ঘাসফড়িং ও বেগে উড়ে চলা বড়সড় টকটকে লাল ফড়িংগুলো খুঁজে বেড়াই। মনে আছে, আদিম পরিবেশে এক উইঢিবিতে সহস্র উইয়ের ঢিবির চারধারে চক্কর দিচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে ফিঙে। এখন তারা নেই।
এদেরকে আমি ফিরিয়ে নিয়ে আসি আমার কল্পনার রাজ্যে। আমার মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাসে ওরা আছে। আমার সাথী রাবু আজও আছে আমার হৃৎস্পন্দনে। আমি আর রাবু ফড়িং ও প্রজাপতির পেছনে ছুটতাম। আমার আর রাবুর মাঝে মিষ্টি একটা প্রেম ছিল; যদিও আমি বা রাবু কেউই জানতাম না যে, একে প্রেম বলে। একসময় আমি ও রাবু বুঝতে পারলাম আমরা শুধু খেলার সাথী নই। দুজন একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম।
তারপর একদিন দূরত্বের সৃষ্টি হয়। আমরা রাবুদের বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র বদলি হই। মাঝেমধ্যে দূর থেকে এসে ওদের বাড়িতে আসতাম। আমাদের বাড়িটা অন্যরা ভাড়া নিয়েছে। রাবুর মা আমাকে জিজ্ঞস করতেন এখন যে বাসায় থাকি তা কেমন। বলতাম। রাবু কাছে আসত, উচ্ছ্বাস বা চাঞ্চল্য ছিল না। বয়স ওর বেড়েছে। দেহ কাঠামোতে পরিবর্তন হয়েছে। চোখেমুখে উদাসীনতা ও কৌতূহলের সামান্য আভাস।
আমি যেতাম, তবে সেটা অনিয়মিত। শুনতে পেতাম রাবুদের নতুন ভাড়াটে পরিবারে আমার বয়সী একজন কিশোর আছে। আমার ভীষণ অভিমান হত।
এখন বুঝি, চোখের আড়াল হলে মানুষ সময়ের সামান্য ব্যবধানেই মানুষকে ভুলে যায়। সময় বয়ে গিয়ে স্কুল-কলেজ-মেডিক্যাল কলেজ পেরিয়ে রাবু তখন ডা. রাবেয়া আনসারী, এম.বি.বি.এস.।
আমি শেলি-বায়রন-কীটস-কোলরিজ-ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও শেক্সপিয়ারের জগতে বিচরণ করছিলাম। খুব জানাতে ইচ্ছে করছিল: রাবি, আমি ইংরেজিতে সম্মান ও এম.এ.। জানাতে পারিনি। দূরত্বের কারণ শুধু রাবু ছিল না — আমিই ছিলাম মূল কারণ এটা আমি পৃথিবীর কারুর কাছে স্বীকার করিনি। করেছিলাম শুধু নিজের কাছে। কেন যেন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছেও রাবুর সঙ্গে আমার দূরত্বের কারণটা লুকিয়ে রাখতাম। আমার ব্যর্থতা বা বোকামি কিংবা আমার স্মার্টনেসের অভাব কাউকে বুঝতে দিতে চাইতাম না।
রাবু যে স্মার্ট ছিল — এমনকি আনঅর্থোডেক্স ছিল — তার প্রমাণ আমি পেয়েছিলাম। সে যে মধুর অনুভূতি জাগানো একটা স্মার্ট জব সম্পাদন করেছিল, তার প্রতিদান দিতে বা মূল্যায়নে আমি চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছিলাম। রাবু ওড়না পরার আগের সময় এটা। ফুটন্ত কুঁড়ির মতো জেগে উঠছিল রাবুর উর্ধ্বাংশ। তাকাতে ইচ্ছে করে, চেয়ে দেখতে সাধ জাগে। অথচ চাইতে পারতাম না।
একদিন চোর ধরা খেলায় রাবু আমাকে ধরল। তিনজনের দল। অন্য সদস্য আমার ছোটোভাই। আমি চোর হয়ে লুকিয়ে ছিলাম পরিত্যক্ত রান্নাঘরের বেড়ার আড়ালে। রাবুই এসে আমাকে জাপ্টে ধরে যতটুকু না চেঁচাবার কথা, তার চেয়ে বেশি চিল্লিয়ে — সেই সাথে কুঁড়িদুটো আমার বুকে ঠেসে ধরে রাখল।
আমি বুঝিনি। রাবেয়া বুঝেছিল, আমি নরাধম। ম্যাড়া, কিংবা ভেড়া।
মূলত কোহিনুর হীরে হারাবার মুহূর্ত সেটাই ছিল; অথচ সেই মুহূর্তটি আমার জন্য হতে পারত কুঁড়ি ফোটানোর লগ্ন। আমি জানি আমি বেওকুফ, আনস্মার্ট ও হাঁদা।
