• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৭ | জানুয়ারি ২০২০ | গল্প
    Share
  • আস্তানা : সুবীর বোস


    ভোজের হাট ব্রীজ। ব্রীজ পুরোপুরি চালু হবার আগে এখনও টুকটাক কাজ চলছে ব্রীজের এখানে-সেখানে। এখানেই — নির্মীয়মান ভোজের হাট ব্রীজের ঠিক গোড়ালির নিচে রাজুর চায়ের দোকান। রাজু তখন খুব মন দিয়ে একটা অমলেট তৈরি করছিল। দোকানে হঠাৎ সুবল মিত্তিরের প্রবেশ। সুবল মিত্তির, যিনি কিনা এই ভোজের হাট এলাকার নেতা — তিনি এসেছেন দেখে রাজু প্রায় নুয়ে পড়ে বলল, বসেন সুবলদা বসেন, চা খান।

    — নাহ্‌, আজকে আর চা খাওয়ার সময় নেই রাজু। সে যাক আমি আসলে তোর কাছেই এসেছিলাম। কথা আছে। সুবল মিত্তিরের দ্রুত উত্তর।

    — আরে এক মিনিট লাগবে চা বানাতে। একটু বসেন তো। রাজুর তোষামুদে আপ্যায়ন।

    — না, রাজু শোন, যেটা বলার সেটা আগে বলেনি। আর ক’দিনের মধ্যেই এই ব্রীজ চালু হয়ে যাবে। সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। তার আগেই ব্রীজের নিচ থেকে তোদের সব্বাইকে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে। “প্রায়” কোনও ভূমিকা ছাড়াই সুবল মিত্তির গড়গড় করে বলে গেলে তাঁর যা বলার ছিল।

    এমনতর বিস্ফোরণের জন্য রাজু তৈরি ছিল না। তার হাত থেকে আরেকটু হলেই গরম চা ভর্তি গ্লাস উলটে পড়ছিল।

    রাজু জানে, এ পাড়ার নেতা, প্রায় বেশির ভাগ লোকেরই “সুবলদা” আসলে রাজুর থেকেও রাজুর বউ নিরুপমাতে মগ্ন বলেই — গোড়াতে তাঁর মুখে এমন মিষ্টি করে “তোকেই খুঁজছিলাম” গোঁজা। সে নিশ্চিত ছিল, যতদিন সুবল মিত্তির আছে — ব্রীজের নিচে তার আস্তানা আর দোকান নিয়ে চিন্তা না করেলও চলবে।

    এই ভোজের হাট ব্রীজের নিচে রাজুর নয় নয় করে প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেল। রাজুর ছেলে পচারই তো এখন বয়েস হয়ে গেল প্রায় দশ বছর। ব্রীজের নিচে রাজুর চায়ের দোকানটা এখন পচাকে ছাড়া প্রায় চলেই না। ছেলেটা যেমন সুন্দর চা বানায় তেমনি অমলেট। এই জায়গা, এই দোকান, এই আস্তানা ছেড়ে চলে যেতে হবে ভেবে রাজুর পায়ের তলার মাটি যেন নড়ে গেল।

    তাৎক্ষণিক সে বিড়ম্বনা কাটিয়ে, একটুও সময় নষ্ট না করে রাজু হাত জোড় করে সুবল মিত্তিরকে বলল, তাহলে সুবলদা আমাদের এখন কী হবে? আমার চায়ের দোকানটারই বা কী হবে? আমরা তো এবার না খেতে পেয়ে মরব। এই দোকান, এই ঘরদোর এসব ছেড়ে যাবই বা কোথায়? আপনিই তো আমাদের সব — কিছু একটা করুন।

