• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৭ | জানুয়ারি ২০২০ | গল্প
    Share
  • মৃণালিনী : শাম্ভবী ঘোষ


    কি অদ্ভুত এই পূর্ণিমার পৌষরাত। সারা আকাশ যেন তার এক জ্বলন্ত চোখ মেলে তাকিয়ে আছে পৃথিবীর দিকে। আমার উঠোনে এসে পড়েছে তার আলোর বুনোন; ঝুমকোলতার ছায়ারা তার উপর রচেছে তাদের আলপনা। আজ সারা দিনটা ভয়, উদ্বেগ, চোখের জলের পরে যেন ক্লান্ত হয়ে ঢলে পড়েছে রাতে। চারিদিকে অখণ্ড নিস্তব্ধতা। এই ধু-ধু জ্যোৎস্নার মাঝে বাড়ির সামনের আগাছাভরা পোড়ো জমিটা থেকে যেন আরেক টুকরো জ্যোৎস্নার মতোই বেরিয়ে এল দুধসাদা বেড়ালটা।


    কাল রাত থেকে রায়দের বাড়ির মেজো মেয়ে আরশি নিখোঁজ। থানা-পুলিশ উথাল-পাথাল। ক্লাবে টেনিস খেলতে গিয়ে ফিরতি পথে বন্ধ হয়ে যাওয়া পুরোনো ছাপাখানাটার সামনে থেকে যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। কি আকুল কান্না ওর মা-বাপের!

    “একি হল মাস্টারমশাই! আমাদের শহরে কার কুদৃষ্টি লাগল?” আরশির কাকা ঘোলাটে চোখে আমার হাত চেপে ধরেছিল।

    “ভেঙে পড়বেন না। শক্ত হতে হবে। পুলিশ একটা কিছু ব্যবস্থা করবেই।”

    রায়দের বাড়ির পাশের তেঁতুলগাছের তলায় কেমন এক মুখের ভাব নিয়ে দাঁড়িয়েছিল উস্কোখুস্কো চুল ছেলেটা।

    “কাল তোমার সাথে দেখা হয়েছিল?” জিজ্ঞেস করলাম তাকে। মাথা নাড়তে গিয়ে কেঁদে ফেলল।

    “পরশুদিন কলেজের মাঠে খুব ঝগড়া হয়েছিল স্যর। বলেছিল আমার মুখ দেখবে না। অনেক দূরে চলে যাবে ...”


    আমার উঠোনে এসে থমকে দাঁড়ায় বেড়ালটা। জ্যোৎস্নার মায়াজালের ভিতর থেকে পান্নার মতো চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। উঠোনে ঘুরপাক খায়; নিজের শরীরের ভারে চলার গতি যেন ধীর হয়ে এসেছে। খেয়াল করে দেখি, সে অন্তঃস্বত্তা। কি যেন বলতে চায় আমাকে। তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি, উত্তর পাইনা।


    “মেয়েদেরকে ঘরে সামলে রাখতে পারেননা?” পুলিশ ইন্সপেক্টর কর্কশভাবে বলেন। চোখের জল তাঁর মনে দাগ কাটে না।

    “সেকি কথা দারোগাবাবু? মেয়েরা রাস্তায় চলাফেরা করতে পারবে না?”

    “আপনি জানেননা মাস্টারমশাই। এ তল্লাটে এক-একটির এক একরকম কেলেঙ্কারি। স্বাধীনতার কদর করে কে? ফল তো পরিবারকেই ভোগ করতে হয়। আপনিই বলুন, এই নিয়ে ক’খানা হল?”

    তিনি আরশির বন্ধুকে নিয়ে পড়েন। তার মুখ দেখে মায়া হয়; এমনিই অপরাধবোধে পুড়ছে ছেলেটা। আরশির কাকিমা ওর পক্ষ নিয়ে বলেন, কতদিনের চেনা ওদের সাথে, ভাল ঘরের ছেলে। ইন্সপেক্টর গ্রাহ্য করেননা। আরশির মাকে দেখতে এসেছিলেন ডাক্তারবাবু। চাপাস্বরে বললেন, “যত হয়রানি। এতদিনে কি একটিরও সুরাহা করতে পারল?”

    তাঁর চোখে আগুন জ্বলতে দেখলাম।


    এইটুকু বুঝেছি, বেড়ালটা এসেছে আমাকে কোথাও নিয়ে যেতে। কে জানে, কি রহস্যের সন্ধান দিতে এসেছে সে! আমাকেই বা কেন চায়? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে বেড়ালকেই অনুসরণ করতে হবে। বেরোব কিনা তার সিদ্ধান্ত নেবার আগেই দেখি, কি এক দুর্নিবার কৌতুহল আমাকে টেনে নিয়ে চলেছে তার পিছু পিছু; গেটের বাইরে, বাড়ির গলি ছাড়িয়ে, খেলার মাঠ পার করে, দূরে, কত দূরে!


    ডাক্তারবাবুকে বাড়ি এগিয়ে দিয়ে আমিও ফিরি। পথে রিমঝিমের সাথে দেখা, উৎকণ্ঠিত পায়ে হেঁটে যাচ্ছে রায়দের বাড়িতে।

    “পরপর একি হচ্ছে মাস্টারমশাই? আগে তো কোনোদিন এমন হয়নি!”

