অলোকসামান্যা ফিনদেশি কবি সিরক্কা সেলিয়া (Sirkka Selja)-র (১৯২০-২০১৭) একগুচ্ছ কবিতা অনুবাদ করেছিলাম ইতিপূর্বে, যা প্রথমে পরবাস-এ প্রকাশিত ও পরবর্তীকালে আমার কাব্যগ্রন্থ ‘বেস্কিড পাহাড়ের ভার্জিন মেরি!’-তে সঙ্কলিত হয়। এখানে রইল তাঁর ‘তমার গানগুলি’, মূল রচনা: Sirkka Selja, TAMAN LAULUJA, Werner Söderström Osakeyhtiö, Helsinki 1945. ফিনিশ থেকে এর ইংরিজি অনুবাদ করেন অ্যানি ফ্রিয়েদ (Anne Fried) (১৯০৩-১৯৯৮) এবং সেটি প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে, ফিনদেশি মহিলা কবিদের একটি অনূদিত কবিতার সংকলনে: Thank you for these illusions: Poems by Finnish women writers, Edited and translated by Anne Fried, Werner Söderström Osakeyhtiö, Finland 1981. অ্যানি ফ্রিয়েদ জন্মসূত্রে অস্ট্রিয়ান, তাঁর সাহিত্য জীবন বিস্তৃত আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এবং ফিনদেশে এবং ব্যক্তিগতভাবে তিনি সিরক্কা সেলিয়ার বান্ধব।
এই দীর্ঘ কবিতাটি আবর্তিত হয় তমা নামক এক রহস্যময়ীর উপস্থিতিকে ঘিরে। তমা মানবী কিনা জানা নেই, তার চারপাশে বিবর্তিত হয় ফিনদেশের নিসর্গ, সেই পরিমণ্ডলে কবিতার এক নিজস্ব পরিসর সৃজিত হয়। কোনো এক অচেনা পরদেশী তমাকে জাগ্রত করেছে, এই কবিতায় তার প্রত্যাবর্তন দেখি একাধিকবার। তমাকে আমার ফিন দেশের অন্তরাত্মা বলে মনে হয়, যার মধ্যে মিশে যায় তৎকালে এক নব্য যুবতী সিরক্কা সেলিয়ার জাগতিক অভিজ্ঞতার সারাৎসার: তমার অবয়বে তার স্রষ্টাকে আমি বারবার খুঁজে পাই। প্রতিটি পাঠে এই কবিতা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। ১৯৪৫ সালে ফিনিশ ভাষার কবিতা এই আঙ্গিকে লেখা হতনা। সিরক্কা সেলিয়া চিরকাল দুঃসাহসী। এই কবির হাত ধরে পরাবাস্তবতা একদিন প্রবেশ করবে ফিনদেশী কবিতায়, তার নবজন্ম হবে। এর সোচ্চার পূর্বাভাষ রয়ে গেছে তমার সঙ্গীতের প্রতিটি অংশে।
আমার দুর্ভাগ্য যে অজস্রবার ফিনদেশে যাতায়াত করেও সিরক্কা সেলিয়ার সান্নিধ্য পাইনি কখনো। শুনে চমকিত হয়েছি যে হান্নেলে পোহিয়ান্মিয়েসের ফিনিশ অনুবাদের কল্যাণে তিনি আমার কবিতার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন এবং আমার লাপ্পেনরান্তা কবিতাটি তাঁকে তাঁর একদা প্রেমিক পাবলো নেরুদার কথা স্মরণ করাতো! আমার এই অনুবাদ আমি সেই স্নিগ্ধ স্মৃতিতে সমর্পণ করলাম।
আমার অনুবাদ নির্মিত হয়েছে প্রধানত অ্যানি ফ্রিয়েদের অনুবাদটির অবলম্বনে। এক্ষেত্রে আমি নিঃশর্ত সহায়তা পেয়েছি হান্নেলে পোহিয়ান্মিয়েসের কাছ থেকে। মূলের পাশাপাশি ইংরিজি অনুবাদের প্রতিটি পঙক্তি তিনি খুঁটিয়ে পড়েছেন, এবং মূলের সঙ্গে ইংরিজি অনুবাদের অজস্র সূক্ষ্ম অমিলের ব্যাপারে আমাকে অবহিত করেছেন। তাঁর কাছে আমি ঋণী। আমাকে এই অনুবাদ প্রকাশের অনুমতি দিয়েছেন প্রকাশনা সংস্থা Werner Söderström Osakeyhtiö, Sirkka Selja estate এবং Anne Fried estate। তাঁদের সবাইকে কৃতজ্ঞতা।
রইল তমার গানগুলি, বঙ্গভাষী পাঠকের জন্য।
একটা কুঁড়িই ছিল তমার আত্মা
এলো কে যেন এক অচেনা পরদেশী, তাকে জাগালো
হায়াসিন্থ ফুলের সৌরভে ছিল তমার আত্মা
অথচ চলে গেছে সেই পরদেশী
তমা একদম একা
অচেনা কেউ আর আসবে না, আর কখনো জাগবে না সে
তাকে ঘুমতে দাও গাছের ছায়ায়, ঘাসের বিছানায়।
*
সাপ আসে তমার কাছে
বলে: খেয়ে নাও তমা, এটা এনেছি জ্ঞানবৃক্ষ থেকে
তমা বলে সে খেতে চায় না,
তমা থাকতে চায় সহজ হয়ে
অন্য কিছু তাই তমার চেয়ে জ্ঞানী।
তমার জ্ঞান সে এক গভীর কূপের মত
বসন্তে যার চুঁইয়ে পড়া জলধারা গুলো মিশে যায় ধরিত্রীর আরও অনেক গভীরের জলে
সমস্ত জ্ঞানের জননী এই জল, তার পরে আর জানবার কিছু নেই
তমা জানে সবকিছু যা ধরিত্রী জানেন, জানে তাঁর জল।
*
তমার আনন্দ ছড়িয়ে আছে চাঁদে
পূর্ণচন্দ্র, পূর্ণ তমার আনন্দ
এই চাঁদ কাল থেকে আর থাকবে না
নেচে ওঠ তমা, কাল থেকে তমাও তো আর থাকবেনা।
*
পরদেশী সেই অচেনা মানুষ বুঝবার আগেই তমা চলে গেছে।
তমা হেঁটে চলে গাছেদের রাজ্যে, একদম একা
পুড়ছে তার শরীর
যা কিছু নিজের ছিল, সবটুকু সে বিলিয়ে দিয়েছে
শুধু দুটো স্বপ্ন এখন তার সম্পদ
তার দিকে চেয়ে থাকা এক অচেনা মানুষের স্বপ্ন
তার কোলে ঘুমিয়ে থাকা একটা ছোট্ট শিশুর স্বপ্ন
শিশুটির চুলে শিহরণ জাগছে তমার কাঁধে
শুনশান হোক সবকিছু! তমাকে কেউ জাগিও না।
*
পশুরা তমাকে দংশন করেনা
বনের গাছেরা তাকে আশ্রয় দ্যায়
তার নিজের যা কিছু ছিল সব তমা বিলিয়ে দিয়েছে
তমার সম্পদ শুধু সেই দুটো স্বপ্ন:
সেই এক অচেনা মানুষের স্বপ্ন যে তমার দিকে চেয়ে ছিলো
আর একটা ছোট্ট ছেলে যে ঘুমিয়ে ছিলো তমার কোলে
এই স্বপ্ন দুটোও যদি কেউ আকুল ভাবে চায়, তমা তবে তাও বিলিয়ে দেবে
তমা আজ কেউ নয়, কিছু নয়; প্রকৃতির প্রত্যাশার কাছে সে আত্মসমর্পিত।
*
তমা যেন সমুদ্রের শাদা বালির মতো:
যে শুধু অপেক্ষা করে আর মেনে নেয়
বালির তো কোনো তাড়া নেই সমুদ্রের কাছে যাবার
সে শুধু তার দুহাত বাড়িয়ে দ্যায়
বালির নিজস্ব কোনো ইচ্ছা নেই, তার ভাগ্য তার নিজের হাতে নেই