    রাজুর কথা শুনে সুবল মিত্তির প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে থাইয়ের কাছটা একবার ভালো করে চুলকে নিয়ে বলল, দ্যাখ রাজু, আমার কিছু করার নেই। অনেক উপর থেকে অর্ডার এসেছে — ক’দিন পরেই এই ব্রীজটার উদ্বোধন হবে আর তার আগে ব্রীজের নিচটা খালি করে দিতে হবে। বুঝতেই পারছিস আমার কিছুই করার নেই।

    সুবলদার উত্তর শুনে রাজুর পিত্তি জ্বলে গেল। তবু নেতা বলে কথা, তাকে তো আর যা তা বলা যায় না। সে জন্যে সেঁকা পাউরুটিতে দুধের সর মাখানোর ভঙ্গিতে রাজু এবার তার ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করার ভঙ্গিতে বলল, সুবলদা, আপনিই বলুন এখন আমরা বাপ-বেটা নয় এখানে-ওখানে জায়গা করে নেব। কিন্তু নিরু...! কথা বলবার সময় রাজু “নিরু” শব্দটার উপর একটু বেশি জোর দিল।

    রাজুর কথা শেষ হওয়া মাত্রই মনে হল রাজুর ছুঁড়ে দেওয়া বলটা সুবল মিত্তির লুফে নিয়েছে। মাথার বেঁচে থাকা গোটা পঞ্চাশেক চুলের গোড়ায় আঙুল বোলাতে বোলাতে খুব চিন্তিত মুখে সুবল মিত্তির বলল, হুম, এটা অবশ্য চিন্তার কথা রাজু। আচ্ছা দেখছি কী করা যায়।

    সুবল মিত্তিরের বাড়িতে নিরুপমা, মানে নিরু, মানে রাজুর বউ ঠিকে ঝি-এর কাজ করে। ঠিকে ঝিকে কী করে ঠিকঠাক ব্যবহার করা যায় — সেটা সুবল খুব ভালোই জানে। সে জন্যেই বোধহয় সুবল বিয়ে-থা করেনি। প্রথম প্রথম রাজু ব্যাপারটা কিছুই জানত না। দিন কয়েক পর ব্যাপারটা রাজুর মাথায় ঢুকে পড়ার পরেও কোনও সমস্যা হয়নি। কারণ রাজু্র নিজেরও পাশের ঝুপড়ির কমলার সঙ্গে বেশ কিছুদিন হল একই চক্কর চলছে। এ ছাড়া “বাস্তববাদী” রাজু যখন দেখল নিরুর দৌলতে ব্রীজের নিচে তার আস্তানায় দুটো বাড়তি দরমা হলো, মোটামুটি একটা চায়ের দোকান হলো — সে ব্যাপারটাকে আরও ভালোভাবে মেনেই নিয়েছে।

    সুবল মিত্তির “আচ্ছা দেখছি কী করা যায়” বলে চলে যাবার পর রাজুর কমলার কথা মনে পড়ল। রাজু দেখেছে যখনই তার সুবল মিত্তিরের সঙ্গে দেখা হয় — তার মনে পড়ে কমলার কথা। ব্রীজের নিচের ডেরা ছেড়ে চলে যেতে হতে পারে এমন খারাপ সম্ভবনার দিনেও রাজুর মনে হয় — যেতে হবে কমলার কাছে।

    যেমন ভাবা তেমনি কাজ। ততক্ষণে দোকানে পচা এসে গেছে দেখে রাজু ছেলেকে বলল, পচা, তুই দোকানটা দেখ, আমি একটু ঘুরে আসছি। কাজ আছে। দশ বছরের পচা এতদিনে ভালোই জেনে গেছে তার বাবার এই “কাজ আছে” ব্যাপারটা সম্বন্ধে। সে তাই মন দিয়ে পেঁয়াজ কাটতে কাটতে বলে, ঠিক আছে। একটু তাড়াতাড়ি এসো কিন্তু।

    দোকান পেরিয়ে বিশ পা গেলেই কমলার ঘর। রাজু কমলার ঘরে ঢুকে দেখল সে তখন আলু কাটছে। রাজুকে দেখে কমলা তার গায়ের অগোছালো কাপড় ঠিক করতে করতে বলল, বোসো। কমলার এই অগোছালো কাপড় ঠিক করা দেখে রাজু হাসে। তারপর বলে, কমলি, তোর এই ব্যাপারটা আমি বুঝি না।

    — কোন ব্যাপারটা?

    — এই যে এইমাত্র আমাকে দেখে গায়ে ভালো করে কাপড় গুছিয়ে নিলি। কী যে ঢাকিস কে জানে...

    রাজুর কথা শুনে কমলা হাসে। সে বুঝতে পারে রাজু কথাটা ভুল কিছু বলেনি। তবু সে রাজুকে বলে, সে তুমি বুঝবে না।

    কমলার বর বিজয় বিহারের ছাপরা জেলার লোক। বিজয় একটা ট্রান্সপোর্ট কোম্পানীর লরির খালাসি। মাসের মধ্যে কুড়ি দিন বাইরে থাকা বিজয় তার বউয়ের কীর্তি-কলাপ সব জেনেও শুধু মাত্র কমলার বিশেষ বচনের ভয়েই তাকে কিছু বলতে পারে না। মাঝে বিজয় কয়েক মাসের জন্য কমলাকে প্রায় জোর করেই দেশের বাড়িতে রেখে এসেছিল। সেখান থেকে ফেরার পর এখন কমলা বিজয়কে ঠেঁট হিন্দীতেই গালি-গালাজ করে। ওই গালাগাল সবচেয়ে খুশি করে, বলাই বাহুল্য রাজুকে। খুব নিরীহ গোছের বিজয় রাজু-কমলার এই “রস-মিলান্তি” বন্ধ না করতে পারলেও — হাল ছেড়ে দেয়নি। সে অপেক্ষায় আছে — কবে আসবে একটা সুযোগ...।

    রাজু কমলাকে বলে, তোকে একটা জরুরী কথা বলতে এলাম।

    — তোমার তো সব কথাই জরুরী। কমলা তার হাসিতে অন্য মাত্রা এনে বলে।

    — না, এটা তেমন কথা নয়। একদম অন্য কথা। খুব চিন্তার কথা।

    — আরে অত ঢ্যামনামো না করে বলেই ফেল না কথাটা।

    — আজ সুবল মিত্তির এসে বলে গেছে ব্রীজের নিচ থেকে আমাদের উঠে যেতে হবে।

    — বললেই হল নাকি?

    — না রে, এবারে বোধহয় এই জায়গা ছাড়তেই হবে। কী যে হবে – আমি ভাবতেই পারছি না।

    — ছাড়ো তো, কিছুই হবে না। ওই সুবল মিত্তিরের বোধহয় এখন আর তোমার বউকে ভালো লাগছে না, তাই ঢ্যামনাটা ও সব বলছে। আজকাল মাঝে-মাঝেই দেখি ঢ্যামনাটা বিজয়কে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে কী সব কথা বলে। আর সুযোগ পেলেই আমার দিকে খুব অসভ্যর মতো তাকায়।

    — বলিস কী রে! তোকে কিছু বলেছে নাকি?

    — না, অত সাহস হবে না। আসুক না একবার হাবিজাবি কিছু বলতে। এমন দেব...

    — যাক গে ও সব ছাড়। কাছে আয়। রাজু কথা ঘুরিয়ে “নিজের কাজে” মন দেবার চেষ্টা করে।

    রাজু আর কমলা “কাছাকাছি” আসার আগেই পলকা দরজায় খটখট শব্দ শোনা গেল। শব্দটা শুনে কমলা রাজুর থেকে কিছুটা সরে গিয়ে বলল, কে? উল্টোদিক থেকে জবাব এল, আমি নিরু। পচার বাবা আছে নাকি এখানে?