    “তুমি ভাল আছ এখন?”

    “কি করে থাকি বলুন! চার মাস আগে আমার দিদি কি ভয়ংকরভাবে গেল। সেই বৈশাখ মাস থেকে এক এক মাসে এক একজন হয় নিখোঁজ, নয় আত্মঘাতী! হঠাৎ কী মড়ক যে লাগল!”

    “নিজের চারপাশের লোকেদের মন ভাল রাখার চেষ্টা করো। দেখবে, এমন দুর্ঘটনা আর হবে না।”

    “মা বাবাকে কত বলেছিলাম, দিদির সাথে ডাক্তারবাবুর বিয়ে না ঠিক করতে। রফি দা মুসলমান বলে ওরা বেঁকে দাঁড়াল, আর দিদি রেলব্রিজে লাইনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে –”

    “থাক না এসব কথা।”

    “আপনিও তো ওদের বোঝাতে গিয়েছিলেন – শোনেনি। এখনও দিদির কাটা-পড়া দেহটার ছবি ভেসে ওঠে, রাতে ঘুমোতে পারিনা মাস্টারমশাই।”

    “কেন দেখতে গিয়েছিলে? জানো না এসব দৃশ্য মনে ছাপ ফেলে যায়?”


    অনেক দূরে চলে এসেছি আমি, মফস্বলের অন্য সীমান্তে। এ পাড়াটা প্রাচীন, প্রশস্ত বাগান বাড়ি, গাছপালা, দিনের বেলাতেও নির্জন। আরও অলি-গলি পেরিয়ে এসে পড়লাম ঘোষালদের পুকুরের ধারে। চারদিকে বাঁশঝাড়, কাঁটা ঝোপ, ঝরা পাতার টুপটাপ। অদূরেই দাঁড়িয়ে ছিল বেড়ালটা, পায়ে পায়ে চলে গেল পাড়ের দিকে। আমিও এগিয়ে গেলাম। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে পুকুরের জল। এত এত শ্বেতপদ্ম ফুটেছে এই অসময়ে! তাকিয়ে তাকিয়ে ঘোর লেগে গিয়েছিল যেন; তারপর হঠাৎ ধ্বক করে উঠল বুক।

    পদ্মবনের মাঝে ও কার মুখ ভেসে উঠেছে! চোখ বন্ধ করে আবার খুললাম, একবার, দু-বার। না, কোনও ভুল নেই; আমার চোখের সামনেই ধীরে ধীরে ভেসে উঠল পুরো দেহটাই। জ্যোৎস্নার আলোয় তার প্রশান্ত মুখটা দেখে স্পষ্ট চিনতে পারলাম।

    মৃণালিনী! ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা মৃণালিনী, বৈশাখী পূর্ণিমার রাতে হারিয়ে গিয়েছিল; কেউ তাকে পায়নি। পিতৃত্ব অস্বীকার করেছিল তার সন্তানের বাবা; তার পর থেকে দিন রাত এই পুকুরপাড়েই নিঝুম হয়ে বসে থাকত। সেই মৃণালিনীর দেহ এতদিনে ভেসে উঠল?

    কিন্তু … তা যে অসম্ভব! তাকে যে ওই গহন বাঁশবনে নিজের হাতে পুঁতে দিয়ে এসেছিলাম আমি! ঠিক যেমন রিমঝিমের দিদির দেহটা ফেলে দিয়েছিলাম শুনশান রেলব্রিজের উপর। আরশি সেই পরিতক্ত ছাপাখানার এমন এক কোণে পড়ে আছে, কেউ তার সন্ধান পাবে না।

    কেউ টের পায়নি। ফাল্গুন মাসে এই শহরে বদলি হয়ে আসবার আগে যেখানে ছিলাম, সেখানেও না। কি করেই বা পেত! আমি যে বড় সাবধানী। আমি তাদেরকেই বেছে নিই যাদের জীবনে অন্য কিছু দাগ, অন্য কোনও সমস্যা থাকে। সেই সব পূর্বকথা ছেড়ে দিয়ে তারা এক নিরীহ মাস্টারমশাইকে সন্দেহ করতে যাবে কেন?

    কিন্তু তাহলে আজ মৃণালিনী জল থেকে ভেসে উঠল কি করে! আমি কি স্বপ্ন দেখছি? তা তো নয়; ওই তো মৃণালিনী কটা চোখজোড়া মেলে এক দৃষ্টে দেখছে আমাকে। তার মৃত হাতটা কি আমাকে ডাকবার জন্য নড়ে উঠছে? সম্মোহিতের মতো ক্রমশই আমি জলের দিকে এগিয়ে চলেছি। শেষ পদক্ষেপের আগে ফিরে চাইলাম; বেড়ালটা ধীর পায়ে এগিয়ে গেল বাঁশবনের দিকে, তারপর জ্যোৎস্নার আলোর মধ্যে মিলিয়ে গেল।

    গল্পটি জীবনানন্দ দাশের ‘শব’ কবিতা থেকে অনুপ্রাণিত।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments