এতদিনে জ্যোতির্ময়ী অদৃশ্য হলেন। নিজের থেকে।
অথচ - এর আগে - এতকাল ধরে - কি ঘটেছিলো বারবার?
সেদিন - সেই রাতে - জ্যোতির্ময়ীকে কি অদৃশ্য মনে করা হয় নি?
কারণ সেই রাতে ঘটনাটা ঘটেছিলো এই ভাবে –
- "ওই দাগটা কিসের?" - জিজ্ঞেস করেছিলেন শুভাশিস।
- "দাগ? কোথায় দাগ?" - অবাক হয়ে উত্তর দিয়েছিলো জ্যোতির্ময়ী। শুভাশিসের স্ত্রী। শুভাশিসের প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে।
- "ওই তো - ওখানে - হালকা লালচে রঙের একটা দাগ দেখতে পাচ্ছি" - গম্ভীর ভাবে বলেছিলেন শুভাশিস।
মাঝরাতে শোওয়ার ঘরের অল্প আলোয় নিজের প্রায় সম্পূর্ণ অনাবৃত শরীরের সামনেটা তাড়াতাড়ি করে যতটা সম্ভব চোখ বুলিয়ে নিয়ে বেশ আরর্য হয়েই উত্তর দিয়েছিলো জ্যোতির্ময়ী - "কোথায়? আমি কিছু দেখছি না তো!"
-"আরে ওই তো - ওই দেওয়ালের কোণে" - যেন বেশ বিরক্ত হয়েই উত্তর দিয়েছিলেন শুভাশিস।
শুনে থতমত খেয়ে গিয়েছিলো জ্যোতির্ময়ী। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পেয়েছিলো তার পিছনের নীল দেওয়াটায় একটা অস্পষ্ট ছোপের মতো কিছু দেখা যাচ্ছে নাইট ল্যাম্পের আলোয়।
তাড়াতাড়ি করে গায়ে শাড়িটা জড়িয়ে নিয়ে জ্যোতির্ময়ী ওই দেওয়ালটার কাছে গিয়ে দেখলো একটা লালচে রঙের ছোপ আছে বটে সেখানে।
- কিন্তু - কিন্তু কি আশ্চর্য ..... -এই মাঝরাতে - এই নাইট ল্যাম্পের আলোয় সে যখন তার গায়ের সবকিছু খুলে এসে দাঁড়িয়েছে তার স্বামীর চোখের সামনে - মাত্র একহাত দূরে - সহজ ঘনিষ্ঠতার প্রত্যাশায় ..... -ঠিক তখনই তার সেই সামনের মানুষটার কিভাবে দৃষ্টি যায় তার শরীরের একেবারে পিছনে থাকা দেওয়ালটার দিকে?
- তাহলে? -তাহলে কি সে দাঁড়িয়ে আছে একেবারে কাঁচের পুতুলের মতো? কিংবা একটা অদৃশ্য মূর্তির মতো তার স্বামীর সামনে?
যদি তার কিছুমাত্র অস্তিত্ব থেকে থাকে ওই সামনে থাকা লোকটার কাছে তাহলে তো এ অসম্ভব!
মাথা নীচু করে ঠোঁট কামড়েছিলো জ্যোতির্ময়ী। কয়েক ফোঁটা চোখের জল ঝরে পড়লো তার ফর্সা গালদুটি বেয়ে তার এলোমেলো হয়ে যাওয়া শাড়ির উপর - শুভাশিসের অলক্ষ্যে। বিয়ের মাত্র দুবছর কেটেছে আর এর মধ্যেই এইরকম মুহূর্তে শুভাশিস তাকে এতো কাছাকাছি দেখতে পেয়েও .....
জ্যোতির্ময়ীকে কি তখন অদৃশ্য মনে করা হয় নি?
সেই কতোকাল আগে ... সেই ছোট্টবেলায়.....তার দাদুর চোখের সামনে?...
কারণ জীবনধন তো তখন যেন জ্যোতিকে দেখতেই পেলেন না।
জীবনধন অর্থাৎ জীবনধন মুখোপাধ্যায়। জ্যোতির্ময়ীর পিতৃমহ। সংস্কৃত কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। রবিবারের সকালে বসেছিলেন তার দুই যমজ নাতিকে নিয়ে। তাদের হাতে খাতা পেন্সিল ধরিয়ে। তাদের বয়স তখন নয়। "বানান করে লেখো- মরীচিকা... পিপীলিকা"- বলছিলেন তিনি। জ্যোতির্ময়ীর দাদারা খাতা পেন হাতে হাঁ করে বসেছিলো - আর জ্যোতির্ময়ী কোত্থেকে একটা একটা কাগজ আর পেন্সিল নিয়ে নিশ্চুপে এসে দাঁড়িয়েছিলো তার দাদুর সামনে। বানানগুলো লিখেই। জ্যোতির্ময়ীর বয়স তখন সাত।
জীবনধন তাঁর নাতিদের খাতা টেনে নিয়ে বানান গুলো দেখতে থাকলেন। আর জ্যোতির্ময়ী? সে যে পাশেই দাঁড়িয়ে আছে যা যেন দেখতেই পেলেন না। সাত বছরের জ্যোতি ফ্যালফ্যাল করে চেয়েছিলো তার দাদুর দিকে।
সেই ঘটনার কুড়ি বছর বাদে আজ এই রাতে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে তার মনে হচ্ছিলো - সেদিন তার দাদু জীবনধন মুখোপাধ্যায় তাকে চোখের সামনে দেখতে পেয়েও.. ....
জ্যোতির্ময়ীকে কি তখন অদৃশ্য মনে করা হয় নি?
সেই ছোট্টবেলার ঘটনার বছর দশেক পর ....
শ্যামপদ তো তখন জ্যোতিকে দেখতেই পেলেন না। শ্যামপদ অর্থাৎ শ্যামাপদ মুখোপাধ্যায়। জ্যোতির্ময়ীর বাবা। অফিস থেকে রিটায়ার করার দিন বাড়ি ফিরেই হাঁক দিলেন - "মনু! অনু! এদিকে আয়!" মনু অর্থাৎ মনোতোষ আর অনু অর্থাৎ অনুতোষ। দুই যমজ ছেলে।
জ্যোতির্ময়ী দেখলো তার দাদারা বাবার হাঁক পেয়েই লাফাতে লাফাতে বাইরের ঘরে হাজির হোলো। ভিতর থেকে সে শুনতে পেলো তাদের হৈ হৈ - "দারুণ হয়েছে! দারুণ!" কৌতূহলে সেও চলে এলো ওই ঘরে। দেখলো দুই দাদার হাতেই ঝকঝকে নতুন দুটি হাত ঘড়ি। ততক্ষণে জ্যোতির্ময়ীর মা ও এসে গেছেন সেখানে। বাবা বলছেন - "কলেজে ঢুকেছে ওরা। এবার ওদের রিস্টওয়াচ তো লাগবেই। তাই ফেরার পথে কিনে আনলাম। আর আমি তো এসব ব্যাপারে খুব খুঁতখুঁতে। তাই কিনত গিয়ে পকেট ফাঁকা।" বলেই - "দাঁড়া! তোদের হাতে কিরকম মানায় পরিয়ে দেখি" - বলতে বলতে দুজনেরই হাতে পরিয়ে দিলেন ঘড়ি দুটি।
আর ঘড়ি হাতে পরানোর সাথে সাথেই তারা তক্ষুনি ওই ঘড়ি সমেত হাত মুঠো করে মাথার উপরে তুলে "ইয়া ইয়া" বলে হুল্লোড় করতে করতে চলে গেলো ভিতরের ঘরে। বাবাও তখন হো হো করে হাসতে থাকলেন তাদের দিকে তাকিয়ে। ওরা চলে গেলে জ্যোতির্ময়ী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলো তার বাবার দিকে।
সেই ঘটনার এতো বছর পর এই রাতের অন্ধকারে চোখের জল মুছতে মুছতে তার মনে হচ্ছিলো - "সেদিন তার বাবা শ্যামাপদ মুখোপাধ্যায় তাকে চোখের সামনে দেখতে পেয়েও...
কিন্তু জ্যোতির্ময়ীর ভবিতব্যে এই ধরনের আরো কয়েকটি ঘটনা রাখা ছিলো।
যেমন - সেই দিন ... সেই সকালে...জ্যোতির্ময়ীকে কি অদৃশ্য ভাবা হয় নি?
কারণ সেদিন স্নেহাশিস যেন জ্যোতির্ময়ীকে দেখতেই পেলো না। সেদিনটা ছিলো স্নেহাশিস অর্থাৎ জ্যোতির্ময়ীর নয়নের মণি একমাত্র সন্তান টুকুনের জন্মদিন। সেদিন দুপুর বেলায় স্নেহাশিসের টেবিলের সামনে জ্যোতির্ময়ী ছেলের খুব পছন্দের রসগোল্লার পায়েস এনে রাখলো।
ছেলের বৌ নীপা গেছে তার বাপের বাড়ি রিষড়ায়। একবছর হতে চলেছে ওদের বিয়ের। নীপা না থাকলেই ছেলেকে তার পছন্দের এটাসেটা রেঁধে খাওয়ানোর চেষ্টা করে জ্যোতির্ময়ী। কারণ নীপা খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে ভীষণ কড়া। তাই নীপার চোখের আড়ালে ছেলের টেবিলে হাজির রসগোল্লার পায়েস। জ্যোতির্ময়ী কাঁচের প্লেটে পায়েস নিয়ে হাসিমুখে এগিয়ে দিতে দিতে বললো - "আজ কোন দিন ভুলে গেলি?"
কোনো উত্তর না দিয়েই স্নেহাশিস খেতে শুরু করলো খুব আনমনে। জ্যোতির্ময়ী হাসিমুখেই দাঁড়িয়ে ছিলো। খেতে খেতেই হঠাৎ সামনের দিকে তাকিয়ে থমকে গেলো স্নেহাশিস। তারপর বলে উঠলো - "এরকম হয়ে গেলো কি করে?"
জ্যোতির্ময়ী অবাক হয়ে বললেন - "কেন রে? মিষ্টি কম হয়েছে নাকি? না নরম হয় নি ঠিক মতো?"
স্নেহাশিস কোনো উত্তর না দিয়ে হঠাৎ উঠে পড়লো চেয়ার থেকে। তারপর সামনের দেওয়ালে টাঙানো তার আর নীপার ল্যামিনেট করা বিরাট ছবিটা মুছতে লাগলো খুব মন দিয়ে। আর নিজের মনেই বলতে লাগলো - "এখানে এই কালচে দাগগুলো আসে কোত্থেকে?"
সেদিন তার একমাত্র সন্তান তাকে চোখের সামনে দেখতে পেয়েও....
তারপর - সেই দিন - সেই দুপুরে - জ্যোতির্ময়ীকে কি অদৃশ্য ভাবা হয় নি?
কারণ সেদিন ইন্দ্রাশিস জ্যোতির্ময়ীকে দেখতেই পেলো না। পা ভেঙে যাওয়ার পর থেকেই জ্যোতির্ময়ীর ঠাঁই এই উত্তরের ঘরটায়। ও ঘরেই ট্র্যাকশন আর ফিজিওথেরাপি। ওইঘরটা বাদ দিয়ে বাকি ঘরগুলো রং হচ্ছিলো। তাই তাঁর নাতি বিড্ডু অর্থাৎ ইন্দ্রাশিস আর তার বন্ধু তিতলি বসে গল্প করছিলো ওই ঘরেই। সামনের সোফাটায়।
হঠাৎ ঝেঁপে বৃষ্টি এলো। উত্তরের দিকের জানালাটা খোলাই ছিলো। হু হু করে বৃষ্টির ছাঁট আসতে শুরু করলো। ওরা উঠে জানলাটা বন্ধ করলো। আর তার পরেই -
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না জ্যোতির্ময়ী! ওরা দুজন কি নির্লজ্জ ভাবে নিজেদের জাপ্টাজাপ্টি করে যা যা কিছু করতে লাগলো তাতে জ্যোতির্ময়ীর চোখ বন্ধ করে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় রইলো না। আর চোখ বন্ধ রেখেই জ্যোতির্ময়ীর মনে হোলো - ছি ছি! কী লজ্জা!কী অপমান! আমি তো মরি নি এখনো!
সেদিন তার একমাত্র নাতি তাকে চোখের সামনে দেখতে পেয়েও....
কিন্তু এবার জ্যোতির্ময়ীকে দেখা গেলো। স্পষ্ট ভাবে। ওই ঘরেই। ওই বিছানাটিতেই। হাঁ করে পড়ে থাকতে। সামনের জানালার দিকে স্হির দৃষ্টিতে। নিস্পন্দ। নিথরভাবে।
প্রথমে দেখতে পেয়েছিলো বাড়ির বহুদিনের কাজের মাসি মোক্ষদা - "ও বৌদি! দেখে যাও! মামী কেমন থির হয়ে..." এরপর পুত্রবধূ নীপা ...তারপর পুত্র স্নেহাশিস ....তারপর একে একে আরো কয়েকজন ....এসে দেখলো জ্যোতির্ময়ীকে ...যারা বেশ কিছু কালের মধ্যে জ্যোতির্ময়ীকে চোখে দেখা তো দূরের কথা কোনো ভাবে কোনো খোঁজখবর নিয়েছে কিনা সন্দেহ। এরা সবাই দেখতে পেলো জ্যোতির্ময়ীকে .... প্রথমে বিছানায় শায়িত অবস্থায়...তারপর চন্দনের ফোঁটায়.... রজনীগন্ধার মালায়.... এবং সবশেষে আট বাই দশের চন্দনচর্চিত ফ্রেমে - ফুলের মালায় ঢাকা - ধূপের ধোঁয়ার পিছনে।
আর জ্যোতির্ময়ী - ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন ওই ফ্রেমের মধ্যে থেকে - তাই কিভাবে সর্বসমক্ষে বলবেন - "কেন? কেন তোমাদের চোখের সামনে আজকে আমায় এভাবে নিজেকে দেখাতে হচ্ছে?" তাই হয়তো ওখান থেকেই নীরবে প্রার্থনা করছেন তাঁর ইষ্টদেবতার উদ্দেশ্যে -- "দয়া করো! দয়া করো ঠাকুর! যাতে আমি এখুনি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারি এদের চোখের সামনে থেকে!"
কিন্তু তাই কি হয়? একটা জলজ্যান্ত ছবি কি হঠাৎ ভ্যানিস করে যেতে পারে সবার সামনে?
অতএব ফুলের মালা আরো পড়তে থাকলো। বাড়তে থাকলো ধূপের ধোঁয়া। সেইসব ফুল আর ধূপের পিছন থেকে সেই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েই রইলেন জ্যোতির্ময়ী।
এরপর কেটে গেছে বেশ কয়েকবছর। জ্যোতির্ময়ীর সেই আট বাই দশ ইঞ্চির ফ্রেমে বাঁধানো ছবি চলে গেছে বিরাট একটা শো কেসের মধ্যে। হঠাৎ একদিন স্নেহাশিস ওই শো কেসটা খুলে একটা জিনিষ খুঁজতে লাগলো। সেটা হোলো ওর স্কুলে প্রথম পাওয়া মেডেলটা। স্নেহাশিসের মনে ছিলো যে মেডেলটা সে আলাদা করে রেখে দিয়েছিলো একটা ছোটো পাথরের কৌটোয়। তারপর এর সঙ্গের মেরিট সার্টিফিকেট আর মেডেলটা একসাথে ঢুকিয়ে রেখেছিলো ওই শো কেসে। আস্তে আস্তে যত রাজ্যের হাবিজাবি জিনিসের আস্তানা হয়ে গিয়েছিলো ওই শো কেসটা। সেগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে শেষ পর্যন্ত বেরোলো সেই ছোট্ট পাথরের বাক্সটা। এবং তারমধ্যে কালচে হয়ে যাওয়া সেই ছোট্ট সোনার মেডেলখানা। স্নেহাশিস যেন হাতে স্বর্গ পেলো। বাক্সটার পিছনেই ছিলো সেই মেরিট সার্টিফিকেটটা। একটা নীলচে রঙের খামের মধ্যে। খাম থেকে সার্টিফিকেটটা বার করে খুব দেখতে ইচ্ছে হোলো স্নেহাশিসের।
আর খামটা হাতে নিতেই - হ্যাঁ খামটা হাতে নেওয়ার সাথে সাথেই দেখা গেলো খামের পিছনে চলে যাওয়া সেই আট বাই দশের ফোটো ফ্রেমটা।
এবং শুধুমাত্র ফোটোফ্রেমটাই। যার চারপাশে চন্দনের ফোঁটাগুলো শুকিয়ে কালচে হয়ে বসে গেছে । কারণ সমস্ত ছবিটাই পোকায় কেটে ফেলেছে নিখুঁত ভাবে। অবশ্যই স্টিলের ফ্রেম ও কাচকে অক্ষত রেখে।
স্নেহাশিস সেটিকে হাতে নিয়ে মুহূর্তের জন্য স্তম্ভিত হোলো।
এইভাবে, কিছু উইপোকা কিংবা পরমকরুণাময়ের জন্য এতদিনে জ্যোতির্ময়ী অদৃশ্য হতে পারলেন।