ছোড়দা পূর্ববঙ্গে থাকতেই খিদিরপুর ডকে কাজ পেয়েছিলেন। আমার মেজদা তখন গরিফা বয়েজ স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছেন। খুবই ছোটখাটো চেহারার নিরীহ মানুষ। অল্প মাইনের চাকরি, তাই স্কুলের পরে টিউশনি করতে যেতেন হাজিনগরের শেষে হালিশহরের কাছে। যাবার পথে হাজিনগর জায়গাটি ছিল মুসলিমপ্রধান।
অন্যদিকে, ছোড়দা ছিলেন দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে বিশাল, বলশালী আর দুর্দান্ত সাহসী। প্রতিদিন কাজ থেকে ফিরে সন্ধের পর একটা পাঁচব্যাটারির টর্চ হাতে নিয়ে পায়ে হেঁটে যেতেন হাজিনগরে। মেজদাকে টিউশন বাড়ি থেকে ফেরৎ আনতে। বড়রাস্তায় উপর দিয়ে ছিল ব্যান্ডেল লাইনে যাবার চারনম্বর ব্রিজ। সেই ব্রিজের নিচে দিয়েই হাজিনগরে যাবার রাস্তা। সারা রাস্তায় কোথাও আলো নেই, মনুষ্যের চলাচল বা আওয়াজ নেই। নিষ্প্রদীপ সম্পূর্ণ এলাকা। রাস্তার দুদিকে ছিল দীর্ঘ ঝিল।
ছোড়দা পৌঁছুবার পরে মেজদাকে ছাত্রের বাড়ি থেকে বেরোনোর কথা বলা ছিল। ছাত্রের বাড়ি থেকে বেরিয়েই নিষ্প্রদীপ হাজিনগর এলাকায় ঢোকার মুখে মেজদাকে পিঠে তুলে নিয়ে ছোড়দা লাগাতেন দৌড়, থামতেন এসে চার নং ব্রিজের এপারে, হিন্দু-বাঙালিপ্রধান এলাকায়।
এই প্রসঙ্গে বলি ছোড়দার আরেক কীর্তির কথা। দেশভাগের আগে, ময়মনসিংহে থাকতে আমার ছোড়দা থাকতেন শহরের দিকে আমার মেজদির বাড়িতে। সেখান থেকে পড়াশোনা করতেন। একদিন কলেজফেরৎ আঠারোবাড়ি স্টেশনে নেমে দেখলেন আমাদের গ্রামেরই একটি ছেলেকে। আমার ছোড়দারই সমবয়সী ছেলেটি ম্যালেরিয়া জ্বরে আক্রান্ত হয়ে একটি চাদর মুড়ি দিয়ে স্টেশনমাস্টারের ঘরের বারান্দায় শুয়ে ককাচ্ছে। আশেপাশে কেউ নেই। তখনও আঠারোবাড়ি স্টেশন এলাকা ততটা শহুরে হয়নি। তাই ট্রেন আসা-যাওয়ার সময় ছাড়া প্রায় শুনশানই থাকত। অনেক দূরে দূরে দু-একটা গ্যাসের বাতি ছাড়া আর কোনো আলো দেখা যেত না।
ছোড়দা ছেলেটিকে দেখে চিনলেন, নাম তার চারুচন্দ্র। গ্রামেরই ছেলে। তাকে ফেলে রেখে চলে যেতে পারলেন না। স্টেশনের পিছনের রাস্তাতেই থাকত পাল্কি বা গরুর গাড়ি। সেখান কিছু যাত্রীসহ গরুর গাড়ি দেখে, গাড়োয়ানদের আর যাত্রীদের অনেক কাকুতি-মিনতি করে চারুকে গাড়ির একপাশে জায়গা দেবার জন্য চেষ্টা করলেন। স্টেশনে পড়ে থাকলে ছেলেটি বাঁচবেই না বলে তাঁদের অনেক অনুনয় করলেন। কিন্তু কেউ রাজি হল না। গ্রামগঞ্জে তখন ম্যালেরিয়াকে যমের মত ভয় করত মানুষ।
যাই হোক, আবার ফিরি নতুন দেশের কথায়। দাঙ্গার ভয়ঙ্করতার সঙ্গে আরও যে কত আপাত মজার ঘটনা জড়িয়ে আছে তার হদিশ কজনে রাখে। আমার মনে পড়েছে তেমনি এক মজার ঘটনা। আমাদের কাছে মজাদায়ক হলেও যাঁদের সঙ্গে ঘটনাটি ঘটেছিল তাঁদের কাছে ছিল প্রাণভিক্ষা, প্রাণরক্ষার আপ্রাণ প্রয়াস।