    রাজু, নিরুপমা আর কমলার এই বোঝাপড়াটাও মনে দাগ কেটে যাবার মতো। আসলে নিরুপমার এমন বিনীত আচরণের পিছনেও সেই “সুবল সখা” জাতীয় অনুমোদিত ব্র্যান্ডটা কাজ করে। নিরুপমার গলা পেয়ে ঘরের ভিতরে কমলা রাজুকে বলে, এখন যাও — তোমার ডাক পড়েছে।

    রাজু বাইরে এসে দেখে নিরুপমা, ফ্যাকাশে চোখমুখ — তার জন্যে অপেক্ষা করছে।

    — কী হল তুমি আজ কাজে যাওনি?

    — গেছিলাম। সেখানেই তো শুনে এলাম সব। নিরুপমা থমথমে মুখে বলে।

    — কী শুনে এলে?

    — শুনে এলাম আমাদের এই জায়গা ছাড়তে হবে সাতদিনের মধ্যে।

    নিরুপমার কথা শুনে রাজুর মুখও ফ্যাকাশে হয়ে যায়। সে বলে, সেকি? সুবলদা যে বলল, দেখছি কী করা যায়।

    — সে বলে দিয়েছে যে সে কিছু করতে পারবে না। এ সব নাকি অনেক উপরের ব্যাপার।

    — তা, তুমি কিছু করতে পারলে না?

    রাজুর শেষ কথাটার ইঙ্গিত নিরুপমা বুঝতে পেরেই উত্তর দিল, সে বলেছে উধমপুরে একটা নতুন “বিরিজ” হচ্ছে। ওখানে তার বন্ধু আছে। আমরা চাইলে সে তাকে বলে দিতে পারে।

    — উধমপুর? সে তো অনেক দূর?

    — হ্যাঁ, এখান থেকে বাসে গেলে নাকি ঘন্টা দুয়েক লাগবে।

    নিরুপমার কথায় পুরোপুরি হতাশ রাজু কমলার কথা ভুলে গিয়ে বলে, চল, ঘরে গিয়ে কথা হবে।



    ভোর পাঁচটা নাগাদ রাজু, পচা আর নিরুপমা হাতে হাতে মাল তুলে জড়ো করছিল একটা ম্যাটাডোরে। ঘরের আর দোকানের মালপত্র সব তুলে দিয়ে রাজু পচাকে বলল, তুই তোর মাকে নিয়ে সামনে বস, আমি পিছনে থাকছি।

    রাজুর ধারণা ছিল কাউকে কিচ্ছুটি না বলে বেরিয়ে গেলে নতুন জায়গায় গিয়ে সে নিজের দোকানটা প্রথমেই চালু করে দিতে পারব। সেই মতো সে এমনকী কমলাকেও ব্যাপারটা জানায়নি।

    দিন দুয়েক আগে সুবল মিত্তির নিরুপমার হাত দিয়ে একটা চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছে। সুবল মিত্তির বলেছিল, চিঠিটা উধমপুরের নেতা গোপাল মণ্ডলকে দেখালে সেই বাকি ব্যবস্থা করে দেবে। সেই মতো রাজু সে চিঠি নিয়ে দেখা করেছিল গোপাল মণ্ডলের সঙ্গে।

    গোপাল মণ্ডল চিঠিটা হাতে নিয়ে বলেছিল, জায়গাটা দেখে এসেছ কি? না দেখে থাকলে দেখে এস। আর হ্যাঁ, এখানে থাকতে হলে মাঝে মাঝে আমাদের মিটিং-মিছিলে আসতে হবে। মনে থাকবে তো? রাজু মাথা নেড়ে “হ্যাঁ” বলে “জায়গাটা” দেখতে চলে গেছিল। দুটো বড় বড় পিলারের মাঝখানে একটা ভালো জায়গা দেখে সেদিন রাজু ফিরে এসেছিল।

