স্কুলের পিকনিকে এবার নালন্দা যাওয়া হচ্ছে শুনে আর্যনীলের খুব আনন্দ হয়েছিল। বাবার কাজের সূত্রে পাটনায় এসেছে ওরা। সেখানেই একটা স্কুলে ভর্তি হয়েছে আর্যনীল। ওর দিদিও সবে একটা কলেজে ঢুকেছে। পাটনা থেকে নালন্দা মাত্র দেড় ঘন্টার পথ কিন্তু ওদের সবার এখনও যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তাই স্কুল থেকে নিয়ে যাওয়া হবে শোনার পর থেকেই নীল বেশ উত্তেজিত। নালন্দা সম্পর্কে সে অনেক কিছু জানে। তবে সেটা জেনেছে অবশ্য ইতিহাসের বই পড়ে নয়, ওর প্রিয় লেখক শ্রী সাগ্নিক মৈত্রর লেখা ‘অভিশপ্ত নালন্দা’ উপন্যাসটা পড়ে। উপন্যাসটা রহস্য উপন্যাস হলে কী হবে সেটাতে নালন্দার ইতিহাস বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করা আছে। কল্পনার সঙ্গে বাস্তবকে মিলিয়ে দেখতে পারবে ভেবেই ভাল লাগছিল নীলের।
যথা সময় বাসে চড়ে রওনা হল ওরা। সবার পরনে সাদা জামা আর গাঢ় নীল প্যান্ট। টিচাররা বলে দিয়েছিলেন পরিষ্কার জামাকাপড় পরে আসতে। ওদের স্কুলের একটা সুনাম আছে চারিদিকে, সেটাকে বজায় রাখার চেষ্টা করা হয় সব সময়। বাস সাঁ-সাঁ করে এগিয়ে চলল গন্তব্যের দিকে। যেটা সমস্যা সেটা হল এক বাস ভর্তি ছেলেপিলেকে সামলানর জন্যে রয়েছেন মাত্র দুজন টিচার। নীলের মতন অন্য ছেলেদের নালন্দার প্রতি কোন আগ্রহ নেই। বাসের ভিতর হইচই মারামারি লেগেই রয়েছে! খুব রাগ হচ্ছিল নীলের, এরা কী রকম রে বাবা! এমন একটা দারুণ জায়গায় যাচ্ছে কিন্তু কারো কোন উৎসাহ নেই। ওদের কিনা মারামারি ঝগড়া করার ইচ্ছে বেশি! যাক কী আর করা যাবে, ওরা যা করছে করুক, ভেবে নীল পিঠের ব্যাগটা থেকে ‘অভিশপ্ত নালন্দা’ বইটা বার করে ফেলল। নালন্দা সম্বন্ধে তথ্য বেশিরভাগ চীনদেশের পরিব্রাজক হুয়েন সাংয়ের লেখা থেকে জানা যায়। উনি তিন বছর ছিলেন নালন্দায়। তখন সেখানে দশ হাজার ছাত্র আর প্রায় দুহাজার শিক্ষক! নালন্দা যে পৃথিবীর সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয় সেটা সবাই এক কথায় স্বীকার করে।
বইটা পড়তে পড়তে এত বিভোর হয়ে পড়েছিল নীল যে খেয়ালই করেনি কখন ওদের বাস থেমে গেছে।
“এই নীল নামবি না? খুব তো নালন্দা নালন্দা করছিলি আর এখন যখন পৌঁছে গেছি তখন আর তোর বাস থেকে নামার ইচ্ছেই নেই দেখছি!” রোহিত ফোড়ন কাটল।
রোহিত ভাল ছেলে নয়। পড়াশোনায় তার মন নেই, সব সময় ঝগড়া, মারামারি বা বদ কিছু করছে তাই ওর কথায় কান না দিয়ে উঠে পড়ে বইটাকে ব্যাগের ভিতর ঢুকিয়ে ফেলল নীল। বাস থেকে নেমে লাইন করে এগিয়ে চলল ওরা সবাই। গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকেই প্রথমেই ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের বড় একটা সাইনবোর্ড আর চারিদিকে দেখা যাচ্ছে ইঁটের তৈরি স্থাপত্য!