সেই যে হারিয়েছিলাম, আর খুঁজে পাইনি। সেই মহল্লায় যেতাম আমার পুরোনো বন্ধুদের সাথে গপ্পো করতে। আমি বিলের ধারে বসে উদাস চোখে চেয়ে দেখতাম নীলাকাশ। কানের কাছে গুনগুনিয়ে উঠত রাবুর মিষ্টিকন্ঠ। আমার সাথে যোগ দিত বিকাল। রাবুর নতুন সাথী। বিকাল একদিন আমাকে আলাদা ডেকে নিয়ে শোনাল একটা মিষ্টি প্রেমের গল্প। ততদিনে বুঝে গেছি প্রেম কাকে বলে। বিকাল ও রাবেয়া প্রেমের পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ।
প্রেম-ট্রেম জাতীয় বিষয়ে আমার জীবনে প্রথম কান্না এলো সেইরাতে বাসায় ফিরে। বিছানায় শুয়ে আকাশকুসুম ভাবতে ভাবতে অলক্ষেই চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াল।
বিকালের সাথে ভোরের শিউলি ফুটেছিল কিনা জানতাম না। জানতে পারিনি যে, সেই আগের বাড়ির হিজল গাছটি আর নেই। নিচু পাঁচিল ঘেঁষে চারা পাকুড় গাছের গোপন ডালে টুনটুনি বাসা বাঁধে না। ফিঙেরা আর আসে না। দূর থেকে বিলের পানির মিষ্টি গন্ধ নাকে ঝাপ্টা দেয় না। জানতাম না আমার কাফিলা গাছের সেই কল্পিত ড্রাগনটি আর নেই। শুকতারা বা সন্ধ্যেতারা আর দেখা যায় না ঘন বস্তি, সুউচ্চ ইমারত ও বিল ভরাট করে আবাসন নির্মাণের কারণে।
এরপর আরও কয়েক দশক ফুরুৎ করে উবে গেল। গুদামের চাল-গমের মতো বস্তায় বস্তায় সময় চলে গেল; আমার মানসপটে কিন্তু রাবুর শেষ দেখা মুখখানা উবে যায়নি। সেই দিনগুলো ও সেই মুখ এখনও আগের মতোই সতেজ-আবেশময়। সেইসাথে আমার করোটিতে ঘাপটি মেরে বসে আছে একটা তীব্র আক্ষেপ, খেদ ও না পাওয়ার বেদনা।
মনে হয়, মরবার আগে সেই সময়টাতে কোনো উপায়ে একবার ফিরে যেতে পারলে ভুলগুলো শুধরে নিতে পারতাম। বিয়ের আগে প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলাম রাবুর আদলের সাথে মিল আছে এমন একটি মেয়ে খুঁজে বের করতে। কিছুতেই পাইনি। রাবু অপরূপা ছিল তা নয়; কিন্তু সে পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে আমার কাছে।
তারপর যাকে পেলাম সে বীথি। আমি ডাকি ছায়াবীথি বলে। ও আমার পাশে ছায়ার মতো ছিল এবং আছে আড়াই দশক ধরে। সত্যি বলতে কি, বীথির রূপের কাছে রাবু কিছুই না; তবুও রাবু আমার কাছে পৃথিবীর সবচাইতে আরাধ্য কিছু একটা। ইহজাগতিক ও পারলৌকিক উপাদানে তৈরি — স্বপ্ন ও বাস্তবতার মাঝামাঝি কোনো এক হীরকখণ্ড।
আমার অসুস্থতার পর থেকে আমার মাথার পাশে বসে থাকে বীথি। অনেকবার বলেছি, সে শোনে না। বসে থাকে। আমার কোনো প্রয়োজন হতে পারে ভেবে সে ঠায় বসে থাকে। যতবারই ভেবেছি বীথি পাশে থাকলে রাবুর কথা ভাববো না, ততবারই রাবু যেন জলজ্যান্ত মানবী হয়ে আমার মস্তিষ্কের কোষে গেঁড়ে বসে।
কিছুদিন আগে ওকে আমি পেয়েছিলাম লিঙ্কড ইন-এ। কানেকশন রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম। সাড়া পাইনি; ম্যাসেজ পাঠিয়েছিলাম, উত্তর পাইনি। জানিয়েছিলাম — আমার সর্বশেষ কেমো চলছে। মনে হলো, রাবু এতটাই আলোকবর্ষ দূরে যে, ওর দিক থেকে সাড়া পেতে বহুযুগ প্রতীক্ষায় থাকতে হবে। অন্য কোনো সোশ্যাল মাধ্যমে ওকে খুঁজে পাইনি। লিঙ্কড ইন-এ প্রোফাইল থেকে জানলাম যে কোনো এক উন্নত দেশের একটি হাসপাতালে কনসালটেন্ট প্যাথলজিস্ট। প্রোফাইলে ঝাপসা একটা ছবি। রাবেয়া আনসারী ওরফে রাবু, যেখানেই থাকো, ভালো থেকো।
আর আমার মরণের খবর কোনো অলৌকিক উপায়ে তুমি পেলে এক ফোঁটা অশ্রু ঝরিয়ো।