যে কোনো ভবিতব্যে বালির তো ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
*
তমা চাঁদের মতো জন্মায় আর মরে যায়
তমা বাতাসের মতো বয়ে যায়, জলের মতো বদলে যায় তার গড়ন
তমার জন্ম সূর্যোদয়ে, তমার মৃত্যু সূর্যাস্তে
কাল যারা তমাকে চিনতো আজ তারা তাকে চিনতে পারবে না
হেমন্তের তমা বদলে যায় বসন্তে
ওই অচেনা মানুষ আসাতেই বুঝি তমা পেয়েছিল তার অস্তিত্ব
ওই পরদেশী মানুষই তাকে সৃষ্টি করেছিলো তার চলার পথে একটা ফুলের সুগন্ধের মতো
ওই অচেনা পরদেশী তাকে সৃষ্টি করেছিলো তার মৃত্যুপথের সহযাত্রী করে।
*
নতুন চাঁদের দিনে তমা অপেক্ষা করেছিলো
তমা আজও অপেক্ষা করে আছে এই পূর্ণচন্দ্রে
তমার ওষ্ঠে কোন শব্দ নেই, তমার চোখে কোনো জ্যোতি নেই
হ্রদের ওপর চাঁদের আলোর মতো তমা মিলিয়ে যাচ্ছে
তমার শরীর যেন একটা কাপড়ের স্তূপ
তমা জেগে আছে! রাস্তায় পায়ের শব্দ
বলো যে তমা হল মাঠে ঝরে পড়া একটা শিশির বিন্দু
বলো যে তমা চলে গেছে মিলিয়ে যাওয়া বাতাসের সাথে।
*
বিপুল তরঙ্গে ভাসছে তমার ছোট্ট নৌকো
গতির উন্মাদনা তাকে থামতে দ্যায় না
আনন্দের জন্য নয়, যন্ত্রণার জন্যও নয়
জলজ লিলি ফুল শুধু জানে যে
প্রতিটি সমুদ্রই আসলে ভালো
একইরকম ভালো যে কোন উপকূলে বিশ্রাম নেওয়া
আর মৃত্যু ঠিক একইরকম সবখানে, তা সে যেখানেই হক না কেন।
*
রহস্যময়ী তমা।
কেউ কখনো জানেনি কোথা থেকে এসেছে সে কিংবা কোথায় চলেছে সে
জলের স্ফীতির নাম তমা বাতাসের নিশ্বাস ও সে
তমা একটা অদৃশ্য শক্তির দৃশ্যমান হয়ে ওঠা
এই অদৃশ্য শক্তিই প্রবাহিত করে জলস্রোত, ফুল ফোটায় ঝোপগুলোতে
তামার শরীর গড়ে ওঠে টুকরো টুকরো অদৃশ্য শক্তির সমন্বয়ে
আর তমার ইচ্ছার সবটাই বুঝি অদৃশ্য কারুর ইচ্ছা।
*
তমার ভালোবাসা কীরকম তা বোধহয় তোমার জানা নেই
তমার ভালোবাসা হল জলের মতো, এস স্নান কর তমায়
একটা সেতু হল তমার ভালোবাসা, তুমি হেঁটে যাও তার ওপর দিয়ে
তমার ভালোবাসা বাতাসে দোলা গাছের শাখা,
তমা তার নিজের ইচ্ছা ভুলে গেছে
তোমাদের ইচ্ছার কথা শুনতে চেয়ে
তমা তার নিজের খামখেয়ালিপনা ভুলে গেছে
তোমাদের খামখেয়ালের কথা শুনতে গিয়ে
রাত্রি হল তমার প্রেম, তমা বাষ্পের মতো উবে যায় সৃষ্টি করবে বলে
উর্বর পৃথিবী তমার প্রেম, তোমাদের প্রতিটি শব্দ তমায় নিষিক্ত হবে
গভীরতা হল তমার প্রেম, নেমে যাও তমার গভীরে।
*
সন্ধ্যার বাতাসকে দূরে সরিয়ে রেখো না। তমা আসছে তোমার কাছে ওই সান্ধ্য সমীরে
ওই সান্ধ্য বাতাসের প্রশ্বাস শীতলতা বুলিয়ে দিচ্ছে তোমার কপালে
ওই সান্ধ্য বাতাসের প্রশ্বাস উষ্ণতা বয়ে আনছে তোমার শরীরে
শোনো ওই বাতাসের শিরায় শিরায় বসন্তের মৃদু কণ্ঠস্বর
তোমার নিজের সময় যদি ফুরিয়ে আসে
জেনো ওই সন্ধ্যার বাতাস তার নিজের সময় থেকে কয়েকটা বছর তোমার জন্য রেখে দেবে।
একদিন এই সন্ধ্যার বাতাস প্রাণ পেয়েছিল তোমার হাতে
তার নিজের জীবন সে আজ তোমায় বিলিয়ে দিতে রাজি।
*
তমা এগিয়ে আসে তোমার দিকে, তার আঙুলে সে ধরে রেখেছে সূর্য
হে, আঙুল বল কোথায় এ সূর্য ফেললে তুমি
তমা তোমাকে আড়াল করে রেখেছে সূর্যাস্তের আলোয়
মিলিয়ে যাচ্ছে সূর্যাস্তের আলো, সূর্য ডুবছে বনভূমির অন্যপ্রান্তে
ম্লান হয়ে আসা সূর্যাস্তের দ্যুতি ডুবে যাচ্ছে কৃষ্ণ বনবীথির আড়ালে
চিরতরে হারিয়ে যেতে চাইছে কালো জলের ধার ঘেঁষে।
*
এই হ্রদ শুনেছে তমার গান
ঘাসেরা ছুঁয়েছে তমার হাঁটু আর বলেছে:
কি সুখী তুমি তমা, সত্যি কি সুখী।
সূর্যাস্তে সবকিছু ঘরে ফিরে গেছে
অন্ধকার মিলিত হল পৃথিবীর সঙ্গে, আর জলের সঙ্গে আকাশ
এই হ্রদ এখন তার অন্ধকার কোলে মাছেদের ঘুম পাড়াচ্ছে দোদুল দোলায়
পাড়ে বসে আছে তমা, একদম একা
তমার বুকে শূন্যতা, কী যেন কাঁদছে তমার বুকে
শুধু এক দুঃখী ছায়া শুনে চলেছে তমার গান।
*
সূর্য পরিণত হয় চাঁদের আলোয়
আর তমার গান হয়ে ওঠে তার জীবনীশক্তি
খুনী তমা, কোথায় তমার ওই ছোট্ট শিশুটি?
জলের গভীর থেকে কেঁদে ওঠে তমার গান:
আমাদের সঙ্গে আছে সে, তোমার ওই ছোট্ট শিশুটি।
*
এক বিচিত্র রমণীর সন্তান ঘুমিয়ে ছিলো তমার বাহুতে
স্তব্ধ বাতাস, স্তব্ধ বনবীথি, সবকিছু শুনশান স্তব্ধ
তখন হঠাত স্প্রুস গাছগুলোর পেছন থেকে জ্বলে উঠল একটা তারা, পুড়তে লাগল
তারাটি কথা বলেনি, শুধু তমার চুলে রেখে গেছে একটা সোনালি আভা।
*
তমা এখন পুরোপুরি সূর্যের আশ্রয়ে
তমাকে এখন ভাবতে হয়না কী হচ্ছে বা কী হতে চলেছে।
যদি সাপ তমাকে দংশন করে, সেটা তবে তমার ভবিতব্য
যদি সাহায্য আসে অনেক দেরি করে, তবে সে সাহায্য তমার জন্য নয়
যখন অন্ধকার পায়ে পায়ে হেঁটে আসতে থাকে বাগানের ঘাসে
তমা তখন অন্ধকারের রোমশ বুকে মুখ লুকোয়
যা ভবিতব্য তমা তার বিরুদ্ধে যায়না।
*
তমার শরীর যতদিন সুন্দর
ততদিন তার বন্ধু তাকে ভালোবাসে
যখন বইতে থাকে শরতের বাতাস
তমার শরীর নামতে থাকে নীচে
সমস্ত মৃতদের সঙ্গে সে ঘুমোবে বলে
তমার মা আসেন তখন, তমাকে উঠিয়ে নেন পাঁজাকোলা করে
নেমে আসে অন্ধকার, তাতে তখন ভয় পাওয়ার কিছু নেই
কেননা তমার মা তাকে ভালোবাসেন, চিরকাল ভালোবাসেন ...
*
তমাকে যদি মানুষ না হতে হত
তবে ছোট একটা ঝর্ণা হয়ে বইত তার শোণিত, তার আঙুলগুলো হয়ে উঠত ঘাস
তখন তমার শরীর হয়ে উঠত মাটি, তাতে যত্নে বেড়ে উঠত সুগন্ধি গুল্ম কিছু
আকাশ ঘিরে থাকত তমাকে, সেই অচেনা মানুষের নিশ্বাসের মত
আর তমার সমস্ত চৈতন্য মিশে যেত সমুদ্রের অসীমে।
*
একটা ছাইয়ের কুচি আটকে আছে রেলিং এ, যেখানে একদিন এক অচেনা পরদেশী ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিল
গ্রীষ্মের বাতাস বইছে ওই রেলিং এর ওপর দিয়ে, তমা ভাবছে:
কী কবোষ্ণ এই বাতাস, কীভাবে তা তমার বাহুকে আলিঙ্গন করছে
নীচের সবুজ পাতাগুলো যেন কারুর নরম কোল
তমা হাত বুলোচ্ছে ওই রেলিং এ, ভাবছে শুধু একটাই কথা:
ওরা নিশ্চয় তমার যত্ন করবে।
*
তমা নিজেই একটা সমুদ্র, গভীরতা কেঁদে উঠছে সেই সমুদ্রে
তমা নিজেই ওই রাতের চাঁদ: একটা একাকী জন্তু কেঁদে যাচ্ছে চাঁদের আলোয়
নিয়ে এসো তোমার চকচকে ছুরি, সটান বসিয়ে দাও তমার বুকে
যেসব চাওয়াগুলো সারাক্ষণ গুমরে মরে তমার মধ্যে, তারা তখন আর কাঁদবে না।
*
একটা কবর হল তমার বুক
তমার বুকে ঘুমিয়ে আছে একরাশ না বলা বাণী
আর সমস্ত মুহূর্তগুলো হারিয়ে গেছে শূন্যতায়
অর্থহীন দিনগুলোর দিকে ছুটে যাচ্ছে তমার লাবণ্য
অর্থহীনভাবে পুষ্পিত হতে, অর্থহীন আনন্দে
শেষে লুটিয়ে পড়ছে কারুর হাতে, যে হাত তমার জন্য নয়
তমার বিদায় বড় মর্মান্তিক: জলে ডোবার যন্ত্রণার মতো।
*
তমার হৃদয় একটা পাহাড়
শব্দের উচ্চারণ কত দুঃসাধ্য একটা পাহাড়ের পক্ষে
তবু ওই পাহাড়ের গভীরতা থেকে একটা স্বর বলে উঠছে: বিদায়!
আর তার পুনরাবৃত্তি করছে অশ্রুসজল গাছেরা:
বিদায়, বিদায়, বিদায়, বিদায় ...
*
তমা একটা ছায়ার মতো পালিয়ে যাচ্ছে অরণ্যের দিকে
তমা পালিয়ে যাচ্ছে, তার বুকে বেঁধা একটা ছুরি
ঘাসের ওপর ছড়িয়ে পড়েছে তার লাল রক্ত
সমুদ্রের ওপর দিয়ে তমা ভেসে যাচ্ছে চাঁদের মতন
ঢেউগুলো মুছে দিচ্ছে তমার চিহ্ন, তার অস্তিত্ব।
*
সবকিছু শেষ হয়ে গেলে একটা মাদকতা ভরিয়ে রাখে পেয়ালা
হে মাদকতা, আবৃত কর, তমাকে তার গোড়ালি পর্যন্ত
তৈরি কর তাকে এক সবুজ প্রান্তরের মাদকতা হিসেবে
অথবা যে মাদকতা জড়িয়ে থাকে বিপুল জলরাশির গুঞ্জনে
হে বিপুল জলরাশি, তমাকে তুমি রক্ষা কর
তার হৃদয়ে কোন আশা জেগে ওঠার আগেই
তার ওষ্ঠ কোন ভাষা খুঁজে পাবার আগেই
তার হাতদুটো তোমাকে জড়িয়ে ধরবার আগেই।
প্রত্যাশা করাটা খারাপ, প্রত্যাশা যন্ত্রণার জন্ম দ্যায়
তমাকে যারা ভালোবাসে তারা ভাবছে যন্ত্রণাহীন তমা ঘুমিয়ে আছে জলের ওপর
একটা একাকী তারার আলো ভাসছে তার চোখে।
*
তমার শ্রবণ এখন বধির
তমার ওষ্ঠ উত্তর দ্যায় না
তমার শরীরে জলজ গুল্মের আভরণ।
-- তুমি কি তমা? – না, তমা অনেক দূরে চলে গেছে।
-- কী করে তুমি চলে গেলে একটা কথাও না বলে?
-- যদি তুমি সময় থাকতে তমাকে জড়িয়ে ধরতে বুকে
তখন; যখন তমার চামড়ায় কিছুটা উত্তাপ অবশিষ্ট ছিলো।
*
তমা এখন ছায়া শরীরিণী
লোকে কথা বলে ছায়ার সঙ্গে, ছায়ার ঠোঁট উত্তর দ্যায় না।
তমার আত্মা পৌঁছে গেছে মৃত্যুর রাজ্যে
মৃত্যুর রাজ্যে পাখীরা গান গায় না
চেনা মুখগুলো ভুলে গেছে তমা
একমাত্র মৃত্যু তার সঙ্গে কথা বলে।
*
রাস্তার দুধারে কালো স্প্রুস গাছের সারি
অনেক উঁচুতে চাঁদ ভেসে যাচ্ছে কালো স্প্রুসের ওপর দিয়ে
কিন্তু ওই কালো স্প্রুসের পেছনে আছে একটা সাদা আর পরিষ্কার জায়গা
-- কী আশ্চর্য, তমা ফিরে আসছে
সাদা ঝোপেরা উৎসাহে ছুঁয়ে যাচ্ছে তার স্কার্ট
এখন তমা অনেক দূরে ... সত্যিই কি তমা ছিলো এখানে?
তার মুখ মৃত মানুষের মুখের মত সাদা।
*
সমুদ্রে গড়িয়ে পড়া রক্ত এখন সূর্য হয়ে উঠেছে
কেউ জানেনা তমা এখন কোথায়
শুধু সমুদ্র শুনেছে তমার বিদায়বাণী:
‘তবু মনে রেখো’।
*
ভোরবেলা সাগরবেলায় ফিরে আসে সেই অচেনা পরদেশী:
কোথায় তমা, আমার তমা, কী হয়েছে তার?
সমুদ্রের নিচে ঝিনুকেরা তাকিয়ে আছে তমার দিকে:
তমার আত্মায় কোনো ঝিনুকের ঢাকনা নেই
কত সহজ তাকে হত্যা করা।
*
সূর্যোদয়ে তামসী তার অবগুণ্ঠন গুটিয়ে নিচ্ছে
তার কোমর এখন খুব সরু, প্রায় অদৃশ্য
ওই ক্ষীণতনু তামসী বিদায় নেওয়ার আগে অস্ফুটে বলছে:
দ্যাখ, সারা উপকূল জুড়ে নিদ্রাহারা রাতের চিহ্ন ছড়িয়ে আছে
এইসব চিহ্নের অর্থ আছে একটা, মনে রেখো আমার এই কথাটা ...
ফুঁসে ওঠে ভোরবেলার বাতাস, বিতিক্ত আর হিংস্র
এই ভোরবেলার বাতাস পরিষ্কার করে দেবে ভারাক্রান্ত মস্তিষ্ক, রাতজাগা চোখের দংশন
কোন শব্দ উচ্চারণের আগেই তমা অদৃশ্য হয়েছে, মিলিয়ে গেছে শিশিরের মত
কেউ জানেনা কোথায় সে বিশ্রাম করছে সাদা ফুলেদের পাশে।
*
তমিস্রা আবৃত করে তমাকে তার উষ্ণ প্লাবনে
আবৃত করে তার শরীর, তার চোখদুটি
তারারা ঘুমতে গেছে, গাছের ছায়ারা নিদ্রামগ্ন
কিছু জেগে নেই, শুধু কিছু স্পন্দন ছাড়া
রাতের নিজস্ব স্পন্দন, তমার শরীরের স্পন্দন
তমা কি চাইছে কিছু? সব হিসেব তো মিলে গেছে
তমা কি শোকার্ত এখন? সবকিছু তো সুরক্ষিত
বধূটি তার স্বামীকে খুঁজে পেয়েছে, মা তাঁর সন্তানকে
নামগুলো উবে গেছে, উবে গেছে যাকিছু একসময় ছিল তমা
নিদ্রা তার প্রিয়তমর বাহুলগ্না
বিস্তৃত রাত্রি তার শয্যা।