এদেশেও মুসলমান নিধনের মত কাজ শুরু হওয়াতে অনেকে মাথায় লম্বা টিকি রেখে, কপালে চন্দনের টিপ দিয়ে হিন্দু সেজে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করতেন। সেই সময়ে শহরের দিকে, গঙ্গার ধারে একটি মুসলমান পরিবারের হিন্দু হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। আমি সেটার সাক্ষী। বহুদিন আগের কথা। আমরা তখনও এদেশে আসিনি। নৈহাটি পৌরপ্রতিষ্ঠানে তখনও কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেক ইংরেজ সাহেব ছিলেন। মেথর জাতি ছাড়া ঝাড়ুদারদের মধ্যে অনেক নিম্নশ্রেণীর পুরুষ ও মহিলা কাজ করত। স্থানীয় এক মুসলিম দম্পতি ঝাড়ুদারের কাজ করত। মহিলা খুবই সুন্দরী। সাহেবের চোখ এড়াতে পারল না। যথাসময়ে মহিলার একটি পুত্রসন্তান জন্মাল, সাহেবের মত গায়ের রঙ, কটা নীল চোখ। ছেলের নাম তারা রাখল হারান শেখ। মহিলার স্বামী ছিলেন শেখ। এর পরে এর বংশের সব ছেলেমেয়েই প্রায় কটা চোখ, আর সাহেবের মত গায়ের রঙ নিয়ে জন্মেছিল।
কালক্রমে স্বাধীন ভারত থেকে সাহেবরা বিদায় নিল। হারান শেখ প্রাপ্তবয়স্ক সুন্দর যুবক। বাবা মারা গেছে। মা তার বিয়ে দিল স্বজাতীয়ের এক সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে। মায়ের পরে সেও পৌরপ্রতিষ্ঠানেই চাকরি পেয়েছিল, তবে বোধ হয় ঝাড়ুদার নয়। তার সুন্দর ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে লাগল। এই পর্যন্ত হারান শেখের বৃত্তান্ত আমার কর্তার মুখ থেকে শোনা। পরবর্তী ঘটনা--অর্থাৎ হারান শেখের হিন্দু হওয়ার ঘটনা আমার দেখা। হারানের হিন্দুত্ব গ্রহণের ঘটনা এইরূপ—
মধুর স্বভাবের গুণে হারান শেখ পৌরকর্মীদের প্রিয়পাত্র ছিল। দেশের দুর্দিনে, দাঙ্গার সময় প্রাণের আশঙ্কা করে সে সহকর্মী পৌরকর্মীদের কাছে পরামর্শ ও সাহায্য চাইল। সহৃদয় পৌরকর্মীদের কাছ থেকে প্রস্তাব এল হিন্দুত্ব গ্রহণের ব্যয়বহুল, আড়ম্বরবহুল এক কর্মযজ্ঞের।
আমরা তখন নৈহাটি শহরের দিকে থাকি। তখন হারান গত হয়েছে। তার বৃদ্ধা স্ত্রী শিশুদের রোগপীড়ায় জলপড়া, তেলপড়া দেয়, মাদুলি দেয়, ঝাড়ফুঁক করে। বহু মানুষ সন্তান কোলে তাদের বাড়ি আসে। আমার মধ্যম কন্যা তখন খুবই অসুস্থ। পৌরপ্রতিষ্ঠানেরই এক মহিলাকর্মী, নাম প্রমদা দিদি, তিনি আমাকে হারানের বউয়ের কথা বললেন, সঙ্গে করে নিয়েও গেলেন সেই বাড়িতে। অন্তর থেকে বিশ্বাস না থাকলেও অসুস্থা কন্যার সুস্থতার আশায় গেলাম জলপড়া আনতে। অন্য উদ্দেশ্যও অবশ্য ছিল। যে হারান একদা হিন্দু হয়েছিলেন তার বাড়ির অন্দর এখন কেমন, কেমন হালচাল সেসব দেখবার জন্যও গেলাম।
সদর পেরিয়ে একতলার ভিতরে ঢুকলাম। একপাশে দেখি একটি তুলসীমঞ্চ। হারানের বৃদ্ধা স্ত্রী সাদা থানকাপড় পরে তুলসীমঞ্চে ধূপদীপ দিচ্ছে। আমাদের দেখেই মাথার কাপড় আর একটু টেনে দিল। আমাদের নিয়ে গিয়ে বসাল দোতলার ঘরে। বসার জন্য পেতে দিল হাতে তৈরি আসন। দেওয়ালে চারদিকে হিন্দু দেবদেবীদের বাঁধানো ছবি আর ক্যালেন্ডার। ঘরের এক কোণে একটি সিংহাসনে লক্ষ্মীনারায়ণের ছবি, ঘট। ধূপদীপ জ্বলছে। প্রাণের আশায় যে হিন্দুত্বকে বরণ করে নিয়েছিল হারান, তার মর্যাদা রেখে চলেছে তার পরিবার।
মনে মনে ভাবলাম ধর্ম কোথায়? প্রাণের মায়া, বাসস্থানের মায়ার কাছে ধর্মের কী মূল্য? কোনটা বড় ধর্ম? সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে জলপড়া নিয়ে সে বাড়ি থেকে বেরোলাম। সঙ্গের প্রমদা দিদিকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে আমি গেলাম গঙ্গায়। মা গঙ্গার উদ্দেশ্যে সেই জলপড়া ঘটটি উপুড় করে দিয়ে গঙ্গাজলে পূর্ণ ঘট নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।
আবার ফিরে যাই পঞ্চাশের দশকের দিনের কথায়। আমি এদেশে আসার সময় জিনিসপত্রের যা দাম ছিল, দেশভাগ আর দাঙ্গার ফলশ্রুতিতে জনাধিক্যে পশ্চিমবঙ্গে জিনিসপত্র দুর্মূল্য হয়ে উঠল। পনেরো-ষোল টাকা মন যে চাউল পাওয়া যেত তা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেল। আট আনা সের ডাল, এক টাকা মানে ৬৪ পয়সায় এক সের তেল, আড়াই টাকা সের খাঁটি দুধ, আড়াই টাকা সের মাংস (পাঁঠার), এখন গল্পকথা বলে মনে হয়। আগে বড় মাছের মাথা বিক্রি হত ভাগা হিসাবে--চার আনা ভাগা। বর্ষার সময়ের গঙ্গার ইলিশের তো কথাই নেই।
আমার মনে পড়ে ১৯৫০ সালের কথা। সে সময়ের জামা, কাপড়, জামার ছিটের দাম আর বর্তমানের দামের আসমান-জমিন ফারাক। ছয় আনা, আট আনা, বা বারো আনা দরে জামার ছিট মিলত। আমি চার টাকা আট আনা দিয়ে একটি আটপৌরে শাড়ি কিনেছিলাম, মান নেহাৎ খারাপ ছিল না। আজ সেসব গল্পকথা। আজকালকার দিনে একটি ছোট্ট বাচ্চার জামার দাম দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই।
দ্রব্যমূল্যের এইরকম উর্ধ্বগতি থাকায় উদ্বাস্তু পরিবারগুলি প্রথমদিকে খুবই অসুবিধায় পড়লেও নিজেদের চেষ্টায় আর বুদ্ধিমত্তায় সে অবস্থা সামাল সহজেই দিয়েছিল। অবাক হয়ে গিয়েছিলাম এইসব মানুষদের প্রায় বিনা পুঁজিতে বা স্বল্প পুঁজিতে ব্যবসায়ে সাফল্যের মুখ দেখার ক্ষমতা দেখে।
পূর্বকথিত সেই পরিবারগুলি যারা ভেঙে-পড়া পোড়ো বাড়িটিতে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের মধ্যে একটি পরিবার নিজের এলাকাটুকু সযত্নে সুন্দর বাসযোগ্য করে তুলেছিল। চারদিকের ঝোপ-ঝাড় কেটে, আগাছা বিদেয় করে, দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সবজির গাছপালা লাগিয়ে সবজির খরচটা বাঁচাবার ব্যবস্থা করেছিল। পরিবারের কর্তাটি ছিলেন পঞ্চাশোত্তীর্ণ, পরিবারে ছিলেন তাঁর স্ত্রী, এগারো ও চোদ্দো বছরের দুটি ছেলে। এদের নিয়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে এসেছিলেন এদেশে। প্রথম দিকে নানান দুর্দশায় এদের দিন কাটছিল। বাড়িটির আশেপাশে, রাস্তায় ধারে ছিল কিছু নারকেল গাছ। মালিক কেউ ছিল না। দুই ভাই একদিন গাছতলায় দুটি নারকেল কুড়িয়ে পেয়েছিল। বাড়ি নিয়ে এলে তাদের মা, দোকান থেকে দু-আনার গুড় কিনে এনে তক্তি বানিয়ে একটি অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে করে তাদের পাঠাল বিক্রি করতে। ছেলেরা সেগুলি নিয়ে গিয়ে বসেছিল স্টেশনে ব্রিজের উপরে। এদেশে তখনও এরকম নারকেলের তক্তির চল ছিল না। একটি নাড়ু চারপয়সা করে বিক্রি করাতে হু হু করে সব নাড়ু বিক্রি হয়ে গেল। নাড়ু বিক্রি করে সেই পয়সা থেকে সংসারের দরকারি নুন তেল কিনে থালা বাজাতে বাজাতে মনের আনন্দে বাড়ি ফিরত ওরা। আমাদের বাড়ির সামনের পথ দিয়েই যেতে হত ওদের বাড়িতে। এরপরে এরা দুইভাই দূর দূর থেকে নারকেল জোগাড় করতে শুরু করে। ক্রমে এই নাড়ুর ব্যবসায় এদের যথেষ্ট অর্থাগম হতে লাগল, অভাব খানিকটা দূর হল।
একদিন কৌতূহলবশত বিকেলে গেলাম ওদের বাড়িতে। ওদের মায়ের মুখেই শুনলাম বিনা মূলধনে এই কারবার শুরু করার গল্প আর শুনলাম বাংলাদেশে ওদের অবস্থার কথা। তিনপুরুষ আগে এদের ছিল জমিদারী। কিন্তু তার পর ভাগ্যবিড়ম্বনায় ক্রমাগত আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটতে হতে থাকে। দেশে প্রাণের আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় পালিয়ে আসতে হয় এদেশে, সঙ্গে আনতে পেরেছিল কেবল একটি নারকেল কুড়ুনি, দা, বঁটি, দুটি পেতলের থালা আর ঠাকুরের আরতির পুরো কাঁসার তৈরি পঞ্চপ্রদীপখানি। দা, বঁটি, নারকেল কুড়ুনি হয়ত এনেছিল পথে বিপদ হলে আত্মরক্ষার জন্য। ভারী পঞ্চপ্রদীপখানি সত্যি দেখার মত ছিল। এদের মত অনেকেই এদেশে এসে কিছু না কিছু ব্যবসা শুরু করেছিল, যার মধ্যে ছিল চিঁড়ের মোয়া, মুড়ির মোয়া, তিলের নাড়ু ইত্যাদি।
দেশের রাজনৈতিক বিপর্যয়ে কত লাখো মানুষের কত দুর্দশা হয়েছিল, কত মানুষের জান গিয়েছিল তার সব কিছু আর প্রত্যক্ষ করার দুর্ভাগ্য আমার হয়নি, যা শুনেছি তাতেই শিউরে উঠেছি। আমাদের প্রতিবেশী হয়ে আসা উদ্বাস্তু পরিবারগুলির মুখে মুখে যেটুকু শুনেছি সেইটুকুই তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি লেখায়।
এদিকে দু-বছরের মধ্যে আমার বাপের বাড়িতে ঘটে গেল বিপর্যয়। ১৯৫৩ সাল, আমার মেজদা হঠাৎ করে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন, রেখে গেলেন নিঃসন্তান যুবতী স্ত্রীকে। শোকে মা শয্যাগ্রহণ করলেন। ১৯৫৫ সালের ১৮ই জুন আমার দ্বিতীয়া কন্যার জন্ম হল। তার পিতামহী নাম রাখলেন গৌরী। দু’বছর পুত্রশোকে শয্যাশায়ী থেকে যখন আমার মা মারা গেলেন আমি তখন ২৫ দিনের আঁতুড়ে।
এদিকে তখন আমার শ্বশুরবাড়ির পরিবারেও শান্তি নেই। শ্বশুরমশাই পারিবারিক দুষ্পরামর্শে নির্বুদ্ধি হয়ে আমার কর্তাকে বাড়ি ছাড়তে বলেছিলেন। ১৯৫২ সালেই তাই আমরা বড় কন্যাসহ নৈহাটি শহরে ভাড়াবাড়িতে চলে যেতে বাধ্য হই। সংসারে কর্মী মানুষের অভাব, ঘরকন্না দেখার মত কেউ নেই আমার কিশোরী ননদটি ছাড়া।
এরপর আমার শ্বশুরমশায় কিছুদিনের মধ্যেই নিজের ভুল বুঝলেন, যাদের চাপে তিনি এই কাজে বাধ্য হয়েছিলেন, আমার সেই ননদরা তখন আর বাপের বাড়িমুখো হত না। শ্বশুরমহাশয় আমাদের বাড়িছাড়া করার আত্মগ্লানিতে ভুগতেন আর সারাক্ষণ বলতেন, ‘আমি রামের বনবাস দিয়ে কি পাপ যে করেছি তা আর ক্ষমার না।’ এই আত্মগ্লানিতে ভুগতে ভুগতেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বছর তিনেকের মধ্যেই পুরোপুরি শয্যা নিলেন, ১৯৫৭ সালের জুন মাসে তিনি পরলোকে পাড়ি দিলেন।
১৯৫৮ সালের ১৬ই জানুয়ারি আমার বর্তমানের তৃতীয়া কন্যা মৈত্রেয়ীর জন্ম হল। ঠাকুমা নাম দিলেন পার্বতী। ডাকনাম খুকুর চাপে পার্বতী নাম হারিয়ে গেল, স্কুলে ভর্তির সময় নাম হল মৈত্রেয়ী।
সে সময়ে আমাদের পারিবারিক অবস্থায় বিশেষ অবনতি ঘটে আমার স্বামীর অফিসের অব্যবস্থার কারণে। তিনি ছিলেন নৈহাটি পৌরসভার স্বাস্থ্যবিভাগের কর্মী। কাউন্সিলার আর প্রশাসকদের মধ্যে অজানা গণ্ডগোলে পৌর কর্মচারীদের মাসমাইনে অনিয়মিত হয়ে পড়ল। প্রশাসনের গণ্ডগোলের শিকার হল মাইনে নির্ভর কর্মচারীরা। আমার বড় কন্যা আশাপূর্ণা (উমা) তখন আট বছরও পূর্ণ করেনি। কিন্তু সেই বয়সেই সংসারের প্রতি, বোনেদের প্রতি তার যত্নশীল মনোভাব দেখে আমার অনটন জর্জরিত সংসারে যেন একটা অবলম্বন হয়ে ওঠার ইঙ্গিত পেলাম। মনে এক উপরি আশার সূচনা হল।
আমার সংসারে তখন চারটি প্রাণী। এর মধ্যে আমার তৃতীয়া কন্যা খুকু--মাস নয়েকের শিশু--নিউমোনিয়ার আক্রান্ত হল। দু-এক দিনের মধ্যেই তার প্রাণ নিয়ে টানাটানি অবস্থা হল। মেয়েদের প্রতি আমার কর্তার ছিল অন্ধ স্নেহ। আর্থিক এই দুরবস্থার মধ্যে কন্যার কঠিন অসুখে দিশেহারা হয়ে পড়লেন। ডাক্তার ডাক্তার করে চারিদিকে ছুটোছুটি আর টাকার সংস্থানের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বাড়ি ফিরেই ঘটল এক বিপত্তি। ঘরে রান্নাবাড়া দুদিন প্রায় নেই বললেই চলে, দুর্বল শরীর, আর মাথায় চিন্তার ভারে জর্জরিত তিনি কলতলায় হাতপা ধুতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেলেন শানের উপরে, মাথায় গুরুতর আঘাত লাগল, জখম গুরুতর। আমাদের পরিচিত ও পারিবারিক ডাক্তার ছিলেন ডাঃ সাধন মিত্র। একদিকে মরণাপন্ন কন্যা, অন্যদিকে দুর্ঘটনাগ্রস্থ স্বামী, হাতে টাকাকড়ির অভাব, আমি যেন অকুল পাথারে পড়লাম। এই অবস্থায় হাল ধরলেন এসে আমার ছোড়দা। ওনাকে নিয়ে গেলেন ডাক্তারের কাছে, মেয়ের ওষুধের ব্যবস্থা করলেন।
বেশ কিছুদিন পরে পিতাপুত্রী দুজনেই সেরে উঠল, সংসার পুনরায় মন্থর গতিতে চলতে লাগল। বড় কন্যা শিশু বিদ্যালয়ে খুবই সাফল্যের সঙ্গে প্রথম শ্রেণী উত্তীর্ণ হল। মুশকিল বাধল আমার মেজকন্যা গৌরীকে নিয়ে। দিদির বইপত্র তছনছ করার হাত থেকে নিবৃত্ত করার উদ্দেশ্যে তাকে সঙ্গী করে নিয়েছিলাম আমার সংসারের কাজে। বাজার থেকে আনা সবজি-আলু, বেগুন এসব মেঝেতে ছড়িয়ে দিয়ে এক, দুই করে গুনে গুনে ঝুড়িতে তোলার কাজ দিলাম। কাজে সাথে সাথে আমার বলে দেওয়া সংখ্যাগুলির নাম অচিরেই মুখস্থ করে ফেলল। লেখা শুরু হল চক পেন্সিল দিয়ে ঘরের মেঝেতে। স্বল্প দিনের মধ্যেই সংখ্যা, বর্ণপরিচয় এমনকি দিদির সাথে সাথে যুক্তাক্ষর সম্বলিত বাক্য অনর্গল পড়তে শিখে গেল। এবার ব্যস্ত দিদির সঙ্গে স্কুলে যাবে। তখনকার দিনে ছয় বৎসর না হলে সরকারি প্রাথমিক স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি নিত না। দিদির সঙ্গে সঙ্গে পড়তে পড়তে এতটা শিখে ফেলেছে, কী করে বাড়িতে বসিয়ে রাখা যায়? তখন স্কুলের মাস্টারমশায়ের অনুমতিক্রমে অগত্যা একবছর বাড়িয়ে স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেওয়া হল তাকে। তখন ভর্তির বয়সের ব্যাপারে নথির প্রয়োজন হত না, অন্তত গ্রামের স্কুলে তো নয়ই। তখন বার্থ সার্টিফিকেটের চল হয়নি, বাড়িতেই ছেলে মেয়ে জন্মাত দাইয়ের হাতে।
ছেলেবেলায় বড়দের মুখে একটা প্রবচন শুনতাম, ‘আগের হাল যেদিকে যায়, পিছনের হালটিও সেইদিকেই যায়।’ প্রবচনের প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেলেম আমার মেয়েদের মধ্যে। একজনকে অনুকরণ ও অনুসরণ করে আরেকজন এগিয়ে যাবার প্রবণতা আর উৎসাহ সবার মধ্যে। দিদিদের যখন গৃহশিক্ষক পড়াতে আসতেন তখন আমার তৃতীয়া কন্যা খুকু--অর্থাৎ মৈত্রেয়ী মেজদির পরিত্যক্ত আদর্শলিপি বইখানি নিয়ে তাদের পাশেই পড়তে বসে যেত। আদর্শলিপি শেষ হয়ে গেল, এবার অন্য বই দরকার, দিদিদের বই নিয়ে টানাটানি। এদিকে তারও পাঁচ বছর হয়ে গেল, স্কুলে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত। কেউ তাকে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছে না দেখে একদিন নিজেই নিজের ব্যবস্থা করে ফেলল। আসলে আমার মৈত্রেয়ী ছেলেবেলা থেকেই স্বনির্ভরতায় বিশ্বাসী আর স্পষ্টবাদী। একদিন সকালে এক কাণ্ড করে বসল। সকাল নটায় স্নান করে নিয়ে, মাথায় আঁকাবাঁকা সিঁথি কেটে মাথা আঁচড়ে, চোখে কাজল দিয়ে, কপালে কাজলের টিপ পরে, স্লেট পেন্সিল আর ছেঁড়া আদর্শলিপিখানা নিয়ে চলল স্কুলে। সোজা ক্লাসঘরে প্রায় সমবয়সীদের সঙ্গে গিয়ে বসে পড়ল। সে স্কুলের হেডমাস্টামশায় ছিল ওদের বড়কাকা। সে তো অবাক, জিজ্ঞেস করল তুই স্কুলে এলি যে, ভর্তি হয়েছিস? সোজা বলে দিল--না, আজ ভর্তি হব। কাকা তখন প্রশ্ন করে দেখল যে আদর্শলিপি প্রায় মুখস্থ। কাকা তখন বয়স বাড়িয়ে নিজেই সই করে ভর্তি করে নিল প্রথম শ্রেণীতে। শুরু হল সমবয়সীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার লড়াই। তখন স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে বৃত্তি পরীক্ষা চালু ছিল। সেই পরীক্ষায় নিজের চেষ্টায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে পাশ করল, প্রাথমিক স্কুল তারও শেষ হল। এবার ভর্তি হল গিয়ে আদর্শ বিদ্যানিকেতন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে।
পড়াশুনায় এদের উদ্যম, উৎসাহের সঙ্গে সংসারের ছোট ছোট নানা কাজে এদের উৎসাহ দেখে আমার মনের গোপনে এক আশার আলো দেখা দিল। পারিবারিক নানা প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতাকে তুচ্ছজ্ঞানে একপাশে সরিয়ে রাখলাম। এদের মনে নিত্যনতুন কাজের প্রেরণা জোগানোর চেষ্টায় মন দিলাম। সাংসারিক অনটনে আমার হতাশাগ্রস্ত মন এদের নানা কাজে, পড়াশুনা, খেলাধূলায় ব্যুৎপত্তি দেখে আমার মন সজীব হয়ে উঠতে লাগল। যে যার বয়স অনুপাতে কঠিনকে আয়ত্ত করার মানসিকতা, চেষ্টা আর কৌশল দেখে ভাবলাম এদের ভবিষ্যৎ হয়ত খুবই উজ্জ্বল হবে। মনে মনে ভাবতে লাগলাম যে উদ্দেশ্য যদি মহৎ হয় তবে মানুষের কোন ইচ্ছাই হয়তো অপূর্ণ থাকে না। এরাই হবে আমার প্রায় শূন্য জীবনে পূর্ণতার সোপান। বৎসরের পর বৎসর নানা প্রতিকূলতার মধ্যেই এরা যে যার জায়গা থেকে সফলতার দিকে এগিয়ে চলল। অনটনের সংসারের কোন আঁচই যেন এদের স্পর্শ করে না। এরা আপন আপন উদ্দেশ্যে স্থির। তাই সেই অভাব, অনটন আর ক্লান্তিকর পারিবারিক পরিবেশ আমাকেও স্পর্শ করতে পারল না। যাই হোক, আসি অন্য কথায়।
(ক্রমশ)