    গাড়ি ছাড়ার ঠিক আগের মুহূর্তেই রাজু দেখল কমলা দৌড়ে আসছে তাদের ম্যাটাডোরের দিকে। রাজু বুঝতে পারল যে সে ধরা পড়ে গেছে এবং এখনই শুরু হবে কমলা-বচন। সে ড্রাইভারকে বলল, গাড়ি ছাড়ো ভাই, এরপর দেরি হয়ে যাবে। অল্প বয়েসী ড্রাইভারও বোধহয় কমলার ওই দৌড়ে আসা দেখে কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছিল। তাই সেও সময় নষ্ট না করে গাড়ি ছেড়ে দিল।

    রাজু ভেবেছিল, পিছন থেকে এরপর প্রচুর গালাগাল উড়ে আসবে। কিন্তু সে সব কিছুই হল না দেখে রাজু বেশ অবাক হল। একই সঙ্গে বেরনোর মুহূর্তে কমলার সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়াতে সে ভিতরে ভিতরে একটা কষ্ট অনুভব করা শুরু করল। তার মনে হল, কমলাকে এভাবে ফাঁকি দেওয়া তার উচিত হয়নি।

    গাড়ি উধমপুর পৌছানোর পর রাজু অবাক হয়ে দেখল তারই দু’চারজন একদা প্রতিবেশী তার আগেই সেখানে পৌছে গেছে। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হল রাজুর পছন্দ করা জায়গাটা এর মধ্যেই কমলার বর বিজয় দখল নিয়ে নিয়েছে। রাজুর মনে হল — তার মানে কমলাও তাকে ফাঁকি দিয়েছে। এ তো আর কেনা জায়গা না — তাই রাজু অন্য জায়গার দখল নিল। এবারের জায়গাটা ব্রীজের মাঝ বরাবর।

    নতুন এলাকা। নতুন দোকান। প্রথম দিনটা দোকান তৈরির পিছনে সময় দিয়ে রাজু পরদিন ঘুরে ঘুরে অন্য প্রতিবেশীদের খোঁজ নিতে নিতে আনমনে দাঁড়িয়ে পড়ল কমলার স্বামী বিজয়ের দোকানের সামনে। উদ্দেশ্য — যদি একবার কমলার দেখা পাওয়া যায়। রাজু আর বিজয়ের কথা নেই। তাই রাজু জানতে পারল না বিজয় লরির খালাসির চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে কিনা, জানতে পারল না কমলাও বিজয়ের সঙ্গে এখানে এসেছে কিনা।

    তারপর যেমনটা হয় — রাজুর চোখ তখন খুঁজছে কমলাকে। রাজুর চোখ-মুখ দেখে, অনুসন্ধানী দৃষ্টি দেখে বিজয় সব বুঝতে পারছিল। তবু সে কোনও কথা না বলে বাঁশের গায়ে পেরেকের উপর হাতুড়ির জোরটা শুধু একটু বাড়িয়ে দিল।

    রাজু ফিরে এল নিজের দোকানে। পচা তখন ব্যস্ত চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে। খদ্দের-পাতি প্রায় নেই বললেই হয়। রাজু বুঝতে পারছিল না দোকানটাকে দাঁড় করাতে না পারলে সে কী করবে এরপর। হঠাৎ পচা চেঁচিয়ে উঠল, বাবা, ওই দেখ সুবলকাকু।

    সুবল মিত্তির রাজুর চায়ের দোকানে ঢুকে বেঞ্চিতে বসতে বসতে বলল, রাজু, এক কাপ চা খাওয়া।

    — আরে সুবলদা আপনি। ভালো আছেন তো? বিনীত রাজু সুবল মিত্তিরের আরও ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করে।

    — হ্যাঁ, আমি ভালো আছি। তোদের দেখতে এলাম। এখানে সব ঠিক-ঠাক তো?