নীল একটা শিহরন অনুভব করল লাল ইঁটের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে। সব কিছু কী প্রকাণ্ড। প্রতিটি ভবন ন’তলা সমান উঁচু ছিল। ৪৫০ খ্রিস্টাব্দে ওরা যে এই রকম ইঁট তৈরি করতে পারত সেটা ভাবলেই কেমন আশ্চর্য লাগছিল। টিচার ওদের হিউয়েন সাংয়ের ঘর আর প্রার্থনাকক্ষ দেখালেন। ঠিক হলফ করে তো বলা যায় না--অত দিন আগের ব্যাপার তো, তবে আন্দাজ করা হয় ওটাই ওনার ঘর ছিল। সাধারণ ছাত্রদের ঘরে একটা বা দুটো করে বেদির মতন করে বাঁধানো বিছানা। ১১৯৩-১২০০ খ্রিস্টাব্দে বক্তিয়ার খিলজি ধ্বংস করে ফেলে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে। বহু বৌদ্ধ ছাত্রদের মেরে ফেলা হয়। মহামূল্য পুঁথিতে ঠাসা বিশাল লাইব্রেরি ছিল। সেই সব পুঁথি ওরা পুড়িয়ে ফেলে। শুধু পুঁথি পোড়াতেই নাকি ছ’মাস লেগে গিয়েছিল ওদের। ৮০০ বছরের গবেষণার ফসল সব পুড়ে ছাই!
“তিব্বতের এক পরিব্রাজক ধর্স্বামী নালন্দার সংহার নিয়ে খুব রোমহর্ষক বৃত্তান্ত লেখেন। নালন্দা ধ্বংসের বিবরণ ওনার লেখা থেকে ভাল পাওয়া যায়,” ইতিহাসের পাঠক স্যার বললেন।
ক্লাসের অন্য ছেলেগুলোও মন দিয়েই সব শুনছিল এবং তাদেরও ভাল লাগছিল বলেই মনে হল। ওদের স্কুলের দলটা এগিয়ে গেল কিন্তু একটা বড় চৈত্যের (প্রার্থনাকক্ষ) সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল নীল। মোহিত হয়ে দেখছিল কারুকার্যগুলো। আশপাশে প্রচুর লোক। বিদেশীও রয়েছে কয়েকজন। যদিও আগ্রা বা রাজস্থানে যত বিদেশীদের দেখা যায় এখানে তার এক শতাংশও নেই দেখে একটু অবাকই লাগছিল নীলের। একজন হাফপ্যান্ট পরা বয়স্ক বিদেশী ভদ্রলোক মন দিয়ে ছবি তুলছিলেন। ওনার ক্যামেরাটাতে হরেক রকমের লেন্স বদলে বদলে লাগাচ্ছিলেন। ওনার সঙ্গে আসা বিদেশিনী মহিলা আবার সালোয়ার কামিজ পরেছিলেন। চৈত্যগুলোর যে সব কারুকাজ নীলের মনে ধরেছিল সেগুলোর বেশ যত্ন সহকারে ছবি তুলছিলেন ভদ্রলোক। নীলের কাছে ক্যামেরা নেই। সে মনে মনে ঠিক করল পরের বার যখন মা-বাবা-দিদির সঙ্গে আসবে তখন বাবার ক্যামেরাতে অনেক ছবি তুলবে।
এই সব সাত-পাঁচ ভাবছে নীল এমন সময় ঘটনাটা ঘটে গেল। বয়স্ক ফটোগ্রাফার ভদ্রলোক পিঠের ব্যাকপ্যাকটা নীচে নামিয়ে ছিলেন কয়েক মুহূর্তের জন্যে, ওমনি রোহিত কোথা থেকে ঝাঁ করে ছুটে এসে, “এই বুড্ঢা, এখানে কী করতে এসেছিস? এখানে একদম ছবি তুলবি না!” বলে ভদ্রলোককে ঠেলে ফেলে দিয়ে ওনার ব্যাগটা তুলে নিয়ে পালালো!
রোহিতের পাজি সাঙ্গোপাঙ্গগুলোও ‘বুড্ঢা, বুড্ঢা!’ বলে কয়েকবার চেঁচিয়ে ছুট দিল। ভদ্রলোক মাটিতে পড়ে গিয়ে অসহায় ভাবে তাকিয়ে রইলেন ওদের দিকে।
লজ্জায় কান লাল হয়ে গেল নীলের। ওর স্কুলের, ওর ক্লাসের ছেলেরাই কিনা ওই রকম করল! পাঠক স্যার আর অন্য টিচারই বা কোথায়?
ততক্ষণে আশপাশের অন্য লোকজনেরা ভদ্রলোককে টেনে তুলেছে। নীল দেখল, নাহ, একটা কিছু করা উচিত। সে এগিয়ে ভদ্রলোকের কাছে গিয়ে বলল, “স্যার, আমার ক্লাসের ছেলেরা আপনার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে তার জন্যে আমি লজ্জিত। ওদের ওই আচরণের জন্যে আমি ক্ষমা চাইছি। নালন্দা আমাদের দেশের অমূল্য সম্পদ। আপনারা যে দূর দেশ থেকে উৎসাহ আর আগ্রহ নিয়ে সেটা দেখতে এসেছেন সেইজন্যে আমরা কৃতজ্ঞ। আপনার ব্যাগটা আমি নিয়ে আসছি, আপনি একটু অপেক্ষা করুন!”
ভদ্রলোক ওর কথা শুনে বেশ খুশি হলেন মনে হল। ওনার সবুজ চোখে একটা ঝিলিক খেলে গেল উনি যখন বললেন, “থ্যাঙ্ক ইউ মাই বয়! আমি সুদুর ফ্রান্স থেকে এসেছি এটা দেখার জন্যে এবং এই ঘটনাটা ছাড়া নিরাশ হইনি!”
নীল আর দাঁড়াল না। ওকে ব্যাগটা উদ্ধার করতে হবে তো। কী ভাবে সেটা করবে কে জানে। মারামারি ঝগড়াঝাটি ওর তেমন আসে না।
যেতে যেতে ও শুনতে পেল ভদ্রলোক বলছেন, “মনুষ্যত্বের প্রতি আমার ধারণা বেশ আঘাত পেয়েছিল ওই ঘটনাটায় কিন্তু ওই বাচ্চা ছেলেটাকে ধন্যবাদ এখন সেই আঘাতটাকে কাটিয়ে উঠতে পারব।”
কথাটা শুনে মনটা জুড়িয়ে গেল নীলের। এখন ব্যাগটা পেলেই শেষরক্ষা হয়ে যায়, ভেবে বিশাল স্নানাগারটার পাশ দিয়ে এগিয়ে চলল সে।
“শুনলাম তুই নাকি ওই বুড্ঢাকে সরি বলেছিস! তোর কী মেরুদণ্ড বলে কিছুই নেই?” রোহিত হঠাৎ উদয় হয়েছে ওর সামনে!
“ওনার ব্যাগটা ফেরত দিয়ে দে রোহিত! উনি বিদেশী, ফ্রান্স থেকে এসেছেন। তুই ওই রকম করলি, এখন আমাদের সম্পর্কে, উনি কী রকম ধারণা নিয়ে দেশে ফিরবেন বল তো!”
“তোকে আর উপদেশ দিতে হবে না! বেশ করেছি ব্যাগ নিয়েছি! সাকেত বলছিল লোকটা গেটের বাইরে ভিখিরিদের ছবি তুলছিল। সেই সব নিজের দেশে নিয়ে গিয়ে দেখাবে ব্যাটা!”
“তাতে কী? ভিখিরি সব জায়গাতেই আছে। আমার কাকু নিউ ইয়র্কে থাকেন, উনি বলেন ওখানেও নাকি প্রচুর ভিখিরি আছে। উনি ছবিও দেখিয়েছেন আমাদের। নে এবার ব্যাগটা দে!”
“দেব না যা! কী করবি তুই?” বলে রোহিত বাঁ হাতে একটা ঘুসি চালাল।
নীল তো এক ঘুসিতেই কাৎ। মাটিতে পড়ে গেল সে। শক্ত ইঁটের মাটিতে পড়ে ভালই ব্যথা লাগল।
“রোহিত, আর্যনীল, কী হচ্ছে এটা! তোমরা এত বড় হয়ে গেছ তাও আমাদের দুদণ্ড শান্তিতে থাকতে দেবে না দেখছি!” পাঠক স্যার কোথা থেকে উদয় হয়েছেন।
অন্য শিক্ষকও যোগ দিলেন, “ছি, ছি আর্যনীল, আমি তো ভাবতাম তুমি ভাল ছেলে আর তুমি কিনা এখানে মারপিট করছ!”
“আমি তো ঝগড়া করতে চাইনি, কিন্তু রোহিত ওই ফরাসি ভদ্রলোকের ব্যাগটা দিতে চাইছে না যে!” নীল কাঁচুমাচু মুখে বলল।
“কী ব্যাগ?” পাঠক স্যার জিগ্যেস করলেন।
সব কিছু শুনে দুজন শিক্ষকই খুব রেগে গেলেন। ব্যাগটা নিয়ে যখন চৈত্যের কাছে গেল ওরা সবাই তখন দেখা গেল আর ভদ্রলোক সেখানে নেই। ব্যাগে অবশ্য কয়েকটা জলের বোতল আর দুয়েকটা টুকটাক ক্যামেরার সরঞ্জাম ছাড়া কিছুই নেই বলেই মনে হয় ভদ্রলোক ওটাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যাওয়ার মনস্থ করেছেন। তাও ব্যাগটা ফেরৎ না দিতে পেরে মনটা খারাপ হয়ে গেল নীলের। ফেরার সারাটা পথ শরীর আর মনের ব্যথাগুলো চিনচিন করতে থাকল।
সোমবার দিন প্রিন্সিপালের অফিসে ডাক পেতে আশ্চর্য হল না নীল। পাঠক স্যার তো বলেইছিলেন পুরো ঘটনাটা প্রিন্সিপালকে জানাবেন। দরজায় টোকা দিয়ে ভিতরে যাওয়ার অনুমতি চাইতেই ওকে নাম ধরে ভিতরে আসতে বললেন প্রিন্সিপাল স্যার।
ঘরে ঢুকে অবশ্য বেশ চমকে গেল নীল কারণ প্রিন্সিপালের ঘরে আরেকজন বসে রয়েছেন। ফ্রান্স থেকে আসা নালন্দায় দেখা সেই ভদ্রলোক! ব্যাগটা ওনার হাতে ফিরে গেছে।
নীলকে দেখে উনি বললেন, “তোমার সঙ্গে আবার দেখা হয়ে খুব ভাল লাগছে!” বলে ওর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন।
প্রিন্সিপাল স্যার বললেন, “তুমি শুনলে খুশি হবে যে মিস্টার লুই পিয়ার আমাদের স্কুলের কম্পিউটার ঘরের জন্যে আরো দশটা কম্পিউটার দিচ্ছেন!”
মিস্টার পিয়ার তার সবুজ চোখে ঝিলিক দেওয়া হাসি হেসে বললেন, “আমি সেই উদ্দেশ্য নিয়েই এখানে এসেছিলাম। একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটায় আমি কিছুক্ষণের জন্যে মত পরিবর্তন করেছিলাম বটে কিন্তু তোমার ব্যবহারে আমি আমার আগের সিদ্ধান্তে ফিরে আসতে পেরেছি। আশাকরি তোমার আঘাত সেরে গেছে!”
নীল কী বলবে বুঝতে না পেরে শুধু মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলল।
এরপর ভদ্রলোক পকেট থেকে একটা বিদেশী চকোলেট বার করে ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “নালন্দার মাটিতে গড়ে ওঠা এক মিষ্টি বন্ধুত্বর স্মৃতি হিসেবে আশাকরি এটা নিতে তোমার আপত্তি হবে না!”