    — এমনিতে সব ঠিকই আছে। তবে দোকানে খদ্দের—পাতি খুব কম গো সুবলদা।

    — আরে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। সুবল মিত্তির এদিক-সেদিক চোখ ঘুরিয়ে — যেন কাউকে খুঁজছে এমন ভাব করে আশ্বাসবাণীটা ছুঁড়ে দেয়।

    — সে আপনি যখন আছেন...। রাজু আরও বিনয়ী।

    — আচ্ছা, এখানে বিজয়ের ঘর কোনটা? শুনলাম ও নাকি এখানে একটা চায়ের দোকান দিয়েছে।

    সুবল মিত্তিরের প্রশ্নটা রাজুকে একটা ধাক্কা দিয়ে যায়। তার মনে পড়ে সুবল মিত্তিরকে নিয়ে ক’দিন আগে বলা কমলার কথাগুলো। তবু চোখে-মুখে সে “চিন্তা”র চিহ্ন না রেখে সে দূরে আঙুল দেখিয়ে বলে, ওই তো বিজয়ের দোকান। যাবেন নাকি একবার সুবলদা?

    — হ্যাঁ, যেতে হবে ওখানে একবার। দে চা দে। চা-টা খেয়ে — একবার বিজয়ের ওখানে ঘুরে আসি।

    সুবল মিত্তির তাঁর “নির্দিষ্ট স্টপেজে” পৌঁছানো মাত্র বিজয় তার দোকান ছেড়ে উঠে এল। সুবল মিত্তির বিজয়ের পিঠে হাত রেখে বললেন, “কী বিজয়, সব ঠিক আছে তো?”

    — হ্যাঁ, হ্যাঁ, মোটামুটি সব ঠিক আছে সুবলদা। দোকানটা প্রায় তৈরি করে ফেলেছি। কাল থেকে চালু হয়ে যাবে।

    — তা তোর দোকানে কী কী পাওয়া যাবে?

    — চা, বিস্কুট...অমলেট...। বিজয় আমতা আমতা করে বলে।

    — তুই পারবি এসব বানাতে?

    — হ্যাঁ, পারব। ঠিক শিখে নেব দেখবেন।

    — ও নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। হয়ে যাবে। তোর বউ কই? তাকে কাজে লাগাবি না?

    — সে তো ঘর থেকে বেরতেই চাইছে না এখানে। কী করি বলুন তো? বিজয় আমতা আমতা করে।

    — আরে তাকে ডাক্‌। বল, আমি ডাকছি। সুবল মিত্তির গলি থেকে রাজপথে যাবার ভঙ্গীতে বলল।

    অবাক রাজু দেখল তার “সুবলদা” একবারও “নিরু”র কথা জিজ্ঞেস করেননি। কিন্তু বিজয়ের দোকানে এসে একথা-সেকথা থেকে সোজা ঢুকে পড়লেন “কমলা”য়।

    এল। কমলা এল। একদম সুবল মিত্তিরের নাকের ডগায় দাঁড়িয়ে একটু গলা চড়িয়েই কমলা বলল, কী ব্যাপার, আপনি আমাকে ডাকছেন কেন?

    — আরে তোমাদের একটু খোঁজ-খবর নিতে এলাম আর কী।

    — আপনার পাড়া থেকে তো আমাদের তাড়িয়ে দিয়েছেন। এখানে আপনার আবার কী কাজ? কমলা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল কথাগুলো।

    — কাজ আছে, কাজ আছে। তোমরা এখানে ভালো আছো কি না সেটা তো আমাকে দেখতে হবে। খারাপ থাকলে “উপরে” জানাতে হবে...।

    — শুনুন, আপনার বন্ধু গোপাল মণ্ডল কাল রাতেই বলে গেছে কোনও সমস্যা হলে তাঁকে জানাতে। সুবল মিত্তিরের কথা শেষ হবার আগেই এবারে একেবারে কমলা-সুনামি।

    — ও তাই নাকি? গোপাল এসেছিল? বাহ্‌, খুব ভালো। আমি আসলে এসেছিলাম তোমাদের খোঁজ-খবর নিতে। তা এ জায়গাটা ভালো লাগছে তো তোমাদের?

    — না, একদমই ভালো লাগছে না। তবে ভালো লাগছে না বললে শুনবে কে — থাকতে তো হবে এখানেই। ফের কমলা ঝড়।

    — আরে আমি তো আছি...

    — না, আপনি নেই। আপনি থাকলে আমাদের এখানে আসতে হত না, এত কষ্ট করে এখানে থাকতে হত না। সে যাক, আপনি অত-শত বুঝবেন না। আমি এখন আসি। বিকেলে আবার গোপালদার সঙ্গে মিছিলে যেতে হবে।

    সুবল মিত্তির বুঝতে পারল “এ মেয়ে” একটু অন্য ধাতুতে তৈরি বিশেষ কেউ। একে এখন ঘাঁটানো যাবে না। তাই মুখের হাসিটা অম্লান রেখে সুবল মিত্তির বলল, আজ চলি রে বিজয়। অন্য কোনোদিন কথা হবে।

    সামনে থেকে পুরো ব্যাপারটা দেখছিল রাজু। কমলার এমন উত্তরণ দেখে সেও কিছুটা চাপে পড়ে যায়। রাজু বুঝতে পারছিল যে ছানা ক্রমশ কেটে যাচ্ছে। এসব চিন্তার মধ্যেই সুবল মিত্তিরের প্রশ্ন, আরে নিরু কোথায়? তার খবর কী?

    রাজু বুঝতে পারল সুবল মিত্তির কমলা ঝড়ে ধরাশায়ী হয়ে ফের নিরুমুখী হবার চেষ্টা করছে। কমলা-বচনে অনুপ্রাণিত রাজুও কি বদলে গেল! নইলে সে কী করে বলে ফেলল, নিরু তো এখন বাড়িতে নেই সুবলদা। কোথায় গেছে কে জানে। কী বলছিল... বিকেলে গোপাল মণ্ডলের সঙ্গে মিছিলে যেতে হবে। আমি ওকে বলে দেব যে আপনি এসেছিলেন।

    সুবল মিত্তির বুঝতে পারছিলেন যে রাজু মিথ্যে কথা বলছে। ভিতরে-ভিতরে প্রচণ্ড রেগে গেলেও পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ সুবল মিত্তির মুখে-চোখে সে রাগের চিহ্ন না রেখে বললেন, ঠিক আছে, আমি চলি রে। পরে কথা হবে। রাজু দেখল সুবল মিত্তির মিলিয়ে যাচ্ছেন সেতুর সবচে’ বড় পিলারটার পিছনে।

    “কমলা-ঝড়”এর পর দশ দিন কেটে গেছে। ভিতরে-ভিতরে অস্থির হয়ে পড়া রাজু আর থাকতে না পেরে কমলা-দর্শনের জন্য বেরিয়ে পড়ল। কী আশ্চর্য! আজ বিজয় নয় — কমলা বসেছে দোকানে। রাজুকে দেখেই কমলা গায়ের শাড়িটা একটু বেশি করে জড়িয়ে নিল। অমন “ঢাকাঢাকি” দেখে রাজু — সেই আগের মতো প্রায় বলে ফেলছিল, কেন বারবার এসব ঢাকাঢাকি। কিন্তু সে বলতে পারল না। একদা কমলার সঙ্গে প্রচুর ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত কাটানো রাজু বুঝতে পারছিল যে সে সাহস পাচ্ছে না আগের মতো আন্তরিক হবার। রাজু বুঝতে পারছিল না কমলার সঙ্গে ঠিক কী দিয়ে কথা শুরু করবে। সে বুঝতে পারছিল না — সে কি হাসবে — নাকি কমলার চোখে-চোখ রেখে খুব কাছে গিয়ে দাঁড়াবে।

    মুশকিল আসান করে দিল কমলা। কোনও ভণিতা না করেই সে বলল, কী গো পচার বাবা, কেমন আছ? দোকান কেমন চলছে?

    রাজুর ইচ্ছে হল বলে, ভালো নেই কমলা, তোমাকে ছাড়া ভালো নেই। কিন্তু রাজু বুঝতে পারছিল যে তার সে আত্মবিশ্বাসটাই আর নেই যে সে অমন অন্তরঙ্গভাবে কথা বলবে কমলার সঙ্গে। ফলে সে শুধু অস্ফুটে বলল, ভালো আছি। দোকান খুব ভালো চলছে না। খরিদ্দারই নেই তেমন। তা, তুমি কেমন আছ?

    — আমি ভালো আছি। হ্যাঁ, সত্যিই খরিদ্দার নেই এখানে তেমন। আমার বরটা তো দু’ দিনে হাঁফিয়ে গিয়ে ফের ফিরে গেছে খালাসির কাজে।

    — বিজয় নেই? বাইরে গেছে? কতদিনের জন্য বাইরে গেছে? রাজু যেন তার আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়।

    — কতদিনের জন্য গেছে জানি না। এখন দোকানটা আমিই সামলাব। আমার বরটা তো না পারে চা করতে, না বানাতে পারে অমলেট। দেখি, আমি পারি কিনা কিছু করতে।

    বিজয় কাছাকাছি নেই — এই ভাবনাতেই সম্ভবত আত্মবিশ্বাসী রাজু কমলার খুব কাছে চলে আসে। এবং কমলা এক ঝটকাতে রাজুকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলে, একটু দূরে, একটু দূরে-দূরে থাকো গো পচার বাবা। সময় ভালো নয়। কোথা থেকে কী হয়ে যাবে।

    — কেন কী হল কমলা। রাজু আমতা আমতা করে বলে।

    — তেমন কিছুই হয়নি। মাঝে ঢ্যামনা সুবল মিত্তির এসেছিল ফের। যা দিয়েছি — আর বোধহয় কোনোদিন এ-মুখো হবে না। তাই বলি, তুমিও একটু দূরে-দূরে থাকো গো পচার বাবা। আমার মেলা কাজ পড়ে আছে।

    — কমলা, তুমি সব ভুলে গেলে?

    — না, কিছুই ভুলিনি। সব মনে আছে। আর সেই জন্যেই বলছি, যাও গিয়ে দোকান সামলাও। সম্ভব হলে এদিকে আর এসো না।

    — কমলা...। রাজুর গলাটা আর্তনাদের মতো শোনায়।

    — হ্যাঁ গো, পচার বাবা, এবার তুমি এসো।

    সে রাতে অনেকদিন পর রাজু নিরুপমাকে হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিল। অনেকদিনের অনভ্যাস, জড়সড় নিরু, আড়ষ্ট নিরু — সব মিলিয়ে প্রায় দিশেহারা রাজু টের পেল যে নিরুপমার উপর থেকে তার অধিকার বোধটাই কবে যেন দূরে কোথাও হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে মূল আন্তরিকতা, বিশ্বাস — সব, সব হারিয়ে গেছে। সে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করল পুরোনো দিন ফিরিয়ে আনতে। প্রাণপণ আদরে নিরুপমাকে ভরিয়ে দিতে দিতে রাজু ফিসফিস করে বলল, সত্যি গতরটা এখনও দারুণ ধরে রেখেছিস... আয়, আয়, আরও কাছে...।

    জোড়াতালি দেওয়া বিছানায় “প্রায়” একাই শরীরী খেলায় ডুবে যেতে যেতে রাজু শুনল নিরুপমা বিড়বিড় করছে, সুবল মিত্তির কি আর এসেছিল কমলার কাছে?




    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments